২৫
খোঁচাখুঁচি করা হেমাঙ্গর একটা বদ অভ্যাস। এটা যে ভাল অভ্যাস নয়, তাও সে জানে। তবে মানুষ তো অভ্যাসেরই দাস। বিখ্যাত ডেন্টিস্ট অতীন নন্দীর চেম্বারে তাকে যেতে হয়েছিল রিটার্নের কিছু জরুরি কাগজপত্র আনতে। বিদেশ প্রত্যাগত নন্দী মস্ত ডাক্তার, তার কাছে সবসময়ে ভি আই পিদের ভিড়। এইসব লোককে কিছু কাগজপত্রের জন্য বা জিজ্ঞাসাবাদের কারণে নিজের অফিসে পারতপক্ষে টেনে আনে না সে। নিজেই চলে যায়। এটুকু পাবলিক সারভিস সে ইচ্ছে করেই দেয়। নন্দী হয়তো বড় বড় ব্যবসায়ীদের মতো মস্ত ক্লায়েন্ট নয়, কিন্তু গুরুতর ক্লায়েন্ট। এঁর মতো লোক হাতে থাকলে আরও অনেক লোক চলে আসে। সাধারণ মানুষদের স্বভাবই হল, জেনে বা অজান্তে ভি আই পিদের অনুসরণ করা।
উপরন্তু নন্দী তার অনেকটা বন্ধুর মতোই হয়ে গেছে।
বিকেলে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার দরুন নন্দীর চেম্বারে ভিড় ছিল না তেমন। নন্দী শেষ রুগীটিকে বিদায় দিয়ে ব্রিফকেস থেকে দরকারি কাগজপত্র বের করে দিল। তারপর বলল, আচ্ছা মশাই, আপনার দাঁতে কোনও কমপ্লেন নেই?
কমপ্লেন! না তো!
আছে কিনা তা আপনি জানেন?
হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, আমার দাঁত আর আমি জানবো না?
নন্দী হেসে বলে, অত সোজা নয়। দাঁতের কমপ্লেন তৈরি হয় খুব ধীর গতিতে। প্রথমটায় বোঝাও যায় না। যখন বোঝা যায় তখনও কেউ সহজে ডেন্টিস্টের কাছে আসতে চায় না। যখন ট্রাবল বাড়ে তখন আসে বটে, কিন্তু তখন আর দন্তোৎপাটন ছাড়া চিকিৎসা থাকে না। সাহেবরা কিন্তু নিয়মিত দাঁত চেক আপ করায়। ওটাই উচিত কাজ।
সাহেবদের কথা আলাদা। তারা মদ মাংস বেশী খায়। আমার সে অভ্যাস নেই। শোওয়ার আগে আমি রোজ দাঁত ব্রাশ করি।
মাঝে মাঝে একটু ক্লিনও তো করে নিতে পারেন। আমার খুব ভাল যন্ত্র আছে, ব্যথা দেবো না।
ক্লিন! তাই না করাবো কেন? আমি পান-টান খাই না, সিগারেটও নয়।
নন্দী হাসল, আচ্ছা, ঠিক আছে। তবু একবার দেখে দিলে আপত্তি নেই তো?
হেমাঙ্গ অবাকের ওপর অবাক হয়ে বলে, আরে কমপ্লেন হলে তো আপনার কাছেই আসবো!
নন্দী কথাটায় কান দিল না। একটু সহজাত কর্তৃত্বের ভাব আছে তার। বংশগত অভ্যাসই হবে। কারণ, নন্দীদের একসময়ে বিরাট জমিদারি ছিল। ওর দাদু ছিল রায়বাহাদুর।
রিক্লাইনিং চেয়ারে তাকে বসিয়ে আলো-টালো ফেলে হেমাঙ্গর দাঁত পরীক্ষা করে নন্দী অবশ্য বলল, আরে বাঃ, এ তো সত্যিই পারফেক্ট দাঁত! চমৎকার! শুধু বাঁ দিকে কষের দাঁতে একটা কেরিজ দেখা যাচ্ছে। ওটা সিল করে দিচ্ছি।
ঘুরন্ত উকো দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে নন্দী খানিকটা পুটিং-এর মতো জিনিস ঠেসে দিল।
তারপর বলল, আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?
কেন, আমার দাঁতের কি এতই খারাপ অবস্থা যে, ঈশ্বরবিশ্বাসের দরকার হবে!
আরে নাঃ, দাঁত ফার্স্টক্লাস আছে। তবে, এই যে চমৎকার দাঁতের সারি, এটা কি একটা কেমিক্যাল অ্যাকসিডেন্ট? মানুষের শরীর, গরু, মোষ, জীবজন্তু, গাছপালা এসবই অ্যাকসিডেন্টাল বলে আপনি বিশ্বাস করেন? নাকি সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ আছে?
হঠাৎ একথা কেন?
ডারউইন থেকে শুরু করে বড় বড় সায়েন্টিস্টরা কেউই সৃষ্টিতত্ত্বকে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। একটা র্যানডম অঘটন বলে জোড়াতাপ্পি দেওয়া এক্সপ্লানেশন দিচ্ছেন। আপনি কি সেটা বিশ্বাস করেন?
কি বললে আপনি খুশি হবেন?
আরে, আপনার কি নিজস্ব কোনও মতামত নেই!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেমাঙ্গ বলে, হিসেবের খাতা থেকে চোখ তোলার সময় পেলে তো ভগবান-টগবান নিয়ে ভাববো! সময়টা কোথায়?
নন্দী ভ্রূ কুঁচকে বলে, তার মানে কি আপনি আমার চেয়েও ব্যস্ত লোক? আমার দুটো চেম্বার, একটা হাসপাতাল আর তিনটে নার্সিং হোম অ্যাটেন্ড করতে হয়, তা জানেন? তবু আমি সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে ভাবার সময় পাই।
হেমাঙ্গ ফাঁপরে পড়ে বলল, ভগবানের কথা আমার মনেই হয় না যে!
কেন হয় না? এই যে আপনার চারদিকে জমজমাট পৃথিবী, চারদিকে প্রাণের প্রকাশ, এসব দেখে এর পিছনকার প্যাটার্নটার কথা আপনার জানতে ইচ্ছে করে না? এই জড় জগৎ থেকে দুম করে জীব সৃষ্টি হয়ে গেল আর সেটা সম্ভব করে তুলল মস্তিষ্কহীন, কল্পনাহীন জড়বস্তুই—এটা কি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা!
তা তো মনে হচ্ছে না।
ওরকম জলে-পড়া ভাব করবেন না। ব্যাপারটা ভাবার মত কিনা বলুন তো!
খুবই ভাবার মতো কথা।
নন্দী হেসে ফেলল, আচ্ছা আজ আর আপনাকে বিব্রত করব না। বেশ বিপদে পড়েছেন দেখা যাচ্ছে।
বিপদটা অবশ্য সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে এল না। হেমাঙ্গ এক কৌটো স্টেরিলাইজড প্ল্যাস্টিকের টুথপিক কিনেছিল বড় একটা ওষুধের দোকান থেকে। সেই টুথপিক দিয়ে দাঁতের সিলিংটা একটু খুঁচিয়ে দেখতে ইচ্ছে হল তার, রাতের খাওয়ার পর। কারণ সবসময়েই দাঁতে একটা ফরেন জিনিস ঢুকে থাকার অস্বস্তি হচ্ছিল তার। খোঁচাখুঁচির ধাক্কায় সিলটা হঠাৎ আলগা হয়ে গেল। আর তারপর থেকেই—ব্যথা নয়, একটা সিরসিরে ভাব ফুটো দাঁতটায় টের পেতে লাগল সে। ব্যাপারটা সাইকোলজিক্যাল না ফিজিকাল সেটা ভাবতে ভাবতে দুশ্চিন্তা নিয়েই সে ঘুমোলো। সে স্বপ্ন দেখল, একদিন সকালে উঠে সে দেখছে সে সম্পূর্ণ ফোকলা, আর তার দাঁতগুলো সব খসে ঝরা শিউলির মতো বালিশে আর বিছানায় ছড়িয়ে পড়ে আছে। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে নিজের চেঁচানিতেই ঘুম ভাঙল হেমাঙ্গর। ঘড়িতে দেখল, ভোর সাড়ে চারটে।
বেলা সাড়ে দশটায় হেমাঙ্গ একটা ছোট্ট রেল স্টেশনে নামল। গঞ্জ পার হয়ে জলকাদায় থকথকে একটা গেঁয়ো পথ রিকশায় ডিঙিয়ে একটা দীন বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে নামল। আজ রবিবার। রবিবারে রবিবারে সে মাঝে মাঝে এরকম শৌখিন অডিট করে বেড়ায়। টাকার জন্য নয়, এইসব আউটিং তাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।
মাঝবয়সী কেরানিবাবু অপেক্ষা করছিলেন। রিকশা থেকে হেমাঙ্গ নামতেই, অফিসঘর থেকে বেরিয়ে এসে, বারান্দা থেকেই হাঁক মারলেন, আসুন স্যার, আসুন।
জলকাদায় ভরা উঠোনে পা ফেলার জন্য জোড়া জোড়া ইঁট পাতা। সাবধানে পা ফেলে হেমাঙ্গ বারান্দায় এসে উঠল। ব্যারাক বাড়ির মতো টিনের দীনদরিদ্র বাড়ি। চল্টা ওঠা মেঝে, নোনাধরা দেওয়াল, জীর্ণ দরজা-জানালা। কেমন একটা ভ্যাতভ্যাতে গন্ধ।
অফিসঘর আজ তার সম্মানে কিছুটা সাজানো হয়েছে। টেবিলের ওপর একটা এমব্রয়ডারি করা সবুজ টেবিলক্লথ পাতা। চেয়ারের পিছনে একটা তোয়ালে।
ডাব আনি স্যার?
দাঁতের ফুটোটায় বারবার জিব চলে যাচ্ছে। হেমাঙ্গ বলল, আনুন।
কোল্ড ড্রিংক্সও আছে স্যার।
না, ডাব হলেই চলবে।
তারপর একটু চা খাবেন তো!
সেটা পরে হবে। কাগজপত্র সব রেডি তো!
আজ্ঞে, সব রেডি। ম্যাডামও আজ এসেছেন। আপনি এলে খবর দিতে বলেছেন। ডাবটা খেয়ে নিন, ওঁকে ডাকছি।
ম্যাডাম মানে হেড মিস্ট্রেস। কেরানিবাবু পর্যন্ত হেমাঙ্গর কোনও অসুবিধে নেই। খাতাপত্রে কোনও অনিয়ম বা অসম্পূর্ণতা থাকলে মৃদু অসন্তোষ প্রকাশ করা যেতে পারে। কিন্তু মহিলারা এন্ট্রি নিলেই মুশকিল। তাঁদের সঙ্গে কখনও এঁটে ওঠে না হেমাঙ্গ। আর কে না জানে হেড মিস্ট্রেসরা সাধারণত রাশভারী, ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা হন, যাঁদের হেমাঙ্গ বরাবর ভয় পায়।
সে বলল, ঠিক আছে। তবে ওঁর একটু পরে এলেও হবে। আমরা বরং কাজটা শুরু করে দিই।
কিন্তু প্রধান শিক্ষিকা ডাবের পিছু পিছুই এলেন। তাঁকে দেখে নিজের অজান্তেই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল হেমাঙ্গ। ছিপছিপে, ফর্সা, অল্পবয়সী, ধারোলো চেহারার এই মহিলাকে হেড মিস্ট্রেস বলে মনেই হয় না। খুবই শহুরে চেহারা। অত্যাধুনিক সাজপোশাক। উপরন্তু বিদেশী সুগন্ধী চারদিকটা মোহময় করে রেখেছে মেয়েটির।
লজ্জা পেয়ে মেয়েটি বলল, আরে! দাঁড়ালেন কেন? বসুন!
হেমাঙ্গ ধপ করে বসে পড়ল। সে গাঁয়ে গঞ্জে অনেক বালিকা বিদ্যালয়ে অডিট করতে গেছে, কিন্তু এরকম হেড মিস্ট্রেস কখনও দেখেনি। এ তে রূপালি পর্দা থেকে নেমে এসেছে! কিংবা তাও নয়। আরও একটা বেশী মাত্রা যোগ হয়েছে। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের নভেলের নায়িকা-টায়িকাদের মতো। তার মানে এ নয় যে, হেমাঙ্গ রবীন্দ্রনাথের সব নভেল পড়েছে বা পড়ে। কিন্তু একটা আন্দাজ আছে তো! সুচরিতা, লাবণ্য এদের কথা খামচা খামচা ভাবে যেটুকু জানে হেমাঙ্গ, তা হয়তো এরকমই। হেমাঙ্গ আধোবদন হল।
হেমাঙ্গ যে নার্ভাস বোধ করছে সেটা মেয়েটি স্পষ্ট বুঝতে পারল। সংকোচহীন চোখে হেমাঙ্গকে একটু মেপে নিয়ে বলল, আপনার তো মস্ত বড় ফার্ম, এ সব ছোটোখাটো অডিট আপনারা করতে এলে আমরা যে ভয় পেয়ে যাই!
হেমাঙ্গ জানে, কেন সে গাঁ-গঞ্জে অডিট করতে যায়, তা প্রায় কাউকেই বুঝিয়ে বলে লাভ নেই। কেউ বুঝবে না। এ মেয়েটি তো নিশ্চয়ই নয়। সে মৃদু মিষ্টি হাসি দিয়ে প্রসঙ্গটিকে পাশ কাটাল। নিবিষ্টভাবে প্ল্যাস্টিকের স্ট্র দিয়ে ডাবের জলটা ধীরে ধীরে টেনে নিতে লাগল ভিতরে। এবং টের পেল, তার সেই দাঁতটা সিরসির করছে। খুব মৃদু, খুব সামান্য, তবু করছে।
স্কুলের দফতরি গোটা চারেক মিষ্টি, দুটো সিঙাড়া, দুখানা নিমকি, কয়েক টুকরো আপেল, কয়েকটা আঙুর, দুটো সিঙ্গাপুরী কলা দিয়ে সাজানো দুটো প্লেট অতি সম্মানের সঙ্গে রেখে গেল সামনে, সঙ্গে পরিষ্কার কাচের গ্লাসে জল।
মেয়েটি বলল, খান।
হেমাঙ্গর অভিজ্ঞতা সর্বত্রই অল্পবিস্তর একইরকম। সর্বত্রই এরকম মিষ্টির প্লেট সাজিয়ে দেওয়া হয়, হেমাঙ্গ স্পর্শও করে না। সে মৃদু স্বরে বলল, আমি খেয়ে এসেছি। ওসব নিয়ে যেতে বলুন।
অন্যান্য জায়গায় এই মৃদু আপত্তিকে সম্মতির লক্ষণ বিবেচনা করে প্রচণ্ড চাপাচাপি করা হয়। এমনকি প্রবল আপত্তিকেও অগ্রাহ্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই শহুরে মেয়েটি মৃদু হেসে বলল, আমি নগেনবাবুকে আগেই বলেছিলাম, এত জলখাবারের আয়োজন করবেন না, বড়লোকেরা বেশী খান না। উনি শুনলেন না। নষ্ট হবে, জানাই ছিল।
হেমাঙ্গ মৃদু হেসে বলে, নষ্ট হবে না। কেউ খেয়ে নেবে, যাদের খিদে আছে।
মেয়েটি একটু মিষ্টি হেসে বলে, ঠিক আছে। কিন্তু দুপুরে খাবেন তো! অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে যে আপনার জন্য বিরাট রান্নাবান্না হচ্ছে।
খাবো। এই বলে নিঃশেষিত ডাবটা চেয়ারের পাশে নামিয়ে রেখে রুমালে মুখ মুছে সে বলল, আমি বড়লোক একথা আপনাকে কে বলল?
বুঝতে অসুবিধে হয় না।
কথাটা শুনে হেমাঙ্গ একটু খুশিই হল। মেয়েটির দিকে সে মোটেই তাকাচ্ছে না। সে জানালা দিয়ে কখনও মাঠের একটা লাল গরুকে দেখছে, কখনও দৃশ্যহীন সিলিং-এর দিকে চেয়ে গলাটা একটু চুলকে নিচ্ছে, কখনও দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের বাঁধানো ফটোর ওপর একটা ধৈর্যশীল মাকড়সাকে বসে থাকতে দেখছে, তবু কি করে যেন এর ফাঁকে ফাঁকে না তাকিয়েও মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে সে। দুষ্টুমিতে ভরা বিচ্ছুর মতো মুখ, নিতান্তই চব্বিশ পঁচিশ বয়সের এই মেয়েটা, কি করে হেড মিস্ট্রেস হল? বাপ-দাদার জোরে? নাকি রাজনীতির ব্যাকিং-এ?
প্রশ্নটা করতে অনেক সময় লাগল হেমাঙ্গর। ঘণ্টা দুয়েক বাদে যখন কাগজপত্র খাতা হিসেব ইত্যাদি নিয়ে তিনজনে খুবই ব্যস্ত, তখন হঠাৎ এক ফাঁকে হেমাঙ্গ বলল, আপনি বেশ অল্প বয়সেই হেড মিস্ট্রেস হয়েছেন, না?
মেয়েটি একটু অবাক হয়ে বলে, অল্প বয়স? মোটেই না। আমার আঠাশ চলছে।
আঠাশ কি অনেক বয়স?
অনেক। হেড মিস্ট্রেস হতে গেলে বয়সটা ফ্যাক্টর নাকি?
হেমাঙ্গ তটস্থ হয়ে বলে, না, তা অবশ্য নয়। তবে কিনা—
নগেনবাবু তাড়াতাড়ি হেমাঙ্গর কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ম্যাডামের বিলিতি ডিগ্রি।
ওঃ, দ্যাট এক্সপ্লেনস্ ইট।
মেয়েটি ঠাণ্ডা গলায় বলে, হোয়াট এক্সপ্লেন হোয়াট?
আপনার বিলিতি ডিগ্রি, আর কে না জানে, আমরা মনে মনে এখনও সাহেবদের প্রতি দাস্যভাব পোষণ করি!
মেয়েটি অবাক হয়ে বলে, তাই নাকি? আমার তো সেরকম মনে হয় না।
কেরানি নগেনবাবু অতিশয় বিগলিত কণ্ঠে বললেন, ম্যাডামের জন্মই তো বিলেতে। লিভারপুলে।
শুনে হেমাঙ্গ প্রথা ভঙ্গ করে মেয়েটার মুখের দিকে এক ঝলক সোজাসুজি তাকাল। ভক্তি ভরে। তারপর মুখটা নামিয়ে নিয়ে বলল, তা হলে এই গাঁয়ের স্কুলে পড়ে থাকার দরকার কি?
মেয়েটি নগেনবাবুর দিকে একটু শাসনকরা দৃষ্টিক্ষেপ করে হেমাঙ্গর দিকে চেয়ে বলে, ওটাও কোনও নিয়ম নয়। বিলেতে জন্ম হলে বা বিলিতি ডিগ্রি থাকলে, এ দেশের গাঁয়ের স্কুলে চাকরি করা তো বেআইনী নয়।
ওটা তর্কের কথা। ঘটনা ওরকমভাবে ঘটে না।
মেয়েটি একটু চুপ করে থেকে বলে, সবাই ঠিক আপনার মতোই প্রশ্ন করে। বিলেতে জন্ম, বিলিতি ডিগ্রি, তা হলে গায়ের স্কুলে পড়ে আছো কেন? আমি তো মানেই বুঝতে পারি না।
হেমাঙ্গ মেয়েদের রাগকে সাঙ্ঘাতিক ভয় পায়। সে জানে, রেগে গেলে মেয়েরা অপ্রতিরোধ্য। সে তাড়াতাড়ি মোলায়েম গলায় বলে, এটা যদি আপনার একটা মিশন হয়ে থাকে তো ভাল কথা। প্রফেশন হলে কিন্তু লোকে অবাক হবেই। কারণ, ইচ্ছে করলেই আপনি যে-কোনও ভাল স্কুলে কলকাতাতেই চাকরি পেতে পারেন।
মেয়েটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সেটা ঠিক কথা। এটা আমার একটা মিশন। আমি এ দেশের গাঁয়ের স্কুলে চাকরি করছি অবস্থাটা বুঝবার জন্য। ঠিক চাকরি করার জন্য নয়।
কেমন বুঝছেন?
খুব ভাল নয়।
দুজনেই একটু হাসল। তারপর আবার কাজ। কাজের মাঝখানে মাঝখানে হেমাঙ্গ মেয়েটির গা থেকে উড়ে আসা মাদক গন্ধটি পাচ্ছিল। বিলিতি ডিগ্রিধারী, বিলেতে জন্মগ্রহণকারী মেয়েটি তাকে আরও একটু তটস্থ করেছে, অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। তার দাঁতটা কি একটু বেশি সুলসুল করছে?
বেঁটেখাটো টাক-মাথা অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার এলেন একটু বাদেই—এবার যে একটু উঠতে হবে। কিছু মুখে দিয়ে আসবেন চলুন। খাবার রেডি।
খেতে গিয়ে আর এক দফা বিপদে পড়তে হল হেমাঙ্গকে। তার আর মেয়েটির খাওয়ার আয়োজন হয়েছে একটা ছোটো টেবিলের দুধারে। মুখোমুখি। দুজনের বেশি বসার জায়গাও নেই। একখানা একটেরে ঘরে তারা দুজনই মাত্র। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারমশাই বশংবদ দরজার কাছে একটু তফাতে দাঁড়ানো।
হেমাঙ্গর যত সংকোচ, যত আড় হয়ে থাকা। মেয়েটির সেসব নেই। খেতে বসে বলল, আপনার সঙ্গে কিন্তু আমার ফর্মাল পরিচয়টাই হয়নি। আমার নাম রশ্মি রায়। আপনার নাম অবশ্য আমি জানি।
হেমাঙ্গর দাগী দাঁতটা অকারণে সুলসুল করে ওঠে এ কথায়।
হেমাঙ্গ কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। একটু ভাবতে হল। তারপর সম্পূর্ণ অনাগ্রহে প্রশ্ন করল, আপনি কি আগাগোড়া বিদেশেই লেখাপড়া করেছেন?
না। আমার আড়াই বছর বয়সে আমরা দেশে চলে আসি। আমি পড়াশুনো করেছি কলকাতায়। বি এস-সি পাশ করে ফের বিলেতে চলে যাই। দুবছর হল ফিরেছি।
আবার যাবেন?
রশ্মি মৃদু হেসে বলে, বিলেত এখন আর অত সুখের দেশ নেই। তবে সামনের বছর হয়তো যাবো। পারমানেন্টলি।
পারমানেন্টলি কথাটায় আবার দাঁতটা সুলসুল করল কেন? দাঁতটার কি কোনও রি-অ্যাকশন হচ্ছে? দাঁতের কি কাতুকুতু আছে? দাঁতের কি মস্তিষ্ক বা হৃদয় থাকা সম্ভব?
পারমানেন্টলি কেন?
কিছু কাজ করার ইচ্ছে আছে। বিদেশ ছাড়া কাজ করার উপায়ও নেই। এই যে স্কুলটা দেখছেন, এর যে কত প্রবলেম, ভাবতেই পারবেন না। তার ওপর ফান্ড নেই, পলিটিক্যাল প্রেসার আছে, ইন ফাইটিং আছে, ভেস্টেড ইন্টারেস্ট আছে। এইটুকু একটু স্কুল নিয়েও কত কি হয়, না দেখলে বিশ্বাস হত না। আপনি আজ খুব আলগাভাবে অডিট করেছেন, ভাল করে হিসেব দেখেননি। দেখলে অনেক ভূতুড়ে এন্ট্রি খুঁজে পেতেন।
হেমাঙ্গ একটু হাসল, পেয়েছি। তবে গাঁয়ের স্কুল বলে, বড় ধরনের গণ্ডগোল না থাকলে আমি প্রশ্ন তুলি না।
সো কাইন্ড অফ ইউ। প্রশ্ন উঠলে আমাকে বিব্রত হতে হত। আমার ইচ্ছে ছিল, ছোট্ট একটা গাঁয়ের স্কুলকে ধীরে ধীরে একটা মডেল স্কুল তৈরি করব। একটা একজাম্পল, তৈরি করব।
পারলেন না?
একদম নয়। একটা বিল্ডিং গ্র্যান্ট বের করতে, একটা এইড বের করতে, একটা উইং খোলার জন্য পারমিশন পেতে যে কী ছোটাছুটি করতে হয়। তাও কাজটা হয় না। এতদিন বাদে বুঝতে পারছি, এখানে পণ্ডশ্রম করে কোনও লাভ নেই। ভারতবর্ষ তার নিজস্ব দর্শনে চলবে, তাকে চালানো যাবে না। যারা সে চেষ্টা করেছেন কেউ পারেনি।
হেমাঙ্গ সপ্রশংস চোখে এক ঝলক রশ্মিকে দেখে নিল। কিছু বলল না। মেয়েটা বুদ্ধিমতী, সময় থাকতে সার সত্যটা বুঝতে পেরেছে।
রশ্মি একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, একজন লোক স্কুলটাকে তিন বিঘা জমি দান করে গেছেন।
আপনি বিশ্বাস করবেন না, সেই জমিটা আজ অবধি আমরা দখল করতে পারিনি। আদালতের হুকুম পাওয়া সত্ত্বেও। কেন জানেন? কিছু পাওয়ারফুল লোক ওই জমিতে চাষ করায়। কোনও সভ্য দেশ হলে এটা হতে পারত না।
ভারতবর্ষের জন্য লজ্জাবোধ করেই যেন হেমাঙ্গ মুখ নামিয়ে নিল এবং বেগুন বড়ির পাতুরিটা সরিয়ে রাখল, খেল না।
রশ্মি বলল, আপনি কিছু খাচ্ছেন না! না খেলে মাস্টারমশাই দুঃখ পাবেন। এ আয়োজনটা ওঁর নিজের। স্কুলের টাকায় নয় কিন্তু।
হেমাঙ্গ ফের অস্বস্তিতে পড়ল।
রশ্মি মৃদু স্বরে আদেশ করল, খান। আপনার খিদে পেয়েছে।
হেমাঙ্গ মৃদু স্বরে বলে, আমি মেয়েদের সামনে খেতে পারি না।
সে কী বলে রশ্মি খিলখিল করে হেসে ফেলল, আপনার বউও তো একটি মেয়েই, তার সামনে খান তো! তখন?
সেই জন্যই তো বিয়ে করিনি।
রশ্মি খুব হাসল, প্রথমে আপনাকে খুব গোমড়ামুখো মনে হয়েছিল, তা তো নন! আচ্ছা বাবা, আমি উঠে যাচ্ছি।
আরে না, আপনি বসুন। আমি খাচ্ছি। কিন্তু তাকাবেন না।
রশ্মি খুব সস্নেহে চেয়ে থেকে বলল, ও লজ্জাটা তো মেয়েদের থাকে। আমার অবশ্য নেই।
এই ছোটোখাটো কথা অদৃশ্য মাকড়সার মতো একটা জাল বুনে যাচ্ছে কি? তৈরি হচ্ছে একটা প্যাটার্ন? হেমাঙ্গ এই প্যাটার্নটাকে ভয় পায়। কোথাকার জল কোথায় গড়ায় কে জানে? হয়তো তারা আজ একসঙ্গে এক গাড়িতেই ফিরবে। হয়তো তারপর দক্ষিণ কলকাতাতেও! হয়তো কাছাকাছিই তাদের বাড়ি।
আচ্ছা কলকাতায় আপনি কোথায় থাকেন? উদ্বিগ্ন হেমাঙ্গ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে।
হাজরা।
হেমাঙ্গ হাঁ করে থাকে দু সেকেন্ড। তার দাগী দাঁতটা সুলসুল করে। হাজরা যে তার গা ঘেঁষে!