২৫. দ্য এগ অ্যান্ড দ্য আই
সোনার ডিমের রহস্য জানতে কতটা সময় তাকে স্নান করতে হবে তা হ্যারির জানা ছিল না। তাই হ্যারি ঠিক করল দিনে নয় রাত্রে স্নান করবে–তাহলে যতটা সময় লাগার ততটা সময় সে বাথরুমে থাকতে পারবে। সেই বাথরুম সবাই ব্যবহার করতে পারে না। তাই তার কাজে বিঘ্ন হওয়ার সম্ভাবনা কম।
সেডরিকের কাছ থেকে ও আরো কিছু জেনে নিতে চায় না… কিন্তু দেখাই যাক, এই ভেবে ও প্রিফেক্টদের বাথরুমে যাওয়া ঠিক করল।
কাজটা খুব সাবধানে করতে হবে। কেয়ারটেকার ফিলচচের চোখে ধূলো দেওয়া সম্ভব নয়। এর আগে একবার মাঝরাতে ডরমেটরি থেকে বেরিয়ে ও ফিলচচের হাতে ধরা পড়েছিল। সেই রকম আবার কিছু ঘটুক হ্যারি তা চায় না। গোপনে আর সতর্কতার সঙ্গে কাজ শেষ করার জন্য অদৃশ্য হবার আলখেল্লা ব্যবহার করতে হবেই। এছাড়াও মরাডরস ম্যাপ সঙ্গে রাখতে হবে। আইন ভঙ্গ করার জন্য সেটা একটা দরকারি সহায়ক হ্যারির কাছে। মানচিত্রটা দিয়ে সম্পূর্ণ হোগার্টের কম সময়ে যাওয়া, গোপনীয় পথগুলো, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ক্যাসেলে যারা থাকে তাদের গতিবিধি জানা যাবে। মানচিত্র সামনে রাখলেই কে কোথায় রয়েছে, কোথায় হাঁটাহাঁটি করছে, কোন পথ ধরে যাচ্ছে, আসছে সবই সামনে ফুটে উঠবে। এমনকি বাথরুমে কেউ যাচ্ছে কিনা তাও জানতে পারবে।
বৃহস্পতিবার দিন মাঝরাতের আগে হ্যারি নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে আলখেল্লাটা পরে পা টিপে টিপে নিচে নামল। হ্যাগ্রিড সেদিন রাতে ওকে যেভাবে ড্রাগন দেখিয়েছিল ঠিক তেমনিভাবে এবার রন মোটা মহিলাটিকে পাশওয়ার্ড (কলা–পিঠা) দিয়ে দরজা খোলাল এবং হ্যারিকে পার করল। তারপর সে গুডলাক জানিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারে কমনরুমে চলে গেল।
গায়ে আলখেল্লা, হাতে ম্যাপ, ভারি সোনার ডিম নিয়ে হ্যারি সেডরিকের দেওয়া নির্দেশ মতো চলল। করিডলরে চাঁদের আলো পড়েছে… করিডলর ফাঁকা, নিশ্ৰুপ। হ্যারি বোরিস দ্যা বেউইলভার্ড মূর্তির কাছে গিয়ে সেডরিকের দেওয়া পাশওয়ার্ড পাইন ফ্রেশ বলে বন্ধ দরজাটায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
দরজাটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল। হ্যারি ভেতরে ঢুকে গা থেকে অদৃশ্য আলখেল্লাটা খুলে চার দিকে তাকাল। বাথরুমটা দেখতে দেখতে মনে হল সে যদি ক্লাস ক্যাপ্টেন হতো তাহলে এমন সুন্দর বাথরুম ব্যবহার করতে পারতো। স্নানঘরে আলো বলতে ছোট্ট ছোট্ট মোমবাতি দেওয়া অতি সুদৃশ্য একটা ঝাড়ু লণ্ঠন। ঘরের সব কিছুই শ্বেত পাথরের-এমন কি ঘরের মেঝের মাঝ খানের সুইমিং পুলটাও। তার চারধারে প্রায় একশটা সোনালি রং-এর ট্যাপ। তাতে বিভিন্ন রং-এর দামী পাথর সেট করা। একটা ডাইভিং বোর্ডও রয়েছে। জানালাগুলোতে ঝুলছে সাদা লিনেন কাপড়ের বড় বড় পরদা, এক কোণে সাজানো রয়েছে তোয়ালে। দেওয়ালে সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো একটি মাত্র ছবি ঝুলছে, একটি সোনালি চুলের সুন্দরী মেয়ের। মেয়েটি সমুদ্রের ধারে একটা পাথরে শুয়ে ঘুমাচ্ছো। ও যতবারই নাক ডাকছে… মুখে পড়া সোনালি চুলগুলো উড়ছে।
হ্যারি হাতের মানচিত্র, সোনার ডিম আর অদৃশ্য হবার আলখেল্লাটা মেঝেতে রেখে সামান্য এগোল। এত নিঃস্তব্ধ যে ওর পদশব্দে দেওয়ালে প্রতিধ্বনি হতে লাগল।
রাজকীয় বাথরুমটার চৌবাচ্চার দুএকটা জলের ট্যাপ খুলতে চাইল হ্যারি। ভাবল সেডরিক ওকে ঠকায়নিতো। বাথরুমে স্নান করলে সোনার ডিমের রহস্য কেমন করে ফাস হবে? যাই হোক, এসেছে যখন দেখাই যাক। ও তোয়ালে, ডিম, মানচিত্র আর অদৃশ্য হওয়ার আলখেল্লাটা সুইমিংপুলের পাশে এনে রাখল। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে দু একটা ট্যাপ খুলল।
বিভিন্ন ট্যাপে বিভিন্ন রংয়ের পানি বুঁদ বুদ করে বেরিয়ে আসতে লাগল। একটায় ফুটবলের মতো বড় গোলাপি আর নীল বুঁদ বুদ, দ্বিতীয়টায় ঘন বরফসাদা ফোম। এত ঘন যে হ্যারি অনায়াসে তার ওপর শুয়ে থাকতে পারে। তৃতীয়টি থেকে বেরিয়ে এল বেগুনি রংয়ের সুগন্ধ মেঘ। সেই মেঘটা জলের ওপর ভাসতে লাগল। হ্যারির দারুণ মজা লাগল। স্নান করার কথা যেন ভুলে গেল। ট্যাপগুলো কখনও বন্ধ করে, কখনও খোলে।
তারপর যখন পুলটা কানায় কানায় গরম জলে ভর্তি হয়ে গেল হ্যারি ফোম আর বাবল দিয়ে মনের সুখে স্নান শেষে সব ট্যাপ বন্ধ করে দিল। পুলটা এত গভীর যে জল মাথা ছাড়িয়ে উঠে। ওর স্নানের শব্দে বাথরুমটা ভরে উঠল।
হ্যারি তারপর ডিমটা হাতে নিয়ে ভিজে হাতে মুখটি খুলল। নানারকম শব্দে বাথরুমটা গমগম করে উঠল। ভয়ে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ডিমের মুখটি বন্ধ করে দিল হ্যারি। এত জোরে শব্দ হচ্ছে যে, যেকোনও সময় ফিলচচের ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তারপর আবার সন্দেহ হল সেডরিক ওকে ঠকাচ্ছে নাতো! সঙ্গে সঙ্গে ও সুইমিংপুল থেকে লাফিয়ে উঠে আসতে গিয়ে হাত থেকে ডিমটি বাথরুমের মেজেতে আছড়ে পড়ল। তারপর শুনতে পেল কে যেন কানের কাছে এসে বলল
আমি যদি তুমি হতাম তা হলে ডিমটি জলের ওপর রাখতাম।
হঠাৎ ওই রকম কথা শুনে হ্যারি হকচকিয়ে একগাদা বাবল খেয়ে ফেলল। তারপর দেখল–গম্ভীর মুখে একটি মেয়ে (খুব সম্ভব ভূত) একটা ট্যাপের ওপর পায়ের ওপর পা তুলে বসে রয়েছে। হ্যারি ওকে দেখে চিনতে পারলো–মোনিং ম্যারটল (চির হরিৎ গুল্ম)। যার ফোঁপানি সাধারণত শুনতে পাওয়া যায় বাথরুমের বাঁকানো পুলের তিন ধাপ নিচে।
–হ্যারি অসম্ভব ক্ষিপ্ত হয়ে বলল–মারটেল! তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন? স্নান করার সময় তো আমি কাপড় খুলে ফেলেছি।
ফোম এত ঘন যে তা ভেদ করে বোধ হয় ওর কথা মারটেলের কানে ঢুকল না। হ্যারির মনে হলো মেয়েটা যখনই বাথরুমে ঢুকেছে তখন থেকে গোয়েন্দাগিরি করে চলেছে।
–তুমি যখন পুলে নেমেছে, তখন আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম। মোটা কাঁচের চশমার মেয়েটি চোখ ছোট ছোট করল, বছরের পর বছর আমাকে তোমায় দেখতে হবে না।
আমার অবশ্য মেয়েদের বাথরুমে আসা ঠিক হয়নি।
–সে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তোমার কাজের জন্য এখানে আসতে হয়েছে।
মারটেলের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ অতীতের কথা বলল হ্যারি।
এরপর হ্যারি ডিমটা ফোমভর্তি জলে ডুবিয়ে মুখটা খুলল, এবার কি আগের। মতো বিকট শব্দ করে উঠল না। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো গলগল সুরে গান। জলের ভেতর থেকে সেই গানের অর্থ ঠিক বুঝতে পারে না হ্যারি।
–গানের শব্দ শুনতে গেলে তোমাকে জলে ডুব দিতে হবে, মার্টেল বলল। গোড়া থেকেই ও হ্যারির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে।
হ্যারি খুব বড় করে একটা দম নিয়ে জলে ডুব দিল, জলের তলায় পাথরের ওপর বসে ও সেই সোনার ডিমের ভেতর থেকে অদ্ভুত সমবেত কণ্ঠের গান শুনতে পেল। হাতে ডিমটা নিয়ে গভীর আগ্রহে ও গান শুনতে লাগল
এসো খুঁজে বের কর, যেখান থেকে আমাদের গান শুনতে পাচ্ছ,
আমরা স্থলে গাইতে পারি না,
আর যখন তুমি আমাদের খুঁজবে,
ভেবে দেখবে
আমরা যা পেয়েছি তা তুমি ভীষণভাবে হারাবে,
ঘন্টার পর ঘণ্টা তোমাকে চেয়ে থাকতে হবে
যা আমরা পেয়েছি সেটা উদ্ধার করতে,
কিন্তু এক ঘণ্টা তো হয়ে গেল–কোনও আশা নেই
বড় দেরি–উধাও হয়েছে…
আর তো ফিরবে না।
হ্যারি জলের তলা থেকে ওপরে ভেসে উঠল। মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে চোখের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিল।
–আমাদের গান শুনেছ?
–শুনেছি।
–তাহলে কোথা থেকে গান গাইছি পেয়েছ খুঁজে?
–না, আমি তোমাদের গান আবার শুনতে চাই, হ্যারি আবার জলে ডুব দেয়।
হ্যারি আরও জলের তলায় ডুবে যায় সেই গান মনে রাখার জন্য। তারপর কিছুক্ষণ জলে সাঁতরে বেড়ায়, গভীরভাবে চিন্তা করে, ম্যারেটল বসে বসে ওকে লক্ষ্য করে। এর আগে হ্যারি ম্যারেটলকে এত খুশি দেখেনি, অবশ্য আরেকদিন তাকে সুখি সুখি দেখাচ্ছিল যেদিন পলিজুস পোসান দিয়ে হারমিওন ওর মুখময় লোম আর বেড়ালের ল্যাজ কবে দিয়েছিল।
হ্যারি জলের গভীর থেকে ওপরে ভেসে উঠে ভাবে–যদি জলের তলায় যাদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় তাহলে তারা জলের জীব! হ্যারি সেই কথাটা বলাতে ম্যারেটল হ্যারির দিকে তাকিয়ে বোকা বোকা হাসল। ম্যারেটল বলল–ঠিক এই প্রশ্নটাই ডিগরি ভেবেছিল। ও ওখানে শুয়ে শুয়ে আপন মনে কথা বলেছিল… অনেক অনেক সময় ধরে… তখন আর একটিও বুদবুদ ছিল না।
–জলের তলায়…, হ্যারি খুব ধীরে ধীরে বলল।–ম্যারেটল, হ্রদে অনেক ছোট ছোট মাছ ছাড়া আর কে থাকে?
–ওহ্ অনেক রকমের, ও বলল, আমি জলের তলায় মাঝে মাঝে যাই…, অনেক সময় উপায় থাকে না–যেতে হয়… যদি আমার টয়লেট অন্য কেউ ব্যবহার করে।
হ্যারি পাইপের ডগায় মারটেল কীভাবে বাথরুম করে এসব না ভেবে ওকে ঘোরাতে বলল–জলের তলায় এমন কেউ আছে যে মানুষের গলায় কথা বলে? প্রতীক্ষা করে জবাবের।
হ্যারির চোখ পড়ল দেওয়ালের তন্দ্রালু মারজেড মৎসকুমারীর দিকে। বলল ম্যারেটল ওখানে কি মৎস কুমারী নেই?
–বাঃ খুব ভাল, ও বলল… ওর চশমার মোটা কাঁচ স্থির তারার মতো ঝিকিমিকি করে উঠল–ডিগরির কথাটা ভাবতে অনেক সময় লেগেছিল!… ওই মেয়েটার তন্দ্রাভঙ্গ পর্যন্ত, ম্যারেটল মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে মৎসকুমারীর দিকে দারুণ বিদ্বেষ ভরা দৃষ্টিতে ওর বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকাল।–মৎসকুমারীর ডানা ঝলসে উঠল।
ঠিক বলেছি না? হ্যারি উত্তেজিত হয়ে বলল–দ্বিতীয় টাস্ক শুরু হবে খুঁজে বের করতে হবে তোমার অনুগামীদের জলের তলায়… আর… আর।
কথাগুলো বলতে বলতে হ্যারি অনুভব করল, ওর ভেতরে যে ভাবনা জমা হয়েছিল সেগুলো বের করার জন্য কে যেন পেটে ঘুষি মারার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল। হ্যারি কখনও ভাল সাঁতারু নয়। তেমন প্রশিক্ষণের সুযোগ–সুবিধা পায়নি। ছোটবেলায় ডাডলি পেয়েছিল (খালাত ভাই আঙ্কেল ভার্ননের অপদার্থ ছেলে); কিন্তু আন্ট পেটুনিয়া (খালা), আঙ্কেল ভার্নন… ভেবেছিল সাঁতার না শেখাই ভাল। জলে নেমে সাঁতার না জানার জন্য ডুবে মরবে)… তাই ওকে ডাডলির সঙ্গে আর সাঁতার শিখতে দেয়নি। বাথরুমে বাথটা বেশ বড়ই বলতে হবে, কিন্তু যে লেকে ম্যারেটলের কথায় গান শুনতে গিয়েছিল সেটা অনেক বড়… গভীর। মত্সকুমাররা নিশ্চয়ই তলদেশে বাস করে।
হ্যারি বলল, ওখানে আমি কেমন করে নিশ্বাস নেব?
কথাটা শুনে ম্যারেটলের দু চোখ জলে ভরে ওঠে।
–মূর্খ! রুমালের বদলে আলখেল্লার এক কোনা দিয়ে চোখ মুছে ম্যারেটল বলল।
–মানে? হ্যারি হতভম্ব হয়ে বলল।
–আমার সামনে নিশ্বাস নেবার কথা বলছ? ম্যারেটল তীক্ষ্ণরে বলল। ওর গলা সারা বাথরুমে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। আমি তো পারি না… কখনও পারিনি… অনেক বছর নয়।–ও রুমালে মুখ চাপ দিল। অশ্রু মুছলো।
হ্যারির মনে পড়ল ম্যারেটলের মৃত্যু। ম্যারেটল তার মৃত্যুর বেদনা বহন করে চলেছে। ওর মতো অন্যকোনও ভূতেরা তা মনে রাখে না। দুঃখিত, হ্যারি হড়বড়িয়ে বলল…, আমি কোনো কিছু না ভেবে কথাটা বলেছি। ভুল হয়ে গেছে, মনে ছিলো না।
–ও হ্যাঁ হ্যাঁ ম্যারটলের মৃত্যু খুব সহজেই ভোলা যায়, ফোলা ফোলা চোখে ম্যারটল বলল।
–আমি যখন বেঁচে ছিলাম কেউ একদিনের জন্যও আমাকে দৃষ্টির বাইরে রাখেনি। আমার দিকে ঘণ্টার ঘণ্টা আমার জন্য অপেক্ষা করত। আর আমি, তাদেরই অপেক্ষায় আমি বসে থাকতাম।
অলিভ হর্নবী বাথরুমে ঢুকে বলল–তুমি আবার এখানে বসে রয়েছে ম্যারেটল? প্রফেসর ডিপের্ট আমাকে তোমার খোঁজ নিতে বললেন। আমার শরীর দেখে সে মুগ্ধ, ওঃ মৃত্যুর দিন পর্যন্ত আমার কথা ভোলেনি। আমি সবসময় ওর পাশে পাশে থেকেছি… ওর ভাইয়ের বিয়ের দিন আমি আজও মনে করি।
কিন্তু হ্যারির ম্যারেটলের একটি কথাও কানে যাচ্ছে না… ওর কানে বাজছে অনুগামীদের সমবেত কণ্ঠের গান। আমরা তোমার একটা জিনিস নিয়েছি তুমি যেটার অভাব সবসময় অনুভব করবে। কথাটা শুনে মনে হয় যেন ওর কোনো জিনিস চুরি করে নেবে… কিন্তু তাকে তা ফিরে পেতেই হবে… ওর থেকে ওরা কি নিয়েছে?
–তারপর ও ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বলে দিল আমি যেন অলক্ষিতভাবে ওর কাছে ঘোরাফেরা না করি।… তাই ফিরে এসে এই টয়লেটে বাসা বেঁধেছি।
–হ্যারি ভাসা ভাসা ভাবে বলল–ভাল–আমাকে আর দেখতে পাবে না। চোখ বন্ধ কর আবার… কর, আমি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি।
হ্যারি বাথটাবের তলা থেকে সোনার ডিমটা তুলে আনে। তোয়ালে দিয়ে গায়ের জল মোছে। জামা–কাপড় পরে নেয়।
বিলাপী ম্যারেটল বিষণ্ণভাবে বলল–আবার একদিন তুমি বাথরুমে এসে আমার সঙ্গে দুএকটা কথা বলবে? হ্যারি এখন অদৃশ্য হওয়ার আলখেল্লা হাতে নিয়েছে।
–আচ্ছা চেষ্টা করব, হ্যারি বলল। ও জানে এই বাথরুমে আর আসার কোনও আশা নেই। একমাত্র আছে, যদি ক্যাসেলের ওদের সব বাথরুম অকেজো হয়ে যায়।
–আবার দ্যাখা হবে ম্যারেটল, আজ আসি। তোমার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ।
ম্যারটেল বিষণ্ণভাবে বলল–বাই, বাই। হ্যারি তখন অদৃশ্য হওয়ার আলখেল্লা পড়ে ফেলেছে।
বাইরে অন্ধকার করিডোরে এসে হ্যারি ম্যাপটা চোখের সামনে ধরে দেখল পথ ফাঁকা, কিছু নেই।
এক বিন্দু আকা দেখে বুঝল ফ্লিচ আর মিসেস নরিস ওদের অফিসে রয়েছেন। একমাত্র পিভস জেগে, ওপর তলা থেকে ট্রফি রুমের আশপাশে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। গ্রিফিন্ডর টাওয়ারের দিকে পা–বাড়াতেই ম্যাপে একটা কিছু ওর চোখে ধরা পড়ল, এমন একটা কিছু স্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক অদ্ভুত! পিভস ছাড়াও স্নেইপের অফিসের বা ধারের কোনের দিকে একটা বিন্দু ঘুরছে। বিন্দুটি কিন্তু সিভেরাস স্নেইপের নামে তলায় নয়… রয়েছে বার্টেমিয়স ক্রাউচ এর নামের তলায়।
চলমান বিন্দুর দিকে হ্যারি তাকিয়ে রইল। ক্রাউচ অসুস্থ, নাচের পার্টিতে আসতে পারেন নি, তবে এত রাতে হোগার্টে এসেছেন কেন? কাউচের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য ও মানচিত্রের দিকে দারুণ বিস্ময় কৌতূহলে তাকিয়ে রইল। বিন্দুটা স্থির নয় স্নেইপের ঘরের চারদিকে ঘুরছে।
হ্যারি যত তাড়াতাড়ি পারে ডরমেটরিতে সোনার ডিম, মানচিত্র আর অদৃশ্য হবার আলখেল্লাটা নিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। ও রনের মতো সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে নামতে গিয়ে হাতে যা কিছু ধরা ছিল নিয়ে হড়কে পড়ল। হাতের সব জিনিস সব ছিটকে পড়ল শুধু নয় রেলিংয়ে একটা পা আটকে গেল। ওর চোখের সামনে দিয়ে সোনার ডিম সিঁড়িতে দিয়ে গড়াতে গড়াতে নিচে চলল-এমন এক শব্দ করে যেন বিব্রট ড্রাম গড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, ডিমের মুখের ঢাকনাটা খুলে গিয়ে নানা রকম শব্দ বেরিয়ে আনতে লাগল। কখনও তীব্র কখনো নরম।
কোনও রকমে হাত বাড়িয়ে আলখেল্লাটা, আর মানচিত্রটা তুলে নিল হ্যারি। ধরা পরে যাওয়ার আশস্কায় ও চটপট অদৃশ্য হবার আলখাল্লাটা পরে নিল। ভয় ভাবনায় ও ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল।
হ্যারি স্কুলের কেয়ারটেকার পিভসের গলা শুনতে পেল। সেজেগুঁজে ফিলচচু স্ত্রী আর তার বেড়াল নিয়ে মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছিলেন।
–আশ্চর্য! পিভস সারারাত তুমি লাফালাফি করে বেড়াও, কোথায় কি হচ্ছে দেখ না? ফিলচচের কণ্ঠস্বর।
ফিলচ নিচে নেমে ডিমটাকে দেখে ডিমের মুখ বন্ধ করে দিতেই আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। রাগে গড় গড় করতে করতে বললেন, তুমি চ্যাম্পিয়নের সোনার ডিম চুরি করতে এসেছিলে?
ততক্ষণে গোলমাল শুনে ঘটনাস্থলে স্নেইপ এসে গেলেন। স্নেইপকে আসতে দেখে হ্যারির ভয়–ভাবনা আরও বেড়ে গেল। ব্যাপারটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে একসা করবেন।
–কী ব্যাপার ফিলচ?
–প্রফেসর আমার মনে হয় পিভস ডিমটা চুরি করে পালাতে গিয়ে হাত থেকে ফেলে দিয়েছে।
স্নেইপ বললেন,–পিভস, কিন্তু ডিমটা তো আমার অফিসে থাকার কথা। কিন্তু পিভস আমার অফিস ঘরে ঢুকবে কেমন করে।
ফিলচচের মুখের দিকে তাকিয়ে স্নেইপ বললেন, অন্যায়, চ্যাম্পিয়নদের ক্ল ডিম… আসল ব্যাপারটা জানতে তদন্ত করতে হবে।
–করুন প্রফেসর, কিন্তু কোনও সন্দেহ নেই পিভস কাণ্ডটা করেছে।
স্নেইপ বললেন,–অফিসের দিকে আসার সময় করিডলরে কে টর্চ জ্বালিয়েছে? অফিসে গিয়ে দেখি আমার অবর্তমানে কে বা কারা আমার আলমারি খুলেছে কাগজপত্র ঘেটেছে…। আপনি ডিমের কথা বলছিলেন; আমার ঘরেছিল… অবশ্যই আমার ঘরে ওটা ছিলো না।
–তাহলে পিভস কিছু করেনি…। ডিমটাও ছুঁড়ে ফেলেনি…?, ফিলচ বললেন।
–আমি জানি ও করেনি, করতে পারে না, স্নেইপ বাধা দিয়ে বললেন। আমি নিজে মন্ত্র পড়ে অফিস সিল করেছি। একমাত্র কোনও জাদুকর ছাড়া খোলার সাধ্য নেই। কথাটা বলে স্নেইপ সিঁড়ির নিচের দিকে তাকালেন… ফিলচ আসুন আমার সঙ্গে ব্যাপারটা দেখা যাক।… যে ঘরে ঢুকেছে তাকে খুঁজে বার করতে হবে।
–আমি যাব… হ্যাঁ কিন্তু প্রফেসর…।
কথাটা বলে ফিলচ সন্দেহের দৃষ্টিতে সিঁড়ির দিকে তাকালেন। হ্যারি গোড়া থেকেই ফিলচচের মুখ দেখে বুঝতে পেরেছে পিভসকে ছেড়ে দেবার কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। হ্যারি নিজের মনে মনে বলল, যাও… ও গেলে হ্যারি বাঁচে… যাও স্নেইপের সঙ্গে যাও। ওদিকে মিসেস নরিস ফিলচচের পায়ের দিকে ঘন ঘন তাকাতে লাগলেন। হ্যারি পরিষ্কার বুঝতে পারলো ওর সারাদেহে স্নান করার সময় যে অপূর্ব গন্ধ ছড়াচ্ছিল তা ও অদৃশ্য থাকলেও নাকে না আসার কোনও কারণ নেই।… ভাবছেন বাথরুমে অত বেশি সুগন্ধ দেবার কোনও কারণ নেই।
-একটা মোদ্দা কথা প্রফেসর, ফিলচ মুখে দুঃখ দুঃখ ভাব এনে বলল, এইবার আমি সরাসরি হেডমাস্টার স্যার-এর কাছে পিভসের ব্যাপারে নালিশ করব। আশা করি এইবার আমার কথা ডাম্বলডোর শুনবেন। আমি জানি পিভস ছাত্রদের জিনিসপত্র হাতায়… আমি হাতে–নাতে ধরেছিলাম ওকে।… আমি ওকে ক্যাসল থেকে তাড়িয়ে ছাড়ব।
–ফিলচ আমি ওই হবাজ ভূতের কথা শুনতে চাই না। এটা আমার অফিস…।
ক্লাংক ক্লালক, ক্লাংক। শব্দ হল।
স্নেইপ মাঝপথে আলোচনা থামিয়ে দিলেন।
দুজনেই সিঁড়ির নিচে তাকালেন।
হ্যারি দেখল ম্যাড–আই–মুডি ওদের দুজনের মাঝে সামান্য পরিসরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে দাঁড়ালেন।
স্বাভাবিকভাবে মুডি অদ্ভুত পোশাক পরেছেন… বেড়াতে যাওয়ার গায়ে জীর্ণ ময়লা যোব, তার ওপর চাপিয়েছেন নাইটশার্ট। যথারীতি লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন।
–কি হে পার্টি হচ্ছে?
ফিলচ বলল,–প্রফেসর আর আমি গোলমাল, প্রচণ্ড শব্দ শুনে এখানে এলাম। দেখলাম হল্লাবাজ পিভস হল্লা করছে… যা হাতের কাছে পাচ্ছে ফেলে দিচ্ছে। তারপর আরও সাংঘাতিক ব্যাপার, প্রফেসর স্নেইপ দেখলেন ওর অফিসঘরে কেউ সিল ভেঙে ঢুকেছে।
–তুমি চুপ কর, স্নেইপ ফিলচকে ধমক দিলেন।
হ্যারি দেখল মুডি সিঁড়ির ধাপের কাছে দাঁড়ালেন। ওর ম্যাজিক্যাল চোখ স্নেইপকে দেখতে লাগল, তারপর ওর দিকে।
হ্যারির বুক ধ্বক করে উঠল। জানা কথা মুডি তার ম্যাজিক্যাল আই দিকে ওকে দেখতে পাবেন। তার সেই চোখের কাছে কেউ কিছু গোপন রাখতে পারে না। ও স্বচক্ষে সব দেখতে পাচ্ছে। স্নেইপ নাইটশার্ট পরে রয়েছেন, ফিলচ হতভম্ব হয়ে ভারি ডিমটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর নিজের রেলিংয়ে পা আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর কেউ না–পারুক মুডি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন।… মুডি ঠোঁট বেকিয়ে হাসলেন। আশ্চর্য হলেন, স্বাভাবিকভাবে কয়েক সেকেন্ড দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মুডি হাসি থামিয়ে ওর নীল চোখের দৃষ্টি স্নেইপের ওপর ফেললেন।
–আমি কী ঠিক শুনেছি? মুডি ধীরে ধীরে বললেন। বলছেন কেউ আপনার অফিসঘরে ঢুকেছিল?
–খুবই মারাত্মক, স্নেইপ বললেন তিক্তভাবে।
মুডি বললেন,–বের করতে হবে… কে আপনার অফিসঘরে ঢুকেছে বা ছিল। তাই না?
স্নেইপ বলল,-একজন ছাত্র আমি হলপ করে বলতে পারি। হ্যারি লক্ষ্য করল স্নেইপের কপালে শিরা দপদপ করছে। আগেও এমন ঘটনা হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত স্টোর থেকে পোসানের উপকরণ চুরি গেছে। চুরির একমাত্র উদ্দেশ্য ছাত্ররা বে–আইনিভাবে যা ইচ্ছে তাই বানাচ্ছে।
মুডি বললেন, আপনি ঠিক জানেন? এছাড়া অন্য কিছু নয়? অন্য কিছু লুকিয়ে রাখছে না?
হ্যারি দেখল মুডির কথা শুনে স্নেইপ দারুণ চটে গেছেন। পাতলা মুখটা কালো হয়ে গেছে। রগের শিরাগুলো আরও বেশি ফুলে উঠেছে।
স্নেইপ খুব আস্তে অথচ মারাত্মক সুরে বললেন–আপনি ভাল করেই জানেন আমি কোনও কিছু গোপন করি না। আপনি আমার অফিস তো বেশ ভালভাবেই সার্চ করেছিলেন।
মুডি বক্ৰহাসি হেসে বললেন, ওটা আমার কাজের মধ্যে পড়ে স্নেইপ… তাছাড়া ডাম্বলডোর আমাকে বলেছিলেন সবসময় সতর্ক থাকতে ও চোখ খোলা রাখতে।
স্নেইপ বললেন, ডাম্বলডোরের আমার ওপর প্রচুর আস্থা আছে। আমি কিন্তু বিশ্বাস করি না যে, আপনাকে আমার অফিসঘর সার্চ করতে বলেছিলেন।
মুডির গলার স্বর গর্জন করে ওঠে–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই বিশ্বাস করেন। তাকেও সকলে বিশ্বাস করে… বিশ্বাস করার মতো মানুষ। তাহলেও মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটে… কি বলতে চাই বুঝতে পেরেছেন?
স্নেইপ হঠাৎ এক মজার কাণ্ড করে বসলেন। ডান হাত দিয়ে বাঁ–হাতটা চেপে ধরে কাঁপাতে লাগলেন। এমনভাবে যেন কেউ তার হাতে প্রচণ্ডভাবে ঘা দিয়েছে।
মুডি হো হো হো করে হেসে বললেন–যাও একটু ঘুমিয়ে নাও।
–আমি কোথায় যাব না যাব তা আপনি বলার কে? স্নেইপ রাগে ফেটে পড়ে বললেন–দিনের বেলা বা রাতে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা ঘুরেফিরে দেখার মতো অধিকার আমারও আছে।
–বেশ তাই করন। মুডি বললেন। মুডির কথার মধ্যে চতুরতার ইঙ্গিত!
–খুবই ভাল, মাঝে মাঝে অন্ধকার করিডলরে আপনার সঙ্গে দেখা হবার সুযোগ মিলবে।
দারুণ এক ভয় হ্যারিকে যেন পেছনে থেকে ছোরা মারল। ও দেখল মুডি মরেডারস মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। মানচিত্রটা ওর থেকে ছটা–স্টেপ পরে পড়ে রয়েছে। স্নেইপ, ফিলচচের দৃষ্টি পড়বার আগেই হ্যারি ওর রোব দিয়ে হাওয়া করে মানচিত্রটা উড়িয়ে দিতে চাইল, সাথে সাথে মুডির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাইল, ওটা আমার। নিজস্ব!
স্নেইপ হাত বাড়িয়ে মানচিত্রটা নিতে গেলেন, চোখেমুখে চোর ধরে ফেলেছি এমন এক কেল্লাফতের ছাপ!
এসিও পার্চমেন্ট!
মানচিত্রটা হাওয়াতে ওপরে ওঠে স্নেইপের আঙ্গুল সামান্য ছুঁয়ে মুডির হাতে এল।
–তাইত… কখন যে আমার পকেট থেকে এটা পড়ে গেছে… আহাঃ আমার জিনিস আমি পেয়ে গেছি।
কিন্তু স্নেইপের কাল চোখ মুডির হাতের মানচিত্র আর ফিলচচের কাছে সোনার ডিমের দিকে।
স্নেইপ দুই আর দুইতে চার হয় সেটা ভাল করে জানে…।
–পটার…, যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে বলল।
মুডি মানচিত্রটা মুড়ে পকেটে রাখতে রাখতে বলল,–কী ব্যাপার… কী আবার হল?
পটার! স্নেইপ ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল… যেখানে হ্যারি দাঁড়িয়ে পা–আটকে সেইদিকে তাকাল… যেন হঠাৎ ওকে দেখতে পেয়েছে।
–ওই ডিমটা পটারের, ওই পার্চমেন্টের মানচিত্রটাও পটারের। আমি ওটা আগে দেখেছি, দেখেই বুঝতে পেরেছি! আমি হলফ করে বলতে পারি পটার এখানে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, ওর গায়ে অদৃশ্য হবার আলখাল্লা রয়েছে!
অন্ধরা যেমন হাত বাড়িয়ে চলে তেমনি ভাবে ও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল, হ্যারি দেখতে পাচ্ছে ওর বড় আকারের নাকটা ফুলে ফুলে উঠছে, হ্যারিকে ওঁকে শুকে ধরার জন্যে। হ্যারি একটু পিছনে হেললো… যাতে স্নেইপের হাত ও পায়ে না লাগে। কিন্তু যেরকমভাবে হাত বাড়াচ্ছে যে কোন সময়ে ছুঁয়ে ফেলতে পারে।
মুডি বেশ জোরে বললেন, আহাহা স্নেইপ কি পাগলের মতো হাত বাড়িয়ে ঘুরছ, ওখানে কেউ নেই, থাকলে ব্যাপারটা আমাকে হেড মাস্টারকে জানানো আমার কর্তব্য (অন্যায় খোঁজার ব্যাপারে)। তুমি কোনো কিছু না জেনে, না বুঝে হ্যারি পটার, হ্যারি বলে ধেই ধেই করে নেচে চলেছে! দরজা ভাঙা আর ডিম পড়ার সঙ্গে হ্যারি পটারের কি সম্পর্ক, আমি বুঝতে পারছি না।
–বুঝতে পারছেন না? স্নেইপ আবার ঘোৎ ঘোঁৎ করে হাত দুটো বাড়ালেন… হাতটা প্রায় হ্যারির বুকে এসে লাগে এমন অবস্থা!
–মানে? মানে খুব সহজ! ডাম্বলডোর জানতে চান অকারণে কারা ওর পেছনে লেগেছে, মুডি অসহিষ্ণু হয়ে বললেন…. খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওর কাছে গেলেন (মুডি ম্যাজিক আই দিয়ে দেখতে পান সবই)–স্নেইপ কর্তব্য পালনে আমি খুবই উদগ্রীব।… টর্চলাইটের আলো ফেললেন নিজের কাটা–ছেঁড়া মুখের ওপর যাতে নাকের কাছে অপকৃত মাংস পিণ্ড আর কাটা দাগ আরও প্রকট ভাবে দেখা যায়।
স্নেইপ থতমত খেয়ে মুডির মুখের দিকে তাকালেন… হ্যারি স্নেইপের মুখের ভাব দেখতে পেলো না। দুজনেই নিশ্চল, নির্বাপণ স্নেইপ তারপর ওর হাত নামিয়ে নিলেন।
বললেন–আমি ভেবেছিলাম (গলার শব্দ হঠাৎ শান্ত হয়ে গেছে) পটার হয়ত এখানে ঘোড়াফেরা করছে, রাতের অন্ধকারে করিডলরে করিডলবে ঘোরা ওর বিশ্রী স্বভাব, আগেও করত, ওকে এইসব করতে দেওয়া ঠিক হবে না প্রফেসর মুডি… ওর সুরক্ষার জন্যই…।
তাই, মুডিও নরম সুরে বললেন, ওহো আপনি যে পটারকে এত ভালবাসেন, ওর মঙ্গল চান… আগে জানতাম না প্রফেসর। সত্যি আপনি কী অন্তর থেকে চান?
সামান্য সময় দুজনেই চুপচাপ রইলেন। দুজনেই দুজনের দিকে তখনও তাকিয়ে। ঘটনাস্থলে মিসেস নরিস এসে হাজির। বিকটভাবে বেড়ালের ম্যাও… ও, ডাক দিলেন। কিন্তু কোথা থেকে তার নাকে আসছে হ্যারির গায়ের গন্ধ। গন্ধটা স্নেইপের পায়ের কাছ থেকে আসছে কেন?
স্নেইপ কাটাকাটা গলায় বলল,–আমি শুতে চললাম।
–খুব ভাল, খুব ভাল, সারারাত শুয়ে শুয়ে ভাবুন, প্রফেসর মুডি বললেন।… ফিলচ তুমি কী ডিমটা আমায় দেবে?
–না! ডিমটা এমন ভাবে বুকে চেপে রেখে বলল যেন ওটি তার প্রথম সন্তান!–প্রফেসর মুডি… এটা পিভসের বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ।
–আমি জানি ডিমটা চ্যাম্পিয়নের প্রপার্টি, কেউ চুরি করেছে, ওটা আমাকে দিয়ে দাও, মুডি বললেন।
বিনা বাক্যব্যয়ে ডিমটা মুডির হাতে তুলে দিল ফিলচ। ফিলচ নরিসকে দেখে খুব খুশি হয়েছে, এমন এক আনন্দ প্রকাশ করে মিসেস নরিসের দিকে তাকাল। মিসেস নরিস অদৃশ্য হ্যারির দিকে তাকালেন (যদিও সে অদৃশ্য)–দু এক সেকেন্ড বা ওই রকম। তারপরই চলে গেলেন। ফিলিচও সেখান থেকে চলে গেলেন। মিসেম নরিসকে খুশি করার জন্য বললেন,–ভেব না সকালেই আমি প্রফেসর ডাম্বলডোরকে বিষয়টা অবশ্যই জানাব। বলতে হবে পিভস কেমনভাবে কাজকর্ম ঢিলে–ঢালাভাবে করছে। খুব জোড়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করার শব্দ শোনা গেল। মুডি ওর জিনিসগুলো শেষ সিঁড়ির ধাপে রেখে পা–টেনে টেনে খুব পরিশ্রম করে হ্যারি যেখানে আটকা পড়ে ছিল সেখানে এলেন।
বললেন–আজ খুব বেঁচে গেলে পটার! আমি কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। হ্যারি তো তো করে বলল… ও হাঁ… আপনার জন্যই–ধন্যবাদ।
-এটা কী পটার? মুডি পকেট থেকে মানচিত্রটা বের করে খুলতে খুলতে বললেন।
–হোগার্টের মানচিত্র, হ্যারি বলল। ও আশা করেছিল মুডি ওর আটকে যাওয়া পাকে রেলিং থেকে মুক্ত করবেন। ওর পায়ে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে।
–মেরিলিনের দাড়ি, মুডি চাপাগলায় বললেন। চোখ কিন্তু তার হ্যারির যন্ত্রণাকাতর মুখের দিকে। মনে হচ্ছে কোন গুরুত্বপূর্ণ মানচিত্র পটার। মুডির ম্যাজিক্যাল আই বন বন করে ঘুরতে লাগল।
–হ্যাঁ, খুবই দরকারী, হ্যারি বলল।–প্রফেসর মুডি আমার একটা পা রেলিংয়ে আটকে রয়েছে, আপনি কী খুলে দিতে সাহায্য করবেন?
–কী বললে? ও হ্যাঁ হ্যাঁ কেন পারবো না, অবশ্যই…।
মুডি, হ্যারির হাত ধরে টান দিলেন। হ্যারির পা খুলে গেল। ওরা সিঁড়ির এক ধাপ ওপরে উঠল।
মুডির চোখ তখনও পটারের সেই আজব মানচিত্রে!–পটার… মুডি খুব আস্তে বললেন…, তুমি কী বলতে পার কে স্নেইপের অফিস ঘরের দরজা ভেঙ্গে ঢুকেছে? আমি বলছিলাম মানে এই মানচিত্রটা তো তুমি দেখেছ।
–হ্যাঁ বলতে পারি। মি. কাউকে দেখেছি।
মুডির ম্যাজিক্যাল আই মানচিত্রের ওপর বন বন করে ঘুরতে লাগল। দেখতে দেখতে আকস্মাৎ একটু যেন শঙ্কিত হলেন।
–ক্রাউচ?… তুমি ঠিক বলছ? তুমি কি নিশ্চিত পটার?
–কোনও সন্দেহ নেই, হ্যারি বলল।
–না ওকে তো এখন দেখতে পাচ্ছি না, ক্রাউচ? খুবই রহস্যজনক বলতে হবে। মুডি একাগ্রচিত্তে সামনে রাখা মানচিত্রটা দেখতে লাগলেন। হ্যারি পরিষ্কার বুঝতে পারলো ক্রাউচের নাম বলাতে মুডি বেশ দ্বিধায় পড়ে গেছেন। কি ভাবছেন খুবই জানতে মন চাইল। ভাবল, জিজ্ঞেস করা সমীচিন হবে কিনা। সন্দেহ নেই ক্রাউচের নাম বলাতে খুব চিন্তিত। তাহলেও ওকে এই মাত্র তিনি একটা দারুণ অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত করেছেন।
–আচ্ছা প্রফেসর মুডি, আপনার কী মনে হয়, কেন ক্রাউচ গভীর রাতে স্নেইপের ঘরে সিল ভেঙ্গে ঢুকেছিলেন?
মুডির ম্যাজিক্যাল আই মানচিত্র ছেড়ে হ্যারির মুখে দিকে ঘুরতে লাগল।
অদ্ভুত গভীর এক দৃষ্টি! সেই দৃষ্টি দেখে হ্যারির মনে হলো মুডি হয়ত ভাবছেন বলবেন কি বলবেন না। বললেও কতটা বলবেন।
–বুঝে নাও পটার, মুডি শেষ পর্যন্ত নীরবতা ভঙ্গ করলেন। তারপর বললেন, লোকদের ধারণা বুড়ো ম্যাড আই-এর কালজাদুকরদের ধরা পারা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই।… বার্তি ক্রাউচের কাছে ম্যাড আই শিশু।
তখন তিনি মানচিত্রটা তন্নতন্ন করে দেখছেন। হ্যারি কিছু জানার জন্য ছটফট করতে লাগল।
–প্রফেসর মুডি…, হ্যারি বলল, আপনি কি মনে করেন কিছু অমঙ্গল হতে পারে… চক্রান্ত চলছে… ক্রাউচ।
–হ্যাঁ হ্যাঁ সেই রকমই কিছু, মুডি তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন। তুমি জান? হ্যারি ভাবল প্রশ্নটা করে ও বাড়াবাড়ি করেনি তো! মুডি তো মনে করেন না হোপার্টের বাইরে কোনও সংবাদটংবাদ রাখে? কথার প্রসঙ্গে হয়ত সিরিয়াসও এসে যেতে পারেন।
–আমি কিছু জানি না, হ্যারি বলল!–মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তাই বলছিলাম। ডেইলি ফেটেও খবর বেরোচ্ছে… কাল মার্ক… ওয়ার্ল্ড কাপের সময়, তারপর ডেথইটার… আরও কি সব মুডির দুটি চোখই বড় বড় হয়ে উঠল।
–পটার তুমি অতি বুদ্ধিমান ছেলে, মুডির ম্যাজিক্যাল আই আবার মানচিত্রের ওপর পড়ল।–ক্রাউচও হয়তো ওইরকম কিছু চিন্তা করেন। ওই রিটা স্কীটার নানারকম লিখছে শুধু নয় রটিয়ে বেড়াচ্ছে, সেই সব কারণে লোকেদের উৎকণ্ঠিত হওয়া স্বাভাবিক। কথাটা বলে মুডি মুচকি হাসলেন। তারপরই মানচিত্রের বা দিকের কোণে তাকালেন। বললেন, দেখছি একজন ডেথইটার যততত্র অবাধে ঘুরছে।
হ্যারি মনে একই প্রশ্ন
–হ্যাঁ শোন পটার, আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই, মুডি বললেন। হ্যারি জানে, প্রশ্নটি, মানচিত্র (মারউডের ম্যাপ) কোথা থেকে ও পেয়েছে। মানচিত্রটি জাদুকরদের কাছে খুবই প্রয়োজনীয় অস্ত্র বলা যায়। সে এক ঘটনা… কেমন করে ওর হাতে এসেছে। দোষী সে একা নয়, ওর বাবা, ফ্রেড ও জর্জ, উইসলি প্রফেসর লুপিন (ওদের কাল আর্টসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শিক্ষক) সকলেই দোষী মুডি প্রশ্ন করে মরাউডার মানচিত্র হ্যারির মুখের সামনে ঘোরাতে লাগলেন। এটা কী তুমি কিছুদিনের জন্য আমাকে ধার দিতে পারবে পটার?
মানচিত্রটি হ্যারির অত্যন্ত প্রিয়। তাহলেও স্বস্তিপেল এই কথা ভেবে যে, কোথা থেকে মানচিত্রটা ও পেয়েছে মুডি এ কথাটা জিজ্ঞেস করেনি বলে। করলে তো আরো বিপদে পড়ত।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।
–খুউব ভাল ছেলে তুমি, মুডি ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বললেন। আমি এটার সদ্ব্যবহার করতে পারব। অনেক দিন থেকে এই রকম একটার খোঁজে ছিলাম। ঠিক আছে পটার, এখন তুমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা মুডির অফিস ঘরের সামনে দাঁড়াল।
মুডি হ্যারির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–তুমি অরর (একরকম উচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা) হতে চাও?
–না, হ্যারি আশ্চর্য হয়ে বলল।
–ভেবে দেখ… ও হ্যাঁ, আমি ভাবছি, ওই ডিমটা তুমি শুধু শুধু নিয়ে যাওনি নিশ্চয়ই তোমার কোনো কাজ ছিল… আমি কী সত্যি বলছি?
–না, শুধু শুধু নয়। আমি কু বের করবার চেষ্টা করে চলেছি। মানে সেকেন্ড টাস্কের কু। ওই ডিম থেকে পাওয়া যাবে…।
–সেই কাজটা রাত্রে করিডলরে ঘুরে–ফিরে করতে হবে? আচ্ছা আবার কাল সকালে দেখা হবে।
মুডি মরেডার মানচিত্র খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
হ্যারি স্নেইপ ও ক্রাউচের কথা ভাবতে ভাবতে গ্রিফিন্ডর টাওয়ারের দিকে চলল। এসবের মানে কী, ক্রাউচ কেন অসুস্থতার ভান করছেন। হোগার্টে তো তার অবাধগতি। লুকিয়ে রাত্রে আসার তো দরকার ছিল না। স্নেইপ তার ঘরে কি লুকিয়ে রেখেছেন, কেন ভেবেছেন? সেটা কী?
মুডিই বা হঠাৎ ওকে অরোর (তালাশি গোয়েন্দা) হতে উপদেশ দিলেন কেন? উপদেশটা খুবই লোভনীয় সন্দেহ নেই। ও নিজের ঘরে এসে আলখেল্লা আর ডিমটা ট্রাঙ্কে খুব সাবধানে রেখেদিল।
ভাবলো–ও যদি বলে অরোর হতে চায়, তাহলে বন্ধুদের মনোভাবটা কি হবে, এটা ভাবার চেষ্টা করল।