কবির মাস্টারের শরীরটা ভালো না।
কয়েক দিন আগে পা পিছলে পুকুরপাড়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন কিছু হয় নি, কিন্তু এখন জানান দিচ্ছে। গত রাতে কোমরব্যথায় ঘুমুতে পারেন নি। সেক দিতে গিয়ে শওকত আগুন-গরম কাপড় কোমরে ধরেছে–নিৰ্থাৎ ফোসিকা পড়েছে। এখন টনটনে ব্যথা। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। বারান্দার ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে আছেন। উঠোনে বৃষ্টিভেজা জোছনা। রাত তেমন হয় নি, কিন্তু মনে হচ্ছে নিশুতি। শুনশান নীরবতা। এতক্ষণ ঝিঝি ডাকছিল, এখন তাও ডাকছে না। তবে মশার পিনপিন হচ্ছে। বড় মশা। কিছুক্ষণ বসে থাকলে মনে হয় গা খুবলে নিয়ে যাবে।
শওকত মালশায় ধূপ দিয়ে পায়ের কাছে রেখে দিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, সেঁক লাগব স্যার?
কবির মাস্টার হুংকার দিয়ে উঠলেন, সাবধান, সেকের কথা মুখে আনবি না। আমাকে আলুপোড়া করেছিস, খেয়াল নেই। সাহস কত, আবার সেঁক দিতে চায়! দূর হ সামনে থেকে।
শওকত সরে গেল, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে উঠোনে দেখা গেল। সাজসজ্জা বিচিত্র। পায়ে গামবুট, হাতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ।
কবির মাস্টার থমথমে গলায় বললেন, যাস কোথায়?
মাছ মারতে যাই।
গামবুট পেলি কোথায়?
শওকত জবাব দিল না। কবির সাহেব ভারি গলায় বললেন, অসুস্থ একটা মানুষকে ফেলে চলে যাচ্ছিাস, ব্যাটা তুই মানুষ না অন্য কিছু!
কবির মাস্টারের কথা শওকতের উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করল বলে মনে হল না। সে টর্চ ফেলে তার কোঁচ পরীক্ষা করল। এবং গামবুটে মচমচ শব্দ করে বের হয়ে গেল। কবির মাস্টার বিড়বিড় করে কি সব বললেন। তাঁর কোমরের ব্যথা বেড়েছে। পানির পিপাসা হচ্ছে। কিন্তু উঠে গিয়ে পানি খাবার উৎসাহ বোধ করছেন না। সারা শরীরে সীমাহীন আলস্য। এর নাম বয়স। বেলা শেষ হয়েছে। অজানা দেশে যাবার প্রস্তুতি তেমন নেই। একা যখন থাকেন, ভয়-ভয় লাগে। এক দিকে মায়া, অন্য দিকে ভয়। অসম্ভব সুন্দর এই জায়গা ছেড়ে যেতে মায়া লাগছে। প্রিয়জন কেউ নেই, তবু যখন মনে হয়, এই শওকতের সঙ্গে আর দেখা হবে না।–দেখা হবে না। শফিক-রাফিকদের সঙ্গে, তখন বুকের ভেতর চাপ ব্যথা অনুভব করেন। তিনি গৃহী মানুষ নন। তাঁরই যখন এমন অবস্থা, তখন গৃহী মানুষদের অবস্থাটা কী ভাবাই যায় না।
কবির মাস্টার লক্ষ করলেন তাঁর চোখে পানি এসে গেছে। তিনি লজ্জিত বোধ করলেন। আশেপাশে দেখার কেউ নেই, তবু কেন জানি মনে হয় কে যেন দেখে ফেলল। যে দেখেছে সে যেন একটি তরুণী মেয়ে। দেখেই চট করে পর্দার আড়ালে সরে গিয়ে হাসছে। মেয়েটির মুখ শাহানার মতো। সরল স্নিগ্ধ একটি মুখ, যে—মুখ দেখলেই মনে এক ধরনের পবিত্র ভাব হয়।
শাহনার বিয়ে খুব শিগগিরই হবার কথা, কিন্তু কেউ এখনো কোনো চিঠিপত্র লিখছে না। হয়তো ভুলে গেছে। তাঁর কথা বিশেষ করে কারোর মনে থাকে না। নিমন্ত্রিত মানুষদের তালিকা যখন তৈরি হয় তখন কেমন করে যেন তাঁর নামটা বাদ পড়ে যায়। কেউ ইচ্ছা করে করে না, তিনি তা জানেন। হয়ে যায়। ভুল ধরা পড়লে খুব লজ্জা পায়। অসংখ্য বার ভাবে এই ভুল আর হবে না। কিন্তু আবার হয়। কেন হয় কে জানে? মানুষ বড়ো রহস্যময় প্রাণী। চন্দ্র, সূৰ্য, গ্রহ-তারকার যে-রহস্য, মানুষের রহস্য তারচে কম নয়। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। মেঘমালা এগিয়ে আসছে। চাঁদ প্রায় ঢাকা পড়তে বসেছে। কী সুন্দরই না লাগছে। কোমরের ব্যথা তাঁর আর মনে রইল না। তিনি প্রায় ধ্যানস্থ হয়ে পড়লেন। শওকত খালিহাতে ফিরে এসেছে, এটিও লক্ষ করলেন না। শওকত যখন বলল, ঘুমাইছেন? তখনই শুধু চমকে উঠলেন।
কি রে, মাছ পাস নি?
না। পাই নাই।
এত মাছ-মাছ করে আবার খালিহাতে ফিরে এলি?
জমির মিয়ার সাথে যাওনের কথা ছিল, তারে ভূতে ধরছে।
কী বললি?
নিয়ামত খাঁর বাড়ির সামনে যে তেঁতুল গাছ আছে, হেইখানে ভূতে ধরল। কুস্তি হইছে দুই জনে। জমির মিয়া খুব ভয় পাইছে! শইল দিয়া বিজল বাইর হইতেছে।
কী পাগলের মতো কথা বলছিস; ভূতে ধরবে কী?
ধরলে আমি কি করমুকন, আমারে জিগাইয়া তো ধরে নাই।
গা জ্বলে যাওয়ার মতো কথা। ভূতের সঙ্গে কুস্তি করেছে এক জন, অন্য জন তা বিশ্বাস করে বসে আছে। কবে এদের বুদ্ধি হবে? কধ্যে এরা সাদা চোখে পৃথিবী দেখতে শিখবে?
বিছনা করছি, যান শুইয়া পড়েন। চা-টা কিছু খাইবেন?
না। তুই আবার যাস কই?
জমির মিয়ার বাড়িত। লোকটা বাঁচত না। তওবা করতে চায়। মৌলবি আনতে লোক গেছে।
কী বলছিস তুই?
সারা শইল দিয়া বিজলি বাইর হইতেছে।
কবির মাস্টার উঠে দাঁড়ালেন। বিরক্ত স্বরে বললেন, ঘরে তালা দে, তারপর চল মুখটাকে দেখে আসি। কুস্তি যে জায়গায় হয়েছে, সেখানটায় আগে নিয়ে যা।
এই অসুখ শইলে যাইবেন? দিনের অবস্থাও বালা না।
কথা বলিস না! তোদের কথা শুনলে গা জ্বলে যায়।
যে তেতুলতলায় ভূতের সঙ্গে কুস্তি হয়েছে, সে জায়গাটায় ধ্বস্তাধস্তির ছাপ সত্যি সত্যি আছে। কবির মাস্টার টর্চ ফেলে— ফেলে উবু হয়ে অনেকক্ষণ দেখলেন। শওকত শীতল গলায় বলল, এখন বিশ্বাস হয়। স্যার? জায়গাটা খারাপ। আসেন, যাই গিয়া।
তোর ভয় লাগছে?
শওকত জবাব দিল না। তার সত্যি সত্যি ভয় লাগছে। ভয় কাটনোর জন্যে সে একটি বিড়ি ধরিয়েছে। হাতে আগুন থাকলে এরা কাছে আসতে পারে না। জ্বলন্ত বিড়ি স্যারের নজর থেকে লুকিয়ে রাখাও এক সমস্যা।
স্যার, চলেন যাই। দিনের অবস্থা খারাপ।
কবির মাস্টার উঠে পড়লেন।
জমির মিয়ার বাড়িতে রাজ্যের লোক এসে জড়ো হয়েছে। তিন-চারটা হারিকেন জ্বলছে। মালশায় ধূপ এবং লোহা পুড়তে দেওয়া হয়েছে। জমির মিয়া বারান্দায় চাটাইয়ে শুয়ে ছটফট করছে। ভূতে—পাওয়া মানুষকে ঘরে ঢোকানো যায় না! কবির মাস্টারকে দেখেই জমির শব্দ করে কেঁদে উঠল।
দিন শেষ গো মাস্টার সাব! ভূতে কামড় দিছে।
কবির মাস্টারের বিস্ময়ের সীমা রইল না। লোকটি সত্যিই মৃত্যুশয্যায়। চোখ ডেবে গেছে। গা দিয়ে হলুদ রঙের পিচ্ছিল ঘাম বেরুচ্ছে। বাঁ হাত রক্তাক্ত। কবির মাস্টারের নিজেকে সামলাতে সময় লাগল।
জমির মিয়া, তুমি যে গিয়েছিলে তেতুলতলায়, তোমার পায়ে জুতো ছিল?
জ্বি না।
তাহলে আমার কথা মন দিয়ে শোনা তোমার সঙ্গে যে কুস্তি করেছে, তার পায়ে ছিল রবারের জুতো। জুতোর ছাপ আছে মাটিতে। ভূত কি আর জুতো পায় দেয়, বল দেখি?
জমির মিয়ার কোনো ভাবান্তর হল না! টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। মৌলানা সাহেব আসবার আগেই ডাক্তার এসে পড়ল। নিমতলির সোবাহান ডাক্তার। নেত্রকোণায় এক সময় কম্পাউণ্ডারি করত, এখন পুরো ডাক্তার। রোগীকে ভূতে ধরেছে শুনেই সে তার কালো ব্যাগ খুলে সিরিঞ্জ বের করে ফেলল। কবির মাস্টার বললেন, কিসের ইনজেকশান দিচ্ছ? ডাক্তার সোবাহান হাসিমুখে বলল, কোরামিন। সুইয়ের এক গুতোয় দেখবেন রোগী ঘোড়ার মতো লাফ দিয়ে উঠছে। ওষুধ তো না, আগুন!
সেই আগুন ইনজেকশানেও কাজ হল না। রোগী আরো ঝিমিয়ে পড়ল। সোবাহান ডাক্তারকে তা নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন মনে হল না। সে নিচু গলায় পাশের লোকটিকে বলল, একটা পান দিতে বল তো। মুখটা মিষ্টি হয়ে আছে!
কবির মাস্টার দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। কী অধ্যস্থা! আশেপাশে কোথাও এক জন পাশ-করা ডাক্তার পর্যন্ত নেই যে জানবে কী হচ্ছে, সমস্যা কোথায়! মৃত্যু নামক কুৎসিত জিনিসটির সঙ্গে যে প্রাণপণ যুদ্ধ করবে, ঠাণ্ডা গলায় বলবে।–বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচট্টগ্র মেদিনী। এই লোকটির মতো বিরস মুখে পান চিবোবে না।
সোবাহান ডাক্তারের জন্যে জলচৌকি এসেছে। সে জলচৌকি প্রত্যাখ্যান করল। তার আরেক জায়গায় যেতে হবে। জরুরি কলা; তার অপেক্ষা ভিজিটের জন্যে। টাকা আসছে না বলে যেতেও পারছে না। পাশের লোকটিকে খানিকটা আড়ালে টেনে নিয়ে গুজগুজ করে আবার কী-সব বলছে। সম্ভবত ভিজিটের কথা।
মৌলানা সাহেব এসে পড়েছেন। অনেক আয়োজন করে তিনি তওবা পড়ালেন। এবং তার কিছুক্ষণ পরই জমির মিয়া মারা গেল। তার অল্পবয়স্ক বউটি গড়াগড়ি করে কাঁদছে।
এত অল্প সময়ে এত বড়ো একটি ঘটনা ঘটে যেতে পারে। মৃত্যু ব্যাপারটা কি এতই সহজ? কবির মাস্টার হতভম্ব হয়ে পড়লেন। তাঁর মনে হল, এ রকম কিছু বোধহয় ঘটে নি। এটা তাঁর কল্পনা।
শওকত।
জ্বিস্যার।
চল বাড়ি যাই।
শওকত বিস্মিত হল। এ অবস্থায় মাস্টার সাহেব বাড়ি চলে যেতে চাইবেন, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। সে কথা বাড়াল না। রাস্তায় নেমে এল।
শওকত।
জ্বি।
চল তো তেতুল তলায় আরেক বার যাই।
আবার যাওনের দরকার কী?
ভূতের কথাটা ঠিক না। ভূত রবারের জুতো পায়ে দেয় না।
যা হওনের হইছে স্যার। অখন ভূত হইলেই—বা কি, না হইলেই—বা কি। বৃষ্টিতে ভিজ্যা লাভ নাই, চলেন যাই গিয়া।
কবির মাস্টার আর আপত্তি করলেন না। রাতে তাঁর চেপে জ্বর এল। বিছানায় ছটফট করতে লাগলেন। শেষরাতের দিকে চোখ লেগে এসেছিল, তখন অদ্ভুত অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখলেন। যেন তিনি মারা গেছেন। তাঁর বাবা-মা এসেছেন তাঁকে কোথায় যেন নিয়ে যেতে। তাঁদের মুখ বিষন্ন। চোখে জল টলমল করছে। তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন মাথা নিচু করে। কবির মাস্টার খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন আপনারা? বসুন।
তাঁরা বসলেন না। দুজনেই কাঁদতে শুরু করলেন।
স্বপ্ন এই পর্যন্তই। কবির মাস্টার জেগে উঠলেন। ঘামে গা স্ট্রিজে গিয়েছে। ক্লান্ত স্বরে ডাকলেন, শওকত, ও শওকত।
শওকত উঠল না। পাশ ফিরে আবার নাক ডাকাতে লাগল; শেষ রাতের দিকে তার ভালো ঘুম হয়।