৩৩
রাজবাড়ি, গাজীপুর
২৬মে মার্চ,১৯৭১
সময় : ভোর প্রায় ৫টা
মনিরুজ্জামান আর্মি জিপটাকে ঘুরিয়ে বাড়ির সামনের বটগাছটার একপাশে দাঁড় করিয়ে দিল। এই গাছটার অন্যদিকেই একটা পুকুর। পুকুরপাড়ে তাদের পারিবারিক গোরস্থান। ওখানেই তার বাবা-মায়ের কবর আছে। পুরানো আমলের এই বাড়িটা তার অনেক প্রিয়। বাড়িটার সামনে অনেকখানি খোলা জায়গা। জায়গাটার একপাশে বিরাট এই পুরানো বটগাছটা। ছোটবেলায় এই বটগাছের নিচ সে খেলা করত। আগে এটার পাশেই একটা বৈঠকখানা ছিল। সে বড় হওয়ার পর ওটা ভেঙে ফেলা হয়।
তারা রাজারবাগ থেকে রওনা দিয়ে এখান পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে এক ঘণ্টারও কম। ওখান থেকে রওনা দিয়েই তারা প্রথমে যায় হাফিজের বাড়িতে। মনিরুজ্জামান আবু আর কবিরকে গাড়িতেই বসে থাকতে বলে সে একবারের জন্য ভেতর থেকে ঘুরে আসে। ভেতরে যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় ফিরে আসে সে। এরপর পথে আর কোনো ঝামেলা হয়নি। আমি জিপ থেকে কোথাও তাদেরকে থামানো হয়নি বা ঝামেলা করেনি। একবার একটা রোড ব্লকে থামানো হয়েছিল ওখানে পেছনের বন্দি দুজনকে দেখানোর সাথে সাথেই ব্লক তুলে যেতে দেওয়া হয়।
রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে মনিরুজ্জামানের মাথায় একটা জিনিসই ঘুরছিল। সেটা হলো যেভাবেই হোক নার্গিসসহ তাদের বাড়ির সবাইকে যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে ফেরতে হবে। কারণ কর্নেল যখন দেখবে সে পালিয়েছে সাথে সাথে সে গাজীপুরের উদ্দেশ্যেই রওনা দেবে এবং চেষ্টা করবে যেভাবেই হোক হয় তাকে কিংবা নার্গিসকে পাকড়াও করতে। কারণ একমাত্র নার্গিসকে পাকড়াও করতে পারলেই সে মনিরুজ্জামানকে হাতের মুঠোয় আনতে পারবে। তাই সে যথাসম্ভব দ্রুত গাড়ি চালিয়েছে গাজীপুরে পৌঁছানোর জন্য।
বাড়ির সামনে গাড়িটা থামিয়েই সে গুলির বেগে গাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো। গাড়িটা দেখেই দৌড়ে এলো তাদের বাড়ির পুরানো খাস লোক আজমত চাচা। মনিরুজ্জামান নিজে নেমে আবু আর কবিরকে গাড়ি থেকে নামতে বলল।
“বাবা তুমি এত রাত্তিরে? দেশে নাকি কীসব হইতেছে?” চাচা মনিরুজ্জামানের পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল।
“হ্যাঁ চাচা, দেশের অবস্থা খুব খারাপ। আমাদেরকে এক্ষুনি এখান থেকে সরে পড়তে হবে। আচ্ছা নার্গিস ঠিকমতো এসে পৌঁছেছিল সন্ধ্যায়?” হঠাৎ সে থেমে গেল। বাড়ির ভেতরে আলো জ্বলছে, আজমত চাচা এত রাতে জেগে আছে এটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। গ্রামের মানুষ যেখানে সন্ধেবেলা ঘুমিয়ে যায় সেখানে এখন রাত প্রায় ভোর হওয়ার দিকে, এরা কোনো কারণ ছাড়াই জেগে আছে এটা হতেই পারে না। “চাচা, কী ব্যাপার? কী হচ্ছে? কোনো সমস্যা?”
“সমস্যা না বাবা তুমার বউয়ের বাচ্চা হবে। হের তো বেদনা উঠছে,” চাচা হাসিমুখে বলল।
মনিরুজ্জামানের এক মুহূর্ত লাগল কথাটার মানে বুঝতে। সর্বনাশ নার্গিসের প্রসব ব্যথা উঠেছে। তার মানে … সে প্রায় দৌড়াতে লাগল নিজের ঘরের দিকে। পুরানো আমলের জমিদার বাড়ির বিরাট বারান্দা পার হয়ে চলে এলো ভেতরে। ঢুকে সোজা চলে এলো শোয়ার ঘরে। বিরাট পালঙ্কে শুয়ে আছে নার্গিস তার স্ফীত পেট সম্পূর্ণ উদোম। পালঙ্কের চারপাশে কয়েকজন মহিলা ভিড় করে আছে। এরমধ্যে চাচি, আর আজমত চাচার ছেলের বউকে সে চিনতে পারল।
মনিরুজ্জামান সোজা গিয়ে পালঙ্কে তার প্রসব বেদনায় কাতরাতে থাকা স্ত্রীর পাশে বসে পড়ল।
“মনির তুমি এসেছ। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল তুমি আর আসবে না। তোমার কোনো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে আর দেখতে পাব না আমি, মনিরুজ্জামানের একটা হাত ধরে নার্গিস কাঁদতে কাঁদতে বলল।
“কিচ্ছু হয়নি নার্গিস, কিচ্ছু না। এই তো আমি এখানে,” মনিরুজ্জামান তার বউয়ের কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল। “দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।” মনিরুজ্জামান কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সে উঠে দাঁড়িয়ে রুমের সবচেয়ে বয়স্ক মহিলাকে একপাশে ডেকে নিল। এই মহিলা এই অত্র এলাকার সবচেয়ে অভিজ্ঞ দাইমা। এই এলাকার বেশিরভাগ বাচ্চাই তার হাত দিয়ে জন্ম নেয়।
“চাচি, নার্গিসের কী অবস্থা?” সে বেশ উদ্বেগের সুরে জানতে চাইল।
“অবস্থা খারাপ না বাবা। তুমার বউয়ের শরীর-সাইস্থ তো ভালা, হে বেশ ভালো অবস্থাতেই আছে। বাচ্চাও মনে অইলো ভিতরে ঠিকই আছে। আমি সব ঠিক কইরা রাখছি যেকুনো সুময় তুমি বাপ হইয়া যাইবা হে হে,” মনিরুজ্জামান একটু শান্তি অনুভব করল।
“চাচি নার্গিসকে কি এখন কোনোভাবে সরানো যাবে?”
“লরাবা মানে! এইডা কী কও। না না, হেরে অহন লরাইলেই বিপদ। মা আর বাচ্চা দুজনেরই ক্ষতি অইবো। কুনোবায়ই হেরে অহন এক চুল লরাইন যাইতো না,” চাচি মনে হলো মনিরুজ্জামানের ওপর একটু ক্ষেপে গেছে
“ঠিক আছে চাচি, আপনি আপনার মতো করে ওকে দেখে রাখুন। যা যা লাগে শুধু আমাকে বলবেন,” বলে সে চাচির একটা হাত ধরল। “চাচি, নার্গিসের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।”
“ঠিক আছে বাপ,” বলে সে চলে গেল।
মনিরুজ্জামান নার্গিসের পাশে বসে তার কপালে হাত বুলিয়ে দিল। “আমি চাচির সাথে কথা বলেছি, কোনো সমস্যা নেই। যেকোনো সময় তুমি মা হয়ে যাবে,” নার্গিস যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে হেসে ফেলল।
“তুমি কোথাও যেও না।
“আমি যাব না। এখানেই আছি,” বলে সে নার্গিসের একটা হাত ধরে মৃদু চাপ দিল। “নার্গিস, আজ বিকেলে আমার অফিসের পিয়ন কি বাসায় কোনো বাক্স নিয়ে এসেছিল?”
“হ্যাঁ এনেছিল তো, ভেতরে একটা খেলনা ছিল। একটা পাথরের ঘোড়া। কিন্তু ওটার না একটা পা ভেঙে গেছে।”
“তুমি ওটা দেখেছ?”
“হ্যাঁ দেখব না কেন। ওই যে ওটা। তুমি পাঠিয়েছ তাই ওটা আমি নিয়ে এসেছি আমার সাথে। ওই যে ওটা।”
মনিরুজ্জামান চট করে ঘুরে দেখল। সত্যি সত্যি জিনিসটা খাটের পাশে একটা টেবিলের ওপর রাখা। মনিরুজ্জামান নার্গিসের কপালে হালকা একটা চুমো খেয়ে উঠে এলো।
সত্যি সত্যি জিনিসটা টেবিলের ওপর রাখা। সে ওটা টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিল। পুরো ব্যাপারটা এখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। হাফিজ যখন বুঝতে পারল পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাকে ধরে ফেলবে সে তখন মনিরুজ্জামানের জন্য কিছ ব্লু রেখে আত্মহত্যা করে। সে কুগুলো এমনভাবে রাখে যেন সেটা দেখে মনিরুজ্জামান বুঝতে পারে জিনিসটা নারায়ণ ব্যানার্জির কাছে আছে। অন্যদিকে নারায়ণ ব্যানার্জি হাফিজের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেয়ে জিনিসটা পাঠিয়ে দেয় তার অফিসে। কিন্তু ততক্ষণে সে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। কাজেই অফিসের দারোয়ান সেটা বাসায় দিয়ে আসে। নার্গিস জিনিসটা দেখে ভাবে ওটা সে পাঠিয়েছে এবং প্যাকেট খুলে দেখে একটা খেলনা ঘোড়া। সে ওটা তার সাথে করে নিয়ে আসে গাজীপুরে। আর এই কারণেই কর্নেল হাবিব যখন তার বাসায় হানা দেয় বাক্সটা ছিল খালি। কারণ নার্গিস ওটা নিয়ে চলে এসেছে।
মনিরুজ্জামান জিনিসটা নিয়ে সোজা পুরানো আমলের কাঠের আলমারিতে ঢুকিয়ে তালা মেরে দিল। এটা এখন একটা ট্রাম্প কার্ড। কারণ… সে ফিরে আসার সময় হাফিজের বাসায়… যাহোক, এখন তাকে অন্য ব্যাপারগুলোর সুরাহা করতে হবে।
সে বাইরে চলে এলো। বসার ঘরে আবু আর কবির বসে আছে। তাদের সামনে কিছু খাবার রাখা। তাদের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আজমত চাচা।
“আবু, কবির এবং চাচা আপনাদের তিনজনের সাথেই আমার কিছু কথা আছে। নার্গিসের অবস্থা সিরিয়াস। যেকোনো সময় বাচ্চা হয়ে যাবে। তার মানে ওকে কিছুতেই এখন নাড়ানো যাবে না। অন্তত বাচ্চা হওয়ার কয়েকঘণ্টার ভেতরে ওকে কোনোভাবেই নাড়ানো যাব না। সমস্যা হলো, কর্নেল হাবিব আমার এই বাড়ির ঠিকানা জানে এবং সে এখানে আসছে। যেকোনো সময় সে এখানে পৌঁছে যাবে। আমরা যদি নিজেদেরকে বাঁচাতে চাই এবং আমাদের পরিবারকে বাঁচাতে চাই তাহলে আমাদেরকে তার মোকাবিলা করতে হবে। আমরা এখনও জানি না কর্নেল কতজন লোক নিয়ে আসবে কী ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আসবে। তাই আমাদেরকে যতটা সম্ভব শক্ত প্রস্তুতি নিতে হবে। একটাই আশার কথা। আজ যতবার কর্নেলকে দেখেছি প্রতিবারই তার সাথে খুব বেশি লোক ছিল না। এর কারণ মনে হয় আজ রাতে আমি খুবই ব্যস্ত এবং ঝামেলার ভেতরে আছে। কর্নেল যদি দ্রুত এখানে আসতে চায় তাহলে সে খুব বেশি লোক আনতে পারবে না। বড়জোর দুটো জিপ আর ছয় থেকে দশজন সৈনিক। কাজেই যেভাবেই হোক আমরা বাধা দেব। চাচা বাড়িতে বন্দুক কয়টা আছে?”
“বাবা তোমার বাপের দুইটা আর দাদার একটা। তয় মনে অয় তোমার দাদারটা নষ্ট। তুমি না আইলে তো অইগুলা কেউ ধরেও না,” চাচা জবাব দিল।
“তার মানে দুইটা বন্দুক। গুলি?”
“গুলি মেলা আছে। তুমি শেষবার যে আনছিলা ওই বাসকু পুরাডাই আছে।”
“ভেরি গুড। বন্দুক দুইটা। একটা মনে হয় দোনলা আর একটা একনলা। এগুলো বেশ ভালো বন্দুক। আর পর্যাপ্ত গুলি আছে। আর অন্যান্য কোনো অস্ত্র, চাচা?”
“কুচ আছে একটা আর রামদা আছে তিনডা। তয় মইরচা পইরা আছে। আর ছুরি আছে কয়েকটা। তোমার আব্বার ওই বড় চুরিডাও আছে।”
“ঠিক আছে চলবে। আবু, কবির শোন আমার একটা পরিকল্পনা আছে। আমরা শুরুতেই ওদেরকে চমকে দেব। যতজনই আসুক আর যারাই আসুক, আমাদের জেতার একটা চান্স আছে যদি আমার পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারি,” বলে সে আজমত চাচার দিকে ফিরে বলল, “চাচা বাড়ির পেছনে পুরানো গুদামটা খুলতে হবে। ওখানকার মজুত করা তেলের বড় ড্রামগুলো এখনও আছে না ঠিকমতো?”
“মনে অয় আছে, বাবা।”
“ভেরি গুড।”