কার্তিকের শেষ। শীত পড়িবার সময় হইয়াছে। কিন্তু এবার শীত ইহারই মধ্যে বেশ কনকনে। হইয়া উঠিয়াছে। সকালবেলায় কাপুনি ধরে। শেষরাত্রে সাধারণ কাপড়ে বা সুতি চাদরে শীত ভাঙে না। কার্তিক মাসে লোক লেপ গায়ে দেয় না কারণ কার্তিক মাসে লেপ গায়ে দিলে মরিয়া পরজন্মে নাকি কুকুর হইতে হয়। তবুও লোকে লেপ-কাঁথা পাড়িয়াছে। বন্যার প্লাবনে দেশের মাটি এমনভাবে ভিজিয়াছিল যে, সে জল এখনও শুকায় নাই। ছায়ানিবিড় আম-কাঁঠালের বাগানগুলির মাটি-জানালাহীন ঘরের মেঝে এখন সেঁতসেঁত করিতেছে। বাউরিপাড়ার লোকে মেঝের উপর গাছের ডাল পুঁতিয়া বারি দিয়া মাচা বধিয়াছে। সতীশ গায়ে দেয় একখানা পাতলা ও জরাজীর্ণ বিলাতি কম্বল, সে এখনও লেপ গায়ে দেয় নাই।
পাতু বলে-কুকুর হতে দুঃখ নাই সতীশ-দাদা। তবে যেন বড় বড় রোয়াওলা বিলিতি কুকুর হই। দিব্যি শেকলে বেঁধে বড়লোকে পুষবে। দুধ-ভাত-মাংস খেতে দেবে।
অনিরুদ্ধ বলিয়াছে—আরে শালারেয়াতে উকুন হবে, রোয়া উঠে গেলে মরবি। ভাগিয়ে দেবে তখন।
—তখন ক্ষেপে গিয়ে যাকে পাব তাকে কামড়াব।
–ডাণ্ডার বাড়ি ঘাকতক দিয়ে না হয় গুলি করে মেরে ফেলবে।
–ব্যস, তখন তো কুকুর-জন্ম থেকে খালাস পাব! … পাতু আবার হাসিয়া বলে–আর যদি দিশি কুকুর হই, তবে তুমি পুষো আমাকে সতীশ-দাদা।
অনিরুদ্ধ আসিবার পর হইতে পাতুর কথাবার্তার ধারাটা এমনি হইয়াছে। খোঁচা দিয়া ছাড়া কথা বলিতে পারে না। পাতুর কথায় সতীশ একটু-আধটু আহত হয়।…
গতকাল রাত্রে ব্যাপারটা বেশ জট পাকাইয়া উঠিয়াছে। গোটা পাড়ার মেয়ে-পুরুষে মদ খাইয়াছে এবং হল্লা করিয়াছে। শেষে কলে খাঁটিবার মতলব প্রায় পাকা করিয়া ফেলিয়াছে। সতীশ ভোরবেলায় উঠিয়া বিলাতি কম্বল গায়ে দিয়া হাল জুড়িবার আয়োজন করিল। তাহাদের পাড়ায় সবসুদ্ধ পাঁচখানি হাল ছিল; পূর্বে অবশ্য আরও বেশি ছিল। ওই পাতুরই ছিল একখানা। এখন এই গো-মড়কের পর পচখানা হালের দশটা বলদের মধ্যে অবশিষ্ট আছে চারিটা। তাহারই শুধু দুইটা আছে—বাকি দুইজনের একটা একটা। তাহারাও দুইজনে মিলিয়া রবিফসলের চাষ করিবে ঠিক করিয়াছে। সতীশ তাহাদের একজনের বাড়িতে গিয়া তাগিদ দিল–আয়, সুফ্যি উঠে গেল।
অটল বলিল—এই হয়েছে লাও, তামাক একটুকুন ভাল করে খেয়ে লাও। আমি কালাচাদকে ডাকি, গরুটা লিয়ে আসি।
সতীশ তামাক খাইতে বসিল।
অটল ফিরিয়া আসিল একা। বলিল—সতীশ-দাদা, তুমি যাও, আমার আজ হল না।
—হল না?
অটল বলিল–যাবে না শালা কালাচেঁদে।
—যাবে না।
—যাবেও না, গরুও দেবে না। বলে—চাষবাস আমি করব না। আমার গরু আমি বেচে দোব। পার তো কিনে লাও। শালার আবার রস কত! বলে—পয়সা ফেল মোয়া খাও, আমি কি তোমার পর!
–হ্যাঁ। ভূতে পেয়েছে শালাকে।
ভূতই বটে। নহিলে পিতৃপুরুষের কাজকর্ম, কুলধৰ্ম মানুষ ছাড়িবে কেন? আঃ, এমন সুখের এমন পবিত্র কাজ কি আর আছে? জমি-চাষ, গো-সেবা-পবিত্র কাজ; কাজগুলি করিয়া যাও–মুনিবেরও ঘরের ধান, মাইনে, কাপড়, এই হইতেই তোমার চলিয়া যাইবে। বর্ষা বাদলে কোথাও মজুরি করিয়া মরিতে হইবে না। অবশ্য আগের মত সুখ আর নাই। আগে অসুখ হইলে মুনিবেরা বৈদ্য সুদ্ধ দেখাইত। তা ছাড়া মুনিবের ঘর হইতে কাঠ-কুটা-খড় এগুলা তো মেলেই। পালে-পার্বণে, মুনিববাড়ির কাজ-কর্মে উপরি বকশিশ আছে। সে সুখ ছাড়িয়া কলে। খাঁটিবার জন্য সব নাচিয়া উঠিয়াছে। কর্মকার কতকগুলা টাকা আনিয়া মদ খাওয়াইয়া লোকের মাথা খারাপ করিয়া দিল। কর্মকারের দোষ কি? সে কোনো দিন বলে নাই। ধুয়াটা তুলিয়াছে পাতু। পাতুই অনিরুদ্ধকে বলিয়াছে—আমাকে তুমি নিয়ে চল কন্মকার-ভাই। তোমার সঙ্গে আমি যাব।
অনিরুদ্ধ পাতুকে লইয়া যাইতে রাজি হইয়াছিল। সে তাহার অনেক দিনের ভাবের লোক। এককালে পাতুর যখন হাল ছিল—তখন পাতুই তাহার জমি চাষ করিত। তা ছাড়া সে দুর্গার ভাই।
অনিরুদ্ধ পাতুকে লইয়া যাইতে রাজি হইয়াছে শুনিয়া সবাই আসিয়া নাচিতে লাগিল–আমাকে নিয়ে চলেন কৰ্মকার মশায়। আমিও যাব। আমিও, আমিও, আমিও।
কর্মকারের আমোদ লাগিয়াছে। সে বলিয়াছে—সবাইকে নিয়ে কোথা যাব ব? তোরা এখানকার কলে গিয়ে খাট। কর্মকারের কি? না ঘর, না পরিবার, না জমি, না কিছু গায়ে-মায়ে সমান কথা—সেই গ্রামকেই সে ত্যাগ করিয়াছে; কলে খাঁটিবার পরামর্শ সে দিয়া বসিল।
কলে খাটা! ভাবিতেও সতীশের সর্বাঙ্গ শিহরিয়া ওঠে। হউক তাহারা গরিব, ছোট লোক, তবু তো তাহারা গৃহস্থ লোক। গৃহস্থ লোকে কি কলে খাটে!
সতীশ অটলকে বলিলনা দিক আয়, তু আমার সঙ্গে আয়। তিনটে গরু নিয়ে আমরা দুজনাতেই যতটা পারি করব—চল্।
অটল চুপ করিয়া বসিয়া ছিল; সেও পাতুর মত কিছু ভাবিতেছিল। সে উত্তর দিল না, নড়িলও না।
সতীশ ডাকিল–কি বলছিস, যাবি?
অটল মাথা চুলকাইয়া এবার বলিলতা পরে ভাগটো কি রকম করবে বল?
—ভাগা?
–হ্যাঁ।–
–যা পাঁচজনায় বলবে, তাই হবে।
–না ভাই। সে তুমি আগাম ঠিক করে লাও।
—বেশ। চল—যাবার পথে পণ্ডিত মাশায়ের কাছ হয়ে যাব। পণ্ডিত মাশায় যা বলবেন তাই হবে! পণ্ডিতের কথা মানবি তো?
পণ্ডিতের বাড়ির সম্মুখে বেশ একটি জনতা জমিয়া গিয়াছে। স্বয়ং শ্ৰীহরি ঘোষ মহাশয় দাঁড়াইয়া আছে। সেই কথা বলিতেছে; খুব ভারী গলায় বেশ দাপের সঙ্গেই বলিতেছে কাজটা তুমি ভাল করছ না দেবু!
আগে ঘোষ পণ্ডিতকে বলিত দেবু-খুড়ো। আজ শুধু দেবু বলিতেই। ঘোষ যে ভয়ানক। চটিয়াছে ইহাতে সতীশ এবং অটলের সন্দেহ রহিল না।
পণ্ডিত হাসিয়াই বলিল-সকালবেলায় উঠেই তুমি কি আমাকে শাসাতে এসেছ শ্ৰীহরি?
শ্ৰীহরি এমন উত্তরের জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিল না। সে কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হইয়া রহিল; তারপর বলিল—তুমি গ্রামের কত বড় অনিষ্ট করছ—তুমি বুঝতে পারছ না।
পণ্ডিত বলিল—আমি গ্রামের অনিষ্ট করছি?
করছ না? গ্রামের ছোটলোকগুলো সব চলল কলে খাটতে! তুমি তাদের উস্কে দিচ্ছা! পণ্ডিত বলিলনা। আমি দিই নি।
—তুমি না দিয়েছ, তুমি অনিরুদ্ধকে ঘরে ঠাঁই দিয়েছ। সে-ই এসব করেছে।
—সে গ্রামের লোক, আমার ছেলেবেলার বন্ধু। সে দুদিনের জন্যে বেড়াতে এসেছে, আমার ঘরে আছে। যতদিন ইচ্ছে সে থাকবে। সে কি করছে-না-করছে—তার জন্যে আমি দায়ী নই।
শ্ৰীহরি বলিলজানি, সে ছোটলোকের সঙ্গে মদ খায়, ভাত খায়! সেই লোককে তুমি ঘরে ঠাঁই দিয়েছ।
দেবু বলিল—অতিথের জাত বিচার করি না আমি। তার এটোও আমি খাই না। আর তা ছাড়া–-।… দেবু এবার হাসিয়া বলিল-আমিও তো পতিত, শ্ৰীহরি!
শ্ৰীহরি আর কথা বলতে পারিল না। সে আর দাঁড়াইলও না, নিজের বাড়ির দিকে ফিরিল।
শ্ৰীহরির পশ্চাদ্বর্তিগণের মধ্য হইতে হরিশ আগাইয়া আসিয়া বলিল—শোন বাবা দেবু, শোন।
দেবু বলিল–বলুন।
–চল, তোমার দাওয়াতেই বসি। না, চল বাড়ির ভেতর চল।
দেবু সমাদর করিয়াই বলিল—আসুন। সে তো আমার ভাগ্য।
বাড়ির ভিতরে আসিয়া হরিশ বলিল–ও পতিত-এতিতের কথা ছাড়া দাও। ও সব কথার কথা। কই, কেউ কোনোদিন বলেছে যে দেবু পণ্ডিতের বাড়ি যাব না, সে পতিত? না–তোমার বাড়ি আসে নি? ওসব আমরা ঠিক করে দেব।
দেবু চুপ করিয়া রহিল।
হরিশ বলিল—শ্ৰীহরি বলছিল, দেবুকে বলো হরিশ ঠাকুরদাদা, ও রাজি হয় তো আমার শালার একটি কন্যে আছে, ডাগর মেয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ করি। পতিত! বাজে, বাজে ওসব।
দেবু বলিল থাক্, হরিশ-খুড়ো-বিয়ের কথা থাক্। এখন আর কি বলছেন বলুন?
হরিশ বলিল—এ কাজ থেকে তুমি নিবিত্ত হও বাবা। এ কাজ কোরো না! গায়ে মুনিষ মিলবে না, মান্দের মিলবে না, মহা কষ্ট হবে লোকের। নিজেদের গোবরের ঝুড়ি মাথায় করে ক্ষেতে নিয়ে যেতে হবে। ওদের তুমি বারণ কর।
—বেশ তো, আপনারাই ডেকে বলুন।
–না রে বাবা। তোমাকে ওরা দেবতার মত মান্যি করে।
দেবু বলিল—শুনুন হরিশ-খুড়ড়া, আমি ওদের কিছু বলি নাই। বলেছে অনিরুদ্ধ। আগে আগে উড়ো-ভাসা শুনেছিলাম, ঠিক-ঠিক শুনেছি কাল রাত্রে। আমি সমস্ত রাত্রি ভেবে দেখেছি। কাগজ-কলম নিয়ে হিসেব করে দেখলাম-গাঁয়ের যত গেরস্ত বাড়ি, তার পাঁচগুণ লোক ওদের পাড়ায়। ইদানীং গায়ের গেরস্তদের অবস্থা এত খারাপ হয়েছে যে লোক রাখবার মত গেরস্ত হাতের আঙুলে গুনতে পারা যায়। অন্য গায়ের গেরুস্ত-বাড়িতে কাজ করে এখন বেশিরভাগ লোক। বানের পর তাদের অনেকেও মুনিষ-মান্দের ছাড়িয়ে দিয়েছে। এখন এ সব লোকে খাবে কি? খেতে দেবে কে বলুন দেখি?
হরিশ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। দেবু চুপ করিয়া রহিল তাহার উত্তরের প্রতীক্ষায়। উত্তর না পাইয়া সে বলিল—তামাক খাবেন? আন্ব সেজে?
হরিশ ঘাড় নাড়িয়া ইঙ্গিতে জানাইলনা। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল–আচ্ছা, তা হলে আমি উঠলাম।
বাড়ির দুয়ারে আসিয়া বলিল-গায়ের যে অনিষ্ট তুমি করলে দেবু, সে অনিষ্ট কেউ কখনও করে নি। সর্বনাশ করে দিলে তুমি।
দেবু বলিল—আমি ওদের একবারের জন্যেও কলে খাটবার কথা বলি নি, হরিশ-খুড়ো। অবিশ্যি আপনি বিশ্বাস না করেন, সে আলাদা কথা।
–কিন্তু বারণও তো করলে না!
কথা বলিতে বলিতে তাহারা রাস্তার উপর দাঁড়াইল; ঠিক সেই মুহূর্তেই চণ্ডীমণ্ডপ হইতে শ্ৰীহরির উচ্চ গম্ভীর কণ্ঠের কথা শোনা গেল-বলে দেবে, যারা কলে খাটতে যাবে তারা আমার চাকরান জমিতে বাস করতে পাবে না। কলে খাটতে হলে গা ছেড়ে উঠে যেতে হবে।
তরতর করিয়া চণ্ডীমণ্ডপ হইতে নামিয়া আসিল কালু শেখ। লাঠি হাতে পাগড়ি মাথায় কালু শেখ তাহাদের সম্মুখ দিয়াই চলিয়া গেল।
শ্ৰীহরির হুকুমজারি শুনিয়া দেবুর মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিয়াছিল, ওটা নিতান্ত বাজে হুকুম। সে জানে, লোকে ও-কথা শুনিবে না। সেটলমেন্ট কিন্তু একটা কাজ করিয়া গিয়াছে। পরচার। ওই কাগজখানা দিয়া নিতান্ত দুর্বল ভীরু লোককেও জানাইয়া দিয়া গিয়াছে যে, এই জমিটুকুর উপর তোমার এই স্বত্ব আছে, অধিকার আছে। আগে গৃহস্থ লোকেরা আপন আপন জমির উপর বাউরি, ডোম, মুচিদের ডাকিয়া বসবাস করিবার জায়গা দিত। তাহারা গৃহস্থের এ অনুগ্রহকে অসীম অপার করুণা বলিয়া মনে করিত। সেই গৃহস্থটির সুখ-দুঃখে তাহারা একটা করিয়া অংশগ্রহণ করিত পবিত্র অবশ্য-কর্তব্যের মত। পৃথিবীতে তাহাদের জমি থাকিতে পারে বলিয়া ধারণাই পুরুষানুক্রমে এই সব মানুষের ছিল না। তাই যে বাস করিতে এক টুকরা জমি দিত-সে-ই ছিল তাহাদের সত্যকার রাজা। পারিবারিক পারস্পরিক কলহ বিবাদে এই রাজার কাছেই তাহারা আসিত। তাহার বিচার মানিয়া লইত, দণ্ড লইত মাথা পাতিয়া। বেগার খাঁটিত উপঢৌকন দিত। আবার যেদিন রাজা বলিত—আমার জমি হইতে চলিয়া যাও, সেদিন আসিয়া তাহারা পায়ে ধরিয়া কাঁদিত, করুণা-ভিক্ষা করিত। ভিক্ষা না পাইলে—তল্পিতল্পা বাঁধিয়া স্ত্রী-পুত্র সঙ্গে লইয়া আবার কোনো রাজার আশ্রয় খুঁজিত। শিবকালীপুরে ইহাদের বাসজমিদারের খাস পতিত ভূমির উপর। শ্ৰীহরি জমিদারের স্বত্বে স্বত্ববান্ হইয়া আজ সেই পুরাতন কালের হুকুমজারি করিতেছে। কিন্তু ইহার মধ্যে কালের যে পরিবর্তন ঘটিয়াছে। তাহারা পূর্বকালের মত নিরীহ ভীরু নাই, আর সঙ্গে সঙ্গে সেটলমেন্ট আসিয়া সকলের হাতে পরচা দিয়া জানাইয়া গিয়াছে যে, এ জমিতে তোমাদের একটা লিখিত অধিকার আছে, যেটা মুখের হুকুমে যাইবে না। কথায় কথায় তাহারা এখন পরচা বাহির করে। শ্ৰীহরির এ হুকুমে কেহ ভয় পাইবে না—এ কথা দেবু জানে।…
গতরাত্রে সমস্ত রাত্রিটাই দেবুর ঘুম হয় নাই। তাহার শরীর অবসন্ন, চোখ জ্বালা করিতেছে। দুর্গাকে ছেলে কোলে করিয়া অকস্মাৎ শিউলিতলা হইতে বাহির হইতে দেখিয়া যে। মারাত্মক ভ্ৰম করিয়া বসিয়াছিল, তাহার অনুশোচনায় এবং ইহাদের এই কলে খাঁটিতে যাওয়ার কথা শুনিয়া কি যে তাহার হইয়া গেল, সারারাত্রি আর কিছুতেই ঘুম আসিল না।
দুইটা চিন্তা একসঙ্গে তাহার মাথায় আসিয়া এমনভাবে জট পাকাইয়া গেল যে শেষটা দুইটাকে পৃথক বলিয়া চিনিবার উপায় পর্যন্ত ছিল না। সে মাথায় হাত দিয়া স্থিরভাবে ধ্যানমপ্নের মত বসিয়া সমস্ত রাত্রি ধরিয়া চিন্তা করিয়াছে। বিলু-খোকা! উঃ, সে আজ কি ভুলই না করিয়াছে! ছেলেটাকে কোলে করিয়া দুর্গা শিউলিতলার পাশ দিয়া আসিতেই তাহার মনে হইল—বিলু থোকাকে কোলে লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে। এখনও পর্যন্ত সে সেই ছবিকে কিছুতেই ভ্রম বলিয়া মনে করিতে পারিতেছে না। উঃ, বিলু-খোকাহীন এই ঘর-এই ঘরে সে কি করিয়া আছে? কোন প্রাণে আছে? বুক তাহার হুহু করিয়া উঠিয়ছিল। পরের কাজ, দশের কাজ, ভূতের ব্যাপার! স্বর্ণ, স্বর্ণের মায়ের ভাবনা, তাহাদের সংসারের কাজকর্মের বন্দোবস্ত, স্বর্ণের পরীক্ষার পড়ায় সাহায্য, তিনকড়ির অপ্রশংসনীয় ফৌজদারি মামলার তদবির, সাহায্য-সমিতি—এই সব লইয়াই তাহার আজ দিন কাটিতেছে। সে এসব হইতে মুক্তি চায়। এ ভার সে বহিতে পারিতেছে না।
তিনকড়িদের বোঝা নামিতে আর বিলম্ব নাই। এই সময়ে অনি-ভাই আসিয়া বাউরি পাড়া, মুচি-পাড়া, ডোমপাড়ার লোকগুলিকে কলের কাজে ঢুকাইয়া দিবার ব্যবস্থা করিয়া ভালই করিয়াছে। যাকড় উহারা কলেই যাক। তাহার সাহায্য-সমিতির কাজের তিন ভাগ তো উহাদের লইয়াই। সমস্ত জীবনটাই তো সে উহাদের লইয়া ভুগিতেছে। তাহার মনে পড়িল উহাদের ময়ূরাক্ষীর বাঁধের তালগাছের পাতা কাটার জন্য শ্রীহরির সঙ্গে বিরোধ বাঁধিয়াছিল।* শ্ৰীহরি উহাদের গরুগুলি খোঁয়াড়ে দিলে, সে উহাদের উপকার করিবার জন্যই তাহার খোকার হাতের বালা বন্ধক দিয়াছিলষষ্ঠীর দিন। মনে পড়িল রাত্রে ন্যায়রত্ন মহাশয় নিজে বালা দুইগাছি ফিরাইয়া আনিয়াছিলেন। সেই দিন তিনি তাহাকে ধার্মিক ব্রাহ্মণের গল্পের প্রথম অংশ বলিয়াছিলেন। তারপর উহাদের পাড়াতেই আরম্ভ হইল কলেরা। সে উহাদের সেবা করিতে গিয়াই ঘরে বহন করিয়া আনিল মহামারী রাক্ষসীর বিষদন্তের টুক্রা; যে টুক্রা বিদ্ধ হইল খোকনের বুকে–খোকন হইতে গিয়া বিঁধিল তাহার বিলুর বুকে। উঃ, সেই সমস্ত সহ্য করিয়াও সে আজও ওই উহাদের বোঝা বহন করিয়া চলিয়াছে!
ন্যায়রত্নের গল্প মনে পড়িল—মেছুনীর ডালার শালগ্ৰামশিলার গল্প। সে উহাদের গলায় বাঁধিয়া আজও ফিরিতেছে। কিন্তু হইল কি? তাহারই বা কি হইল? ওই হতভাগ্যদেরই বা কি করিতে পারিয়াছে সে? বন্যার পরে অবশ্য সাহায্য-সমিতি হইতে উহাদের অনেক উপকার হইয়াছে। কিন্তু উপকার লইয়া কতকাল উহারা বাঁচিয়া থাকিবে? অন্ন নাই, বস্তু নাই, সংসারে কোনো সংস্থান নাই, অন্য কেহ উপকার করিতেছে—সেই উপকারে বাঁচিয়া থাকা কি সত্যকারের বাঁচা? আর পরের উপকারে বা কতদিন চলে? না, তার চেয়ে কলে-খাটা অনেক ভাল। অনি-ভাই তাহাদের বাঁচার উপায় বাহির করিয়াছে। চৌধুরীর লক্ষ্মী-জনার্দন শিলা বিক্রয় করিবার পর হইতে আর তাহার মেছুনীর ডালার শালগ্রামকে গলায় বাঁধিয়া ফেরার আদর্শে বিশ্বাস নাই। ন্যায়রত্ন মহাশয়ের কথায় তাহার অবিশ্বাস নাই। কিন্তু মেছুনীর ডালার শালগ্ৰাম হইতে এইবার ঠাকুর হাত-পা লইয়া মূর্তি ধরিয়া বাহির হইয়া আসুন এই সে চায়। তাহাতে তাহার হয়ত মুক্তি হইবে। কিন্তু তাহার মুক্তির পর শালগ্রামশিলার সেবা করিবে কে? তার্কিক হয়ত বলিবে—দেবু, তুমি ছাড়া সংসারে কোটি কোটি সেবক আছে। সত্য কথা। কিন্তু এ পরীক্ষা পুরনো হইয়া গিয়াছে। আর ওই বাউরি-ডোমেরাই যদি মেছুনীর ডালার শালগ্ৰাম হয়—তবে সেবকের চেয়ে দেবতার সংখ্যাই বাড়িয়া গিয়াছে। নাঃ, উহারা যদি নিজে হইতে বাঁচিবার পথ না পায়, তবে কাহারও সাধ্য নাই উহাদের বাঁচাইয়া রাখে। তাহার চেয়ে অনিরুদ্ধের পথই শ্রেয়। এ পথে অন্তত তাহারা পেটে খাইয়া, গায়ে পরিয়া—এখনকার চেয়ে ভালভাবে থাকিবে। একটা বিষয়ে পূর্বে তাহার ঘোর আপত্তি ছিল। কলে খাঁটিতে গেলে মেয়েদের ধর্ম থাকিবে না; পুরুষেরাও মাতাল উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিবে। কিন্তু কাল সে ভাবিয়া দেখিয়াছেও আশঙ্কাটা অমূলক না হইলেও, যতখানি গুরুত্ব সে তাহার উপর আরোপ করিয়াছে ততখানি নয়। গায়ে থাকিয়াও তো উহাদের ধর্ম খুব বজায় আছে! মনে পড়িয়াছে শ্ৰীহরির কথা, কঙ্কণার বাবুদের কথা, হরেন ঘোষালের কথা; ভবেশ-দাদা, হরিশ-খুড়ার যৌবনকালের গল্পও সে শুনিয়াছে। এই সেদিন শোনা দ্বারিকা চৌধুরীর ছেলে হরেকৃষ্ণের কথা মনে পড়িল। অনি-ভাই আগে যখন মাতামাতি করিয়াছিল—তখন সে গ্রামের মানুষ ছিল। ইহাদের মেয়েগুলি কঙ্কণার বাবুদের ইমারতে রোজ খাঁটিতে যায়, সেখানেও নানা কথা শোনা যায়। কালই চিন্তা করিতে করিতে হঠাৎ তাহার মনে হইয়াছে যে, মানুষের এ পাপ যায় যে পুণ্যে সেই পুণ্যে যতদিন সব মানুষ। পুণ্যবান না হইবে ততদিন বর্বর অবস্থায় এ পাপ থাকিবে। এ পাপপ্রবৃত্তি গ্রামে থাকিলেও থাকিবে, গ্রামের বাহিরে গেলেও থাকিবে। চেহারার একটু বদল হইবে মাত্ৰ।
যাক, অনি-ভাইয়ের কথায় যদি উহারা কলে খাঁটিতে যায় তো যাক। সে বারণ করিবে না। উহাদের দুঃখ-দুর্দশার প্রতিকারে ইহার অপেক্ষা বর্তমানে ভাল পথ আর নেই।
কলের মজুরও সে দেখিয়াছে। অনেকের সঙ্গে আলাপও আছে। তাহারা বেশ মানুষ। তবে একটু উচ্ছৃঙ্খল। ওই অনিরুদ্ধ সব চেয়ে ভাল নমুনা। তা হোক। উহারা যদি উপায় বেশি করে কিছু বেশি পয়সার মদ গিলুক। কিন্তু অনিরুদ্ধের শরীরখানা কি সুন্দর হইয়াছে! কত সাহস তাহার! উহারা এমনই হোক। সে বারণ করিবে না। ঘাড়ের বোঝ নামিতে চাহিতেছে—সে বাধা দিবে না। সে মুক্তি চায়, তাহার মুক্তি আসুক।
সে আজ বাধা দিলেও তাহারা শুনিবে না। এ কথা কাল রাত্রেই তাহারা তাহাকে বলিয়া দিয়াছে। গানের শব্দ ভাসিয়া আসিতেছিল হঠাৎ গান থামিয়া গিয়া একটা প্রচণ্ড কলরব উঠিল। আপন দাওয়ায় বসিয়া চিন্তা করিতেছিল দেবুকলরবের প্রচণ্ডতায় সে চমকিয়া উঠিয়া চুটিয়া। গিয়াছিল। মদ বেশি খাইলেই হতভাগারা মারামারি করিবেই। সকলেই বীর হইয়া ওঠে। রক্তারক্তি হইয়া যায়। মনের যত চাপা আক্রোশ অন্ধকার রাত্রে সাপের মত গর্ত হইতে বাহির হইয়া যুঁসিয়া ওঠে। অনেকে আবার মারামারি করিবার জন্যই মদ খায়।
দেবু গিয়া দেখিল—সে প্রায় কুরুক্ষেত্র কাণ্ড। মদের নেশায় কাহারও স্থির হইয়া দাঁড়াইবার শক্তি নাই, লোকগুলো টলিতেছে; সেই অবস্থাতেও পরস্পরের প্রতি কিল-ঘুষি হানাহানি করিতেছে। শত্ৰু-মিত্ৰ বুঝিবার উপায় নাই। একটা জায়গায় ব্যাপারটা সঙ্গিন মনে হইল। দেবু ছুটিয়া গিয়া দেখিল সত্যই ব্যাপারটা সঙ্গিন হইয়া উঠিয়াছে। পাতু নির্মম আক্ৰোশে একটা লোকের ভদ্রলোকের গলা টিপিয়া ধরিয়াছে; পাতু বেশ শক্তিশালী জোয়ান—তাহার হাতের পেষণে লোকটার জিভ বাহির হইয়া পড়িয়াছে। দেবু চিৎকার করিয়া বলিলপাতু, ছাড় ছাড়!
পাতু গর্জন করিয়া উঠিল—এ্যাঁও। না ছাড়ব না।
দেবু আর দ্বিধা করিল না, প্রচণ্ড একটা ঘুষি বসাইয়া দিল-পাতুর কাঁধের উপর; পাতুর হাত খুলিয়া গেল। ছাড়া পাইয়া লোটা বনবন করিয়া ছুটিয়া পলাইল, কিন্তু পাতু আবার ছুটিয়া আসিয়াই দেবুকে আক্ৰমণ করিতে উদ্যত হইল। দেবু ধাক্কা দিয়া কঠিন স্বরে বলিল পাতু!
এবার পাতু থমকিয়া গেল; মত্ত-চোখের দৃষ্টি স্তিমিত করিয়া দেবুকে চিনিতে চেষ্টা করিয়া বলিল–কে?
–আমি পণ্ডিত।
—কে, পণ্ডিত মশায়? … পাতু সঙ্গে সঙ্গে বসিয়া তাহার পায়ে হাত দিয়া বুলিল—পেনাম। আচ্ছা, তুমি বিচার কর পণ্ডিত! বামুনের ছেলে হয়ে ও-বেটা মুচি-পাড়ায় যখন তখন ক্যানে আসে?
ও-দিকে গোলমালটা তখন থামিয়া আসিয়াছে। সকলে চাপা গলায় বলিতেছে—এ্যাঁই চুপ। পণ্ডিত! … কেবল একটা নিতান্ত দুর্বল লোক তখন আপন মনেই দুই হাতে শূন্যে ঘুষি খেলিয়া চলিয়াছে। পাতু বলিতেছেনেহি মাংতা হ্যায়। তুমি শালার বাত নেহি শুনে গা! যাও!
দেবু বলিল—কি হল কি? তোরা এ সব আরম্ভ করেছিস কি?
পাতু বলিল-আমাদের দোষ নাই। ওই সতীশ সতীশ বাউরি। শালা আমার দাদা না কচু!
—কি হল? সতীশ কি করলে?
–বললে যাস না তোরা, যা না।
–কি বিপদ? যাস না কি?
পাতু হাত দুটি জোড় করিয়া বলিল—তুমি যেন বারণ কর না পণ্ডিত। তোমাকে জোড়হাত করছি।
—কি? ঠিক বারণ করব?
—আমরা সব কি করেছি কলে খাটব। কষ্মকার সব ঠিক করে দেবে; আমি অবিশ্যি কৰ্ম্মকারের সঙ্গে কলকাতা যাব। এরা সব এখানকার কলে খাটবে। তুমি যেন বারণ কর না।
দেবু হাসিল।
পাতু বলিল–আমরা কিন্তু তা শুনতে পারব।
দেবু বলিল–শতীশ তার কি করলে?
—শালা বলছে যাস্ না যেতে পারি না, গেরস-ধম্ম থাকবে না। গেরস্ত-ধৰ্ম্ম না কচু! পেটে ভাত নাই বলে ধরমের উপোস করেছি! শালা, ভিখ মেগে খেতে হচ্ছে-গেরস্ত-ধম্ম!
একজন বলিল—উ শালার জমি আছে হাল আছে, আমাদিগে দি হাল-গরু-জমি, তবে বুঝি। তা না-শালা নিজে পেট ভরে খাবে, আর আমরা ভিখ মাগব আর ঘরে বসে বসে গেরস্ত-ধম্ম করব!
পাতু বলিল—আর ওই শালা ঘোষাল! … হঠাৎ জিভ কাটিয়া কপালে হাত ঠেকাইয়া প্ৰণাম করিয়া বলিলনা না। বেরান। ঘোষাল মাশায়। বল তো পণ্ডিত—আমার ঘরে আসে ঘোষাল—সবাই জানে। বেশ-আসিস, পয়সা দিস, ধান দিস, বেশ কথা। তা বলে তো, আমার একটা ইজ্জৎ আছে। গোপনে আয়, গোপনে যা। তা না, আমাদের মারামারি লেগেছে। আর ঘোষাল আমার ঘর থেকে বেরিয়ে এল—তামাম লোকের ছামুতে। এসে মাতব্বরি করতে লেগে গেল। তাতেই ধরেছিলাম টুঁটি টিপে।… তারপর আপন মনেই বলিল দাঁড়া দাঁড়া, যাব চলে কৰ্মকারের সঙ্গে—তোর পিরীতের মুখে ছাই দোব আমি। দাঁড়া।
দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল-কম্মকার কোথায়?
–ওই, ওই শুয়ে রয়েছে।
অনিরুদ্ধে মদের নেশায় বকুলগাছ তলাটাতেই পড়িয়া ছিল; ঘুমে ও নেশায় সে প্রায় চেতনাহীন। এত গোলমালেও ঘুম ভাঙে নাই।
দেবু সকলকে বাড়ি যাইতে বলিয়া ফিরিয়া আসিয়াছিল।
তাহারা তাহাকে বলিয়াও দিয়াছে—পণ্ডিত, তুমি বারণ করিও না। অনিরুদ্ধের সমৃদ্ধি দেখিয়া তাহারা ওই পথ বাছিয়া লইতে চাহিতেছে। আর তাহারা ভিক্ষা মাগিয়া গৃহস্থ-ধর্ম পালনের অভিনয় করিতে চায় না। উপার্জনের পথ থাকিতে পেট ভরিয়া খাইবার উপায় থাকিতে তাহারা ক্রীতদাসত্ব অথবা ভিক্ষা করিয়া আপেটা খাইয়া থাকিতে চায় না। সে বারণ করিবে কেন? কোন মুখেই বা বারণ করিবে? তা ছাড়া তাহাদের বোঝা তাহার ঘাড় হইতে নামিতে চাহিতেছে, সে ধরিয়া রাখিবে কেন? মুক্তির আগমন-পথে সে বাধা দিবে না। মুক্তি আসুক। খোকন-বিলু-শূন্য জীবন-বাড়ি-ঘর তাহার কাছে মরুভূমির মত খাঁখাঁ করিতেছে। সে তাহাদেরই সন্ধানে বাহির হইবে। পরলোকের আত্মাও তো ইহলোকের রূপ ধরিয়া আসিয়া প্রিয়জনকে দেখা দেয়। এমন গল্প তো কত শোনা যায়।
সকালে উঠিয়াই শ্ৰীহরি তাহাকে দেখিয়া চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া শাসন করিতে আসিয়াছিল। বেচারা জমিদারত্ব জাহির করিবার লোভ কিছুতেই সংবরণ করিতে পারে নাই।
দেবু স্থির করিলসে নিজে কলে গিয়া মালিকদের সঙ্গে কথা বলিয়া আসিবে ইহাদের কাজের ব্যবস্থা করিয়া আসিবে শর্ত ঠিক করিয়া দিবে। শ্ৰীহরি যদি উহাদের বসত বাড়ি হইতে জোর করিয়া উচ্ছেদ করিবার চেষ্টা করে, তবে ওই বাউরি-ড্ডামদের লইয়া সে খোদ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাইবে।
পাতু আসিয়া প্ৰণাম করিয়া দাঁড়াইল। গতরাত্রির সে পাতু আর নাই। নিরীহ শান্ত মানুষটি।
দেবু হাসিয়া বলিল—এস পাতু।
মাথা চুলকাইয়া পাতু বলিল—এলাম।
—কি সংবাদ বল?
–কাল রেতে—
হাসিয়া দেবু বলিল—মনে আছে?
—সব নাই। আপুনি যেয়েছিলেন—লয়!
–তোমার কি মনে হচ্ছে?
–যেয়েছিলেন বলেই লাগছে।
–হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।
মাথা চুলকাইয়া পাতু বলিল—কি সব বলেছিলাম।
–অন্যায় কিছু বল নাই। তবে ঘোষালকে হয়ত মেরে ফেলতে আমি না গেলে।
পাতু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল,অন্যায় হয়ে গিয়েছে বটে। তা ঘোষালেরও অন্যায় হয়েছে; মজলিসের ছামুতে আমার ঘর থেকে বেরুনো ঠিক হয় নাই মশায়।
দেবু চুপ করিয়া রহিল। এ কথার উত্তর সে কি দিবে?
পাতু বলিল–পণ্ডিত মশায়?
—বল!
–কি বলছেন, বলেন?
–ও-কথার আমি কি উত্তর দেব পাতু?
পাতু জিভ কাটিয়া বলিল—রাম-রাম-রাম! উ কথা লয়।
—তবে?
পাতু আশ্চর্য হইয়া গেল, বলিল–আপুনি শোনেন নাই? কলে খাটতে যাওয়ার কথা?
—শুনেছি।… দেবু উঠিয়া বসিল, বলিল—শুনেছি। যাও—তাই যাও। তা নইলে আর উপায় নাই ভেবে দেখেছি। আমি বারণ করব না।
পাতু খুশি হইয়া দেবুর পায়ের ধূলা লইল। বলিল পণ্ডিত মশায়, কল তো উপারে অনেক। কালই হয়েছে—এতদিন যাই নাই। দুঃখ-কষ্টে পড়েও যাই নাই। কিন্তু এ দুঃখ-কষ্ট আর সইতে পারছি!
দেবু জিজ্ঞাসা করিল-অনি-ভাই কোথা?
—সে জংশনে গিয়েছে। কলের বাবুদের সঙ্গে পাকা কথাবার্তা বলতে।
–বেশ। তাই যাও তোমরা। তাই যাও।
পাতু চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পর দেবুও উঠিল। জগন ডাক্তারের বাড়িতে গিয়া ডাকিল–ডাক্তার।
ডাক্তারের দাওয়ায় এখনও অনেক রোগীর ভিড়। ম্যালেরিয়ার নূতন আক্রমণ অবশ্য কমিয়াছে; মৃত্যুসংখ্যাও হ্ৰাস পাইয়াছে। কিন্তু পুরনো রোগীও যে অনেক জনকয়েক দাওয়ায় বসিয়াই কাঁপিতেছে। একজন গান ধরিয়া দিয়াছে; আপন মনেই গাহিয়া চলিয়াছে—আমার কি হল বকুল ফুল!
ডাক্তার ঘরের মধ্যে ওষুধ তৈয়ারি করিতে ব্যস্ত ছিল। দেবুর গলার স্বর শুনিয়া সাড়া দিলে—কে? দেবু-ভাই? এস, এই ঘরের মধ্যে।
প্রকাণ্ড একটা কলাই-করা গামলায় ডাক্তার ওষুধ তৈরি করিতেছিল; হাসিয়া বলিল–পাইকারি ওষুধ তৈরি করছি। কুইনিন, ফেরিপার ক্লোর, ম্যাগসালফ আর সিন্কোনা। একটু লাইকার আর্সেনিক দিলে ভাল হত, তা পাচ্ছি কোথায় বল? এই অমৃত—এক এক শিশি গামলায় ডোবাব আর দেব। তারপর, কি খবর বল?
দেবু বলিল—সাহায্য-সমিতির ভার তোমাকেই নিতে হবে। একবার সময় করে হিসেব টিসেবগুলো বুঝে নাও। তাই বলতে এলাম তোমায়।
—সে কি!
–হ্যাঁ ডাক্তার। টাকাকড়িও বিশেষ নাই, কাজও কমে এসেছে। তার ওপর বাউরি-মুচিরা কলে খাটতে চলল। আমি এইবার রেহাই চাই ভাই। একবার তীর্থে বেরুব আমি।
–তীর্থে যাবে?… ডাক্তারের হাতের কাজ বন্ধ হইয়া গেল। দেবুর মুখের দিকে সে চাহিয়া রহিল এক অদ্ভুত বিচিত্র দৃষ্টিতে। সে দৃষ্টির সম্মুখে দেবু একটু অস্বস্তি বোধ করিল। ডাক্তারের চিবুক অকস্মাৎ থথ করিয়া কাঁপিতে আরম্ভ করিলরূঢ় অপ্ৰিয়ভাষী জগন ডাক্তার সে কম্পন সংযত করিয়া কিছু বলতে পারিল না।
দেবু হাসিল,গভীর প্রীতির সঙ্গে সে যেন আপনার অপরাধ স্বীকার করিয়া হাসিয়া বলিল–হ্যাঁ ভাই ডাক্তার। আমার ঘাড়ের বোঝা তোমরা নামিয়ে দাও।
ডাক্তার এবার আত্মসংবরণ করিয়া দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
দেবু বলিল—তিনকড়ি-খুড়োর হাঙ্গামাটা মিটলেই আমি খালাস।
—————
* গণদেবতা উপন্যাস দ্রষ্টব্য।