২৫শে মার্চ – ২৭

২৭

ওয়ারি, ঢাকা
বর্তমান সময়, রাত প্রায় ৯টা

ফ্রেশ একটা গোসল দিয়ে অরণির দারুণ ঝরঝরে লাগছে। কাপড়ও পালটে নিয়েছে সে। মোটামুটি ঠিকই হয়েছে। ফ্রেশ হয়ে নিজেকে ঠিকঠাক করে সে বাইরে চলে এলো। রুমের বাইরেই একজন আয়া অপেক্ষা করছিল। এই মহিলাই তাকে সব ঠিকঠাক করে দিয়েছিল। অরণি রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই মহিলা তাকে জানাল বশির সাহেব এবং হাসান ওর জন্য ডাইনিংরুমে অপেক্ষা করছেন। অরণি ওর ব্যাগটা সাথে নিয়ে চলে এলো ডাইনিংরুমে।

হাসান আর আহমদ বশির দুজনেই অপেক্ষা করছে। “এসো অরণি। আগে খাওয়াদাওয়া করে নাও তারপর আমরা কথা বলব। তবে খেতে খেতে আমি তোমাদের সারাদিনের ঘটনা শুনতে চাই।”

অরণি টেবিলে বসার পর আয়াই ওদেরকে খাবার পরিবেশন করল। আহমদ বশির তেমন কিছুই খেলেন না। তিনি নাকি রাতে খুব একটা খান না। হাসান আর অরণি বেশ গোগ্রাসেই খেল। ওরা সারাদিন খাওয়াদাওয়া প্রায় ঠিকমতো করতে পারেনি। খেতে খেতে অরণি সারাদিনের ঘটনা বলে গেল। ওর বলার মাঝখানে আহমদ বশির বারবার থামিয়ে এটা-ওটা প্রশ্ন করল। বিশেষ করে ওদের জজ কোর্টের সামনে থেকে পালানোর ব্যাপারটা শুনে সে বেশ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল। “তোমাদের সাহস আছে বলতে হবে। তারপর।”

অরণি সবটা বলার পর সে বলল, “পুলিশের ব্যাপারটা বোঝা গেল, কিন্তু এই লোকটার ভূমিকা বুঝতে পারলাম না। যাহোক, তোমরা দুজনেই এখন পর্যন্ত অসাধারণ সাহস আর বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছ। তবে এটুকু বুঝতে পারলাম তোমার মা-ই এই কুগুলো ইমপ্ল্যান্ট করে গিয়েছিলেন, যাতে তোমরা এই পর্যন্ত আসতে পারো।”

“আপনি কিন্তু এখনও তেমন কিছু বলেননি আমাদেরকে। বিশেষ করে আপনার ভূমিকা প্রসঙ্গে,” অরণি বলল।

“চলো স্টাডিতে চলো। ওখানে বসে আলাপ করব এবং আমরা ধাঁধাটার সমাধান করার চেষ্টা করব,” ইতোমধ্যে ওদের খাওয়া শেষ হয়েছে।

অরণি তাকে থামিয়ে বলল, “আমাদের সাথে যে চাচা ছিলেন, তিনি?”

“হ্যাঁ তাকে ভেতরে এনে বসানো হয়েছে। তিনিও ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে নিয়েছেন। এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন,” আয়া জবাব দিল।

“আমি তার সাথে একটু দেখা করতে চাই,” অরণি জানাল। “তিনি আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন এবং আমাদের কারণেই তিনি পুলিশের তাড়া খেয়ে বেড়াচ্ছেন। আপনারা স্টাডিতে গিয়ে বসুন। আমি দেখা করেই চলে আসব।”

“ঠিক আছে তোমার যেমন ইচ্ছে। কিন্তু বেশি দেরি করো না। আমাদের অনেক আলোচনা আছে,” বলে আহমদ বশির হাসানকে নিয়ে চলে গেল।

অরণি আয়ার সাথে নেমে এলো নিচে। চাচা একটা রুমে বসে আছে। এটা মূলত ড্রাইভার-দারোয়ানদের বিশ্রাম নেওয়ার রুম। সুন্দর ব্যবস্থা, রুমে টিভিও আছে। চাচা বসে বসে হেডফোনে গান শুনছে।

“চাচা আপনি খেয়েছেন?” অরণি হাসিমুখে চাচার দিকে এগিয়ে গেল। “ওরা ঠিকমতো যত্ন নিচ্ছে তো আপনার?”

চাচাও হাসিমুখে ওর মাথায় হাত রাখল। “হ্যাঁ মামণি কোনো সমস্যা নেই। আমি খাইছি। তুমরা ঠিক আছ তো?”

“হ্যাঁ চাচা, আমরা একদম ঠিক আছি, কোনো সমস্যা নেই। আমারা আসলে এখন কাজ করব। আজ রাতে মনে হয় এখানেই থাকব,” অরণি চাচার পাশে বসে কথা বলছে। “আপনি এখানেই থাকতে পারবেন তো? কারণ এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটার একটা সামাধানের দিকে আমরা যেতে পারব। আমার মনে হয় ব্যাপারটার একটা সম্পূর্ণ সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকাটাই আপনার জন্য নিরাপদ হবে।”

“জি মা কুনো সমস্যা নাই। আমি এইহানেই থাকতে পারব। তুমরা সাবধানে থাইকো আর চেষ্টা করো ক্যামনে ব্যাপারটার একটা সুরাহা করা যায়। আশা করি তুমরা জলদিই করতে পারবা।”

“ঠিক আছে চাচা, আপনি বিশ্রাম নেন আমি আসি,” অরণি চাচার কাছ থেকে বিদায় নিল।

“ঠিক আছে মা,” চাচা আবার কানে হেডফোন লাগাতে লাগাতে বলল।

অরণি চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো স্টাডিতে। হাসান আর আহমদ বশির কফি খাচ্ছেন আর আলাপ করছেন। অরণি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। মনে হচ্ছে দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা একটু হলেও সহজ হয়েছে। অরণি এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তায় ছিল। কারণ এরকম শত্রুতামূলক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করতে গেলে পদে পদে বিপদে পড়তে হয়।

“এসো অরণি। তুমি চাইলে কফি নিতে পারো,” আহমদ বশির কফি পটের দিকে দেখিয়ে বলল। “এটা বিশ্বের সেরা কফিগুলোর একটা। সরাসরি ব্রাজিল থেতে আনানো।”

অরণি পট থেকে মগে কফি ঢেলে নিতে নিতে মনে মনে স্বীকার করল কফির ঘ্রাণটা আসলেই অসাধারণ। এক চুমুক কফি খেয়ে অরণি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। “আমার মনে হয় এখন আমাদের কাজ শুরু করা উচিত।”

“হ্যাঁ অবশ্যই,” বলে বশির সাহেব ড্রয়ার খুলে একটা খাম বের করে আনল। অরণি দেখল খামটা সিল করা।

“অরণি এই খামটা তোমার মা দিয়েছিলেন আমাকে,” বলে সে খামটা অরণিকে দেখাল কিন্তু হাতে দিল না।

“আমার মা আপনাকে চিনতেন কীভাবে? তার সাথে আপনার যোগাযোগ হলো কীভাবে?” অরণি জানতে চাইল।

“আমি সেটাই এখন বলব,” বলে সে উঠে গিয়ে আবারও কফির মগ ভরে আনল। “প্রথমে আমার নিজের ব্যাপারে একটু বলে নেই। আমি একসময় ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম এবং এরপর ইতিহাসের শিক্ষকও ছিলাম। দেশের বাইরে পড়তে গিয়ে আমি পুরাতত্ত্ব নিয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠি। বিশেষ করে আমাদের দেশের বিভিন্ন পুরানো রেলিক এবং এগুলোকে ঘিরে বিভিন্ন মিথ এবং লেজেন্ড নিয়ে আমার আগ্রহের কোনো সীমা নেই। এর ওপর আমি দুবার পিএইচডি করেছি। তো এই কারণে একটি মহলের লোকজন আমার ব্যাপারে জানে এবং এসব বিষয়ে কোনো কিছু থাকলে, জানলে অথবা জানানোর থাকলে আমার কাছে আসে। কখনো পরামর্শের জন্য, কখনো আবার পুরানো বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে। আমিও এগুলো নিয়ে কাজ করে আনন্দ পাই। আমি এখনও আমাদের দেশের বিভিন্ন পুরাতত্ত্ব বিষয়ক মিথ এবং লেজেন্ড নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছি। আমার ব্যাপারে পত্রিকাওয়ালারা যাই লিখুক আর মানুষে যাই মনে করুক না কেন, এটাই সত্যি,” বলে সে একটু থেমে হাসানের দিকে তাকিয়ে মৃদু

একটা হাসি দিল। হাসানও তার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। “আমার গবেষণার মিথগুলোর ভেতরে একটা মিথ হলো ‘দা ওল্ড ইন্ডিয়ান মিথ অভ ব্রোকেন হর্স”, বশির সাহেব বলে চলেছেন। “আমার ধারণা এই বিষয়ক কিছু জিনিস তোমার কাছে আছে। তুমি যদি জিনিসগুলো দেখাও তাহলে ভালো হয়।”

অরণি মাঝখানে একটু ইনসার্ট দিল,”এই মিথটা আসলে কী?”

“আমার মনে হয় এর ভিত্তিটা তোমার জিনিসগুলো দেখলে আমি আরও ভালো বলতে পারব।”

অরণি ব্যাগ খুলে প্যাকেটটা বের করল। ওটা থেকে ধীরে ধীরে বের করে আনল ছবি, ডায়েরি এবং কয়েনটা। জিনিসগুলো বের করে অরণি টেবিলের ওপর রাখল।

আহমদ বশির বেশ আগ্রহের সাথে প্রথমে ছবিটা দেখল। তারপর কয়েনটা তুলে নিল। ওটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে অস্ফুটে বলল, “ও মাই গড, দা লেজেন্ড রিয়েলি এক্সিস্ট। মিথটা তাহলে পুরোপুরি সত্য,” বলে সে অরণির দিকে ফিরে বলল, “অরণি তুমি জানো না এটা কী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ। শত বছরের পুরানো এটি সত্যের প্রমাণ। ছবিটা আমি আগেই দেখেছিলাম, তোমার মা-ই দেখিয়েছিল কিন্তু কয়েনটা দেখিনি।”

“স্যার আপনি কিন্তু আমাদের প্রতি অবিচার করছেন। পুরো ব্যাপারটা বলছেন না,” অরণি জানতে চাইল।

“ঠিক আছে ঠিক আছে বলছি। কাল্ট কি জানো তো নিশ্চয়ই?” সে অরণি এবং হাসানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ, এক ধরনের গুপ্ত সংঘ,” হাসান জবাব দিল।

“এক ধরনের না। সব ধরনের গুপ্ত সংগঠনকেই কাল্ট বলে। একেক কাল্টের একেক ধরন আছে, আছে নানা ভিন্নতা, নানা বিষয়বস্তু। ধর্মীয় কাল্ট থেকে শুরু করে, মিউজিক, কোনো বিশেষ আচার-আচরণ অভ্যাস করা মানুষদেরকেও কাল্ট বলা হয় ক্ষেত্র বিশেষে। এমনকি কোনো একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা সত্যকে লালন করা কাল্টও আছে পৃথিবীব্যাপী। আমাদের এই প্রাচীন ভূভারতেও অনেক প্রাচীন কাল্ট ছিল। একদম পুরানো ভারতবর্ষ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অনেক কাল্টের অস্তিত্বই এখানে পাওয়া গেছে। এই যেমন ধরো ভূভারতের বিখ্যাত কাল্টেগুলোর ভেতরে একটা হলো, প্রাচীন ভারতের খুনে দল ঠগিদের কাল্ট। এরকম আরেকটি কাল্টের মিথ হলো, “কাল্ট অভ ব্রোকেন হর্স’,” বলে সে একটু থামল।

“এটাকে কান্টের মিথ বলা হয় কেন?” অরণি জানতে চাইল।

“মিথ বলা হয় এই কারণে, এদের অস্তিত্বের ব্যাপারে নিরেট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কথিত আছে সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে সমগ্র ভারতবর্ষে যখন আগুন জ্বলছিল তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তৎকালীন ভূ-ভারতের বিভিন্ন বিদ্রেহী গোত্রের নেতাদের একটি অংশ বিশেষ একটা সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্তটা ছিল, তারা মোগল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে তাদের কথিত নেতা মেনে তার নেতৃত্বে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। কিন্তু মোগল সাম্রাজ্যের সম্রাট হলেও এই লোকটা ছিল একজন অকর্মা এবং ভঙ্গুর প্রকৃতির লোক। সে কোনো নেতৃত্ব তো দিতে পারেইনি উলটো বিদ্রোহের বারোটা বাজিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে ইংরেজরা তাকে বন্দি করে আরাকানে নির্বসানে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে খুবই করুণ অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তাকে বন্দি করার পর বিদ্রোহ একরকম স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে। ইংরেজরা চারপাশে জয়ী হতে থাকে। সম্রাট বাহাদুর শাহ যত ভঙ্গুর আর অকাজের লোকই হোক সে ছিল মোগল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট। কথিত আছে এই বাহাদুর শাহের কাছে নাকি মোগল সাম্রাজ্যের বিপুল পরিমাণ গচ্ছিত সম্পদের চাবিকাঠি ছিল। মানে সন্ধান ছিল। যদিও বেশিরভাগ ঐতিহাসিক এটাকে গুজব বলে উড়িয়ে দেন। তবে মিথ বলে বাহাদুর শাহ ধরা পড়ার ঠিক আগে তার একান্ত বিশ্বস্ত একজনকে এই গচ্ছিত সম্পদের দায়িত্ব দিয়ে পালিয়ে যেতে বলেন। এই লোকটা কে ছিল বা তার অতীত কী ছিল তা সঠিকভাবে কেউই প্রমাণ করতে পারেনি। সম্রাট ধরা পড়ার পর সে নাকি পালিয়ে চলে আসে ঢাকাতে। এর পেছনে দুটি কারণ প্রচলিত আছে। এক. সে নাকি এই বাঙাল মুল্লুকের লোক ছিল। দুই. পুরো ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ এবং প্রভাবশালী নগরীগুলোর ভেতরে একমাত্র ঢাকাতেই বিদ্রোহের তেমন কোনো ছাপ ছিল না। সে নাকি ঢাকাতে এসে তৎকালীন একজন সুবাদারের সাথে মিলে এই সম্পদ ঢাকাতেই লুকিয়ে ফেলে,” বলে সে একটু বিরতি দিল।

“এরপর কী ঘটে?” হাসান প্রশ্ন করল। দুজনেই মুগ্ধ হয়ে শুনছে।

“এরপর ঢাকার বুকেও জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের আগুন,” আহমদ বশির আবারও শুরু করল। কিন্তু অরণি তাকে থামিয়ে দিল।

“ওয়েট মাই ডিয়ার, ধৈর্য ধরতে হবে। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হলে তোমাদেরকে শুনতে হবে পুরো ইতিহাসটা। আর আমি যে ইতিহাসটা বলছি এটা নির্দিষ্ট কোনো বই থেকে নেওয়া না। এগুলো আমার দীর্ঘদিনের গবেষণা, বিভিন্ন বই থেকে নেওয়া টুকরো টুকরো ঘটনা, লোকমুখে প্রচলিত বিভিন্ন মিথ মিলিয়ে আমি তোমাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করছি পুরো ব্যাপারটা।”

“তার মানে ব্রাহ্ম লাইব্রেরির ওই বইয়ের চ্যাপটারটা আপনিই চুরি করেছেন?” হাসান হঠাৎ বলে উঠল।

“এই ব্যাপারে আমরা পরে কথা বলব কেমন? আগে ইতিহাসটা আলোচনা করে নেই,” আহমদ বশির মৃদু হেসে বলল।

হাসান মাথা নেড়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল অরণি তাকে থামিয়ে দিল, “হাসান তুমি চুপ করো। আগে পুরো ব্যাপারটা শুনে নেই,” হাসান ওর দিকে একটু আহত দৃষ্টিতে তাকাল। “ঠিক আছে বলুন, এরপর কী ঘটে?” হাসানেরও ইতিহাসের বাকি অংশটুক শোনার জন্য তর সইছে না।

“এরপর কথিত আছে তারা যখন তাদের কাজ প্রায় গুছিয়ে আনছে ঠিক তখনই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকজন কোনো না কোনোভাবে ওদের এই ব্যাপারটা টের পেয়ে যায়। কীভাবে সেটা জানার কোনো উপায় নেই। এরপর চলে আসে ২২শে নভেম্বর, ১৮৫৭। সেই ঐতিহাসিক দিন।”

“কী ঘটেছিল ওই দিনে?” অরণি জানতে চাইল।

“ওইদিন ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহ দমনের জন্য ঢাকা আক্রমণ করে। তারা পুরো ঢাকা ঘিরে ফেলে এবং সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ট্রেজারি এবং লালবাগ দুর্গ দখল করে নেয়। গণহারে বাঙালি আর ভারতীয় সিপাহিদেরকে মেরে ফেলতে থাকে। বিদ্রোহ দমনের নামে এখানকার সৈন্যদেরকে কচুকাটা করে ফেলা হয়। ধরা পড়া সৈন্যদের একটা বড় অংশকে প্রথমে বুড়িগঙ্গার পাড়ে দাঁড় করিয়ে কামানের গোলা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। কিছু সৈন্যদেরকে সরাসরি কুয়ায় ফেলে দেওয়া হয়। আর বড় একটা অংশকে বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কে গাছের সাথে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। যেটার চিহ্ন এখনও আছে।”

“স্যার, ওই লোকটার কী হলো? আমরা মনে হয় অফ-টপিকে চলে এসেছি,” অরণি ফোড়ন কাটল।

“ওহো সরি। বুড়ো বয়সের এই এক সমস্যা। কথায় কথায় হুঁশ থাকে না। প্রকৃতপক্ষে ওর ভাগ্যে কী ঘটেছিল এটা পরিষ্কার না। সবই ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা শোনা কথা। ইংরেজদের অভিযানের ব্যাপারে তো বললাম। কথিত আছে, ইংরেজদের কাছে সুবাদার এবং ওই লোকটার ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য ছিল। ওরা সম্পদটা লুকানোর ঠিক পরপরই ইরেজদের কাছে ধরা পড়ে যায়। ট্রেজারি আর লালবাগ কেল্লায় অভিযান চালানোর ঠিক আগ মুহূর্তে প্রথমে সুবাদার তাদের হাতে ধরা পড়ে। তার বাড়িতে নাকি অভিযান চালানো হয়। এই অভিযানে সুবাদার মারা যায় এবং তার স্ত্রী নাকি পালিয়ে যায়।”

“আর ওই লোকের ভাগ্যে কী ঘটে? ওই যে বাহাদুর শাহের লোকটা?”

“এইখান থেকেই মিথের শুরু। কেউই পরিষ্কার করে বলতে পারে না। সবই প্রচলিত মতবাদ, যেগুলোকে আবার বেশিরভাগ স্কলাররাই উড়িয়ে দেয়। কেউ বলে ওই লোক ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল। আবার কেউ বলে লালবাগ দুর্গ আক্রমণের সময়ে সে নাকি দুর্গের পেছন দিয়ে পালিয়েছিল এবং এই ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছিল সুবাদেরর স্ত্রী। আমার ব্যক্তিগত পড়াশুনা এবং মতামতও সেটাই সাপোর্ট করে। এর পেছনে দুটি কারণ আছে। এক. ঐতিহাসিক সত্য বলে ইংরেজরা লালবাগ দুর্গের ভেতরে একজন মহিলাকে অর্ধমৃত অবস্থায় পরিবিবির মাজারের ভেতর থেকে গ্রেপ্তার করে এবং বাহাদুর শাহ পার্কে নাকি অন্যান্য পুরুষ বিদ্রোহীদের সাথে তাকেও ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। আবার অনেকে বলে তাকে নাকি পরিবিবির মাজারের ভেতরেই গুলি করে মারা হয়েছিল। কোনটা সঠিক কে জানে। নাজির হোসেনের লেখা ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ বইটাতে এই ঘটনার ডিটেইল বর্ণনা আছে এবং ‘হৃদয় নাথের ঢাকা’ নামে আরেকটা বইতেও এই সুবাদার ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দুই. পরবর্তী মিথ বলে এই লোকটাই, মানে সম্ভবত বাহাদুর শাহের লোকটাই পরবর্তীতে এই মিথের জন্মদাতা।”

“মানে?” হাসান কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল।

“মানে হলো, ইতিহাসের যে অংশটুকু বললাম এই অংশটুকু পর্যন্ত কিছু ঘটনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রমাণ আছে। এর পরের যে অংশটুকু আছে সেটা পুরোপুরিই মিথ এবং এই মিথটাকেই বলা হয়ে থাকে “মিথ অভ ব্রোকেন হর্স কেউ কেউ বলে ‘কাল্ট অভ ব্রোকেন হর্স’।”

“এই ব্রোকেন হর্সের ব্যাপারটা কী? ভাঙা ঘোড়া নিয়ে এত মাতামাতি কেন?”

“এই ভাঙা ঘোড়ার ব্যাপারটা খুব মজার। প্রাচীন ঢাকায় পা ভাঙা ঘোড়া নিয়ে একটা অদ্ভুত বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। মানুষ বিভিন্ন মাজারে মানত করার জন্য মাটির, পাথরের, কাঠের তৈরি বিভিন্ন ধরনের ঘোড়ার এক পা ভেঙে মাজেরের প্রাঙ্গণে রেখে আসত।”

“আজব তো, এইরকম কোনো বিশ্বাসের কথা তো এর আগে শুনিনি, হাসান বেশ অবাক হয়েছে।“

“হ্যাঁ অবাক হলেও সত্য। এর পেছনে মানুষের বিশ্বাস অনেকটা এরকম ছিল, ঘোড়ার পা ভেঙে গেলে যেমন দৌড়াতে পারে না। তেমনি পা ভাঙা ঘোড়া মাজারের প্রাঙ্গণে রেখে মানত করলে কোনো শত্রু তাদের ক্ষতি করতে পারবে না। কিংবদন্তির ঢাকা’ যে বইটার কথা বললাম সেটাতে তারপর ‘ঢাকা : একটি স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী’ এই বইগুলো পড়লে এই প্রাচীন বিশ্বাসের ব্যাপারটা জানতে পারবে। এই বইগুলোতে এসব বিশ্বাসের কথা সুন্দরভাবে লেখা আছে।”

“তাহলে আমাকে বলুন, এই পা ভাঙা ঘোড়ার বিশ্বাস আর বাহাদুর শাহের পালানো লোকটার মধ্যে সংযোগ কোথায়?” অরণি প্রশ্ন করল।

“প্রকৃতপক্ষে সংযোগটা যে আসলে কোথায় তা কেউই বলতে পারে না। তবে সিপাহি বিদ্রোহের ঠিক পর দিয়ে পূর্ব বাংলার কিছু এলাকায় এক অদ্ভুত কাল্টের জন্ম হয়। যারা নাকি নিজেদের ভেতরে বিভিন্ন মোগল বিশ্বাসগুলো লালন করত এবং ধর্মীয় আচার-আচরণগুলো ওভাবেই ওরা মানার চেষ্টা করত। সবচেয়ে বড় কথা ওরা নিজেদের কাজকর্ম করত খুব গোপনভাবে, নিজেদের ভেতরে ওরা প্রতীক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করত এই ভাঙা ঘোড়া। ওরা আসলে মূলত ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লড়ত খুবই গোপনভাবে। তবে মূল কথা হলো ওরা নাকি মোগলদের ওই বিপুল সম্পদের সন্ধান জানত এবং ওটাকে লালন করার জন্যই এই কাল্টের প্রতিষ্ঠা। খুবই গোপনে থাকত এরা এবং এই কারণেই ওদের ব্যাপারে কেউই তেমন একটা জানে না। ওদের প্রতিটি সদস্যের কাছে এই ভাঙা ঘোড়ার প্রতীক থাকত এবং সেটা থাকত কয়েনের আকারে।”

“তার মানে এই কয়েনগুলো আসলে কয়েন না, অনকেটা ওদের সদস্যপদের মতো?”

“একদম ঠিক। তবে এখন পর্যন্ত এই কয়েনের কোনো অস্তিত্বের কথা কেউই প্রমাণ করতে পারেনি। মানে কেউই দেখেনি এটা, শুধুই মাত্র মিথ প্রচলিত ছিল এটা নিয়ে। এমনকি আমিও এর কোনো প্রমাণ পাইনি। এই প্রথম দেখলাম।

“আচ্ছা তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন যার কাছে এই কয়েন থাকবে সে—ই এই কাল্টের সদস্য ছিল?”

“না, এই কয়েন সবার কাছে থাকার প্রশ্ন আসবেই না। এই কয়েন শুধুমাত্র এই গুপ্ত সংঘের ধারকদের কাছেই থাকত।”

“আচ্ছা, এরপর কী হলো? মানে সিপাহি বিদ্রোহের পর?” হাসান প্রশ্ন করল। দুজনেই পুরো ইতিহাসটা জানতে চাচ্ছে।

“সিপাহি বিদ্রোহে পুরো ভারতবর্ষ জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। ভেঙে পড়ল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ইংরেজরা অনুধাবন করল কোম্পানি আর ভারতবর্ষ শাসন করার ক্ষমতা রাখে না। তখন শাসনব্যবস্থা নিয়ে নিল ইংরেজ সরকার, মানে তৎকালীন রাজ ব্যবস্থা নিজে। এরপর কী ঘটেছিল কেউই সঠিকভাবে বলতে পারে না। তোমরা যে বইটা দেখেছ ওটাতেও এর পরের ইতিহাস কিছু লেখা নেই। ওই বইটাতে লেখক এভাবে শেষ করেছেন, সংঘ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ওদের মূল মোটো নাকি ছিল এই সম্পদের রহস্যকে লালন করা এবং একদিন এই দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য সেটার সঠিক ব্যবহার করা। পাশাপাশি নিজেদের মতো আচার-অনুষ্ঠান পালন করত ওরা।”

“তারপর ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর কী করল ওরা? তখন তো ইংরেজরা এই ভূমি ছেড়ে চলেই গেছে। তখন ওরা সামনে এলো না কেন?”

“তা জানা সম্ভব হয়নি। হয়তোবা ওরা তৎকালীন শাসনব্যবস্থায় খুশি ছিল না। এই কারণেই হয়তো রহস্যটাকে লুকিয়েই রেখেছে। তবে বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের মতে ওদের অস্তিত্বই নাকি বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না ওরা ওদের মতো ঠিকই ছিল। ১৯৪৭-এ ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো। দেশভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলো। এই সময় নাকি আরেকবার এই রহস্য ফাঁস হয়ে পড়ে। কোথায় কীভাবে হয়েছিল কেউই জানে না। কিন্তু শোনা যায় তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নাকি এটার সন্ধান পেয়েছিল এবং কোনোভাবে নাকি পাকিস্তান সরকার সেটা জানতে পারে। হয়তোবা কেউ একজন বেইমানি করেছিল। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মানে আমাদের বাংলাদেশের সর্বত্র উত্তাল অবস্থা। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। এরপর পঁচিশে মার্চ রাতে নাকি সেই প্রফেসরকে ধরতে পাকিস্তান সরকার চেষ্টা করে। এরপরের ইতিহাস কেউই জানে না। ওইদিনের পর থেকে এই ব্যাপারে কেউ কিছু শোনেনি, জানতেও পারেনি। ঐতিহাসিক কোনো ঘটনারও কোথায় রেকর্ডও পাওয়া যায়নি। যারা এই ব্যাপারে আগ্রহী ছিল তারাও ধরে নেয় এরকম আসলে কিছু নেই। পুরোটাই গুজব। একমাত্র আমার নিজের কেন জানি মনে হতো এই মিথ সত্য হলেও হতে পারে।”

“তাহলে আপনি বলছেন ১৯৭১ সালের পর থেকে এর কোথাও কোনো অস্তিত্বই ছিল না? তাহলে আমার মা এই ঘটনার সাথে কীভাবে সংযুক্ত হলো?” অরণি ইতিহাস শুনতে শুনতে একটু বিরক্ত। মজার ইতিহাস হলেও এখন সে চেষ্টা করছে আসল ব্যাপারটার কাছাকাছি আসতে।

“অস্তিত্ব ছিল না গত সপ্তাহ পর্যন্ত। গত সপ্তাহে আমি আগের দিন রাতে ফ্রান্স থেকে ফিরেছি। হঠাৎ হায়দার এসে বলল একজন মহিলা নাকি আমার সাথে দেখা করতে চাইছে। আমি প্রথমে একটু বিরক্তই হই। কারণ প্রচণ্ড টায়ার্ড তো ছিলামই সেই সাথে জেট লেগ। আমার মাথায় তখন ঘুম ছাড়া আর কিছু ছিল না। আমি প্রথমে না করে দেই। হায়দার মানা করে আসার পরও সেই মহিলা বারবার বলতে থাকে খুবই জরুরি। অবশেষে আমি দেখা করতে রাজি হই। এই মহিলাই ছিল – “

“আমার মা,” বশির সাহেবের কথাটা অরণি শেষ করে দিল।

“একদম ঠিক। ভেরি ফাইন লেডি, দিস ইজ সাচ আ শেইম দ্যাট শি ডাইড। আমি ওকে বলেছিলাম, সাবধান করে দিয়েছিলাম। কিন্তু… আহমদ বশিরের গলায় আফসোসের সুর। “যাহোক ওইদিন ও এলো। এসে সরাসরি আমার কাছে জানতে চাইল আমি এই ব্রোকেন হর্সের মিথের ব্যাপারে কী জানি। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে জানতে চাইলাম কেন। সে-ও কোনো উত্তর না দিয়ে আমাকে ছবিটা বের করে দেখাল। আমি আগ্রহী হয়ে তাকে পুরো ইতিহাসটা জানালাম। ও শুনতে শুনতে খুবই উত্তেজিত হয়ে গেল। আমাকে বলল, এই ইতিহাসের সন্ধান যদি সে বের করতে পারে তবে আমি তাকে কোনো সাহায্য করতে পারব কি না? আমি জানালাম অবশ্যই পারব। সে আমাকে জানাল এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছে না। কারণ খুব বিপদে আছেন। এটা কেটে গেলেই ও ফিরে আসবে অথবা তার যদি কিছু একটা হয়ে যায় তবে অন্য কেউ একজন আসবে। ও তোমার কথা বলেছিল। আমি তাকে বললাম, যেকোনো ঝামেলা বা বিপদে আমি সাহায্য করতে পারব। চাইলে সে আমার কাছে আশ্রয় পেতে পারে। আমাকে উত্তরে ও বলল, সেটা এখন সম্ভব না, বলে আমাকে একটা জিনিস দিল। দিয়ে বলল, যদি সে ফিরে আসতে পারে তবে এর কোনো প্রয়োজন হবে না। আর যদি ফিরে আসতে না পারে তবে আমি যেন সেটা তোমার কাছে দেই। এরপর আমার সামনেই জিনিসটা সিল করে দিল এবং বলল, আমি যেন কোনো অবস্থাতেই তোমাকে ছাড়া সেটা না খুলি। এরপর আফরোজা চলে গেল। আমি জানতাম সে বিপদে আছে। যদিও আমার সাহায্য ও রিফিউজ করেছিল তবুও আমি হায়দারকে বললাম, ওর ওপর নজর রাখতে। কোনো বিপদ বা ঝামেলা হলে প্রয়োজনে সাহায্য করতে। হায়দার তাকে ফলো করতে গিয়ে দেখে আগে থেকেই অন্য একটা গ্রুপ ফলো করছে ওকে। এখান থেকে বেরিয়ে হায়দার তাকে ফলো করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে। এরপর হায়দার তার বাসার সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। ইতোমধ্যে আমি তার ব্যাপারে সব খোঁজখবর নিয়ে ফেলি। একদিন পর সে বাড়িতে ফিরে আসে। বাসায় ঢোকার ঘণ্টাখানেক পরেই তুমি সেখানে যাও। হায়দার আমার কাছে জানতে চায় ও কী করবে। আমি তখন বোকার মতো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমি আফরোজার বিপদের কথা চিন্তা করে পুলিশে খবর দিতে বলি। বাকিটা তোমরা জানো। আমার মনে হয়। আফরোজা বাড়িতে ঢোকার পরপরই খুন হয়। এবং তখন তুমি ওখানে গিয়ে ঢোকো। আর এরপরেই পুলিশ আসে এবং তোমাকে অ্যারেস্ট করে।”

তার মানে আপনি জানতেন আমি খুন করিনি?” হাসান প্রশ্ন করল।

“অনুমান করতে পেরেছিলাম,” আহমদ বশির আবারও কফি ঢেলে নিল।

“এরপরও আপনি সামনে আসেননি!” হাসান আবারও রেগে উঠছে।

“কোনো কারণ ছিল কি?” সে তীর্যকভাবে হাসানের কাছে প্রশ্ন করল। “তুমি বলো আমার জায়গায় তুমি হলে কী করতে?” হাসান চুপ হয়ে গেল। লোকটা ঠিকই বলেছে। শত্রুর হয়ে কে ওকালতি করতে যায়।

“তবে সেটাও না। আমি আসলে অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য। আমি জানতাম তুমি আসবে। আফরোজা অনেক কনফিডেন্স নিয়ে বলেছিল তার কিছু হলে তুমি আসবেই এবং সেটা বের করেই ছাড়বে।”

অরণির হঠাৎ চোখে পানি চলে এলো। “আপনি বলছিলেন মা আমার জন্য একটা খাম রেখে গেছে?” সে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল।

“হ্যাঁ, আফরোজা বলেছিল তোমার কাছে একটা ডায়েরি থাকবে। তুমি ছবি ডায়েরি আর কয়েনটা বের করো। আমি খামটা বের করছি,” বলে সে ড্রয়ার খুলে একটা চাবি বের করে বুক শেলফের দিকে এগিয়ে গেল। বুক শেলফের একটা অংশের প্যানেলিং সরাতে ওখানে একটা ছোট্ট লোহার কেইসের তালা খুলে ডালাটা সরাতেই দেখা গেল একটা সেইফ বাক্স। ওটার ওপরে কম্বিনেশন লক দেওয়া। সে পাসওয়ার্ড টিপে সেইফ বক্স থেকে বের করে আনল একটা খাম।

অরণিও ওর ব্যাগ থেকে প্যাকেটটা বের করে ডায়েরি আর কয়েনটা টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখল।

বশির সাহেব সাদা সিল করা খামটা টেবিলের ওপর এনে রাখল। “আমি ডায়েরিটা দেখব।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডায়েরি। সালটা ১৯৭১। “এ ধরনের ডায়েরি একটা সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে দেওয়া হতো,” বলে সে ডায়েরিটা খুলে দেখল। ভেতরে প্রথমেই ব্যক্তিগত তথ্যের পাতাটা নেই। সেখান থেকে শুরু করে একবারে ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত একটা পাতাও নেই। ২৬শে মার্চ থেকে পাতাগুলো সব ঠিক আছে। কিন্তু ওতে কিছু লেখা নেই। পুরো ডায়েরিটাই ফাঁকা।

তিনজনই টেবিলের ওপর ঝুঁকে আছে। হাসান টেবিলের ওপর থেকে খামটা তুলে নিল। নাড়া দিতে ভেতরে খসখস শব্দ হলো। “ভেতরে মনে হয় কাগজ আছে। হতে পারে ডায়েরির মিসিং পাতাগুলো। কিন্তু আমার একটা কথা আছে,” বলে হাসান আহমদ বশিরের দিকে তাকাল। “উইথ ডিউ রেসপেক্ট স্যার, আমরা কী করে বুঝব আপনি খামটা খুলে পাতাগুলো সরিয়ে ফেলেননি।”

“ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে, আর সাংবাদিক… যাহোক, আমি এনশিওর করছি। আমার ধারণা সিলটা যে অথেনটিক অরণি এটা বুঝতে পারবে। সিলটার দিকে দেখো। ওটার ওপরে ওর মায়ের হাতের একটা আংটির ছাপ আছে। আমার ধারণা ও ছাপটা চিনতে পারবে। অরণি সিলটা দেখে নিয়ে মাথা নাড়ল।

“সন্দেহ দূর?”

“ওকে স্যার, সরি। আমরা কি এখন খামটা খুলতে পারি?”

অরণি খামটা তুলে নিল টেবিল থেকে। কিন্তু হঠাৎ বশির সাহেব ওকে থামিয়ে দিল। “কিন্তু আগে একটা শর্ত আছে,” অরণি অবাক হয়ে গেছে। “কী শর্ত?”

“শর্তটা আমার দেওয়া না, তোমার মা-ই বলে গেছেন। শর্তটা হলো তুমি কেন আফরোজা, মানে তোমার মা-কে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে? তখন কী ঘটেছিল? তোমাকে পুরো ঘটনাটা বলতে হবে।”

 অরণি কারেন্টের শক খেয়ে থেমে গেল। এরকম কিছু তার স্বপ্নেও আসেনি। ওর মা এরকম কিছু বলে যেতে পারে এটা তার মোটেও বিশ্বাস হতে চাচ্ছে না। “অসম্ভব। মা এটা বলে যেতেই পারে না। আমি বিশ্বাস করি না।”

“তোমার মা-ই এটা বলে গেছেন অরণি। তোমার মা যদি বলে গিয়ে না থাকে তবে আমি কীভাবে জানব যে তখন কিছু হয়েছিল। কিংবা আদৌ কিছু হয়েছিল কি না এবং তোমার মা-ই সব বলে গেছে তুমি এই ব্যাপারটা না বললে এই রহস্যের সমাধান কোনোদিই করা যাবে না। কাজেই তোমাকে বলতেই হবে।”

অরণির চোখে পানি চলে এসেছে। ও কিছু বলতে পারছে না। মা এভাবে ওকে এবং নিজেকে অপমান করতে পারে এটা কোনোদিনই ভাবতে পারেনি ও। মা এভাবে মারা যাওয়ার পরেও ওর ওপর প্রতিশোধ নেবে ও ভাবতেই পারেনি।

“অরণি ব্যাপরটা আসলে কী বলো তো?” এবার হাসান জানতে চাইল। ও অরণির একটা হাত ধরে রেখেছে। “আমিও জানতে চাই, আসলে কী ঘটেছিল। কারণ বহুবার আমি ম্যাডামের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আঙ্কেল কীভাবে অ্যাকসিডেন্টে মারা গেলেন। কেন তুমি হঠাৎ এভাবে বাইরে চলে গেলে। তিনি আমাকেও কোনো সঠিক উত্তর দেননি। তুমিই বলো আসলে ব্যাপারটা কী? আমি বুঝতে পারছি এমন কিছু একটা ঘটেছিল তুমি বলতে চাইছ না। তারপরও আমি মনে করি তুমি আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারো।”

“বলো অরণি, তুমি সব খুলে বলতে পারো।”

অরণি একটু দম নিল। টিসু দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে শক্ত করার চেষ্টা করল নিজেকে। “আমার চলে যাওয়া, বাবার মৃত্যু, সবকিছুর পেছনে একটাই কারণ ছিল, বলে সে একবার বশির সাহেবকে এবং আরেকবার হাসানকে দেখল। “কারণ আমার মা একজন যুদ্ধ শিশু।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *