পঁচিশ
এখন দুপুর। দুটো গাড়ি ছুটে যাচ্ছিল শহর থেকে পাহাড়ি পথ ধরে। প্রথমটি জিপ। সামনের আসনে ড্রাইভারের পাশে ভার্গিস চুরুট মুখে। অত্যন্ত বিরক্ত এবং সেইসঙ্গে চিন্তিত। পেছনে আসছিল পুলিশের ভ্যান। সেখানে আটজন পুলিশের মাঝখানে ডেভিড রয়েছে। ভ্যানের বাইরে থেকে আরোহীদের বোঝা যাচ্ছিল না।
ভার্গিসের বিরক্তি এইভাবে শহরের বাইরে আসতে হচ্ছে বলে। কদিন থেকে বিশ্রাম শব্দটাকে তিনি প্রায় ভুলতেই বসেছেন। সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না এখন। কিন্তু তাঁর মনে হয়েছিল এইসময় শহরে থাকা দরকার। অ্যাম্বুলেন্সটার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু তার ড্রাইভার এবং অফিস জানিয়েছে লেডি প্রধান অসুস্থ খবর আসায় অ্যাম্বুলেন্সটি রাস্তায় বেরিয়েছিল। বৃদ্ধা মহিলা অসুস্থ হতেই পারেন এবং হয়েছেন। তার প্রমাণও বেরোবার আগে তিনি পেয়েছেন। অতএব অ্যাম্বুলেন্সটিকে নিয়ে বেশি দূর ভাবা যাচ্ছে না। হঠাৎ ভার্গিসের খেয়াল হল, লেডি প্রধানের মতো বিত্তশালিনী বৃদ্ধা হাসপাতালে যাওয়ার জন্যে কেন অ্যাম্বুলেন্সকে তলব করবেন? তাঁর নিজের গাড়িই তো রয়েছে। বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলা দরকার। ওঁর বাড়ির লোকদের জেরা করলে জানা যাবে সত্যি কেউ অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে ফোন করেছিল কিনা! ভার্গিস তৎক্ষণাৎ হেডকোয়ার্টার্সের সঙ্গে ওয়ারলেসে যোগাযোগ করে এই তদন্তটি করে ফেলার নির্দেশ দিলেন। সময় বেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ ডেডবডির কোনও পাত্তা নেই।
ডেভিডকে নিজের গাড়িতে নিয়ে আসা হয়তো উচিত ছিল কিন্তু ঝুঁকি নিতে চাননি তিনি। কে বলতে পারে ওর বন্ধুরা শহরের বাইরে তার ওপর চড়াও হতে চেষ্টা করবে না। অবশ্য ভ্যানটাকে তিনি বাংলোর বেশ কিছুটা দূরেই রেখে দেবেন।
চিন্তাটা অন্য কারণে। বাবু বসন্তলালের বাংলোয় ডেভিডকে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন ম্যাডাম। কেন? তালেগোলে ওখানকার কথা মাথায় ছিল না ভার্গিসের। সেই সার্জেন্ট আর চৌকিদারটা এখনও বাংলোতেই আছে। বাবু বসলালের খুনি চৌকিদারটাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে তাঁকে। ম্যাডাম জানেন লোকটা পলাতক। ওকে কিছুতেই ম্যাডামের সামনে আসতে দেওয়া যাবে না। মিনিস্টারকে যেমন ম্যাডাম আটকাতে পারেন ঠিক তেমনি ম্যাডামের ওঝা হবে ওই চৌকিদারটি। হেডকোয়ার্টার্স থেকে বের হবার আগে তিনি নিজস্ব টেলিফোনে কয়েকবার চেষ্টা করেছেন বাংলোর সার্জেন্টকে ধরতে। ওখানে সমানে রিং হয়ে গিয়েছে। কেউ রিসিভার তোলেনি।
মূল রাস্তা ছেড়ে গাড়ি দুটো প্রাইভেট লেখা পথটায় ঢুকল। খানিকটা যাওয়ার পর বাঁক নেবার মুখে ভার্গিসের নির্দেশে তারা থামল। ভার্গিস চারপাশে দেখে নিলেন। কোথাও কোনও শব্দ নেই। হাওয়ারা গাছের পাতায় ঢেউ তুলে যাচ্ছে সমানে। পাহাড়ের এই সৌন্দর্য দেখার মন বা সময় ভার্গিসের নেই। তিনি চিতাটার কথা মনে করলেন। এই দিনদুপুরে নিশ্চয়ই সেটা এখানে অপেক্ষা করবে না আক্রমণের জন্যে।
ভার্গিস হেঁটে ভ্যানের সামনে পৌঁছালেন। আদেশ দিলেন বন্দিকে নামিয়ে দিতে। ডেভিডকে নামানো হল। ওর হাতকড়ার দিকে একবার তাকালেন তিনি। ওটা থাক। ঝুঁকি নেবার কোনও মানে হয় না। সবাইকে ওখানেই অপেক্ষা করতে বলে ডেভিডকে জিপে তুলে ড্রাইভারকে সরিয়ে নিজেই স্টিয়ারিং-এ বসলেন। ডেভিডের মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল। ব্যান্ডেজে ইতিমধ্যে লাল ছোপ এসেছে। সে ভার্গিসকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’
‘গেলেই দেখতে পাবে। এতক্ষণে তোমার ছাল চামড়া ছাড়িয়ে নেবার কথা। কপাল করে জন্মেছিলে বলে আমার পাশে বসে যেতে পারছ।’ ভার্গিস চুরুট চিবোলেন।
ডানদিকে বাঁক ঘুরতেই জিপ চালাতে চালাতেই ব্রেকে পা দিলেন ভার্গিস। তার বুক ধক করে উঠল। নীচে ঢালু পথটার শেষের মাঠের গায়ে বাংলোর সামনে একটা সাদা টয়োটা দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে ম্যাডাম ইতিমধ্যেই এখানে পৌঁছে গিয়েছেন। থুক্ করে থুতু ফেলতেই ভার্গিসের মুখ থেকে চুরুটটা ছিটকে বাইরে গিয়ে পড়ল। সর্বনাশ হয়ে গেল। এখন যা হবার তাই হবে। ম্যাডাম নিশ্চয়ই সাতসকালে এখানে এসে এখান থেকেই তাঁকে টেলিফোন করেছিলেন। তিনি যখন সার্জেন্টকে টেলিফোনে খুঁজেছেন তখন ওঁর নির্দেশেই কেউ রিসিভার তোলেনি। অথাৎ ওঁকে লুকিয়ে চৌকিদারকে পাহারা দেবার জন্যে যে তিনি এখানে একজন সার্জেন্টকে পাঠিয়েছেন তা ইতিমধ্যে ম্যাডাম জেনে গেছেন।
‘ভার্গিস ধীরে ধীরে বাংলোর সামনে জিপটা রাখতেই ম্যাডামকে দেখতে পেলেন। ওপাশে একটা বেতের চেয়ারে বসে আছেন টেবিলে দুই পা তুলে। চোখে বড় সানগ্লাস। গাড়ির শব্দে চোখ ফেরালেন না। ভার্গিস জানেন ম্যাডাম এখানে একা আসেননি। ওঁর দেহরক্ষী কাম ড্রাইভার নিশ্চয়ই ধারে-কাছে আছে।
ভার্গিস জিপ থেকে নেমে কাছে এগিয়ে গেলেন, ‘গুড আফটারনুন ম্যাডাম!’
ম্যাডামের মাথা ঈষৎ নড়ল। পা না সরিয়ে তিনি বললেন, ‘বসন্তলালের পছন্দ ছিল। জায়গাটা দারুণ!’
ভার্গিস কি বলবেন ভেবে পেলেন না। এই সময়ে জায়গার তারিফ করা কেন? তিনি মুখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন চারপাশ। সার্জেন্ট কিংবা চৌকিদারটাকে দেখা যাচ্ছে না। ম্যাডাম কি বাংলোর ভেতরে ঢুকেছেন? বারান্দার ওপাশে দরজাগুলো এখন বন্ধ।
‘আপনি অবশ্য এসব কোনও দিন বুঝলেন না।’ ম্যাডাম পা নামালেন। চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘মিস্টার ভার্গিস, আপনার জীবনে শুনেছি কখনওই রোমান্স আসেনি!’
ভার্গিসের গলা বুজে এল, ‘আসলে, ম্যাডাম, সার্ভিসে ঢুকেছিলাম অল্প বয়সে। এটাই মন দিয়ে করতে করতে কখন যে বয়স হয়ে গেল তা বুঝতে পারিনি।’
‘কত বয়স আপনার?’
‘ফিফটি ফোর।’
‘বোম্বেতে শুনেছি ওই বয়সের অভিনেতা নায়ক হয়। আপনি শোনেননি?’
‘আমি মানে, ফিল্ম সম্পর্কে কিছুই জানি না।’ ভার্গিস স্বীকার করলেন।
‘আকাশলালকে ওরা কবর থেকে তুলে কিভাবে সরাল?’
হঠাৎই ম্যাডাম কাজের কথায় চলে আসায় ভার্গিস সোজা হলেন, ‘আমরা সন্দেহ করেছিলাম অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কারফিউ-এর সময় অন্য গাড়িকে রাস্তায় অ্যালাউ করা হয় না।’
‘শহরে যে-কটা অ্যাম্বুলেন্স আছে খোঁজ নিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ। যে অ্যাম্বুলেন্সটিকে আটকানো হয়েছিল সেটা নাকি লেডি প্রধানের কল পেয়ে গিয়েছিল। ভদ্রমহিলা খুবই অসুস্থ।’
‘লেডি অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে যাবেন, এটা ভাবতে পারেন?’
‘না ম্যাডাম। কিন্তু লেডির সঙ্গে কথা বলা যাবে না এখন। ওঁর বাড়ির লোকদের জেরা করার অর্ডার দিয়ে এসেছি।’
‘গুড। লোকটাকে এনেছেন?’
‘হ্যাঁ। আমার জিপে আছে।’
‘নিয়ে আসুন এখানে।’
ভার্গিস ফিরে গেলেন জিপের পাশে। ডেভিডকে হুকুম করলেন নেমে আসতে। ডেভিড ভদ্রমহিলাকে লক্ষ করছিল। এখানে তাকে কেন নিয়ে আসা হয়েছে তা সে বুঝতে পারছিল না।
ডেভিড কাছে যেতেই ম্যাডাম উঠে দাঁড়ালেন, ‘হ্যালো! আপনি ডেভিড?’
‘হ্যাঁ।’
‘বসুন। মিস্টার ভার্গিস, আমরা কি কথা বলতে পারি?’
‘অ্যাঁ?’ ভার্গিস প্রথমে বুঝতে পারেননি।’
‘আমরা একটু কথা বলতে চাই। আপনি ততক্ষণে জায়গাটাকে দেখুন। বলা যায় না এই ফিফটি ফোরেও নতুন করে সব কিছু শুরু করতে পারেন।’ ম্যাডাম শব্দ করে হাসলেন।
অর্থাৎ ওঁকে সরে যেতে বলা হচ্ছে। এটা বেআইনি। ম্যাডাম সরকারের কেউ নন। তাঁর সঙ্গে এত বড় অপরাধীকে একা রেখে যাওয়ার জন্যে তাঁকে জবাবদিহি দিতে হতে পারে। কিন্তু একথাও ঠিক, ম্যাডাম ছাড়া তাঁর কোনও অবলম্বন নেই। ভার্গিসের মনে হল তাঁর সামনে একটা সুযোগ এসেছে। হাতকড়া থাকায় ডেভিডের পক্ষে পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু তিনি এই ফাঁকে বাংলোটাকে সার্ভে করে নিতে পারেন। যদি সার্জেন্ট চৌকিদারকে নিয়ে এর ভেতরে লুকিয়ে থাকে তাহলে তাদের সরাবার ব্যাবস্থা করতে পারবেন।
ভার্গিস হাঁটতে শুরু করলে ম্যাডাম বললেন, আপনাকে বসতে বলেছি।’
ডেভিড বসল। এতক্ষণে সে ভদ্রমহিলাকে চিনতে পেরেছে। এই রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাবতী মহিলা। এঁর আঙুলের ইশারায় সব কিছু হতে পারে।
ম্যাডাম চেয়ারে বসে বললেন, ‘আকাশলালকে নিয়ে গিয়ে কি করবেন?’
‘আমি জানি না।’
‘আমি জানি।’
‘তার মানে?’
‘কোনও মৃত মানুষকে নতুন করে কবর দেবার জন্যে কেউ এমন ঝুঁকি নেয় না।’
‘আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।’
‘ঠিক আছে, আপনি চাইলে আমি বুঝিয়ে দেব। তার আগে বলুন আমাদের মধ্যে কি ধরনের সম্পর্ক হবে? আপনি আমার বন্ধুত্ব চান?’ ঠোঁটের কোণে মদির ভাঁজ ফেললেন ম্যাডাম। ধরা পড়ার পর থেকে এতক্ষণ যেভাবে কেটেছে, এই মুহূর্তটি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ওই হাসিটি ডেভিডকে বেশ নাড়া দিল। তবু সে বলল, ‘বন্ধুত্ব সমানে সমানে হয়।’
‘ঠিক কথা। আর হয় নারী এবং পুরুষে। তাই না?’ এবার হাসিটা আরও একটু জোরে।
বাংলোর বারান্দায় উঠেও সেই হাসি শুনতে পেলেন ভার্গিস। মেয়েমানুষটার মতলব কি? এত হাসি ওরকম একটা দেশদ্রোহীর সঙ্গে কিভাবে হাসছে? মানুষ যদি হাসি শুনেই পেটের সব কথা উগরে দিত তাহলে টরচার-শেল তুলে দিতে হত বাহিনী থেকে।
ভাঙা কাচের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন ভার্গিস। চাপ দিলেন কিন্তু ওটা খুলল না। অতএব ভাঙা জায়গা দিয়ে হাত ঢোকাতে ছিটকিনি পেয়ে গেলেন। যে কেউ বাইরে এসে এইভাবে দরজা বন্ধ করে চলে যেতে পারে। ভার্গিস ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। লনের দুটো মানুষ এখন নিজেদের কথা নিয়ে ব্যস্ত। তিনি দরজাটা ভেতরে ঢুকেই বন্ধ করে দিলেন।
বাইরে তবু হাওয়ার শব্দ ছিল, ভেতরে কোনও আওয়াজ নেই। ভার্গিস জানেন ওরা এখানেই লুকিয়ে আছে। হয়তো ম্যাডাম এসেছেন বলেই সামনে আসতে পারছে না। তিনি চাপা গলায় ডাকলেন, ‘অফিসার!’ কেউ সাড়া দিল না।
ভার্গিস ধীরে ধীরে ঘরটি অতিক্রম করলেন। জানলাগুলোর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর চোখ বাইরে লক্ষ করছিল। ম্যাডাম এবং ডেভিড কথা বলছে। ভার্গিস হাসলেন। ম্যাডামের শরীরে এখনও ওই কিসব বলে, সেসব আছে। কিন্তু লনের চেয়ারে বসে কথা বললে ডেভিড কতটা কাত হবে?
দ্বিতীয় ঘরটি ডাইনিং কাম স্টোর রুম। লুকোবোর জায়গা নেই। তৃতীয় ঘরটিতে একটা ন্যাড়া তোশক রয়েছে খাটের ওপরে। ঘরটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। অ্যাসট্রেতে প্রচুর সস্তার সিগারেটের অবশিষ্ট। ঘরের একপাশে টেবিল চেয়ার। ভার্গিস টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। কয়েকটা পেপারওয়েট আর একটা কলমদানি ছাড়া টেবিলে কিছু নেই। লোক দুটো গেল কোথায়? ম্যাডামকে দেখে জঙ্গলে পালিয়ে যায়নি তো? যেতে পারত যদি সার্জেন্ট একা থাকত। চৌকিদারটা তো সহজে যেতে চাইবে না। ওর মস্তিষ্ক ঠি্কঠাক নেই। ভার্গিস ড্রয়ার টানলেন। কয়েকটা কাগজ, একটা ডটপেন এবং হাতঘড়ি চোখে পড়ল। ঘড়িটাকে তুলে নিলেন ভার্গিস। ঠিক সময় দিচ্ছে। সাধারণ ঘড়ি, নিত্য দম না দিলে যে ঘড়ি বন্ধ হয়ে যায় এটি সেই রকমের। ব্যান্ড চামড়ার। নাকের কাছে ধরতে ঘামের গন্ধ পেলেন। এবং তার পরই খেয়াল হল গতবছর বাহিনীর সব পুলিশ অফিসারকে বোর্ড একটা করে হাতঘড়ি দিয়েছিল। ওপরের অফিসাররা দামি ঘড়ি পেয়েছিলেন। নীচের তলায় এইরকম ঘড়ি দেওয়া হয়। অর্থাৎ ঘড়িটি এখানে সার্জেন্ট রেখেছে। দম দেওয়া হয়েছে গত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। আর তার একটাই অর্থ সে এখানে ছিল এবং এখনও আছে। ভার্গিস চাপা গলায় ডাকলেন, ‘সার্জেন্ট!’
দরজা জানলা বন্ধ থাকায় নিজের গলা আরও মোটা এবং জড়ানো বলে মনে হল ভার্গিসের। ব্যাটা গেল কোথায়? তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ঘড়িটা পকেটে পুরে। এপাশে একটা ছোট দরজা। ঠেলাঠেলি করতে সেটাও খুলল। ভার্গিস দেখলেন নীচে সিঁড়ি চলে গেছে এবং নীচের তলায় আলো জ্বলছে। আচ্ছা। সার্জেন্টের লুকিয়ে থাকার জায়গা আবিষ্কার করে ভার্গিস খুশি হলেন। মাটির নীচের ঘরেই বাবু বসন্তলালের কফিন ছিল। নিজের রিভলভারটাকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে নিয়ে ভার্গিস তাঁর ভারী শরীর কাঠের সিঁড়িতে রাখলেন। ঠক্ ঠক্ শব্দ হচ্ছে। নীচের ঘরে বোটকা গন্ধ। তিনি নীচে নামামাত্র শব্দ হতে লাগল। একটা ছোট কাঠের টুকরো যেন পড়ে গেল। ভার্গিস রিভলভার বের করে ডাকলেন, ‘সার্জেন্ট। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ম্যাডাম এখনই চলে যাবেন। বেরিয়ে আসুন। কুইক।’
আর একটা আওয়াজ হল। ভার্গিস মুখ ফিরিয়ে দেখতে পেলেন দুটো ধাড়ি ইঁদুর ছুটে গেল পাশ দিয়ে। এত বড় ইঁদুর সচরাচর দেখা যায় না। তিনি কয়েক পা এগিয়ে ঘরটিকে দেখলেন। পুরনো আসবাব ডাঁই করে রাখা আছে এখানে। মাকড়সার জাল ছিল একসময়। এখন তার কিছু কিছু এখানে ওখানে ঝুলছে। টেবিলের ওপর একটা কফিন পড়ে আছে। এই কফিনটির কথা তিনি জানেন। বাবু বসন্তলালের মৃতদেহ মাটির নীচের ঘরে একটি কফিনে রাখা ছিল। মনে হচ্ছে এটিই সেই কফিন। তিনি এগিয়ে যেতেই কফিনের ভেতর থেকে স্রোতের মত ইঁদুরের দল বাইরে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়তে লাগল। ভার্গিসের মতো মানুষও একটু ভয় পেয়ে গেলেন কাণ্ড দেখে। রিভলভারের গুলি দিয়ে ইঁদুর মারার মতো কাজ যদি তাঁকে করতে হয় তাহলে লজ্জার শেষ থাকবে না। কিন্তু এদের কাণ্ড এবং সাহস দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। ভার্গিস বুঝতে পারলেন কফিনে কিছু না থাকলে ওর ভেতর ইঁদুরদের আকর্ষণ থাকত না। তিনি আর একটু এগিয়ে মুখ নামাতে গিয়ে চমকে উঠলেন। সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। তাঁর মতো জাঁদরেল পুলিশ অফিসারের পেট গুলিয়ে উঠল দৃশ্যটা দেখে। দ্রুত, প্রায় ছিটকে সিঁড়ির কাছে চলে এলেন তিনি। নিজের শরীরটাকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে ওপরে তুলে এনে শোওয়ার ঘরের চেয়ারে ফেলে দিলেন। যদিও সাধারণ মানুষের চেয়ে তাঁর অনেক কম সময় লাগল সামলে নিতে, তবু দৃশ্যটা তিনি ভুলতে পারছিলেন না। সরকারি ইউনিফর্ম পরা সার্জেন্ট শুয়ে আছে কফিনের মধ্যে। চিত হয়ে। ইতিমধ্যেই ইঁদুরেরা ওর শরীরের খোলা জায়গা থেকে মাংস খুবলে নিয়েছে। প্রথম আক্রমণ ওরা করেছে চোখ এবং ঠোঁটের ওপর। চোখের গর্ত দুটো আর মুখের ভেতরে রক্তাক্ত গহ্বর দেখতে পেয়েছেন তিনি। হ্যাঁ, এখনও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চটচটে রক্ত রয়েছে। কালো জমাট হবার সময় পুরোটা পায়নি।
ভার্গিস উঠে দাঁড়ালেন। সার্জেন্টকে খুন করা হয়েছে। এবং ওই ঘটনা ঘটেছে আজ সকালের মধ্যেই। খুন করে কফিনে শুইয়ে দিয়েছে আততায়ী। এখনই হেডকোয়ার্টার্সে টেলিফোন করে এক্সপার্টদের এখানে আনা দরকার। তিনি পা ফেলে জানলার কাছে আসতেই তাঁর চোখ লনের ওপর গেল। ম্যাডাম কথা বলছেন। ডেভিডের মুখ নিচু।
সঙ্গে সঙ্গে ভার্গিসের খেয়াল হল। সার্জেন্ট কেন এখানে এসেছিল এই কৈফিয়ত যদি তাঁর কাছে চাওয়া হয় তাহলে তিনি কি জবাব দেবেন? ওকে তিনিই পাঠিয়েছিলেন এই বাংলোয় তা আর কি কেউ জানে? না। চটজলদি কিছু করার দরকার নেই। তিনি জানেন না, কিছুই দেখেননি। নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন ভার্গিস। কোনওভাবেই তিনি ম্যাডামের কাছে ধরা পড়তে রাজি নন।
কিন্তু এত বড় খুন করল কে? একটা আধাপাগল চৌকিদার এমন কাজ করবে তা তিনি বিশ্বাস করেন না। তাঁর মনে পড়ল সার্জেন্ট যখন চৌকিদারের সঙ্গে কথা বলার পর তাঁকে টেলিফোন করেছিল তখন কিছু সাক্ষী থেকে গিয়েছিল। থাকগে। কিছু কিছু ব্যাপার উপেক্ষা করতেই হয়। কিন্তু খুনি কে? যে-ই হোক তাকে তিনি ছাড়বেন না কিছুতেই।
ভার্গিস সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে বারান্দায় পা রাখলেন। তাঁর কানে এল ম্যাডাম বলছেন, ‘ধরুন আমি যদি প্রচার করি আপনি আমার কাছে, পুলিশের কাছে সব কথা ফাঁস করে দিয়েছেন তাহলে আপনার দলের লোকেরা সেটা কি অবিশ্বাস করবে?’
‘হ্যাঁ, করবে।’
‘না। করবে না। আকাশলাল মারা যাওয়ার আগেই সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল। তার শরীর যখন কবর দেওয়া হচ্ছিল তখন আপনারা সুড়ঙ্গের মধ্যে ছিলেন। আমি বলব আপনি বলেছেন এই মৃত্যুটা সাজানো।’
‘না। আমি এই কথা বলিনি।’
‘বলেছেন। আকাশলাল তো নাও মারা যেতে পারে। যে ডাক্তারের সার্টিফিকেটের ওপর নির্ভর করে ওকে কবর দেওয়া হয়েছিল সে মিথ্যা কথা বলতে পারে। এই কথাও আমি আপনার কাছ থেকে শুনেছি।’
ম্যাডামের কথা শেষ হওয়ামাত্র ডেভিড খুব নার্ভাস গলায় বলল, ‘এসব আপনি কি বলছেন! আমি এ কথাগুলো বলিনি।’
‘কিন্তু কথাগুলো সত্যি হতেও তো পারত।’
‘হয়তো।’
‘হয়তো নয়। আপনি বলুন, এটাই সত্যি।’
‘আপনি আমাকে এতক্ষণ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা রাখবেন?’
‘অবশ্যই।’
‘বেশ। আমি যা জানি তার সঙ্গে আপনার অনুমানের মিল আছে।’
‘গুড। মিস্টার ভার্গিস। ডেভিডকে আমরা এখান থেকেই ছেড়ে দিতে পারি?’
‘তার মানে?’ ভার্গিসের গলা মিনমিনে।
‘ধরুন উনি এখান থেকে চলে যাওয়ার পর আপনি কি বলতে পারেন না যে পুলিশের ভ্যান থেকে পালিয়ে গেছেন। এমন তো কত আসামি পালায়। আপনি ওঁকে সময় দেবেন ইন্ডিয়ায় চলে যেতে। উনি যে সহযোগিতা করছেন তার বিনিময়ে এটুকু আমাদের করতেই হবে।’
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘আমরা অনুমান করছি আকাশলাল মারা যায়নি। ডাক্তার মিথ্যে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। ওঁরা জীবিত আকাশলালের জন্যেই সুড়ঙ্গ খুঁড়েছিলেন।’
‘অসম্ভব। ডাক্তারকে আমি চিনি। তাছাড়া আমি নিজে ডেডবডি দেখেছি। ম্যাডাম, আকাশলাল অত্যন্ত অসুস্থ ছিল। তার হৃদযন্ত্র বন্ধ ছিল না, পাল্স পাওয়া যায়নি। ওই অবস্থায় মাটির নীচে পাঁচ মিনিট থাকলেও, ধরে নিলাম ওকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল, ধরে নিয়ে বলছি, পাঁচ মিনিটও ওর পক্ষে মাটির নীচে থাকা সম্ভব নয়।’ তীব্র প্রতিবাদ করলেন ভার্গিস, এই লোকটা আপনাকে আষাঢ়ে গল্প শোনাচ্ছিল।’
‘গল্পটা আষাঢ়ে কিনা সেটার প্রমাণ আমরা শিগ্গির পাব। মিস্টার ডেভিড, আপনি ইন্ডিয়ায় চলে যাওয়ার পরেই আমরা আকাশলালকে অ্যারেস্ট করব।’
‘আকাশলাল? তাকে আমরা কোথায় পাচ্ছি?’ ভার্গিস জিজ্ঞাসা করলেন।
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন ম্যাডাম। তাঁর চোখে বিস্ময়। সেই চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে হাত দশেক দূরের ঝোপের মধ্যে। ভার্গিস সেটা লক্ষ করলেন। ম্যাডাম বললেন, ‘কেউ আমাদের লক্ষ করছে। এখানে আর কে থাকে?’
‘কেউ না, কেউ না।’ ভার্গিস অনুমান করলেন চৌকিদারটা ফিরে এসেছে। ম্যাডাম যদি তাকে একবার দেখতে পায়! কি করা যায় এখন?
ম্যাডাম বললেন, ‘ডেভিড, আপনার দলের কেউ না তো?’
‘আমি জানি না।’
‘লোকটা, আমি স্পষ্ট একটা লোককে ওখানে দেখেছি। ও আমাদের খুন করতে পারে মিস্টার ভার্গিস। আপনি কিছু একটা করুন।’
ভার্গিস সন্তর্পণে রিভলভার বের করলেন। তাঁর মনে হল চৌকিদারের মুখ বন্ধ করার এটাই সুযোগ। ওকে মেরে ফেললে ম্যাডাম কিছুই জানতে পারবেন না। তিনি চকিতে গুলি চালালেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্তনাদ শোনা গেল এবং ঝোপের ওপাশে কেউ পড়ে গেল।
ভার্গিস রিভলভার নিয়ে ছুটে গেলেন। ঝোপ সরিয়ে কাছে যেতেই লোকটাকে দেখতে পেয়ে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। ওর পরনে ড্রাইভারের পোশাক। এই লোকটাই তো ম্যাডামের গাড়ি চালায়। এইসময় পেছনে আওয়াজ পেলেন ভার্গিস।
‘মাই গড! এ আপনি কাকে গুলি করেছেন?’
‘আমি বুঝতে পারিনি। আমি একদম ভাবিনি!’ ককিয়ে উঠলেন ভার্গিস!
‘ইজ হি ডেড?’
ভার্গিস ঝুঁকে দেখলেন। বুঝতে অসুবিধে হল না। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।
‘ওর পকেটে কি আছে দেখুন।’
ভার্গিস চিত করে লোকটাকে শুইয়ে পকেটে হাত দিলেন। কাগজ, আইডেন্টিটি কার্ড, কারফিউ পাশ এবং একটি ছোট পিস্তল বেরিয়ে এল।
‘ওগুলো আমার হাতে দিন।’
ভার্গিস আদেশ মান্য করল। ড্রাইভারের পকেটে পিস্তল কেন?
ম্যাডাম ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, ‘ওহো নো!’
ভার্গিস বেরিয়ে এলেন ঝোপের আড়াল থেকে। ডেভিড ততক্ষণে দৌড়ে লনের শেষ প্রান্তে চলে গিয়েছে। জঙ্গলে ঢুকে পড়ছে। ম্যাডাম ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘ফায়ার করুন।’
ছুটে গেলে লোকটাকে ধরা যায়। হাতে হাতকড়া নিয়ে কেউ দ্রুত পালাতে পারে না।ওকে মেরে ফেললে অনেক ক্ষতি। ম্যাডাম দাঁতে দাঁত চাপলেন, ‘শুট হিম।’
আর পারলেন না ভার্গিস। রিভলভারের লক্ষ্য সম্পর্কে কোনও দ্বিধা করার কারণ ছিল, না। ডেভিডের শরীরটা জঙ্গলে আটকে পড়ল।
ম্যাডাম বললেন, ‘গিয়ে দেখুন মারা গিয়েছে কিনা।’
ভার্গিসকে ছুটতে হল। ডেভিড মৃত জানাতেই ম্যাডাম বললেন, ‘ওর হাতকড়া খুলে নিন। আমার ড্রাইভারকে খুন করে পালাচ্ছিল বলে আপনি ওকে খুন করতে বাধ্য হয়েছেন। বাই।’
মহিলা দ্রুত চলে গেলেন গাড়ির পাশে। ব্যাগ থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে স্টিয়ারিং-এ বসলেন। তারপরই সাদা হাঁসের মতো বেরিয়ে গেল সাদা টয়োটা।
দুপাশে দুটো মৃতদেহ। ভার্গিস লনের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। গাড়ির চাবি ড্রাইভারের কাছেই থাকার কথা। ওর পকেটে চাবিটা ছিল না, ছিল ম্যাডামের ব্যাগে। কেন? যিনি গাড়ি চালিয়ে আসেননি তিনি কেন চাবি রাখবেন? ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে ম্যাডাম নিশ্চয়ই গাড়ি চালাননি। ম্যাডাম কি জানতেন ড্রাইভারকে সরিয়ে দিতে হবে? তার মানে ওই ড্রাইভারই সার্জেন্টকে খুন করেছে। আর সেই কারণে প্রমাণ লোপ করতে পিস্তলটা নিয়ে গেলেন।
ভার্গিসের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। কী ভয়ানক মহিলা। নিজের ড্রাইভারকে খুন হতে দেখেও তিনি ভার্গিসকে কোনওরকম দোষারোপ করেননি। কেন? ভার্গিস দেখলেন চার-পাঁচজন পুলিশ ছুটে আসছে। হয়তো ম্যাডামই তাদের জানিয়ে গেছেন। তিনি একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, ‘দুপাশে দুটো মৃতদেহ আছে। ভেতরে নীচের তলার ঘরে আর একজন। তিনটে বডি এক জায়গায় করো।’
পুলিশরা কাজে লেগে গেল। ভার্গিস বসে বসে ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না। এসব করে ম্যাডামের কি লাভ হচ্ছে। ঘটনাগুলো এমনভাবে ঘটে গেল যে ম্যাডামকে কোনও ভাবেই দোষী করা যাবে না। বরং ম্যাডাম ইচ্ছে করলে তাঁকেই—মাথা নাড়লেন ভার্গিস। আর তখনই ওপাশের জঙ্গল থেকে একটা পুলিশ চিৎকার করে সঙ্গীদের ডাকতে লাগল। মিনিট খানেকের মধ্যেই ভার্গিস নিজের চোখে দৃশ্যটা দেখলেন। তিনটে নয়। আজ বাংলোর ভেতরে বাইরে চারটে মৃতদেহ রয়েছে। চৌকিদারকে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওর জন্যে বুলেট খরচ করেনি ম্যাডামের ড্রাইভার।