গলির সেই লম্বা ফালি জ্যোৎস্নাটা ধীরে ধীরে আকাশে চাঁদের অগ্রগতির সঙ্গে গলির ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে গলির মুখে তখনও যেন দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঠিক মানুষের মত দাঁড়িয়েছিল। ওইটেই শশাঙ্কের বাড়ির গলি। ওই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েই শশাঙ্কের স্ত্রী তাকে অভিসম্পাত দিয়েছিল।
বনবিহারী অকালেই মারা গিয়েছে। কিন্তু বনবিহারীর মৃত্যুর নিষ্ঠুর আঘাতে বিচলিত বিহ্বল হয়ে মনে মনেও কোনোদিন পুত্ৰশোককে ওই মেয়েটির অভিশাপ বলে স্বীকার করেন নি।
নিজে ডাক্তার হয়েও বনবিহারী মৃত্যুকে নিমন্ত্রণ করেছিল মৃত্যু ফিরে যাবে কেন? ডেকে এনে তার সে কী ভয়? সে কী বাঁচবার ব্যাকুলতা! ওই দাঁতুর মত। ওই মতির মায়ের মত! যখন মনে পড়ে তখন শশাকের চেয়ে দুঃখ হয় বেশি। যে মানুষ মরতে চায় না, জলমগ্ন মানুষের মত দু হাত শূন্যে বাড়িয়ে আমাকে বাঁচাও বলে ড়ুবে যায় তার জন্যেই শোক হয় মর্মান্তিক। নইলে শোক তো শুভ্র শান্ত-জীবনের মহাতত্ত্ব। শান্ত শোক জীবনকে কয়েকটি দিনের জন্য বৈরাগ্যের গৈরিক উত্তরীয় পরিয়ে নিয়ে মনোহর করে তোলে। কানের কাছে সত্যসঙ্গীত ধ্বনিত করে। তোলেবাউল বৈরাগীর মত। অন্যহনি ভূতানি গচ্ছন্তি যমমন্দিরং। অন্য বংশে অন্য কুলে এ হয়ত সম্ভব নয় কিন্তু মশায় বংশে–সে তো অসম্ভব ছিল না। মনে পড়ছিল প্রথম যৌবনে। বিখ্যাত শখের দলের অভিমন্যুবধ পালার কথা। সেই প্রসঙ্গে চণ্ডীতলার সাধক মহান্ত রঘুবর গোঁসাই কয়েকটি কথা বলেছিলেন যাত্ৰাদলের অধিকারীকে সেই কথাগুলি মনে গেঁথে আছে। সপ্তরথীর অস্ত্রাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত দেহে কুরুক্ষেত্রের মাটিতে পড়ে ষোল বছরের কিশোর অভিমন্যু কাতর স্বরে কেঁদেছিল; সুকণ্ঠ প্ৰিয়দৰ্শন ছেলেটি কান্নামেশানো সুরে গান ধরেছিল–
অন্যায় ঘোর সমরে অকালে গেল প্ৰাণ আমার–
তৃতীয় পাণ্ডব পিতা মাতুল গোবিন্দ যার।
একে একে মা সুভদ্ৰা, প্রিয়া উত্তরার নাম ধরে সে এক মর্মচ্ছেদী করুণ সঙ্গীত! সারা আসরের লোকের চোখের জলে বুক ভেসে গেল।
গান শেষ হল; অভিমন্যু টলতে টলতে চলে গেল সাজঘরে। অঙ্ক শেষ হল—ঐকতানবাদন শুরু হল। রঘুবর গোস্বামী গম্ভীর কণ্ঠে অধিকারী মশায়কে ডেকে বললেন– অধিকারী মশায়, এ কী হইল ভাই?
-আজ্ঞে? অধিকারী প্রশ্ন বুঝতে না পেরে প্রশ্নই করল—খুলে বলুন?
–অভিমন্যু এমন করে কাদল কেন ভাই? অর্জুনের ছাওয়াল-কিষণজীর ভাগনাসে মরণকে ডরে এমন করে কাঁদবে কেন ভাই? কাঁদবে তো লড়াইমে সে আইল কেন দাদা? এমন করে সাত সাত বীরের সাথে লড়াই দিল কাহে ভাই? সে তো ভাই, হাত দুটা বঢ়ায়ে দিয়ে বন্ধন পরে বাঁচতে পারত ভাই? ভাঙা রথের চাকা নিয়ে লড়তে কেন গেল? অভিমন্যু তো কাঁদবে না। বীর বংশের সন্তানসে তো ভাই মরণকে ডরবে না।
অধিকারী হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। এমন প্রশ্ন তো সাধারণত কেউ করে না! মানুষ কেঁদে সারা হয়ে আসর জমিয়ে তোলে। ধন্য ধন্য পড়ে যায়। তিনি সবিনয়ে সেই কথাই বলেছিলেন। বলেছিলেন-বাবা মানুষ এতে কাঁদে।
কথা কেড়ে নিয়ে গোস্বামী বলেছিলেন—তাই বলে দুখ দিয়ে কাঁদাবে ভাই; যাতনা দিয়ে কাঁদাবে? কাদন খুব ভাল জিনিস, মনকে ময়লা ধুয়ে যায়—দিল সাফা হয়—ঠিক বাত। কিন্তু তার জন্যে মাথায় ডাণ্ডা মারকে কাঁদাবে দাদা? প্রেমসে কাদাও; আনন্দসে কাদাও। তবে তো ভাই! অৰ্জুন মহাবীর। কিরাত বেশ ধরকে শিব আইলেন, তার সাথে লড়লেন; তার ছাওয়াল মরণকে ডর না করে বলুক, আওরে তু মরণ! মরণ আসুক হাত জোড় করকে আসুক। বলুকহামারা পুরী ধন্য হামি আজ ধন্য হইল। মরণকে ডরসে পরিত্রাণকে পথ দেখে মানুষ আনন্দসে কাঁদুক; তবে তো ভাই!
যাত্রার দলের অভিমন্যর চেয়ে বহুগুণ দীনতার সঙ্গে কাতর কান্না কেঁদে মরেছিল বনবিহারী। অবশ্য আসল নকলে তফাত আছে—কিন্তু যাত্ৰাদলের ওই মৃত্যুর অভিনয় সত্যও যদি হত—তবুও তার তুলনা ভুল নয়। বনবিহারী মারা গিয়েছে ম্যালেরিয়ায়। বনবিহারী রিপুর প্ররোচনায় দেহখানাকে করে রেখেছিল রোগের বীজের পক্ষে অতি উর্বর ক্ষেত্রের মত অনুকূল। দাহ্য বস্তুতে সামান্য একবিন্দু আগুন যেমন সর্বধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে পরিণত হয়—ঠিক তেমনভাবেই ম্যালেরিয়া মৃত্যুরোগে পরিণত হল। আর. জি. কর স্কুল থেকে পাস করেই সে এসেছিল। বিলাসী তরলচিত্ত উল্লাসচঞ্চল উচ্ছঙ্খল বনবিহারী। তখন তার ধারণা সে ধনীর সন্তান। জমিদারের সন্তান।
হায়রে সেই এক আনা অংশের জমিদারি! তাকেও একদিন অহংকৃত করেছিল। তার উপর বনবিহারী তখন এক অবস্থাপন্ন মোক্তারের একমাত্র কন্যাকে বিবাহ করে তার সম্পত্তিরও ভাবী উত্তরাধিকারের স্বপ্ন দেখছে। বিবাহ অবশ্য তিনিই দিয়েছিলেন। তবে পছন্দ আতর-বউয়ের! তিনিও অমত করেন নি। পিতার একমাত্র উত্তরাধিকারিণী কন্যাকে তিনি পছন্দ করেছিলেন। শ্বশুর দিয়েছিল দামি সাইকেল, জামাই সাইকেল চড়ে ডাকে যাবে; দিয়েছিল ভাল ঘড়ি, ঘড়ি দেখে নাড়ির বিট গুনবে, হার্টের বিট গুনবে। নতুন চমৎকার বার্নিশ-করা আলমারি চেয়ার টেবিল, ডাক্তারখানার সরঞ্জাম। আরোগ্য-নিকেতনের ওই দিকে একখানা ছোট কুঠুরিতে বনবিহারী ডাক্তার বসতে শুরু করল। নতুন সাইনবোর্ড টাঙালে সঞ্জীবন ফার্মেসি। তিনি সকল কাজই করেছিলেন কিন্তু নিজে থেকে কিছু করেন নি। মনের মধ্যে ঘুরেছিল শশাঙ্কের স্ত্রীর কথা। তখন অবশ্য পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে। বনবিহারীও মৃত্যুকে নিমন্ত্রণের পথে অনেকটা এগিয়েছে। মদ ধরেছে।
জীবনমশায় সহজ রোগী বনবিহারীর কাছে পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু আশ্চর্য, এই মশায় বংশের কুলগত চিকিৎসাবিদ্যার বুদ্ধির এতটুকুও বোধ বনুর মধ্যে স্কুরিত হয় নি।
হবে কী করে? যে ধ্যানযোগে বিজ্ঞান ধারণায় ধরা পড়ে সে ধ্যান সে কোনোদিনই করে নি, করতে চায় নি। রোগীর চেয়ে ভিড় বেশি হত বন্ধুর। নামের ব্রাহ্মণবাবুদের ছেলেরা আসত বনুর ডিসপেনসারিতে। কাপের পর কাপ চা আসত। হাস্যধ্বনিতে আতুরালয়ের মৌন বিষণ্ণতা যেন চাবুকের আঘাতে মুহুর্মুহুঃ চকিত ত্রস্ত হয়ে উঠত। রোগীরা বসে থাকত। সংশয়াপন্ন রোগীর স্তিমিত জীবনদীপের শিখাকে সমুজ্জ্বল করবার জন্য শাস্ত্রোক্ত সঞ্জীবনী তৈলের মত ওষুধ যে ব্রান্ডি, সে ব্রান্ডি চলত উল্লাসের জন্য।
এখানে পড়বার সময় ব্যভিচার থেকে তার ব্যাধি হয়েছিল। কলকাতায় পড়তে পড়তে আবারও ব্যাধিগ্রস্ত হয়েছিল। সে কথা সে তাকে জানায় নি। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন, সালসা খাওয়া দেখে ধরেছিলেন। তখন সালভারশন ইনজেকশন উঠেছে বটে কিন্তু খুব প্রচলন হয় নি। রক্ত পরীক্ষার এত ব্যাপক প্রসার হয় নি, সহজ সুযোগও ছিল না। দুটি তিনটি ইনজেকশনে ক্ষত নিরাময় হলেই লোলাকে ইনজেকশন বন্ধ করত। প্রথম মহাযুদ্ধের পর তখন সালভারশনের দাম অনেক এবং ওষুধ দুষ্প্রাপ্য। ক্ষত নিরাময়ের পর লোকে সালসা খেত। উইলকিনসন্স্ সারসা পেরিলা।
তখন দাতব্য চিকিৎসালয়ের ডাক্তার চক্রধারী ঘোষ, বনবিহারী থেকে কয়েক বছরের বড়, বনবিহারীর বন্ধু। বনবিহারীর মজলিসে চক্রধারী আসত, বিকেলবেলা এখানেই চা খেত; সন্ধ্যার পর বনবিহারী যেত চক্রধারীর বৈঠকে। সেখানে গানবাজনার আসর বসত-নিরুদ্বেগে নিরুপদ্রব উল্লাস চলত। গানবাজনা পানভোজন। গভীর রাত্রে বনবিহারী ফিরত। যেদিন মশায় বাড়িতে থাকতেন সেদিন বনবিহারীর জড়িত কণ্ঠস্বর তাঁর কানে আসত। বনবিহারীর সঞ্জীবন ফার্মেসিতেও মধ্যে মধ্যে নৈশ আড্ডা বসত-পানভোজন চলত। সকালবেলা উঠে জীবনমশায় দেখতে পেতেন উচ্ছিষ্ট পাতা, ভুক্তাবশেষ, দাওয়ার ধারে দুর্গন্ধ উঠত, দেখতে পেতেন বমি করার চিহ্ন, অগন্ধের সঙ্গে বিকৃত মদ্যগন্ধ পেতেন—ভনভন করে মাছি উড়ত; দু-একটা কুকুর তাই চাটত আর মশায়কে দেখে লেজ নাড়ত। কিন্তু বলবার উপায় থাকত না। এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই জড়িত থাকতেন—জামাতা। সুরমা সুষমার তখন বিবাহ হয়েছে।
দুটিই পয়সাওয়ালা বাপের সন্তান; উচ্চ কুলীন। কী করবেন? সেকালের বিচারে তারাই সুপাত্র। তবু তিনি খুঁতখুঁত করেছিলেন। পেয়েছিলেন ভাল ছেলে। স্কুলমাস্টার। কিন্তু সে অন্য কারও পছন্দ হয় নি। চল্লিশ টাকা মাইনে কি উপার্জন? লোকে নিন্দা করে বলেছে—ছি-ছি–ছি—এই বিশ-পঁচিশ বিঘে জমি-সম্বল পরিবার কি মশার বংশের যোগ্য কুটুম্ব সবচেয়ে বেশি বলেছিল আতর-বউ এবং বনবিহারী। শুধু ওরাই নয়, তিনি নিজেও দায়ী। উঁর মনও এতে সায় দিয়েছিল। তবে একটা বিষয়ে তিনি প্রতারিত হয়েছিলেন। তার জন্য মানুষ দয়ী নয়, কাল তাঁকে প্রতারিত করেছিল। তিনি বুঝতে পারেন নি যে কালধর্মে উত্তরপুরুষ কুলধৰ্ম ত্যাগ করেছে জীর্ণ কন্থার মত। এ অঞ্চলের বৈষ্ণব মন্ত্ৰ উপাসক কায়স্থ সমাজের ছেলেরা কালধর্মে মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়েছে বা হবে এটা তিনি অনুমান করতে পারেন নি।
মহাসমারোহ করেই তিনি মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন। তারা আসত। তাদের আসার অজুহাতেই মশার বংশের অন্দরের রান্নাশালে মাংস প্রবেশ করেছিল।
অতীত কথা মনে করতে করতে গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ জীবনমশায়।
ওই চক্রধারী ডাক্তারকে মশায় বলেছিলেন–চক্রধারী, বনবিহারী এত সালসা পেরিলা খায় কেন হে? জিজ্ঞাসা কোরো তো।
চক্রধারী হেসে বলেছিল বনবিহারী তো নিজেই ডাক্তার; ওসব ওর উপরে ছেড়ে দিন।
–হুঁ। কিন্তু—
–ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। সেসব সেরে গিয়েছে। সালসা পেরিলা খায় শরীর ভাল হবে বলে। আমিও খাই।
—ভাল।
কিন্তু প্রকৃতি অনাচার সয় কতদিন? অমিতাচারী অসতর্ক বনবিহারী পড়ল ম্যালেরিয়ায়। বিচিত্র ব্যাপার; ডাক্তার বনবিহারী কুইনিন খেত না; কুইনিনের বদলে প্রতিষেধক হিসেবে খেত ব্রান্ডি। মশায় নিজে খেতেন শিউল পাতার রস, মধ্যে মধ্যে কুইনিনও খেতেন। বনবিহারী হাসত। দেশে তখন প্রবল ম্যালেরিয়া। বছরের পর বছর পাহাড়িয়া নদীর বন্যার মত দেশকে বিধ্বস্ত করে চলেছে। ওই দাঁতুর মত। জ্বর হলে বনবিহারী ম্যালেরিয়া মিকশ্চারের সঙ্গে আউন্স দুয়েক ভাইনাম গ্যালেসিয়া মিশিয়ে নিত। নিজেই প্রেসক্রিপশন করে নিজের ডাক্তারখানা থেকেই আনিয়ে নিত। নিজের ডাক্তারখানায় না থাকলে পাঠাত নবগ্রামে সীতারামের দোকানে। সীতারাম বনবিহারীর সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। সীতারামও মরেছে অকালে। অমিতাচারের নিমন্ত্রণে মৃত্যু তার জীবনে এসে প্রবেশ করেছিল কদর্যতম মূর্তিতে। কুষ্ঠ হয়েছিল সীতারামের। কখন হয়েছিল উপদংশ—তাকে গোপন করেছিল। তারই বিষজর্জরতায় সীতারামের দেহরক্ত কুষ্ঠবীজ সংক্রমণের গুপ্তপথ খুলে দিয়েছিল। হতভাগ্য সীতারাম।
হতভাগ্য বনবিহারী। ক্রমে ক্রমে অমিতাচার অনিয়মের প্রশ্রয়ে রোগ হয়ে উঠল জটিল। আয়ুও ক্ষয় হল, দেহ জীৰ্ণ হল।
লিভার, প্লীহ্যাঁ, পুরনো ম্যালেরিয়া, রক্তহীনতা, পানভোজনের প্রতিক্রিয়া—সব জড়িয়ে সে এক জটিল ব্যাধি।
জীবনমশায় মনে মনে বনবিহারীর অকালমৃত্যুর কথা অনুমান করেছিলেন। মশার বংশের আয়ু মহৎ সাধনার পরমায়ু সে পাবে না, পাবার অধিকারীই নয়। কিন্তু এত শীঘ্ৰ যাবে, ভাবতে পারেন নি। অকস্মাৎ একদিন চোখে পড়ে গেল। সকালবেলা বাড়ির ভিতরে দাওয়ায় বসে বনবিহারী চা খাচ্ছিল। আরোগ্য-নিকেতন থেকে কী একটা বিশেষ প্রয়োজনে বোধ করি টাকা নেবার জন্য তিনি বাড়ি ঢুকেছিলেন। পূর্বন্বারী কোঠাঘরের বারান্দায় বনু বসেছিল, পরিপূর্ণ রৌদ্র উপভোগের জন্য।
বনবিহারীর রৌদ্রালোকিত মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। রক্তহীন বিবৰ্ণ মুখ বনবিহারীর, দৃষ্টি ক্লান্ত এবং ওই বিবৰ্ণ পাণ্ডুরতার উপরে যেন একটা পাংশু অর্থাৎ ছাই রঙের সূক্ষ্ম আস্তরণ পড়েছেনয়?
সেদিন তিনি বিধিলঙ্ন করে গোপনে ঘুমন্ত বনবিহারীর নাড়ি পরীক্ষা করেছিলেন; সন্তৰ্পণে হাতখানি নামিয়ে রেখে নেমে এসেছিলেন। তিনিই সেদিন নিজে চক্রধারীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন বনবিহারীর রোগ কি কমেছে চক্রধারী? কী বুঝছ?
চক্রধারী একটু চিন্তিত হয়েই বলেছিল—আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অন্যরকম। আমি বলব বলব ভাবছিলাম। বনবিহারীকে আমি বলেছি। আমার মনে হচ্ছে কালাজ্বর।
–কালাজ্বর?
–হ্যাঁ। বনবিহারীকে একবার কলকাতায় পাঠান। একবার দেখিয়ে আসুক।
–যাক। তাই যাক। তুমি যখন বলছ। যাক।
–আপনি একদিন দেখুন ভাল করে।
–না। দেখা উচিত নয়। আর–যাক। যাক, কলকাতা গিয়ে দেখিয়ে আসুক।
বনবিহারী কলকাতা গেল, সঙ্গে আতর-বউ গেল। মশায় বলেছিল—বউমাকেও নিয়ে যাও সঙ্গে।
—বউমাকে? কেন? না। ওই সৰ্বনাশীকে বিয়ে করেই বনু আমার গলে গেল রোগে। না। ওর নিশ্বাস আমি লাগতে দেব না।
মশায় আবার বলেছিলেন—এসব বলতে হয় না আতর-বউ। ওতে ছেলে-বউ দুজনের মনেই কষ্ট হয়। বউমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও, আমার কথা শোন, তোমার সাহায্য হবে, তা ছাড়া বনুর মন ভাল থাকবে। এখন মন ভাল থাকাটা আগে দরকার।
এই শশাঙ্কর বধূটির কথা সেদিন মনে পড়েছিল। মনে মনে বলেছিলেন তোমাকে মাছের মুড়ো খেতে দিয়েছিলাম। এবং তোমাকে দেওয়া কথা অনুযায়ী আমার পুত্রবধূকে স্বামীসঙ্গ ভোগের জন্যই সঙ্গে পাঠাচ্ছি।
আসামের কালব্যাধি কালাজ্বর। এককালে মৃত্যু-আশ্রিত ম্যালেরিয়াই বলত লোকে। তারপর কালাজ্বরের স্বতন্ত্র স্বরূপ ধরা পড়েছে। জীবাণু আবিষ্কৃত হয়েছে। বাঙালি ডাক্তার ইউ. এন. ব্রহ্মচারী তার ওষুধ আবিষ্কার করেছেন।
তার বাবা বলতেন—আসামে এক ধরনের বিষজ্বর আছে। সাক্ষাৎ মৃতু; মহামারীর মত। গতিপ্রকৃতি। সেই রোগে ধরল বনবিহারীকে?
না। চক্রধারী নূতন ডাক্তার, নূতন কালের রোগ এবং নূতন ওষুধের উপর একটি ঝোঁক আছে। তিনি নাড়ি দেখে বুঝেছিলেন জীৰ্ণ জ্বর পুরনো ম্যালেরিয়া-জীবনকে ক্ষয় করে শেষ সীমান্তে উপনীত করেছে। অন্ধকার মৃত্যুলোকের ছায়ার আভাস ওই আস্তরণ।
তার কথাই সত্য হয়েছিল। রক্তপরীক্ষায় কালাজ্বরের বীজাণুর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় নি। কলকাতায় বনবিহারীর শিক্ষকেরা যত্ন করেই দেখে ব্যবস্থাপত্র করে তাকে বায়ু পরিবর্তনে। যেতে আদেশ করেছিলেন।
কিন্তু সেখান থেকে ফিরে এল জীর্ণতর হয়ে।
রোগ মৃত্যুরোগে পরিণত যখন হয়তখন রিপুই জীবনের বুদ্ধিদাতা। অমৃত বলে বিষ খাওয়ার দুৰ্ম্মতি দেয় সে। পোর্ট ওয়াইন খেতে দিয়েছিলেন ডাক্তার। বনবিহারী দুদিনে এক বোতল পোর্ট খেত, তার সঙ্গে দ্রুত শক্তি সঞ্চয়ের জন্য মুরগি খেতে শুরু করেছিল।
মৃত্যুর তিন দিন আগে মশায় আতর-বউকে বলেছিলেন-বুক বাঁধতে হবে আতর-বউ। বনুর ডাক এসেছে।
আতর-বউ বজ্ৰাহতের মত কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত থেকে বজ্ৰবহ্নিতে জ্বলে উঠেছিলেন, বলেছিলেন বলতে তোমার মুখে বাঁধল না? তুমি বাপ!
—আমার যে মশায় বংশে জন্ম আতর-বউ। আমার যে একটা কর্তব্য আছে। বনুকে প্ৰায়শ্চিত্ত করানো আমার কর্তব্য।
–না-না-না।
বনবিহারী সে কথা শুনতে পেয়েছিল। হাউহাউ করে কেঁদেছিল সে।বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও। প্ৰায়শ্চিত্ত আমাকে করিয়ো না। তা হলে আমি আরও বাঁচব না।
—বেশ, তা হলে কিছু খেতে যদি সাধ থাকে—খেতে দিয়ে। আতর-বউ তাও পারেন নি। সেদিনের জ্বরটা ছেড়ে গেলে বনবিহারী নিজেই আচার চেয়ে খেয়েছিল।
আতর-বউ দেন নি, দিয়েছিল বনবিহারীর স্ত্রী। পরের দিন বনবিহারী ভাল রইল। চক্রধারী। কুইনিন ইনজেকশন দিয়ে গেল।
জীবনমশায় জানতেন—এরপর একটা প্রবল জ্বর আসবে। আগামীকালের মধ্যে।
কখন আসবে জ্বর?
বিনিদ্র হয়েই শুয়ে ছিলেন। ভাবছিলেন।
গভীর রাত্রে সেদিন আবার ডাক এসেছিল।
—ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু!
–কে?
–আজ্ঞা, পশ্চিম পাড়ার হাজি সাহেবের বাড়ির লোক।
–কী? ছেলে কেমন আছে? ডাক্তার উঠে বসেছিলেন। হাজির ছেলের সান্নিপাতিক চিকিৎসা তিনিই করেছেন।
—আসতে হবে একবার। বড় বাড়াবাড়ি।
–যাচ্ছি। চল।
পথ সামান্য। মাইল দেড়েক। কিন্তু অন্ধকার রাত্রি, ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে পথ। মশায় ভারী পায়ে শব্দ তুলে ভাবতে ভাবতে চলেছিলেন। লোকটা চলেছিল আলো হাতে কাঠের কলবাক্স মাথায় নিয়ে আগে আগে । যমে-মানুষে লড়াই। রোগে ভেষজ দ্বন্দ্ব। মনে আছে, সব ভুলে শুধু চিন্তা করেছিলেন–ষ্ট্ৰিকনিন, ডিজিটেলিস, এড্রেনলিন। হার্ট, নাড়ি, রেসপিরেশন। গভীর চিন্তায় মগ্ন মশায় যেন ঘুমের ঘোরে পথ চলেছিলেন সেদিন, রাত্রির অন্ধকার, দুপাশের ধানক্ষেত এসব যেন কিছু ছিল না। মধ্যে মধ্যে নক্ষত্রঝলমল আকাশের দিকে চোখ পড়েছিল। ক্ষণিকের জন্য, আবার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নামিয়ে নিয়েছিলেন।
সেখানে গিয়ে রোগীর বিছানার পাশে বসে নাড়ি পরীক্ষা করে আলো তুলে ধরে রোগীর উপসর্গ লক্ষ্য করে চোহারা দেখে গন্ধ বিশ্লেষণ করে অনেক চিন্তা করে ওষুধ দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ বসে ওষুধের ক্রিয়া লক্ষ্য করে বাড়ি ফিরেছিলেন। হাজির নাতির ক্রাইসিস কাটবে। প্রশান্ত অথচ অবসন্ন মনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে ভগবানের কাছে বনবিহারীর মঙ্গল কামনা করেছিলেন। সবই জানেন—তবু কামনা করেছিলেন।
পূর্বদিগন্ত থেকে পাণ্ডুর জ্যোত্মাকে গ্রাস করে অন্ধকার সম্প্রসারিত হচ্ছে, দূরের গ্রামান্তর। অন্ধকারে অস্পষ্ট হয়ে হয়ে অন্ধকারে ঢাকা পড়ছে।
ঠিক রোগীর দেহে মৃত্যুলক্ষণ সঞ্চারের মত; নখের কোণ নীল হয়ে উঠছে, হাত-পায়ের তালুর পাণ্ডুরতা ক্রমশ সর্বদেহে ব্যাপ্ত হচ্ছে।
বাড়ি ফিরে একবার থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘
না। তখনও জ্বর আসে নি। ভালই আছে বনু। সকলে গাঢ় ঘুমে ঘুমুচ্ছে।
তিনিও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল—তার ঘরের দরজায় কে তাঁকে ডাকছে।-বাবা!
বনু!
কী হল? তাড়াতাড়ি দরজা খুলেছিলেন; সামনে উঠানে অন্ধকার থমথম করছে, গাঢ় নির্জনতার মধ্যে ঝিঝি ডাকছে। কই বনু? কে ডাকলে সম্ভবত তার মনে হয় বনু ডেকেছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তিনি বনুর ঘরের দরজায় গিয়ে ডেকেছিলেন—আতর-বউ!
—অ্যাঁ! সাড়া পেয়ে চমকে উঠেছিলেন জীবনমশায়। আতর-বউ জেগেছে। তবে আসছে।
–বনু কেমন আছে?
শীতশীত করছে বলছে, হয়ত জ্বর আসবে।
আসবে নয়, তখন এসেছে! উঃ, সে কী ভীষণ কম্প!
***
সেই কম্পই শেষ কষ্প বনুর।
মশায় সেদিন শেষরাত্রির আকাশের দিকে তাকিয়ে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন আরোগ্যনিকেতনের দাওয়ার উপর। উত্তর-পশ্চিম কোণে কালীতলা, দাওয়ার পাশেই কুয়ো, করবীর গাছ দুটো ফুলে ভরা। সামনে শিশির ভেজা ধুলোয়-ভরা নিথর পথখানা পড়ে ছিল। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে তারাগুলিকে দেখছিলেন, কোথায় কোন্ তারা? কোথায় সপ্তর্ষিমণ্ডল, অরুন্ধতী কোথায়? ধ্ৰুব? ধ্রুবতারা গেল কোথায়? কাল পুরুষ? পূর্বদিগন্তে তখন দণ্ড দুয়েক আগে চঁদ উঠেছে; কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশীর চাঁদ। তাদের মতে ক্ষয়রোগগ্রস্ত চাদ; পাণ্ডু বিবৰ্ণ, ক্ষয়িত কলেবর, পাঁচ ভাগের চার ভাগ ক্ষয়ে গিয়েছে; ক্লান্তির আর পরিসীমা নাই যেন। জ্যোক্সও স্নান। আকাশে ছড়িয়েছে কিন্তু তাতে আকাশের দ্যুতি খোলে নাই। নীলিমার মধ্যেও যেন পাণ্ডুরতার ছায়া পড়েছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই শশাঙ্কের বউয়ের কথা মনে পড়েছিল। দৃষ্টি নামিয়ে তাকিয়েছিলেন শশাঙ্কের বাড়ির গলিপথটার দিকে। সেদিনও ওই গলিটার মুখে তখন জ্যোত্মার একটা ফালি মলিন-থানকাপড়-পরা একটি বিষণ্ণ নারীমূর্তির মত দেওয়ালের গায়ে লেগেছিল; কিন্তু সেদিন আর শশাঙ্কের স্ত্রী বা মঞ্জরী বলে ভ্ৰম হয় নাই।
ঠিক এই সময়েই বনুর উচ্চ চিৎকার শোনা গিয়েছিল—গেল! গেল! গেল! ধর! ধর! ধর! আঃ! হা-হা-হা! মা! মা! মা! প্ৰলাপ বকতে শুরু করেছিল বনু।
–বাবা! বনু! বনু রে! সাড়া দিয়েছিলেন আতর-বউ।
শেষ সময়ে বনুর একবার জ্ঞান ফিরেছিল। কেঁদেছিল সে।
—আমাকে বাঁচাতে পারলে না!
মশায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আতর-বউ ডেকেছিলেন—একবার দেখে যাও। কিছু ওষুধ দাও। লোকে বলে তোমার ওষুধে মরণ ফিরে যায়।
—যায় না। কারুর ওষুধে যায় না। আমাকে ডেকো না।
চক্রধারী অবশ্য এসেছিল; শিয়রে সে-ই বসেছিল। দুটো ইনজেকশনও সে দিয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুকে ডাকলে সে কোনো প্রতিরোধই মানে না। সে শক্তির আবিষ্কার হয় নি, হবে না। যতক্ষণ ব্যাধি ততক্ষণ ওষুধ, কিন্তু ব্যাধির হাত ধরে মৃত্যু এসে আসন পাতলে সব ব্যর্থ।
শুধু দুঃখ হয়েছিল বনুর জন্যে। কাঁদছে বনু!
মনে পড়েছিল হাসিমুখে যারা মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের কথা।
* * *
দেখেছেন বৈকি এমন রোগী। কদাচিৎ নয়—একটি দুটি নয়। অনেক অনেক দেখেছেন তিনি। একালের ডাক্তারেরা দেখতে পায় না, পাবে না। তিনি দেখেছেন। অনেক দেখেছেন, নিতান্ত সাধারণ মানুষের মধ্যেই দেখেছেন।
নবগ্রামের রায় বংশের ভুবন রায়ের কথা মনে পড়ছে।
তখন মশায়ের বাবার আমল। জীবন মশায়ের তরুণ বয়স। ভুবন রায় তখন প্রায় সর্বস্বান্ত। জগৎ মশায়কে ডেকে পাঠালেন—মশায়কে বোলো, আমাকে যেন একবার দেখে যায়।
জগৎ মশায়ের চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিলেন ভুবন রায়। দরিদ্র বৃদ্ধ নিজের বাড়ির ভাঙা। দেউড়িতে হুঁকো হাতে বসে থাকতেন। অভাব এমনই প্রচণ্ড যে, যে-কোনো পথচারীকে তামাক খেতে দেখলে তাকে ডাকতেন, কুশল প্রশ্ন করতেন, পরিশেষে বলতেন—দেখি, তোমার কষ্কেটা একবার দেখি।
তরুণ জীবন দত্ত সেদিন ভুবন রায়ের ডাক শুনে মনে মনে হেসেছিলেন। অবশ্য জগৎ মশায়কে বলতে সাহস করেন নি। ভেবেছিলেন, উঃ, মানুষের কী বাঁচবার লালসা! এই বয়স সংসারের কোথাও কোনো পূর্ণতার আকর্ষণ নাই—তবু ভুবন রায় মরতে চায় না।
জগৎ মশায়ের সঙ্গে তিনিও গিয়েছিলেন। হেঁড়া ময়লা বিছানায় শুয়ে ভুবন রায় ক্ষীণকণ্ঠে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন—এস মশায়, এস। এস।
–কী হল?
–যেতে হবে কি না দেখ তো ভাই।
–যেতে তো হবেই রায়মশাই। বয়স মানেই কাল–
হেসে রায় বলেছিলেন—সে কথা ভুবন রায় ভুলে যায় নি জগৎ। সেই কাল পূর্ণ হল কি না দেখ। কাল পূর্ণ না করে অকালে যাওয়া যে পাপ। সেও ভুবন রায় যাবে না। লোকে বলে গেলেই খালাস। তা অকালে জেলখানা থেকে পালালে কি খালাস হয় রে ভাই? পালিয়ে যাবেই। বা কোথা? আবার এনে ভরে দেবে। এখন খালাসের সময় যদি হয়ে থাকে–দেখ দেখি। এখানকার কটি কৃত্য আছে আমাকে সারতে হবে।
ভুবন রায়ের বিষয় থাকতে বন্ধুর কাছে পাঁচশো টাকা নিয়েছিলেন। সে টাকার দলিল ছিল না, বন্ধুও সর্বস্বান্ত ভুবন রায়কে কোনোদিন তাগাদা করতেন না, কিন্তু ভুবন রায় সেটি ভুলতে পারেন নি। অনেকবারই এ সম্পর্কে তার কর্তব্য করবার চেষ্টা করেছিলেন। পারেন নি। কিন্তু কল্পনা ছিল। বন্ধুর কাছে মাফ চেয়ে নিতে হবে। কিন্তু সে কি সহজ? ভেবে রেখেছিলেন মৃত্যুর পূর্বেতা সে বন্ধুরই হোক আর নিজেরই হোক, চেয়ে নেবেন মুক্তি। তাই নিজের মৃত্যুর কথা স্থির জেনে তবে বন্ধুকে ডেকে হাত জোড় করে বলবেন—আমাকে মুক্তি দাও।
অবশ্য বিঘাখানেক নিষ্কর জমি রেখেছিলেন, সেইটুকু দেবারও সংকল্প ছিল ভুবন রায়ের।
একটি টাকা বালিশের তলা থেকে বের করে মশায়ের হাতে দিয়েছিলেন। জগৎশায় হাত জোড় করে বলেছিলেন—আমাকে মার্জনা করুন, রায়মশাই।
—তা হয় না জগৎ। বৈদ্যপ্রণামী না দিলে মুক্তি আসবে না আমার। তারপরেই হেসে বলেছিলেন—আমার শ্রাদ্ধ তো একটা হবেই, তাতেই তুমি এক টাকার জায়গায় দু টাকা নৌকুতো দিয়ে।
বন্ধুর কাছে মুক্তি নিয়ে ভুবন রায়ের হাসিমুখে চোখ বোজার কথা অনেকদিন পর্যন্ত মানুষ স্মরণ করে জীবনে ভরসা সঞ্চয় করেছে। তিনি নিজেও করেছেন।
শুধু কি ভুবন রায়? গণেশ বায়েন! এ তো বিশ বছর আগের কথা। তার আরোগ্য নিকেতনের দাওয়ার সামনে খোলা একখানা গাড়িতে চেপে আশি-পঁচাশি বছরের বুড়ো গণেশের সেই আসার কথা আজও চোখের উপর ভাসছে। লম্বা লাঠিখানায় ভর দিয়ে বুড়ো নেমে শোরগোল তুলেছিল সেদিন। চিরদিনের কালা গণেশের শোরগোল তুলে কথা বলাই অভ্যাস। ছোটমশায় কই গো? আমাকে আগে দেখ। কই? পরের গাড়ি চেয়েচিন্তে এসেছি। ওরা আবার চলে যাবে, লবগেরামের লটকোণের দোকানে জিনিস লেবে। বুড়োকে আগে বিদেয় কর।
লোকজন সকলেই অবাক হয়েছিল গণেশের দাপট দেখে।
মশায়ও গণেশকে দেখে প্রথমটা চিনতে পারেন নি। কে?
শীর্ণ দীর্ঘদেহ বৃদ্ধ! কে? গণেশ বায়েন নয়? চিতুরার গণেশ বায়েন! হ্যাঁ, সেই তো!
গণেশ তার চেয়েও বয়সে বড়। দশ-পনের বছরের বড়। গণেশ তাঁর বিয়েতে ঢোল বাজিয়েছে, মায়ের চন্দনধেনু শ্রাদ্ধে, বাবার বৃষোৎসর্গে ঢাক বাজিয়েছে, বনুর বিয়েতেও বাজনা বাজিয়েছে; গণেশ দাবি করে দীনবন্ধু মশায়ের অর্থাৎ তার পিতামহের শ্রাদ্ধেও সে ঢাক বাজিয়েছে। আশি-পঁচাশি বৎসর বয়স হবে গণেশের। সেই কারণেই গণেশ তাঁকে ছোটমশায় বলত।
জীবনমশায় প্রশ্ন করেছিলেন-গণেশ? কী রে? তোর কী হল?
—অ্যাঁ? কান দেখিয়ে গণেশ বললে—জোরে বল!
ভুল হয়ে গিয়েছিল তার, গণেশ চিরদিন কালা, বৃদ্ধ বয়সে বেশি হয়েছে। নিজেই চিৎকার করছে অর্থাৎ নিজেই শুনতে পাচ্ছে না নিজের কথা। মশায় কণ্ঠস্বর উঁচু করেই বলেছিলেন-কী ব্যাপার?
—অসুখ! ব্যাধি ধরেছে।
–তোরও অসুখ হল শেষে?
–হবে না? যেতে হবে না?
–হবে নাকি?
–তাই তো দেখতে বলছি গো। দেখ। মনে যেন তাই লাগছে, বুঝেছ?
–অসুখটা কী তাই বল আগে।
–পেটের গোলমাল গো!
–পেটের গোলমাল?
–হ্যাঁ। হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে মুখর বৃদ্ধ বলেই গিয়েছিল—বুঝেছ, আরও হয়ত ছ মাস। এক বছর বাতাম। তা সেদিন ঢাক বাজিয়ে ভাইপো একটা পঁঠার চরণ এনেছিল; তা মনে হল জীবনে এম পিথিমীতে, মাংস তো খেলাম না। সারাজীবনে বাদ্যি বাজিয়ে পেসাদী মাংস পেলাম। অনেক, মুখে দিলাম না। অথচ সাধ তো আছে। ও না খেলে তো ছুটি হবে না। তাই বাপু খেলাম। ভালই লাগল। কিন্তু ওতেই লাগল ফ্যাসাদ। পেটের ব্যামো হল—দুদিন খুব পেটে মোচড় দিলে, তাপরেতে ঘাটে গেলাম একদিন; খুব সে ঘাটে-যাওয়া। সেই সূত্রপাত। এখন তোমার দু মাস হয়ে গেল—সেই চলেছে। এখন আবার আমেশা হয়েছে। কী রকম মনে হচ্ছে বাপু।
জীবনমশায় ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন—এ অবস্থায় এলি কেন? আসা ঠিক হয় নি। খবর দিলেই তো পারসি!
কে একজন বলেছিল—তোমার তো টাকা আছে শুনতে পাই হে। না হয় মশায়কে দু টাকা দিতে।
—অ্যাঁ, কী বলছে এঁটে বল গো!
–বলি, তোমার তো টাকা আছে হে।
—আছে। সাত কুড়ি টাকা আমার আছে। পুঁতে রেখেছি। তাই তো এয়েচি মশায়ের কাছে, মশায় বলুক। আমি তা হলে জীবন-মচ্ছবটা করে ফেলি। ছেলে নাই পরিবার নাই-ভাইপোরা টাকা কটা নেবে, কিছুই করবে না। জমি আছে—সে ওদের পাবার, ওরা নিক। টাকাটা আমি জীবন-মচ্ছবটা করে আর মা চণ্ডীর পাট-অঙ্গন বাঁধিয়ে খরচ করে যাব। তা দেখ। ভাল করে দেখে বল কতদিন আর বাকি।
—বোস। একটু জিরিয়ে নে।
গণেশ খুব সমঝদারের মত ঘাড় নেড়ে বলেছিলা। সে বুঝেছ, ওই রোগ হতেই আমি বুঝেছি। উই ইনি যেসে লয়। ইনি সে-ই তিনি। মন ঠিক বলে দিয়েছিল। তবু বলি, কে জানে মুরু-সুরুক্ষু মানুষ, যাই ছোটমশায়কে দেখিয়ে আসি। তার তো ভুল হবে না! তা হলে ঠিক আছে! চণ্ডীমায়ের পাট-অঙ্গন বাধাবার কাজ লাগিয়ে দিই। তাপরেতেজীবন-মম্ব। হরি হরি বল মন। হরি হরি বল।
বলে প্রণাম করে দুটো টাকা নামিয়ে বলেছিল—না বোলো না। স্রোল বিনা পয়সায় দেখেছ। এই দুই টাকাতে শোধ!
মনে মনে সেদিন প্রশ্ন জেগেছিল-–গণেশ কি সত্যিই বুঝতে পেরেছিল?
শরৎ চন্দের দিদিমার কথা মনে পড়েছিল। বনুর মৃত্যুর মাস আষ্টেক আগের কথা।
তাকে হাত দেখতে ডেকেছিল।
সেও বুঝতে পেরেছিল। ডাক শুনতে পেয়েছিল। বৃদ্ধা চিরদিনই খেতেদেতে ভালবাসত। খাওয়াদাওয়া আয়োজন করতেও জানত। শরতের দিদিমার হাতের ফুলবাড়ি আর পঁপর ছিল উপাদেয় সামগ্রী। সেই কারণেই মশায় হাত দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কী খেতে ইচ্ছে হয় গো?
জিভ কেটে বৃদ্ধা বলেছিল—আমার পোড়াকপাল। এই কথা তুমি জিজ্ঞাসা করলে বাবা?
—তবে কী সাধ হয় বল।
–শরৎকে দেখব শুধু। দেখে বল, কদিন বাঁচব। শরৎ ফিরে আসা পর্যন্ত থাকব?
শরৎ তখন বি. এ. পরীক্ষা দিচ্ছে। শরতের মা বলেছিল—বলুন, টেলিগেরাপ করব কি না।
—নাঃ, দিন পনের দেবউ আছে। শরৎ তো সাত দিন পরে আসবে?
–হাঁ।
—তা হলে ঠিক আছে। নাতি দেখতে তুমি পাবে দে-বউ। কিন্তু কষ্ট কী বল। খোরাক কয়েক ওষুধ দেব।
–কষ্ট অস্বস্তি। আর কী? মনে হচ্ছে—গেলেই সুখ। নিশ্চিন্দি। বাঁচি।
এমন অনেক মানুষকে দেখেছেন। এই যাওয়াই তো যাওয়া। মৃত্যুর সমাদরের অতিথি। একালে তেমন অতিথি বোধ করি মৃত্যু পায় না।
আর কি হবে না? ঠিক এই সময়েই আতর-বউ চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলেন–ওরে বনু রে!
***
বিপিন সম্পর্কে তিনি বলতে পারবেন না।
বিপিন বনবিহারীর মত অসহায় আর্তের মত চিৎকার করে নি, করার কথাও নয়। সে কর্মবীর। সে কাঁদবে না। কিন্তু প্রসন্ন প্রশান্তভাবেও আত্মসমর্পণ করতে পারবে না। তার বেদনা ক্ষোভের হাহাকারে ফেটে পড়বে।
অন্ধকারের মধ্যে আত্মমগের মত পথ হাঁটছিলেন তিনি। সত্য সত্যই যেন স্থানকাল সম্পর্কে চেতনা ছিল না তার। চেতনা ফিরে এল নবগ্রামের বাজারের আলোয়।
চৌমাথাটায় দোকানে দোকানে আলো জ্বলছে। সেকালের মত ম্লান আলো নয়। উজ্জ্বল আলো। পেট্রোম্যাক্স, লণ্ঠন, দেওয়ালগিরি আড়াইশো বাতি, পঁচিশ বাতি, চল্লিশ বাতি। এই আলোর ঝলক তার চোখে লেগে তাঁকে সচেতন করে দিল। সামনে একটা মনিহারীর দোকানের ঝকমকে জিনিসগুলি চোখে যেন রঙ ধরিয়ে দেয়। হরেন ডাক্তারের দোকানে ওরা কারা?
প্রদ্যোত ডাক্তারের স্ত্রী আর সেই আগন্তুক বন্ধুটি। তারা দুজনেই বেরিয়ে এল এই সময়। ডাক্তারের স্ত্রী সুন্দরী মেয়ে, তার ওপর সেজেছে। মনোরমা করে তুলেছে নিজেকে। মশায় দাঁড়ালেন। তারা দুজনে চলে গেল, টর্চ জ্বালিয়ে ডানপাশের অন্ধকার পথ ভেদ করে। ওই পথে তাকেও যেতে হবে।
কোলাহল উঠছে চারিদিকে। বাজারের কেনাবেচা চলছে। বেছে অল্প আলো যেদিকটায় পড়েছিল সেই দিকটা ধরে তিনি চৌমাথাটা পার হয়ে মোড় ফিরলেন। এবার পথ আবার অন্ধকার। বাঁচলেন তিনি। বিপিনের কথা কেউ জিজ্ঞাসা করলে কী বলতেন তিনি? অনেকটা আগে ডাক্তারের স্ত্রী আর ডাক্তারের বন্ধুটি চলেছে।
অন্ধকার রাস্তায় বালি-কাঁকরের উপর মশায়ের পায়ের জুতোর শব্দ উঠছে। এই জায়গাটা নির্জন, বসতিহীন। অনেকটা পিছনে নবগ্রামের বাজারপটির আলোর ছটা শূন্যলোকে ভাসছে। এতটা দূরে বাজারের কোলাহল স্তিমিত হয়ে এসেছে, ক্ষীণ হয়ে আসছে ক্রমশ। বর্ষার মাঠে ব্যাঙের ডাকের ঐকতান উঠছে। কলরব করছে। ওটা কী যন্ত্ৰণাকাতর শব্দ! ওঃ, সাপে ব্যাঙ ধরেছে! মশায় থমকে দাঁড়ালেন। আবার চললেন।
বড় পুকুরটার পাশ দিয়ে এসে মাঠের মধ্যে রাস্তার একটা বাঁক ফিরতেই আলো পেলেন। মশায়। হাসপাতালের কোয়ার্টারের জানলায় বারান্দায় আলোর ছটা পড়েছে; হাসপাতালের বারান্দায় আলো জ্বলছে। প্রদ্যোত ডাক্তারের বারান্দায় পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে। ওই যে ডাক্তারের স্ত্রী আর বন্ধুটি। প্রদ্যোত ডাক্তার বসে রয়েছে। চারুবাবু ডাক্তার। আরও কজন।
–এতক্ষণে ফিরছেন ডাক্তারবাবু?
–হাসপাতালের বাইরের দেওয়ালের পাশ থেকে কে একটি লোক বেরিয়ে এল। কে? বিনয়? চিনতে পেরে আশ্চর্য হলেন মশায়। বি-কে মেডিক্যাল স্টোর্সের মালিক বিনয়।
—ডাক্তারদের মিটিং হচ্ছে।
–মিটিং?
–হ্যাঁ। আমাকে বয়কটের ব্যবস্থা হচ্ছে।
–তোমাকে বয়কটের?
–হ্যাঁ। কাল যাব আমি আপনার কাছে। মিটিং শুধু আমাকে নিয়েই নয়, আপনিও আছেন। বলব, কাল সকালে সব বলব। যাব আমি। এখানকার সব ডাক্তার এসেছে। ওই দেখুন না। এখন হরেন শুধু আসে নি। চারুবাবু প্রদ্যোতবাবু যাচ্ছে, হরেনকে নিয়ে বিপিনবাবুকে দেখে। আসবে; এসে মিটিং হবে। আপনি দেখে এলেন বিপিনবাবুকে? আপনি থাকলেন না? ও আপনাকে বলে নাই বুঝি?
মশায় কোনো জবাব দিলেন না। না, কোনো কথাই তিনি বলবেন না।
বিনয় বললে—আজ সকালে কিশোরদাদা তো খুব বলেছে আপনার কথা। সারা গাঁয়ে একেবারে হইহই করছে।
এ কথারও কোনো উত্তর দিলেন না মশায়। বিনয় বলেই গেল—প্রদ্যোত ডাক্তার শুনলাম খুব চটেছে।
মশায় এবার বললেন– আমি যাই বিনয়।
বিনয় চকিত হয়ে উঠল–হ্যাঁ। ওরা আসছে। আমিও যাই। কাল যাব আমি আপনার কাছে।
সে আবার দেওয়ালের পাশ দিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল। চারুবাবু, প্রদ্যোত, প্রদ্যোতের বন্ধু বারান্দা থেকে নেমে চলে আসছে।