২৫. এককড়ি ভোরবেলার কনকনে ঠান্ডায়

এককড়ি ভোরবেলার কনকনে ঠান্ডায় পুকুরে মাথা ড়ুবিয়ে স্নান করেছেন। কোমরে লুঙ্গির মতো পেঁচিয়ে সাদা ধুতি পরে জলচৌকিতে বসেছেন। তাঁর পাশে অবিনাশ ঠাকুর হাতে ঘণ্টা নিয়ে ঘণ্টা বাজাচ্ছেন। অবিনাশ ঠাকুর শাস্ত্ৰজ্ঞ ব্ৰাহ্মণ। তিনি মাঝে মাঝে ঘন্টাধ্বনি বন্ধ করেন। চোখ বন্ধ করে উপনিষদ থেকে শ্লোক আবৃত্তি করেন। দাঁত না থাকার কারণে কথাগুলি জড়িয়ে যায়। মন্ত্র অদ্ভুত শোনায়।

ওঁ আপ্যায়ন্তু মমাঙ্গানি বাক প্ৰাণশ্চক্ষুঃ শ্রোত্রমাথা বলমিন্দ্ৰিয়ানি চ সৰ্বাণি। সৰ্ব্বং ব্রহ্মৌপনিষদম। মাইহাং ব্ৰহ্ম নিরাকুর্যাং, মা মা ব্ৰহ্ম নিরাকারোৎ অনির্যাকরণমস্তু, অনির্যাকরণং মেহত্ত্ব।

আমার সমস্ত অঙ্গ যেন পুষ্ট হয়। তার সঙ্গে আমার প্রাণবায়ু, বাকশক্তি, দৃষ্টি, শ্রবণ এবং অন্যান্য ইন্দ্ৰিয়গুলিও যেন শক্তিশালী হয়। ব্ৰহ্মার কথাই উপনিষদ বলে।

এককড়ির সামনে পিতলের থালা। থালায় জবাফুল, কিছু ধান, আম এবং বটের পাতা। লোকজন আসছে, কৌতূহলী হয়ে দেখছে। ছেলেমেয়েরা সকাল থেকেই ভিড় করে আছে। বান্ধবপুরে ছড়িয়ে গেছে— এককড়ি জোড়া পাঠা বলি দেবেন। সবাইকে পাঠার মাংস ভাগ করে দেয়া হবে।

মেয়েরা দলে দলে আসছে। এককড়ির বৃদ্ধা মা অনেক দূরে সাদা থান পরে দাড়িয়ে আছেন। মেয়ের দল দেখলেই খনখনে গলায় চিৎকার করছেন। সাবধান, বিধবারা কেউ কাছে যাবা না। সাবধান, বিধবারা দূরে। এককড়ির মা নিজেও বিধবা। তিনিও উৎসবে থাকতে পারছেন না।

আজকের উৎসবের কারণ এককড়ির মন্দির বানানো হচ্ছে। নেত্রকোণা থেকে রাজমিন্ত্রি এসেছে। তারা আজ মধ্যদুপুর থেকে ইট গাথা শুরু করবে। প্রথমে তৈরি হবে দেবীর মঞ্চ। মঞ্চে দেবী স্থাপনা হবে সন্ধ্যায়। এরপরেই শুরু হবে দেয়াল গাথা। মধ্যদুপুর লগ্ন শুভ। অবিনাশ ঠাকুর ছক ঐকে বের করেছেন। এই বিশেষ সময়ে মঙ্গল কৃত্তিকা নক্ষত্রে যাবে। অতি শুভ সময়।

মন্দির নির্মাণের যাবতীয় দেখাশোনা শ্ৰীনাথ করছেন। তাঁর আগ্রহের কোনো সীমা নাই। রামমন্দির হচ্ছে না, রাধাকৃষ্ণের মন্দিরই হচ্ছে। রাধাকৃষ্ণের মূর্তি শ্ৰীনাথ লাবুসের বাড়ি থেকে চাদরে জড়িয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি এটাকে অপরাধ মনে করছেন না। দেবদেবী মুসলমান বাড়িতে অনাদরে অবহেলায় পড়ে ছিলেন। এখন পূজা পাবেন।

রাধাকৃষ্ণের এই মূর্তি হরিচরণের পরিবার পূজা করতেন। অষ্টধাতুর মূর্তি। চোখ ফেরানো যায় না। এত সুন্দর।

মূর্তিটি যে চুরি গেছে। লাবুসকে এই খবর দেয়া হয়েছে। খবর দিয়েছে হাদিস উদ্দিন। হাদিস উদ্দিন উত্তেজিত এবং দুঃখিত।

ছোটকৰ্তা, আমি হইলাম ওস্তাদ দরবার মিয়ার সাগরেদ। আমার চোখের সামনে জিনিস চুরি গেল। আমি কিছু বুঝলাম না। এই খবর শুনলে দরবার মিয়া আমার মুখে ‘ছেপ’ দিবেন।

লাবুস বলল, দরবার মিয়া যেহেতু শুনছেন না। কাজেই তোমাকে মুখে ছেপ মাখতে হবে না।

আইজ না শুনলেন, কোনো একদিন তো শুনবেন। তখন কী উপায় হবে?

লাবুস বলল, একটা কিছু উপায় নিশ্চয়ই হবে। শান্ত হও।

ঘরের এমন দামি একটা জিনিস চুরি যাবে, আপনি কিছুই বলবেন না?

লাবুস বলল, চুরি তো যায় নাই। চোখের সামনেই থাকবে। মূর্তি দেখে সবাই আনন্দ পাবে।

হাদিস উদ্দিন বলল, কই আমি তো কোনো আনন্দ পাইতেছি না। আমার তো শইল জুইল্যা যাইতেছে। কপাল দিয়া গরম ভাপ বাইর হইতেছে।

লাবুস হাই তুলতে তুলতে বলল, সময়ে জুলুনি কমবে। এখন সামনে থেকে যাও।

সন্ধ্যাবেলা ধুমধামের সঙ্গে দেবীমূর্তি মঞ্চে স্থাপিত হলো। দেবীকে নৈবেদ্য দেয়া হলো। ভক্তরা প্ৰসাদ পেলেন। প্ৰায় সারারাত নাম জপ হলো। ভোরবেলা দেখা গেল কে বা কারা মূর্তি চুরি করে নিয়ে গেছে। শুধু যে মূর্তি চুরি করেছে তা-না, যেখানে মূর্তি ছিল সেখানে এক তাল কাদা রেখে গেছে। কাদার ওপর দুটা কাঁচকলা পাশাপাশি বসানো।

হাদিস উদ্দিনকে সকাল থেকেই খুব উৎফুল্ল দেখা গেল। সে নামাজ রোজার ধার ধারে না, কিন্তু সেদিন দুপুরে সে গোসল করে পাক পবিত্র হয়ে মসজিদে জোহরের নামাজ পড়তে গেল। মসজিদে নতুন ইমাম সাহেব এসেছেন। শ্যামগঞ্জের আলীম পাশ বিরাট মাওলানা, নাম মোহাম্মদ সিদ্দিক। নতুন ইমাম কেমন তা জানা প্রয়োজন।

মোহাম্মদ সিদ্দিকের বয়স অল্প। সুন্দর চেহারা। গলার স্বর মিষ্টি। সমস্যা একটাই— তার দাড়ি নেই। ইমাম সাহেবের দাড়ি না থাকলে কীভাবে হবে? ইমামের চাকরি দিতে গিয়ে ধনু শেখ থমকে গেলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, দুনিয়ার ইসলামি পাশ দিয়া বইসা আছ, তোমার দাড়ি কই?

ইমাম মাথা নিচু করে বলল, আমাদের বংশে দাড়ি নাই জনাব।

দাড়ি ছাড়া মাকুন্দা ইমাম লোকজন মানবে কেন?

সিদ্দিক বিনীত ভঙ্গিতে বলল, দাড়ি রাখা সুন্নত। নবীজির দাড়ি ছিল। যাদের দাড়ি হয় না। তারা এই সুন্নত পালন করতে পারে না। এছাড়া আর কোনো সমস্যা নাই।

ধনু শেখ বললেন, সমস্যা যে নাই সেটা তুমি বলতেছ। সমস্যা তোমার না। সমস্যা আমার। লোকজন বলবে, ধনু শেখ ইচ্ছা কইরা মাকুন্দা নিয়া আসছে। যাই হোক, এসে যখন পড়েছ থাক। মুসুন্ত্রিরা কেউ আপত্তি তুললে সঙ্গে সঙ্গে বিদায়।

আপত্তি তুলবে না।

আগ বাড়ায়া কথা বলবে না। আপত্তি তুলবে না। তুমি জানো কীভাবে?

ইমাম সিদ্দিক চুপ করে রইল। ধনু শেখ বললেন, খাওয়া থাকা আমার বাড়িতে। বেতন দশ টাকা।

ঠিক আছে জনাব। তবে আপনার বাড়িতে থাকব না। রাতে মসজিদে থাকব।

মসজিদে কেন থাকবে?

আমি রাতে ইবাদত বন্দেগি করি। মসজিদে থাকা আমার জন্যে ভালো।

ধনু শেখ বললেন, তোমার জন্যে ভালো হলে ভালো। থাক মসজিদে, তবে সাবধানে থাকবা। এই মসজিদের কিছু দোষ আছে।

কী দোষ?

এই মসজিদের ইমামদের কিছুদিন পরই মাথা নষ্ট হয়ে যায়। ইমাম ইদরিস ছিল। মাথা হয়ে গেল পুরাপুরি নষ্ট। বাজারের এক মেয়েছেলে বিবাহ করল। এখন যে সে কোথায় আছে। কেউ জানে না। তারপরে আসল করিম। বিরাট মাওলানা। সে এখন আধাপাগল হয়ে ঘুরতেছে। খবর পেয়েছি নিচুজাতের সঙ্গে এখন তার উঠাবাসা। তারা চোলাই মদ বানায়, সেই মদ খায়া সে শুনেছি। এইখানে সেইখানে পড়ে থাকে।

উনার কথা শুনেছি।

ধনু শেখ উগ্র গলায় বললেন, তার কথা শুনলে আমার কথাও নিশ্চয়ই শুনেছ? তার তালাক দেয়া স্ত্রীর সাথে আমার যে বিবাহ হয়েছিল এটা শুনেছি?

জি।

সেই মেয়ে যে রঙিলা নটিবাড়িতে থাকে, এটা শুনেছি?

সিদ্দিক মাথা নিচু করে ফেলল। ধনু শেখ বললেন, মাথা নিচা করলা কেন? তোমার স্ত্রী তো নটিবাড়িতে নাই। শাদি করেছ?

জি-না।

আচ্ছা এখন সামনে থেকে যাও। মিজাজ খারাপ হয়ে গেছে। আরেকটা কথা, আতর মাইখা আমার কাছে আসবা না। আতরের গন্ধে আমার মাথায় যন্ত্রণা হয়।

 

জোহরের নামাজ পড়তে মুসুল্ল এসেছে মাত্র একজন— হাদিস উদ্দিন। জোহর কাজকর্মের সময়। নামাজি মানুষ এমনিতেই কম আসে। তাছাড়া নতুন ইমাম এসেছে, পাঞ্জেগানা নামাজ আবার শুরু হয়েছে- এই খবর এখনো সবার কাছে পৌঁছে নি।

নামাজ শেষ করে সিদ্দিক হঠাৎ বলল, জনাব, আপনার সঙ্গে যে আল্লাহপাকের দেখা হয়েছিল এটা কি আপনার স্মরণে আছে?

হাদিস উদ্দিন হতভম্ব হয়ে বলল, এটা কী বললেন?

সিদ্দিক হাসিমুখে বলল, না জেনে বলি নাই। জেনে বলেছি।

হাদিস বলল, আপনের মাথা তো আগের দুই মাওলানার চেয়েও খারাপ।

সিদ্দিক খানিকটা ঝুকে এসে বলল, আল্লাহপাক মানুষ সৃষ্টির আগে মানুষের আত্মা সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর তিনি সব আত্মাকে একত্র করে বললেন, বিলো তোমাদের রব কে? আত্মারা সবাই একসঙ্গে বলল, আপনি আমাদের রব। এই কারণেই আপনাকে জিজ্ঞাস করলাম, আল্লাহপাকের সঙ্গে আপনার যে দেখা হয়েছিল। এই ঘটনা ইয়াদ আছে কি-না? সামান্য রহস্য করে বললাম। অপরাধ নিবেন না।

হাদিস উদ্দিন নতুন ইমাম সাহেবের জ্ঞানবুদ্ধিতে এবং বিনয়ে মোহিত হয়ে গেল। সে ঠিক করল, তেমন কোনো কাজকর্ম না থাকলে মাঝেমধ্যে নামাজে আসবে। জীবনযাপন করতে গেলে দুএকটা ছোটখাটো দোষত্রুটি হয়ে যায়। নামাজের মাধ্যমে সে সব কাটান দিতে হয়।

 

শ্ৰীনাথ মূর্তি চুরির বিষয়ে কথা বলার জন্যে ধনু শেখের কাছে গিয়েছে। মূর্তি কে নিয়েছে শ্ৰীনাথ জানে। ধনু শেখের মতো ক্ষমতাবান মানুষ ছাড়া তা উদ্ধার করা যাবে না।

ধনু শেখ তামাক টানতে টানতে বললেন, মূর্তি কে চুরি করেছে তুমি জানো?

শ্ৰীনাথ গলা নামিয়ে বলল, অবশ্যই জানি। লাবুসের ইশারায় চুরিটা হয়েছে। চুরি করেছে ল্যাংড়া হাদিস উদ্দিন।

ধনু শেখ বললেন, গলা নামায়া কথা বলতেছ। কেন? আশেপাশে তো কেউ নাই।

শ্ৰীনাথ বলল, আপনি ব্যবস্থা না নিলে জিনিস উদ্ধার হবে না।

ধনু শেখ বললেন, শুনেছি। রাধাকৃষ্ণ বিরাট দেবদেবী। তারা নিজেরা নিজেদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে পারে না? ধনু শেখের সাহায্য লাগে?

শ্ৰীনাথ বলল, দেবদেবীরা তাদের ক্ষমতা সর্বসাধারণে দেখান না। নিজেদের কাজ অন্যকে দিয়ে করায়ে নেন। উদ্ধারের কাজটা যেমন আপনার মাধ্যমে হবে।

ধনু শেখ তামাক টানা বন্ধ করে হঠাৎ গভীর ভঙ্গিতে বললেন, শশাংক পালের ভূত দেখার গল্পটা তো তুমি শেষ কর নাই। গাছে বসে ছিল ভূত। তুমি বাকি দিয়া ফেললা। তারপরে কী হলো?

শ্ৰীনাথ বলল, ওই গল্প আরেকদিন শেষ করব। আপনি মূর্তির মীমাংসাটা করেন। হাদিস উদ্দিন বদমাইশটা নিয়েছে।

বুঝলা কীভাবে?

পায়ের ছাপ দেইখা বুঝতে পেরেছি। যে চুরি করতে এসেছে তার পায়ের ছাপা পড়েছে। একপায়ের ছাপা গভীর। আরেকটা পাতলা। খোড়া পায়ের ছাপ পাতলা।

ধনু শেখ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, পায়ের ছাপের কারণেই আমি চুরি করতে বাইর হই না; আমি যেখানেই যাব এক ঠ্যাং-এর ছাপ পড়বে। তোমার মতো বুদ্ধিমান লোক সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলবে চোর ধনু শেখ।

শ্ৰীনাথ দুঃখিত গলায় বলল, জনাব, আপনি পুরা বিষয়টা নিয়া হাসি। তামাশা করতেছেন। এটা হাসি তামাশার কোনো বিষয় না। শুধু যে মূর্তি চুরি করেছে তা-না। হিন্দু জাতিরে বিরাট অপমানও করেছে।

কীভাবে অপমান করেছে?

দুটা কাঁচকলা রেখে গেছে।

ধনু শেখ বললেন, কাঁচকলার মধ্যে অপমানের কী আছে? হিন্দু বিধবারে কলা দুইটা দেও, তারা বড়া বানায়ে খেয়ে ফেলবে।

বিষয়টা নিয়া যে কত বড় সমস্যা হবে। আপনি তা বুঝতে পারতেছেন না। রঙ্গতামাশা করতেছেন। এটা রঙ্গতামাশার বিষয় না।

ধনু শেখ বললেন, এখন তুমি পথে আসছি। রঙ্গতামাশার বিষয় তো অবশ্যই না। মূর্তি চুরি নিয়া হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাধতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু মুসলমান কাটাকাটি যে শুরু করেছে এটা শুনেছ? মুসলমান পিঁয়াজ খায়, গরু খায়, এইজন্যে কাটাকাটিতে সে আগায়া আছে। এই অঞ্চলে হিন্দু যদিও বেশি, কাটাকাটি শুরু হইলে দেখবা কী অবস্থা।

শ্ৰীনাথ উঠে পড়ল। এই লোকের সঙ্গে কথা বলতে আসাই তার ভুল হয়েছে। উন্মাদশ্রেণীর মানুষ। কী বলে না বলে সে নিজেও জানে না। ধনু শেখ বললেন, বেয়াদবের মতো হুট কইরা উঠে দাড়াইলা, তার কারণ কী?

শ্ৰীনাথ বলল, আমার কথা শেষ, আমি চইলা যাব। বুঝেছি আপনার এখানে কোনো ফয়সালা হবে না।

কে বলেছে। ফয়সালা হবে না? অবশ্যই ফয়সালা হবে। আচ্ছা শ্ৰীনাথ, এই মূর্তি তোমরা পাইছ কই? হরিচরণের ঠাকুরঘরে এমন মূর্তি ছিল। আমি নিজে অনেকবার দেখেছি।

শ্ৰীনাথ হড়বড় করে বলল, আমাদেরটা দেখতে একই রকম, কিন্তু মূর্তি ভিন্ন।

ধনু শেখ বললেন, তা হতে পারে। মানুষও একই চেহারার প্রায়ই পাওয়া যায়। এম এস বাহাদুর নামে আমার একটা লঞ্চ ছিল। সেখানে পাঁচক বামুন যে ছিল তার চেহারা অবিকল তোমার মতো। বিরাট চোর ছিল। একদিন তারে একশবার কানে ধরে উঠবোস করতে বললাম। বিশবার উঠবোস করে সে ধপাস করে পড়ে গেল। মিনমিন করে বলল, কর্তা আর পারব না। শ্ৰীনাথ শোন, মনের ভুলে কোনদিন যে তোমারেও উঠবোস করাই তার নাই ঠিক। একই রকম চেহারার কারণে ভুল হইতে পারে। মানুষ মাত্রই ভুল করে। ভালো কথা, শ্ৰীনাথ, তোমরার দেবদেবীরা ভুল করেন না?

শ্ৰীনাথ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ধনু শেখের কাছে আসা বিরাট ভুল হয়েছে। তার উচিত ছিল মন্দিরের কাছে থাকা। রাজমিস্ত্রিদের কাজ তদারক করা। মন্দির নির্মাণ বন্ধ হয় নি। কাজ পুরোদমে চলছে।

ধনু শেখ বললেন, বেশি চালাক হওয়া ঠিক না শ্ৰীনাথ। আমি বেশি চালাক হয়েছিলাম, আমার ঠ্যাং চলে গেছে। ইমাম করিম বেশি চালাক হয়েছিল, তার বউ চলে গেছে। তোমার কী যায় কে জানে।

শ্ৰীনাথ বলল, আমার যাওয়ার মতো কিছু নাই।

তাও ঠিক। এখন গল্পটা শেষ কর।

কী গল্প?

শশাংক পালের গল্প। এত বড় জমিদার ভূত হইয়া গাছে বসা। কী লজ্জার কথা! তারপর তুমি কী করলা? ঝাঁকি দিয়া ভূত পাড়লা? ভূত ধুপ্‌পুস কইরা মাটিতে পড়ল?

 

ইমাম করিম মাধাই খালের পাড়ে বসে আছে। সকাল থেকেই এই জায়গায় বসে ছিল। এখন মধ্যদুপুর। কাল রাতে সে স্বপ্নে দেখেছে, কলার ভেলায় করে শরিফা খাল বেয়ে আসছে। শরিফার পরনে সুন্দর শাড়ি। বোরকা হাতে পুঁটলি পাকিয়ে ধরা। মাথায় ঘোমটাও দেয় নাই। করিম বলেছে, ছিঃ ছিঃ শরিফা, এইসব কী? বোরকা হাতে নিয়া বইসা আছ কেন? কতজন তোমারে দেখবে!

শরিফা বলল, দেখুক।

করিম বলল, এটা কেমন কথা বললা? সারাজীবন তোমারে পর্দা পুশিদার কথা বলছি।

শরিফা বলল, আপনের কথা ব্যাঙের মাথা। ভেলায় উঠেন দেখি।

করিম স্বপ্লের মধ্যেই ভেলায় উঠলেন। ভেলাটা তখন নৌকা হয়ে গেল। স্বপ্নে এই ব্যাপারগুলি এমনভাবে ঘটে যে মোটেই অস্বাভাবিক লাগে না। করিম বলল, আমরা যাই কই?

শরিফা বলল, ভাটির দেশে যাই। ভাটির দেশে আমার স্বামী থাকে। তার সাথে ঘর করতে যাই।

তোমার স্বামী আবার কে? আমি তোমার স্বামী।

উঁহু। আপনে আমার কেউ না।

করিম বলল, তোমারে একটা কথা বলব?

শরিফা বলল, আপনের কথা ব্যাঙের মাথা।

করিম মাধাই খালের পাড়ে বসে আছে, একটু পরপর বিড়বিড় করে বলছে, আপনের কথা ব্যাঙের মাথা। করিম বুঝতে পারছে তার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। একই কথা অসংখ্যবার বলা মাথা খারাপের প্রথম লক্ষণ।

মাথা খারাপ মানুষদের জন্যে অনেক সুবিধা আছে। তাদের জন্যে নামাজ রোজা মাফ। তারা খুন করলেও খুনের বিচার হবে না। একটা খুন করলে না, দশটা খুন করলেও না।

করিম ঠিক করে রেখেছে, পুরোপুরি পাগল হয়ে গেলে সে কয়েকটা খুন করবে। পুরোপুরি পাগল সে এখনো হয় নাই। পুরোপুরি পাগল হলে গায়ে কাপড় রাখতে পারত না। পাগলের শীত-গ্ৰীষ্ম বোধ থাকে না। তার এখনো আছে। গা থেকে কম্বল খুলে দেখেছে। শীত লাগে। পানিতে নামলে শীত লাগে। শীতের কারণে সে গোসল বন্ধ করে দিয়েছে।

করিম উঠে দাঁড়াল। ক্ষুধাবোধ হচ্ছে। কিছু খাওয়া দরকার। সে লাবুসের বাড়ির দিকে রওনা দিল। যাদের সে খুন করবে। সেই তালিকায় লাবুসের নাম আছে, তারপরেও সে যায়। হাদিস উদ্দিন তাকে দেখলেই বলে— ইমাম সাব, কিছু খাবেন? হাত ধুইয়া আসেন, খানা দেই।

হাত ধুইতে পারব না, তুমি খানা দাও। হাত ধুইতে গেলে শীত লাগবে।

ময়লা হাতে খাইবেন?

মাথায় হাত মুইছা খাব। অসুবিধা নাই। পাগলের জন্যে সব মাপ।

করিম লাবুসের বাড়ির কাছাকাছি এসে মত বদলাল। ক্ষুধাটা চলে গেছে। যেহেতু ক্ষুধা নাই ওই বাড়িতে যাওয়ার প্রশ্ন উঠে না। সে জুম্মাঘরের দিকে রওনা হলো। নতুন ইমাম এসেছে, তার সঙ্গে এখনো পরিচয় হয় নাই। পরিচয় থাকা উচিত। তাছাড়া ইমাম নতুন মানুষ। তাকে পরামর্শ দেওয়াও করিমের কর্তব্য। তাকে অঞ্চলের হাবভাব বুঝিয়ে দিতে হবে। নতুন মানুষ বিপদে যেন না পড়ে। একেক অঞ্চলের ভাব একেক রকম। রঙিলা নটিবাড়ির বিষয়টাও ইমাম সাহেবকে বুঝিয়ে দিতে হবে। ভুলেও যেন সেদিকে না যায়। যাওয়া দূরের কথা, ওইদিকে তাকালেও বিরাট পাপ হবে। হাবিয়া দোজখের আগুনে পুড়ে মরতে হবে। নতুন ইমাম সাহেবের জ্ঞান বুদ্ধি, হাদিস কোরানের ওপর দখল কেমন এগুলোও দেখতে হবে। আজান দিয়া নামাজ পড়াতে পারলেই ইমাম হওয়া যায় না।

ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়কে উঠতে গিয়ে করিম ভুরু কুঁচকে তাকাল। মনিশংকরের ছেলে শিবশংকর আসছে। করিম দ্রুত চিন্তা করল, খুন করার তালিকায় এই ছেলে আছে কি-না।

না, এই ছেলের নাম নেই। করিম হাসিমুখে এগিয়ে গেল। খুনের তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করা উচিত। করিম বলল, বাবা, কেমন আছ?

শিবশংকর বলল, বেশি ভালো না কাকু। আমার রোজ জ্বর আসছে।

ম্যালেরিয়া হয়েছে। কুইনাইন খাওয়া দরকার।

কুইনাইন খাচ্ছি।

বিসমিল্লাহ বলে খাও না তো? বিসমিল্লাহ বলে খেলে কাজ হবে না। ওষুধপত্র খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বলা নিষেধ। তখন বলতে হয় আল্লাহু শাফি। আল্লাহু কাফি।

কাকু, আমি হিন্দু।

সেটা তো জানি। জানিব না কেন? পুরাপুরি পাগল তো হই নাই। যেদিন হব সেদিন হিন্দু-মুসলমান ভেদ থাকবে না। তখন আমার কাছে হিন্দুও যা, মুসলমানও তা।

শিবশংকর দুঃখিত চোখে তাকিয়ে আছে। করিম বলল, বাবা এখন যাই। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব। যদিও আমার কথা হলো ব্যাঙের মাথা। শরিফা এরকম বলে। শরিফাকে চিনেছ তো? আমার স্ত্রী। সম্পর্কে তোমার চাচি হয়। এখন সে আছে। রঙিলা নটিবাড়িতে। ঠিক করেছি একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে যাব। টাকা-পয়সার জোগাড় হচ্ছে না বলে যেতে পারছি না। তাড়াহুড়াও কিছু নাই। তোমার চাচি তো আর পালায়া যাচ্ছে না। রঙিলাবাড়িতে একবার কেউ ঢুকলে পালাতে পারে না। বাকি জীবন ওইখানে কাটাতে হয়।

 

নয়া ইমাম মোহাম্মদ সিদ্দিকের জ্ঞান-বুদ্ধিতে করিম সন্তুষ্ট হলো। সব প্রশ্নের জবাব নতুন ইমাম ঠিকঠাক দিলেন। করিম এতটা আশা করে নি।

করিম বলল, ইমাম সাহেব, বলেন দেখি হাবুতি সনটা কী? বাংলা সন, হিজরি সনের কথা সবাই জানে। হাবুতি সনের কথা জানে জ্ঞানীজন। চট করে বলেন হাবুতি সন কী?

মোহাম্মদ সিদ্দিক বললেন, হযরত আদম (আঃ)-এর বেহেশত থেকে পৃথিবীতে অবতরণের দিন থেকে হাবুতি সন শুরু।

করিম বললেন, হয়েছে। মাশাল্লাহ। এখন বলেন নবীদের মধ্যে সবচে’ দীর্ঘ আয়ু কে পেয়েছেন, স্বল্প আয়ু কে পেয়েছেন?

সবচে’ দীর্ঘ আয়ু পেয়েছেন দুই নবী। হযরত নুহ (আঃ) এবং হযরত আয়ুব (আঃ), দুইজনই ১৪০০ বছর বেঁচেছেন। আর অল্প আয়ু পেয়েছেন দুইজন। হযরত ঈসা (আঃ), উনি বেঁচেছেন মাত্র ৩৩ বৎসর। আমাদের প্ৰাণপ্ৰিয় নবী হযরত মোহাম্মদও (দঃ) অল্প আয়ু পেয়েছিলেন। তিনি বেঁচেছেন মাত্র ৬৩ বৎসর।

মাশাল্লাহ। শেষ প্রশ্ন, এটা না পারলেও ক্ষতি নাই। হযরত আদমের বংশধরদের তালিকা বলেন। নবী বংশ বললেই হবে।

মোহাম্মদ সিদ্দিক চোখ বন্ধ করে তালিকা বলা শুরু করলেন—(এই তালিকার সঙ্গে লুক লিখিত সুমাচারের অদ্ভুত মিল আছে। শুধু কিছু নামের বানান ভিন্ন। —লেখক)

(১) হযরত আদম (আঃ) (২) হযরত শীশ (আঃ) (৩) হযরত ইয়াসিন (আঃ) (৪) হযরত কইনান (আঃ) (৫) হযরত মাহিলীল (আঃ) (৬) হযরত ইয়ারত (আঃ) (৭) হযরত ইদরিস (আঃ) (৮) হযরত আখিমুখ (আঃ) (৯) হযরত শালিখা (আঃ) (১০) হযরত লামক (আঃ) (১১) হযরত নুহ (আঃ) (১২) হযরত সাম (আঃ) (১৩) হযরত আরাফাক শাম (আঃ)

করিম বললেন, আর বলতে হবে না। মাশাল্লাহ। আপনার জ্ঞানে আমি মুগ্ধ। আসেন কোলাকুলি করি।

মোহাম্মদ সিদ্দিক বললেন, আপনার সঙ্গে আমি কোলাকুলি করব না। আপনার শরীর এবং কাপড় নোংরা। আপনি কতদিন গোসল করেন না কে জানে।

শীতের কারণে গোসল করতে পারতেছি না। তাছাড়া সাবানও নাই। সাবান ছাড়া গোসল করে ফয়দা কী?

সিদ্দিক বললেন, আমি গরম পানি আর সাবানের ব্যবস্থা করলে গোসল করবেন? গোসল করা উচিত। আমাদের নবী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।

গরম পানি কোথায় পাবেন?

আমি ব্যবস্থা করব।

গোসলের পর পারব কী?

আমি লুঙ্গি, পাঞ্জাবির ব্যবস্থা করব।

করিম বেশকিছু সময় চিন্তা করে বললেন, গোসল করতে রাজি আছি।

মোহাম্মদ সিদ্দিক গরম পানির সন্ধানে গেলেন। গরম পানি, সাবান, পরিষ্কার ধোয়া কাপড় নিয়ে ফিরে এসে দেখোন— করিম নেই।

 

সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রথমে গুড়িগুড়ি কুয়াশার মতো পড়ছিল। যতই রাত বাড়তে লাগল বৃষ্টিও বাড়তে লাগল। একসময় শিল পড়তে শুরু করল। শীতের দিনে এমন শিলাবৃষ্টি অনেক দিন এই অঞ্চলে হয় নি। ধনু শেখ আগ্ৰহ নিয়ে শিলপাড়া দেখছেন। পা ভালো থাকলে ছোটবেলার মতো শিল কুড়াতেন। মাটির গোল সরায় শিল জমা করতেন। কিছুক্ষণ পর সারা ভাঙলে পাওয়া যেত বরফের গোল বল। ধনু শেখ ডাকলেন, সদরুল।

সদরুল দৌড়ে এলো।

ধনু শেখ বললেন, আমি আবছামতো দেখেছি করিম কদম গাছের নিচে দীড়য়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজতেছে। মাথার মধ্যে শিল পড়তেছে।

তাড়ায়া দিয়া আসি? যদি বলেন বাড়ি দিয়া ঠ্যাং ভাঙ্গব। বড় ত্যক্ত করতেছে।

ধনু শেখ বললেন, না। তারে ধইরা নিয়া আসি। সাবান ডাইল্যা গরম পানি দিয়া গোসল দেও। শুকনা কাপড় দেও। আইজ তারে সঙ্গে নিয়া খানা খাব। তারে দেইখা হঠাৎ মায়া লাগল।

সদরুল বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল।

ধনু শেখ বললেন, এইভাবে তাকায়া আছ কেন? আমার কথা বুঝতে পার নাই?

বুঝেছি।

তাহলে দৌড় দেও।

সদরুল কদম গাছের দিকে ছুটে গেল।

 

করিম জলচৌকিতে বিপ্লাম ধরে বসে আছে। সদরুল তার গায়ে সাবান ডলছে। অন্য একজন লোটায় করে মাথায় পানি ঢালছে। করিম লজ্জায় মরে যাচ্ছে। খালি গায়ে তাকে গোসল দেয়া হচ্ছে- এই কারণে লজ্জা না। আতর নামের মেয়েটা দূর থেকে তাকে দেখছে এটাই লজ্জা। খুন করার তালিকায় এই মেয়েটা আছে কি-না করিম মনে করতে পারছে না। মনে হয় আছে। মেয়েটাকে সে একটা চিঠি দিয়েছিল। চিঠিটা সে শরিফাকে দেয় নি। যদি দিত অবস্থা ভিন্ন হতো। এই অপরাধ গুরুতর। এই অপরাধের জন্যে অবশ্যই তাকে খুন করা যায়। তবে এ মেয়েছেলে এবং বয়স অল্প। অল্পবয়েসি মেয়েছেলের কারণে তাকে কি ক্ষমা করা যায়? করিম চিন্তা করে কূল পাচ্ছে না।

আতর আজ তার বাবার কিছু অপরাধ ক্ষমা করেছে। বাবা যে মমতা ইমাম করিমকে দেখিয়েছে সেই মমতার হয়তো অন্য অর্থ আছে। কিন্তু এই মুহুর্তে মমতাটাই চোখে পড়ছে। অন্যকিছু না। আতর ছাতি মাথায় দিয়ে শিল কুড়াতে শুরু করল।

করিম মুগ্ধ হয়ে আতরের শিল কুড়ানো দেখছে। শরিফাও শিল কুড়ান্ত। গ্লাসে জমা করে রাখত। শরিফার একটা কাজ আতর করছে, এইজন্যে করিম আতরকে ক্ষমা করে দিল। এবং কোমল গলায় বলল, আম্মাজি, ভালো আছেন? আতর বলল, এখন থেকে আপনি আমাদের বাড়িতে থাকবেন। পথেঘাটে ঘুরবেন না।

করিম বলল, কেন?

আতর বলল, আপনি আমাকে আম্মাজি ডেকেছেন এইজন্যে।

করিমের চোখে পানি এসে গেছে। তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে বলে চোখের পানি আলাদা করা যাচ্ছে না।

 

শীতে ধনু শেখের শরীর জমে যাচ্ছে। বিলাতি পানিতে শীত কমবে। একা একা এই পানি খেয়ে মজা নাই। রঙিলা বাড়িতে যাওয়া যায়। ঝড়বৃষ্টিতে পথ কাদা হয়ে আছে। পাল্কি বরদাররা পা পিছলে পালকি নিয়ে পড়লে অবস্থা কাহিল হবে। ধনু শেখ কী করবেন মনস্থির করতে পারছেন না। রঙিলা বাড়িতে গেলে শরিফার সঙ্গে দেখা হবে। এর আলাদা আনন্দ। নতুন জায়গায় মেয়েটা কেমন আছে স্বচক্ষে দেখা। তার ঘটনা কী জানা! ধনু শেখ ডাকলেন, সদরুল।

সদরুল ছুটে এলো।

শীত কেমন নামল বলো দেখি?

ভালো নামছে।

বুড়াবুড়ি যা আছে। এই শীতে শেষ হবে কি-না বলো? শীত হলো বুড়া মারার কাল। ঠিক বলেছি না?

অবশ্যই ঠিক বলেছেন।

আমি নিজেও তো বুড়ার দলে। শীতে আমারও মরণের কথা।

আপনে কী যে কিনা!

ধনু শেখ বললেন, আমার শীত কমানোর ব্যবস্থা কর। শীত না কমলে আমি শেষ।

সদরুল মাথা চুলকাচ্ছে। শীত কীভাবে কমাবে বুঝতে পারছে না। সে ইতস্তত করে বলল, আগুন করব?

ধনু শেখ বললেন, এটা মন্দ না। শীতের আসল ওষুধ আগুন। বড় করে আগুন কর, কয়েকটা হিন্দু বাড়ি জ্বালায়া দাও।

সদরুল বলল, কথাটা বুঝলাম না।

ধনু শেখ বললেন, কথা না বুঝার কী আছে? সব জায়গায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলতেছে। এইখানে কিছুই নাই। হিন্দুস্থান পাকিস্তান ভাগাভাগি যখন হবে, তখন দেখা যাবে বান্ধবপুর পড়েছে হিন্দুস্থানে। সেটা ভালো হবে?

জে না।

হিন্দু কিছু কমাইতে হবে। ভোটাভুটিরও ব্যাপার আছে। এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন কিছু হিন্দু কমে, কিছু দেশ ছাইড়া পালায়। আইজ আগুন দেওয়া সমস্যা। বৃষ্টিতে সব ভিজা।

ধনু শেখ হতাশ গলায় বললেন, তোমরার বুদ্ধি গরু-ছাগলের বুদ্ধি। পেট্রল ঘরে রাখা আছে না? পানির সাথে মিশলে পেট্ৰল ভালো জ্বলে। বুঝেছ?

জি।

ঠান্ডা। আর ঝড়বৃষ্টির কারণে লোকজন সব থাকবে ঘরে। আগুনের কারিগররে কেউ দেখবে না। কথা ঠিক বলেছি?

জি বলেছেন।

এককড়ির দোকানটা অবশ্যই জ্বালাইবা।

জি আচ্ছা।

জুম্মাঘরে আগুন দিতে ভুলব না। কিন্তু।

কথাটা বুঝলাম না।

ধনু শেখ ঠান্ডা গলায় বললেন, দাঙ্গা-হাঙ্গামার পরে ইংরাজ ম্যাজিষ্ট্রেট আসবে। পুলিশ সুপার আসবে। তারা স্বচক্ষে দেখবে মুসলমানের পবিত্র ধৰ্মস্থান হিন্দুরা কীভাবে জ্বালায়ে দিয়েছে। এখন বুঝেছ?

বুঝেছি। আপনার বুদ্ধির কোনো সীমা নাই।

বুদ্ধি অনেকেরই আছে। সবে বুদ্ধি ব্যবহার করে না। আমি করি। পাল্কি ঠিক করতে বলো। রঙিলা বাড়িতে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শীত কমানোর ব্যবস্থা।

আগুনের ব্যবস্থা কি এখনই করব?

অবশ্যই। আগুন দেখতে দেখতে যাব।

 

প্ৰায় একই সঙ্গে কয়েকটা জায়গায় আগুন জুলল। এককড়ির দুটা দোকান। ভরদ্বাজের বাড়ি। মনিশংকরের বাংলাঘর এবং জুম্মাঘর। বান্ধবপুর অঞ্চল জুড়ে হৈচৈ ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। বাচ্চাদের কান্নাকাটি শোনা যাচ্ছে। অনেক হিন্দু বাড়িতে শঙ্খ বাজানো শুরু হয়েছে। ভয়াবহ দুর্যোগে শঙ্খ বাজানোর নিয়ম।

ধনু শেখ পাঙ্কি করে যাচ্ছেন। হঠাৎ দেখলেন শ্ৰীনাথ দৌড়ে যাচ্ছে। তিনি ডাকলেন, শ্ৰীনাথ, যাও কই?

শ্ৰীনাথ থমকে দাঁড়াল। জবাব দিল না। ধনু শেখ বললেন, যেখানেই যাও ধীরেসুস্থে যাও। রাস্তা পিছল। পিছল রাস্তায় সাবধানে হাঁটতে হয়। বুদ্ধিমান মানুষ সাবধানে হাঁটে। তোমারে বুদ্ধিমান জানতাম।

শ্ৰীনাথ কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলাল। ধনু শেখ বললেন, শশাংক পালের ভূতের বিষয়টা শুনলাম না। ঝাঁকি দিয়া ভূতটারে তুমি যখন নিচে ফেললা তখন কী হইল? আচ্ছা থাক, পরে শুনব। মনে হয়। আইজ তুমি সামান্য ব্যস্ত।

ধনু শেখের পালকি এগুছে। শ্ৰীনাথ কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। আগুন বাড়ছে। বাতাসের কারণে দ্রুত ছড়াচ্ছে।

 

মালেকাইন ধনু শেখের যত্নের চূড়ান্ত করছেন। বিলাতি পানি আনা হয়েছে। হুক্কায় আম্বুরী তামাক পুড়ছে। পিতলের বড় মালসায় কাঠকয়লার আগুন করে ধনু শেখের পাশে রাখা হয়েছে। হাত গরম করার ব্যবস্থা। ধনু শেখ বললেন, একটা পা না থাকার কারণে আমার এখানে আসা-যাওয়ার বড়ই অসুবিধা। আসতে ইচ্ছা করলেও আসতে পারি না।

মালেকাইন বললেন, আহা আহা!

ধনু শেখ বললেন, আমার এই অসুবিধা আপনি সহজেই দূর করতে পারেন।

মালেকাইন বললেন, অবশ্যই। আমার চার বেহারিার পালকি আছে। আপনি খবর দিলেই পাল্কি যাবে। আদবের সাথে আপনাকে নিয়ে আসবে।

ধনু শেখ বললেন, পাঙ্কি আমারও আছে।

মালেকাইন বললেন, তাও ঠিক।

ধনু শেখ তামাকে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আমার সমস্যা দূর করার সহজ উপায় রঙিলা বাড়ির যাকে আমার পছন্দ তারে পাল্কি দিয়া আমার কাছে পৌঁছায়ে দেয়া।

মালেকাইন বললেন, সেটা সম্ভব না। এই বাড়ির কিছু নিয়ম আছে। অনেক দিনের পুরনো নিয়ম। বাড়ির মেয়ে কোনোখানে পাঠানো যাবে না। এরা থাকবে আলাদা। কোনোখানে যাবে না।

দিনের সাথে নিয়ম পাল্টায়। ইংরেজ আমলের নিয়ম আর স্বরাজ আমলের নিয়ম এক না।

মালেকাইন বললেন, স্বরাজ এখনো হয় নাই। যখন হবে তখন দেখব। তবে রঙিলা বাড়ির নিয়ম। তখনো বহাল থাকবে।

ধনু শেখ বললেন, আপনার প্রয়োজন টাকা। নিয়মের আপনার প্রয়োজন নাই। আমি যখন কাউকে নিজের বাড়িতে নিয়া রাখব ডাবল টাকা দিব।

তিনগুণ টাকাতেও হবে না।

ধনু শেখ বললেন, না হলে কী আর করা। আমি নিজেও নিয়ম মানা মানুষ। নিয়মের বাইরে যাই না। বান্ধবপুরের বিভিন্ন জায়গায় আগুন লেগেছে। এই খবর কি পেয়েছেন?

পেয়েছি।

আগুন নিয়ম মানে না। সে তার ইচ্ছায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। আপনি সাবধানে থাকবেন যেন রঙিলা বাড়িতে আগুন না ধরে। রঙিলা বাড়ি পুইড়া ছাই হয়ে গেলে আপনার আমার সবেরই অসুবিধা।

মালেকাইন ধনু শেখের গ্রাসে বিলাতি পানি ঢালতে ঢালতে চিন্তিত গলায় বললেন, আপনি কাকে নিজের বাড়িতে নিতে চান?

ধনু শেখ বললেন, শরিফাকে।

আজই নিতে চান?

হুঁ।

রাখবেন কত দিন?

জানি না।

মালেকাইন বললেন, ঠিক আছে নিয়া যান।

ধনু শেখ বললেন, আপনার অনেক মেহেরবাণী।

শরিফা আলাদা পালকিতে ধনু শেখের বাড়িতে যাচ্ছে। তাকে চিন্তিত বা দুঃখিত মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে ক্লান্ত। যেন অনেক দিন শান্তিমতো ঘুমাচ্ছে না। সে পালকিতেই ঘুমিয়ে পড়ল।

 

বান্ধবপুরের আগুনে পাঁচজন মানুষ মারা গেল। এদের মধ্যে মুসলমান একজন। জুম্মাঘরের নতুন ইমাম মোহাম্মদ সিদ্দিক। আগুন লাগার পর সে দরজা খুলে বের হতে পারে নি। দরজা খুঁজে পায় নি। মসজিদের ভেতর ছোটাছুটি করেছে এবং চিৎকার করেছে— ইবলিশ শয়তান। ইবলিশ। ইবলিশ। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তার ধারণা ছিল— ইবলিশ শয়তান কিছু একটা করছে। ইবলিশের মায়া। আসলে আগুন-টাগুন কিছুই লাগে নি।

গৌরাঙ্গ এককড়ির দোকানেই ঘুমাত। আগুন লাগার পর সে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। দোকানের ক্যাশবাক্স উদ্ধারের জন্যে সে আবার দৌড় দিয়ে জ্বলন্ত ঘরে ঢুকে। তখনি ঘরের চাল তার ওপর পড়ে। ক্যাশবাক্সে ছিল ছয় টাকা সাত আনা।

বাকি তিনজন শিশু। ভরদ্বাজের তিন মেয়ে- সুশিলা, সরাজুবালা এবং দুৰ্গা। উদ্ধারের পর দেখা যায় তিনবোন জড়াজড়ি করে আছে।

 

বান্ধবপুরে বুনকা বুনকা ধোঁয়া উড়ছে। আগুন জ্বলছে। কিছু জায়গায় এখনো আগুন নেভানোর চেষ্টা হচ্ছে। ধনু শেখ আগ্রহ নিয়ে আগুনের খেলা দেখছেন।

আরো একজন আগুনের খেলা দেখছেন তার গোপন বাংকারে বসে। তার নাম হিটলার। হিটলারের সামনে বৃদ্ধ এক জিপসি। সে দেয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন জ্বালিয়ে ভবিষ্যৎ বলতে পারে। জিপসির নাম ইয়ান’র। তার চেহারা সাধু সন্তের মতো। লম্বা দাড়ি, লম্বা চুল। ঘন নীল চোখ।

ইয়ান’র একের পর এক কাঠি জ্বালাচ্ছে। কাঠির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছে। দাড়িতে হাত বুলাচ্ছে। নিজের মনে বিড়বিড় করছে। তার সামনে বিশ্বের অতি ক্ষমতাধর একজন বসে আছে। এই ঘটনা তাকে তেমন আলোড়িত করছে বলে মনে হচ্ছে না।

হিটলার দেয়াশলাইয়ের কাঠির আগুনে জার্মান বাহিনীর ভবিষ্যৎ দেখতে চাচ্ছেন। ভবিষ্যৎ দেখা খেলা তার পছন্দের। টেরাট কার্ড দিয়ে ভবিষ্যৎ বলার কিছু পদ্ধতি তিনি নিজেও জানেন। কার্ড দেখে যুদ্ধে জার্মানির ভবিষ্যৎ বলার খেলা মাঝেমধ্যে তিনি তার বান্ধবী ইভা ব্ৰাউনের সঙ্গে খেলেন।

হিটলার বললেন, কী দেখলে?

জিপসি শিতল গলায় বলল, বরফ পড়ছে।

শীতকালে বরফ পড়বে। শীতকালে আকাশ থেকে কমলা বৃষ্টি হবে না। ভালো করে দেখে বলো, রাশিয়াতে আমার বাহিনীর অবস্থা কী?

বরফ পড়ছে। জার্মানবাহিনী বরফের কাছে পরাজিত।

হিটলার বললেন, বরফ শুধু জার্মানবাহিনীর ওপর পড়ছে না। রুশদের ওপরও পড়ছে।

জার্মানবাহিনী বরফের হাতে পরাজিত। রুশবাহিনী না, রুশরা বরফের সঙ্গে পরিচিত।

তোমার দেশ কোথায়?

আমি জিপসি। আমার কোনো দেশ নেই।

জন্মেছ। কোথায়?

মস্কোর কাছে, ভলগা নদীর তীরে।

জার্মানবাহিনী রুশদের কঠিন শিক্ষা দিয়েছে, এই গল্প তুমি জানো। জার্মানদের প্রতি ক্রোধের কারণে জার্মানবাহিনী সম্পর্কে এধরনের কথা বলছে।

আমি জিপসি, কারো প্রতি আমার কোনো ক্ৰোধ নেই।

হিটলার উঠে দাঁড়ালেন। জিপসি তখনো বসে। এখনো তার হাতে দেয়াশলাইয়ের কাঠি। হিটলার নির্দেশ দিলেন ইহুদিদের সঙ্গে জিপসিদেরও যেন নির্মূল করা হয়। আধুনিক জার্মানি হবে ইহুদি এবং জিপসিমুক্ত।

 

লেনিনগ্রাদ অবরুদ্ধ। জার্মানরা এই শহরকে একটা মৃত শহরে পরিণত করেছে। চব্বিশ ঘণ্টাই কামানের গোলাবর্ষণ হচ্ছে। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী রেলস্টেশন তিখভিন্ন জার্মানদের দখলে। বোমা এবং কামানের আঘাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি মোটামুটি ধ্বংস। শহরে খাদ্য নেই বললেই হয়। কলকারখানার শ্রমিকরা গ্রিজ, কারখানার তেল খাচ্ছে। কাঠের গুড়ি দিয়ে রুটি তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। ক্ষুধার্তা মানুষজন কুকুর-বিড়াল সিদ্ধ করে খাচ্ছে। নরমাংস খাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

অবিরাম তুষারপাত হচ্ছে। বসতবাড়িতে বিদ্যুৎ দেয়া হচ্ছে না। সামান্য বিদ্যুৎ যা তৈরি হচ্ছে চলে যাচ্ছে কলকারখানাতে। শীতে জমে যাওয়া মানুষজন ঘরের কাপড়চোপড়, আসবাবপত্র পুড়িয়ে চেষ্টা করছে শরীর উষ্ণ রাখতে। শহরে শিশুখাদ্য শেষ। কর্তৃপক্ষ প্রতিটি শিশুর জন্যে সপ্তাহে ছয়গ্রাম চিনি বরাদ্দ করেছেন। সেই চিনির জন্যে দীর্ঘ লাইন।

জার্মানরা শহরটিতে কোনো খাদ্য আসতে দিচ্ছে না। সব পথ বন্ধ। একটা পথ অবশ্যি খোলা আছে। লাগোদা হ্রদের ওপর দিয়ে ট্রাকে করে খাদ্য নিয়ে আসা। ট্রাক আসার জন্যে হ্রদের পানি জমে কম করে হলেও দু’শ মিলিমিটার পুরো হতে হবে। তার জন্যে আরো তুষারপাত প্রয়োজন। বন্দি লেনিনগ্রাদবাসী শীতে কাঁপতে কাঁপিতে প্রার্থনা করছে আরো দুর্দান্ত শীতের। তুষারপাতের। যেন লাগোদা হ্রদ, জমে লোহার মতো শক্ত হয়ে যায়।

২৬ নভেম্বর (১৯৪২) আটটা ট্রাক লেনিনগ্রাদ থেকে বের হয় এবং লাগোদা হ্রদ পার হয়ে খাদ্য নিয়ে শহরে ফিরে আসে। খাদ্যের পরিমাণ ৩৩ টন।

একই সঙ্গে জাবেরি নামের শহরের সঙ্গে লেনিনগ্রাদের যোগাযোগের জন্যে রাস্তা বানানো হয়। জাবেরি থেকে খাদ্য আনার ব্যবস্থা। মাত্র ২৭ দিনে তৈরি হয় দুশ মাইল রাস্তা। এই সড়কই বিখ্যাত ‘রোড টু লাইফ’। ডিসেম্বরের ছয় তারিখ তিনশ’ ট্রাক খাদ্য নিয়ে লেনিনগ্রাদের দিকে যাত্রা করে।

রুশরা জার্মানদের হাত থেকে দখল করে নেয় রেলস্টেশন তিখাভিন। রুশবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে জার্মানির ওপর।

জার্মানদের পরাজয়ের স্বাদগ্রহণের পালা শুরু হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *