৩৫
রাজবাড়ি, গাজীপুর
বর্তমান সময়, দুপুর প্রায় ১২টা
“ভাই রাজবাড়ির রাস্তাটা কোন দিকে?” হাসান সিগারেট ধরাতে ধরাতে প্রশ্ন করল দোকানদারকে। ওরা গাজীপুর চৌরাস্তা পার হয়ে এসেছে অনেকক্ষণ আগে। হাসানের ধারণা এইখানেই কোনোদিকে হবে রাজবাড়ির রাস্তাটা।
“ও রাজবাড়ি যাইবেন,” পান সিগারেটের দোকানদার লোকটা একগাল হেসে বেশ পাণ্ডিত্য একটা ভাব নিয়ে বলল, “এইহান থাইক্কা আরও আধামাইল সামনে আগাইলে ডাইনে একটা রাস্তা পাইবেন। ওইটা দিয়া মাইল পাঁচেক গেলেই রাজবাড়ি এলাকার শুরু। কই যাইবেন আপনেরা?” লোকটা একগাল হেসে বলল। তার দাঁতগুলো সব পানের দাগে দেখতে অনেকটা তরমুজের বিচির মতো লাগে।
“আপনি নিশ্চিত ওইটাই রাজবাড়ির রাস্তা?”
“আরে ভাই কী যে কন, রাজবাড়ি চিনুম না। নিশ্চিন্তে যাইতে পারেন, “ সে আরেক রাউন্ড তরমুজের বিচি প্রদর্শন করল। বিনিময়ে হাসানও একগাল হেসে সিগারেটের দাম দিয়ে গাড়ির কাছে চলে এলো। অরণি আর আহমদ বশির গাড়ি থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি করছে।
“লোকটা বলল এখান থেকে আরও আধামাইল গেলে হাতের ডানে একটা রাস্তা পড়বে ওটা ধরে মাইল মাঁচেক গেলে রাজবাড়ির শুরু,” হাসান ওদেরকে উদ্দেশ করে বলল।
“হুমমম ঠিকই আছে মনে হচ্ছে। চাচার নির্দেশনার সাথে মিলে যায়। চলো তাহলে আবার রওনা দেই,” অরণি গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল। “চাচা আপনার নির্দেশনা ঠিকই ছিল।”
অরণির কথা শুনে চাচা একটা হাসি দিল। “আসলে অনেক আগে আসছি তো তাই ঠিক ঠাওর করতে পারছিলাম না।”
ওরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রওনা দিয়ে প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের ভেতরে গাজীপুর চৌরাস্তায় এসে পৌঁছায়। ওখানে একটা হোটেলে থেমে নাশতা করে নেয়। নাশতা করতে করতে আলোচনা চলতে থাকে জায়গাটার সম্ভাব্যতা নিয়ে।
“আহমদ বশির তার মোবাইলে গুগল ম্যাপ বের করে জায়গাটার সম্ভাব্য অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছিল হঠাৎ আমির চাচা বলে ওঠে তিনি এই জায়গাটা চেনেন। একবার এক যাত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন।
“মা ঠিকানাটা একটু দেখা যাবে?” অরণির কাছে জানতে চায়।
“অবশ্যই চাচা, খান লজ, হাশেমপুর গ্রাম, রাজবাড়ি, গাজীপুর,” অরণি জবাব দেয়।
“আচ্ছা গাজীপুরে তো এক সময় ভাওয়াল রাজার বাড়ি ছিল, ওইটা না তো,” আহমদ বশির বলল।
“না না, ওই রাজবাড়ি তো অন্যখানে। ওইটা শহরের মধ্যে। ওইটা এখন গাজীপুর পৌরসভার অফিস। এইটা অন্য জায়গা। এই জায়গাটার নামই রাজবাড়ি। আমি অনেক আগে একবার এক যাত্রীকে নিয়ে গাড়িতে আসছিলাম। আমার মনে হয় হাশেমপুর গ্রামটাও আমি চিনি। ওইটা ভাওয়াল বনের মধ্যে ছোট্ট একটা গ্রাম।”
“বাহ, তাহলে তো ভালোই হলো। আমাদের যেতে কোনো সমস্যা হবেন না।”
এরমধ্যে অরণি আহমদ বশিরকে ছবিটার ব্যাপারেও বলে। আহমদ বশির সাহেব ব্যাপারটা শুনে মাথা নেড়ে মন্তব্য করেন, “আমি আগেই অনুমান করেছিলাম।”
এরপর ওরা রওনা দিয়ে আরও সামনে এসে গাজীপুরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। গাড়ি চালাতে চালাতে নিশ্চিত হওয়ার জন্য গাড়ি থামিয়ে হাসান নেমে এসে এই সিগারেটের দোকানদারের কাছে জানতে চায়।
ওরা দোকানদারের নির্দেশনা অনুযায়ী এগোতে থাকে। ডানের রাস্তাটা ধরে মাইল তিনেক এগোতে ভাওয়াল বন শুরু হয়ে গেল। আরও দুই মাইলের মতো এগোনোর পর আরেকজনকে জিজ্ঞেস করল হাশেমপুর গ্রামে খান লজটা কোনদিকে। লোকটা জানাল এদিক দিয়ে সোজা গিয়ে ডানে মোড় নিতে হবে। ওখানে পুরানো একটা জমিদার বাড়ি আছে ওটাই খান লজ। হাশেমপুর গ্রামের যে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে।
ওরা এগোতে লাগল নির্দেশনা অনুযায়ী। হাশেমপুর গ্রামের ভেতরে ঢুকে রাস্তার পাশের একটা টং দোকোনে চা পান করতে থাকা এক বুড়ো লোকের কাছে গাড়ির জানালা দিয়ে হাসান জানতে চাইল, “চাচা এখানে খান লজ বাড়িটা কোনদিকে?”
“জমিদার বাড়িডা, এই রাস্তা দিয়া সুজা গিয়া, জঙ্গলের এক্কেবারে শেষ কিনারাত। ওইহানে গিয়া কী করবেন, ওইহানে কেউ থাহে না। নাটক—সিনেমার শুটিং করবেন নি?” চাচার প্রশ্নের জবাবে হাসান সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
ওরা ভাওয়াল বনের একদম ভেতরে চলে এলো। হাশেমপুর গ্রামটা জমজমাট হলেও এই এলাকাটা বেশ নির্জন। এদিকে কেউ আসে বলেও মনে হলো না। তার মানে বুড়ো লোকটার কথাই ঠিক, বাড়িটা পরিত্যাক্ত। বনের কিনারায় চলে আসার প্রায় সাথে সাথেই দেখতে পেল পুরানো বাড়িটা। হায়দার রাস্তার একপাশে গাড়িটা রেখে দিল। এখান থেকে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে। কারণ গাড়ি যাওয়ার মতো রাস্তা নেই।
ওরা সবাই নেমে এলো। সবাইকে বাড়িটার দিকে এগোতে বলে অরণি হাসানকে ডাক দিল। ওর সাথে একটু আলাপ করে ফিরে এলো গাড়িটার দিকে। সেখানে আমির চাচা বসে আছে। অরণি আমির চাচাকে বলল, “চাচা আপনি গাড়িতেই থাকেন।”
“হ্যাঁ চাচা, আপনি এখনেই থাকেন। আর এইটা রাখেন,” বলে হাসান চাচার দিকে ওর পিস্তলটা বাড়িয়ে দিল। ধানমন্ডি ফ্ল্যাটে যাওয়ার পর হায়দার ওটা তাকে ফেরত দিয়েছিল।
“এইটা নিয়া আমি কী করুম?” চাচাকে একটু বোকা বোকো লাগছে।
“চাচা এখানে কী হবে আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না। আর এখানে কাউকে পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারছি না, একমাত্র আপনি ছাড়া। আপনি এইটা রাখেন। কোনো বিপদ হলে আপনি আমাদের একমাত্র ভরসা। কোনো ঝামেলা হলে আমি আপনার মোবাইলে কল দেব। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে বাবা। আল্লাহ তোমাদের সহায় হোক।”
আহমদ বশির আর হায়দার আলি অনেকটা এগিয়ে গেছে। ওরা এসে তাদের সাথে যোগ দিল। হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে এলো বাড়িটার কাছে। বুনো ঝোপঝাড়ে ছেয়ে গেছে চারপাশ। অবশ্যই এই বাড়িতে কেউই থাকে না এখন আর।
তবে এখনও বাড়িটার চেহারা দেখার মতো। পুরানো দিনের জমিদার বাড়ি। বিরাট বিরাট থাম আর বিশাল বারান্দা সামনে। বারান্দার ওপরে বড় বড় করে লেখা ‘খান লজ’। “এটাই সেই বাড়ি,” হাসান বিড়বিড় করে বলল।
অনেকখানি জায়গা নিয়ে অবস্থিত বাড়িটার ঠিক সামনেই বিরাট মাঠের মতো অনেকখানি খালি জায়গা। মাঠের একপাশে বিরাট একটা বটগাছ। গাছটার একপাশে পুরানো মরচে পড়া একটা গাড়ি। গাড়িটার উলটোদিকে বাঁধানো দুটো কবর। কবরের পরেই পুকুরের মতো একটা জলাবদ্ধ জায়গা।
ওরা বাড়িটার দিকে এগোচ্ছে হঠাৎ কম বয়স্ক একটা ছেলে বেরিয়ে এলো পাশের জঙ্গল থেকে। পরনে টি-শার্ট আর লুঙ্গি। হাতে একটা ছোট কঞ্চি। সে এগিয়ে এসে ওদেরকে প্রশ্ন করল, “আপনারা কি শুটিং করতে এসেছেন?”
“তুমি কে?” হাসান ছেলেটাকে প্রশ্ন করল।
“আমি জামিল, এই গ্রামেই থাকি। এদিকেই ছাগল চরাই। এইখানে কেউ থাকে না তো তাই এদিকে ঘুরাঘুরি করি। আর মাঝে মাঝে এখানে শুটিং পার্টি আসলে ওদের কাজ করে দেই। আপনারা কি শুটিং করতে এসেছেন?”
“এইখানে কি অনেক শুটিং হয়?” আহমদ বশির প্রশ্ন করল।
“না স্যার, এই এলাকাতে অনেক নাটক-সিনেমার শুটিং হয় তবে এই বাড়িতে মাঝেমধ্যে শুটিং হয়। পুরান বাড়ি তো। যাগো পুরান বাড়ি লাগে শুটিং করতে ওরা আসে মাঝেমধ্যে। পরিত্যক্ত বাড়ি কোনো টেকাটুকা লাগে না। খালি পরিষ্কার কইরা লইলেই চলে।”
“কয়েকদিনের ভেতরে এখানে কেউ এসেছিল?” অরণি প্রশ্ন করল।
“না কোনো শুটিং পার্টি আসে নাই। তবে…”
“তবে কী?”
“গেল সপ্তাহে এক ম্যাডাম আসছিল। আপনের মতো সুন্দর দেখতে, অরণিকে দেখিয়ে বলল। “তিনি আমাকে এই বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করল। তারপর আমাকে বলল ঘুরিয়ে দেখাইতে। শেষে আমাকে পঞ্চাশ টাকা দিছিলেন।”
“তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন?” হাসান প্রশ্ন করল।
“তিনি বাড়ির ভিতরে দেখতে চেয়েছিলেন। আমি মানা করছি কারণ একে তো ঝোপঝাড়ে ছাওয়া চারপাশ, তার উপরে সাপ আছে। তিনি চারপাশে একটু একটু দেখলেন, তারপর ওই কবরগুলা দেখলেন। কিছুক্ষণ গাছটার ওখানে ঘুরাঘুরি করলেন। তারপর অনেকক্ষণ ওইখানে দাঁড়ায়া থাইক্কা চইলা গেলেন,” ছেলেটা হাত তুরে পারিবারিক গোরস্থানটা দেখাল।
অরণি পায়ে পায়ে ওদিকে এগিয়ে গেল। পাশাপাশি কয়েকটা কবর। প্রায় সবগুলোই পাথর দিয়ে বাঁধাই করা। দুটো কবরে সিমেন্টের গাঁথুনি। অরণি ওগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। একটা কবরে নাম ফলক লেখা ‘নার্গিস আক্তার। জন্ম ১৯৪২, মৃত্যু ২৫শে মার্চ ১৯৭১।” অপর কবরটার ফলকে লেখা নামটা পড়ল ও বিড়বিড় করে, “মনিরুজ্জামান খান, জন্ম ১৯৩৪, মৃত্যু ২৫শে মার্চ ১৯৭১।”
সবাই গুটিগুটি পায়ে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অরণি ব্যাগ থেকে কার্জন হলে পাওয়া ছবিটা বের করল। “ইনিই সেই ব্যক্তি। পাশে নিশ্চয়ই তার স্ত্রী। কিন্তু মা’র সাথে তাদের সম্পর্কটা কী ছিল?”
“এ প্রশ্নেরে জবাব আমি দিতে পারব,” নতুন একটা কণ্ঠ শুনে সবাই ফিরে তাকাল। “এই দুজন মানুষ তোমার মা’র বাবা-মা ছিলেন। মানে তোমার নানা-নানি। আর এই মানুষটি ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং গুরু, যাকে আমি পিরের মতো ভক্তি করতাম।”
বেশ বয়স্ক একজন মানুষ। একটা হাত স্লিঙে ঝোলানো। অপর হাতটাতে লাঠি সেটাতে ভর দিয়ে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। ভদ্রলোক ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে মনিরুজ্জামান লেখা কবরটার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ অশ্রু বিসর্জন দিয়ে তিনি অরণির দিকে ফিরে বললেন, “অরণি, আমার নাম আফতাব মাহমুদ। তোমার শ্রদ্ধেয় নানাজান, মানে মনিরুজ্জামান স্যার আমাকে আবু বলে ডাকতেন,” বলে মানুষটা চোখ মুছলেন। “আমি তোমাদেরকে একটা কাহিনি শোনাব। একজন মানুষ, এক টুকরো ইতিহাস এবং একটি ভয়ংকর রাত, ২৫শে মার্চের কাহিনি।”