২৫শে মার্চ – ৩১

৩১

বর্তমান সময়, ভোর ৪টা

এসপি আতিকুর রহমান ক্লান্ত এবং শ্রান্ত পায়ে নিজের রুমে এসে ঢুকল। বাসায় কেউ নেই। থাকার কথাও না। তার স্ত্রী ছেলেটাকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। নিজেকে তার খুব বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। তার দীর্ঘ সাত বছরের পুলিশি জীবনে এত বড় ব্যর্থ দিন আর কখনো আসেনি। এই ভয়ংকর চ্যালেঞ্জিং ক্যারিয়ারে সে টিকে আছে নিজের সততা, উদ্যম আর একরোখা জেদ নিয়ে যেখানে সবজায়গাতে জঙ্গলের আইন চলে সেখানে কাউকে তেল না মেরে এক পয়সা ঘুস না খেয়ে টিকে থাকাটা যে কত কষ্টের একমাত্র সে-ই জানে। আজ পর্যন্ত কোনো কেসে কোনো অ্যাসাইনমেন্টে সে ব্যর্থ হয়নি। আর আজ একদিনে সে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। সে কাপড় ছেড়ে শাওয়ার নিল। তারপর এক কাপ কফি বানিয়ে বারান্দায় এসে বসল, একটা সিগারেট ধরিয়ে।

গতকালকের দিনটা ছিল তার জন্য ব্যর্থতম দিন, আর আজকের দিনটা হবে সবচেয়ে গ্লানিময় দিন। তার ডিপার্টমেন্টে বহু লোকজন আছে যারা তাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলার জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছে। এতদিন তারা কোনো সুযোগ পায়নি, আজ পেয়ে গেছে। কী কী ধরনের সম্ভাব্য বিপদ তার ওপর আসতে পারে হিসাব করতে করতে সে ঘুমিয়ে গেল।

হঠাৎ মোবাইলের রিং বাজার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। একবার ভাবল না দেখে কলটা সাইলেন্ট করে ঘুমায়। কারণ সে প্রায় নিশ্চিত এটা ডিপার্টমেন্টের কারও কল। পরমুহূর্তেই ভাবল ঝামেলার মুখোমুখি যদি হতেই হয় তবে এখন থেকেই নয় কেন। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল আননোন একটা নম্বর। সে কলটা রিসিভ করে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিল, “হ্যালো।”

“হ্যালো,” অপর প্রান্ত থেকে ভারি একটা কণ্ঠ জবাব দিল। “অফিসার আতিকুর রহমান বলছেন?”

“জি, বলছি,” কণ্ঠটা সে চিনতে পারেনি। “আপনি কে বলছেন? প্লিজ।”

“আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না। আমার নাম আফতাব মাহমুদ। পেশায় আমি একজন শিক্ষক এবং সায়েন্টিস্ট। আমি এয়ারপোর্ট থেকে বলছি। এইমাত্র আমি মালয়েশিয়া থেকে এলাম।”

“আপনি আমাকে কেন কল করেছেন বললে ভালো হতো,” আতিকুর রহমান যারপরনাই বিরক্ত। তার ধারণা কোনো সুপারিশ কল। কিন্তু এত সকালে কেন। “আমি আসলে ঘুমাচ্ছিলাম।”

“আমার মনে হয় আমি আপনাকে এমন কিছু তথ্য দিতে পারব যেটা আপনার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার।”

“মানে?” আতিক সাহেব ধড়মড় করে উঠে বসল।

“আমার কাছে আফরোজা আক্তার শায়লার খুনের ব্যাপারে তথ্য আছে এবং আমার মনে হয় আপনি যাদেরকে খুঁজছেন তারা কোথায় আছে আমি জানি।”

“আপনি এখন কোথায়?”

.

জীবন কখনোই সহজ নয়। বিশেষ করে তার মতো একজন মানুষের জন্য। পুরান ঢাকার বস্তি থেকে উঠে আসা সেই ছেলেটার দিকে যখন সে ফিরে তাকায় তখন কেন জানি মাঝে মাঝে খুব আফসোস হয়। মাঝে মাঝে কেন জানি মনে হয় এই ভয়ংকর পথে না এসে সাধারণ জীবনযাপন করতে পারত। কিন্তু এখন আর সে উপায় নেই। তবে এখনও সে মাঝে মাঝে ভাবে একদিন সে কোথাও চলে যাবে। প্রচুর টাকা তার বাইরের ব্যাংকে জমানো আছে। হয়তো কোনো একদিন এই ভয়ংকর জীবন ছেড়ে এমন কোনো শান্তির জীবন বেছে নিতে পারবে যেখানে এত হাঙ্গামা-হুজ্জত থাকবে না।

ওয়ারির ওই বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসা তার জন্য ছিল ভয়ংকর একটা ব্যাপার। বাড়িটাতে যখন পুলিশ ঢুকছিল প্রথমে সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কী করবে। তার পরে ব্যাপারটা মোটামুটি সহজ একটা সমাধান তার চোখে পড়ে। সে সেটাই করে যেটা তাকে নির্দেশ করা হয়েছে। তবে বোমাটা ছুড়ে দেওয়ার পর ছেলে আর মেয়েটাকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে সে নিজেই আটকা পড়ে যায় স্টাডিটার ভেতরে। সামনের দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দেওয়া হয়। একদল পুলিশের সাথে সে-ও আটকা পড়ে ওই রুমে। তার কপাল ভালো জায়গাটা খোলা স্টাডি ছিল, আর ওই এক অফিসার বাদে বাকি সবাই ছিল হাদা কিসিমের। ধোঁয়া আর গন্ডগোলের সুযোগে স্টাডির পেছনের দরজা দিয়ে চলে আসে বাড়ির পেছন দিকে। সেখান থেকে দেয়াল টপকে রস্তায় বেরিয়ে আসে। তারপর গাড়িটার কাছে এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করে দেখে গাড়ির ব্যাপারটা পুলিশ বা অন্য কেউ বুঝেছে কি না। তার গাড়িটাকে কেউ খেয়াল করেনি বুঝতে পেরে সে গাড়িতে উঠে চলে আসে মূল রাস্তায়। সে গাড়িটাকে চালিয়ে কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছিল না তখনই মোবাইলে এসএমএস-এ নির্দেশ আসে ‘গ্যাদার ইউর টিম, ওয়েট ফরম মাই কমান্ড’।

ব্যাস এবার তার কাজ পরিষ্কার। এখন তার নিজের টিমকে একসাথে করতে হবে। এরপর অপেক্ষা করতে হবে নির্দেশের। তার ধারণা এবার খেলা সাঙ্গ করার সময় চলে এসেছে। যেকোনো সময় শেষ খেলা শুরু হয়ে যাবে।

সেখান থেকে টানা গাড়ি চালিয়ে চলে আসে আদাবরে নিজের এই বিশেষ বাড়িটাতে। এই বাড়িটাকে সে বলে ‘ব্যাকআপ হোম’। যেকোনো পরিস্থিতিতে সে এই বাড়িটাতে এসে আশ্রয় নেয়। দেড় শতাংশ জায়গার ওপরে এই ছোট্ট হাফ বিল্ডিং বাড়িটা প্রায় সারা বছরই খালি থাকে, শুধুমাত্র কেয়ারটেকার ছাড়া। এলাকার সবাই জানে এর মালিক দেশের বাইরে থাকে, মাঝে মাঝে দেশে আসে। এখানে মোটামুটি তার প্রয়োজনীয় সবই আছে। তার টিমের লোকজনও যখন একসাথে হওয়ার প্রয়োজন হয় এখানেই আসে। বাড়ির কাছে এসে কেয়ারটেকারকে কল করে গেটটা খুলতে বলল সে। বাড়িটাতে ঢুকে প্রয়োজনীয় কয়েকটা কল করল। এরপর ফ্রেশ একটা গোসল দিয়ে এক রাউন্ড খেয়ে নিল।

তার টিমের সবাই আসতে ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে। এই সময়টা সে বিশ্রাম নেবে।

.

“হায়দার তুমি ঠিক আছ?” আহমদ বশির বেশ উদ্‌বেগের সাথে গাড়ি ড্রাইভ করতে থাকা হায়দারের কাছে জানতে চাইল।

“জি চাচা,” জবাব দিয়ে হায়দার মনে মনে জিভ কাটল। আহমদ বশির তার চাচা হলেও জনসমক্ষে সে কখনোই তাকে চাচা ডাকে না, সবসময় স্যার বলেই ডাকে।

“আপনার হাত থেকে রক্ত পড়ছে,” হাসান বলল। লোকটার প্রতি তার সব রাগ পানি হয়ে গেছে। লোকটা যে খেল দেখাল ওয়ারিতে, এরপর সে লোকটার ফ্যান হয়ে গেছে বললেও ভুল বলা হয় না।

“ব্যাপার না, তেমন একটা লাগেনি, গুলিটা স্রেফ ছুঁয়ে গেছে,” হায়দার আলি জবাব দিল।

অরণি কথা বলছে না, সে মনোযোগ দিয়ে চাচার দেখভাল করার চেষ্টা করছে। লোকটা একদম নির্জীব হয়ে গেছে ওয়ারির ঘটনার পর। এখন চোখ বুজে শুয়ে আছে। তবে ওদের সবার অবস্থাই খারাপ। ওয়ারির ঘটনার পর সবাই কেমন যেন নেতিয়ে গেছে। বিশেষ করে শেষ মুহূর্তের ঘটনায় সবার এত উত্তেজনা গেছে, তাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সবাই। আহমদ বশিরকেও দুর্বল লাগছে।

“স্যার, কোনদিকে যাব এখন?” হায়দার আলি জানতে চাইল।

“ধানমন্ডিতে চলো। আট নম্বরের অ্যাপার্টমেন্টটা খালিই আছে। ওখানে গিয়ে আগে তোমার ক্ষতের পরিচর্যা করতে হবে। আর সবার একটু হলেও বিশ্রাম দরকার,” আহমদ বশির চোখ বন্ধ করেই জবাব দিল। “ওখানে গিয়ে সবাই ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিয়ে আমার পরবর্তী কাজের প্ল্যান করব।”

 “জি স্যার,” হায়দার গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল।

অরণি এবার ভাবল কিছু বলে কিন্তু সবার কথা চিন্তা করে চুপ হয়ে গেল। বাকি সবার কথা বাদই থাক, তার নিজের অবস্থাও খারাপ। চাচা মনে হয় ঘুমিয়েই গেছে, সে নিজেও চোখ বন্ধ করল।

রাতের ঢাকার ফাঁকা রাস্তায় বিশ মিনিটের ভেতরেই চলে এলো ওরা ধানমন্ডি আট নম্বরে। বিরাট একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। “এত রাতে আমরা যে এলাম, সমস্যা হবে না?” অরণি জানতে চাইল।

“আরে নাহ, এই অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের মালিক আমি। বেশিরভাগ ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেওয়ার পর আমারগুলো সব ভাড়া দেওয়া। এই একটা অ্যাপার্টমেন্ট একদম টপ ফ্লোরে আমি রেখে দিয়েছি। মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকি। আসলে আমার আসাই হয় না। দেশের বাইরে থেকে আমার ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিরা এলে ওরা থাকে।”

“আর মাঝে মাঝে কিছু বিজনেস ডিল করার জন্য এটাকে অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন তাই না?” প্রশ্নটা হাসানের। কারণ সে যখন বশির সাহেবের নামে রিপোর্ট করার জন্য খোঁজখবর নিচ্ছিল তখন শুনেছিল এখানে নাকি তার চোরাকারবারির সব ডিল হয়। আর হোটেল পূর্বানিতে তার নামে একটা সুইট সারা বছরের জন্য ভাড়া নেওয়া আছে।

“হাসান, সাংবাদিকদের নিয়ে বিখ্যাত ওই কৌতুকটা শুনেছ?” আহমদ বশির মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বলল।

হাসান রেগেমেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ওদের গাড়ি অ্যাপার্টমেন্টের পার্কিং লটে প্রবেশ করল। রাতের দারোয়ান ঝিমাচ্ছিল, গাড়িটা দেখে লাফ দিয়ে উঠে গেট খুলে দিল। সে গাড়িটাকে ভালো করেই চেনে।

ওরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে এসে লিফটে উঠল। অ্যাপার্টমেন্টটা একদম টপ ফ্লোরে। একদম ওপরে হওয়ায় দারুণ একটা ভিউ পাওয়া যায়।

হায়দার কেয়ারটেকারের কাছ থেকে চাবি আনতে গেছে ওরা সবাই টেরেসে এসে দাঁড়াল।

“দারুণ না?” আহমদ বশির জানতে চাইল।

“সত্যিই চমৎকার,” অরণি জবাব দিল।

“এটাকে অ্যাপার্টমেন্টের লোকজন নিয়ম অনুযায়ী কমিউনিটি হল করতে চেয়েছিল। আমাকে ওদের সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। হা হা।”

হায়দার চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিলে ভেতরে চলে এলো সবাই। অ্যাপার্টমেন্টটা ছোট। বড়জোর আটশ বা নয়শ স্কয়ার ফিট হবে সাইজে কিন্তু চমৎকার ইন্টেরিওর। সবকিছু সুন্দর করে সাজানো।

“সবাই ফ্রেশ হয়ে নাও,” বলে আহমদ বশির হায়দারের দিকে ফিরল। “হায়দার তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর মেডিকেল কিটটা নিয়ে এসো। দেখি আমিই তোমার ক্ষতটা দেখে দিতে পরব।”

“আমার মনে হয় সেটা আমি ভালো পারব। আমার ফার্স্ট এইড ট্রেনিং আছে,” অরণি বলল।

“ঠিক আছে। সবাই ফ্রেশ হও, তারপর আমরা খেয়ে বিশ্রাম নেব।”

আধাঘণ্টার ভেতরে অরণি ফ্রেশ হয়ে চলে এলো ডাইনিংরুমে। ফার্স্ট এইড কিটটা নিয়ে বসে গেল হায়দার আলির ক্ষতটার যত্ন নিতে। পরীক্ষা করে দেখল হায়দার ভুল বলেনি ওটা আসলেই খুব একটা গভীর না। গুলিটা স্রেফ ছুঁয়ে গেছে। তারপরও সেলাই লাগবে। অরণি বিটাডিন দিয়ে ক্ষতটা পরিষ্কার করে সেলাই করে দিল। “একটু সবধানে থাকবেন, আর এই দুটো খেয়ে নিন,” বলে ও দুটো ওষুধ বাড়িয়ে দিল। মৃদু স্বরে ধন্যবাদ দিয়ে বড়ি দুটো গিলে ফেলল হায়দার আলি।

হাসান আর আহমদ বশির ডাইনিংরুমে এলো। অরণি হাসানের কাছে জানতে চাইল, “চাচার কী অবস্থা?”

“ঘুমিয়ে পড়েছেন, একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার আমি আর ডাকিনি।

“ভালোই করেছ। বেচারা আমাদের জন্য অনেক ঝক্কি পোহাচ্ছে। এরপর আমরা যা-ই করি তাকে আর টানাহেঁচড়া করা ঠিক হবে না। তিনি এখানেই বিশ্রাম নিতে পারবেন। কোনো সমস্যা নেই তো?” ও আহমদ বশিরের দিকে তাকিয়ে বলল। আহমদ বশির মাথা নাড়ল।

“কিন্তু একটা সমস্যা আছে,” হাসান বলল। “যদি ওই অফিসার বশির স্যারের সম্পদের একটা লিস্ট করেন সহজেই এটার ব্যাপারে জানতে পারবেন। হয়তো সার্চ করতেও চলে আসবে। তখন চাচা বিপদে পড়বেন। তার চেয়ে তিনি সম্পূর্ণ ব্যাপারটার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাক।”

“ঠিক আছে, সেটা ভাবা যাবে সময় এলে। এখন আমাদের ভাবা দরকার এরপর আমাদের কাজের পরিকল্পনা কী?” আহমদ বশির বলল।

“আমার মনে হয় এখন ওই অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া উচিত,” হাসান বলল।

“হ্যাঁ, আমার ধারণা সব রহস্যের গোড়া নিহিত আছে ওখানেই। তাই আমাদের ওই ব্যাপারেই আগে খোঁজ নেওয়া উচিত।”

“তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ঠিকানার জায়গায় লেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা শিক্ষক কোয়ার্টার। নিশ্চয়ই এখন ওখানে নেই। থাকার প্রশ্নই ওঠে না।”

“আমার মনে হয় এই ভদ্রলোক একাত্তরে খুন হয়েছিলেন এবং সম্ভবত তার ডায়েরিটা লেখা ছিল ২৫শে মার্চ পর্যন্ত। খুব জোরদার সম্ভবনা আছে তিনি ২৫শে মার্চ রাতেই খুন হয়েছিলেন পাকিস্তানিদের হাতে।”

“আমার মনে হয় এই ভদ্রলোকের কাছে ছিল সেই ঐতিহাসিক ঘটনার ব্লু যেটা তিনি পরবর্তীতে কাউকে না কাউকে দিয়ে গিয়েছিলেন। তার মানে আমাদের এই লোকের কাউকে খুঁজে বের করতে হবে এবং সেটা করতে হলে আমাদেরকে তার অরিজিন খুঁজে দেখতে হবে। তার গ্রামের বাড়ি বা স্থায়ী ঠিকানা এরকম কিছু একটা।”

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সব ধরনের তথ্য থাকে কোথায়? রেজিস্ট্রার বিল্ডিঙে? নাকি অন্য কোথাও?” অরণি জানতে চাইল।

“রেজিস্ট্রার বিল্ডিঙে আমার পরিচিত এক লোক আছে। তাকে ফোন দিলেই আমি জানতে পারব। তবে এখন তো আর ফোন দেওয়া যাবে না। তাকে সকালে ফোন দিতে হবে,” হাসান বলল।

“ঠিক আছে, তাহলে সকালেই আমরা কাজ শুরু করে দেব। সবাই একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। আমরা খুব ভোরেই কাজে হাত দেব। আর এখানে খুব বেশিক্ষণ রেস্ট করাটা একদম বোকামি হবে। হাসানের পরামর্শটা যদি আমরা ঠিক ধরে নেই। ওই অফিসারের পক্ষে এই অ্যাপার্টমেন্টের সন্ধান করাটা খুব একটা কঠিন হবে না। তো সবাই এখন যাও। ঠিক আটটার ভেতরেই সবাই রেডি হয়ে যাবে। আমরা সাড়ে আটটার ভেতরেই বেরিয়ে যাব। ওকে

সবাই যার যার মতো শুয়ে পড়ল। অরণি বিছানায় শুয়ে মনে মনে ভাবল ঘণ্টা তিনেক সময় আছে ঘুমানোর মতো। এটাই বা খারাপ কি।

.

হাসানের ঘুম ভেঙে গেল আহমদ বশিরের ডাকে। হাসান চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল। ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়ে আরও ক্লান্ত লাগছে যেন। আড়মোড়া ভেঙে সে উঠে বসল। আহমদ বশির তার সামনে দাঁড়িয়ে, পরনে জিন্স আর একটা সাদা স্ট্রাইপ পলো। “উঠে পড়ো। তুমি অরণিকেও ডেকে ওঠাও। আমাদেরকে বেরোতে হবে,” বলে সে চলে যাচ্ছিল হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। “আচ্ছা আমার একটা প্রশ্ন আছে। তখন উত্তেজনার কারণে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। প্রশ্নটা আমাকে বেশ খোঁচাচ্ছে,” বলে আহমদ বশির হাসানের দিকে দেখল।

“কী প্রশ্ন?” হাসান বলল।

“আচ্ছা ওই লোকটা যে স্টাডিতে এসে হাজির হয়েছিল। এই লোকটা কে?”

“ওহহহ আমারও মনে নেই। এই লোকই সেই লোক যে আমাদেরকে সবখানে ফলো করেছে। এখন পর্যন্ত আমরা যেখানেই গেছি সে আমাদের সাথে সাথে হাজির হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে আমাদেরকে সাহায্যই করে যাচ্ছে।”

“আশ্চর্য ব্যাপার এই লোকটা তোমাদেরকে সবসময় খুঁজে বের করছে কীভাবে? নিশ্চয়ই সে তোমাদেরকে কোনো না কোনোভাবে বাগ করেছে।”

“বাঘ?” হাসান বলল। “ও বাগ? মানে ছারপোকা? হায় হায়। তাই তো।”

আহমদ বশির তার দিকে তাকিয়ে আছে। “হাসান তুমি আর অরণি, তোমাদের সব জিনিসপত্র চেক করো। এক্ষুনি।”

হাসান দৌড়ে চলে এলো অরণি যে রুমে ঘুমিয়েছে ওখানে। অরণিকে ডেকে তুলল প্রায় সাথে সাথেই। এত ক্লান্ত থাকার পর এত অল্প ঘুম থেকে কাউকে ডেকে তোলা বেশ কঠিন একটা কাজ।

“অরো, ওঠো ওঠো,” কয়েকবার ধাক্কা দেওয়ার পর অরণি চোখ খুলল ধীরে ধীরে।

ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “এত তাড়াতাড়ি সকাল হয়ে গেল?”

“অরণি এক্ষুনি আমাদের জিনিসপত্র সব চেক করতে হবে। তোমার ব্যাগটা কোথায়?” অরণি ইশারায় টেবিলের ওপর রাখা ব্যাগটা দেখাল। ব্যাপার? কী হয়েছে?” অরণি উঠে বসতে বসতে জানতে চাইল।

হাসান জবাব না দিয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে টেবিলের ওপরটা খালি করল। ব্যাগের চেন খুলে সব ঢেলে দিল টেবিলের ওপর। “আরে আরে করছ কী?” অরণি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মেয়েরা তাদের হ্যান্ডব্যাগের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর হয়। অরণিও তার ব্যতিক্রম নয়।

হাসান ব্যাগটা টেবিলের ওপর ঢেলে দিয়ে জিনিসপত্রগুলো ঘেঁটে দেখছে। হঠাৎ একটা কয়েনের মতো জিনিস তুলে নিল টেবিলের ওপর থেকে। জিনিসটা দেখতে অনেকটা ক্যালকুলেটরের চ্যাপ্টা ব্যাটারির মতো।

“সর্বনাশ,” বলে সে অরণির দিকে তাকাল।

“কী ওটা?” অরণি জানতে চাইল। ঠিক এমন সময় আহমদ বশির রুমে ঢুকল।

“মি. বশির সত্যিই অরণির ব্যাগে একটা বাগ রাখা আছে। তার মানে আমাদের শত্রু যারাই হোক তারা শুরু থেকেই আমাদের ফলো করছে এবং এখনও তারা জানে আমরা কোথায়।”

“ওটা আমার কাছে দাও,” বলে আহমদ বশির জিনিসটা নিয়ে মাটিতে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে ফেলল। “চলো আমাদের এক্ষুনি এই জায়গা ত্যাগ করা উচিত।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *