৩৬
রাজবাড়ি, গাজীপুর
২৬ শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : ভোর ৬টা ৩০ মিনিট
মনিরুজ্জামান ভীষণ আতঙ্কের সাথে অনুভব করল তার হাঁটু কাঁপছে। দুইবার সে মুখ খুলল কিন্তু কথা বের হলো না। আবুরও একই অবস্থা। কিন্তু মনিরুজ্জামানের আগে সে-ই কথা বলে উঠল।
“কবির তুই…?” শব্দগুলো আসলে সে বলল না তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েছে, সবাই চুপ শুধুমাত্র সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটা সামান্য নড়াচড়া করছে।
মনিরুজ্জামান কথা বলার জন্য মুখ খুলল কিন্তু কিছু বলার আগেই তীব্ৰ বিস্ফোরণে মূল দরজাটা উড়ে গেল। সেইসাথে দরজার সামনে জড়ো করে রাখা সবকিছু। সবাই মাথা নিচু করে ফেলল। মনিরুজ্জামান নড়লও না। সে এতটাই হতবাক হয়ে গেছে নড়ার মতো অবস্থাও তার নেই।
বিস্ফোরণের মাত্রা কমার একটু পরেই কর্নেল হাবিব প্রবেশ করল ভাঙা দরজা দিয়ে। তার সাথে মেজর ফয়সল আর তিনজন সৈনিক। মেজর ফয়সল কাছে এসে একটানে মনিরুজ্জামানের হাত থেকে বন্দুকটা নিয়ে নিল। কর্নেল কবিরের কাছে গিয়ে একবার তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “ওয়েল ডান, বয়।“
কবির বাচ্চাটাকে বিছানার ওপরে নামিয়ে রেখে মনিরুজ্জামানের দিকে এগিয়ে এলো। মনিরুজ্জামান এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে। কবির তার কাছে এসে একদম সামনে দাঁড়াল। “কী দেখছেন স্যার, এভাবে? সবাই আপনার মতো বোকা না। অন্তত আমি না। আপনি আমাদেরকে ব্যবহার করেছেন এখনও করছেন। এই গাধাটা,” সে আবুর দিকে দেখাল। “বুঝতে না পারলেও আমি পারি।”
“হ্যাঁ তুই ঠিকই বলেছিস কবির, তুই আমার মতো না।”
কর্নেল তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “মি. জামান এবার বুঝতে পেরেছেন তো কে আমাদেরকে সব তথ্য দিয়েছে? আপনার বন্ধু হাফিজের কাছ থেকে না। আমাদের ইন্টেলিজেন্সের কাছে সবকিছু ফাঁস করেছে কবির। কারণ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মূলনীতিতে বিশ্বাস করে। ও নিজেরটা ভালো বোঝে। এখন বুঝতে পেরেছেন তো কেন আমি সবকিছুর পরও নিশ্চিন্ত ছিলাম? খেলাটা আসলে আপনি লেখেননি,লিখেছিলাম আমি। কারণ আমি জানতাম আপনি যেখানেই যান, আমি সেটা কোনো না কোনোভাবে জানতে পারব। আপনাদেরকে রাজারবাগে ধরে নেওয়ার পর ওকে আমি আবুর কাছ থেকে আলাদা রুমে নিয়ে সব জেনেছি। এখন আপনি আমাদেরকে জানাবেন জিনিসটা কোথায় এবং তারপর আপনি সসম্মানে মৃত্যুর মুখে উপনীত হবেন, অর্থাৎ ইন্তেকাল করবেন। তবে আপনার পরিবারের বাকি লোকজন এবং বাচ্চাটাকে আমি কিছু করব না। আর যদি না বলেন তবে ওরাও সবাই মারা যাবে। এখন সিদ্ধান্ত আপনার।”
মনিরুজ্জামান কিছু বলল না।
“মি. জামান আপনার স্ত্রী তো মারাই গেছে। এখন আপনি বাচ্চাটাকে বাঁচাতে চান না?”
“জিনিসটা ওই কাঠের আলমারির দ্বিতীয় তাকে আছে,” মনিরুজ্জামান খাটের পাশে বিরাট কাঠের আলমারিটা দেখিয়ে বলল।
কর্নেল ইশারা করতেই মেজর আলমারির দিকে রওনা দিল
“ওটার চাবি এই যে,” বলে মনিরুজ্জামান চাবিটা ছুড়ে দিল মেজরের দিকে। সে একদম মাথা নিচু করে আছে।
মেজর ফয়সল আলমারিটা খুলে তাক থেকে পাথরের ঘোড়াটা নিয়ে এলো।
“অসাধারণ,” কর্নেল জিনিসটা হাতে নিতে নিতে বলল। “অবশেষে হাতে পেলাম,” তার চোখ দুটো চকচক করছে। “এটা কীভাবে কী করতে হয়?” সে মনিরুজ্জামানের দিকে ফিরে বলল।
“ওটার মাথাটা চেপে ধরে উলটোদিকে, মানে বাম দিকে মোড়চ দিলে খুলে যাওয়ার কথা।”
কর্নেল জিনিসটা ধরে মোচড় দিল। সবাই হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে আছে। মনিরুজ্জামানের চোখের কোণে কিছু একটা ধরা পড়ল। প্রথমে সামান্য একটু নড়াচড়া। সে খুব সাবধানে কারও মনোযোগ আকর্ষণ না করে সেদিকে মাথাটা ঘোরাচ্ছিল হঠাৎ কর্নেলের তীব্র আর্তনাদ শুনে ঝট করে তার দিকে ফিরে তাকাল।
“নেই, ভেতরে কিছুই নেই,” কর্নেলের কণ্ঠে হাহাকার। “তাহলে কীসের জন্য এত সবকিছু করলাম।”
মনিরুজ্জামান তার দিকে ফিরে তাকাল। কর্নেলের হাতে ঘোড়াটা ওটার মাথাটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ভেতরে দেখা যাচ্ছে একটা গর্ত। ওখানেই ম্যাপটা থাকার কথা একটা চামড়ার পুঁটলিতে। কিন্তু সে জায়গাটা একদম ফাঁকা।
“অবশ্যই আছে স্যার,” কবির ঝট করে এগিয়ে এসে কর্নেলের হাত থেকে জিনিসটা নিয়ে নিল। “অবশ্যই আছে, কারণ তা না হলে এই লোকটা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এত কষ্ট করত না। নিশ্চয়ই এই ব্যাটা সরিয়েছে।”
কর্নেল হাবিব, মেজর ফয়সল আর কবির তিনজনই মনিরুজ্জামানের দিকে আগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনিরুজ্জামান দুই হাত তুলল, “আমি কিছুই জানি না। সবকিছু এই দুজনের চোখের সামনেই ঘটেছে। ওরা জানে,” সে কবির আর আবুর দিকে দেখাল।
কর্নেল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কবিরের দিকে তাকাল।
কবির বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু এখানে আসার পর সে কী করেছে আমি জানি না,” বলে সে ঝট করে এগিয়ে এলো মনিরুজ্জামানের দিকে। মেজর ফয়সলের কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে নিয়ে সেটা চেপে ধরল মনিরুজ্জামের পেটে কবিরের একটা হাত মনিরুজ্জামানের কলারে অপর হাতটা দিয়ে পিস্তলটা চেপে ধরেছে মনিরুজ্জামানের পেটে।
“বল কোথায় ম্যাপটা, হারামির বাচ্চা, বল। তুই জানিস ওটা কোথায়?” কবিরকে দেখে মনে হচ্ছে সে হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। মনিরুজ্জামান হাসতে লাগল।
“কবির, থামো,” কর্নেল চিৎকার করে উঠল। “কবির, এভাবে হবে না। থামো।”
কবির জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কর্নেলের দিকে তাকাতেই কর্নেল বিছানায় শুয়ে থাকা বাচ্চাটাকে দেখাল। এবার কবিরের মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে মনিরুজ্জামানের কলার ছেড়ে দিয়ে ঘুরতে যাবে মনিরুজ্জামান তার হাত চেপে ধরে একটানে তাকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বলল, “আমাদের বংশে আগে কেউ বেইমানি করলে আমরা তার হাত কেটে দিতাম। যাতে কেউ তাকে দেখলেই চিনতে পারে সে একটা বেইমান,” বলে সে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আজমত চাচার ভাতিজার দিকে ইশারা করল। একসাথে ঘটে গেল অনেকগুলো ঘটনা।
কথাটা বলেই মনিরুজ্জামান তার কোমরে গুঁজে রাখা বড় ছুরিটা বের করে কবিরের বাম হাতে এক কোপ মারল। কবির তার কবজিবিহীন হাতের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। ওটা থেকে রক্তের ফোয়ারা ছিটকে বেরোচ্ছে। কবির গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল। কর্নেল পিস্তল তুলল মনিরুজ্জামানের দিকে আর আজমত চাচার ভাতিজা বোতলের মুখে আগুন ধরিয়ে সেটা ছুড়ে দিল সৈনিক তিনজনের দিকে। বোতলটা মেঝেতে পড়ার সাথে সাথে সৈনিক তিনজনের গায়ে আগুন ধরে গেল। মেজর ফয়সলের একটা পায়ে আগুন ধরে গেছে। মেজর কবিরকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
কর্নেলের পিস্তলটা তাক করা ছিল মনিরুজ্জামানের দিকে। মনিরুজ্জামান সেটা ধরে ফেলল খালি হাতে। পিস্তলের মুখটা সে সরিয়ে দিতে যাবে তার আগেই কর্নেল গুলি করে দিল। গুলিটা তার বুকের ডান দিকে ঢুকে যাওয়ার সাথে সাথে সে পড়ে গেল। তবে কর্নেলের হাত ধরে রাখার কারণে কর্নেলও পড়ে গেল তার সাথে। কর্নেলের হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে পড়ে গেল ফ্লোরে। পিস্তলটা ছিটকে খটখট করতে করতে আবুর কয়েক হাতের মধ্যে গিয়ে থামল। আবু পিস্তলটা দেখল। কর্নেলও মনিরুজ্জামানের হাত ছাড়িয়ে উঠে বসেছে। সেও দেখল পিস্তলটা। আবু আর কর্নেল প্রায় একইসাথে লাফ দিল ওটা ধরার জন্য। কিন্তু কর্নেলের কাছ থেকে পিস্তলটার দূরত্ব অনেক বেশি। সে ওটা হাতের নাগালে পাওয়ার অনেক আগেই আবু সেটা তুলে নিয়ে গুলি করল কর্নেলকে উদ্দেশ করে। আবু চোখ বন্ধ করে একটানা গুলি করে গেল যতক্ষণ পিস্তলটাতে গুলি ছিল। গুলি শেষ হয়ে খটখট শব্দে কয়েকবার হ্যামার পড়ার পর তার হুঁশ হলো। ধীরে ধীরে সে চোখ খুলে তাকাল।
কর্নেল খোলা বাম চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সে চোখে প্ৰাণ নেই। অপর চোখের জায়গায় শুধুই রক্ত। ওই চোখটা ভেদ করে গুলি বেরিয়ে গেছে মাথার পেছন দিয়ে। কর্নেলের মৃতদেহে দেখে ওর হুঁশ ফিরল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল মেজর ফয়সল বা কবিরের কোনো চিহ্ন নেই। ওরা নিশ্চয়ই পালিয়েছে। আজমত চাচার ভাতিজা রক্ত মাখা রামদা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অগ্নিদগ্ধ সৈন্য তিনজনকে সে কচুকাটা করেছে।
আবু তখনও মৃদু কাঁপছে মনিরুজ্জামানের ডাক শুনে তার হুঁশ ফিরল। আবু দৌড়ে এসে তার পাশে বসে পড়ল। মনিরুজ্জামানের মুখ মরার মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বুকের ডান পাশের গর্ত থেকে স্রোতের মতো রক্ত বেরিয়ে আসছে।
“স্যার, এ কী হলো? এখন আমি কী করব?” আবু হাউমাউ করে উঠল।
“আবু অস্থির হবি না। আমাকে নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি বাঁচব না। চেষ্টা করেও লাভ নেই,” মনিরুজ্জামান কথা বলতে বলতে মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। ফুসফুসে মারাত্মক আঘাত লাগার লক্ষণ। “তার চেয়ে আমি যা বলি শোন।”
“জি, সার।”
“তোর বয়স কম কিন্তু তোর ওপর আমার এখন অনেক দায়িত্ব। আমার বাচ্চাটাকে নিয়ে আয়, আর ওই ঘোড়াটা,” বলেই মনিরুজ্জামান আবার কাশতে লাগল প্রতিটা কাশির সাথে বেরিয়ে আসছে রক্ত। তার হাতে বড়জোর আর কয়েকমিনিট সময় আছে। আবু বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ফিরে এলো তার অপর হাতে পা-ভাঙা ঘোড়াটা।
মনিরুজ্জামানকে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে দিল সে। মনিরুজ্জামান বাচ্চাটার কপালে চুমু খেল। “আবু আমি আজ থেকে আমার বাচ্চাটার দায়িত্ব তোকে দিয়ে গেলাম। ওকে তুই বড় করিস। তবে সেই সাথে এরচেয়েও আরও বড় একটা দায়িত্ব তোকে দিয়ে যাচ্ছি,” বলে সে ঘোড়াটা আবুর হাতে তুলে দিল। প্যান্টের পকেট থেকে হাফিজের প্যাকেটটা বের করে ঘোড়ার ছবিটার ওপরে রক্ত মাখা আঙুল বুলাল একবার। মনিরুজ্জামান প্যাকেটটা আবুর হাতে গুঁজে দিল। “একটা ইতিহাসের দায়িত্ব তুলে দিয়ে যাচ্ছি আমি তোর হাতে। তুই এটাকে রক্ষা করবি। তারপর আমার মেয়েটা বড় হলে ওকে এই দায়িত্ব বুঝিয়ে দিবি। একদিন এই মাটি ঠিকই স্বাধীন হবে। ইতিহাসের এই প্রাচীন সম্পদ যেন এই মাটির মানুষের কাজে লাগে।”
“কিন্তু স্যার এটার ভেতরে তো কিছুই নেই।”
“এটার ভেতরে কখনোই কিছু ছিল না। এই জিনিসটা আসলে একটা ফাঁকিবাজি। হাফিজ বুঝতে পেরেছিল ওর পেছনে পশ্চিম পাকিস্তানিরা লেগেছে। তাই সে এটা দিয়ে একটা নাটক সাজিয়েছিল মাত্র। আসল জিনিসটা আছে অন্য জায়গায়। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। আমাদেরকে রাজারবাগে নেওয়ার পর ঠান্ডা মাথায় যখন ভাবার সুযোগ পেয়েছি তখন বুঝতে পেরেছি। হাফিজ আসলে ‘সত্য সর্বদা তোমার সামনেই থাকে’ বলে কী বুঝিয়েছে। ওই লেখাটা যে আয়নার ওপরে লেখা ওই আয়নার সামনে দেখবি একটা ঘোড়ার মূর্তি আছে। ঠিক এটার মতোই দেখতে। ওটার ভেতরেই আছে সবকিছু। ম্যাপ, নিয়মাবলি সবকিছু। আমি রাজারবাগ থেকে ফেরার পথে একবার ওখানে গিয়েছিলাম তখন আমি চেক করে দেখেছি। তুই ওটা উদ্ধার করবি। তুই এখন এটার প্রধান। যেভাবেই হোক রক্ষা করবি। তোর অনেক শত্রু থাকবে, অনেক লোক লাগবে তোর পেছনে তাই আমার মেয়েটাকে কখনোই তুই সরাসরি তোর কাছে রাখবি না। তারপর ও বড় হলে এই সব ব্যাপার ওকে জানাবি। বুঝতে পেরেছিস?”
“আবু মাথা নাড়ল।
“আমার কাছে প্রতিজ্ঞা কর।”
“আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, স্যার।”
“ওই যে দেখ নতুন সূর্য উঠছে,” মনিরুজ্জামান সকালের লাল সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল। “যেদিন এই সম্পদ এই মাটির মানুষের কাজে লাগবে সেদিন যেন এটা উদ্ধার হয়,” বলে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।