নারীর ভবিষ্যৎ
নারী কি বিপন্ন? নারী কি এমন কোনো প্ৰজাতি, যা ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে, বা ব্যাপক নিধনের ফলে পৌচেছে অবলুপ্তির প্রান্তে, যাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জনো? না, নারী এমন কোনো প্ৰজাতি নয়; নারী সংখ্যায় হ্রাস পাচ্ছে না, ব্যাপক সংহারেরও শিকার নয়, বরং গ্রহ জুড়ে বাড়ছে নারীর সংখ্যা। তবে প্রতি প্রজন্মের রক্ষণশীলেরাই আৰ্তনাদ করেছে; এখন আর খাঁটি নারী নেই, যারা ছিলো সুখ শান্তি কল্যাণ সতীত্ব পাতিব্ৰত্য প্রভৃতি বৰ্মণীয়তার আধার, তারা অবলুপ্ত হয়েছে। প্রতি প্রজন্মের প্রতিক্রিয়াশীলেরা তাদের চারপাশে প্রাচীন পুণ্যময়ী নারীর বদলে বিকশিত হ’তে দেখেছে দানবী, যারা নষ্ট করছে সংসার, পতিকে পদচ্যুত করছে দেবাসন থেকে, এবং সন্দেহজনক যাদের সতীত্ব। উনিশশতকের বাঙলায় প্রাচীনার অবলুপ্তিতে আর্তনাদ করেছে। পুরুষতন্ত্র; দিকে দিকে, সংসারবৃক্ষের ডালে ডালে, ঝুলতে দেখেছে ‘বিষময় ফল’। বিষাক্ত নারী ফুল ফুটিয়েছে ফল ধরিয়েছে বিষবৃক্ষের। পুরুষের চোখে চিরকালই নারী নয়, নারীত্ব বিপন্ন, তাই পুরুষ সব সময়ই চেষ্টা করেছে নারীকে আদিম অবস্থায় রেখে দিয়ে ‘নারীত্ব’ উপভোগ করতে। নারীর মৃত্যুতে তাদের দুঃখ নেই, তাদের উদ্বেগ নারীত্বের মৃত্যুতে। নারীর সামনে সময় থাকে, নারীর বয়স বাড়ে, সময়ের কামড় বোধ করে নারী; কিন্তু নারীর কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। পুরুষ এগোয় ভবিষ্যতের দিকে, নারী এগোয় বার্ধক্য ও ভবিষ্যৎইৗনতার দিকে; তাই বিশশতকের শেষ দশকে পৌঁছেও মনে হয় নারীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই, যদি নারী তা সৃষ্টি করতে না চায়। পুরুষের হাতে নারীর ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেয়ার অর্থ বিপন্নতা, পুরুষের হাতে পর্যুদস্ততা। প্ৰণতির অগ্ৰগতি ধারাবাহিক ব্যাপার নয়, প্রগতির পর প্রতিক্রিয়াশীলতা মাঝেমাঝেই দেখা দেয়: বিশশতকের শেষাংশে প্রতিক্রিয়াশীলতাই হয়ে উঠছে প্রবল, তাই তা নারীর জন্যে বড়ো আতঙ্কের কারণ। সব ধরনের প্রগতিশীলতা নারীর জন্যে শুভ, প্রতিক্রিয়াশীলতা অশুভ। পিতৃতন্ত্র যতো সংস্থা তৈরি করেছে, —পরিবার, বিয়ে, সমাজ, ধর্ম, বিদ্যালয় সবই মৰ্মমূলে প্রতিক্রিয়াশীল, এগুলোকে অনেক শতকেও প্রগতিশীল করা যায় নি; কেননা সমাজরাষ্ট্র যারা অধিকার ক’রে আছে, তাদের জন্যে প্রতিক্রিয়াশীলতাই আধিপত্য রক্ষার উপায়। কয়েক সহস্ৰক ধরে নারী ভবিষ্যৎইন, বিশশতকের শেষাংশেও নারী ভবিষ্য ৎইন। তার সামনে অনেক শতাব্দী, কিন্তু তার সামনে ভবিষ্যৎ নেই।
পৃথিবী জুড়ে আগের থেকে নারীর অবস্থা কিছুটা ভালো, অবশ্য খারাপও হয়েছে অনেক দেশে : ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ও কযেকটি মুসলমান রাষ্ট্রে দু-তিন দশক আগের থেকে অনেক শোচনীয় এখন নারীর অবস্থা। তবে অধিকাংশ দেশে আগের থেকে কিছুটা ভালো আছে নারী, কিন্তু বেশি ভালো নেই; এখন এমন সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন মহাদেশে যে শিগগিরই নারীর অবস্থা হবে খুবই খারাপ। নারী এখন কয়েকটি মুসলমান দেশ ছাড়া এক ঘর থেকে বেরোতে, ভোট দিতে, শিক্ষা লাভ করতে, কিছু পেশায় জড়িত হতে পারে, এবং কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করে। শোনা যায় পৃথিবীর খুব উন্নতি ঘটেছে, ঘাঁটি চলছে দ্রুত পরিবর্তন; কিন্তু ওই উন্নতি আর পরিবর্তন যতোটা কিংবদন্তি ততোটা বাস্তব নয়। গত আড়াই শো বছরের বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের ফলে পৃথিবীর ঘটেছে নানা বাহ্যিক পরিবর্তন; মানুষ চাঁদে গেছে, ঘরে বসে আজ সারা পৃথিবী দেখা যায়, টেস্টটিউবে উৎপাদিত হচ্ছে শিশু, কিন্তু নারীকে এখনোও রেখে দেয়া হয়েছে আদিম অবস্থায়ই। সংখ্যাধিক্যবশত পৃথিবী নারীদেরই গ্রহ, কিন্তু তারা রখনো এখানে পরবাসী, পুরুষের শোষণসামগ্ৰী। পুত্বপশ্চিমে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে, পুরুষতন্ত্রের কাছ থেকে কিছুটা সুবিধা আদায় ক’বে নিয়েছে কিছু নারী, কিন্তু অধিকাংশ নারীর অবস্থা শোচনীয়। গত দুশো বছরে গৃহপালিত পশুর অবস্থার যতোটা উন্নতি ঘটেছে নারীর অবস্থার ততোটা উন্নতি ঘটে নি। কিছু নারী এখন বিখ্যাত, কিছু নারী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তিধর, কিন্তু তা নারীর অবস্থার সূচক নয়; বিখ্যাত ও শক্তিধর নারীরাও পুরুষাধীন, পুরুষশোষিত; কেননা পৃথিবী পুরুষতান্ত্রিক।
নারীপুরুষের বিশুদ্ধ সাম্য কোথাও এখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নি; নারী তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার অধিকার পায় নি, যদিও তার অধিকার আন্দোলনের বয়স দুশো বছর। নারীর সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা ও বিধান তৈরি করছে এখনো পুরুষই, পুরুষই স্থির করছে কী মঙ্গলজনক নারীর জন্যে। শোষণমুক্তির জন্যে শোষিতরা এক সময় স্বপ্ন দেখেছে সমাজতন্ত্রের, কিন্তু সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক ব্যর্থতা মুক্তির স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনাও নষ্ট ক’রে দিয়েছে; এবং যারা মনে করছে সমাজসংগঠন সম্পূর্ণ বদলে দিতে না পারলে মুক্তি আসবে না। নারীর, তারা নারীমুক্তিকে সমর্পণ করছে অনিশ্চিত সময়ের হাতে। আসলে তারা চায় প্রথমে পুরুষের মুক্তি, পরে ভেবে দেখবে নারীর মুক্তি, সাম্য, অধিকার প্রভৃতির কথা। কবে সমাজসংগঠন সম্পূর্ণ বদলাবে, তার জন্যে যদি অপেক্ষা করতে হয় নারীকে, তাহলে হয়তো নারী সম্পূর্ণ ভুলে যাবে নিজের মুক্তির কথা। নারীমুক্তিকে সময়ের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না; সম্পূর্ণ সমাজসংগঠন বদলের অপেক্ষায়ও স্থগিত ক’রে রাখা যায় না। নারীর মুক্তি। আর সমাজসংগঠন বদলালেই যে মুক্তি পাবে নারী, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই; কেননা দেখা গেছে সামজতন্ত্রের মধ্যেও নারী পুরুষের সমান অধিকার পায় নি। তবে সব ধরনের সমাজতন্ত্রই নারীর জন্যে মঙ্গলজনক, যদিও তা-ই যথেষ্ট নয়; নারীমুক্তির জন্যে দরকার সমাজতন্ত্রাতিরিক্ত কিছু: এবং গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের মধ্যেও অর্জন করা সম্ভব অনেক অধিকার। নারীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। শুধু ধর্মতান্ত্রিক মৌলবাদের মধ্যে, মৌলবাদ নারীর চরম শত্র। আড়াই শতকের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো পৃথিবীর বাহ্যিক বদল ঘটিয়েছে, আভ্যন্তর বদল বিশেষ ঘটাতে পারে নি; মানব মন ও সমাজের আজো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে নি, মৌলিক বদল ঘটানো ওই আবিষ্কারগুলোর লক্ষ্যও নয়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর থেকে আজো মানুষের ওপর বেশি প্রভাবশালী পুরোনো পুরুষাধিপত্যবাদী সংহিতাগুলো, বিজ্ঞানকে ওগুলোকে প্রতিরোধ করার কাজেও ব্যবহার করা হয় নি; বরং বিজ্ঞানকে নতজানু ক’রে রাখা হয়েছে ওই সব পুরোনো কুসংস্কারের কাছে। তাই আধুনিক পৃথিবীও যথেষ্ট আধুনিক নয়; এর ভেতরে আদিমতারই প্রাধান্য। নারী ওই আদিমতারই শিকার। বিজ্ঞান পুরুষতন্ত্রের নিজস্ব জিনিশ, তাই ব্যবহৃত হচ্ছে পুরুষতন্ত্র ও বিশেষ একগোত্র পুরুষের স্বার্থে।
যে-সব ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে পুরুষাধিপত্য ও নারী-অধীনতা, সেগুলো হচ্ছে পরিবার, বিয়ে, শিক্ষা, পেশা, রাজনীতি, ও ধর্ম। পিতৃতান্ত্রিক সব সংঘ আর ব্যবস্থাই নারীর বিরুদ্ধে। এগুলো প্রথাগত সমাজব্যবস্থা স্থায়ী ক’রে রাখার প্রয়াসে লিপ্ত। পুরুষাধিপত্য টিকিয়ে রাখার ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠান পরিবার, বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র রাষ্ট্র কাজ ক’রে চলছে পরিবারের মধ্য দিয়ে, তাই পুরুষতন্ত্র খুবই ব্যাকুল পরিবারসংগঠন অপরিবর্তিত রাখার জন্যে। পরিবারে আজো প্রধান পুরুষ; সমাজ তাকে এ-প্রাধান্য দিয়েছে, এবং এমন ব্যবস্থা করেছে, যাতে রক্ষা পায় তার প্রাধান্য। পুরুষকে দিয়েছে আর্থনীতিক অধিকার; আজো পুরুষই সাধারণত আয় ও সংসার ভরণপোষণ করে, তাই পুরুষই আধিপত্য করে সংসারে। নারী পরিশ্রম করে পুরুষের থেকে অনেক বেশি, তার শ্রম পুরুষের শ্রমের থেকে অনেক বেশি ক্লান্তিকর, কিন্তু তা নিরর্থক। দরিদ্র নারীদেব শ্রমের শেষ নেই, সংসার সচল রাখার পেছনে তাদের শক্তি তারা পুরোপুরি নিয়োগ করে; কিন্তু তাদের সাংসারিক শ্রমের কোনো মূল্য নেই। পৃথিবী জুড়ে এখন প্রধান শ্রমিক শ্রেণী নারী, তারা উৎপাদন করে দেশের অধিকাংশ সম্পদ, কিন্তু তাদের পারিশ্রমিক নূ্যনতম। বাঙলাদেশে এবার বৈদেশিক আয়ের প্রায় সবটাই উপার্জন করেছে নারীরা, বস্ত্ৰবালিকারা; কিন্তু তারা তার ভাগ পায় নি, পরিবারেও তাদের স্থান গৌণ, সমাজে তারা অসম্মানিত ৷ যে-বস্ত্ৰবালিকার আয়ে সংসার চলে, তার স্বামী বা পিতা হয়তো কোনো আয়ই করে না, কিন্তু সেই প্রাধান্য করে পরিবারে ও সমাজে। শিক্ষিত নারীদের বেলা একই ঘটনা ঘটে, তারা তাদের যোগ্যতাব থেকে আয় করে অনেক কম। তাদের, দরিদ্র নারীদের থেকেও, অনেক বেশি নির্ভর করতে হয় স্বামীর আয়ের ওপর; এক নিজের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হ’লে অধিকাংশ শিক্ষিত নারীই বস্তিজীবন কাটাতে বাধ্য হতো। শিক্ষা আজো নারীকে আর্থনীতিক স্বনির্ভরতা দেয় নি; কাজে আসে নি নারীমুক্তিতে।
এক শ্রেণীর শিক্ষিত নারীই সহযোগিতা ক’রে চলছে। পুরুষাধিপত্য ও নারী-অধীনতা রক্ষায়; ওই নারীরা পরগাছা, তারা আজো সুখ পায় সুখকর ক্রীতদাসীত্বে। নারীর প্রধান শত্ৰু শিক্ষিত গৃহিণীরা, যারা শিক্ষিত কিন্তু শুধুই গৃহিণী। ওই নারীরা শুধুই মাংস, তারা পুরুয্যের প্রমোদসঙ্গিনী, স্বামীর প্রমোদবালা; তারা বেছে নিয়েছে অধীনতা। তারা অনেক বেশি অসহায় শ্রমিক নারীর থেকেও, শ্রমিক নারী যে-স্বাধীনতা ভোগ করে তারা তাও ভোগ করে না, এবং স্বামী তাদের ছেড়ে দিলে পথনারী হওয়া ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা তাদের থাকে না। তারা এটা জানে, তাই নিজেদের স্বার্থে সেবা ক’রে চলে পুরুষতন্ত্রের; তাবা সুবিধার বিনিময়ে বাতিল ক’রে দেয় নিজেদের সত্তা ও স্বাধীনতা। শুধু নিজেদের নয়, তারা শত্ৰুতা৷ ক’রে চলে স্বাধীন নারীর সাথে, নিজের স্বাধীনতা হারানোর পর অন্যের স্বাধীনতা নষ্ট করা হয় তাদের কাজ। শিক্ষিত ধনী গৃহিণীরা যে-সচ্ছলতার মধ্যে থাকে শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরা সাধারণত ততোটা সচ্ছলতায় থাকে না; তারা বিচিত্র বিলাসের মধ্যে থেকে উপহাস করে চলে কর্মজীবী শিক্ষিত নারীদের। তাদের কৃতিত্ব তারা ধনী স্বামী ধরতে পেরেছে। একটি শিক্ষিত নারী যখন দেখে সে কাজ করে, কিন্তু ওই বিলাস নেই তার জীবনে, তখন তার মনে এমন বোধ জন্ম নেয়া স্বাভাবিক যে শিক্ষিত না হয়ে বা পেশা গ্ৰহণ না করে একটি ধনী স্বামী ধরাই ছিলো অনেক ভালো। এ-বোধটা আরো প্রবল হয়ে উঠতে পারে। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে;–কোনো বালিকা যখন দেখে তার মায়ের মতো পেশা গ্ৰহণ করে কষ্ট করার চেয়ে পাশের বাড়ির মহিলাটির মতো একটা ধনী স্বামী ধরলে জীবন অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে, তখন সে স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছে ছেড়ে দিতে পারে। এমন ঘটছে এখন বাঙলাদেশে। পরগাছারা এখন এতো আকর্ষণীয় যে অনেক বালিকাই নিজের শেকড় গভীরে ছড়ানোর অভিলাষ ছেড়ে দিয়ে সোনালি পরগাছা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। পরগাছারা ওই বিলাস কেনে নিজেদের সত্তার বিনিময়ে, তারা সুস্বাদু মাংসের থেকে বেশি মূল্য পায় না।
বিয়ে ও সংসার আজো নারীর জন্যে প্রধান পেশা হয়ে আছে, প্রতিক্রিয়াশীলতা যেভাবে প্রবল হচ্ছে তাতে অচিরেই তা আবার একমাত্র পেশা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। সমাজ নারীকে আজো হ’তে বলে সুগৃহিণী ও সুমাতা, তার কাছে দাবি করে সতীত্ব ও পাতিব্ৰত্য! সমাজ পুরুষকে দেয় বাস্তব শর্ত, অর্থাৎ পুরুষের কাজ সংসার চালানো: নারীকে দেয় নৈতিক শর্ত, তাকে হতে হবে সুমাতা, সুগৃহিণী, সতী। নারীর সুমাতা, সুগৃহিণীত্বকে ঐশী ভাবাদর্শে পরিণত করা হয়েছে নারীকে পুরুষাধীন রাখার জন্যে। মা হওয়ার অর্থ গর্ভধারণ, তবে সুমাতার অর্থ নারী গর্ভধারণ করবে: সমাজসম্মতভাবে, সমাজের জন্যে, নিজের জন্যে নয়; শঙ্ধারণ করবে নারী বিবাহিত হয়ে, বিবাহিত না হয়ে নারী সন্তান চাইতে পারবে না। এর অর্থ তার শরীর, তার জরায়ু তার নয়, তার মালিক পুরুষ ও পিতৃতন্ত্র। পুরুষ এসব বিধি প্রচার করেছে বিধাতার নামে, তবে এসব হচ্ছে বিশেষ এক ধরনের সমাজ সংরক্ষণের বিধিনিষেধ। নারীর গৰ্ভধারণ একান্ত পাশবিক কাজ! নারীকে কি চিরকালই ধারণ ক’রে যেতে হবে গর্ভ, পালন ক’রে যেতে হবে পশুর ভূমিকা? গৰ্ভবতী নারী দেখতে অনেকটা গর্ভবতী পশুরই মতো, দৃশ্য হিশেবে গর্ভবতী নারী শোভন নয়, আর গর্ভধারণ নারীর জন্যে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। এক দিন হয়তো গৰ্ভধারণ গণ্য হবে আদিম ব্যাপার ব’লে, মানুষ বেছে নেবে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প উপায়; তখন গর্ভধারণই নারীত্ব বলে মনে হবে না। নারী গর্ভধারণে আনন্দ পায় না। পুরুষতন্ত্রের শিক্ষার ফলে নারী আজো মনে করে গর্ভধারণেই তার জীবনের সার্থকতা, কিন্তু এটা তা নয়। অধিকাংশ নারী এখনই গৰ্ভধারণপ্রক্রিয়া থেকে রক্ষা থেলে আনন্দে তা গ্ৰহণ করবে; গর্ভবতী হওয়ার মধ্যে জীবনের কোনো সার্থকতা, মহত্ত্ব, পুণ্য নেই। এক সময় নিয়ত গর্ভিণী থাকাই ছিলো নারীর কাজ, এখন গর্ভের সংখ্যা কমেছে, তাতে ক্ষতি হয় নি, বরং সমাজরাষ্ট্র এই চায়। আমূল নারীবাদীরা মনে করেন মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়, পুরুষকে উদ্ভাবন করতে হবে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প পথ; এবং কয়েক শো বছর পর গৰ্ভধারণ যে আদিম পাশবিক কাজ ব’লে গণ্য হবে তাতে সন্দেহ নেই।
সুমাতার ভুল ধারণাও আজো প্রবল সমাজে। উনিশশতকে মনে করা হতো যে সুমাতার কাজ মহাপুরুষ জন্ম দেয়া ও লালনপালন করা। পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষেরা’ নারীর কাছে বারবাব সুমাতা দাবি করেছে, সমাজকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে নারী যদি তাদের সুমাতা দেয়, তবে তারা দেশকে উন্নতির চুড়োয় পৌঁছে দেবে। এর অর্থ নারী নষ্ট হযে গেছে, তার জবায়ুর অপরাধেই মহাপুরুষেরা সম্পন্ন করতে পারছে না দেশের উন্নতি; অর্থাৎ যে-অপরাধ তাদের, তারা তা চাপিয়ে দিয়েছে নারীর ওপর। উনিশ শতক নারীর কাছে দাবি করে দলে দলে নেপোলিয়ন, জর্জ ওয়াশিংটন বিয়োনো; কিন্তু কারো পক্ষে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ওয়াশিংটন বা আইনস্টাইন বা রবীন্দ্রনাথ বা একটি একনায়ক জন্ম দেয়া সম্ভব নয়। আর যে-মায়ের এ-ধরনের মহাপুরুষ জন্ম দিয়েছেন, তারা যে সুমাতা ছিলেন, তাও নয়। রবীন্দ্রনাথের মা তো রবীন্দ্রনাথকে লালনপালনই করেন নি, ওই মহাকবি পালিত হয়েছেন ভৃত্যদের দ্বারা। এটা প্রমাণ করে যে মহাপুরুষ লালনের জন্যে কোনো সুমাতা’ দরকার করে না; এবং কোনো মায়ের পক্ষে লালনপালন ক’রে মহাপুরুষ তৈরি করা সম্ভব নয়। লালনপালনের ওপর মানুষের বিকাশ খুব নির্ভর করে না। সুমাতা বলতে সমাজ বোঝায় এমন মা, যে এমনভাবে চালাবে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া, যার ফলে তার সন্তানরা মেনে নেবে সমাজের সমস্ত বিধিনিষেধ, এবং রোধ করবে সমাজের বিবর্তন। সুমাতার সন্তানরা পৃথিবীকে বদলায় না, তারা পৃথিবীকে অচল ক’রে রাখে। শিশু অবশ্যই মায়ের এবং পিতার কাছে থেকে স্নেহপ্ৰীতি ও অনেক কিছু পাবে, এটা তাদের অধিকার; কিন্তু প্রথাগত সুমাতা দরকার শুধু প্রথাগত সমাজ রক্ষার জন্যে।
প্রথাগত সমাজের আরেক রোগের নাম সুগৃহিণী। সুগৃহিণী হচ্ছে সে-নারী, যার জীবন নানা নিরর্থক কাজে ভারাক্রান্ত: যে একই কাজ বারবার করে, যার কাজ কখনো শেষ হয় না, যার জীবন হচ্ছে একই দিনের আমৃত্যু একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি। এক সময় গৃহিণীর ওপর চাপিয়ে দেয়া হতো সংসারের সমস্ত কাজ, এখন দরিদ্র নারীদের ওপরও ততোটা কাজের ভার নেই। সুগৃহিণীর সারাটি জীবনই অপব্যয়, এবং এক সময় তা হয়ে ওঠে। ক্লান্তিকর, নিঃসঙ্গ, নিজীব। এক বালিকার যদি বিয়ে হয় আঠারো বছর বয়সে, বাইশ বছর বয়সের মধ্যে সে যদি দুটি সন্তান প্রসব ক’রে মুক্তি নেয়। গৰ্ভধারণ থেকে, তাহলে চৌত্ৰিশ বছর বয়সে সে দেখবে তার সন্তান দুটি নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, স্বামী ব্যস্ত উন্নতি ও অন্য নারী নিয়ে, শুধু তারই হাতে কোনো কাজে নেই। সে যদি আরো ত্ৰিশ বছর বাঁচে, তাহলে ওই ত্ৰিশ বছর তাকে কাটাতে হবে অসীম ক্লান্তির মধ্যে। তখন তার পক্ষে অসম্ভব মানসিক রোগগ্ৰস্ত না হওয়া। তার জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই, তার কোনো সত্তা নেই। এমনকি তার যৌন জীবনও তখন বিপন্ন। নারীকে ছেড়ে দিতে হবে গৃহিণীর ভাবমূর্তি যদি সে জীবনকে ক’বে তুলতে চায় তাৎপর্যপূর্ণ। এর মানে এ নয় যে সে স্বামীকে তালাক ও সন্তানদের ছেড়ে দিয়ে একলা জীবন শুরু করবে। এ-মুহূর্তেই জরুরি হচ্ছে নারীকে একটি পেশা নিতেই হবে, আর সে-পেশাটি কিছুতেই সংসার হবে না।
দরিদ্র দেশগুলো যেমন দরিদ্র, তেমনই প্রথাগত্ব। অধিকাংশ দেশে নারীর পেশা গ্রহণের সুযোগ নেই। বাঙলাদেশ এমন এক দেশ। শিক্ষিত নারীদেরই এখানে পেশা গ্রহণের সুযোগ কম, দরিদ্র নারীদের সুযোগ আরো অনেক কম; তবু এখানে দরিদ্র নারীরাই জীবিকার জন্যে পেশা গ্রহণ করে বেশি। তা গৃহপরিচারিকার পেশা হ’তে পারে, হতে পারে ছাইআলির পেশা, বা ইটভাঙানির, বা বস্ত্ৰবালিকার পেশা। কোনো পেশাই নারীর জন্যে অস্বাভাবিক নয;–পুরুষ যে-সব পেশা দখল ক’রে আছে, তার প্রতিটির জন্যেই নারী উপযুক্ত; এমনকি শারীরিক শ্রমের পেশায়ও। নারীর শারীরিক অশক্তি অনেকটা পুরুষতন্ত্রেরই সৃষ্টি: পুরুষ তার কাছে চেয়েছে অশক্তি, তাই নারী অশক্ত দুর্বল হওয়াকেই নিজের গুণ ব’লে মনে করেছে। নারীর পক্ষে হাল চাষ, মাছ ধরা, নীেকো বাওয়া কঠিন কাজ নয়; তবে নারী সাধারণত এসব করে না, কেননা সমাজ নারীকে তা করতে দেয় না! এক সময় নারীর জন্যে সমস্ত পেশাই নিষিদ্ধ ছিলো, আজ নিষিদ্ধ অধিকাংশ পেশা, যার ফলে রক্ষা পাচ্ছে পুরুষের প্রাধান্য। বাঙলায় নারীশিক্ষা এগিয়েছে অজস্র প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, কিন্তু পুরুষতন্ত্র তা ব্যৰ্থ ক’রে দিতে কোনো আয়োজন বাকি রাখে নি। নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে বড়ো চক্রান্ত নারীর শিক্ষা নিষিদ্ধ করা নয়, সবচেয়ে বড়ো চক্রান্ত হচ্ছে শিক্ষিত নারীকে নিষ্ক্রিয় ক’রে দিযে তাকে নিজের, পরিবার, ও সমাজের কাছে বোঝা ক’রে তোলা } এটা করা হয়েছে শিক্ষা ও পেশার থেকে বিয়েকে নারীর জন্যে প্রধান ক’রে রেখে। শিক্ষা যদি নারীকে আর্থনীতিকভাবে স্বাবলম্বী করে, তখন বিয়ে হয়ে ওঠে। ঐচ্ছিক ব্যাপার; নারী তার শারীরিক বা মানসিক প্রয়োজনে বিয়ে করতে পারে, না : করতে পারে। করা না-করা তার নিজের পছন্দ; কিন্তু শিক্ষিত নারীকেও পুরুষের ওপর আর্থনীতিকভাবে নির্ভরশীল ক’রে ব্যৰ্থ ক’রে দেয়া হয়েছে শিক্ষাকে; সফল ক’রে রাখা হয়েছে বিয়ে ও সংসারকে।
নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে এখন চলছে সুগভীর সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। বাঙালি মুসলমান সমাজে কয়েক দশকের নারীশিক্ষা নারীকে পরিণত করেছে। পুরুষের শিক্ষিত প্রমোদসহচরী, শিক্ষিত পরিচারিকায়, অর্থাৎ নারীশিক্ষা উপকারে এসেছে পুরুষের, নারীর নয়। এক সময় নারীশিক্ষার যে-যৌনাবেদন ছিলো, বর্তমানের প্রতিক্রিয়াশীলতার পর্বে নারীশিক্ষা সে-আবেদনও হারিয়ে ফেলছে; শিক্ষিত স্ত্রী আর তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে না। শিক্ষিত তরুণেরা এখন আকর্ষণ বোধ করছে অল্পশিক্ষিত কচি কিশোরীদের প্রতি, প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষিত নারীর সাথে বসবাসের প্রাপ্তবয়স্কতা হারিয়ে ফেলছে তরুণেরা। এর ফলে নারীর প্রথাগত পেশাটি নষ্ট হচ্ছে, তার সংসারের সম্ভাবনা কমছে; আবার সে যে আর্থনীতিকভাবে স্বাধীন জীবন যাপন করবে, তার সুযোগও নেই। রাষ্ট্র পুরুষদেরই কোনো পেশা দিতে পারছে না, নারীকে কোনো পেশা দেয়ার কথা তার জন্যে দুঃস্বপ্ন। এর ফলে নারীর উচ্চশিক্ষা শুধু ব্যর্থই হচ্ছে না, তা পরিহাস ও পরিহারের বিষয় হয়ে উঠছে। প্ৰবেশিকা পাশের আগে থেকেই মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়ছে পিতামাতা, এমনকি প্রগতিশীলেরাও নিজেদের কন্যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার আগেই বিয়ে দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করছেন। উচ্চশিক্ষিত নারীরা হয়ে উঠছেন সমাজের কৌতুক, করুণা, ও নিজের জন্যে বোঝা। এভাবেই চলছে নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রিক-সামাজিক চক্রান্ত।
পিতৃতান্ত্রিক সতীত্বের ধারণা রখনো প্রবলভাবে রক্ষা ক’রে চলছে তার মধ্যযুগীয় চরিত্র। সব পিতৃতন্ত্রেই সতীত্ব নারীর জন্যে প্রথম বিধান, সতীত্বই নারীত্ব; কিন্তু পুরুষের জন্যে সততা বা কমনিষ্ঠা গৌণ ব্যাপার। পৃথিবী জুড়েই পুরুষের বিবাহপূর্ব ও
সাফল্যমণ্ডিত; খুব কম পুরুষই পাওয়া যাবে, যাদের বিবাহপূর্ব কামের অভিজ্ঞতা নেই, এবং বিবাহবহির্ভূত কামের সুযোগ নেয় নি। কিন্তু পৃথিবী জুড়ে, বিশেষ ক’রে প্রথাগত সমাজগুলোতে, নারীর বিবাহপূর্ব পুরুষসংসৰ্গ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, এবং বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বিপজ্জনক। তাই নারীর কামতৃপ্তির একমাত্র পথ বিয়ে, যদিও বিয়েও পুরুষেরই কামতৃপ্তির জন্যে আয়োজিত হয়; নারীর তৃপ্তি ওপরিপাওনামাত্র, না পেলেও তা উদ্বেগের কারণ নয়। নারী বহু শতাব্দী ধ’রে প্রথাগত সতীর ভাবমূর্তি বহন ক’রে ক্লান্ত, প্রথাগত সতীর ধারণা তাকে মুক্ত হ’তে দিচ্ছে না, প্রথাগত সতীর ভাবমূর্তি নারীর জন্যে ক্ষতিকর। প্রথাগত সতী পুরুষের এমন দাসী, যার শরীরটিও তার নিজের নয়; একটি পুরুষের। প্রথাগত সতীর ধারণা চূড়ান্তে নিয়ে গিয়েছিলো হিন্দুরা, যারা নারীর দেহকে জন্মজন্মান্তর ধ’রে একটি পুরুষের সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলো, যার সতীত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্যে ব্যবস্থা করেছিলো সতীদাহের। পশ্চিমে এখন প্রথাগত সতী নেই, কেউ চায়ও না; কিন্তু উগ্ৰ পিতৃতন্ত্রগুলোতে সতীত্ব আজো ঐশী ব্যাপার। এ-পিতৃতন্ত্রগুলো দ্বৈত মান বজায় রাখার জন্যে ব্যস্ত; পুরুষের জন্যে এক নৈতিকতা, নারীর জন্যে আরেক নৈতিকতা এগুলোর আদর্শ। এ-অনৈতিক নৈতিকতার কবল থেকে নারী বাচতে পারে শুধু আর্থনীতিকভাবে স্বাধীন হয়ে। সব অঞ্চলের নারীই, পুরুষের মতোই, নিজের শরীর উপভোগ পছন্দ করে; নারী জৈবিকভাবে একপুরুষতৃপ্ত নয়, যদিও পুরুষতন্ত্র এটা ভাবতে পছন্দ করে। একটি মাত্র পুরুষের সংসৰ্গকে নারী তার জীবনের ধ্রুব লক্ষ্য মনে করে না; পুরুষের মতো নারীও বহু শরীরের সংসর্গ কামনা করে। বদ্ধ সমাজের নারী যখন মুক্ত সমাজে যায়, তার তখনকার যৌন আচরণ বুঝিয়ে দেয় যে সতীত্ব তার কাছে মূল্যবান নয়; শুধু সমাজের পীড়নেই সে সতীর ভূমিকায় অভিনয় করে। সতীত্ব অনেকটা অভিনয়। প্রথাগত সমাজগুলো নারীকে সতী ক’রে রেখেছে দুটি প্রক্রিয়ায়; দারিদ্র্য ও কঠিন বিধিনিষেধে। যেমন, বাঙলাদেশে নারী বাধ্যতামূলকভাবে সতীর ভূমিকায় অভিনয় করছে দারিদ্র্যবশত, এটি সচ্ছল সমাজ হ’লে অনেক আগেই ভেঙে পড়তো ওই দেয়ালটি; আব্ব সৌদি আরবে নারী সতীর ভূমিকায় অভিনয় করছে হিংস্ৰ বিধানের ফলে। সমাজ যদি কামসততা চায়, তবে চাইতে হবে নারীপুরুষ উভয়েরই জন্যে; শুধু নারীর জন্যে সতীত্বের বিধান হচ্ছে নারীপীড়ন।
মানুষের প্রধান শত্রু এখন মৌলবাদ, নারীরও প্রধান শক্ৰ এখন মৌলবাদ: তবে নারীর জন্যে মৌলবাদ অনেক বেশি মারাত্মক। সব ধরনের মৌলবাদেরই লক্ষ্য নারীকে আবার অবরোধে ঢুকিয়ে পুরুষের ভোগ্যবস্তু ও দাসী ক’রে তোলা। মৌলবাদীর কাছে নারীপুরুষের এলাকা ও ভূমিকা সম্পূর্ণ বিপরীত; মৌলবাদী বিশ্বাস করে না মুক্তি ও সাম্যে। নারী থাকবে গৃহে, অবরোধের মধ্যে, পালন করবে। ভোগ্যবস্তু ও গর্ভধারিণীর ভূমিকা, এ-ই মৌলবাদীর স্থির সিদ্ধান্ত। শিক্ষা নারীকে মুক্তি দেয় এ-ভূমিকা ও অবস্থান থেকে, যা মৌলবাদীর কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর; তাই মৌলবাদী প্রচণ্ড প্রতিপক্ষ নারীর শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, ও মুক্তির। মুসলমান দেশগুলোতে মৌলবাদীরা এখন শরিয়া আইন প্রবর্তনের জন্যে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, কারণ ওই আইনের সাহায্যেই তারা নারীকে চূড়ান্তরূপে পযুঁদিস্ত করতে পারবে। নারীকে আবার অন্ধ বোরখা পরানো হচ্ছে, বোরখায় জানোলা লাগানো হচ্ছে, সামান্য বিচূতির জন্যে নারীকে দেয়া হচ্ছে লোমহর্ষক শাস্তি: কিন্তু শাস্তির বাইরে থেকে যাচ্ছে পুরুষ। ইসলামে জিনা অবৈধ সঙ্গম নারীর জন্যে মারাত্মক অপরাধ। নারী এক জিনা করতে পারে না, কিন্তু এ-অপরাধের জন্যে দণ্ডিত হয় শুধু নারী। পুরুষটি সাধারণত মুক্তি পেয়ে যায়, কারণ সে নিজের শরীরে জিনার কোনো চিহ্ন রাখে না; কিন্তু নারীটি পায় কঠোর দণ্ড, কারণ নারী জিনার প্রমাণ অনেক সময় অবৈধ সন্তানরূপে ধারণ করে গর্ভে। পাকিস্তানে সাফিয়া বিবির ঘটনা মৌলবাদী পুরুষতন্ত্রের অন্ধ নির্বিবেক নারীপীড়নের এক ভয়ঙ্কর উদাহরণ। সাফিয়া, আঠারো বছরের অন্ধ চাষীকন্যা, দাসীর কাজ করছিলো জমিদার বাড়িতে। তাকে প্রথম ধর্ষণ করে জমিদারপুত্র, তারপর জমিদার নিজেই। সফিয়া এর ফলে জন্ম দেয় এক অবৈধ সন্তান। সাফিয়ার বাবা তাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনে, কিন্তু শরিয়া আইনের বিধি অনুসারে পুরুষ দুটি মুক্তি পায়, ধরা পড়ে নারীটি তার গর্ভই প্রমাণ করে সে অপরাধী, সে ইসলামি আইন অমান্য করেছে। শরিয়া বিচারক ওই অন্ধ ধৰ্ষিত নারীটিকে ব্যভিচারের অপরাধে দণ্ডিত করে প্রকাশ্যে ১৫টি বেত্ৰাঘাত, ৩ বছর কারাদণ্ড, ও ১০০০ টাকা জরিমানায় মমতাজ ও শহীদ (১৯৮৯, ৫১-৫২)। এ হচ্ছে মৌলবাদীর শরিয়াপ্রয়োগ। ইরানে নারী এখন নৃশংস পুরুষতন্ত্রের শিকার; এক সময়ের মুক্ত ইরানি নারী এখন বোরখার ভেতরে ঢুকে প্রশংসা করতে পারে শুধু আল্লা, মেহেদি ও আয়াতুল্লার।
ইসলামে নারী ফিৎনা বা বিশৃঙ্খলা, যে তার কাম দিয়ে বিপর্যস্ত করে সমাজ, তাই তাকে অবরুদ্ধ ক’রে রাখতে হবে অবরোধে। ফাতিমা মেরনিসসির (১৯৭৫, ৩৪) মতে নারীপুরুষ সম্পর্ক ইসলামি সমাজে রয়েছে দুটি তত্ত্ব, একটি স্পষ্ট, আরেকটি অন্তর্নিহিত : স্পষ্ট তত্ত্বটি হচ্ছে পুরুষ সক্রিয়, আক্রমণাত্মক; নারী অক্রিয়, মর্ষকামী; অন্তর্নিহিত তত্ত্বটি হচ্ছে নারীর কাম অসীম। অন্তর্নিহিত তত্ত্বটির চূড়ান্ত রূপ মেলে। গাজ্জালির ইহয়া উলুম আল-দিন বা ধর্মতত্ত্বের পুনরুজ্জীবন-এ। তাঁর মতে সভ্যতা নিরন্তর সংগ্ৰাম ক’রে চলছে নারীর সর্বগ্রাসী সর্বনাশী শক্তির সাথে তাই পুরুষ যাতে অবিচলিতভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেজন্যে দরকার নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা। সমাজ টিকে থাকতে পারে এমন সব সংস্থা তৈরি করে, যেগুলোর কাজ নারীকে অবরুদ্ধ ও পুরুষের বহুবিবাহের ব্যবস্থা ক’রে পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। নারীপুরুষ সম্পর্কে ইসলামি স্পষ্ট তত্ত্বটি হচ্ছে পুরুষ নারীর থেকে শ্রেষ্ঠ; পুরুষের প্রবণতা জয়লাভ ও আধিপত্য করা; নারীর প্রবণতা পরাভূত, অধীনস্থ হওয়া। ইসলামি মৌলবাদীর মধ্যে এ-দুটি বিশ্বাসই কাজ করে; সে নারীকে যেমন ভয় পায়, নারীর মুখোমুখি। যেমন অসহায় বোধ করে, তেমনই তাকে অবরুদ্ধ, পর্যুদস্ত ক’রে রাখতে চায়। শুধু ইসলামি মৌলবাদী নয়, সব মৌলবাদীর স্বপ্নই এক : নারীকে পর্যুদস্ত করা। হিন্দু মৌলবাদী নারীকে মনুসংহিতানুসারে আবদ্ধ ও দগ্ধ করতে চায়; খ্রিস্টান মৌলবাদী নারীর ওপর চাপাতে চায় মানুষের সমস্ত পাপের ভার।
বাঙলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীলতার যে-বিস্তার ঘটছে, তা প্রগতির জন্যে উদ্বেগজনক, এবং নারীর জন্যে বিশেষভাবেই ভীতিকর। চারপাশে এখন কালো বোরাখার ভৌতিক প্রচ্ছায়া দেখা যাচ্ছে, নারীদের এখন বেরোতে হয় আগের থেকে অনেক সাবধানে, নারী এখন আগের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে নিজের শরীর ঢেকে রাখতে বাধ্য হয়; এবং সবচেয়ে শোচনীয় হচ্ছে অনেক নারীও দীক্ষিত হচ্ছে মৌলবাদে। শ্বশুরবাড়ি হচ্ছে তরুণীদের জন্যে কারাগার, প্রতিক্রিয়াশীলতায় দীক্ষার মন্দির, যেখানে তাদের বাধ্য করা হয়। পুরুষাধিপত্য ও মধ্যযুগীয়তা মেনে নিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বোরখা প’রে যে-ছাত্রীরা আসে, তারা বিবাহিত বা জামাতের সদস্য;–এ-দুটির একটি, বা দুটিই; বোরখাপরা বিবাহিত ছাত্রীরা কেউ বিয়ের আগে বোরখা পরতো না, বিয়েই তাদের তুলে দেয় মধ্যযুগের হাতে। এতে তারা সবাই খুবই পীড়িত বোধ করে, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্যে তারা বাধ্য হয় মধ্যয়ুগকে মেনে নিতে। কিছু কিছু মেয়ের জন্যে এটা এতো পীড়াদায়ক যে তারা আক্রান্ত হয় মানসিক রোগে। আধুনিক তরুণীর মুখের ওপর কালো বোরখা চাপিয়ে তাকে কেমন বিকৃত ক’রে দেয়া হয়, তার কিছু অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে, তার মধ্যে একটি কখনো ভুলবো না। কয়েক বছর আগে জাতীয় উদ্যানে বিভাগীয় বনভোজনে একটি ঝোপের মাঝে দুটি অত্যন্ত রূপসী আকর্ষণীয় প্রাণবন্ত তরুণী আমাকে ঘিরে ধরে। তারা জিজ্ঞোস করে, ‘আমাদের চিনলেন, স্যার?’ আমি তাদের চিনতে পারি নি। তখন তারা আরেকটুকু ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে, ‘যে-দুজনকে ক্লাশে আপনি বোরখাপরা দেখেছেন, যাদের মুখ কখনো দেখেন নি, আমরা সে-দুজন।’ আমি অত্যন্ত আহত বোধ করি এজন্যে যে এমন সুন্দর প্রাণবন্ত দুটি তরুণী বোরখাচাপা পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে নিম্প্রাণ। তারা কেনো বোরখা পরে জানতে চাইলে তারা জানায়, কারণ হচ্ছে শ্বশুরবাড়ি ও এক অধ্যাপক-চিকিৎসক চাচা। বনভোজনে ওই তরুণী দুটি ছিলো সবচেয়ে প্রাণবন্ত, তারা উদ্যানের নিসর্গের স্তরে স্তরে সেদিন প্রাণসঞ্চার করেছিলো, কিন্তু জীবনে তারা বোরখাচাপা পড়ে নিজেরাই থাকে নিম্প্রাণ। এ-ক-বছরে হয়তো তারা সম্পূর্ণ নিজীব হয়ে পড়েছে, বা শিকার হয়েছে মনোব্যাধির। এখন বোরখা বেড়ে চলছে, ষাটের দশকে বোরখা খুঁজে পাওয়া যেতো না কলাভবনে, এখন কলাভবনের বারান্দায় চলে অন্ধ বোরখার মিছিল।
মুসলমান পিতৃতন্ত্র একটি কথার ব্যাপক প্রচার দিয়েছে যে সপ্তম শতক থেকে ইসলামই নারীকে মুক্তি দিয়েছে; নারীকে দিয়েছে সামাজিক অধিকার। পাকিস্তানপর্ব থেকে এ-প্রচারটি ধ্রুবপদের মতো উচ্চারিত হতে থাকে, এ-অঞ্চলে; নারীরাও এতে বিশ্বাস করে, এবং কী অধিকার দিয়েছে, সে-সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না ক’রে তারাও এটা আবৃত্তি করে। কোনো ধর্মই নারীকে প্রকৃত অধিকার দেয় নি, ইসলামও দেয় নি; চোদো। শো বছর ধ’রে নারীর অধিকার যতোটা বুলি ততোটা বাস্তব সত্য নয় [দ্র ‘পিতৃতন্ত্রের খড়গ’]। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারীর অবস্থা দেখলেই তা বোঝা যায়। ইসলামের আগে আরবে নারীর অবস্থা যতোটা খারাপ ছিলো বলে প্রচারিত, ততোটা খারাপ ছিলো না; ঐতিহাসিকদের মতে নারী অনেক বেশি স্বাধীন ছিলো অন্ধকার যুগের আরবে [দ্র ফাতিমা (১৯৭৫, ৬৪-৭৩)]। বাঙলাদেশে কিছু শিক্ষিত নারীও না বুঝে, বা কপটতাবশত, বা নিজেদের সুবিধার জন্যে চোদো শো বছর ধরে নারীর অধিকার ও ধর্মের জয়গানে এমন মুখর হয় যে সমগ্র পরিবেশ অতিপ্রাকৃতিক হয়ে ওঠে। টেলিভিশনে পুরুষতন্ত্রের আজ্ঞায় এবং কিছুটা লোভে যে-নারী ধর্মের গাথা প্রচার করে, সে জানে না। অন্যদের আত্মত্যাগের ফলে সে ধর্মের অনেক কঠোর বিধি অমান্য করতে পেরেছে ব’লেই টেলিভিশনে যেতে পেরেছে; যদি তার প্রশংসিত ধর্মের সব বিধি তার ওপর আবার চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তাকে অবরুদ্ধ থাকতে হবে অন্ধকারে। মৌলবাদ যেদিন সমস্ত প্ৰগতিশীলতাকে ধ্বংস ক’রে, সেদিন কখনো না। আসুক, তাকে মানতে বাধ্য করাবে সমস্ত বিধান, সেদিন সে শুধু টেলিভিশন নয়, অন্য কোথাও কোনো কথা বলার অধিকার পাবে না। সে জানে না ব্যক্তিগত সুবিধার জন্যে সে কাজ ক’রে চলছে নিজের, ও নারীমণ্ডলির বিরুদ্ধে।
রাজনীতি সবখানেই আজো পুরুষতান্ত্রিক; মৌলবাদী রাজনীতি উগ্র পুরুষাধিপত্যবাদী; আর গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রও আজো পুরুষের কবল থেকে মুক্তি পায় নি। চিরকালই নারী থেকেছে রাজনীতিক ক্ষমতার বাইরে; ইতিহাসে মাত্র কয়েকজন নারীর নাম মেলে, যারা রাজ্য শাসন করেছেন; তবে তারা এতো মুষ্টিমেয় যে পরিণত হয়েছেন কপকথায়। শাসক ও শাসিতদের মাঝামাঝি চিরকাল থেকেছে একদল মধ্যস্থতাকারী, তাদের অধিকাংশ সরকারি আমলা, এবং কিছু থাকে অসরকারি ব্যক্তি, যারা ব্যক্তিগত সম্পর্কবশত প্রভাব বিস্তার করে শাসকদের ওপর। ব্যক্তিগত সম্পর্কবশত শাসকদের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী উপদেষ্টাদের মধ্যে নারীই বেশি; তারা রানী, স্ত্রী, রক্ষিতা হিশেবে শাসকদের প্রভাবিত করেছে, আজো করে। তবে রানী, ও স্ত্রীদের থেকে রক্ষিতারা শাসকদের প্রভাবিত করেছে অনেক বেশি, কেননা রানী ও স্ত্রীদের থেকে রক্ষিতারাই বেশি প্ৰিয় শাসকদের। পুরুষতন্ত্র ‘রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানী’ তত্ত্বে বিশ্বাস করে, কারণ এটা রক্ষিতার কাজ; পুরুষ নারীকে রক্ষিতা হিশেবেই দেখতে পছন্দ করে, সরাসরি শাসক হিশেবে দেখতে পছন্দ করে না। শাসকদের উপদেষ্টার ভূমিকায় নারী এসেছে রক্ষিতারূপে; তাই নারীশাসকেরা উপদেষ্টা হিশেবে নারী নেয় না, তাদের উপদেষ্টামণ্ডলিতে সাধারণত নিয়োগ করে পুরুষই। আধুনিক রাষ্ট্রের উৎপত্তির পর শুধু রাজা নয়, দেখা দিয়েছে বিচিত্র ধরনের শাসক, যারা বাজনীতিক, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, আমলা ও আরো নানা ভূমিকায় ক্ষমতা ভোগ করে। কিন্তু এটা হয়ে থাকে পুরুষের অধিকার, নারীর নয়। বিশশতকের দ্বিতীয় দশকের আগে পশ্চিমের সর্বজনীন মানবাধিকারবাদীরাও নারীদের কোনো রাজনীতিক অধিকার দেয়। নি; এমনকি দেয় নি প্ৰায়-নিরর্থক ভোটাধিকারও। আজো, নব্বইয়ের দশকেও, নারীর বিরুদ্ধে রাজনীতিক বৈষম্যের অভাব নেই; নারী আজো রাজনীতিতে অনভিপ্ৰেত, যদিও পুরুষতন্ত্র নিজের সুবিধার জন্যে তাকে কাজে লাগায,। পুরোনো কুসংস্কার আজো এতো প্রবল যে নারী আজো রাজনীতিতে প্ৰবেশাধিকারহীন; অনেক দেশ রয়েছে যেখানে নারীর রাজনীতিক অধিকার সাংবিধানিকভাবেই নিষিদ্ধ। আরব আমিরাত, ইয়েমেন, ওমান, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, সৌদি আরব প্রভৃতি মুসলমান রাষ্ট্রে নারীকে রাখা হয়েছে রাজনীতির বাইরে; তারা ভোটও দিতে পারে না, অবশ্য অনেক দেশে ভোট দেয়ার ব্যাপারই নেই।
এখন অধিকাংশ দেশে নারী ভোট দিতে পারে, তবে এর মানে নয় যে নারী তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে স্বাধীনভাবে। অনেক মুসলমান রাষ্ট্রে ভোটাধিকার থাকা সত্ত্বেও নারী ভোট দেয় না, বা দিতে পারে না, বা দেয় পুরুষ অভিভাবকের নির্দেশমতো। নারী এখন অধিকাংশ দেশে ভোট দিতে পারে, তার রাজনীতিক অধিকারও রয়েছে, কিন্তু সে-তুলনায় তাদের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের হার অত্যন্ত তুচ্ছ। আজো নারী রাজনীতিক রূপকথা বা রাজনীতিতে উৎকট দৃশ্য। এখন পৃথিবীর ৯৬ শতাংশ নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ দেশে রাজনীতিক পদে অধিষ্ঠিত নারীর সংখ্যা শোচনীয়রূপে স্বল্প। অধিকাংশ দেশে সংসদে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা খুবই কম; কোনো কোনো দেশে-যেমন বাঙলাদেশ, পাকিস্তান, ঘানায়-সংসদে নারীদের জন্যে আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। এ-বোধ থেকে যে নারীরা সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য। সংরক্ষিত নারী আসনগুলো নারীমুক্তির পক্ষে নয়, বিরুদ্ধে; এর ফলে দেখা দেয় এমন সুবিধাবাদী নারী, যারা শুধু ক্ষমতাশালীদের অনুগত থাকার ফলেই ওই আসন লাভ করে। তাদের কোনো রাজনীতিক যোগ্যতা থাকে না, তারা হয়ে থাকে সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদী, পুরুষ রাজনীতিকদের মতোই দুশ্চরিত্র: তারা নারীদের যোগ্যতা অর্জনের বদলে শুধু শক্তিশালীদের অনুগত, এমনকি রক্ষিতা, হাতে শেখায়। গত কয়েক দশকে কয়েকটি দেশে নারী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে : শ্ৰীলঙ্কায় শ্ৰীমাভো বন্দরনায়েকে, ইসরাইলে গোল্ড মেয়ার, ভারতে ইন্দিরা গান্ধি, আর্জেন্টিনায় ইসাবেলা পেরন, যুক্তরাজ্যে মাৰ্গারেট থ্যাচার, ফিলিপিনসে কোরাজান অ্যাকিনো, পাকিস্তানে বেনজির ভট্টো, বাঙলাদেশে খালেদা জিয়া অধিকার করেছেন সর্বোচ্চ রাজনীতিক ক্ষমতা। কিন্তু তারা, গোল্ড মেয়ার ও মার্গারেট থ্যাচার বাদে, সবাই ক্ষমতায় এসেছেন কোনো মৃত বা নিহত পুরুষের উত্তরাধিকারী ও পুরুষতন্ত্রের পুতুল রূপে। কেউ কেউ অবশ্য পুতুল হয়ে থাকেন নি; যেমন ইন্দিরা গান্ধি। তারা যতোটা রূপকথা ততোটা বাস্তব নন; তারা অনেকাংশে নারীর জন্যে পুরুঘের থেকেও ক্ষতিকর। পুরুষতন্ত্রের কোনো পীড়িত পক্ষ যখন পুরুষতন্ত্রের অন্য কোনো হিংস্র পক্ষের দ্বারা পর্যুদস্ত হতে থাকে, তখন তারা ব্যবহার করে এমন কোনো নারীকে যে সম্পর্কিত কোনো কিংবদন্তিতুল্য পুরুষের সাথে। এভাবেই উদ্ভব ঘটেছে শ্ৰীমাভো, ইন্দিরা, ইসাবেলা, কোরাজান, বেনজির, খালেদার। এসব দেশে নারীর অবস্থা খুবই শোচনীয়, কিন্তু শবপুজোবাদী রাজনীতির ফলে তাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাই তারা নারীমুক্তির উদাহরণ নন, সম্ভাবনাও নন। রাজনীতি এখন সম্পূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক, রাজনীতিতে শক্তিশালী নারীরাও পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধি; তাই তারা নারীদের উপকারে আসছেন না। নারীকে নিজের স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্যে বিশ্বাস করতে ও সক্রিয় হ’তে হবে প্ৰগতিশীল রাজনীতিতে, নারীবাদী রাজনীতিতে। পুরুষদের জন্যে প্রতিক্রিয়াশীলতা সুবিধাজনক ব্যাপার, নারীর জন্যে প্রতিক্রিয়াশীলতা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।
নিজের ভবিষ্যতের জন্যে নারীকে ত্যাগ করতে হবে পিতৃ-ও পুরুষ-তন্ত্রের সমস্ত শিক্ষা ও দীক্ষা; ছেড়ে দিতে হবে সুমাতা, সুগৃহিণী, সতীর ধারণা; তাকে আয়ত্ত করতে হবে শিক্ষা, এবং গ্রহণ করতে হবে পেশা। তাকে হ’তে হবে আর্থনীতিকভাবে স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত; তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে সব ধরনের প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে লড়াইয়ের জন্যে। তাকে কান ফিরিয়ে নিতে হবে পুরুষতন্ত্রের সমস্ত মধুর বচন থেকে, তাকে বর্জন করতে হবে পুরুষতন্ত্রের প্রিয় নারীত্ব। তাকে সাবধান থাকতে হবে পুরুষতন্ত্রের সমস্ত মহাপুরুষ সম্বন্ধে, সন্দেহের চোখে দেখতে হবে সবাইকে, কেননা কেউ তার মুক্তি চায় নি। তাকে মনে রাখতে হবে সে মানুষ, নারী নয়; নারী তার লৈঙ্গিক পরিচয় মাত্ৰ; মনে রাখতে হবে পুরুষের সাথে তার পার্থক্য মাত্র একটি ক্রোমোসোমের, এবং একটি ক্রোমোসোমের জন্যে একজন প্ৰভু ও আরেকজন পরিচারিকা হয়ে উঠতে পারে না। নারীকে ঘৃণা করতে শিখতে হবে সম্ভোগের সামগ্ৰী হ’তে, এবং হতে হবে সক্রিয়, আক্রমণাত্মক। নিজের ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করে নিতে হবে নিজেকেই, পুরুষ তাঁর ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করবে না। নারীর ভবিষ্যৎ মানুষ হওয়া, নারী হওয়া নারী থাকা নয়।