1 of 2

২৫. দীপ একটু থতমত খেয়েছিল

দীপ একটু থতমত খেয়েছিল ঠিকই। আবার বোসের সঙ্গে চলার দীর্ঘকালের অভ্যাসবশে সামলেও গেল।

চেম্বারে ঢুকে বোস সাহেবের মুখোমুখি বসল শান্তভাবে। মনে কিছু প্রত্যাশা। চাকরি বা পারমানেন্ট স্ট্যাটাস নিয়ে। দীপনাথ অবশ্য নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। বোস নিজেই যদি বলে।

বোস সাহেবকে খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। ইদানীং দীপ লক্ষ করছে, এই অল্প বয়সেই বোসের গায়ের চামড়া অনেকটাই যেন ঝুলে ঝুলে পড়েছে। শরীরের কোনও বাঁধন নেই। মুখশ্রীতে কিছু শ্রীহীনতা। ফ্যামিলি অ্যাফেয়ার্সের জন্য হতে পারে। কিংবা কোনও অসুখ হওয়াও বিচিত্র নয়।

বোস নিজের চুলে অতি দ্রুত উত্তেজিত আঙুল চালাল কয়েকবার। একটু হাঁফাচ্ছেও। আজকাল অসম্ভব গরম পড়ে গেছে কলকাতায়। জুন চলে গেল। জুলাইয়ের আজ চার তারিখ। বৃষ্টি নেই। কলকাতায় আজকাল বৃষ্টি হয় কম। গরম ক্রমেই বাড়ছে। বৃক্ষহীন শহরের বাতাস বিষিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এই গরমে বোসের মতো আরামপ্রিয় নধরকান্তিদের হাঁফ ধরা স্বাভাবিক। তবু কেমন সন্দেহ হয় দীপনাথের। লোকটার শরীর হয়তো ভাল নেই।

বোস কিছু বলার আগেই তাই দীপনাথ হঠাৎ বলে ফেলল, ইদানীং কোনও মেডিক্যাল চেক-আপ করিয়েছেন মিস্টার বোস?

বোস সাহেব বেশ কষ্টকর একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বলল, না তো! কেন?

আপনার বয়স বেশি নয় জানি। তবু একটা মেডিক্যাল চেক-আপ করিয়ে রাখা ভাল।

বোস একটু অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলে, কেন বলুন তো! আমি তো বেশ ভালই আছি।

আমি বলছি না যে, আপনি অসুস্থ। তবে চেক-আপের হ্যাবিট রাখা ভাল। বিশেষ করে যারা রেসপনসিবল পোস্টে কাজ করে তাদের জন্য এটা দরকার। অন্তত হার্ট, প্রেশার আর সুগার।

হেল উইথ দোজ থিংস। শুনুন, কোম্পানি আপগ্রেডেড হচ্ছে।

দীপনাথ অপমান হজম করে অভ্যস্ত। প্রথম কথাটা তাই গায়ে মাখল না। দ্বিতীয় কথাটা শুনে একটু নড়েচড়ে বসল। বলল, মালিকরা রাজি হয়ে গেল তা হলে?

ভারবালি। ফাইনাল ডিসিশন আমেদাবাদে গিয়ে জানাবে। তবে কথার নড়চড় বড় একটা ওদের হয় না।

তা হলে আপনি কি এই কোম্পানিতেই থাকছেন?

সম্ভবত। ওরা আমাকে আমেদাবাদে হেড অফিসে যাওয়ারও অফার দিয়েছে। সেকেন্ড অফার দিল্লির নতুন ব্রাঞ্চের চার্জ। আমি কোনওটাতেই রাজি হইনি। ইস্টার্ন জোনে আমার পাওয়ার অনেক বেশি।

সে কথাও ঠিক!

আগামী কয়েক মাসে এখানে অনেক রদবদল হবে। আমি যদি শেষ পর্যন্ত থাকি তবে আপনি একটা ভাল পজিশন পাবেন।

সাবধানে দীপনাথ মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কীরকম পজিশন?

চারজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার নেওয়া হবে। আপনি ওই চারটে পোস্টের একটা পেতে পারেন। আবার বলছি, যদি আমি থাকি। আমার ডিসিশন এখনও ফাইনাল নয়।

আর যদি বাংগালোর যান, তা হলে?

তা হলেও ওপেন অফার আছে। কাল রাতেও বলছিলাম। আপনিও যেতে পারেন।

কিন্তু আপনারই যে কোনও নিশ্চয়তা নেই মিস্টার বোস।

বোস মাথা নাড়ল, না, আমার কোনও নিশ্চয়তা এখনও নেই। তবে হয়তো দিন সাতেকের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি তো অনেকদিন অপেক্ষা করলেন। আর তোমোটে সাত আটটা দিন। মালিকরা ফিরে গিয়েই বোর্ডের মিটিং ডাকবে। তবে সে মিটিং নাম কো বাস্তে। ডিসিশন যা হওয়ার তা এখানে আজই বলতে গেলে হয়ে গেল।

তবু আপনি বাংগালোরে যাওয়ার ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখলেন কেন?

দেয়ার ইজ অ্যানাদার প্রবলেম। কাল রাতে সেটা নিয়েও আপনার সঙ্গে ডিসকাশন হয়েছিল। মিসেস বোস?

একজ্যাকটলি।

প্রবলেমটা কী?

দীপা নিজেই প্রবলেম। শি ইজ পলিটিক্যালি অবসেন্ড। মেয়েদের পলিটিকস করা আমার পছন্দ নয়। দু’নম্বর, শি ইজ গাইডেড বাই অ্যানাদার ম্যান।

আপনি তো কাল ডিভোর্সের কথা বলছিলেন।

ডিভোর্স একটা সোশ্যাল স্ক্যান্ডাল। জবাবদিহি করতে করতে জিব বেরিয়ে যাবে পাঁচজনের কাছে। আমি চাইছিলাম স্নিগ্ধর ক্লাচ থেকে ওকে বের করে বাংগালোরে নিয়ে যেতে।

দীপ একটু ভাবল। বলল, উনি বোধ হয় রাজি নন।

না।

তা হলে কী হবে?

ও যদি শেষ পর্যন্ত রাজি হয় তবে আমি নিশ্চয়ই এ চাকরি ছেড়ে বাংগালোরের অফারটাই নেব। ইট অল ডিপেন্ডস অন হার।

বুঝলাম। বলে দীপ বিরস মুখে উঠে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত মিসেস বোসের অনিশ্চিত ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরেই তার ভাগ্য নির্ভরশীল। ব্যাপারটা খুবই অপমানজনক নয় কি?

বোস একটু ঠান্ডা হয়েছে। হাফ-ধরা ভাবটাও আর নেই। বলল, আমি কাল আপনাকে আর-একটা কথাও বলেছিলাম। সেটা কিন্তু ইমোশনের কথা নয়।

কী কথা?

আই রিয়েলি নিড ইউ। প্লিজ ট্রাই টু বি মাই ফ্রেন্ড।

দীপনাথের ভদ্রতায় বাধে। নইলে বলত, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম আছে সন্দেহ করেও বন্ধুত্ব চনি? না বলে দীপনাথ একটু কাষ্ঠহাসি হাসল। মাথা নাড়ল শুধু। তার অর্থ, ঠিক আছে।

বোস খুব তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ছিল। হঠাৎ চোখ নামিয়ে টেবিলের একটা কাগজ খামোখা দেখতে দেখতে বলল, আমি জানি কাজটা আপনার পক্ষে বেশ শক্ত। ইন রিয়েলিটি, আপনার ওপর কিছু ইনজাস্টিস হয়েছে। কিন্তু সেগুলো মেরামত করা অসম্ভব নয়।

মিসেস বোসের মতামতটা কবে জানা যাবে?

জানি না। তবে আজ আমি আর-একবার ট্রাই করব।

একবার স্নিগ্ধদেবকে অ্যাপ্রোচ করুন না!

বোস এবার চোখ তুলে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর ধীর স্বরে বলে, লোকটাকে আমি চিনি। প্রথম দিকে ওপেনলি কয়েকবার আমাদের বাসায় এসেছে। কথাবার্তায় ভীষণ ভদ্র, হাসিটাও খুব সুইট। কিন্তু অসম্ভব স্টাব্যের্ণ। ও যদি কোনও কিছু স্থির করে থাকে তবে তা মরলেও বদলাবে না। তা ছাড়া আপনি কি মনে করেন নিজের স্ত্রীকে কোনও ব্যাপারে রাজি করাতে অন্য কারও সাহায্য নেওয়াটা ওয়াইজ ডিসিশন?

সেটা অবশ্য ভেবে দেখিনি।

ম্লান হেসে বোস বলে, আমাকে ভাবতে হয়।

দীপনাথ বিনীতভাবে বলল, যদি অনুমতি দেন তবে আমি একবার এই রিমোট কন্ট্রোলটির কাছে অ্যাপ্রোচ করতে পারি।

রিমোট কন্ট্রোল!–বলে বোস অবাক হয়ে তাকায়।

ওই যে স্নিগ্ধদেব। যিনি আড়াল থেকে মিসেস বোসকে চালাচ্ছেন।

রিমোট কন্ট্রোল!–বলে হঠাৎ হেসে ওঠে বোস। খুব জোরে নয়। তবু সেটা হাসিই। মাথা নেড়ে বলে, রিমোট কন্ট্রোল! একজ্যাকটলি। কিন্তু আপনারও তার কাছে যাওয়ার দরকার নেই। স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারে ঠিক ওভাবে ফয়সালা হয় না। তবু আপনার অফারের জন্য ধন্যবাদ। আপনি আজ চলে যেতে পারেন। আমার আজ আর আপনাকে দরকার হবে না। কল ইট এ ডে।

দীপনাথ বেরিয়ে এল।

বাইরে হা হা করছে রোদ। ফুটকড়াই ভাজা গরম। টেরিলিনের নিচ্ছিদ্র শার্টের তলায় গা ভিজে গেল ঘামে।

আনমনে রাস্তা পার হল দীপনাথ। হাতে অনেকটা সময় আছে। এই খর গ্রীষ্মের দুপুরে তার কোথাও যাওয়ার নেই। বোস যদি বাংগালোরে না যায় তবে সে এই কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হবে কোনওদিন। কিন্তু অতটা ভাবতে একটু কষ্ট হয় তার। বোস সাহেব যতই বলুক, লোকটা ধুরন্ধর। কোনও না কোনও দিক থেকে লোকটার ওপর প্রেশার রাখতে হবে। কিন্তু বোসকে প্রভাবিত করার কোনও পথ পায় না দীপ।

স্নিগ্ধদেব। একবার স্নিগ্ধদেবের কাছে খুব যেতে ইচ্ছে করে দীপনাথের। সে হয়তো এক ছদ্মবেশী ট্রটস্কি। সে-ই হয়তো ভারতের ভাবী প্রধানমন্ত্রী। স্নিগ্ধদেবই হয়তো সেই মানুষ যার জন্য পৃথিবী অপেক্ষা করছে। আবার হয়তো বা সে একটা ফ্রড! একটা সাইকিক কেস। স্রেফ ধোঁকাবাজ।

যাই হোক, একবার স্নিগ্ধদেবের কাছে যেতে খুব ইচ্ছে করে।

বিলু যে ব্যাংকে কাজ করে সেটা খুব দূরে নয়। প্রীতমটা কেমন আছে জানতে গুটি গুটি সেদিকেই রওনা দিল দীপ। বেলা দুটো বাজবার মুখে মুখে পৌঁছেও গেল।

বিলু কাউন্টারে বসে। চোখাচোখি হতেই চোখ তুলে বলল, সেজদা!

প্রীতম কেমন?

ওই রকমই।

লাবু?

আর কী, দিন দিন দুষ্টু হচ্ছে।

তুই কখন বাড়ি ফিরিস?

দেরি হয়। সন্ধের মুখে মুখে। কেন বলো তো?

না এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। অনেকটা সময় প্রীতম একা থাকে।

কী করব বলো! সবই তো বোঝে।

বুঝি, আবার বুঝিও না। চাকরিটা না নিলেই পারতিস।

পারতাম না। জোরে বোলো না, সবাই শুনবে। কোত্থেকে এলে হঠাৎ?

আমার অফিস তো দূরে নয়।

তাই তো। মনেই ছিল না।

অরুণ আসে-টাসে?

বিলু যেন চোখটা ফিরিয়ে নিল একটু। বলল, আসে। ওর বাবা এই ব্যাংকের ডিরেক্টর।

বিলু কি সত্যিই অরুণের সঙ্গে প্রেম করে? দীপনাথ সাহস করে বলল, কীসে ফিরিস বিকেলে?

লেডিজ ট্রামে। কখনও মিনিবাসে।

অরুণ লিফট দেয় না?

বিলু কি একটু ভয় পেল? কেমন যেন দেখাল মুখখানা। ধরা পড়া ভাল। নিচু স্বরে বলল, কালেভদ্রে। যখন আসে তখন পৌঁছে দেয়।

বিলু অরুণের সঙ্গে প্রেম করলেই বা তার কী? ভেবে পায় না দীপনাথ। সে নিজেও কি মণিদীপার প্রেমে পড়েনি? ওটাও পরস্ত্রী, এটাও পরস্ত্রী। তবু মানুষ এমনই অন্ধ, এমনই নিকৃষ্ট যে, নিজের বেলা আর পরের বেলা দু’রকম চোখ নিয়ে দেখে। দীপনাথও অবিকল তাই। নিজেকে একদিন দীপনাথ হয়তো এ জন্যই ঘৃণা করতে শুরু করবে। নিজেকে ঘৃণা করার অনেকগুলো কারণ ঘটতে শুরু করেছে।

দীপনাথ উদাস মনে জিজ্ঞেস করল, আজ কখন ফিরবি?

দেরি আছে। পাঁচটার আগে তো নয়।

দীপনাথ ঘড়ি দেখে বলল, একটু আগে বেরোতে যদি পারিস তবে আমিও সঙ্গে যেতে পারতাম।

তুমি যাও না বাসায়! ও তো একা আছে, তোমাকে পেলে ভীষণ খুশি হবে। আমি ছুটি হলেই তাড়াতাড়ি চলে যাব।

দীপনাথ ভাবতে লাগল। ব্যাংকের লোহার শাটার নেমে এল সদর দরজায়। লেনদেন বন্ধ। কোথায় যাবে বা কোথাও যাবে কি না তা আজ ঠিক করতে পারছিল না দীপনাথ। সে কি সত্যিই মণিদীপার কাছে রঞ্জনের কথা নিয়ে চুকলি করছিল? ভাবলে এখনও কান লাল হয়ে ওঠে যে!

না রে যাই। আজ অন্য কাজ আছে।

বলে দীপনাথ কাউন্টার ছেড়ে চলে আসতে আসতেও একবার কী ভেবে বিলুর দিকে ফিরে দেখল। বিলুকে একটু অন্যরকম লাগছে না? কেন লাগছে? কয়েকদিন ধরেই যেন একটু অন্যরকম! না? বিলুর চুল আর রুক্ষ নয়। একবেণীতে বাঁধা। ক্রু কি প্লাক করে বিলু আজকাল? হতে পারে। তবে ঠোঁটে ন্যাচারাল কালারের লিপস্টিক যে দিযেছে তা স্পষ্টই বোঝা যায়। মুখের উজ্জ্বল রং প্রমাণ করে মুখেও আজকাল কোনও দামি মেক-আপ ব্যবহার করে সে। চোখে কি একটু আবছা কাজলও দিয়েছে?

দীপনাথের ফিরে তাকানো দেখে বিলুও চেয়ে ছিল। দীপনাথ তাই চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে আসে। মনটা খারাপ লাগে। খুব খারাপ লাগে। হয়তো চাকরি করতে গেলে মেয়েদের একটু সাজতেই হয়। এর পিছনে হয়তো অন্য কারণ নেই। তবু কেন মনটা খারাপ হল আজ দীপনাথের?

বিলুর ভাবনাটা শেষ করেনি দীপনাথ। ভাবতে ভাবতেই প্রচণ্ড রোদের রাস্তায় ছায়া দেখে দেখে হাঁটছিল। বিলু আজকাল আগেকার মতো গোমড়ামুখী নয়। বেশ কথাটথা বলে। হাসে-টাসেও। বয়সটাও যেন যথেষ্ট কমে গেছে।

এসব থেকে অবশ্য কোনও পাকা সিদ্ধান্তে আসতে পারে না দীপনাথ। কিন্তু বুকের মধ্যে একটা মনখারাপের বাতাস বইতে থাকে।

এই জনকোলাহল, মানুষে-মানুষে বিচিত্র সব সম্পর্ক, সংসারে জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে হরেক জটিলতা, অপমান, দুঃখ ও অভাববোধ, এসব ছাড়িয়ে ওই বহু দুরে এক মহান শ্বেতবর্ণের পর্বত দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য। শুধু তারই জন্য। দীপনাথ বরফকাটা কুটুল নেবে না, নাল লাগানো জুতো পরবে না, সঙ্গে নেবে না অক্সিজেন সিলিন্ডার, দড়ি বা তাঁবু। সে একদিন এমনি সাদামাটা ভাবে রওনা দেবে সেই উত্তুঙ্গ প্রেমিক ও প্রভুর কাছে। নিজের তুচ্ছতাকে বিসর্জন দেবে সেই মহিমময়ের অতুলনীয় মহত্ত্বের মধ্যে। একদিন কি পাহাড় ডাকবে না তাকে?

 

আজ হঠাৎ সেজদা ব্যাংকে এসেছিল।–বিলু একটু দুশ্চিন্তার সঙ্গে বলে।

অরুণ গাড়ি চালাচ্ছিল। মুখ না ফিরিয়েই বলল, সো হোয়াট?

সেজদা কখনও আসে না তো।

তাই বলেই কি আসতে নেই? তোমার সব অদ্ভুত-অদ্ভুত প্রবলেম। সেজদা ব্যাংকে এসেছিল কেন তা নিয়েও মাথা ঘামাতে হবে নাকি?

অরুণ ঠিক এসব ব্যাপার বুঝবে না। ওদের পরিবার সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। ওরা অন্য রকম মানুষ। অঢেল টাকা, অপার স্বাধীনতা। পরিবার থেকে কোনও বাধা নিষেধ নেই। বাপে-ছেলেতে একসঙ্গে বসে মদ খায়, একই ক্লাবে ফুর্তি করতে যায়, মেয়েমানুষ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করে।

বিলু তাই দাঁতে ঠোঁট কামড়ে একটু ভেবে বলল, জিজ্ঞেস করছিল যে তুমি আমাকে লিফট দাও কি না!

দিই তো!

দাও সে তো ঠিকই। এখনও তো দিচ্ছ। বললাম যে, সেজদা কথাটা জানতে চাইছিল।

অরুণ গাড়িটা একটু আস্তে করে বলল, প্রবলেমটা কি একটু বলবে খোলাখুলি? সেজদা জানতে চাইল তো তাতে কী হল?

ভাবছি সেজদা আমাদের নিয়ে কিছু ভাবছে কি না।

কী ভাববে?

সন্দেহ করতে তো পারে কিছু!

লাভ অ্যাফেয়ার?

যদি ধরো তাই।

অরুণ হাসল, কথাটা তো মিথ্যেও নয়। আই লাভ ইউ।

ইয়ারকি কোরো না। সেজদা একটু সেকেলে। হয়তো ফ্রেন্ডশিপ বোঝে না। উল্টোপাল্টা কিছু ভেবে বসে আছে।

সেটা কি কোনও অ্যাংজাইটির ব্যাপার আমাদের? তুমি যেমন আছে তেমনি থাকবে। লোকে যা খুশি ভাবতে পারে। আমরা তো বাচ্চা ছেলেমেয়ে নই। ভালমন্দ বুঝি।

বোঝো?–বিলু একটু হাসে।

আলবাত বুঝি।

তা হলে বলো তো, এই যে আমাকে লিফট দিচ্ছ, এটা ভাল না মন্দ?

রাবিশ, বিলু। এসব নিয়েও তুমি ভাবো নাকি আজকাল? তুমি একদম পাল্টে গেছ।

কী রকম?

আগে তোমার এত সংকোচ ছিল না। কত ফ্রি ছিলে!

আজকাল ফ্রি নই?

একদম নও। সেজদার সঙ্গে সঙ্গে তুমিও একই লাইন অফ থটস ধরে ফেলেছ।

সংসারে, বিশেষ করে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত সংসারে বেশি ফ্রিডম ভাল নয়, অরুণ।

কে তোমাকে এসব শেখাচ্ছে বলো তো!

কে শেখাবে! নিজেই বুঝতে শিখছি।

বিলু, পৃথিবী তো পিছিয়ে যাচ্ছে না। চারদিকে চেয়ে দেখো কত মুক্ত হয়ে যাচ্ছে সমাজ, কত অবাধ হচ্ছে। নিজের মনের মধ্যে মাথা কুটে মরার সংস্কার থাকলে স্বাধীনতার অর্থই থাকে না। তোমাকে স্বাধীন করবে কে?

বোকো না তো! বকবকানি একদম ভালবাসি না।

অরুণ খুব হাসল। বলল, কেমন দিলাম আস্ত একখানা ভাষণ ছেড়ে!

কলেজের ডিবেটিং-এ বলতে, সে একরকম ছিল। এখন তো দামড়াটি হয়েছ।

আচ্ছা, নাউ আই শ্যাল হোল্ড মাই টাং অ্যান্ড লেট ইউ লাভ।

বিলু খানিকক্ষণ থম ধরে রইল। তারপর হঠাৎ বলল, তুমি একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ, অরুণ?

কী বলো তো!

আমার ভুল হতে পারে। আগে বলল, প্রীতমকে আজকাল তুমি কেমন দেখছ?

কেমন মানে?

মানে প্রীতমকে আগের মতোই রুগ্ন লাগে কি তোমার?

অরুণের মুখে হাসি নেই। গম্ভীর মনোযোগে খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, হয়তো খুব খুঁটিয়ে লক্ষ করিনি। ইজ দেয়ার এনি ইমপ্রুভমেন্ট?

বললাম তো, আমার চোখের বা মনের ভুল হতে পারে। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।

আমি লক্ষ করিনি। তুমি কিছু দেখেছ?

মনে হয়। খুব সামান্য একটু যেন, ভুলই হবে হয়তো, তবু—

বিলু আর বলল না। বোধহয় ভাল কথা বলতে নেই বলেই।

অরুণ গম্ভীর মুখেই বলল, ঠিক আছে, আজ লক্ষ করে দেখব।

দেখার কিছু নেই। তেমন কিছু হলে তোমার নজরে এমনিতেই পড়ত।

তার কোনও মানে নেই। প্রীতমের সঙ্গে দেখা হয় বটে। কিন্তু খুব ইনটেনসিভভাবে তো ওকে লক্ষ করি না। মনটা হয়তো নানা রকম চিন্তায় ব্যস্ত থাকে। মানুষ তো কত সময়ে একটা জিনিস দেখেও দেখে না।

বিলু ভ্রু কুঁচকে সামনের কাচের ওপাশে গতিশীল রাস্তাঘাট দেখছিল। বলল, কদিন আগে লাবুর জন্মদিনে কী কাণ্ড করেছিল সে তো জানো।

হুঁ।–অরুণ মাথা নাড়ল। তারপর বলল, দেয়ার মে বি সাম ইমপ্রুভমেন্ট।

ডাক্তার কি তোমাকে কিছু বলেছে?

ডাক্তাররা তো সব সময়ে প্রফেশনাল কথাবার্তাই বলে।

ইদানীং কিছু বলেনি?

না। তেমন কিছু নয়।

ডাক্তারকে একবার জিজ্ঞেস করবে?

আজই তো যাচ্ছি প্রীতমকে নিয়ে। জিজ্ঞেস করব।

আজই আকুপাংচারের ডেট নাকি?

অরুণ বিস্ময়ে ভ্রু তুলে বললে, না তো আজ আচার্যি কবিরাজের ডেট। ভুলে গেছ?

আমি আজকাল ভুলে যাই। এত চিন্তা মাথায়, অথচ অনেক কিছু মনে রাখতে পারি না।

ন্যাচারাল। তোমার অবস্থায় যে কারও হত।

বিলু একটু স্মিত মুখে বলল, তুমি তো মনে রেখেছ! আমার ভরসা যে তুমিই।

এ কথায় অরুণের ফর্সা রং রাঙা হল, বাজে কথা বোলো না।

কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি বলে ভেবেছ নাকি?

কখনও ওসব জানিয়ো না। তাতে রিলেশনটা হালকা হয়ে যায়।

কী মুশকিল! কৃতজ্ঞতা জানাইনি তো! তবু বকছ কেন?

অরুণ চুপচাপ কিছুক্ষণ গাড়ি চালাল।

বিলু বলল, মুডটা হঠাৎ খারাপ করে ফেললে নিজের দোষেই।

অরুণ হঠাৎ হেসে ফেলল এবং চমৎকার দেখাল তাকে। বলল, লিভ ইট। প্রীতমবাবুর যদি কোনও ইমপ্রুভমেন্ট হয়ে থাকে তবে সেটাই আপাতত বড় কথা।

ময়দানের ভিতর দিয়ে খুব আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে অরুণ। অন্যমনস্ক। গম্ভীর।

বিলু নিজের মনে মনে আর-একবার সম্মোহিত হয়। এই একটি লোককে সে চেনে যে নিজের প্রশংসা একটুখানি শুনলে লজ্জায় রাঙা হয় এবং কখনও-কখনও রেগে যায়। অরুণের অনেক গুণের মধ্যে এই একটা গুণ সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে বিলুকে। অথচ অরুণ কত ব্যাপারে কতই না প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু সেসব বলার কথা বিলুর মনেও থাকে না। অরুণ অরুণের মতোই, সেটা আবার তাকে বলার কী? আজ হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল।

বিলু খানিকক্ষণ ভেবেচিন্তে বলল, প্রীতমকে বাইরে থেকে যেমন মনে হয়, ও মোটেই সে রকম নয়। ওর মনের জোর সম্পর্কে আমার এতদিন কোনও ধারণাই ছিল না।

আজকাল খুব স্বামীর প্রশংসা করে বেড়াচ্ছ যে!

যেটুকু বলার সেটুকু বলব না কেন?

অরুণ আবার সিরিয়াস হয়ে বলে, কথাটা মিথ্যে নয়। হি ইজ এ ফাইটার। এ টাফ ফাইটার।

হয়তো সেই জোরটার জন্যই লড়তে পারছে। তোমার কি মনে হয় না মনের জোর থাকলে অসুখ সেরে যেতে পারে?

আই বিলিভ ইন সায়ান্স। মনের জোর জিনিসটা ফ্যালনা নয়! কিন্তু তার ক্ষমতার সীমা আছে।

প্রীতম পারবে না বলছ?

পারতে পারে। নট ইমপসিবল।

কিন্তু তুমি চাইছ না যে আমি ওর মনের জোরের ওপর নির্ভর করে কোনও আশার কথা ভাবি।

অরুণ প্রথমে জবাব না দিয়ে মলিন মুখ করে হাসল একটু। তারপর বলল, কথাটা অবশ্য তাই দাঁড়ায়।

কেন চাইছ না, অরুণ?

প্রীতম যদি ভাল হয়ে ওঠে তো লক্ষ বার ওয়েলকাম। কিন্তু তুমি যে-কোনও ইভেনচুয়ালিটির জন্য তৈরি থাকলেই ভাল। তাতে কোনও শকই তোমাকে ভেঙে ফেলতে পারবে না।

ডাক্তাররা যে রুগিদের মনের জোর রাখতে বলে, সেটা তা হলে কী?

সেটাও দরকার। কিন্তু মনের জোরটাই সব নয়। একবার আমার ইস্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষার আগে টাইফয়েড হয়েছিল। দিন চারেক টেম্পারেচার ঠায় একশো চারে দাঁড়িয়ে। তখনও টাইফয়েডের মডার্ন ট্রিটমেন্ট বেরোয়নি। চারদিনের দিন রক্ত পরীক্ষা করে টাইফয়েড ধরা গেল। আমি যেই বুঝলাম যে এ অসুখ সহজে সারবে না আর অ্যানুয়াল পরীক্ষাও দেওয়া হবে না, তখন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে মনের খুব জোর করতে লাগলাম। বছর নষ্ট হওয়ার আতঙ্কে জোরটা বেশ ভালই দিয়েছিলাম। সন্ধেবেলা টেম্পারেচার সাতানব্বইতে নেমে গেল। ডাক্তাররা পর্যন্ত হাঁ। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। তারপরই তেড়ে জ্বর উঠল। আবার একশো-চার। ত্রিশ দিনের দিন ভাত খাই।

খুবই স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে বিলু। ঠোঁটদুটো লিপস্টিক সত্ত্বেও ভারী শুকনো দেখায়।

অরুণ কয়েকবার ফিরে ফিরে দেখল বিলুকে। তারপর বলল, হতাশ হলে বোধহয়!

বিলু কিছু বলল না। কিন্তু একটা বড় শ্বাস ফেলল।

অরুণ গাঢ় আন্তরিক গলায় বলে, তোমাকে মিথ্যে কোনও স্তোক দেওয়াটা উচিত হত না বিলু। তার চেয়ে বাস্তববাদী হওয়া ভাল।

আমি স্তোক চাইনি তো।–বিলু একটু অবাক হয়ে বলে।

তবু বলছি প্রীতমের মনের জোরের ওপর নির্ভর করে খুব একটা বেশি আশা করে বোসো না।

বিলু আবার একটু বড় শ্বাস ফেলে বলল, দিনরাত তো কেবল নেগেটিভ চিন্তাই করে যাই অরুণ! আমাকে সেটা আর শিখিয়ো না তুমি।

নেগেটিভ চিন্তা করতেও বলিনি। যে-কোনও অবস্থার জন্য মনটাকে নিরপেক্ষ রাখা।

হঠাৎ বিলু ঝাঁঝালো গলায় বলে, কেন বাজে বকছু অরুণ, মনকে নিরপেক্ষ রাখা কথাটাই ভণ্ডামি। কেউ কোনওদিন তা পারে না।

চেষ্টা করলেই ডিটাচড হওয়া যায়। তুমি চেষ্টা করছ না। দিনে দিনে তুমি আরও বেশি জেবড়ে জড়িয়ে পড়ছ।

বেশ করছি।

অরুণ হাসল, কদিন পর দেখব তুমি হয়তো তারকেশ্বরে মানত করতেও যাচ্ছ।

বিরক্ত হচ্ছিল বিলু। নীরস গলায় বলল, যদি বুঝি তাতে কাজ হবে তা হলে তাও করব। একজন মানুষের জন্যই করব তো!

একটা শ্বাস ফেলে হতাশ গলায় অরুণ বলে, করো। মেয়েরা কোনওদিনই সংস্কারমুক্ত হতে পারে না, এ তো জানা কথা।

আবার ভাষণ!

ভাষণ কেন হবে! তোমাকে তো অন্যরকম জানতাম বিলু। তুমি ছিলে ঠান্ডা, লজিক্যাল, আনইমোশনাল। প্রীতমের এই অসুখ যখন হল তখনও তোমাকে ইমোশনাল হতে দেখিনি। হঠাৎ আজকাল তোমার ভিতরে একটু আবেগ-টাবেগ দেখছি।

বিলু চুপ করে থাকে। এ কথার জবাব হয় না। অরুণ দীর্ঘকালের বন্ধু। বিলুর স্বভাব, বিলুর চরিত্র সবই অরুণের নখদর্পণে। সে যদি আজ কোনও কথা বলে তবে সেটা বাজে কথা হবে না। কথাটা মিথ্যেও নয়। বিলুর ভিতরে কোনওদিনই কোনও আবেগ ছিল না। কোনও কিছুতেই সে উত্তেজিত হয়নি কখনও। এমনকী জ্ঞানত কোনওদিন বিলু কোনও কারণেই কাদেনি। অথচ কান্না নাকি মেয়েদের বড় সহজেই আসে। প্রীতম সম্পর্কে বিলু কোনওদিন তেমন কোনও টানও বোধ করেনি, আবার বিরূপতাও নয়।

কিন্তু এই সেদিন যখন লাবুর জন্মদিনে রোগা লোকটা বিছানায় বসে প্রাণপণে বেলুন ফোলানোর চেষ্টা করছিল তখন হঠাৎ সেই সামান্য দৃশ্যটা দেখে হঠাৎ বিলুর ভিতরে খান খান শব্দে কী যেন ভেঙে গেল। হঠাৎ এল আবেগ, হঠাৎ এল ভয়। প্রীতম মরে যাবে, এই সত্যটাকে সে শান্ত বিমাদে গ্রহণ করে নিয়েছিল। কিন্তু রোগা কাঠির মতো হাতে বেলুনটা ধরে কাপতে কাপতে যখন নিজের মহার্ঘ শ্বাসবায়ু তার মধ্যে ভরে দেওয়ার চেষ্টা করছিল প্রীতম তখনই যেন বিলু টের পেল একটা মানুষের কাছে তার নিজের বেঁচে থাকাটা কত জরুরি।

আজকাল আমার মধ্যে একটু-আধটু আবেগ আসছে ঠিকই।–বিলু অনেকক্ষণ বাদে বলল, কিন্তু তার মানে তো এ নয় যে, সেটা ইললজিক্যাল।

অরুণ নিস্পৃহ গলায় বলে, আমি ইমোশন জিনিসটা বুঝি না। আমার নিজের তো কোনও সেন্টিমেন্ট নেই, বুঝব কী করে? আমার মা যেদিন মারা গেল সেদিন এক ফোটাও কঁদিনি। কোনও দুঃখ বা অভাব বোধ করিনি। আমি বিকেলে একটা পার্টিতেও গিয়েছিলাম। আমি হচ্ছি আলবিয়ার কামুর নায়কদের মতো। ভেরি মাচ কোন্ড-ব্লাডেড।

বিলু চিমটি কেটে বলে, তোমার পরিবারকে জানি। বেশি বোকো না। মায়ের জন্য কাদবেই বা কেন, তুমি মাকে তো ভাল করে চেনোইনি। মানুষ হয়েছ গভর্নেসের কাছে। একটু বড় হতেই চলে গেলে বিদেশে। ওরকম পরিবারে কোনও ইমোশনাল সম্পর্কই গড়ে ওঠে না।

তা অবশ্য ঠিক।

কিন্তু তোমার ভিতরে যে ইমোশন টসটস করছে তা একদিন টের পাবে, দেখো। নিজেকে যত আধুনিক ভাবছ, ততটা নও।

বাড়ির গলিতে গাড়ি ঢোকাবার আগেই বিলু নেমে গেল। অরুণ গাড়ি ব্যাক করিয়ে ঢোকাবে। অন্য দিন এই অবস্থায় বিলু গলির মুখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে ওর জন্য। আজ করল না। এক্ষুনি প্রীতমকে একবার দেখবার জন্য সে কিছুটা অস্থির বোধ করছিল।

দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উঠে ঘরে ঢুকে দেখল, প্রীতম শান্তভাবে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।

বিলু হাতের ব্যাগটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে লঘু নিঃশব্দ পায়ে বিছানার কাছে আসে। তারপর খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে প্রীতমের হাত পা মুখ। একটু কি রং বদল হয়েছে চামড়ায়? সামান্য স্বাস্থ্যের ঝিকিমিকি কি দেখা যাচ্ছে না?

ঠিক বুঝতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *