৩২
বর্তমান সময়, সকাল প্রায় ৯টা
সকাল নয়টা বেজে গেছে। ওদের গাড়ি মহসিন হলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এলাকাটা এখন বেশ সরগরম। স্টুডেন্টরা বেরিয়ে আসছে, ছোট ছোট টং দোকানগুলোতে চা খাচ্ছে, নাশতা করছে, অনেকেই ক্লাসের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। হাসান গেছে রেজিস্ট্রার বিল্ডিঙে তার পরিচিত লোকটার কাছে খোঁজ নিতে। অরণির ব্যাগে ছারপোকাটা আবিষ্কার করার একটু পরেই খুব দ্রুততার সাথে ওরা বেরিয়ে আসে ফ্ল্যাটটা থেকে। যে জিপটা নিয়ে গিয়েছিল জিপটা ওখানকার পার্কিং লটেই রেখে এসেছে। সতর্কতা স্বরূপ অন্য একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। বিশেষ প্রয়েজনে ব্যবহার করার জন্য সাদা এই গাড়িটা ওই অ্যাপার্টমেন্টেই থাকে। ওরা গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়িয়েছে কেউ অনুসরণ করলে যাতে বোঝা যায়। কিন্তু সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এরপর পরামর্শ করে ওরা চলে আসে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। এখানে এসে ওরা হাসানকে মূল চত্বরে রেজিস্ট্রার বিল্ডিঙের সামনে নামিয়ে দিয়ে মহসিন হলের গেটের কাছে এসে দাঁড়ায়। আধা ঘণ্টার ওপর হয়ে গেছে হাসানের কোনো খবর নেই।
একটু পরেই হাসান রেজিস্ট্রার বিল্ডিঙের পেছন দিককার একটা ছোট গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল
“পেয়েছ?” অরণি জানতে চাইল।
“হাহ, ওয়েলকাম টু ঢাকা ইউনিভার্সিটি। রেজিস্ট্রার বিল্ডিং, এক্সাম কন্ট্রোলার, এসব জায়গার কাজকারবার এখানে যদি এত সহজে হয়ে যেত তাহলে তো ভালোই হতো। ওই ব্যাটাকে মোবাইলে না পেয়ে অফিসে গেলম, সে এখনও আসেনি। এত সকালে আসার কথাও না। কিন্তু আমি জানতাম তাকে কোথায় পাওয়া যাবে। গেলাম সূর্যসেন হলের সামনে ক্যান্টিনে, গিয়ে দেখি হ্যাঁ ঠিকই আছে, চা খাচ্ছে। বুঝিয়ে বললাম আমার কী দরকার, হাতে দুশো টাকা ধরিয়ে দিলাম তারপর সে অফিসের দিকে রওনা দিতে দিতে বলল, পনেরো-বিশ মিনিটের ভেতরেই জানাবে। এখন এইটুক সময় বসে অপেক্ষা করতেই হবে,” বলে হাসান গাড়ির সিটে হেলাম দিল।
“ওই লোক কীভাবে জানাবে?” আহমদ বশির জানতে চাইল।
“আমার মোবাইল নম্বর দিয়ে এসেছি, সে জানতে পারলেই কল দেবে,” বলে হাসান চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, “আহ এই জায়গাগুলো আমার কী যে প্রিয়। ভার্সিটিতে আমার হল অ্যাটাচমেন্ট ছিল মহসিন হল। দিনের কত সময় আর রাত যে এখানে আড্ডা মেরে কাটিয়েছি। ওই যে দোকানগুলো দেখছ ওইগুলোকে আমরা বলতাম কেএফসি। মানে হলো কাদের ফ্রায়েড চিকেন। যদিও এখানে আসলে চিকেন ফ্রাই-এর ‘চ’ বা ‘ফ’ কোনোটাই পাওয়া যায় না। হা হা হা,” বলে হাসান হাসতে লাগল।
“তোমার মোবাইল বাজছে,” অরণি বলার সাথে সাথে হাসান মোবাইলটা বের করে কানে লাগাল।
কথা বলা শেষ করে সে আহমদ বশিরের দিকে তাকাল, “এখানে এত পুরানো রেকর্ড নেই। আমাদেরকে ডিপার্টমেন্টে যেতে হবে। তার মানে কার্জন হল পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ।”
হাসান কথা বলা শেষ করার সাথে সাথে আহমদ বশির হায়দার আলিকে বলল কার্জন হলের দিকে যেতে। ওদের গাড়ি মহসিন হলের সামনে থেকে রওনা দিল কার্জনের দিকে।
“আচ্ছা ওখানে গিয়ে যদি আমরা রেকর্ড না পাই তাহলে কী হবে?” অরণি জানতে চাইল।
“রেকর্ড পাওয়াটা কঠিক হবে। তবে আমার ধারণা সেটা অসম্ভব হবে না। ওখানে না পেলে আমরা ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টার অ্যালোটমেন্টের অফিসে খোঁজ নিলেই পাব। যদিও সবখানেই এত পুরানো রেকর্ড খুঁজে বার করাটা বেশ মুশকিল হবে। তবে সঠিক জায়গায় সঠিক ঘুস প্রদান করতে পারলে কাজ হবে বলেই আমার মনে হয়।”
“হুমমম আমারও তাই মনে হয়। পুরানো সব কাগজপত্রের মোটামুটি রেকর্ড থাকে। যদিও এত আগেরটা আছে কি না আমি জানি না,” আহমদ বশির হাসানের কথার সমর্থন জানাল।
“আরেকটা রাস্তা আছে,” হাসান বলল। “এই দুটোর একটাতেও যদি কাজ না হয় তবে আমরা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের পুরানো কোনো টিচারকে খুঁজে বার করব। তার কাছ থেকে হয়তো একটা না একটা কিছু জানা যাবে।”
“ঠিক আছে, আগে দেখি, যদি এখানে কাজ হয়ে যায় তবে আর এত কষ্ট করতে হবে না,” অরণি মন্তব্য করল।
ওদের গাড়ি কার্জন হলের কাছে চলে এসেছে। কার্জন হলের গেটের কাছে এসে হায়দার আলি গাড়ি থামিয়ে দিল।
“আমি আর অরণি নেমে যাই। আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন,” বলে হাসান আর অরণি নেমে এলো। ওরা হাঁটতে হাঁটতে কার্জন হলের ভেতরে চলে এলো। হাসান ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট ভালোই চেনে। ওরা একেবারে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের অফিসে চলে এলো। দিনের এই সময়ে অফিস ফাঁকাই বলা চলে। এদের কাজকর্ম শুরু হয় আরও বেলা করে। অফিসে বয়স্ক এক চাচা বসে পত্রিকা পড়ছে। বেশ সুন্দর লাল দাড়ি তার মুখে।
“তুমি কোনো কথা বলো না। ভার্সিটির অফিস অ্যাডমিনের লোকেরা নবাবের নবাব। একটু উলটা-পালটা হলেই শেষ।”
“আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহে আলাইহু, চাচা ভালো আছেন?” হাসান লম্বা এক সালাম দিয়ে শুরু করল।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম,” মুরুব্বি পেপার থেকে মুখ তুলে জবাব দিল। বোঝা গেল সালামটা তার পছন্দ হয়েছে। “কী চাই?”
“চাচা, আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
“বলো,” সরাসরি তুমি বলে ডাকল সে হাসানকে।
“চাচা অনুমতি দিলে একটু বসে বলতাম,” হাসানের কথার জবাবে চাচা চেয়ার দেখাল। হাসান বসে অরণিকেও বসার ইশারা করল।
“চাচা আমি একটা পত্রিকাতে কাজ করি। সাংবাদিক,” কথাটা বলার পেছনে একটা কারণ হলো ভার্সিটিতে সাংবাদিকদেরকে কেউ ঘাঁটাতে চায় না। “আপনাদের এখানে কি পুরানো শিক্ষকদের কোনো রেকর্ড রাখা হয়? এই যে তাকে দেখছেন,” বলে সে অরণিকে দেখাল। “তিনি আমেরিকা থেকে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো শিক্ষকদের বিভিন্ন অবদানের ওপর একটা গবেষণামূলক প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য।”
“ও আচ্ছা, ভালো খুবই ভালো। তোমরা তো ভালো কাজ করতেছো।”
“জি চাচা আপনাদের দোয়ায়। তা চাচা আপনাদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক মনিরুজ্জামান, প্রতিবেদনের একটা অংশ তাকে নিয়ে করতে চাচ্ছিলাম কিন্তু তার কোনো খোঁজখবর পাচ্ছি না কোথাও। তার বাড়ির ঠিকানাটা একটু দরকার ছিল। যদি আপনি একটু সাহায্য করতেন তাহলে ভালো হতো।”
“আচ্ছা, কত পুরানো। মানে তিনি কত সালে রিটায়ার করেছেন?”
“সে তো জানি না চাচা, তবে অনেক পুরানো।”
“শিক্ষকদের সব তথ্য তো ডিপার্টমেন্টে থাকে কিন্তু সেটা তো বাইরের কাউকে দেওয়া নিষেধ,” বলে সে আবারও পত্রিকা তুলে নিচ্ছে দেখে হাসান তাড়াতাড়ি বলল, “চাচা তথ্যটা আমাদের খুবই জরুরি দরকার।”
“হুমমম ঠিক আছে, তোমরা ভালো পোলাপাইন বইলা মনে হয়। আজকালকার পোলাপাইন তো দুনিয়ার বেয়াদপ। ঠিকমতো সালামও দেয় না। “ঠিক আছে দাঁড়াও,” বলে সে উঠে গেল। একুট পরে পুরানো একটা চাবির গোছা নিয়ে এলো।
“চলো,” ওদেরকে নিয়ে চাচা পিছনের একটা ঘরে চলে এলো। “এখানে আছে সব। খুঁইজ্জা লও। কাজ শেষ হইলে আমারে জানায়ো।”
“জি চাচা অনেক ধন্যবাদ।”
সামনে ফাইলের বিশাল স্তূপ। “হায় হায়! এগুলো সব ঘাঁটতে গেলে তো পুরো এক প্লাটুন আর্মির একমাস লেগে যাবে,” স্তূপের দিকে তাকিয়ে অরণি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
“সব ঘাঁটা যাবে না। সাল দেখে দেখে শুরু করো। আমার ধারণা এখানে নিয়োগের বছরের ভিত্তিতে ফাইলগুলো সাজানো আছে। আমরা একাত্তরের আগের সব ফাইল থেকে শুরু করব।
ওরা একে একে ফাইল দেখতে শুরু করল। কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করেই হতাশ হয়ে গেল। এখানকার সব ফাইল আশি সালের পর থেকে। “এখানে নেই,” হাসান মন্তব্য করল। “এখানকার সব ফাইল আশির পর।” সে হাত ঝাড়ছে। ফাইলগুলোতে দুনিয়ার ধুলোময়লা। একটু নাড়ালেই ধুলো উড়তে থাকে।
“চলো অফিসে চলো।”
অফিসে ফিরে এসে দেখে চাচা মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছে। “কি কাজ হয়ে গেল?” ওদেরকে দেখে মুরুব্বি জানতে চাইল।
“না চাচা, ওখানে তো সব ফাইল ১৯৮০ সালের পর থেকে। আমাদের একাত্তরের আগের দরকার।”
“কী এত পুরানো? এত পুরানো ফাইল তো পাবা বলে মনে হয় না।”
“কী বলেন চাচা! পুরানো ফাইল নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও রাখা আছে।”
“তা থাকতে পারে। ফাইল বেশি পুরানো হয়া গেলে সেইগুলো রাখার জন্য ভিতরের বড় একটা রুম আছে। কিন্তু সেইখানে তো—”
চাচা আমাদের দরকারটা আসলে খুবই জরুরি। দেখেন একজন মানুষ শিক্ষা আর জ্ঞানের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। আর আমরা যদি একটা ফাইল খুঁজে বের করতে না পারি কেমনে হয় বলেন। এই যে চাচা আপনি ছাত্রদের জন্য জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন, আর আমরা এটুকু পারব না। তাহলে ক্যামন হয় বলেন!”
“হুমমম ভাতিজা বুঝছি তুমি ফাইল না দেইখা যাইবা না। দাঁড়াও দেখি কী করা যায়?” চাচাকে দেখে মনে হলো সে তেলটা ভালোই খেয়েছে।
একটু পরে ফিরে এলো আরেকটা বিরাট চাবির গোছা নিয়ে। একেকটা চাবির সাইজ বিশাল বিশাল। সবচেয়ে ছোট চাবিটাও চার ইঞ্চির কম না। “ভাতিজা তোমারে ভালো লাগছে দেইখা কষ্টটা করলাম। আমারে কিন্তু তোমার পান খাওয়াইতে হবে।”
“অবশ্যই চাচা কী পান খাবেন বইলেন। পুরান ঢাকা থেকে একসময় নিয়ে আসব,” হাসান আসলেই আন্তরিক খুশি হলো লোকটার প্রতি।
“ঠিক আছে। কথা দিতে হইবে কিন্তু। চলো আমার লগে,” চাচা ওদরেকে নিয়ে চিপাচাপা একেকটা গলি পার হয়ে চলে এলো একদম ভেতরের দিকে। গোছা থেকে একটা চাবি বেছে নিয়ে খুলে ফেলল পুরানো মরচে ধরা তালাটা
“ভিতরে আসো,” চাচা ভেতরে ঢুকে একটা ১০০ পাওয়ারের লাইট জ্বেলে দিল। হাসান অবাক হয়ে দেখছে। কার্জন হলে সে এর আগে অসংখ্যবার এসেছে। কিন্তু এর ভেতরে এরকম বড় একটা রুম আছে কল্পনাতেও আসেনি তার।
“এইটা এক সময় হলরুমের মতো ছিল। এখন রেকর্ডরুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এইখানে মোটামুটি সবকিছুর রেকর্ডই আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে প্রথম থেকে,” চাচা সারি সারি লোহার র্যাকগুলো দেখিয়ে বলল।
“ওই যে ওইখানে পদার্থবিজ্ঞানের সব ফাইল রাখা আছে। খুঁইজ্জা নেও আমি বাইরে আছি। বেশি দেরি কইরো না।“
হাসান আর অরণি নির্দিষ্ট র্যাকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সারি সারি কলামের মতো করে ফাইলগুলো রাখা আছে। ওরা একটা একটা করে উঁচু করে দেখতে লাগল। “এই যে এখানে টিচারদের ফাইলগুলো রাখা।
দুজনে মিলে দেখতে লাগল। “হ্যাঁ আশির আগেরগুলো এখানেই রাখা।”
“একাত্তরের আগ থেকে দেখবে। একটা আমাকে দেবে আর একটা তুমি দেখবে। তাহলেই দ্রুত দেখা যাবে।”
ওরা একে একে ফাইল উলটে চলল। হঠাৎ অরণি হাসানকে ডাক দিল। “হাসান দেখো তো এটা হতে পারে।”
হাসান অরণির হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে ওপরের তারিখটা দেখল, “১৯৬৪। এটা নিশ্চয়ই নিয়োগের বছর। হতে পারে।” হাসান অরণির দেখা ফর্মটা পড়তে লাগল। নাম মনিরুজ্জামান খান। শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ। বাড়ি : গাজীপুর। থানা : রাজবাড়ি। পো : রাজবাড়ি। স্থায়ী ঠিকানা… অরণি একটা কলম বের করো ঠিকানাটা লিখে নাও।”
অরণি ব্যাগ থেকে কলম আর একটা প্যাড বের করে বলল, “বলো।”
“খান লজ, হাশেমপুর, রাজবাড়ি, গাজীপুর। লিখেছ?”
“হ্যাঁ,” অরণি ঠিকানাটা লিখতে লিখেতে বলল, “হাসান মা’কে বড় করেছিলেন যিনি তার বাড়িও গাজীপুর ছিল। তার মানে গাজীপুরের সাথে কোনো না কোনো কানেকশন আছে পুরো ব্যাপারটার।
“হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে,” হাসান ফাইলটা রেখে দিচ্ছিল টুপ করে ভেতর থেকে ছোট একটা কিছু পড়ে গেল। অরণি মেঝে থেকে তুলে নিল জিনিসটা।
“কী ওটা?” হাসান জানতে চাইল। পুরানো একটা পাসপোর্ট সাইজ সাদাকালো ছবি। একটা পাশ যেখানে পিন মারা ছিল জায়গাটা মরচে পড়ে গেছে। “ও মনে হয় কোনো একটা ফর্ম থেকে পড়ে গেছে। রেখে দাও। আমাদের কাজ হয়ে গেছে।”
অরণি ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। “হাসান?”
“কী?”
“ছবিটা ভালোভাবে দেখো,” বলে অরণি ছবিটা হাসানের দিকে বাড়িয়ে দিল। হাসান ছবিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখতে দেখতে শিস দিয়ে উঠল “আশ্চর্য।” ছবিটা এক যুবকের। মনে হয় ভার্সিটিতে জয়েন করার সময়ে তোলা। যদিও পাসপোর্ট সাইজের ছবিতে পরিষ্কার বোঝা সম্ভব না তবুও ছবির যুবকের চেহারার সাথে অরণির মায়ের চেহারার বেশ মিল। “তার মানে এই মনিরুজ্জামান লোকটা ম্যাডামের বাবা হওয়ার জোর সম্ভবনা আছে।”
অরণি কোনো জবাব দিল না। “চলো, আমাদের বেরোনো উচিত,” বলে অরণি হাসানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ছবিটা দাও, ওটা আমি রেখে দেব।”
“ঠিক আছে,” বলে হাসান ফাইলটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিল। বাইরে এসে দেখে চাচা দাঁড়িয়ে আরেক লোকের সাথে কথা বলছে। “কাজ হইছে ভাতিজা?”
“জি চাচা, আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। কী পান খাবেন বলেন। আজ তো পারব না আমি আরেকদিন নিয়া আসব।”
“হা হা, লাগবো না ভাতিজা তুমি খাওয়াইতে চাইছো এতেই হইবে।”
“ঠিক আছে চাচা। আজ আসি,” চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজনেই বেরিয়ে এলো বাইরে।
“অরণি তুমি কল্পনাও করতে পারবা না আমরা কী পরিমাণ দ্রুত কাজটা সম্পন্ন করতে পেরেছি। স্বাভাবিকভাবে এই কাজটা করতে মিনিমাম সাত দিন লাগার কথা। উফফফফ।”
অরণি চুপ হয়ে আছে। সে মনে মনে এই মনিরুজ্জামান মানুষটার কথা ভাবছে। এই লোকটা কি সত্যিই মা’র বাবা ছিলেন। কী ঘটেছিল আসলে তার ভাগ্যে? ২৫শে মার্চে আসলে হয়েছিল কী? ও কি সত্যিই তাহলে মা’কে ভুল বুঝেছিল?
“অরো, তোমার কি মন খারাপ লাগছে?”
“নাহ,” অরণি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল। “দ্রুত চলো। আমাদেরকে এখন গাজীপুর যেতে হবে।”
হাঁটতে হাঁটতে কার্জনের গেটের কাছে এসে দেখে গাড়িটা নেই। “কী ব্যাপার, ওরা আবার গেল কই?”
“হাসান,” আহমদ বশিরের গলা শুনে হাসান ডানে ফিরে তাকাল। গাড়িটা রাস্তার অন্য পাশে পার্ক করা। ওরা গাড়িতে গিয়ে উঠতে উঠতে আহমদ বশির জানতে চাইল, “কাজ হয়েছে?”
“হ্যাঁ, অনেক কষ্টে।”
“উফফফ আমি তো ভাবছিলাম আর হবেই না। যাক ঠিকানাটা পেয়েছ? কোথায়?”
“রাজবাড়ি, গাজীপুর, হাশেমপুর নামে একটা গ্রামে। আমরা কি এখন ওখানেই যাব?” অরণি জানতে চাইল।
“আমার তো মনে হয় ওখানেই এখন আমাদের যাওয়া উচিত। ওখানেই আমার ধারণা সব প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে।”
“হ্যাঁ আমারও তাই মনে হয়,” অরণি জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে বলল।
.
তারা দুজনেই উত্তরাতে একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। এসপি আতিকুর রহমানের পরনে সাধারণ পোশাক। সে বারবার তার সামনে বসে থাকা মানুষটাকে দেখছে। মানুষটার একটা হাত স্লিঙে ঝোলানো। ঠিক তার পেছনে দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ, তার বডিগার্ড।
আতিকুর রহমান ঘন কড়া কফিতে বারবার চুমুক দিতে গিয়ে জিভ পুড়িয়ে ফেলেছে। তার চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। প্রচণ্ড পরিশ্রম আর না ঘুমানোর ক্লান্তি। তিন্তু তার মাথায় ঘুরছে অন্য ব্যাপার। বিগত প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে এই মানুষটি তাকে যে কাহিনি শুনিয়েছে সেটার লোভ সে এখনও পুরোপুরি মাথায় নিতে পারেনি। পুরো ব্যাপার শুনে এবং সেটার সাথে তার গতকাল সারাদিনের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে সে একটা বাস্তব চিত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।
“অফিসার আপনি কি পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন?” আফতাব মাহমুদ জানতে চাইল।
“হুমমমম,” আতিকুর রহমান মাথা তুলে তার দিকে তাকাল। “আপনি যা বললেন তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বলতে হয় ওরা খুব বিপদে আছে।”
“একদম ঠিক বলেছেন।”
“শুধু সেটাই না, আরও অনেক বড় ঘটনা ঘটে যাবে।”
“অফিসার আপনি কি আমাকে এবং ওদেরকে হেল্প করবেন না?”
“অবশ্যই কিন্তু এই মুহূর্তে আমি অফ ডিউটিতে আছি এবং আমাকে এই কেস থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
“তাতে কী? আপনার কর্তব্যজ্ঞান থেকে তো আপনি সরে যাননি।“
“আপনি কি শিওর ওরা এখন ওখানেই যাবে?”
“আমি শিওর অফিসার। আফরোজা শেষ মুহূর্তে গাজীপুর গিয়েছিল। আমার ধারণা ওরাও যাবে। পুরো রহস্যটার সমাপ্তি ওখানেই হবে।”
“ঠিক আছে চলুন আমরা রওনা হয়ে যাই। আর দেখি আমি কী করতে পারি।”
.
তার পুরো টিম প্রস্তুত হয়ে আছে সেই ভোর থেকে। তারা অপেক্ষা করছিল একটা ছোট্ট আদেশের। একটা খুদে বার্তার মাধ্যমে সেটা এইমাত্র এসে পৌছাল। সেখানে একটা ঠিকানা লেখা। ওখানে তাকে পুরো টিম নিয়ে যেতে হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী আদেশের। সে তার টিমের উদ্দেশে বলল, “আদেশ এসে গেছে। সবাই জানো কী করতে হবে,” বলে সে তার টিমের প্রত্যেকের দিকে একবার করে তাকাল। প্রত্যেকেই অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত, প্রত্যেকেই তার আদেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।
“সবাই গাড়িতে ওঠো। আমরা গাজীপুর যাব।”