২৫. তিতলী লক্ষ্য করল

তিতলী লক্ষ্য করল

তিতলী লক্ষ্য করল শওকতের বাঁ গাল খানিকটা ফোলা। সে কিছুক্ষণ পরপর গালে হাত দিচ্ছে। তাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। বেশি রকম চিন্তিত হলে শওকত মাথার চুল টানে। এখন মাথার চুলও টানছে। চুল এলোমেলো হয়ে আছে। চিন্তিত হাবার মতো কোনো কারণ ঘটেছে? পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে। ট্রাভেলার্স চেকভর্তি মানিব্যাগ খোয়া গেছে? তিতলী বসে আছে। কাঠমুণ্ডু এয়ারপোর্টে সে কৌতুহল নিয়ে শওকতকে লক্ষ করছে। সমস্যায় সে যে পড়েছে তা তাকে দেখে বোঝা যায়। মানুষটার একটা বড় গুণ হচ্ছে যত সমস্যাতেই পড়ুক সোধৈৰ্য হারায় না। খুব বেশি হলে মাথার চুল টানে। চুল টানারও কি কোনো বিশেষ ভঙ্গি আছে? টেনশন বেশি হলে মাথার সামনের চুল টানা। টেনশন কম হলে পেছনের চুল টানা জাতীয় কিছু। তিতলী এমনভাবে মানুষটাকে লক্ষ করে নি। প্রয়োজন বোধ করে নি। এখনো প্রয়োজন বোধ করছে না।

শওকত বড় একটা পেপার গ্লাস নিয়ে তিতলীর দিকে আসছে। তার ভুরু কুঁচকে আছে। চিন্তা মনে হয় আরো বেড়েছে।

তিতলী নাও পেপসি খাও।

তিতলী গ্লাস হাতে নিল। তার পেপসি খেতে ইচ্ছে করছে না–মানুষটা এত আগ্ৰহ করে এনেছে, না খেলে ভালো দেখায় না। একবারের জন্য হলেও গ্লাসটা ঠোঁট ছোঁয়ানো দরকার। তারপর হাতে নিয়ে বসে থাকলেই হবে।

তিতলী বলল, কোনো সমস্যা হয়েছে?

না। তেমন কিছু না। আমার সুটকেসটা আসে নি। ওরা বলছে এক ঘণ্টা পর রয়েল নেপাল এয়ারলাইনসের একটা প্লেন আসবে। সুটকেসটা নাকি সেখানে। অপেক্ষা করা ছাড়া পথ দেখছি না। তোমার বোধহয় চুপচাপ বসে থাকতে খারাপ লাগছে।

খারাপ লাগছে না। তোমার গাল ফোলা। কী হয়েছে?

হঠাৎ করে দাঁত ব্যথা শুরু হয়েছে।

বেশি?

হাঁ বেশি। হোটেলে গিয়ে পেইনকিলার টিলার খেতে হবে।

আমার কাছে প্যারাসিটামল আছে।

প্যারাসিটামলের স্টেজ পার হয়ে গেছে। তুমি বস, আমি হোটেলের খোঁজ নিই। গল্পের বইটই কিছু এনেছ? বসে বসে পড়।

গল্পের বই লাগবে না।

শওকত চিন্তিতমুখে হোটেল ইনকোয়োরির দিকে যাচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে তাকে নিয়ে যাবার জন্যে বাংলাদেশ এম্বেসির এক ভদ্রলোকের আসার কথা। হোটেল বুকিং তারই করে রাখার কথা। তিনি আসেন নি। এম্বেসিতে টেলিফোন করেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। চারটা বাজে। অফিস আওয়ার্স শেষ। হোটেল রিজার্ভেশনের সমস্যা হয়তো হবে না। এখন টুরিস্ট সিজন না। ভরা বর্ষায় কেউ নেপাল বেড়াতে আসে না। হোটেলের চেয়েও বেশি জরুরি–একজন ডাক্তার খুঁজে পাওয়া। দাঁতের ব্যথা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। মাথা দপদপ করছে। নেপাল এয়ারলাইনসে সুটকেস পাওয়া না গেলে রেডিমেড শার্ট-প্যান্ট থেকে শুরু করে টুথপেস্ট, টুথব্রাশ সবই কিনতে হবে।

নেপাল এয়ারলাইনসের ফ্লাইট দু ঘণ্টা দেরি করে এল। সেখানে সুটকেস নেই। শওকতের গাল আরো ফুলেছে। মনে হচ্ছে জ্বর এসে গেছে। বাইরে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। মুষলধারে বৃষ্টি। পাহাড়ি অঞ্চল বলেই কি বৃষ্টির ফোঁটা এত বড়?

এম্বেসির ভদ্রলোকের নাম সোবহান। তিনি শেষ পর্যন্ত এসেছেন। ভদ্রলোক বিমানের টাইমিঙে গণ্ডগোল করেছেন। তবে ভদ্রলোক করিতককর্মা। নগরকেটে হোটেল বুকিং নিয়ে রেখেছেন। কাঠমাণ্ডুতে নাকি দেখার কিছু নেই। ভদ্রলোকের মতে হিমালয়ের সঙ্গে প্ৰথম পরিচয় নগরকেটে হওয়া উচিত। ভদ্রলোক এয়ারপোর্ট থেকেই শওকতের সুটকেস খুঁজে বের করলেন। পরের দিন বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে সুটকেস আসবে এটা নিশ্চিত করলেন। ডেনটিক্টের সঙ্গেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলেন। বিদেশের এম্বেসিতে যারা কাজ করেন তারা ঘুমানো এবং শপিং করা ছাড়া অন্য কিছুই পারেন না বলে যে ধারণা দেশে প্রচলিত তা সম্ভবত সত্যি নয়।

ভদ্রলোক শওকতকে শার্ট-প্যান্ট কিনতে দিলেন না। গষ্ঠীরমুখে বললেন, কাল তো সুটকেস চলেই আসছে–শুধু শুধু ডলার খরচ করবেন কেন? একটা রাতেরই তো কারবার। ভাবির শাড়ি প্যাঁচ দিয়ে লুঙ্গির মতো পরে শুয়ে থাকবেন। দুপুরের মধ্যে আমি সুটকেস পৌঁছে দেব। পরদিন রওনা করবেন পোখরা।

শওকত বলল, কোথায় যাব?

পোখরা। সেখানে খুব সুন্দর তিনটা হ্রদ আছে–ফিওয়া, বেগনাস এবং রুপা। লোকগুলোর উৎস হলো অন্নপূর্ণ রেঞ্জের তুষার গলা পানি। ফিওয়া হ্রদের পাশে লোকভিউ হোটেল। একটা রুমি নিয়ে রেখেছি। এসি রুম, আপনাদের পছন্দ হবে।

যাব। কীভাবে?

বাইরোডে যাবেন। ট্যাক্সি নিয়ে যাবেন। প্লেনেও যাওয়া যায়। ওয়ান ওয়ে টিকিট ফোর্টি নাইন ডলার। প্লেনে যাওয়া অর্থহীন। পোখরা যাবার দুপাশের দৃশ্য না দেখলে মানবজন্ম বৃথা।

কাঠমাণ্ডুতে কিছু দেখার নেই?

মন্দির ফন্দির আছ–চাইলে একদিন দেখিয়ে আনব। ইউরোপ আমেরিকার টুরিস্টরা ক্যামেরা হাতে নিয়ে খুব আগ্রহ করে পটাপট মন্দিরের ছবি তোলে। মন্দির দেখার জন্যে নেপালে আসার দরকার কী? নেপালে এসেছেন। হিমালয় দেখবেন। প্রাণভরে হিমালয় দেখুন। তবে…।

তবে কী?

বর্ষাকাল তো। হিমালয় দেখতে পারবেন কি না, সেটা হলো কথা। আকাশ পরিষ্কার না থাকলে কিছু দেখা যায় না। আপনাদের ভাগ্য ভালো হলে ইনশাল্লাহ দেখবেন।

 

তারা নগরকেটে পৌঁছল রাত আটটার দিকে। বৃষ্টি তখনো ঝরছে। মুষলধারে না হলেও ঝিরবির করে পড়ছে। আঁকাবাকা পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তায় আলো নেই। একপাশে গভীর গিরিখাদ। স্টিয়ারিঙের হতে শক্ত না হলে ভয়াবহ অ্যাকসিডেন্ট ঘটবে। বষ্টিভেজা রাস্তাও খুব পিছল। মাঝে মাঝেই গাড়ি ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে যাচ্ছে। অল্পবয়সী ড্রাইভার জয় পশুপতিনাথজী বলে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে।

শওকত বলল, রাস্তা তো ভয়াবহ। তিতালী তোমার ভয় লাগছে?

তিতলী বলল, না।

তাহলে তোমাকে ‘সাহসী তরুণী’ টাইটেল দেয়া যায়। ভয়ের চোটে আমার দাঁত ব্যথা সাময়িকভাবে চলে গেছে। আমার ধারণা হোটেলে পৌঁছার পর ভয় কেটে যাবে, দাঁত ব্যথা আবার শুরু হবে।

সেক্ষেত্রে হোটেলে না পৌঁছে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো ভালো।

শওকত শব্দ করে হাসল। তিতালীর মনে হল–মানুষটার হাসি খুব সুন্দর। হাসান ভাইয়ের হাসিও সুন্দর, তবে হাসান ভাই এত শব্দ করে হাসত না। তিতালীর অস্বস্তি লাগছে। তুলনামূলক চিন্তা সে কেন করছে। এর মধ্যে তুলনার কী আছে?

বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়ে গাড়ি থেমেছে। ড্রাইভার জয় জয় পশুপতিনাথজী বলে দু’হাত একত্র করে স্টিয়ারিংকে নমস্কারের মতো করেছে। তিতালী ভীত গলায় বলল, কী হয়েছে? ড্রাইভার হাসিমুখে বলল, বহেনজি আ গয়া।

এত অন্ধকার কেন ?

নেপালি ড্রাইভার বাংলা বাক্য বুঝল। জবাব দিল ইং – নো ইলেকট্রিসিটি । পাওয়ার ফেইলিউর ।

অন্ধকারে এতক্ষণ চোখে পড়ে নি- এখন দেখা যাচ্ছে- দক্ষিণে বিশাল দোতলা হোটেল। ভূতের বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে। ইলেকট্রিসিটি না থাকলে এত বড় হোটেলে চার্জলাইট জ্বলবে, বাতি জ্বলবে–পুরোপুরি অন্ধকার খাঁখাঁ করছে। বৃষ্টি সূচের মতো গায়ে বিধছে। তিতালীর শরীর কাঁপছে। এত ঠাণ্ডা বৃষ্টি এর আগে তার গায়ে পড়ে নি। পাহাড়ি বৃষ্টি কি এত ঠাণ্ডা হয়? বৃষ্টির এই নমুনা জানলে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই লিখতেন না, এস কর স্নান নবধারা জলে।

তিতালী হোটেলের লবিতে পা দেয়ামাত্র ইলেকট্রিসিটি চলে এল। চারদিক ঝলমল করে উঠল। হোটেল দেখে তিতালী মুগ্ধ। শোবার ঘরগুলো বড় বড়। ঘরে কাঠের পুরনো ধরনের আসবাব। ডেসিং টেবিলের আয়নাটা সুন্দর। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে । হোটেলের আয়না। সচরাচর ভালো হয় না। বাথরুমেও ঝক ঝক করছে ।

তিতলী খুশি খুশি গলায় বলল, হোটেলটা তো খুব সুন্দর।

শওকত বলল, হোটেলটা খুব সুন্দর না। মাঝারি ধরনের। তুমি কখনো ভালো হোটেলে থাক নি বলে তোমার কাছে এত সুন্দর লাগছে। তোমার কি ক্ষিধে লাগছে?

হুঁ।

তাহলে তুমি এক কাজ কর খেয়ে এস। ডাইনিং হলে চলে যাও। রাত বেশি হলে ডিনার পাবে না।

তুমি খাবে না?

আমার দাঁতের যে অবস্থা! পানি ছাড়া কিছু খেতে পারব না। তাছাড়া খেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে জ্বর আসছে। আমি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকব।

আমি একা একা খেতে যাব?

হ্যাঁ যাবে। আমরা যে বিচিত্র জীবন শুরু করেছি। সেখানে দোকার ব্যাপার তো নেই–তাই না? এক কাজ করা–ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নাও কিংবা গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর খেতে যাও। মেনু দেখে দেখে অর্ডার দেবে সমস্যা কিছু নেই। পারবে না?

পারব।

গুড।

শওকত বিছানায় গা এলিয়ে দিল। শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে। গা কেমন ঘিনীঘিন করছে। বাসি কাপড় ছাড়া হয় নি। ছাড়ার উপায়ও নেই। একসেট কাপড় হলেও কেনা দরকার ছিল। গরম পানিতে গোসল সেরে হোটেলের গামছা গায়ে জুড়িয়ে শুয়ে থাকলে হয়। ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে একজন তরুণীর সামনে ব্যাপারটা শোভন হবে না। এই তরুণী তার স্ত্রী এটিও খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। ভিক্টোরিয়ান যুগের গল্প-উপন্যাসে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন স্বামী-স্ত্রী হয়তো থাকে। এ যুগে কি থাকে? তিতলী যা করছে তা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা থেকে করছে। আর সে নিজে যা করছে তাও কি অসুস্থতা নয়? অন্যের অসুখকে প্রশ্রয় দেয়াও তো এক ধরনের অসুখ। সে যা ভেবেছিল তা হচ্ছে না–সময়ের সঙ্গে তিতলী সহজ হচ্ছে না। বরং উল্টোটা হচ্ছেঅস্বাভাবিক সম্পর্কই এখন স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এক সময় আরো স্বাভাবিক মনে হবে। ভুল হচ্ছে, মস্ত বড় ভুল। ভুলের ছোট্ট চারা রোপণ করা হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই চারা ডালপালা মেলে মহীরুহ হয়ে গেছে। এই মহীরুহ এখন আর খুব সহজে টান দিয়ে উপড়ে ফেলা যাবে না। বড় করাত দিয়ে গাছটা কাটতে হবে। সেই করাত দুজনের করাত। করাতের এক মাথা থাকবে তার হাতে অন্য মাথা থাকবে তিতলীর হাতে। তিতলী কি সেই করাতের একমাথা ধরবে? মনে হয় না।

শওকতের জ্বর বাড়ছে। মনে হচ্ছে এন্টিবায়োটিকগুলো কাজ করছে না। ঠাণ্ডাও বোধহয় লেগেছে–বুকের ভেতর ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। সামান্য কাশি। নিউমোনিয়া না তো? বড় ধরনের অসুখ বাঁধিয়ে ফেললে তিতলী সমস্যায় পড়বে। বিদেশে অসুস্থ মানুষ মানে নানান যন্ত্রণা। তিতলী নামের এই মেয়েটিকে এ জাতীয় যন্ত্রণায় ফেলার কোনো অর্থ হয় না। মেয়েটা কে? কেউ না। খুব রূপবতী একটা মেয়ে যে বাস করছে ভয়ঙ্কর এক ঘোরের জগতে। ঘোর কাটছে না। সম্ভবত কাটবেও না।

তিতলী?

হুঁ।

ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দিতে বল। পানি খাব।

কাকে বলব? রুম সার্ভিসকে বলতে হবে। আচ্ছা টেলিফোনটা আমার কাছে দাও–আমি বলছি। তোমার জ্বর কি বেড়েছে?

তাই মনে হচ্ছে।

মাথায় পানি ঢালতে হবে?

না। তুমি বসে আছ কেন? খেতে যাও।

তিতলী চলে গেল। শওকত ভেবেছিল তিতলী গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখবে। এই ভদ্রতা সাধারণ ভদ্রতা। তিতলীর কাছ থেকে এই সামান্য ভদ্রতাটুকু কি আশা করা যায় না?

 

নতুন জায়গায় তিতলীর ঘুম হয় না। নগরকেটের হোটেলে তার খুব ভালো ঘুম হলো। দীর্ঘ ঘুম এবং খুব আরামের ঘুম। ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। হোটেলের ভেতরে তখনো অন্ধকার। শওকত চাদর মুড়ি দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। তার মাথা বালিশ থেকে সরে গেছে। বাচ্চাদের এই অভ্যাস শওকতের আছে। মাথার নিচে বালিশ থাকে না। তিতলীর একবার ইচ্ছা করল শওকতের মাথাটা বালিশে তুলে দেয়। তারপরই মনে হলো থাক।

সে বাথরুমে ঢুকে হাতমুখ ধোল। কলটা ছাড়ল খুব সাবধানে। অসুস্থ মানুষ-ঘুম যেন না ভাঙে।

তিতলী ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় এল। সেখান থেকে চলে এল হোটেলের বাগানে। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। যে বিস্ময়কর দৃশ্য তার সামনে ছিল তার জন্যে তার কোনো প্ৰস্তুতি ছিল না। দিগন্তজুড়ে হিমালয় পর্বতমালা। বরফের চাদরে তার গা ঢাকা। প্ৰভাতের প্রথম সূর্যকিরণে সেই চাদরে সোনালি আভা লাগতে শুরু করেছে। এ কী অপরূপ দৃশ্য! তিতলী মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগোচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘন কুয়াশা তাকে ঢেকে ফেলল। বর্ষাকালে এত কুয়াশা এল কোথেকে? হঠাৎ তার মনে হল–এটা মেঘ না তো? জলভরা একখণ্ড মেঘ কি তাকে জড়িয়ে ধরেছে? অবশ্যই তাই। এম্বেসির সোবাহান সাহেব এ জাতীয় কথাই তো বলেছিলেন। নগরকোট এত উঁচুতে যে গায়ের ওপর দিয়ে মেঘ চলে যায়। হাতের মুঠোয় মেঘ ধরা যায়; এই তো সেই মেঘ। আকাশের মেঘ হাত দিয়ে ছোয়া যাচ্ছে! চোখের সামনে হিমালয়ের রঙ বদলে যাচ্ছেপ্রকৃতি এত সুন্দর হয়? তিতলীর রীতিমতো কান্না পেয়ে গেল। এত সুন্দর কখনো একা দেখা যায় না। শওকতকে এনে দেখাতে হবে। ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে আসতে হবে। বাগানে চেয়ার-টেবিল পাতা আছে। হোটেলের গেস্টরা চেয়ারে বসে হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের সামনে পটভর্তি চা। তিতলীরাও তাই করবে। দুজন বসে চা খাবে তারপর হঠাৎ একসময় বিশাল একখণ্ড মেঘের ভেতর তারা ডুবে যাবে।

তিতলী শওকতের গায়ে হাত রেখে কোমল স্বরে ডাকল–এই ওঠ তো। ওঠ।

শওকত চোখ মেলল। অদ্ভুত একটা দৃশ্য সে দেখছে—তিতলী তার গা ঘেঁসে বসে আছে। তিতলীর একটা হাত তার পিঠে। এটি কি কোনো স্বপ্নদৃশ্য? না স্বপ্নদৃশ্য নয়। তিতলীর গা থেকে বাসি ফুলের গন্ধ আসছে। স্বপ্নদৃশ্যে গন্ধ থাকে না।

চট করে উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাও।

কেন?

বাইরে যে কী সুন্দর! আমি এতক্ষণ মেঘের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিলাম।

সত্যি।

হ্যাঁ সত্যি। এই দেখ তোমার গা ছুঁয়ে বলছি। শুয়ে আছ কেন ওঠ।

শওকত হাত বাড়িয়ে তিতলীর হাত ধরল। তিতলী হাত সরিয়ে নিল না। শওকত তাকে কাছে টানল। তিতলী কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে রইল–তারপর হঠাৎ নিজেকে ছেড়ে দিল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কী করছ দরজা খোলা! শওকত বলল, থাকুক খোলা।

তিতলী বলল, তোমার গায়ে জ্বর নেই?

না নেই।

তিতলী বলল, আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। তুমি কি এক সেকেন্ডের জন্য আমাকে ছাড়বে?

এক সেকেন্ডে কী করবে?

দরজা লাগিয়ে দেব।

দরজা লাগাতে হবে না।

কী আশ্চর্য বারান্দা দিয়ে বেয়ারারা আসা-যাওয়া করছে।

ওরা হাইলি টেন্ড। হোটেলের খোলা দরজা দিয়ে এরা কখনো ভেতরে তাকাবে না।

আমরা হিমালয় দেখব না?

হিমালয় পালিয়ে যাচ্ছে না।

আমিও তো পালিয়ে যাচ্ছি না। ছিঃ ছিঃ তুমি তো আমাকে নগ্ন করে ফেলছ। আমি কিন্তু এখন ধাক্কা দিয়ে তোমাকে বিছানা থেকে ফেলে দেব।

ফেলে দাও।

ধাক্কা দিতে গিয়ে তিতলী ধাক্কা দিতে পারল না। তার শরীর জেগে উঠেছে। সে গভীর মমতা ও ভালবাসায় শওকতকে জড়িয়ে ধরল। হিমালয় সূর্যকিরণ মেখে তার রঙ বদলাচ্ছে। ফেরারি মেঘমালার দু-একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে হোটেলের চারপাশে। তিতলীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছে কোনো একটা দুষ্ট প্রকৃতির মেঘ বোধহয় খোলা দরজা দিয়ে তাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। তারা ডুবে গেছে মেঘের দিঘিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *