২৬
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা
২৬শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : রাত প্রায় ৩টা
ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে আসাটা অনেকটা গভীর অন্ধকার থেকে আস্তে আস্তে আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার মতো। কিন্তু এই ধীর প্রক্রিয়াটা মনিরুজ্জামান পুরোটা শেষ করতে পারল না। হঠাৎ পানির ঝাপটার তোড়ে চমকে সজাগ হয়ে গেল। সজাগ হয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগল। এক মুহূর্ত কিছুই দেখতে পেল না সে, কিছুই মনে করতে পারল না। তারপর ধীরে ধীরে সব মনে পড়তে লাগল। সে পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে বন্দি।
আলোটা চোখে সয়ে আসার পর প্রথমেই দেখতে পেল একজন লোক বিছানায় বসে কিছু একটা দেখছে। লোকটাকেও সে চিনতে পারল। একটু আগেই নাম বলেছিল। কর্নেল হাবিব। তার পাশে দাঁড়ানো দুজনের একজনকে চিনতে পারল। ফরসা লম্বা ছেলেটাকে চিনতে না পারার কোনো কারণ নেই। এই ছেলেটা তার ছাত্র ছিল। কিন্তু কিছুতেই নাম মনে করতে পারল না। ছেলেটা বেশ উদ্বেগের সাথে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে আরও কয়েকজন মিলিটারিকে দেখতে পেল সে। পুরো বাড়িটাকে লন্ডভন্ড করে ফেলা হয়েছে। এমনকি বিছানার জাজিম—তোশকও কাটা হয়েছে কুচি কচি করে।
আশার ব্যাপার আবু আর কবিরকে দেখতে পেল না। তার মানে ওরা হয়তো ধরা পড়েনি।
“মি. মনিরুজ্জামানের জ্ঞান ফিরল তাহলে। খুব বেশিক্ষণ অজ্ঞান ছিলেন না আপনি, বড়জোর মিনিট পনেরোর মতো। আপনি কী ভাবছেন আমি জানি। আপনার দুই ছাত্রের কথা তাই না?” বলে সে একজন সৈন্যের দিকে ফিরে ইশারা করল।
মনিরুজ্জামানের সমস্ত শরীরে একটা হতাশার স্রোত বয়ে গেল। কারণ আবু আর কবিরকে দুজন মিলিটারি টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে এলো। ইতোমধ্যেই আবুর একটা চোখ ফুলে উঠেছে মারের চোটে।
“আপনি ওদেরকে ছেড়ে দিন। আপনার বিরোধ বা প্রয়োজন আমার সাথে। ওদের সাথে আপনার কোনো বিরোধ নেই। ওদের কোনো দোষও নেই। কাজেই ওদেরকে ছেড়ে দিন,” মনিরুজ্জামান নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল। সে ভেবেছিল আওয়াজই বেরোবে না। কিন্তু বেশ দৃঢ় স্বরেই কথাগুলো বলল।
“তোমরা বাঙালিরা এখনও মাথা সোজা করে কথা বলার সাহস রাখো? একটু অবাক হলাম,” পরিষ্কার ঝরঝরে ইংরেজিতে কর্নেল বলে উঠল। “আজ রাতের পর থেকে মাথা তোলা তো দূরে থাক মেরুদণ্ডও যাতে বাঁকা হয়ে যায় সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”
মনিরুজ্জামান তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে মিলিটারি পোশাক পরা মির্জার দিকে তাকাল। “মির্জা ভালো আছ?” হঠাৎ তার ছেলেটার নাম মনে পড়েছে। “তোমার মা কেমন আছে? কিছুদিন আগে তোমাদের ব্যাচের কার কাছে যেন শুনেছিলাম তিনি অসুস্থ। এখন কেমন?”
মির্জা মাথা নিচু করে আছে। সে মনিরুজ্জামানের দিকে না তাকিয়েই বলল, “জি, এখন ভালো।”
“শাবাশ মি. মনিরুজ্জামান। আপনার সাহস আছে। বাঘের খাঁচায় দাঁড়িয়ে বাঘকে উপেক্ষা করে কথা বলেন। দারুণ,” বাঙালিদের ভেতরে এত তেজ আমি এর আগে দেখিনি।
“মি. কর্নেল আপনি বাঙালিদের সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তবে টের পাবেন আশা করি। এখন বলুন আমাকে কী দরকার? আর শুনুন এটা মোটেই বাঘের খাঁচা নয়। এটা আমার বাসা, আপনারা এখানে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করেছেন।
এবার আর সহ্য করতে পারল না মেজর ফয়সল। যেখানে বাঙালিদের পায়ের নিচে পিষে ফেলা হচ্ছে সেখানে এই পুঁচকে ইঁদুর কি না মুখে মুখে কথা বলছে। কর্নেলের পাশে দাঁড়ানো মেজর ফয়সল বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে একটা চড় মারল। এরপর সবুট লাথি মেরে ফেলে দিল মনিরুজ্জামানকে। মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরও লাথি মারতেই লাগল। কর্নেল হাবিব তাকে ধমকে উঠতেই সরে দাঁড়াল।
মনিরুজ্জামান কাশতে কাশতে উঠে পড়ল। তার চেয়ারের একটা পায়া ভেঙে গেছে। একজন সৈন্য এগিয়ে এসে তার কাঁধে চাপ দিয়ে বসিয়ে দিল মাটিতে। মনিরুজ্জামান কাশতে কাশতে মুখ তুলে তাকাল।
“কিছু টের পেলেন মি. মনিরুজ্জামান?” বলে কর্নেল একটা সিগারেট ধরাল। “এবার বলুন জিনিসটা কোথায়?”
“কোন জিনিস?”
“মি. জামান। আপনাকে জামান বলে ডাকি, এই লম্বা নাম বারবার বলতে কষ্ট হয়। যে জিনিসটা আপনার বন্ধু হাফিজ আপনাকে দিয়েছিল। যে জিনিসটা এখন আপনার কাছে আছে বলে আমি মনে করি।”
“আমার কাছে কিছুই নেই। সহজভাবে চিন্তা করুন,” বলে মনিরুজ্জামান কাশতে লাগল। বুকের ওপর বুটের লাথিতে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে সে। “যদি জিনিসটা আমার কাছেই থাকত তবে আমি এখানে কেন?”
“সেটাই তো আমি বোঝার চেষ্টা করছি।”
তাকে থামিয়ে দিয়ে মনিরুজ্জামান জানতে চাইল, “হাফিজের কী হয়েছিল? কর্নেল সাহেব আপনি যদি আমাকে পুরো ব্যাপারটা না বলেন আমি আপনাকে কোনো তথ্য দেব না। হাজার টর্চার করলেও না,” বলে সে আবারও কাশতে লাগল।
কর্নেল একবার তার দিকে দেখল। মির্জা বলে উঠল, “স্যার আমার মনে হয় কথোপকথনটা ভালোভাবে করা দরকার।”
কর্নেল হাবিব মনিরুজ্জামানের দিকে দেখিয়ে ইশারা করল। মির্জা তাকে উঠিয়ে অন্য একটা চেয়ারে বসিয়ে পানি খেতে দিল। মনিরুজ্জামান পানি খেয়ে একটু শান্ত হলো। মনিরুজ্জামানকে ধরে চেয়ারে ওঠানোর সময় মির্জা তার কানে কানে বলল, “আমি সরি স্যার।”
মনিরুজ্জামান কিছু বলল না।
“এখন বলুন, জিনিসটা কোথায়?”
“আপনি আমাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে না বলা পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারছি না। বলতেও পারব না।”
“ঠিক আছে। মাস কয়েক আগে আমাদের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স যখন আপনাদের বাঙালিদের হাঙ্গামা নিয়ে ব্যস্ত তখন এক ইন্টেলিজেন্স অফিসার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গোপন সোর্সের কাছ থেকে একটা বার্তা গ্রহণ করে। বার্তাটি একদিকে ছিল বেশ ইন্টারেস্টিং অন্যদিকে বেশ হাস্যকরও। ঢাকা শহরের বুকে ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে একটা গোপন কাল্ট নাকি নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নাকি পুরানো একটা ধারণা লালন করে এবং তাদের কাছে নাকি মোগল আমলের হারানো সম্পদের বিরাট এক উৎস লুকানো আছে। ইন্টেলিজেন্স অফিসার প্রথমে উড়িয়ে দিলেও পরে সে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে এই কাল্টের অস্তিত্ব নাকি সত্যিই আছে এবং এর বর্তমান প্রধান নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। মজার ব্যাপার হলো এরা নিজেদের গোপন কার্যক্রম পরিচালনা করে খুব সাবধানে। তাহলে প্রশ্ন হলো এদের অস্তিত্ব তাহলে ফাঁস হলো কীভাবে? কাল্টের প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার এক বন্ধুকে একটা বিরাট প্রজেক্টের ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য তাকে পুরো ব্যাপারটা জানায় এবং সেখান থেকেই ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়ে। আমার ধারণা এই বন্ধু শিক্ষকই আপনি মি. জামান।”
মনিরুজ্জামান চুপচাপ শুনল কিন্তু কিছু বলল না।
“এরপর আমরা পুরো ব্যাপারটা খুব গোপনে এবং সাবধানে লক্ষ করতে থাকি এবং আমাদের একজন ভেতরের এজেন্ট আমাদেরকে সব তথ্য দিতে থাকে। পুরো ব্যাপারটা যখন একটা পরিণতির দিকে যেতে থাকে তখন পূর্ব পাকিস্তানে লাগে গন্ডগোল। তখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশ আসে আজ রাতের ভেতরেই যেভাবেই এর শেষ সন্ধান বের করতে হবে। কারণ আজ রাতে পূর্ব পাকিস্তান ধ্বংস হবে। চিরতরে বাঙালি জাতিকে দমিয়ে দেওয়া হবে। তার আগে এই পুরো সম্পদটার হদিশ পাকিস্তান সরকারের চাই। আর আমি এর দায়িত্বেই আছি।”
“হাফিজের কী হয়েছিল?” মনিরুজ্জামান গম্ভীর স্বরে জানতে চাইল।
“আহহহ, হাফিজ আপনার বন্ধু, মহান এক কাল্টের প্রধান। আসলে আজকে হাফিজের পরিণতির জন্য আপনিই দায়ী। এই মুহূর্তে আপনার এই দুরবস্থার জন্য আপনার বন্ধুই দায়ী। হাহা, পোয়েটিক জাস্টিস, ইজন্ট ইট, মি. জামান?” কর্নেল হাসাতে হাসতে আবার শুরু করল। আপনার পাগলাটে বন্ধুর এই কাল্টের একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে, বর্তমান কর্ণধার সবসময় কাল্টের ভবিষ্যৎ কর্ণধার ঠিক করে এবং সবসময় তিনজন জীবিত মানুষ এর খোঁজ জানে। আপনার বন্ধুর এই তিনজন মানুষের একজন তিন মাস আগে মারা যায় তখনই তিনি আপনাকে সব জানান। অপরজনকে আজ আমরা কুর্মিটোলা এয়ারপোর্ট থেকে পাকড়াও করেছি। একে পাকড়াও করার আগে সব গুছিয়ে এনে আমরা যখন আপনার বন্ধুর বাড়িতে হানা দেই ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তিনি গলায় দড়ি দিয়েছেন এবং সেটা করার আগে আমার বিশ্বাস তার সব গোপন রহস্য, সম্পদ আর সবকিছুর সন্ধান দিয়ে গেছেন আপনাকে। আর সেটা সে করেছে এমনভাবে যেটা একমাত্র আপনিই বুঝতে পারবেন আর একারণেই সব ক্লু আমরা ছিনিয়ে না নিয়ে সেটা আপনার হাতে তুলে দিয়েছি, যাতে আপনি এটা বের করতে পারেন। আপনার এই বন্ধুটি মারা যাওয়ার পর আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিই তার রেখে যাওয়া সব কু আমি আপনার হাতে তুলে দেব। হাসপাতালে ওই অফিসার সেই দায়িত্বটা পালন করেছে। এরপর আপনাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর আমার নির্দেশেই ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ আমি জানতাম আপনার বন্ধু এই রহস্য চিরতরে হারিয়ে যেতে দেবে না। কাজেই সে এটা এমনভাবে সাজিয়ে গেছে যেটা একমাত্র আপনিই বুঝতে পারবেন। আজ দুপুরে হাসপাতালে ওই প্যাকেটটা আপনার হাতে পড়ার পর থেকে যা যা ঘটেছে সবই আসলে আমিই পরিচালনা করেছি। আপনি শুধু গুটির মতো চলেছেন। তবে খেলা এখনও শেষ হয়নি, এখন আপনি জিনিসটা বের করে আমাদেরকে দেবেন।”
মনিরুজ্জামান হাসতে লাগল। কর্নেল তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছে না হাসির কী হলো।
“মি. কর্নেল আপনি আমাকে হাসালেন। তো বুদ্ধিমান মানুষ আপনি কিন্তু হিসাবে ছোট্ট একটা ভুল করে ফেলেছেন। হাফিজ আসলে আমাকে উত্তরসূরি করতে চেয়েছিল মাত্র। কিন্তু আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই সে মারা গেছে। আমার কাছে কিছুই নেই। হাফিজ কী করেছে বোঝার আগেই আপনারা আমাকে ধাওয়া শুরু করেন। আমি এতসবের কিছুই জানতাম না। আমি কিছুই জানি না।”
“মি. জামান আমার ধারণা আপনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের চিনতে পারেননি। আমরা হিংস্র পশুর চেয়েও হিংস্র হতে পারি। আপনি আমার এই ভদ্র চেহারা দেখে ভুল ভাববেন না। আমি আপনাকে সব বললাম। আর আপনি যদি আমাকে সহায়তা না করেন। এর পরিণতি আপিনি ভাবতেও পারবেন না।”
মনিরুজ্জামান চুপ করে আছে। তার মুখে রক্তের নোনা স্বাদ, কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে মুখের কাটা জায়গাগুলো জ্বালা করছে। সে কিছুই বলল না।
“আপনি কি ভাবছেন মি. জামান আমি কিছুই জানি না। আমি অনেক কিছুই জানি। আমি জানি আপনি এখানে কেন?” বলে সে একজন মিলিটারির দিকে ইশারা করল। লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটু পরেই ফিরে এলো। হাতে একটা বাক্স।
“আপনি এটার জন্য এখানে এসেছেন, তাই না?”
মনিরুজ্জামান মনে মনে প্রমদ গুনল। গেল এতসব কষ্ট, শ্রম, মেধা সব তো গেলই এখন প্রাণটাও যাবে। চরম হতাশার সাথে সে অনুভব করল জিনিসটা ওদের হাতে পড়ে গেছে। আসলে কর্নেল সত্যিই বলেছে হাফিজ পুরানো ওই কাল্টের প্রধান ছিল। ওদের মোটোই ছিল প্রাচীন এই সম্পদকে আগলে রাখা এবং সেটা এই দেশের মানুষের কাজে লাগানোর। মনিরুজ্জামান এর সাথে জড়িয়েছে দুই মাস আগে। সে একটা কাজের জন্য বড় ফান্ড খুঁজছিল, ঠিক সেই সময়ই হাফিজের কাল্টের তিন প্রধানের একজন মারা যায়। হাফিজ তখন তাকে উত্তরসূরি করার কথা চিন্তা করে। সে মনিরুজ্জামানকে ধীরে ধীরে সবকিছু শিখিয়ে আনছিল এই সময়ে দেশে গন্ডগোল লাগে। এরপর সবকিছু বোঝার আগেই আজকের ঘটনা। আর এখন তো মনে হচ্ছে…
“কি খুব হতাশ লাগছে মি. জামান? হতাশ হওয়ার কোনোই কারণ নেই। আপনাকে একটা মজার জিনিস দেখাই,” বলে সে কাগজে মোড়ানো বাক্সটার মুখ খুলে ফেলল। “দেখুন।”
মনিরুজ্জামান মাথা সামনে বাড়াল দেখার জন্য। সবাই তাকিয়ে আছে বাক্সটার দিকে। সবাই অবাক হয়ে দেখল ভেতরে কিছুই নেই। জিনিসটা পুরোপুরি ফাঁকা।
“মি. জামান, এটা ফাঁকা, ভেতরে কিছুই নেই। আমরা এখানে এসে পৌঁছানোর পর এটাকে এভাবেই পেয়েছি। আমার ধারণা আপনি জানেন এর ভেতরের জিনিসটা কোথায়। এবং আপনি এখন আমাদেরকে সেটা বলবেন।”