না কাবেল ফিরিঙ্গি কারপরদাজি
বাহাদুরপুর গ্রামটা খরিদ করল এক মহাজন। করিন্দারা তাকে সলা পরামর্শ দিল, কিষানের খাজনা দু’গুণ বাড়িয়ে দিলে হর সাল তার মুনাফা হবে একশো রুপিয়া। এই তাজ্জব কারবার কী করে সম্ভব হল সেটা এবার দেখুন। কালেক্টর হুজুরের দরবারে দাখিল করার জন্য কানুনগোকে দেওয়া হল জমাবন্দি। মুনাফা এত বেশি ধরা ছিল যে তার হিম্মত হল না সেটা তসদিক (tasdiq) করে। কানুনগো তাই হুজুরের কাছে কৈফিয়ত দাখিল করে জানাল, “বেশক জমার হার খুব বেড়ে গেছে। তবে নিলামদার কবুল করেছে আসামিরা এই বাড়তি খাজনা দিতে রাজি। কারণ সে এই বাড়তি খাজনা থেকে তাদের তালাও, ইঁদারা, ইত্যাদি বানিয়ে দেবে।” হুজুর সব শুনে হুকুম করলেন, “তুমি খোদ গিয়ে আসামিদের সঙ্গে মোলাকাত কর। তারপর জানতে চাও তারা সাচমুচ এই বাড়তি খাজনা দিতে রাজি তো? যদি বলে রাজি তা হলে জমাবন্দিতে তাদের দিয়ে দস্তখত করিয়ে আনবে।” এমন একটা ভাব করা হল যেন কাজটা হুজুরের হুকুম মাফিক হচ্ছে। এক মাস পার হলে কানুনগো তার কৈফিয়ত আর জবানবন্দি হুজুরের সামনে পেশ করল। কৈফিয়ত মোতাবেক পাটোয়ারি আর কিষানেরা কাগজে দস্তখত করে দিয়েছে। এবার সাহেব হুকুম করুন আর কী করতে হবে? হুজুর খোদ এবার জমাবন্দিতে দস্তখত করলেন। তাতে লাগানো হল মোহর। হুকুম হল এই দস্তাবেজ যেন বাকি রেকর্ডের সঙ্গে ফাইল করা হয়।
রায়তের কাছ থেকে কতটা হাসিল করা যাবে তার উপর ঠিক হয় কেমন ভাবে চলবে ধোঁকাবাজি। শুরুতে বকেয়ার জন্য কোনও মামলা রজু করা হয় না। নেওয়া হয় না জমির দখল। ইরাদা আসামি যেন জমাবন্দিতে ভরসা রাখে। পাশাপাশি এবার শুরু হয় নকল জমার খেল। হয়তো দুটো বছর পার হয়েছে। খেত ভরা ফসল, স্রেফ কাটার অপেক্ষা। আচমকাই কিষানদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় নোটিশ। মালগুজারি দুগুণা করা হল। কিষানরা ছুটল হাকিমের কাছে দরবার করতে। তাদের ফরিয়াদ নিলামদার ফসল কাটতে দিচ্ছে না। হুজুর পেশকারকে হুকুম দিলেন, দেখ কী করে রফা করা যায়। পেশকারকে কোনও মামুলি আদমি ঠাওরালে ভুল হবে। তাকে হুকুম করলেই যে জলদি রফা হয়ে যাবে এমনও নয়। এক হপ্তা পর তার মর্জি হলে সে হাজির হয় ছাউনিতে। নিলামদার তার খিদমতের আচ্ছা বন্দোবস্ত করে রেখেছিল। রায়তদের তাই ধাক্কা মেরে সেখান থেকে হটিয়ে দেওয়া হল। পেশকারও এখন নিলামদারের দোসর। সেও লেলিয়ে দিল তার পেয়াদাদের। আবার কিষানরা ছুটল হাকিমের কাছে। তাদের তখন একটাই জবান, দোহাই কালেক্টর সাহেব! দোহাই কোম্পানি বাহাদুর! হুজুর খোঁজ নিয়ে জানলেন পেশকার ফিরে আসেনি। তিনি আবার একটা কড়া সন্দেশ পাঠালেন, তুরন্ত তহকিকাত খতম কর। মামলার অন্ত হল পেশকারের কৈফিয়তে। সে হুজুরকে এত্তেলা করল, দু’বছরের হিসাব কিতাব খুব ভাল করে পরখ করা হয়েছে। তার মনে হয়েছে নিলামদার কোনও বেআইনি কিছু করেনি। তার দাবি কেবল পাওনাটুকুই। খাজনা না পেয়ে ক্রোক করা হয়েছে ফসল। সাহেব বাহাদুর এমনিতেই তাঁর কাম কাজ নিয়ে মশগুল থাকেন তাই কিষানদের বলা হল, তারা যেন কমিশনার ক্রোকের কাছে তাদের মালজমিন (malzaminee) পেশ করে আর সেই সঙ্গে রুজু করে একটা বেজা ক্রোকের (bejah koorkee) মামলা। কিষানরা তো গেল কাছারিতে। কিন্তু সেখানকার ঢিলেঢালা রকমসকম দেখে তারা বেদম হয়ে পড়ল। তাই আখেরে একটা রফা হল নিলামদারের সঙ্গে।
কিষান যতই তনদুরস্ত হোক না কেন জরুরত পড়লে দেখা যাবে সে কিছুতেই পঁচিশ-পঞ্চাশ রুপিয়ার বেশি জোগাড় করতে পারছে না। ফসল আটকে থাকলে মুশকিল আরও বেশি। কারণ ফসল থেকেই তার মেলে দুওয়াক্তের রোটি। কোনও কেয়ামত খাড়া হলে লাচারের স্রেফ দুটো রাস্তা, হয় বরবাদি না হলে জমিদারের সামনে শির ঝোঁকানো। তা সে হাকিমরা যতই নজরদারি আর ইনসাফের কথা বলুন না কেন।
আমি দেখাতে চেয়েছিলাম কেমন করে কানুনগো আর পাটোয়ারিরা তাদের মর্জি মাফিক কোনও গ্রামের দলিল দস্তাবেজ পাল্টে দিতে বা জালসাজি করতে পারে। অন্য কারও ইচ্ছেতেও তাই একই কাজ হতে পারে যদি দেখা যায় তাতে ফয়দা আছে। সাহেবান আলিসান যতই কৈফিয়ত চান বা তহকিকাত করান পুরো সচ কিছুতেই তারা খোলসা করবে না। শুধু জনাব ‘ও’ বা জনাব ‘এম’-র মতো হুজুর হলে অন্য কথা। তাঁরা খোদ চালাবেন তহকিকাত। দেখা যাবে দড়ির পাক খোলার মতো তখন হুড় হুড় করে বেরিয়ে আসছে সাচ্চাই। সেই রকম একটা কিস্সা আপনাদের শোনাই।
লালা লছমিলাল হল সরকারি উকিল। দিমাগ খাটিয়ে যে বহু জমি হাসিল করে। হাতেও জমে ছিল এন্তার কাঁচা টাকা। দেওয়ানি আদালতের হুকুম মোতাবেক জানা গেল গোহরার (Guhora) বাসিন্দা গুরবক্স সিং (Goorbuksh)-এর জমি নাকি খুব মামুলি রকমে বেচে দেওয়া হচ্ছে। তুরন্ত সেই জমি খরিদ করল লালা লছমিলাল। কানুনগো আর পাটোয়ারিকে সোনার চশমা পরিয়ে গুরবক্স সিং লাম্বেদারের গোহরার জমি সে যে নিলামে খরিদ করেছে এই কথাটা পাকাপাকি লিখিয়ে নিল কাগজপত্রে। কিন্তু লাম্বেদারের নাম জমাবন্দির খাতায় ওঠানো হয়েছিল কেবল আগের বছর। এবার তার জায়গায় ঢুকল লালার নাম। গ্রামের বাকিরাও এবার হুঁশিয়ার হয়ে উঠল। হাকিমকে আর্জি জানাল, তাদের নামগুলোও যাতে জমাবন্দিতে ঢোকানো হয়। কিন্তু বেঁকে বসল পাটোয়ারি আর কানুনগো। তাদের কথায়, বাকিদের নাম তো জমাবন্দিতে নেই, পাটোয়ারির দাখিলনামাতে বা মহতিমিম (mohtimim) বন্দোবস্তেও এদের কথা বলা হয়নি। কাগজপত্র খুঁটিয়ে পরখ করে দেখা গেল সেখানে আছে স্রেফ গুরবক্স সিং-এর নাম। বাকিদের আর্জি খারিজ করে দিয়ে সাহেব হুকুম দিলেন, লাছমি লালার নামই শুধু জমির মালিক বলে বহাল থাকবে। প্রায় ফতুর হতে বসা পাট্টাদারেরা (Putteedars) আইনি লড়াই লড়ে আখেরে জমির হক কায়েম করতে পেরেছিল। আপনারা সওয়াল করতেই পারেন, এতগুলো নাম তা হলে জমাবন্দির খাতা থেকে কেমন করে বাদ গেল? আমি দু’-চার কথায় সেটাই বলি।
দুই ভাই। জমির উপর তাদের বরাবর হক। দু’জনের আবার খুব মিলমিশ। তবে জমির মালিক হিসাবে নাম আছে বড় ভাইয়ের। এন্তেকাল হল ছোট ভাইয়ের যার আবার ছয় বেটা। এন্তেকাল-ই জায়দাদ মোতাবেক এদের সবার বাপের সম্পত্তির এক ভাগ করে পাওয়ার কথা। কিন্তু এতদিন তারা দেখেছে তাদের জমি জায়গার দেখভাল করে ব়ড় চাচা। তারাও চায় না চাচার কাজে দখল-আন্দাজি করতে। কিন্তু বরবাদ হওয়া কে ঠেকায়? ছোকরাদের বিয়ের বয়স হল। জরুরত পড়ল পয়সার। এবার হাজির মহাজন। লালার জুড়িদারেরা বলতে লাগল, কোনও চিন্তা নেই, লালা বহুত সমজদার আর আশরফ (usharf)। আলবাত সে তাদের চাচাকে উধার দিল। তারপর লালা খোদ গিয়ে আদালতে দায়ের করল মামলা। আদালত তো লালার খাসতালুক। মিলে গেল ডিক্রি। ছোকরাদের চাচাই ছিল সম্পত্তির ওয়ারিশ তার জায়গায় এবার ঢুকে গেল লালার নাম। কানুনগো আর পাটোয়ারির অজানা ছিল না কিছুই। তারা যদি নিজেদের কাজ বরাবর করত তা হলে তো কোনও মুশকিলই ছিল না। অনেক পাট্টাদারের জমি বেদখল হলেও আখেরে ইনসাফ মেলে। তবে মামলা চালিয়ে যেতে হয় দিনের পর দিন আর সেই সঙ্গে আর্জির পর আর্জি। তেমন হিম্মত আর দৌলত থাকলে তবেই কাজটা সম্ভব।
দশটার ভিতর ন’টা মামলাতেই দেওয়ানি আদালতের ডিক্রি মিললেও সুরাহা হয় কি? ডিক্রিধারী আদালতে আর্জি জানায় ‘এ’-র গোরু-ছাগল ক্রোক করা হোক! সঙ্গে সঙ্গে হাজির ‘বি’। সাবুদ দাখিল করে সেই হল আসল মালিক। এরা হচ্ছে সব ভাই-বেরাদার। নিজেদের ভিতর শুরু থেকেই সব ঠিক করা। ধরা যাক কোনও এক তরফ মামলা করল নবাব সাহেবের বাড়ি-ঘর-তালুক বিক্রি করা যাবে না। নবাব সাহেবের বেগম বলে কেউ তখন খাড়া হয়ে যাবে। ফরিয়াদ করবে ওই তালুক আসলে তার। নিকাহ-তে পাওয়া দহেজ। তার উকিলও পেশ করবে জমির দলিল দস্তাবেজ। আদালত থেকে পেয়ে যাবে জমির দখল। লেজিসলেটিভ কাউন্সিল আর সদর দেওয়ানি আদালত এমন কল বানিয়েছে যাতে ডিক্রি পাওয়া মানেই হয়রানির একশেষ। আইন-আদালত করে ডিক্রিধারীদের মেলে কেবল শামুকের খোল। এমন কোনও বন্দোবস্ত এখনও তৈরি হয়নি যাতে এই বজ্জাতি ঠেকানো যায়।