আলাউদ্দিন আল আজাদ
সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা শিল্প-সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। কবি, কথাশিল্পী, মননশীল লেখক ও শিল্পীদের সমসাময়িক রাজনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনুপ্রাণিত এবং প্রভাবিত করবেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শিল্প-সাহিত্য আর আগের মতো রইল না। মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পূর্ব বাংলার মুসলমান লেখকদের রচনার বিষয়বস্তুতে নতুন উপাদান যোগ হয় : ইসলাম ও মুসলমান। বিশেষ করে যারা পাকিস্তানবাদী ছিলেন, তাঁদের রচনায়। কিন্তু পাকিস্তানের অনুগত নাগরিক হয়েও নতুন প্রজন্মের অনেকেই পাকিস্তানবাদী ছিলেন না। তাঁরা কেউ ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, কেউ ছিলেন বামপন্থী ধারায় জীবনের জন্য শিল্প’ নীতিতে।
পাকিস্তান ও ভারতের রাজনৈতিক আদর্শ ছিল ভিন্ন; কিন্তু দুই নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের একটি ক্ষেত্রে অভিন্নতা ছিল, তা হলো, দুই রাষ্ট্রই কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের এক নম্বর শত্রু ঘোষণা করে। স্বাধীনতার অল্পকাল পরই ভারত সরকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করে। বহু কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীকে জেলে ঢোকানো হয়। অনেকে আত্মগোপনে চলে যান। কেউবা পূর্ব পাকিস্তানে, কেউবা পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান। পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলেও ব্যাপক হারে কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করে। ১৯৪৭-পরবর্তী কয়েকটি বছর পাকিস্তান ও ভারতে কমিউনিস্টদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। দুই দেশের কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বা অন্যভাবে বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।
নতুন প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে তরুণ লেখকদের মধ্যে আলাউদ্দিন আল আজাদ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তখন তিনি কলেজের ছাত্র। লেখালেখি করে কিছুটা পরিচিতিও পেয়েছেন। ‘৪৭-এর পর কলকাতা থেকে ঢাকায় পালিয়ে এসেছিলেন চল্লিশের দশকের কবি ও কথাশিল্পী গোলাম কুদ্দুস। তিনি ছিলেন শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহদের বন্ধু। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। চুয়াডাঙ্গার অধিবাসী, কিন্তু ‘৪৭-এর পর ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে কলকাতায় থেকে যান। আশির দশকে আমি কলকাতায় তাঁর আহিরিপুকুর লেনের বাসায় তাঁর একটি সাক্ষাঙ্কার গ্রহণ করি। তিনি বলেন, ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি ঢাকায় এসে আত্মগোপন করে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেন। ঢাকার বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা নেপাল নাগ তাকে ওয়ারী এলাকায় এক হিন্দুর পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। নাম পরিবর্তন করে থাকলেও গোয়েন্দা পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেটা টের পেয়ে গোলাম কুদ্দুস পুরানা পল্টনে এক পরিচিত লোকের বাড়িতে এসে ওঠেন। সারা দিন তিনি ঘরে থাকতেন, রাতে বেরিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতেন।
১৯৪৮ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কিছুদিন পুরানা পল্টনে এক বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। রেডিও পাকিস্তান ঢাকার সহকারী বার্তা সম্পাদক ছিলেন। তাঁর এক অবাঙালি বাবুর্চি ছিল। তাকে নিয়ে একদিন ঠাঠারিবাজারে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক বাড়ির জানালায় গোলাম কুদ্দুসকে দেখতে পান। তখন দাঁড়িয়ে কোনো কথা না বলে, না দেখার ভান করে তিনি বাজার করে আসেন। বাসায় এসে ওয়ালীউল্লাহ তাঁর কাজের লোকটির হাতে একটি চিরকুট দিয়ে গোলাম কুদুসের কাছে পাঠান। চিরকুটে লেখা ছিল :
‘আপনি আমার চাকরের সঙ্গে এক্ষুনি আমার বাসায় চলে আসতে পারেন। খুব নিরাপদ আস্তানা। যতদিন খুশি থাকতে পারেন। আমি অবিবাহিত।’
অনিশ্চিত পরনির্ভর জীবনে বন্ধুর এই আহ্বান বিধাতার আশীর্বাদের মতো। মুহূর্ত দেরি না করে গোলাম কুদ্দুস ওয়ালীউল্লাহর বাসায় চলে আসেন। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর ওয়ালীউল্লাহর বন্ধুবান্ধবরা আসতেন। আড্ডা চলত অনেক রাত অবধি। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেই ছিলেন তার বন্ধু। একদিন আসেন পুলিশের একজন ডিআইজি। পেশাগত দক্ষতা থেকে তিনি বুঝতে পারেন গোলাম কুদ্দুস একজন আত্মগোপনকারী বাম নেতা। তাঁর সম্পর্কে তিনি ওয়ালীউল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন। তাঁদের কথাবার্তা কানে যেতেই গোলাম কুদ্দুস পরদিনই অন্য জায়গায় চলে যান।
গোলাম কুদ্দুস এ সম্পর্কে আমাকে যা জানান, তা এ রকম : ‘পুরান ঢাকায় কারও বাড়িতে এক রাত রইলাম। তার পরদিন পার্টির এক কর্মী আমাকে নিয়ে যায় ঢাকার পাশেই মালিবাগ নামক এক শহরতলির গ্রামে। সেই মালিবাগ গ্রামে গাছপালা-জঙ্গল ছিল প্রচুর। সেখানে এক টিনের ঘরে থাকতেন এক তরুণ লেখক। নিজেই রান্না করে খেতেন এবং প্রচুর পড়াশোনা করতেন। আমি যাওয়ায় তিনি পেলেন একজন সঙ্গী। সেই তরুণের নাম আলাউদ্দিন আল আজাদ। কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় কর্মী।’
গোলাম কুদ্দুস জানান, মালিবাগ থেকে হেঁটে আজাদ শহরে ঢাকা কলেজে যেতেন। (বর্তমান ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস নয়) বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। বিভিন্ন মানুষ থেকে বই ধার নিয়ে আসতেন। বাংলা, ইংরেজি গল্প-কবিতার বই প্রচুর পড়তেন। মার্ক্সবাদী সাহিত্য নিয়ে আমার সঙ্গে তাঁর আলোচনা হতো।
আমি গোলাম কুদ্দুসকে বললাম, আপনি যে মালিবাগ গ্রামের কথা বলছেন এখন আর তা কোনো গ্রাম নয়, শহরতলিও নয়, অতি ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা মহানগরীর একটি এলাকা।
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে গোলাম কুদুসের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল কবি ও কথাশিল্পী হিসেবে। বাম রাজনীতিতে বেশি জড়িয়ে পড়ায় তাঁর লেখালেখির ক্ষতি হয়। তাঁর দুটি কবিতার বই প্রশংসিত হয়েছিল। একটি বিদীর্ণ এবং অপরটি ইলা মিত্র। নাচোল আন্দোলনের ইলা মিত্রকে নিয়ে কবিতা লিখে ডান-বাম সব শ্রেণির পাঠকেরই প্রশংসা অর্জন করেন। তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে বন্দী, মরিয়াম, একি শূঙ্গে প্রভৃতি রয়েছে। ঢাকায় থাকলে এবং সাহিত্যচর্চা ভালোভাবে চালিয়ে গেলে গোলাম কুদ্দুস বাংলা সাহিত্যে একটি স্থান করতে পারতেন বলে মনে করতেন তাঁর বন্ধু শওকত ওসমান ও কবি আবুল হোসেন। গোলাম কুদ্দুস জানান, আলাউদ্দিন আল আজাদের কিছু ছোটোগল্প কলকাতার লেখকসমাজেও প্রশংসিত হয়েছিল। তাঁর গল্পের সংকলন জেগে আছির কলকাতার পত্রপত্রিকায় প্রশংসামূলক সমালোচনা বেরিয়েছিল। কিছুদিন পরে বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় তাঁর কবিতাও প্রকাশিত হয়। পঞ্চাশের শুরুতেই আজাদ একজন প্রতিষ্ঠিত কবি ও কথাশিল্পী।
আলাউদ্দিন আল আজাদ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। প্রস্তুতি নিয়েই তিনি সাহিত্যসাধনা করেছেন। প্রথম দিকে তিনি কবিতা ও গল্পই বেশি লিখতেন। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই প্রকাশিত হয় আজাদের দুটি ছোটগল্পের। বই : জেগে আছি এবং ধানকন্যা। এই দুই সংকলনের গল্পগুলো তাঁর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে রচিত। সুতরাং, অপরিণত হাতের ছাপ থাকাই স্বাভাবিক; কিন্তু শিল্পকর্ম হিসেবে অবহেলা করার মতোও নয়। তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স এবং ‘৫৪-তে মাস্টার্স করেন। তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং যথার্থ অর্থে একজন ভাষাসংগ্রামী।
একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তপাতের পর পরই ভাষাসংগ্রামীরা রাতারাতি একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। কিন্তু সরকার চায়নি কোনো স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করা হোক ঘটনাস্থলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা শহীদ মিনারটি ভেঙে দেন। প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা দেখে অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র আজাদ লিখেছিলেন। একটি প্রতিবাদী কবিতা :
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ভয় কি বন্ধু,
আমরা এখনো চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো। যে ভিত কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরার মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটিকা ধূলায় চূর্ণ যে-পদপ্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক
ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
চার কোটি পরিবার।
[একুশে ফেব্রুয়ারি]
সংঘবদ্ধ সাহিত্যচর্চায় পঞ্চাশের প্রথম দিকে আজাদ খুবই সক্রিয় ছিলেন। সাহিত্যের সভা-সমাবেশের আয়োজন করতেন এবং সাহিত্য সম্মেলনগুলোতে অংশগ্রহণ করতেন। ওই সময়ে বাম ধারার লেখক হিসেবে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের প্রত্যাখ্যান করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করতে যাঁরা তখন ভূমিকা রাখেন, আজাদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। বিশেষ করে তাঁর পরিচিতি ছিল সমাজ সজ্ঞান লেখক হিসেবে। জেগে আছি এবং ধানকন্যার গল্পগুলোতে সমাজের হতদরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের চিত্রই তিনি এঁকেছেন। ‘কয়েকটি কমলা লেবু’, ‘কয়লা কুড়ানোর দল’, ‘রঙিলা’, ‘সুবসা’, ‘শিষ ফোঁটার গান’ প্রভৃতি গল্পে সর্বহারা মানুষের দুঃখ-বেদনার কথাই বলা হয়েছে। পাকিস্তানি জোশের জ্বরে আক্রান্ত সমাজে এই সমাজসচেতন ধারার রচনার মূল্য ছিল অসামান্য।
আজাদ ছিলেন বহুমুখী সৃষ্টিশীল প্রতিভা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ প্রভৃতি তিনি দুহাতে লিখবেন। তার প্রথম উপন্যাস তেইশ নম্বর তৈলচিত্র প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। পরবর্তী তিন বছরে প্রকাশিত হয় তাঁর তিনটি উপন্যাস : কর্ণফুলী, শীতের শেষ রাত বসন্তের প্রথম দিন এবং ক্ষুধা ও আশা। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও কবিতার বই বের হয় একটু দেরিতে। প্রথম কাব্য সংকলন মানচিত্র ১৯৬১-তে এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ ১৯৬২-তে। পঞ্চাশের দশকে এবং ষাটের শুরুতে প্রকাশিত তার দুটি নাটক– মরক্কোর জাদুকর এবং ইহুদির মেয়ে প্রশংসিত হয়েছিল। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ শিল্পীর সাধনা তাঁর মননশীলতার পরিচয় বহন করে। ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত রচিত আজাদের সাহিত্য সম্ভারের পরিমাণ প্রচুর।
শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ এবং তাদের বন্ধুরা পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের সাহিত্যের যে ভিত্তি স্থাপন করেন, তার ওপরই নির্মিত হয়েছে আধুনিক বাংলাদেশের সাহিত্যের সৌধ।
আশির দশকের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ কবি হতে গিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যজগতকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেন। এক দলকে তার পাশে নিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা দেন, অন্যদের করেন নানাভাবে অসম্মান। আজাদ শিক্ষা। মন্ত্রনালয়ে যুগ্মসচিব পদমর্যাদায় উপদেষ্টা বা এ ধরনের কোনো পদে ছিলেন। সুতারাং সরকারি পক্ষে তাঁর না থেকে উপায় ছিল না। তার ফলে তিনি তাঁর প্রথম দিকের বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাঁর সেই বন্ধুরাও ক্ষুদ্রতামুক্ত ছিলেন না।