২৫শে মার্চ – ৬

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা
২৫শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : রাত প্রায় ৯টা

ফুলার রোডের মুখে রাস্তার ঠিক পাশে নিজের ওপেল রেকর্ড গাড়িটাকে দাঁড় করাল মনিরুজ্জামান। দেশের অবস্থা যে প্রচণ্ড রকম খারাপ তা চারপাশের রাস্তাঘাট দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রমনা থানা থেকে গাড়ি চালিয়ে ফুলার রোড পর্যন্ত আসতে রাস্তাঘাটে মানুষজন প্রায় দেখাই যায়নি। চারপাশ কেমন যেন চুপচাপ আর থমথমে। তবে তার চেয়ে বেশি থমথমে হয়ে আছে তার নিজের চেহারা। পাশে বসা আবু তার চেহারার দিকে তাকিয়ে ভয়ই পেল। একটাও কথা না বলে মনিরুজ্জামান বের করল হফিজের প্যাকেটটা। প্যাকেটের ভেতর থেকে ছবিটা বের করে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগল। ছবিটা দেখা শেষ করে বের করল কয়েনটা।

এই ছবি এবং লেখাগুলোর কারণে গত চার ঘণ্টা তাদেরকে রমনা থানায় বসে থাকতে হয়েছে। হাসপাতালে হাফিজের রেখে যাওয়া প্যাকেটটা দেখার পর মনিরুজ্জামান যারপরনাই অবাক হয়। কারণ এই জিনিসগুলো তার কাছে পুরোপুরি অপরিচিত নয়। এইগুলোর সন্ধানেই তারা ছিল। কিন্তু হাফিজ কখন এগুলো হাতে পেল এবং সে কেনই বা সুইসাইড করল কিছুই তার কাছে পরিষ্কার নয়। ডাক্তারের কাছ থেকে খামটা নেওয়ার পর মনিরুজ্জামান সেটা দেখছিল। হঠাৎ কয়েকজনের হাঁকডাক শুনে তারা চমকে ওঠে। কয়েকজন পুলিশ তাদেরকে জেরা করতে শুরু করে। প্রথমেই ডাক্তারকে তারা চার্জ করতে থাকে মৃতদেহ কেন দেখানো হলো। তারপর তারা মনিরুজ্জামানকে একের পর এক প্রশ্ন শুরু করে। মৃতের সাথে তার সম্পর্ক কী? কেন মৃত ব্যক্তি তার নামে নোট লিখে গেছে। এইসব হাবিজাবি নানা ধরনের উদ্ভট সব প্রশ্ন। অবশেষে তাদের স্বস্তি না হওয়ায় তারা দুজনকে তাদের সাথে রমনা থানায় যেতে বলে।

থানায় নিয়ে যাওয়ার পর তাদেরকে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হয় বেঞ্চে। থানায় এমনিতেই প্রচুর ব্যস্ততা। তাদেরকে দেখার মতো সময় কারোরই নেই বলতে গেলে। বারবার জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর না পাওয়ায় এক পর্যায়ে মনিরুজ্জামান খেপে ওঠে। সে ডিউটি অফিসারের সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়। ঝগড়া বাড়তে বাড়তে যখন বাজে অবস্থা তখন থানার ওসি চলে আসে। সে মনিরুজ্জামান আর আবুকে তার রুমে ডেকে নেয়। বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চায়। এমন সময় পাঁচটার দিকে তার কাছে একটা ফোন আসে। ওসি মনোযোগ দিয়ে ওপর প্রান্তের কথা শোনে এবং কথা শেষ হওয়ার পর ওদেরকে জানায় তারা এবার যেতে পারে।

ব্যাপারটা তার কাছে খুবই অবাক লেগেছে। কারণ ওদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল তাদেরকে যথেষ্ট হয়রান করার তালে আছে কিন্তু একটা ফোন কলের সাথে সাথেই ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা তার কাছে মোটেও স্বাভাবিক মনে হয়নি। মনিরুজ্জামান মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখছে। তার মনের ভেতরে একটাই প্রশ্ন, হাফিজ সুইসাইড করল কেন?

“স্যার আপনার কি মনে হয় হাফিজ স্যার সুইসাইড করেছে?”

“হুমমম, কী বললি?” মনিরুজ্জামান আবুর দিকে ফিরে জানতে চাইল। “বলছিলাম, স্যার আপনার কি মনে হয় হাফিজ স্যার আসলেই সুইসাইড করেছে?”

মনিরুজ্জামান কোনো উত্তর দিল না। সে এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। “কবির, কতক্ষণে আসবে রে?”

“স্যার আমি তো ওর হলে ফোন করে বলে দিছি এই সময়ে আমরা ফুলার রোডের মুখে থাকব। মনে হয় চলে আসবে,” বলে আবু একটু বিরতি নিল। “স্যার বললেন, হাফিজ স্যার কি আসলেই সুইসাইড করেছে?”

“তোর কী মনে হয়?”

“স্যার আমার তো মনে হয় না তার মতো একজন মানুষ এইরকম করতে পারে।”

“তার মানে তুই কি বলতে চাচ্ছিস হাফিজকে খুন করা হয়েছে?” বলে মনিরুজ্জামান একবার চারপাশে দেখে নিল। কেন জানি একটা আইডিয়া তার মাথায় পাক দিয়ে উঠছে। কেন যেন তার মনে হচ্ছে তাদেরকে থানা থেকে এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া হয়নি। তাদেরকে ফলো করা হচ্ছে। যদি তা করা হয়ে থাকে তবে তার অনুমান সত্যি বলে ধরে নিতে হবে এবং…

“স্যার, ওই তো কবির চলে আসছে।”

কবির, মনিরুজ্জামানের আরেক ছাত্র। সেও আবুর মতোই মনিরুজ্জামানকে মানে এবং তার প্রায় সব আদেশ-নির্দেশ মেনে চলে। কবির এসে গাড়ির জানালার কাচে টোকা দিতে মনিরুজ্জামান তাকে ভেতরে ঢুকতে বলল।

কবির ভেতরে ঢুকেই তড়বড় করে কথা বলা শুরু করল, “স্যার খবর শুনেছেন?”

“কী খবর?”

“মিটিং তো বাতিল হয়া গেছে।”

“মানে,” মনিরুজ্জামান আর আবু দুজনেই কবিরের দিকে ফিরে তাকাল।

“স্যার ইয়াহিয়া সাব তো আচমকা মিটিং বাতিল করে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরা গেছে। এহন কী হবে?”

“আর বঙ্গবন্ধু, তিনি কী বলেছেন,” এই মিটিংটার দিকেই তাকিয়ে ছিল পুরো জাতি। এখন পরিস্থিতি পুরোপুরি অনিশ্চিত। মনিরুজ্জামান গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে দিল। তার মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে। “কখন ঘটেছে রে এই ঘটনা, কবির?”

“এই তো সাড়ে চারটার দিকে ইয়াহিয়া সাব মিটিং বাতিল কইরা দিয়া পাঁচটার দিকে প্লেনে উঠছে। আর বঙ্গবন্ধু এখনও কিছু বলেন নাই। তারা জরুরি মিটিঙে আছেন।”

মনিরুজ্জামানের কাছে মনে হলো, উত্তপ্ত কয়লায় আগুন ধরেছে। থামানোর সাধ্য কারও নেই। গত কিছুদিনের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে খানিকটা আশার বাণী নিয়ে এসেছিল এই মিটিংটা। সেটাও যখন বাতিল হয়ে গেছে তার মানে এখন যুদ্ধ আসন্ন। মনিরুজ্জামান ড্যাশ বোর্ডের ওপর রাখা হাফিজের প্যাকেটটার দিকে তাকাল। ওটার ওজন এখন একশ কেজি মনে হচ্ছে। ওদিকে বাসায় আবার নার্গিসের যখনতখন অবস্থা। যেকোনো সময় তার ডেলিভারি হতে পারে

বুক ভরে বড় করে মনিরুজ্জামান একবার দম নিল। সে দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছে।

“কবির আর আবু তোরা গাড়ি থেকে নাম, তোরা একটা রিকশা নিয়ে সোজা চলে যবি মতিঝিল। ওখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসবি আমার বাসায়। গাড়িটা ঠিক করবি গাজীপুর যাওয়ার জন্য। বুঝেছিস?”

দুজনেই মাথা নাড়ল। “আর যদি গাড়ি না পাই?”

“আমার ধারণা পাবি। প্রয়োজনে বেশি টাকার কথা বলবি। আর যদি বাইচান্স না পাস তাহলে ওখান থেকে চলে যাবি ধোলাইখাল। ওখানে কুতুব নামে এক ব্যাপারী আছে। তাকে খুঁজে বের করে আমার নাম বলে দুই গ্যালন পেট্রোল নিয়ে আসবি। এই রাখ টাকা।”

মনিরুজ্জামান ওদেরকে টাকা দিয়ে বিদায় করে গাড়ি নিয়ে রওনা দিল নিজের কোয়ার্টারের দিকে।

বাসার দরজাটা ধাম করে খুলে গেল মনিরুজ্জামানের জোর ধাক্কায়। দরজাটা খোলা দেখে তার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে। ভেতরে ঢুকে দেখে নার্গিস একটা ইজিচেয়ারে বসে আসন্ন বাচ্চার জন্য কাঁথা সেলাই করছে। মনিরুজ্জামান এগিয়ে নার্গিসের সামনে বসে পড়ল। সহজ-সরল নার্গিসকে দেখে তার মায়াই লাগল। তার এই ব্যস্ত জীবনে সে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় এই মেয়েটাকে। বিয়ে হওয়ার পর থেকে কখনোই মনে হয় এই মানুষটাকে সে ঠিকমতো সময় দেয়নি। বিশেষ করে নার্গিস প্রেগনেন্ট হওয়ার পর থেকে তার ব্যস্ততা যেন আরও বেড়ে গেছে।

“এখন কেমন লাগছে?” মনিরুজ্জামান নার্গিসের পেটে হাত রেখে জানতে চাইল। আজ সকালে সে যখন বের হচ্ছিল তখন নার্গিস বলছিল তার শরীর বেশ খারাপ লাগছে। তবুও চাচির কাছে রেখেই তাকে বের হয়ে যেতে হয়েছিল। মনুিরজ্জামানের বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। আত্মীয় বলতে দূর সম্পর্কের এক চাচা আর চাচি আছেন। নার্গিস প্রেগনেন্ট হওয়ার পর থেকে এই চাচিকেই সে নিয়ে এসেছে গাজীপুর থেকে, নার্গিসের দেখাশোনা করার জন্য।

মনিরুজ্জামানের প্রশ্ন শুনে নার্গিস মৃদু হাসল। হাসলে খুব সুন্দর টোল পড়ে ওর গালে। “এখন ঠিক আছি। তোমাকে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন?”

“নার্গিস তুমি তৈরি হয়ে নাও, বেরোতে হবে।”

 “ওমা, সে কী কোথায়?”

“দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আজ বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়া খানের মিটিং বাতিল হয়ে গেছে। যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আমি চাই না তোমার এই অবস্থায় এখানে থাকো তুমি,” মনিরুজ্জামান হাফিজের মৃত্যুর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল।

“আর তুমি?”

“আমি তো যেকোনো সময় চলে যেতে পারব। আমি আবু আর কবিরকে গাড়ি আনতে পাঠিয়েছি। চাচিকে বলে দিচ্ছি, তুমি তৈরি হয়ে নাও। গাড়ি এলেই তোমরা রওনা দেবে।”

“আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না। আর ওখানে কেউ নেই আমার খারাপ লাগবে।”

“না নার্গিস, আমি বুঝতে পারছি তোমার খারাপ লাগবে ওখানে। কিন্তু তবুও যেতে হবে। আমি কাল সকালেই চলে আসব। আমিও আর এখানে থাকতে চাচ্ছি না। কাল সকালে প্লিজ। এইটুকু কথা রাখো, আমি প্রমিজ করছি কাল সকালে চলে আসব।”

“তাহলে আমি কাল সকালে গেলে সমস্যা কী?”

“নার্গিস, কথা শোনো, আমি অনুরোধ করছি। আজ রাতটা আমার এই ক্যাম্পাসেই থাকতে হবে। বিশেষ একটা কাজ আছে আমার। আজ রাতে সেটা করতে না পারলে আর কখনোই করা সম্ভব হবে না। প্লিজ তুমি তৈরি হয়ে নাও। চাচি চাচি,” বলে মনিরুজ্জামান ডাকতে ডাকতে ভেতরে চলে গেল। “চাচি, আপনি আগে নার্গিসকে তৈরি করুন। ওর যা যা লাগে রেডি করে আপনি নিজেও রেডি হয়ে যান। কিছুক্ষণের ভেতরে গাড়ি চলে আসবে। আপনারা বাড়িতে চলে যাবেন। আর শোনেন আপনি বাড়িতে গিয়ে আজমত চাচাকে বলবেন সবসময় কাছাকাছি থাকতে আর আপনার ছেলে আর ওর বউটাকে বলবেন আপাতত যেন বাড়িতেই থাকে। বুঝেছেন?”

চাচি মাথা নাড়ল। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর এই মহিলাই মনিরুজ্জামানকে মায়ের স্নেহে বড় করেছে। আজ পর্যন্ত কখনোই সে মনিরুজ্জামানের কথার বরখেলাপ করেনি। আজও করবে না।

নার্গিসকে তৈরি হতে দেখে মনিরুজ্জামান বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরাল। এখানে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পাসের একটা অংশ চোখে পড়ে। অন্ধকারের ভেতরে ক্যাম্পাসের দিকে তাকিয়ে তার ভেতরে কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হলো। মনে হচ্ছে চারপাশ থেকে অন্ধকার যেন তাকে ঘিরে ধরছে। দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে সে দরজা খুলল। আবু আর কবির ফিরে এসেছে। ওদের হাতে পেট্রোলের গ্যালোন নেই দেখেই সে বুঝল ওরা গাড়ি পেয়ে গেছে।

“পেয়েছিস?”

“জি, স্যার। একদম বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসবে, তবে টাকা বেশি লাগবে।”

“ঠিক আছে, আগে ব্যাগগুলো গাড়িতে নিয়ে তোল।”

মনিরুজ্জামান নার্গিসকে গাড়িতে তুলে দিল। কেন জানি দুঃখে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। গাড়িতে ওঠার আগে হালকা করে নার্গিসের কপালে একটা চুমো খেল। কে জানে আর দেখা হয় কি না।

“তুমি কাল সকালে চলে এসো কিন্তু,” নার্গিস গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলল।

মনিরুজ্জামান চোখের পানি আটকে রেখে মাথা নাড়ল। গাড়িটা চলে যেতে কিছুক্ষণ সে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। তারপর দ্রুতবেগে রওনা দিল কোয়ার্টারের দিকে। ভেতরে ঢুকে আবু আর কবিরকে ড্রয়িংরুমে বসতে ইশারা করে সে চলে এলো বেডরুমে। আলমারিটা খুলে ওপরের দেরাজের ভেতর থেকে বের করল একটা স্ক্রু ডাইভার। ওটা দিয়ে ঘরের কোণার দিকের একটা ইলেকট্রিক বোর্ড খুলে ফেলল। সাদা রঙের বোর্ডটা খুলে ওটার ভেতর থেকে একটা প্যাকেট বের করল সে। প্যাকেটটার মোড়ক খুলতেই ওটার ভেতর থেকে বের হলো একটা টাকার বান্ডিল আর একটা .৪৫ কোল্ট পিস্তল। এই প্যাকেটটা সে এইরকম একটা পরিস্থিতির জন্যই রেখে দিয়েছিল। টাকার বান্ডিলটা থেকে কিছু টাকা মানিব্যাগে ভরে, বাকিটা রেখে দিল প্যান্টের ভেতরের একটা পকেটে। এরপর পিস্তলটা কোমরে রেখে ড্রয়িংরুমে চলে এলো।

আবু আর কবির বসে আছে। দুজনেরই মুখ হয়ে আছে পাংশু। সম্ভবত আসন্ন অনিশ্চিত পরিস্থিতির কারণে। মনিরুজ্জামান একটা চেয়ার টেনে দুজনের মুখোমুখি বসল।

“আমি আজ রাতে একটা কাজ করতে যাচ্ছি এবং তোদের দুজনের সাহায্য দরকার। আমি জানি এই কারণে হয়তো আমি তোদেরকে ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছি। কিন্তু উপায় নেই। আশা করি তোরা ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *