পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে সে একবার কলিকাতা আসিলফিরিতে কুড়ি পঁচিশ দিন দেরি হইয়া গেল— আষাঢ় মাসের শেষ, বর্ষা ইতিমধ্যে খুব পড়িয়াছিল, সম্প্রতি দু-একদিন একটু ধরিল, কখনও আকাশ। মেঘাচ্ছন্ন, দিন ঠাণ্ডা, কোনদিন বা সারাদিন খররৌদ্র।
এই কদিনে দেশের চেহারা বদলাইয়াছে, গাছপালা আরও ঘন সবুজ, উঁচু গাছের মাথা হইতে কচি মাকাললতা লম্বা হইয়া ঝুলিয়া পড়িয়াছে-বাল্যের অতীব পরিচিত দৃশ্য, এখনও বউ-কথা-কও ডাকে, কিন্তু কোকিল ও পাপিয়া আর নাই—এখনও বনে সোঁদালি ফুলের ঝাড় অজস্র, কচি পটপটি ফলের থোলো বাঁধিয়াছে গাছে গাছে কটু গন্ধ ঘেটকোল বোজ বেলাশেষে কোন্ ঝোপঝাপের অন্ধকারে ফোটে, ঘাটের পথে ফিরিবার সময় মেয়েরা নাকে কাপড় চাপা দেয়—কি পবিচিত, কি অপূর্ব ধরনের পরিচিত সবই, অথচ বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছিল সবটা এতদিন। বাহিরের মাঠ সবুজ হইয়াছে নবীন আউশ ধানে—এই সময় একদিন সে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে আর একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা লাভ করিল।
খুব রৌদ্র, দুপুর ঘুরিয়া গিয়াছে, বেলা তিনটার কম নয়, অপু কি কাজে গ্রামের পিছনদিকের বনের পথ ধরিয়া যাইতেছিল। দুধারে বর্ষার বনঝোপ ঘন সবুজ, বাঁশবনে একটা কঞ্চি হইতে হলদে পাখি উড়িয়া আর একটা কঞ্চিতে বসিতেছে।
একটা জায়গায় ঘন বনের মধ্যে সুঁড়ি পথ, বড়োগাছের পাতার ফাঁক দিয়া ঝলমলে পরিপূর্ণ রৌদ্র পড়িয়া কচি, সবুজ পাতার রাশি স্বচ্ছ দেখাইতেছে, কেমন একটা অপূর্ব সুগন্ধ উঠিতেছে। বনঝোপ হইতেসে হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেল সেদিকে চাহিয়াই। তাহার সেই অপূর্ব শৈশব জগৎটা!
ঠিক এইরকম সুঁড়ি বনের পথ বাহিয়া এমনি রৌদ্রালোকিত ঘুঘুডাকা দীর্ঘ শ্রাবণ দিনে দুপুর ঘুরিয়া বৈকাল আসিবার পূর্ব সময়টিতে সে ও দিদি কৌশালিকের বাসা, পাকা মাকালফল মিষ্টি রাংচিতার ফল খুঁজিয়া বেড়াইত-দুপুর রোদের গন্ধমাখানো, কত লতা দোলানো, সেই রহস্যভরা, করুণ, মধুর আনন্দলোকটি!…মাইল বাহিয়া এ গতি নয়, সেখানে যাওয়ার যানবাহন নাই—পৃথিবীর কোথায় যেন একটি পথ আছে যাহা সময়ের বীথিতল বাহিয়া মানুষকে লইয়া চলে তার অলক্ষিতে। ঘন ঝোপের ভিতর উকি মারিতেই চক্ষের নিমেষে তাহার ছাব্বিশ বৎসর পূর্বের শৈশবলোকটিতে আবার সে ফিরিয়া গেল, যখন এই বন, এই নীল আকাশ, উজ্জ্বল আনন্দভরা এই রৌদ্রমাখানো শ্রাবণ দুপুরটাই ছিল জগতের সবটুকু-বাহিরের বিশ্বটা ছিল অজানা, সে সম্বন্ধে কিছু জানিতও না, ভাবিতও না…রঙে রঙে রঙিন রহস্যঘন সেই তার প্রাচীন দিনের জগৎটা…
এ যেন নবযৌবনের উৎস-মুখ, মন বার বার এক ধারায় স্নান করিয়া হারানো নবীনত্বকে ফিরিয়া পায়-গাছপালার সবুজ, রৌদ্রালোকের প্রাচুর্য, দুর্গাটুনটুনির অবাধ কাকলি—ঘন কুঁড়ি পথের দূরপারে শৈশবসঙ্গিনী দিদির ডাক যেন শুনা যায়।…
কতক্ষণ সে অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল-বুঝাইবার ভাষা নাই, এ অনুভূতি মানুষকে বোবা করিয়া দেয়! অপুর চোখ ঝাপসা হইয়া আসিল–কোন দেবতা তার প্রার্থনা শুনিয়াছিলেন? তার নিশ্চিন্দিপুর আসা সার্থক হইল।
আজ মনে হইতেছে যৌবন তার স্বর্গের দেবতাদের মতো অক্ষয়, অনন্ত…সে জগন্টা আছে— তার মধ্যেই আছে। হয়তো কোনও বিশেষ পাখির গানের সুরে, কি কোনও বনফুলের গন্ধে শৈশবেব সে হারানো জগৎটা আবার ফিরিবে। অপুর কাছে সেটা একটা আধ্যাত্মিক অনুভূতি, সৌন্দর্যের প্লাবন বহাইয়া ও মুক্তির বিচিত্র বার্তা বহন করিয়া তা আসে, যখনই আসে। কিন্তু ধ্যানে তাকে পাইতে হয়, শুধু অনুভূতিতেই সে রহস্যলোকের সন্ধান মিলে!
তার ছেলে কাজল বর্তমানে সেই জগতের অধিবাসী। এজন্য ওর কল্পনাকে অপু সঞ্জীবিত রাখিতে প্রাণপণ করে–শক ও হুণের মতো বৈষয়িকতা ও পাকাবুদ্ধির চাপে সে-সব সোনাব স্বপ্নকে রূঢ়হস্তে কেহ পাছে ভাঙিয়া দেয়—তাই সে কাজলকে তার বৈষয়িক শ্বশুর মহাশয়ের নিকট হইতে সরাইয়া আনিয়াছে—নিশ্চিন্দিপুরের বাঁশবনে, মাঠে, ফুলে ভরা বনঝোপে, নদীতীবেব উলুখড়ের নির্জন চরে সেই অদৃশ্য জগৎটার সঙ্গে ওর সেই সংযোগ স্থাপিত হউক–যা একদিন বাল্যে তার নিজের একমাত্র পার্থিব ঐশ্বর্য ছিল…
নিশ্চিন্দিপুর
১০ আষাঢ়
ভাই প্রণব,
অনেকদিন তোমার কোনো সংবাদ পাই নি, কোনো সন্ধানও জানতুম না, হঠাৎ সেদিন কাগজে দেখলুম তুমি আদালতে ক্যুনিজম নিয়ে এক বক্তৃতা দিয়েছ, তা থেকেই তোমার বর্তমান অবস্থা জানতে পারি।
তুমি জানো না বোধহয় আমি অনেকদিন পর আমার গ্রামে ফিরেছি। অবশ্য দুদিনের জন্য, সে-সব কথা পরে লিখব। খোকাকেও এনেছি। সে তোমায় বড়ো মনে রেখেছে, তুমি ওর মাথায় জল দিয়ে বাতাস করে জ্বর সারিয়েছিলে সেকথা ও এখনও ভোলে নি।
দেখো প্রণব, আজকাল আমার মনে হয়, অনভূতি, আশা, কল্পনা, স্বপ্ন—এসবই জীবন! এবার এখানে এসে জীবনটাকে নতুন চোখে দেখতে পাই, এমন সুবিধে ও অবকাশ আর কোথাও হয় নি এক নাগপুর ছাড়া! কত আনন্দের দিনের যাওয়া-আসা হল জীবনে। যেদিনটিতে ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে প্রথম কুঠির মাঠ দেখতে যাই সরস্বতী পুজোর বিকেলে যেদিন আমি ও দিদি রেলরাস্তা দেখতে ছুটে যাই–যেদিন বিয়ের আগের রাত্রে তোমার মামার বাড়ির ছাদটিতে বসেছিলুম সন্ধ্যায়, জন্মাষ্টমীর তিমিরভরা বর্ষণসিক্ত রাত জেগে কাটিয়েছিলুম আমি ও অপর্ণা মনসাপোতার খড়ের ঘরে, জীবনের পথে এরাই তো আনন্দের অক্ষয় পাথেয়—যে আনন্দ অর্থের উপর নির্ভর করে না, ঐশ্বর্যের ওপর নির্ভর করে না, মান-সম্মান বা সাফল্যের উপরও নির্ভর করে না, যা সূর্যের কিরণের মতো অকৃপণ, অপক্ষপাতী, উদার, ধনী-দরিদ্র বিচার করে না, উপকরণের স্বল্পতা বা বাহুল্যের উপর নির্ভর করে না। বড়োলোকর মেয়েরা নতুন মোটর কিনে যে আনন্দ পায়, মা অবিকল সেই আনন্দই পেতেন যদি নেমন্তন্ন থেকে আমি ভালো ছাঁদা বেঁধে আনতে পারতুম, আমার দিদি সেই আনন্দই পেত যদি বনঝোপে কোথাও পাকা-ফলে ভরা মাকাল কি বৈচিগাছের সন্ধান পেত।
জীবনে সর্বপ্রথম যেবার একা বিদেশে গেলুম পিসিমার বাড়ি সিদ্ধেশ্বরী কালীর পূজা দিতে, বছর নয়েক বয়স তখন হাজার বছর যদি বাঁচি, কে ভুলে যাবে সেদিনের সে আনন্দ ও অনুভূতির কথা? বহু পয়সা খরচ করে মেরু পর্যটকেরা তুষারবী শীতের রাত্রে, উত্তর-হিমকটিবন্ধের বরফজমা নদী ও অন্ধকার আরণ্যভূমির নির্জনতার মধ্যে Northern light–জুলা আকাশের তলায়, অবাস্তব, হলুদরঙের চাঁদের আলোয়, শুভ্রতুষারাবৃত পাইন ও সিলভার স্ফুসের অরণ্যে নেকড়ে বাঘের ডাক শুনে সে আনন্দ পান না—আমি সেদিন খালি পায়ে বালুমাটির পথে সিমুল সোঁদালি বনের ছায়ায় ছায়ায় ভিন্ গায়ে যেতে যেতে যে আনন্দ পেয়েছিলুম, আমি তো বড়ো হয়ে জীবনে কত জায়গায় গেলুম, কিন্তু জীবনের উষায় মুক্তির প্রথম আস্বাদের সে পাগলকরা আনন্দের সাক্ষাৎ আর পাই নিতাই রেবাতটের সেই বেতস তরুতলেই অবুঝ মন বার বার ছুটে ছুটে যায় যদি, তাকে দোষ দিতে পারি কই?…
আজ একথা বুঝি ভাই যে, সুখ ও দুঃখ দুই-ই অপূর্ব। জীবন খুব বড়ো একটা রোমান্স বেঁচে থেকে একে ভোগ করাই বোমান্স—অতি তুচ্ছতম, হীনতম একঘেয়ে জীবনও রোমান্স। এ বিশ্বাসটা এতদিন আমার ছিল না—ভাবতুম লাফালাফি করে বেড়ালেই বুঝি জীবন সার্থক হয়ে গেল—তা নয় দেখলুম ভাই।
এর সুখ, দুঃখ, আশা, নিরাশা—আত্মার যে কি বিচিত্র, অমূল্য অ্যাডভেঞ্চার-তা বুঝে দেখতে ধ্যানদৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা আছে, তা আসে এই রহস্যমাখা যাত্রাপথের অমানবীয় সৌন্দর্যের ধারণা থেকে।…
শৈশবের গ্রামখানাতে ফিরে এসে জীবনের এই সৌন্দর্যরূপটাই শুধু চোখে দেখছি। এতদিনের জীবনটা এক চমকে দেখবার এমন সুযোগ আর হয় নি কখনও। এত বিচিত্র অনুভূতি, এত পরিবর্তন, এত রস-অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে চাবিধারের বৌদ্রদীপ্ত মধ্যাহ্নের অপূর্ব শান্তির মধ্যে কত কথাই মনে আসে, কত বছর আগেকার সে শৈশব-সুরটা যেন কানে বাজে, এক পুরোনো শান্ত দুপুরের রহস্যময় সুব…কত দিগন্তব্যাপী মাঠের মধ্যে এই শান্ত দুপুরে কত বটের তলা, রাখালের বাঁশির সুরের ওপারের যে দেশটি অনন্ত তার কথাই মনে ওঠে।
কিছুতেই আমাদের দেশের লোকে বিস্মিত হয় না কেন বলতে পারো, প্রণব? বিস্মিত হবার ক্ষমতা একটা বড়ো ক্ষমতা। যে মানুষ কোনও কিছু দেখে বিস্মিত হয় না, মুগ্ধ হয় না, সে তো প্রাণহীন। কলকাতায় দেখেছি কি তুচ্ছ জিনিস নিযেই সেখানকার বড়ো বড়ো লোকে দিন কাটায়। জীবনকে যাপন করা একটা আর্ট—তা এরা জানে না বলেই অল্প বয়সে আমাদের দেশে জীবনের ব্যবসায়ে দেউলে হয়ে পড়ে।
দিনের মধ্যে খানিকটা অন্তত নির্জনে বসে থেকে ভাবতে হয়—উঃ, সে দেখেছিলুম নাগপুরে ভাইসে কী অবর্ণনীয় আনন্দ পেতুম। বৈকালটিতে যখন কোনো শালবনের ছায়ায় পাথরের ওপর গিয়ে বসতুম—লোকাতীত যে বড়ো জীবন শত শত জন্মমৃত্যুর দূর পারে অক্ষুন, তার অস্তিকে মন যেন চিনে নিত…ডি সিটারের, আইনস্টাইনের বিশ্বটার চেয়েও তা বড়ো।
এখানে এসেও তাই মনে হচ্ছে প্রণব।…এখানে বুঝেছি জগতে কত সামান্য জিনিস থেকে কৃত গভীর আনন্দ আসতে পারে। তুচ্ছ টাকা, তুচ্ছ যশ-মান। আমার জীবনে এরাই হোক অক্ষয়। এত ছায়া, এত ভঁসা খেজুরের আতাফুলের সুগন্ধ, এত স্মৃতির আনন্দ কোথায় আর পাব? হাজার বছর কাটিয়ে দিতে পারি এখানে, তবু এ পুরোনো হবে না যেন।
লীলাকে জানতে? আমার মুখে দু-একবার শুনেছ। সে আর নেই। সে সব অনেক কথা। কিন্তু যখনই তার কথা ভাবি, অপর্ণার কথা ভাবি, তখন মনে হয় এদের দুজনের সঙ্গ পেয়ে আমার জীবন ধন্য হয়ে গিয়েছে বাইবেলে পড়েছ তোAnd। saw a new Heaven and a new Earth এরা জীবন দিয়ে আমার সে চোখ খুলে দিয়েছে।
হ্যাঁ, তোমায় লিখি। আমি বাইরে যাচ্ছি। খুব সম্ভব যাব ফিজি ও সামোয়া—এক বন্ধুর কাছ থেকে ভরসা পেয়েছি। কাজলকে কোথা রেখে যাই এই ছিল সমস্যা। তোমার মামার বাড়ি রাখব না-তোমার মেজমামিমা লিখেছেন কাজলের জন্যে তাদের মন খারাপ, সে চলে গিয়ে বাড়ি অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। তোক অন্ধকার, সেখানে আর নয়। আমার এক বাল্যসঙ্গিনী এখানে আছেন। তার কাছেই ওকে রেখে যাব। এঁর সন্ধান না পেলে বিদেশে যাওয়া কখনও ঘটে উঠত না, খোকাকে যেখানে-সেখানে ফেলে যেতে পারতুম না তো!
আজ আবার এয়োদশী তিথি, মেঘশূন্য আকাশ সুনীল। খুব জ্যোৎস্না উঠবে—ইচ্ছা হয় তোমায় নিয়ে দেখাই এ-সব, তোমার ঋণ শোধ দিতে পাব না জীবনে ভাই—তুমিই অপর্ণাকে জুটিয়ে দিয়েছিলে—কত বড়ো দান যে সে জীবনের, তা তুমিও হয়তো বুঝবে না।
তোমারই চিরদিনের বন্ধু
অপূর্ব