পরদিন বেলা প্রায় একটা।
অহল্যা ডোবায় গেছে বাসন মাজতে। মহিম নানান রকম গাছের আটা ও চুর্ণ সংমিশ্রণে মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ার নতুন মশলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
এমন সময় জমিদারের কয়েকজন পাইক, আদালতের নাজির, পেয়াদা এসে হাজির হল। পেছনে সান্যাল বোধ হয়, দখলদারের প্রতিনিধি হিসাবে এসেছে।
পেয়াদা হাঁকল, মহিম মণ্ডল, ঈশ্বর ভরত মণ্ডলের বউ অহল্যা মণ্ডল বাড়িতে আছে?
মহিম উঠোনে নেমে এল। বলল, কী বলছেন?
নাজির বলল, তুমি ভরত মণ্ডলের ভাই মহিম মণ্ডল?
হ্যাঁ।
নোটিশ পেয়েছিলে তুমি গতকাল রাত্রের মধ্যে ভিটে ঘর সব খালাস করে দেওয়ার?
না তো!
পেয়াদা খিঁচিয়ে উঠল, কোথায় ছিলা বাবা। বড় ভাই জীবনভর মামলা করে মল, এ-খবরটা রাখো না?
নাজির গম্ভীর গলায় বলল, দশ মিনিট সময় দেওয়া গেল। যা পারো, খালাস করো।
ডোবার ধার থেকে অহল্যা ছুটে এসে ঘোমটার আড়াল থেকে বলল, ঘরের মানুষ বলছিল, তিন মাস সময় আছে। সে সময় তো হয় নাই?
সান্যাল তাকাল নাজিরের দিকে, নাজির তাকাল পেয়াদার দিকে। পেয়াদা হেসে উঠল হাতের কাগজগুলো অহল্যাকে দেখিয়ে, তোমার মানুষ মরবার সময় কী বলছিল তা জানি না আর আদালতের কাগজ তোমার বাওড়ঘাটের মেয়েমানুষের ঘোট পাঁচালীও নয়। দুই মাস বাইশ দিন গত কাল পূর্ণ হয়ে গেছে। এই হল আদালতের রায়।
সান্যাল বলল, যা করতে হয় করেন নাজির মশাই। বলে সে পেয়াদাকে প্রথম দেখাল মহিমের ঘর।
পেয়াদা পাইকদের নিয়ে মহিমের ঘরের দাওয়ায় উঠে বলল, খালাস করো এ ঘর।
যেমনি বলা, তেমনি পাইকদের সঙ্গে পেয়াদা ও ঘর থেকে সব ছুড়ে, ছুড়ে বাইরে ফেলতে শুরু করল।
মহিমের প্রাণ, মহিমের রক্ত দিয়ে গড়া সব মূর্তি উঠোনে এসে পড়তে লাগল। বিচূর্ণ হতে লাগল সব।
প্রথমটা মহিম হতভম্ব হয়ে রইল কিছুক্ষণ। যেন চক্ষের নিমেষে কী ঘটে গেল। পরমুহূর্তেই আকাশফাটানো চিৎকার করে সে ছুটে গেল ঘরের দিকে। কিন্তু অহল্যা ছুটে এসে মহিমকে দুই হাতে ধরে টেনে নিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। বলল, ঠাণ্ডা হও মহী। ওরা এখন শোধ তুলছে, ওরা যে হার মানছে তোমার কাছে। জিততে পারে নাই।
কুঁজো কানাইয়ের অর্ধসমাপ্ত মূর্তির গলা ভেঙে গেছে, হরেরামের মুখ চূর্ণবিচূর্ণ, পাগলা ঠাকুরের মূর্তি, শিবসতী, বুদ্ধদেব, কিছুই ভাঙতে বাদ গেল না। পুরনো দিনের সব কাজ, ভাঙাচোরা অবস্থায় উঠোনে তূপীকৃত হয়ে উঠল। অহল্যার মাটির শিশু টুকরো টুকরো হল। ভূমিকম্পে উৎক্ষিপ্ত বিশাল মাটির চাঙরের মতো অখিল আর তার মোষের মূর্তি আছড়ে পড়ে খান খান হয়ে গেল।
যারা দেখতে এসে ভিড় করেছে তারা ড়ুকরে উঠল। অহল্যা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইল। তার হাতে ধরা মহিম চোয়াল শক্ত করে প্রতিটি মূর্তিকে ধ্বংস হতে দেখল, রুদ্ধশ্বাস, অপলক কঠিন দৃষ্টি, যেন পাথর হয়েছে।
হরেরামের বাউরি বউয়ের কান্না শোনা গেল। সে কান্নায় নয়নপুরের বাতাস হল বাউরি। আকাশে মেঘ ভেসে গেল হরেরামের বীভৎস মুখের আকৃতি নিয়ে। বাঁশঝাড়ের বাউরি হাওয়া তেপান্তর দিয়ে খাল বেয়ে নদী ভেঙে ছুটে গেল দিগদিগন্তে।
ধ্বংসের স্তূপ-মাঝে ঝাপসা হয়ে গেল মহিমের চোখে। তার চোখে ভেসে উঠল কুঁজো কানাইয়ের মুখ। কালুমালার সোন্দরী মেইয়ের মুখ দেখতে গিয়ে যে অপঘাতে মরেছে। তার চোখে ভাসল অখিলের সেই কান্নার কথা, মৃত মোষের নিষ্পলক চোখ, না দেখা ভাদ্রবউয়ের অনুরাগ ভরা মুখ, হরেরামের ভ্রুকুটি, বউয়ের বিয়োনো মরা ছেলে। তার চোখে ফুটে উঠল গোবিন্দর মন্ত্রগুরু, তার প্রাণবন্ধু পাগলাঠাকুরের উদ্দীপ্ত মুখ, দেশে বিদেশে আবাদে জঙ্গলে যাকে খেয়ে না খেয়ে শত্রুর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়। সে দেখল নয়নপুরের খালের শ্যাম শিশু হাসতে হাসতে নয়নপুরের তেপান্তর ভেঙে ছুটে আসছে। হরেরামের বউয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে, অহল্যার কোল জুড়ে এসে বসেছে। আহা, সংসারে যেন হাসি ফোটাবার মানুষ আসছে!চোখের জল সে কিছুতেই রোধ করতে পারল না।
পীতাম্বর আর ভজন এসে অহল্যা মহিমকে ধরে ডাকল, চল, বেলা যায়। সারা নয়নপুরের মানুষ এসেছে এ ধ্বংসলীলা দেখতে। গোবিন্দ এসে দাঁড়িয়েছে মহিমের হাত ধরে। বনলতা এসেছে। পাশে।
মহিমের শিল্প-সাধনার অতীত দিন আর ভরতের প্রাণভরা ব্যর্থ আকাঙ্ক্ষার রিক্ত সংসারের ধ্বংসস্তুপের উপর দিয়ে তারা সকলে বেরিয়ে এল।
হরেরামের বাউরি বউয়ের কান্না বাতাসে ভর করে ছড়িয়ে পড়ছে সারা নয়নপুরে। সারবন্দি মেঘের দল ছুটে চলেছে উত্তরদিকে। হেলে পড়া সূর্যের আলো পড়ে সেই মেঘের ধারে ধারে যেন আদিম কালের পাথরের কিম্ভুতকিমাকার অস্ত্রের মতো দেখাচ্ছে।
অহল্যা পেছিয়ে পড়েছে। ভজন-পীতাম্বরের সঙ্গে চলেছে মহিম। তাদের পেছনে চলেছে অনেক মানুষ, যেন ক্রোধে বেদনায় আত্মহারা মূক মিছিল একটা।
সকলের অলক্ষ্যে জমিদারবাড়ির দোতলার একটি ছোট জানলা খুলে গেল। দেখা গেল উমার মুখ। তার মুখে হাসি নেই, বেদনা নেই, রাগ নেই, যেন ত্রাস রয়েছে। কেন, তা সে-ই জানে।
পাগলির সেই হাসি অন্তঃপুরের অলিন্দে অলিন্দে খিলানে প্রাচীরে ঘা খেয়ে আবার হারিয়ে যাচ্ছে ইমারতের অন্ধ গুহায়, তলিয়ে যাচ্ছে সন্তান-সন্ধানে।
খানিকদূর চলে ভজন আর পীতাম্বর হঠাৎ দাঁড়াল। বলল, অহল্যা যে পেছিয়ে পড়ল।
মহিম দেখল, পথের মাঝে ভিটের দিকে ফিরে অহল্যা দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, মুই নিয়া আসি।
মহিম এসে দেখল, পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে অহল্যা দাঁড়িয়ে আছে ছেড়ে আসা ভিটা, উঠানের ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকিয়ে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে, বিশাল বলিষ্ঠ বুক সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো দুলে উঠছে। চোখ ধক ধক করে জ্বলছে। আগুন ভরা চোখ। ঘোমটা ভেঙে পড়েছে ঘাড়ের কাছে, অবিন্যস্ত চুলের গোছা এসে পড়েছে মুখে। ঠোঁট কঠিন রেখায়
বঙ্কিম।
তারপরই আচমকা মনে পড়ল ভরতকে। জীবন্তে, মরণেও যার জন্য হৃদয় তার এতখানি অনুশোচনা বুঝি হয়নি, এখন হল যেন তার সব চিহ্ন আজ ছেড়ে যাবার বেলায়।
মহিমের চোখে আলো ভরে উঠল। আবেগকম্পিত গলায় বলল, বউদি, তোমার মূর্তিখানি মুই গড়র, এই মুখ, এই চোখ মুই গড়ব। নতুন প্রস্থে সেই হইবে মোর প্রথম কাজ। সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অহল্যা মহিমের দিকে তাকাল। ভাবে আবেগে গভীর চোখ মহিমের। অহল্যার বুক ঠেলে হঠাৎ কান্না এল। ফিস ফিস করে বলল, চেরকাল মুই পাথরের অহল্যা হইয়ে থাকব?
মহিম বলল, না, তাতে মুই রান পিতিষ্ঠা করব!
চকিতে মুখ ফিরিয়ে অহল্যা বলল, নেও, সে হইবে অখন। বলে ঘোমটা টেনে দিল। যেন ভয় পেয়েছে। পীতাম্বর হাঁক দিল একটা। মহিম এগিয়ে চলল।
কিন্তু অহল্যা কান্না কিছুতেই রোধ করতে পারল না। মুখে আঁচল চেপে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। এ গোপন কান্নার বুঝি শেষ নেই।
আহ, বাঁধা বীণার তারে বেসুর কী গভীর!