২৫শে মার্চ – ২৮

২৮

রাজারবাগ পুলিশ লাইন,
ঢাকা ২৬শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : রাত প্রায় ৪টা

জিপের ক্রমাগত ঝাঁকুনিতে মনিরুজ্জামানের সামান্য ঘুম চলে আসছিল। কিন্তু শারীরিক যন্ত্রণা আর মাথার ভেতরের দুঃশ্চিন্তা তাকে ঘুমাতে দিল না। ক্লান্ত শরীর ঝিমিয়ে আসতে চায় আর বিক্ষিপ্ত মন চায় সজাগ থাকতে। এ যেন মন—মস্তিষ্ক আর শরীরের ভেতরে এক অদ্ভুত টাগ অভ ওয়ার। কথাটা মনে হতে তার এই বিপদের ভেতরেও মৃদু হাসি পেল।

তারা আর্মি জিপের পেছনে বসে আছে। কবির আর আবুর দিকে তাকাল সে। আবুর ঠোঁটের কোণা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, কপালের একটা পাশ ফুলে আছে। কবিরও বিধ্বস্ত কিন্তু তাকে দেখে মনে হলো না খুব একটা ভয় পেয়েছে সে।

মনিরুজ্জামান রাস্তার দিকে ফিরে তাকাল। এখন তারা রাজারবাগের দিকে যাচ্ছে। টিচার্স কোয়ার্টারে কর্নেল যখন তাদের সাথে কথোপকথন চালাচ্ছিল তখনই তাদের ওপর নির্দেশ আসে সকল বন্দিদেরকে রাজারবাগে নিয়ে রিপোর্ট করতে হবে। সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি নাকি রাজারবাগে অবস্থানরত সব পুলিশকে মেরে সেটার দখল নিয়ে নিয়েছে।

নির্দেশ পেয়ে কর্নেল তাদেরকে জিপে নিয়ে তোলার নির্দেশ দেয়। রুম থেকে বেরোনোর সময়ে কর্নেল মনিরুজ্জামানের দিকে ফিরে বলে, “আমি আপনাকে হেল্প করতে চেয়েছিলাম কিন্তু একবার ওখানে গেলে আপনি নরক দেখতে পাবেন। সেই সাথে আপনার এই দুই ছাত্রকেও আর বাঁচাতে পারবেন না। ওখানে আপনাদের মৃত্যু হবে অনেক যন্ত্রণাময় এবং দীর্ঘ। কাজেই এখনও সময় আছে। বলে ফেলুন।।”

মনিরুজ্জামান চুপ ছিল। যেটা জানে না সেটা সে বলবে কীভাবে। কর্নেল রেগে গিয়ে ওদেরকে গাড়িতে তোলার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তারও মাথায় একটাই চিন্তা, জিনিসটা গেল কোথায়?

মনিরুজ্জামান রাস্তার দিকে ফিরে তাকাল। গাড়ি রাজারবাগের দিকে যাচ্ছে। দূরত্ব আর বেশি নেই। তাদের জিপের ঠিক সামনেই একটা মিলিটারি ট্রাক। ট্রাক ভরতি মেয়ে আর মহিলা। মনিরুজ্জামান খেয়াল করে দেখল বাচ্চা মেয়ে থেকে শুরু করে চলিল্লশোর্ধ্ব মহিলা পর্যন্ত কেউই বাদ যায়নি এই হায়েনাদের কবল থেকে। ওদেরকে জিপে তোলার সময়ে সে দুই সৈন্যের কথোপকথন থেকে জানতে পেরেছে এই মেয়েদেরকে ধরে আনা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল আর আবাসিক এলাকা থেকে। সমস্ত ঢাকা শহর থেকেই নাকি এরকম মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন আর ক্যান্টনমেন্টে। মনিরুজ্জামান মনে মনে ভাবল, এই মেয়েদেরকে একবার ওই নরকে নিয়ে ঢোকালে এদের ভাগ্যে কী ঘটবে কে জানে।

সামনের ট্রাকটা দাঁড়িয়ে যেতে সে দেখল ট্রাকে বসে থাকা প্রতিটা মেয়ে ভয়ে আতঙ্কে কাঁপছে। অনেকেই কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। ফ্রক পরা একটা পিচ্চি মেয়েকে দেখল বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে একটা বই। মাথার দুপাশে বেণি দুলিয়ে কাঁদছে। আহারে না জানি কোন বাপের আদরের সন্তান এই হায়েনাদের কবলে পড়েছে। সামনের ট্রাকটা আবারও চলতে শুরু করেছে।

“আপনি খুবই আনইউজুয়াল একজন মানুষ মি. জামান,” কর্নেল সামনের সিট থেকে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল। “এইরকম একটা পরিস্থিতিতেও আপনি নিজের কথা চিন্তা না করে অন্যদের কথা ভাবছেন,” বলে কর্নেল হাসল। “ভাবছেন, আমি আপনার মনের কথা কীভাবে বুঝলাম? এটা আমার জন্মগত একটা ক্ষমতা। আমি মানুষের মনের কথা পড়তে পারি। আর পরবর্তীতে আমি এই ক্ষমতা চর্চা করে আরও বৃদ্ধি করেছি। এটা করতে পারি দেখেই আমি এত ভালো একজন ইন্টেলিজেন্স অফিসার।”

মনিরুজ্জামান ত্যাচরা একটা হাসি দিল।

“ভাবছেন আমার জ্ঞাতি ভাইদের মতো আমিও উন্নাসিক? মোটেই না। এখন পর্যন্ত সবচেয় কঠিন আর দুর্বোধ্য কেসগুলো আমাকে দেওয়া হয়েছে ইন্টেলিজেন্স থেকে এবং আমি একবারও ব্যর্থ হইনি।”

“সবসময়ই প্রথমবার বলে একটা কথা থাকে,” মনিরুজ্জামান এখনও ত্যাচরা হাসিটা ধরে রেখেছে।

“আমার ক্ষেত্রে নেই,” বলে সে মনিরুজ্জামানের দিকে ফিরে তাকাল। “মি. জামান আপনি বুঝতে পারছেন না। রাজারবাগে আপনাকে নিয়ে গেলে একটা ইন্টারোগেশনের পর আমি আর কিছুই করতে পারব না। আমার আপনাকে মিলিটারির কাছে হস্তান্তর করতে হবে। এখনও সময় আছে, বলে দিন। আমি আপনাকে বাঁচাতে হয়তো পারব না কিন্তু পরিচ্ছন্ন একটা মৃত্যু দিতে পারব এবং আপনার এই দুই ছাত্র এবং আপনার পরিবারকে যেন কিছু করা না হয় সে ব্যবস্থা করতে পারব।”

“ধন্যবাদ। আপনাদের কাছ থেকে গত তেইশ বছরে অনেক কিছু পেয়েছি আর চাই না,” মনিরুজ্জামান কথাটা বলে মুখ ফিরিয়ে নিল। সে বুঝতে পেরেছে এইমাত্র নিজের কবর রচনা করল।

ওরা রাজারবাগে চলে এসেছে। রাজারবাগের গেটের সামনে মিলিটারিরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল। মনে হয় তাদের কাছে আগেই খবর চলে গেছে ট্রাক ভরতি মেয়েরা আসছে। সামনের ট্রাকটা থামতেই মিলিটারিরা ফেটে পড়ল উল্লাসে। মনিরুজ্জামানের কাছে মনে হলো একপাল হায়না যেন লোভনীয় খাবার পেয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছে। হায়নারাও তবু ক্ষেত্রবিশেষে বাছবিচার করে, এরা করল না। ট্রাকটা থামতেই মিলিটারিরা মেয়েদেরকে ট্রাক থেকে টেনে নামাতে লাগল গরুর পালের মতো।

চক্ষুলজ্জাও করল না সবার সামনে। ট্রাক থেকে নামানোর আগেই টেনে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল মেয়েগুলোর গায়ের কাপড়। চুলের মুঠি ধরে, কাঁধে তুলে, বন্দুকের বাঁট দিয়ে পেটাতে পেটাতে, বেয়োনেট দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে মেয়েগুলোকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে চলল। মনিরুজ্জামান সহ্য করতে না পেরে চোখ ফিরিয়ে নিল। এত বীভৎসতা সহ্য করা যায় না। সৈনিকদের জান্তব উল্লাস আর মেয়েগুলোর করুণ আর্তনাদ যেন গরম লোহার শিকের মতো তার কানে খোঁচা দিতে লাগল। সে চোখ ফিরিয়ে নিল গাড়ির ভেতরে। আবু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর কবির তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।

মনিরুজ্জামান আবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “সাহস হারাস না।” বলে মুখটা ফিরিয়ে নিল। ভেতরে ভেতরে নিজেই ভয়ে কাঁপছে, ওকে কী সাহস দেবে। সে আবার চোখ তুলে সামনের দিকে তাকাল। মিলিটারির দল ভেতরে অদৃশ্য হয়েছে এখন ভেতর থেকে ভেসে আসছে মেয়েদের তীব্র আর্তনাদ আর কান্নার শব্দ আর হিংস্র পশুদের জান্তব উল্লাস।

কর্নেল ওয়াকিটকিতে কথা বলছিল। কথা শেষ করে মনিরুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে বলল, “ইটস টাইম, মি. জামান।”

ওদেরকে জিপ থেকে নামানো হলো। দুজন মিলিটারি নামানোর সাথে সাথে ওদের সবার হাতে পরিয়ে দিল হ্যান্ডকাফ। আর মেজর দুজন দুপাশে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলল। কর্নেল সামনে ওয়াকিটকিতে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছে। মনিরুজ্জামানের ঠিক পাশেই মির্জা।

“মির্জা, দিনকাল কেমন চলছে। আর্মিতে কেমন লাগছে?”

মির্জা মনে হয় লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। “জি, স্যার ভালো।”

ওরা মূল দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। এখানে বেশ শক্ত অপারেশন চালানো হয়েছে। পুরো করিডরে এদিকে-সেদিকে রক্ত আর বুলেটের আঘাতের চিহ্ন। কয়েকজন আরদালি মৃতদেহগুলো সরাচ্ছে, এখনও সব সরানো শেষ হয়নি। একজন পুলিশ করিডরে পড়ে ছিল, এখনও মরেনি, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তাকেও লাশের মতো করেই টানতে টানতে নিয়ে গেল। ওরা নিচতলা পার হয়ে চলে এলো দোতলায়। এখানের অবস্থা আরও ভয়াভহ। পাকিস্তানি সৈনিকেরা মনুষ্যত্বের মাথা খেয়ে এখানে-সেখানেই পশুর মতো মেয়েদেরকে ধর্ষণ করছে। মেয়েদের অমানবিক আর্তনাদে ভারি বাতাস।

কর্নেল হাবিব তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে মৃদু হাসি। “মি. জামান, আমি শুনেছিলাম আপনি নাকি অনেক শক্ত মনের মানুষ। এখন তো আমার কাছে সেরকমটা মনে হচ্ছে না।”

মনিরুজ্জামান কিছু বলল না। শক্ত চোখে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, “আপনি এসব সাপোর্ট করেন? এটা যুদ্ধের কোন নিয়মের ভেতরে পড়ে? এভাবে নিরীহ মানুষকে হত্যা? এভাবে নিরাপরাধ মেয়েদের ওপর অত্যাচার? আপনারা না ধর্মের দোহাই দেন? এই আপনাদের ধর্ম!”

“মি. জামান, সবকিছুরই একটা নিয়ম আছে। এটা যুদ্ধের নিয়ম।”

তারা তিনতলায় চলে এসেছে। এখানে আবু আর কবিরকে আলাদা করে ফেলা হলো তার কাছ থেকে। তাকে টানতে টানতে নিয়ে আসা হলো একটা রুমের সামনে। মেজর ফয়সলের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা এক দারোয়ান একটা রুমের দরজা খুলে দিল। ভেতরটা অন্ধকার কিন্তু অন্ধকারের ভেতর থেকে মৃদু গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। দারোয়ানটা ভেতরে ঢুকে লাইট জ্বেলে দিল। মনিরুজ্জামান দেখল এই রুমটা একটা টর্চার সেল। আগে এটা একটা রুমই ছিল। কিন্তু এখন এটাকে টর্চার সেল হিসেব ব্যবহার করা হচ্ছে।

ঘরটার ঠিক মাঝখানে ফ্যানের আংটা থেকে ঝুলছে একজন মানুষ। সম্পূর্ণ উলঙ্গ মানুটার সারা শরীর রক্তাক্ত। কর্নেল একটা ইশারা করতেই লোকটাকে নামিয়ে আনা হলো ফ্যানের আংটা থেকে। আরেকজন মনিরুজ্জামানকে টানতে টানতে বসিয়ে দিল একটা চেয়ারে। ইতোমধ্যে আবু আর কবিরকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মনিরুজ্জামান দেখল টেবিলের ওপরে একটা হাতুড়ি, একটা প্লাস আর একটা কাঠের টুকরো রাখা। সে চোখ ফিরিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটাকে দেখল।

কর্নেল হাবিব মনিরুজ্জামানের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ওদের টেবিলের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন সৈনিক। “মি. জামান লোকটাকে চিনতে পারছেন?” সে রক্তাক্ত লোকটাকে দেখিয়ে জানতে চাইল। আপনাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনার বন্ধু হাফিজের সেই ফ্রেন্ড। আমার স্বজাতি, যে কি না আমাদের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।”

মনিরুজ্জামান অবাক হয়ে লোকটাকে দেখল। এতক্ষণ সে চিনতে পারেনি। আসলেই এই লোকটাই হাফিজের সেই ফ্রেন্ড। হাফিজ বলেছিল ওর সংঘের আরেকজন কর্তা আছে। কিন্তু এই লোকটার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় পায়নি হাফিজ।

“আজ বিকেলে এয়ারপোর্ট থেকে আমরা তাকে পাকড়াও করি। এরপর সে খুব সুন্দর একটা ডিল করে আমাদের সাথে। তার নিজের জীবনের বিনিময়ে তার পরিবারকে পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে দেওয়ার ডিল। … এবং এরপর সে আমাদেরকে সব বলে দিয়েছে। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমরা এতকিছু কীভাবে জানলাম।”

মনিরুজ্জামান হেসে উঠল।

“আমি কি মজার কিছু বলেছি?”

“মি. হাবিব, আপনিই বলেছেন আপনাদের ইন্টেলিজেন্স বেশ আগেই এইসব ব্যাপারে জানতে পেরেছে। তার মানে বেইমান আরও কেউ একজন আছে। আপনি তার কথা বলছেন না কেন? এই লোক স্রেফ পরিস্থিতির স্বীকার। আরও অনেক ভেতরে, আরও অনেক কাছের একজন বেইমান আছে।”

“মি. জামান, আপনার সাথে এতক্ষণ অনেক ভালো ব্যবহার করেছি। আপনি আমার স্বজাতির কুৎসিত রূপটা দেখেছেন আমারটা দেখেননি। এবার দেখবেন,” বলে সে হঠাৎ ঝট করে উঠে দাঁড়াল। টেবিলের ওপর থেকে পিস্তলটা নিয়ে সোজা গুলি করল মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার বুকে।

গুলির শব্দে পুরো রুমটা কেঁপে উঠল। মনিরুজ্জামান অনুভব করল সে কাঁপছে।

কর্নেল পিস্তলটা টেবিলের ওপর রেখে ওভারকোটের পকেট থেকে হাফিজের প্যাকেটটা বের করে টেবিলের ওপর রাখল। “মি. জামান আপনি এখন আমাকে বলবেন জিনিসটা কোথায়?”

 “কর্নেল আমি আপনাকে বলেছি আমি জানি না,” মনিরুজ্জামান বলার সাথে সাথে কর্নেল ইশারা করল। আর টেবিলের দুপাশে দাঁড়ানো সৈনিকদের একজন চেয়ারের পেছন থেকে মনিরুজ্জামানের একটা হাত ধরে টেবিলের ওপর চেপে ধরল। মনিরুজ্জামান অনুভব করল তার সমস্ত শরীর থেকে ঘামের স্রোত নেমে আসছে।

“কর্নেল আমি সত্যিই জানি না জিনিসটা কোথায়,” সে চিৎকার করে উঠল। “আপনি আমাকে মেরে ফেললেও আমি বলতে পারব না। কারণ আমি আসলেই জানি না।”

কর্নেল কঠিন চোখে মনিরুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে আছে। সে এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলনি। মনিরুজ্জামানকে পরখ করছে।

“এই ছেড়ে দাও,” বলার সাথে সাথে মনিরুজ্জামানকে ছেড়ে দিল সৈনিকটা। হাতটা আবার পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলা হলো চেয়ারের সাথে।

“আপনি বড় শক্ত লোক, মি. জামান। কিন্তু আমি জানি কার সাথে কীভাবে ডিল করতে হয়। আমি আপনাকে টর্চার করব না। কিন্তু আপনি আমাকে সব বলবেন। যদি না বলেন প্রথমে আপনার দুই নিরাপরাধ ছাত্রকে টর্চার করে খুন করা হবে আপনার চোখের সামনে। এরপর—” বলে কর্নেল নাটকীয় বিরতি দিল।

“এরপর কি আমাকে টর্চার করবেন?”

“মোটইে না, মি. জামান। আমরা আপনার প্রেগনেন্ট ওয়াইফকে ধরে আনব।”

মনিরুজ্জামানের মনে হলো তাকে কেউ চলন্ত ট্রেন থেকে নিচে ফেলে দিল। কর্নেল এরকম কিছু বলবে সে ভাবতেও পারেনি। তবুও শান্তভাবেই জবাব দিল, “আপনি তাকে পাচ্ছেন কোথায়?”

“আপনি কি ভেবেছেন আমরা আপনার গাজীপুরের বাড়ির ঠিকানা জানি না?”

মনিরুজ্জামান কোনো জবাব দিল না। সে বুঝতে পারছে হেরে যাচ্ছে। জিনিসটা কোথায় এটা তার জানা নেই। আর …তার মাথা কাজ করছে না। কর্নেল মনোযোগ দিয়ে তাকে লক্ষ করছে… “মি. জামান, আপনি এখনও কি বলবেন না জিনিসটা আসলে কোথায়?”

হঠাৎ রুমের দরজাটা খুলে গেল। মির্জা বেগ ভেতরে ঢুকল। “ডিসটার্ব করার জন্য দুঃখিত স্যার। কিন্তু জরুরি একটা ব্যাপার।”

“কী বলো?”

“স্যার কমান্ড সেন্টার থেকে আপনাকে এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে ডাকা হয়েছে।”

কর্নেল একটু চুপচাপ ভাবল। তারপর জবাব দিল, “ঠিক আছে আমি আসছি।”

“স্যার, এক্ষুনি।”

“ঠিক আছে,” কর্নেল উঠে দাঁড়াল। সৈনিক দুজনের একজনকে ভেতরে থাকতে বলল অপরজনকে বলল দরজার বাইরে পাহারা দিতে। মনিরুজ্জামানের দিকে ফিরে বলল, “মি. জামান, আমি দ্রুতই ফিরে আসছি। আমাদের সামনে সমস্ত রাত পড়ে আছে,” বলে সে মির্জার সাথে বেরিয়ে গেল।

মনিরুজ্জামান চুপচাপ বসে ভাবতে লাগল। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না কীভাবে তার পরিবারকে বাঁচাবে। একবার ভাবল মিথ্যে কিছু একটা বলে দেয়। কিন্তু সাথে সাথেই সেটা বাতিল করে দিল। লাভ নেই সেই একই কথা। পরিবারের সাথে সাথে তার বেশি খারাপ লাগছে আবু আর কবিরের জন্য। এই ছেলে দুটোও এখন তার কারণে প্রাণ হারাবে। সে চোখ তুলে মেঝেতে পড়ে থাকা প্রফেসরের মৃতদেহের দিকে তাকাল। লোকটা নিজের প্রাণ দিয়ে অন্তত তার পরিবারকে বাঁচাতে পেরেছে। তার নিজের জন্য সেই দরজাও বন্ধ।

তবে তার মাথায় একটা ব্যাপার থেমে থেমেই পাক দিয়ে উঠছে। সেই বিকেল থেকেই সে ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়ার চেষ্টা করছে। বারবার মাথা ঠান্ডা করে ভাবার চেষ্টা করছে সে কিন্তু একের পর এক ঘটনার ধাক্কায় পরিষ্কারভাবে ভাবার সুযোগই পচ্ছে না। তবে এখন যত ভাবছে ততই যেন পরিষ্কার হচ্ছে। সে মনে মনে ঠিক করে দেখল এই ব্যাপারটাই সে কর্নেলের সামনে তুলে ধরবে। এটাই হবে তার শেষ ট্রাম্প কার্ড। এটাতে যদি কাজ না হয় তাহলে আর কিছুই করার নেই।

দরজার বাইরে মৃদু কথোপকথন শোনা গেল। দরজাটা খুলে যাচ্ছে হঠাৎ খট করে একটা শব্দ হলো। মনিরুজ্জামানের গার্ড শব্দটা শুনে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। লোকটা দরজার পাল্লাটা ধরে টান দিতে যাবে তীব্র বেগে ওটা এসে লাগল তার গায়ে। লোকটা পড়ে যেতেই মির্জা বেগ দ্রুতগতিতে ভেতরে ঢুকল, তার হাতে একটা পিস্তল। পিস্তলের বাঁটটা বসিয়ে দিল গার্ডের মাথায়। সে দরজাটা পুরোপুরি খুরে দরজার বাইরের গার্ডটার মৃতদেহ টেনে নিয়ে এলো ভেতরে।

“মির্জা তুমি?…” মনিরুজ্জামান এতটাই চমকে গেছে, কী বলবে বুঝতে পারছে না।

মির্জা কোনো কথা না বলে তার হাতের বাঁধন খুলে দিল। “স্যার জলদি করুন, আমাদেরকে সবকিছু খুব দ্রুত করতে হবে। বড়জোর কয়েক মিনিট সময় পাওয়া যাবে।”

“কী করতে চাইছ তুমি?”

“আমি কর্নেলকে কমান্ড সেন্টারের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছি। সে ওখানে গেলেই বুঝতে পারবে কোনো কল আসেনি। তার মানে আমরা স্রেফ কয়েক মিনিট সময় পাব পালানোর জন্য,” মির্জা দ্রুতগতিতে অজ্ঞান এক গার্ডের কাপড় খুলছে। মনিরুজ্জামান অবাক হয়ে তাকে দেখল। ব্যাপারটা এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছে না।

“স্যার, কী হলো এগুলো ধরুন। জলদি পরে নিন কাপড়গুলো।”

মনিরুজ্জামান কাপড়গুলো ধরে দাঁড়িয়ে রইল। “তুমি…?”

“স্যার,” মির্জা তার কথা শেষ করতে দিল না। “আপনি এগুলো পরে নিন। একমাত্র এই পোশাক থাকলেই আপনি আর দশজন মিলিটারির মতোই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন। আমি পেছনের গেটের বাইরে একটা জিপ রেডি করে রেখে এসেছি। ওটা দিয়েই পালাতে পারবেন।”

“আমি আবু আর কবিরকে ছাড়া পালাব না।”

“স্যার আপনি কি ভেবেছেন আমি সেটা জানি না। আমি ওদেরকে আগেই বের করে অন্য একটা রুমে রেখে এসেছি। আমি আগে জিপ রেডি করে, ওদেরকে বের করে তারপর কর্নেলকে সরিয়েছি। এখন জলদি করুন।”

মনিরুজ্জামান দ্রুতগতিতে আর্মির পোশাকগুলো পরে নিতেই তারা দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। বেরোনোর আগে টেবিল থেকে তুলে নিল হাফিজের প্যাকেটটা। ওটা নিয়ে গুঁজে রাখল আর্মি শার্টের ভেতরে।

“স্যার একদম স্বাভাবিক থাকবেন। আরেকটা মেয়ে ভরতি ট্রাক এসেছে সবাই এখন ওগুলো নিয়ে ব্যস্ত। আজ এখানে নরকগুলজার চলছে। স্বাভাবিক থাকলে কেউই এমনকি টেরও পাবে না কিছু। শুধুমাত্র কর্নেল হাবিব আসার আগে আমাদেরকে বেরোতে হবে।”

তারা স্বাভাবিকভাবে হেঁটে প্রথম ভবনটা থেকে বেরিয়ে এলো। পথিমধ্যে সৈনিক আর অফিসারদের দুটো গ্রুপের সাথে দেখা হলো সবাই হাসাহাসি করতে করতে গেটের দিকে যাচ্ছে। ওদের দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না। মূল ভবনের বাইরে একটা টিনের চালাঘরের সামনে এসে মির্জা থেমে গেল। একবার এদিক-ওদিক দেখে সে মনিরুজ্জামানকে নিয়ে ডুকে গেল ভেতরে। আবু আর কবির বসে আছে ভেতরে, দুজনেরই হাত আর মুখ বাঁধা।

মনিরুজ্জামানকে দেখে দুজনেই নড়েচড়ে উঠল। মনিরুজ্জামান দৌড়ে গেল ওদেরকে মুক্ত করতে। মির্জা সাথে সাথে বাঁধা দিল। “না স্যার, ওদের বাঁধন খোলার দরকার নেই। ওদেরকে নিয়ে আপনি এখান থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবেন যাতে মনে হয় দুজন বন্দি নিয়ে বেরোচ্ছেন। আপনারা আর্মি জিপ নিয়ে যাচ্ছেন কাজেই পথেও কোনো বড় ধরনের সমস্যা হবে বলে মনে হয় না,” বলে সে একটু থামল। “স্যার আমি এখান থেকেই বিদায় নেব। আজকে যা ঘটল তার জন্য আমি দুঃখিত।”

“মির্জা, তুমিও চলো আমাদের সাথে। তোমাকে ওরা মেরে ফেলবে। কর্নেল অবশ্যই বুঝে ফেলবে তুমিই আমাদেরকে পালাতে সাহায্য করেছ।”

“জি স্যার, সেটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি আপনাদের সাথে গেলে আপনাদের বিপদ আরও বাড়বে। আমি এখান থেকে ক্যান্টনমেন্ট চলে যাব। ওখানে আমার আপন চাচা আছেন। তিনি আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে পারবেন।”

“মির্জা, শেষ একটা কথা। কেন তুমি আমাকে সাহায্য করলে? কেন নিজের ক্যারিয়ার, জীবনের ওপর এত বড় ঝুঁকি নিলে?”

“স্যার আপনি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে সাহায্য করেছেন সেটার কথা আর নাই বা বললাম। তবে আমি পশ্চিম পাকিস্তানি হলেও জন্মেছি এই মাটিতে, এখানে বড় হয়েছি, আমি রক্তের দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি হতে পারি কিন্তু মনেপ্রাণে বাঙালি,” মির্জার চোখে পানি। “স্যার আপনারা বিদায় নিন। এখানে প্রতি সেকেন্ড এখন বিপজ্জনক। আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ মির্জা,” বলে আবু আর কবিরকে নিয়ে বেরিয়ে এলো সে। মির্জার দেখানো গেটের কাছে এসে থেমে গেল। দুজন সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে। মনিরুজ্জামানকে দেখে তার কাঁধের ব্যাজটা দেখেই স্যালুট দিল। তার মানে সে যার পোশাক পরে আছে এরা তার নিচের র‍্যাঙ্কের সৈনিক।

মনিরুজ্জামান স্যালুট ফিরিয়ে দিতেই একজন উর্দু ভাষায় জানতে চাইল এদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। মনিরুজ্জামান উত্তর দিল এদেরকে বাইরে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হবে।

জবাব শুনে দুজনেই হেসে উঠে গেটটা খুলে দিল। একজন বলল, বাঙালিদের সবগুলোকে এভাবে গুলি করে মারা উচিত। মনিরুজ্জামান আর কোনো কথা না বলে গেট থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে। কথা বললেই বিপদ। বাইরে এসেই দেখল জায়গামতো জিপটা দাঁড় করানোই আছে। সে প্রথমে দুজনকে গাড়ির পেছনে তুলে দিল। তারপর নিজে সামনে উঠেই ছেড়ে দিল গাড়ি।

নিজে নিজে বিড়বিড় করে বলে উঠল, “মুক্তি।”

.

মির্জা বেগ টিনের চালা দেওয়া ঘরটার ভেতরে মিনিট পনোরোর মতো অপেক্ষা করল। সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে এখান থেকে কীভাবে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত যাবে। একবার তার চাচার জিম্মায় চলে যেতে পারলে সে তাকে বাঁচাতে পারবে। হয়তো মিলিটারির চাকরিটা আর থাকবে না কিন্তু বাঁচতে তো পারবে। আর মিলিটারির এই চাকরি এমনিতেও সে ছেড়ে দিত। তার কাছে আর ভাল্লাগছিল না। সে ঘড়ি দেখল মনিরুজ্জামানরা বেরিয়ে যাওয়ার পর ষোলো মিনিট পার হয়ে গেছে। তার মানে তারা এখন মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে। সে টিনের ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো।

বেরিয়েই জমে গেল বরফের মতো। কর্নেল হাবিব, সাথে মেজর ফয়সলসহ আরও কয়েকজন সিপাই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেলের মুখে কোনো রাগ নেই, সে সিগারেট টানছে আর মৃদু মৃদু হাসছে।

“মির্জা মির্জা মির্জা, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। যেটা আমি পারছিলাম না সেটা তুমি করে দিলে।”

মির্জা কোনো কথা বলল না।

“যখন আমাকে ডাকতে এলে তখনই আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কিছু একটা করতে চাইছ। কারণ কমান্ড সেন্টার থেকে আমার সাথে সরাসরি যোগাযোগ হয়। কাজেই ওখান থেকে ডাকার কোনো কারণ নেই। তাহলে বলো আমি কেন মনিরুজ্জামানকে পালাতে দিলাম?”

“কেন?” প্রশ্নটা মির্জার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।

“কারণ মনিরুজ্জামান এখান থেকে বেরিয়ে তার পরিবারের কাছে যাবে এবং সেই জিনিসটার কাছে যাবে যেটা আমরা খুঁজছি। তাকে টর্চার করে আমরা কিছুতেই ওটা বের করতে পারতাম না। কাজেই তুমি আমার বিরাট একটা উপকার করলে।”

“স্যার, আপনি কীভাবে জানবেন সে কোথায় যাচ্ছে?”

“সবকিছু আর না-ই বা জানলে মির্জা। এসব বাদ দাও। মরার আগে কোনো শেষ ইচ্ছা?” কর্নেল একটা পিস্তল বের করে আনল।

“স্যার, আপনি এভাবে আমাকে মারতে পারেন না। আমি একজন মিলিটারি অফিসার। আমাকে কিছু করতে হলে নিয়ম মেনে আপনাকে করতে হবে। তাছাড়া আমার চাচা…” মির্জা কথা শেষ করার আগেই কপালে কর্নেলের গুলি খেয়ে পড়ে গেল।

“বেইমানের বীজ নষ্ট করতে কখনোই দেরি করা উচিত না,” কর্নেল পিস্তলটা ভরে রাখতে রাখতে বলল। এরপর মেজর ফয়সলের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, “সব রেডি?” ফয়সল মাথা নাড়তেই জবাব দিল, “ভেরি গুড। আমরা কিছুক্ষণ পরেই রওনা দেব। তার আগে আমাকে হাই কমান্ডোর কাছে রিপোর্ট করতে হবে। এবার আমাদের গন্তব্য গাজীপুর। ওখানেই কাহিনির সমাপ্তি হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *