এখন মানুষটাকে নিয়ে কুলসুম করে কী? পাশে বসে স্বামীর কপালে হাত দিলে কুলসুমের হাতের তালুতে আগুনের ছ্যাক লাগে, জ্বরের দাপাদাপিতে তমিজের বাপের গা যেন পুড়ে যাচ্ছে। মানুষের গায়ে এতো তাপ? এই তাপে কুলসুম এক হাঁড়ি ধান সেদ্ধ করে ফেলতে পারে। তবে ধানের হাঁড়ির বদলে তমিজের বাপের ওপর সে চাপাতে থাকে তমিজের পুরনো পিরান, তার লুঙি, নিজের একটা ছেড়া শাড়ি, ঘরের সবগুলো। কাঁথা এবং এমন কি একটা ছেড়া জাল পর্যন্ত। তমিজের বাপের কাঁপুনি তবু যায় না। ভেতরের উঠান থেকে কুলসুম কয়েক বারে দুই হাত জড়িয়ে খড় এনে বিছিয়ে দেয় তার। ওপর। স্বামীর কাঁপুনি তবু না থামলে সে নিজেই শুয়ে পড়ে ওই শরীরের ওপর। তমিজের বাপ একটা গড়ান দিয়ে তাকে ফেলে দিলে তার আর কিছুই করার থাকে না। তবে দেখতে দেখতে কাঁপুনিটা থামে, কিন্তু জ্বর যেমন ছিলো তেমনি থাকে। মণ্ডলের হাতে মার খেয়ে তমিজের বাপ কি সারাটা সকাল—সারাটা দুপুর ঘুরে ঘুরে দুনিয়ার আগুন, আসমানের আগুন সব চুরি করে জমিয়ে নিয়ে এসেছে নিজের গতরের মধ্যে? তমিজের বাপের শরীরের নানা জায়গায় নাক লাগিয়েও কুলসুম তো কোনো গন্ধ পায় না। এই শরীরের চিরকালের বোটকা গন্ধ আর আঁশটে গন্ধ কি তাপে তাপে লোপ পেয়ে গেলো নাকি? এমন কি একটু ফাঁক-করা মুখে নাক লাগিয়ে জোরে নিশ্বাস টেনেও কুলসুম কোনোরকম গন্ধই তো পায় না। তার ভয় হয়, লোকটার পেট জুড়েও কি তবে আগুন জ্বলছে? নিজের নাক একটু তফাতে নিয়ে তমিজের বাপের সেই হাঁ-করা মুখ দেখতে দেখতে কুলসুমের মাথা ঝিমঝিম করে : এই মাঝারি আকারের হয়ে কেমন পুস-করা পুস-করা ঢং। কী যেন জানার জন্যে মুখটা সে ফাঁক করে রেখেছে। হাঁ-করা মুখে এমন প্রশ্নবোধক দাগ কুলসুম আগেও অনেকবার দেখেছে। কিন্তু এরকম অবাক হয়ে কিছু জিগ্যেস করা ঠোঁটের ফাঁক সে দেখলো কবে? কোনদিন? কোটে গো?
সিথানে পড়িয়া থাকে কার্পাসের বালিস। হায়রে চেরাগ আলি গানের কলিটা এখানে ছেড়ে দিলে কুলসুম ধরে, শিতানে পড়িয়া থাকে কার্পাশের বালিশ। পাতলা চুলের নিচে কালো ও গোল মুখ, মুখের দাড়িও তেমন ঘন নয়, একটু এলোমেলো বটে, দাড়িগোঁফের ফাঁকে মোটা ঠোট হাঁ করে একটা মানুষ মাটিতে হাঁটু ভেঙে বসে গান, শোনে। তার মুখ সবসময়ই চেরাগ আলির দিকে। তার হাঁ-করা মুখের ফাঁকে সে যেন ফকিরের গানের ভেতরটা খাবার জন্যে ব্যাকুল।কত আগেকার কথা, এতোদিন আগে উজান যেতে অনেক বল লাগে। এখন কি আর সেই বয়স কুলসুমের আছে? তবে হয়তো তমিজের বাপের গায়ের প্রচণ্ড তাপে কুলসুম শক্তি পায়; তার বাহু থেকে কে জানে হয়তো ডানাই গজায় এবং এক উড়ালে সে পৌঁছে যায় যমুনার ভাঙনের দিনগুলিতে। হেঁড়াখোড়া বইটা দেখে আর মাটিতে চারকোণা চারকোণা রেখা এঁকে এঁকে চেরাগ আলির বাতানো মাদারিপাড়ার ফকিরগুষ্টির মানুষদের সব খোয়াবের ইশারা আর চেরাগ আলির নিজের মহা আত্মবিশ্বাস আর অকাট্য ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ করে শালার যমুনা নদী খেয়ে ফেললো গোটা গ্রামটাকেই। আকন্দদের জমিতে মাস দেড়েক মুখ গুঁজে থাকার পর তারা ঢুকে পড়লো দরগাতলার দরগাশরিফে। তা দরগা তো তখন কবজা করেছে ভিন্ন তরিকার খাদেমরা। ফকির যতোই হাম্বিতম্বি করুক, তারই পরদাদারা যে কোম্পানির সঙ্গে লড়াই করেছে দরগাশরিফে ওরস চালাবার নিয়ত নিয়ে, সেখান তারা টিকতে তো পারলো না। নিজের মাদারি তরিকার ইজ্জত রাখতে, না-কি নতুন খাদেমদের হুকুমমাফিক শরিয়ত মোতাবেক নামাজ রোজা করার ভয়ে,-কী শোলোক বলে বেড়াকুড়া খাবার লোভেই কি-না আল্লাই জানে, নাতনিকে নিয়ে সে সোজা রওয়ানা হয় পশ্চিমে। পুব এলাকাতেই সে থাকবে না, করতোয়া পেরিয়ে চলে যাবে সোজা মহাস্থান। সেখানেই ছিলো তাদের ফকিরদের আখড়া। মজনু শাহ তো আসল জেহাদটা চালিয়েছিলো সেখান থেকেই। অতোদূর যাওয়া কি অতোই সোজা? বাঙালি পার হওয়ার পর কয়েকটা গ্রাম পেরোলে দুইদিকে লোকজন কমে আসতে লাগলো। ভাদ্র মাসের দুপুর, ভ্যাপসা রোদে কুলসুম পায়ে আর বল পায় না। জুতমতো গান করার জায়গা না পেয়ে ফকিরও অস্থির হয়ে উঠেছিল। রাস্তায় যে কয়েকজন মানুষ পাওয়া। যায়, সবাই জমিতে হাঁটু পানিতে পাট ধোঁয়ায় ব্যস্ত। এদের কেউ কেউ ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বড়ো সকড়ের ওপর বড়ো কোনো গাছের তলায় জিরিয়ে নেয়। ফকিরের হাতে দোতারা দেখে এদেরই কেউ বলে, ও ফকিরের বেটা, সামনে যাও, আজ গোলাবাড়ির হাট, মেলা মানুষ পাবা। এই আশ্বাসে দুজনেই পায়ে বল পায়, রাস্তার একটা মোড় পেরুলে একটু দূরে বেশ কিছু মানুষ দেখলে চেরাগ আলি প্রায় দৌড়ুতে শুরু করে।
গোলাবাড়ি হাটের এক পাশে প্রাইমারি স্কুলের সামনে টিউবওয়েল। টিনের থালা মাটিতে রেখে টিউবওয়েলের মোটা নলে মুখ রেখে এক হাতে পাম্প করে কুলসুম অনেকক্ষণ ধরে পানি খায়। টিউবওয়েলের নিচে কাদার সোঁদা গন্ধ বর্ষার তোড়ে অনেকটা পানসে। কিন্তু পানির লোহার গন্ধ ও স্বাদে তার খিদের প্রায় সবটাই মিটে যায়। ও পানি খাচ্ছে, আর এর মধ্যে হাটের মাঝখানে বটতলার মস্ত ইট-গাঁথা চাতালে লোহার লাঠি, দোতারা ও ঝোলাটা রেখে জায়গাটা দখল করে চেরাগ আলিও টিউবওয়েলের কাছে আসে।
বটতলায় লোকজন খুব বেশি নাই। হাট তখন জমে উঠেছে, সবাই হাটে কেনাবেচায় ব্যস্ত। বটতলায় দাড়িয়ে দোতারায় টুংটাং করতে করতে চেরাগ আলি গুনগুন করে, হায় রে শিথানে পড়িয়া থাকে কার্পাশের বালিশ। গানের এই কথাগুলিই সে বারবার বলে, আর মাঝে মাঝে তার সঙ্গে গলা মেলায় কুলসুম। বয়স তখন তার অল্প হলে কী হয়, তখুনি তার বুকের ওপর গামছা তুলে দিতে হয় বারবার। অল্প যে কয়েকজন মানুষ জুটেছে, চেরাগ আলির গানের সঙ্গে তাদের নজর সমানভাবে পড়ে কুলসুমের বুকের দিকে। একটিমাত্র মানুষকেই শুধু দেখা গেলো মাটিতে হাঁটু ভেঙে বসে। হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে চেরাগ আলির দিকে। একেকটা গানের পর চেরাগ আলি নতুন গান শুরু করার জন্যে দোতারায় টুংটাং তুললে কুলসুম তার টিনের থালাটা মেলে ধরে শ্রোতাদের সামনে। যার সামনেই থালা ধরে সে-ই অন্যমনস্ক হয় কিংবা চুপচাপ কেটে পড়ে হাটের ভেতর। কেবল এই মাটিতে বসা পাতলা চুল আর দাড়িওয়ালা লোকটি অন্যমনস্কতার ভাণ করে না, উঠে দাঁড়িয়ে সটকে পড়ে না, আবার পয়সাও সে দেয় না। সে ঠোট ফাঁক করে শুধু চেরাগ আলির রূপই দেখে আর গানই শোনে। কুলসুমের বয়েসি একটি ছেলে এসে লোকটির পাশে দাড়িয়ে বলে, বাজান, চলো। দেরি করলে মরিচের পুল পাওয়া যাবি না। ব্যামাক পুল খালি নেত্যা নেতা যাচ্ছে। মরিচের চারা রোদে নেতিয়ে পড়লে লোকটির কিছু এসে যায় বলে মনে হয় না। সে কেবল চেরাগ আলির দিকেই তাকিয়ে থাকে। হয়তো তার নীরব প্রশ্নের জবাব দিতে, কিংবা লোকজন জমতে দেখে কিংবা আরো লোক আকর্ষণের জন্যে চেরাগ আলি তার মুখের হাঁ মস্ত ফাঁক করে, কখনো বাকা করে, কখনো চোখজোড়া খুঁজে কখনো হাট করে খুলে গেয়েই চলে,
পার্শ্বে বিবি নিন্দে মগন চান্দ কোলে জাগে গগন
খোয়াবে কান্দিল বেটা না রাখে হদিস।
হায়রে একেলা পড়িয়া থাকে শিথানের বালিশ।
মুখ বাঁকাচোরা করে সে গাইছে, এমন সময় ওই ঠোট ফাঁক করে শুনতে-থাকা লোকটির পাশে দাঁড়ানে কালো ছোঁড়াটা খিলখিল করে হাসে, এতোই জোরে হাসে যে, লোকজন তার দিকে একবার করে তাকায়।
চেরাগ আলি ওমনি মুখভঙ্গি করেই গাইতে থাকে,
ত্যজিলো দেহের আরাম নিদ্রা তাহার হইলো হারাম
হাড়িতে লোহুতে ফকির পোষে দশদিশ।
ফকির বাহিরিলো পথে না থাকে উদ্দিশ।।
মাথা ঝাকিয়ে দোতারা বাজাতে থাকলে কুলসুম একাই বাকি চরণটি গায়
শিথানে পড়িয়া থাকে কার্পাশের বালিশ।।
সন্ন্যাসীর গৃহত্যাগের মুহূর্তে পুত্রের, যার কি-না একমাত্র সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা একশো এক ভাগ, স্বপ্নের ভেতরে কেঁদে ওঠার জরুরি খবর দেওয়ার সময় ফকিরের কাঁদো কাঁদো গলার স্বরের সঙ্গে তার বিকট মুখব্যাদানের সামঞ্জস্য না থাকলেও ওই কালো বালকটি ছাড়া আর সবাই মন খারাপ করে শোনে। এর মধ্যে বটতলারই আরেক পাশ থেকে আসে নারচিতলার ওবায়েদ সরকারের কথা। এই লোকের কথা মানেই ভাষণ; সে জানায় যে, ফজলুল হক আইন তৈরী করেছে, আইন লেখা হয়ে গেছে, এখন খালি লাট সাহেবের দস্তখত বাকি। এই আইনে জমিদারের দাপট শেষ হয়ে যাবে, জমির ওপর স্বত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে প্রজার। তখন কে জমিদার আর কে প্রজা? আর লাট সায়েব দস্তখত না করলে হক সাহেব প্রধান মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবে। ওবায়েদের কথায় হাটুরেদের তেজ বাড়ে। সেই তেজ তারা ব্যবহার করে ফকিরের গান শোনার কাজে। খালি পায়ে, পরিষ্কার গেঞ্জি গায়ে ও ময়লা ধুতিপরা একটা জোয়ান মানুষ কয়েকবার এদিকে আসে, একটু গান শোনে, বেসুরো গলায় গানের সঙ্গে দিব্যি একটু গলা মেলায়, তারপর ফের কোথায় যায়। আসা যাওয়ার ফাঁকে সে কালো বালকটিকে ধমক দেয়, ক্যা রে ছোঁড়া হাসিস কিসক? গান শোন, গান শোন। ছোঁড়া তার হাসির কারণ ব্যাখ্যা করে হাসতে হাসতেই, বুড়াটা মুখ ওংকা করে কিসক? চেরাগ আলি গাইতে থাকে,
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ঘোড়া করিলো কুর্নিশ।
ফকির ঘোড়ায় চড়ি বাহিরিলো নাহিকো উদ্দিশ।।
গানটি শেষ হলে ময়লা ধুতি ও ফর্সা গেঞ্জিপরা লোকটি বলে, আগে পোড়াদহের মেলাত ইগলান গান খুব শুনিচ্ছিলাম। গান বন্ধ হলেও মাথা একটু দোলাতে দোলাতে চেরাগ আলি বলে, পোড়াদহের মেলাত হামাগোরে যমুনা পারের মানুষ আগে কতো আসিছে। পোড়াদহ, বাগবাড়ি, নুনগোলা, জোড়গাছা, আবার ওদিকে ধরো চন্দনদহ, কড়িতলা, রয়াদহ, কুতুবপুর-ব্যামাক মেলার মধ্যে হামাগোরে ফকিরগুষ্টির মানুষ কতো আসিছে। গান তো করিছে তারাই। তা বাপু, নদী ভাঙার পরে কেটা কোটে ছিটকা পড়লো তার আর দিশা নাই। এখন তাই তোমরা গানও আর শোনো না।
যুবক একটা প্রতিবাদ করে, কী যে কও ফকিরের বেটা? ইগলান গান এদিককার মানুষ জানে। হামাগোরে পোড়াদহ মেলার নামই হলো সন্ন্যাসীর মেলা। মেলা তো ভবানী সন্ন্যাসীর পিতিষ্টা করা। বুঝছো না?
গানের শেষে কুলসুম ঘুরে ঘুরে থালা ধরলে টিনের থালায় ঠং ঠং করে পয়সা পড়লে তার মিষ্টি প্রতিধ্বনি ওঠে দোতারার তারে। কালো ছেড়াটিকে ফের এদিকে আসতে দেখে কুলসুমের ভয় হয়, এবার এসে তার বাপের মুখ না ভাংচায়। না, সে তার বাপের পাশে ঝুঁকে জানায়, বাজান হাটোত ভাও আজ বেশি ঠেকিচ্ছে। কাল বাদে পরশু জোড়াগাছার হাট, ভাত খায়া হাঁটা দিলে মরিচের পুল লিয়া বেলা ডোবার সাথে সাথে বাড়িত আসা যাবি।
লোকটি ঘাড় নেড়ে ছেলের প্রস্তাবে সায় দিয়েও রেহাই পায় না, কালো ছোঁড়া তাকে উঠতে তাগাদা দেয়, বাজান, পানি আসিচ্ছে দেখো না? ওঠো।।
ততোক্ষণে চেরাগ আলির আরেকটি গান অনেকটা এগিয়ে ফের ফিরে এসেছে প্রথম লাইনে।
আমার হইলো ভাবের ব্যারাম।
এই ব্যারামের নাইকো আরাম, গো ও ও ও!
শেষ শব্দটির রেশ টানতে চেরাগ আলির পাতলা ঠোঁটজোড়া এমনভাবে গোল হয় এবং গোটা শরীর এমনভাবে বেঁকে যায় যে এই ধ্বনির সঙ্গে তার শেষ নিশ্বাসটিও বেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা যায়। কিন্তু দেখতে দেখতে তার অক্ষত শরীর ফের ফিরে আসে বহাল তবিয়তে, দোতারার টুংটাং করতে করতে সে দম নেয়। কিন্তু এই গান তার জমে না। মেঘ দেখে চেরাগ আলি তার দোতারা আর লোহার লাঠি আর ঝোলা গুছিয়ে নিতে নিতে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে আবেদন জানায়, হিন্দু মোসলমান ভাইসকল, শোনেন। হিন্দু ভাই নমস্কার করি, মোসলমান ভাইদের বলি, সেলামালেকুম। বাবারা, আমরা মাদারির ফকির, খয়রাত কর্যাই হামাগোরে খাওয়া নাগে গো। আমরা বেড়াকুড়া খাই, হামাগোরে দুইটা পয়সা দিলে সেই পয়সা লষ্ট হয় না। আল্লার ওয়াস্তে দেন। একটা পয়সা দিলে সত্ত্বর পয়সার নেকি মিলবে গো ভাইসকল। কিন্তু সত্তর গুণ পুণ্য অর্জনের দিকে শ্রোতাদের আগ্রহ তেমন নাই। কুলসুমের থালায় ঠং ঠং করে পয়সা পড়ে বটে, কিন্তু চেরাগের কান খাড়া হয়ে থাকে ঝনাৎ ঝনাৎ বোলের আশায়।
বৃষ্টির মোটা মোটা ফোঁটা পড়তে শুরু করলে চেরাগ আলি বাড়ির দিকে রওয়ানা হতে পা বাড়ায়। কিন্তু কুলসুম গো ধরে, খিদা নাগিছে, ও দাদা খিদা নাগিছে। আরে খিদে তো চেরাগ আলির কম লাগে নি। সে কথা চেপে নাতনিকে সে উৎসাহ দেয়, হাটো সোনা হাঁটো। দরগাত যায়া গরম শিরনি খামো। আজ দারোগার মায়ে খিচড়ি দিবি কছিলো।
না, জিলাপি খামো। কুলসুমের আবদারের পুনরাবৃত্তি চলে, এমন সময় বৃষ্টি নামে ঝমঝম করে। লোকজনের ছোটোছুটি, বিক্রি হওয়া ও বিক্রি না হওয়া গোরুছাগলের ডাক, সওদাপাতি নিয়ে দোকানদারদের দৌড়াদৌড়ি সব মিলিয়ে তুমুল কোলাহল শুরু হয়। ওই মহা ক্যাচালের মধ্যেও কুলসুমের বায়না চলে, দাদা, জিলাপি, খামো। মেয়েটির জেদ দেখে চেরাগ আলির রাগ হয়, হুঁড়ি জিলেপির কথা ভোলে না। হাটের প্রায় সব জায়গা থেকেই জিলেপির দোকানটা চোখে পড়বেই। এতোক্ষণ ভাজা হচ্ছিলো দোকানের বাইরে, এখন চুলা ও কড়াই নিয়ে গেছে ভেতরে, তবু গন্ধ ও ধোঁয়া আসছে গলগল করে। চেরাগ আলির রাগ হয়, মেয়েটা বেশি চালাকি শিখেছে। তবে বেশি রাগ করা চেরাগের ধাতে নাই। যাদের কথা শোলোকে বলা হয় তারা অনেকেই বীরপুরুষ, ঘুমিয়ে-থাকা বিবি ও খোয়াবে কেঁদে-ওঠা বেটাকে তারা অগ্রাহ্য করে, লড়াইয়ের ময়দানে তাদের হুংকারে দুষমন টলোমলো পায়ে কাঁপে। কিন্তু হলে কী হয়, নিজের রাগ করার শক্তি চেরাগের একেবারেই উনো। রাগ তো রাগ, রাগের ছোটো বোন বিরক্তিও যদি তার একটু বেশি মাত্রায় চড়ে তো তার হাত-পা থরধর করে কাঁপে; অনেক সময় মাটিতে সে পড়েও যায়। আবার এখন রাগ করার ইচ্ছাও চেরাগের তেমন প্রবল নয়, কারণ তার নিজেরও খুব জিলেপি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু নিজে নিজে জিলেপি খাওয়ার বাদশাহি সিদ্ধান্ত নেওয়া কি তার পক্ষে সম্ভব? যাক, একটাই তো নাতনি তার, বাপ-মা মরা নাতনি, একটু জিলাপিই তো খাবে,—এই মনে করে দোকানের বাইরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই সে ছয় পয়সা দিয়ে দেড় পোয়া জিলাপি কিনলো। দোকানদার তাকে ভেতরে যেতে না করে, ভেতরে খদ্দের গিজগিজ করছে। চেরাগ আলি এখন যায়। কোথায়? কুলসুম বুকে দুই হাত জড়িয়ে হি হি করে কাঁপছে। এমন সময় একটু ডানদিকে উল্টোদিকের টিনের ঘর থেকে ডাক শোনা গেলো, ও ফকির ও ফকিরের বেটা। ফকির। প্রবল বৃষ্টিতে এই ডাক ভিজে খুচরো পয়সার মতো ঠনঠন ধ্বনিতে কানে বাজে চেরাগ আলির, কুলসুম ব্যাকুল চোখে এদিক ওদিক তাকায়। কিন্তু বৃষ্টির তোড়ে টিনের ঘরের লোকটিকেও চেনা দায়। হঠাৎ করে কুলসুম আঁচ করে, ওই ময়লা ধুতিপরা মানুষটির গলা মনে হচ্ছে। ডাক লক্ষ করে কুলসুম ছুটতে লাগলো, পিছে পিছে। ছোটে চেরাগ আলি। মাটির দুটো ধাপ বেয়ে দুজনেই উঠলো চওড়া বারান্দায়, বারান্দা পেরিয়ে ঢুকে পড়লো টিনের মস্ত ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই কুলসুম অন্তত বার পনেরো হাঁচি দিলো। ঘর ভর্তি মরিচের বস্তা; জিরা, আদা আর রসুনের স্কুপের পাশে গাদা গাদা মরিচের বস্তা। এই গন্ধ তার খুবই পরিচিত। মাদারিপাড়ায় খাল পেরোলেই একটা সময় ঘরের চালে, বাড়ির উঠানে, বাড়ির খুলিতে লাল মরিচ বিছানো থাকে। যে-কোনো বাড়িতে খেতে বসলে এই গন্ধ শুকে শুকে সে এক সানকি ভাত সাবাড় করে ফেলতে পারে। অথচ কী জ্বালা, এমন একটা বিদঘুটে জায়গাতেই এসে পড়লো, এই গন্ধটিও তার সহ্য হচ্ছে না। ঠিক তখন তার এরকম মনে হয়েছিলো কি-না এখন তো তা আর মনে নেই, তবে কালাম মাঝির বাঁশঝাড়ে ছাপড়ার ভেতরে বসত করার পর উজানে ফিরে গিয়ে কুলসুম ওই বিরক্তি আরোপ করে বসেছে টিনের ঘরে মরিচের আড়তের ওপর। আসলে যা ঘটেছিলো তা হলো এই, টিনের মস্ত ঘরে নাকে এবং নাকের ভিতর দিয়া মাথায় পশিল যে মরিচের ঝাঁঝ, তাই থেকে রেহাই পেতে বাইরের দিকে মুখ করে সে দাড়িয়েছিলো দরজার চৌকাঠে, বৃষ্টির পানিতে তার সারা শরীর ভিজে যাচ্ছিলো, তবে বৃষ্টির ছাঁট লাগছিলো কেবল মুখে। জলে ভেজো কিসক? ঘরের মধ্যে আসো। ডাক শুনে তাকিয়ে লোকটাকে এবার ভালো করে চেনা গেলো, ওই ফর্সা গেঞ্জি ও ময়লা ধুতিপরা লোকটি; তবে বৃষ্টির পানি লেগে গেঞ্জিটা অতো ফর্সা নাই, কুলসুম তাই ভরসা পেয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে একটু শীতে ও একটু ভয়ে কাঁপতে লাগলো। মস্ত টিনের ঘরের এক কোণ থেকে হুংকার শোনা যায়, বৈকুণ্ঠ, তুই বারে বারে কুটি পলাস রে?
কুটি যাই? বিষ্টির মধ্যে কুটি যাই বাবু?
আরে বিষ্টি তো নামলো ক্যাবল। কামের সময় তোক পাওয়া যায় না। আন্ধার ঘুটঘুট করে, বাতি জ্বালাস না?
ত্যাল নাই বাবু।
হেরকিন লিয়া ত্যাল লিয়া আয়। যা।
বৈকুণ্ঠ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, পয়সা নাই বাবু।
টিমটিমে কুপির আলোয় কালো মোটা একটা লোক, বেশি মোটা বলে দৈর্ঘ অনুসারে তাকে বেটে মনে হয়, ঘরের কোণ থেকে দরজার কাছে এসে ফের একটুখানি ভতরে গিয়ে একটি গদিতে বসে ক্যাশবাক্স খুলে গুনে গুনে খুচরা পয়সা বার করে। বৈকুণ্ঠের হাতে পয়সা দেওয়ার সময় সে ফের গোনে। তারপর যে স্বরে হাঁকডাক করছিলো তা অপরিবির্তিত রেখেই বলে, মাঝির দোকানের আগের সাড়ে পাঁচ আনা। পয়সা শোধ করা বাকি পয়সার ক্যারাসিন ত্যাল আর একটা দিয়াশলাই লিয়া আয়। চেরাগ আলির দিকে নাকমুখ কুঁচকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় সে বলে, এখন ভিক্ষা : দেওয়া হয় না। যাও। আড়চোখে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে-থাকা চেরাগ আলি ও কুলসুমের দিকে তাকিয়ে ফের ভেতরে কার উদ্দেশ্যে আক্ষেপ করে, গোবিন্দবাবু জল যা হচ্ছে, বাড়িত চালের উপরে মরিচ শুকাবার দিয়া আসিছি, বুদ্ধি করা না তোলে তো সব লষ্ট।
বড়ো একটা হ্যারিকেন হাতে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বৈকুণ্ঠ চেরাগ আলিকে ধমক দেয়, এখন দোকানে সন্ধ্যা, দেওয়া হবি, তোমার এটি থাকা চলবি
তার হাতের ইশারা পেয়ে বৈকুণ্ঠের পিছে পিছে বৃষ্টির মধ্যেই চেরাগ আলি চলে মুদির দোকানের দিকে, চেরাগ আলির আলখেল্লার কুল ধরে থাকে কুলসুম। এর মধ্যেই তার প্যাগনা শুরু হয় আবার, ও দাদা, জিলাপি খামু না? ও দাদা।
মাঝারি আকারের দোকান, তবে সামনে একটু বারান্দা মতো আছে। বারান্দার এক। ধারে একটা সেলায়ের মেশিন, মেশিনের পাশে মাদুর পাতা। বাঁ হাতের তর্জনিতে : বৈকুণ্ঠ তাদের মাদুর দেখিয়ে দিয়ে দোকানদারকে বলে, ও মাঝিকাকা, এই ফকির • আপনার এটি একটু বসুক। গান শুনবার পারবেন। হামাগোর আড়তেত এখন সন্ধ্যা দেওয়ার সময় বেজাতের মানুষ দেখলে বাবু কোদ্দ করবি।
ঘরের ভেতর হ্যারিকেন জ্বালাচ্ছিলো কালো ঢ্যাঙা একটা মানুষ, বৈকুণ্ঠের আবেদনে সাড়া না দিয়ে বলে, ত্যাল লুিব? খাড়া। ওটি খাক। বেজাতের মানষেক হামরাও ঘরোত ঢুকবার দেই না।
বৈকুণ্ঠ তার কথা গায়ে না মেখে বলে, ও কাকা, আজ কয় বস্তা তুললা গো? তথ্যটি না শুনেই চেরাগ আলিকে সে বলে, তোমার গলাটা খুব গমগমা গো। তোমার ওই সিথানে পড়িয়া থাকে গানটা আগে পোড়াদহের মেলাত খুব শুনিচ্ছিলাম। বসো, এটি বসো। ওই গান আজ শোনমো।
এর মধ্যে বৈকুণ্ঠের হ্যারিকেনে তেল ভরা হয়ে যায়, কেষ্টর হাত থেকে পয়সা গুনে নিয়ে দোকানদার বলে, কালকার সাড়ে পাঁচ আনা পয়সা আছিলো।
লিও। কাল লিও। বাবু কলো, মাঝিক কোস, পয়সা কয়টা আজ দিবার পারলাম রে।
হ্যারিকেন জ্বলে উঠলে দোকান ঘরটা ঝকঝক করে। মাঝারি দোকানটা মালপত্রে ঠাসা। একটা জলচৌকি জুড়ে কয়েকটা চালের বস্তা, ২/৩টা ডালের বস্তা, মৌমাছিতে ঢাকা গুড়ের মটকা, নুনের বারকোষ, মুড়ির টিন, চিড়ার টিন, নারকেল তেলের বড়ো বোতল এবং মেঝেতে রাখা কেরোসিন তেলের টিন। গাঢ় একটি গন্ধ ঘরে অদৃশ্য মশারির মতো ঝোলানো, ঘরের ভেতর নিশ্বাস নিলে নাকে তো বটেই, চোখেমুখে মাথায় সেই গন্ধ কুলসুমের মাথায় ঠেকে নিরেট বস্তুর মতো। কুলসুমকে এমন কি নিশ্বাসও নিতে হয় না, ঘন সেই গন্ধ তার মাথায় ঢুকে পড়ে ক্ষুধাতৃষ্ণাকে প্রথম দফায় নিকেশ করে দেয় এবং পলকের ভেতর পেটের মধ্যে তাই আবার জ্বালিয়ে তোলে দাউ দাউ করে। মাদুরে বসবে বি-না চেরাগ আলি ঠিক বুঝতে পারে না, বৈকুণ্ঠের বাবুর ক্রোধ আবার এই দোকানদারের শরীরেও ঢুকলো কি-না এই ভাবনায় বসতে তার হয়তো বাধোবাধো ঠেকছিলো। এমন সময় কুলসুম হাত বাড়ায়, জিলাপি দাও।
ঢ্যাঙা কালো দোকানদার বারান্দায় পা দিয়ে কারো দিকে না তাকিয়ে বলে, ধরো তো। চেরাগ আলি তার সঙ্গে সেলাই মেশিনের একটা দিক ধরলে দুইজনে মিলে সেটাকে ঢোকায় দোকানঘরের ভেতরে; ওটার জন্যে কেরোসিনের টিন দুটো আগেই তক্তপোষের পেছনে রাখা হয়েছিলো। এখন বারান্দার খালি জায়গার দিকে দোকানদার ইশারা করতেই চেরাগ বসে পড়ে। দোকানদার ধীরে সুস্থে দাঁড়িপাল্লায় এক পোয়া চিড়া ওজন করে কলাপাতায় সেই চিড়ে জড়িয়ে কুলসুমের দিকে এগিয়ে দেয়, বলে খা। ফের ঘুরে ঢুকে ওজন না করেই একটু আখের গুড় এনে চেরাগের হাতে দিয়ে বলে, গুড় দিয়া খাও। তারপর ঘরে তক্তপোষে নিজের আসনে আয়েশ করে বসে জিগ্যেস করে, ফকিরের বেটার বাড়ি কোটে গো?
চিঁড়া গুড় ও জিলেপির ভোজ খেতে খেতে চেরাগ আলি দোকানদারের এই নিরাসক্ত কৌতূহলের সুযোগ নেয়, টোক গিলতে গিলতে সে বলে, আমরা বাপু নদীভাঙা মানুষ। হামাগোরে আবার বাড়ি কিসের বাপ? এই লাতনিটা আছে, বাপ মরা, মা লিকা বসিছে যমুনার চরের মধ্যে, এখন এটাক হামার সাথে সাথে রাখি।
লোকটা বিরক্ত হয়, লদী ভাঙিছে তো কী? বাড়ি আছিলো না তো লদী ভাঙলো কি? বাড়ি নাই, তোমার মাও কি তোমার জর্ম দিছে ঘাটার মধ্যে?
চেরাগ আলি তার গ্রামের নাম বলে, সর্বনাশা নদীর করাল গ্রাসের বিস্তারিত বিবরণ দিতে শুরু করে, এমন সময় কাউকে আসতে দেখে দোকানদার কলরব করে ওঠে, আরে তমিজের বাপ চাচা, তুমি বাড়িত যাও নাই? শোনো শোনো কাম আছে গো আসো।
বৃষ্টি ধরে আসছে। এতোক্ষণে আটকাপড়া লোকজন এখন কলরব করতে করতে হাট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আন্ধকারে, ও গেদুর বাপ, বাজান, বাজান, রইস মামু, কেষ্টদা, ও কেষ্টদা রমেশ, জ্যাঠো, জ্যাঠো গো প্রভৃতি আহ্বান পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে চেরাগ আলি ও কুলসুম হঠাৎ করে যততটা তাড়াতাড়ি সম্ভব গপগপ করে খাওয়াটা সেরে ফেলে। তমিজের বাপ এসে ওঠে দোকানের বারান্দায়। দোকানদার তাকে দেখে বেশ খুশি, আরে হামি কই, তুমি বলে বাড়ি গেছে। পানি আসার আগেই তমিজেক দেখলাম ঘাটা ধরিছে। তুমি যাও নাই যে? সে কেন যায় নি তার কারণ না শুনেই তার দিকে একটা থলে এগিয়ে দিয়ে দোকানদার বলে, ইস্কুলের সামনে মোষ জবো করিছিলো, একটা ভাগ লিছি, সোয়া দুই সের গোশতো, গোশতোটা হামার ঘরত দিয়া কয়ো, আজ জাল দিয়া রাখবি, কাল ব্যায়না পাক করা লাগবি। আর হামি আজ আর বাড়িত যামু না। আফসার আজ আসবার পারবি না। বাদলার রাত, দোকান খালি রাখা যাবি না।
চটের থলে নিয়ে তমিজের বাপ বসে পড়লো মাদুরের ধার ঘেঁষে। হ্যারিকেনের আলো তার কালো মুখের ওপর যেন হালকা হলদে ধুলো মাখিয়ে দিয়েছে। হাই তুলতে তুলতে কুলসুম লোকটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তার ঘুম পাচ্ছে, সে তাকিয়েই থাকে। কিন্তু এখানে শোয়া যাবে কি-না কে জানো?—তার চোখ এখন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, সে শুধু তাকিয়েই থাকে।-তমিজের বাপের বিকালবেলা ওই। ঝিমাননা চোখ অমনি রয়েছে, ঠোঁটজোড়া তার একইরকম ফাঁক-করা। তার চোখ আর তার ঠোঁটে একইরকম প্রশ্নবোধক চিহ্নের দাগ কাটা। হ্যারিকেনের আলোয় চোখের দুটো মণি থেকে আর ঠোঁটের ভেতরকার দাঁত ও জিভ থেকে সব রঙ যেন মুছে গেছে। মিনমিন করে লোকটা যখন বলে, আর গান হবি না? তখন ঝিমুতে ঝিমুতে কুলসুম দারুণ চমকে ওঠে, মানুষটা কথা বলতে পারে? তার চমকানিটা ভয়ে গড়াবার আগেই দোকানদারের ধমক শোনা যায়, তুমি পাগলা হছো চাচাঃ ফকিরের বাড়িত যাওয়া লাগবি না? কততখানি ঘাটা তা জানো? না কি তোমার বাড়িত আজ জেয়াফত দিচ্ছো? তমিজের বাপকে এইভাবে বকার ভঙ্গিতেই ফকিরের প্রতি দোকানদারের প্রশ্রয় বোঝা যায়। চেরাগ আলি মোটা ও একটু ঘ্যাসঘেষে গলাটা যতোটা পারে তরল করে, বাবা, হামাগোরে বাড়িঘর কিছু নাই। গায়ের কাছে দরগাশরিফ, হামাগোরে পরদাদার পরদাদারা ওই দরগাশরিফ হেফাজত করিছে, এখন ভিনো তরিকার মানুষ দখল করা ওটি হামাগোরে থাকবার দেয় না। হামার লাতনিক দেখায়া কয়, মেয়ামানুষ যখন তখন নাপাক হয়, ওটি থাকা হবি না। হামাগোরে থাকার জায়গা নাই বাপু। দোকানদার একটু নরম হয়েছে বুঝে সে বলেই চলে, এংকা ঘুরঘুটা আন্ধার, পানি পড়িচ্ছে, একটা বেটি ছেলেক লিয়া হামি ক্যাংকা করা ঘাটা ধরি বাবা?
হঠাৎ করে গলির ওপাশ থেকে লাফ দিয়ে এসে হাজির হয় বৈকুণ্ঠ। দোকানের চৌকাঠে পা দিয়ে হাত বাড়িয়ে গুড়ের মটকা থেকে একটু গুড় তুলে নিয়ে চেটে চেটে খায় আর বলে, আহারের পর মিষ্টিমুখ, ভুরিভোজের পরম সুখ। খাবার পর মিঠা না হলে চলে না। ধুতির খুঁটে পরিপাটি করে আঙুল মুছে মাদুরে বসে ফকিরের দোতারা হাতে নিয়ে সে টুংটাং করে। বড়োজোর দুই মিনিট, দোতারা বাজানো খান্ত দিয়ে বৈকুণ্ঠ হুকুম ছাড়ে, ফকির এটিই কাৎ হও। থাকো, কিন্তু গান শোনান লাগবি। এরপর দোকানদারকে বলে, কালাম মাঝি, ও মাঝিকাকা, চিড়ামুড়ি যা হয় ফকিরের বেটাক খিলাও। লাতনিক লিয়া কি উপাস করবি নাকি?
তোর অতোই দরদ তো কিন্যা লিয়া খিলা না। মানা করছে কেটা?
তোমার এক জাতের মানুষ, তোমরা খিলালে তিরিও লিয়া খাবি? হামরা দিলে কী খাবি?
দোকানদার কালাম মাঝির প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা না করেই এবার সে চেরাগ আলিকে অনুরোধ করে, ফকির, ওই গানটা ধরো তো গো। ওই যে শিথানে পড়িয়া থাকে। আহা কি গান গো। আগে কতো শুনিছি।
তমিজের বাপ কিন্তু একেবারেই চুপচাপ। একইরকম ঘুমঘুম চোখে সে তাকিয়ে থাকে চেরাগ আলির দিকে, তার চোখ দেখে কুলসুমের গা ছমছম করে, লোকটা কি চোখ খুলে ঘুমায়, সে কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দাদার মুখ দেখছে? কিন্তু ঘুমের জন্যে কুলসুমের ভয় দানা বাঁধতে পারে না, মাদুরের অন্যপ্রান্তে বসে মানুষটা কি তার চোখের ঘুম মাখিয়ে দিচ্ছে কুলসুমের চোখে? চেরাগ আলি গাইতে শুরু করলে কালাম মাঝি বলে, ও তমিজের বাপ, শুনলা, তুমি টোপ পাড়ো কিসক? বাড়িত যাও। লোকটা তবু বসেই থাকে। তার স্থির চোখ চেরাগের দিকে এমনভাবে সাঁটা যে ঘুমঘুম চোখে কুলসুমের মনে হয়, লোকটা যেন তার দাদাকে স্বপ্নে দেখছে। মানুষটা কেমন মানুষ গো?—এভোলা মানুষের সামনে বসে থেকে দিব্যি খোয়াব দেখে?–না-কি খোয়াব দেখছে কুলসুম নিজেই? তাই হবে।–নইলে দাদার গলায় লোহার শিকল ঝোলে কী করে? লোহার শিকল তো সে ছেড়েছে কয়েক বছর আগেই, দরগাশরিফের নতুন খাদেমদের হুকুমে। আর মাথায় কালো পাগড়ি আসে কোত্থেকে? কিন্তু কুলসুম স্বপ্নই যদি দেখবে তো দোকানদারের এই বৈকুণ্ঠ, এটি গান শুনিস? সাহা আসুক, তোক এক চোট দ্যাখাবি।—এই কথা স্পষ্ট শোনে কী করে? বৈকুণ্ঠ পরোয়া করে না, বাদ দাও কাকা। বাবুর বলে মরিচ লষ্ট হচ্ছে আধ মণের উপরে বাড়িত গেছে, এই জলের মধ্যে আর আসিচ্ছে। তবে সব ছাপিয়ে ওঠে চেরাগ আলির গান, সেটা কি স্বপ্নের ভেতরে?
পার্শ্বে বিবি নিন্দ পাড়ে, চান্দ জাগে বাঁশ ঝাড়ে। আবার এর মধ্যেই নদীতে চেরাগ আলির শয়ে শয়ে বিঘা জমি খাওয়ার মিছে কথাগুলো শুনতে একঘেয়ে লাগে। কিন্তু তাতে চেরাগ আলির মাথা দোলানো ও তমিজের বাপের খোয়াব-সাটা চোখ দেখায় ব্যাঘাত ঘটে না। এর মধ্যে কখন যে বৈকুণ্ঠ বলে, ও কাকা, তুমি না তোমার বাড়িত একটা মানুষ রাখার কথা কহিলা গো। অসিমুদ্দি মাঝি বলে তোমার বাঁশঝাড় লিয়া খুব ক্যাচাল করিচ্ছে। তা ফকিরকে জায়গা দাও না। তোমার বাঁশঝাড় দেখাও হবি আবার পরান ভরা গান শুনবার পারবা। বাঁশঝাড়ের শোঁ শো ঝাপটায় বৈকুণ্ঠের কথা হারিয়ে যায়। কুলসুমের বন্ধ চোখের পাতার নিচে চোখের মণিতে তখন একটা বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের ওপর সাদা চাঁদ। বাঁশঝাড়ের সবচেয়ে উঁচা বাঁশটার ওপর বসে চাঁদ একটু নড়াচড়া করে। পার্শ্বে বিবি নিন্দ পাড়ে, চাঁদ জাগে বাঁশঝাড়ে। তারপর, বাঁশ জাগে বাঁশঝাড়ে, একটা একটা ডিম পাড়ে। ঘুমের মধ্যে কুলসুমের এতোবার শোনা আর এতোবার গাওয়া গান এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। টিনের থালে পয়সা গুনে না মিললে মাথায় যে অস্থির চুলকানি শুরু হয়, প্রায় এই অস্বস্তিতে কুলসুম আঁ আঁ আওয়াজ করে। গান করতে করতে চেরাগ আলি ফকির তার মাথায় আস্তে করে হাত রাখলে সে নিরাপদ ঘুমের মধ্যে ঢলে পড়ে। কিন্তু ফের দেখে, হয়তো গান শুনতে শুনতেই দেখে, বাঁশঝাড়ে ডিম-পাড়া চাঁদের তলে ডিমের ভাঙা কুসুমে হলুদবরণ মাটিতে বুক চিতিয়ে হেঁটে চলেছে কালো পাগড়ি মাথায় এক দাড়িওয়ালা মানুষ, তার হাতে লোহার লাঠি, গলায় শিকল। বাঁশঝাড় পেরোলে মানুষটার সামনে ধূ ধূ বালির চর। সেখানে দাড়িয়ে রয়েছে উঁচালম্বা সাদা ধবধবে একটা ঘোড়া। ঘোড়ার সারাটা গা জুড়ে খালি তীর বেধানো। তীরের মুখে মুখে ঘামের বড়ো বড়ো ফোঁটার মতো রক্তের বিন্দু। লোকটা ঘোড়ার ওপর চড়ে বসতেই ঘোড়া ওই লোকটাকে নিয়ে তার গা ভরা তীর নিয়ে ছুটতে লাগলো। কুলসুম ফের গোঁ গোঁ করে। হায়, হায়, সামনেই যমুনা। যমুনার ভাঙনের আওয়াজ পাওয়া যায়। চেরাগ আলির দোতারায় সেই আওয়াজ থরথর করে কাঁপে। এই তীরঘেঁধা ঘোড়া মানুষটাকে নিয়ে এক্ষুনি পানিতে পড়ে কোথায় তলিয়ে যাবে, তার কোনো দিশা পাওয়া যাবে না। চেরাগ আলি ফের তার মাথায় ভালো করে হাত বুলিয়ে দিলে কুলসুম ড়ুবে যায় ঘুমের গভীর কাদার ভেতরে। কিন্তু এখন? তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়াবে কে? কুলসুমের খোয়াব এখন টাঙানো হয়ে গেছে তমিজের বাপের মুখের সুড়ঙের ভেতরে। বাঁশঝাড়ের চিহ্ন পর্যন্ত নাই, অথচ তমিজের বাপের নাক ডাকায় শোনা যায় যমুনার ভাঙনের আওয়াজ। কুলসুমের শরীর কেমন শিরশির। করে, তমিজের বাপের ঠোঁটের ফাঁক থেকে নজর সরিয়ে সে উঠে বসে এবং তার ডান হাতটি রাখে তমিজের বাপের কপালে। এখনো অনেক জ্বর। এদিকে কুলসুমের শরীরের রক্তস্রোত শিরা উপশিরায় বইতে বইতে তার হাতের তালু পেরোবার সময় সুড়সুড়ি দেয় তমিজের বাপের কপালে। তপ্ত কপালে সে তখন শোলোকের স্পন্দন ঠাহর করে। ঘোরের ভেতর তমিজের বাপ শোনে,
মজনু হুঙ্কারে যতো মাদারি ফকির।
আন্ধার পাগড়িতে ঢাকো নিজ নিজ শিরা।।
সিনা টান রাখো আর আঁখির ভিতর।
সুরমা করিয়া মাখো সুরুজের করা।।