২৫শে মার্চ – ১৯

১৯

পুরান ঢাকা
বর্তমান সময়, বেলা ৪টা

পুরান ঢাকা জায়গাটা কখনোই তার পছন্দ না। একে তো মানুষের ভিড় তার ওপর আবার অতিরিক্ত চিপা গলি। তবে সমস্যা আসলে এগুলোর কোনোটাই না। সমস্যা হলো এখানকার মানুষ। এখানে কেউ কাউকে কেয়ার করে না। এটাই হলো তার ভালো না লাগার মূল কারণ। এছাড়া আরেকটা কারণ অবশ্য আছে। তার নিজের জন্ম এবং বেড়ে ওঠাও এই এলাকাতেই। বহু বছর আগে সে এখান থেকে পালিয়েছিল। বহু বছর আগে, ধোলাইখালের এক মহাজনের পালিত চোর ছিল সে। একদিন মহাজনের সব টাকা চুরি করে পালাল। তখন তার বয়স ছিল আট কি দশ। এরপর কত পানি গড়িয়ে গেল বুড়িগঙ্গা দিয়ে। আজও পালিয়েই চলেছে। কত বছর আগে ছিল সেটা, বিশ, নাহ আরও আগে। প্রায় ত্রিশ বছর আগে পালিয়েছিল সে এখান থেকে। এসবই এখর বহু দূরের স্মৃতি। এখন তাকে এই ছেলে আর মেয়ে দুটোকে খুঁজে বার করতে হবে।

.

লুঙ্গির গিঁট ঠিক করতে করতে বয়স্ক এক লোক বেরিয়ে এলো বাইরে। পরনে কুঁচকানো শার্ট। ঘুমঘুম চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “কাকে চাচ্ছেন?” বেশ পরিশীলিত কণ্ঠস্বর।

“জি, আমরা মোল্লা সাহেবকে চাচ্ছিলাম,” হাসান বেশ ভদ্রভাবেই বলল।

“বলুন, আমিই খলিল মোল্লা। কিন্তু আপনাদেরকে তো চিনতে পারলাম

না,” লোকটা চোখ ছোট ছোট করে ওদেরকে দেখার চেষ্টা করছে। “আপনারা কি কোনো অ্যান্টিকের খোঁজে এসেছেন?”

“না আঙ্কেল, কিন্তু অনেকটা ওই ধরনের একটা তথ্য আমাদের দরকার এবং খুবই জরুরি দরকার,” অরণি সামনে এগিয়ে এলো।

“আপনারা কয়েকদিন পরে এলে ভালো হয়। আমার আসলে শরীরটা বেশি ভালো না,” লোকটা কাশতে কাশতে বলল।

“আঙ্কেল আসলে আমাদের দরকারটা খুবই জরুরি না হলে আপনাকে ডিসটার্ব করতাম না,” এবার হাসান অনুরোধ করল। “আঙ্কেল, আমাদের বেশি সময়ও লাগবে না। মাত্র কয়েক মিনিট।”

“ঠিক আছে তোমরা এখানেই বসো,” বলে সে ছাদে রাখা চেয়ার দেখাল। “আমি আসছি।”

ওরা দুজনে দুটো চেয়ার টেনে বসল। একটু পরে মানুষটা বেরিয়ে এলো, হাতে একটা চশমা আর শার্টটা চেঞ্জ করে এসেছে।

“বলো তোমাদের কী জানা দরকার?” সে নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল।

“আঙ্কেল আমরা আসলে সঠিক কোন বিষয়ে জানতে চাচ্ছি সেটা আমাদের নিজেদের কাছেও পরিষ্কার না। তবে সেটা যাই হোক এই ছবিটার সাথে সংশ্লিষ্ট,” বলে অরণি ওর ব্যাগ থেকে ছবিটা বের করে দিল। “সেইসাথে এই জিনিসটাও।”

এবার বের করে দিল কয়েনটা।

চাচা মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখতে দেখতে হাত বাড়িয়ে কয়েনটা নিল। সেটা হাতে ধরে বুঝতে সময় নিল এক সেকেন্ড। কয়েনটা দেখে সে রীতিমতো আঁতকে উঠল। আরেকটু হলে কয়েনটা ফেলেই দিয়েছিল।

“ও মাই গড,” কয়েনটা সে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বলল। “আমি সবসময়ই জানতাম কিন্তু আমার হাতে কখনোই কোনো প্রমাণ ছিল না এবং এই কারণেই কেউ আমার কথা বিশ্বাস করেনি।”

“আঙ্কেল আপনি কী বলছেন? একটু পরিষ্কার করে বললে ভালো হতো, হাসান বলল। ওরা বুঝতে পারছে এই লোক অবশ্যই কিছু একটা জানে।

লোকটা এখনও মুগ্ধ হয়ে জিনিসটাই দেখছে,” সেটা অরণির হাতে ফেরত দিতে গিয়ে হঠাৎ অরণির মুখের দিকে তাকাল। এর আগে সে চশমা পরা অবস্থায় সরাসরি ওর মুখের দিকে তাকায়নি।

“তুমি তুমি, তোমাকে কি আমি চিনি?” তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অরণিকে চেনে। “না না, তোমাকে না গত সপ্তাহে আরেকজন ভদ্রমহিলা এসেছিলেন দেখতে ঠিক তোমার মতোই। আমার দোকানে এসেছিলেন। তিনি কি তোমার কিছু হন?”

“হ্যাঁ, আমার মা,” তার সাথে আপনার কথা হয়েছিল?”

“হ্যাঁ, সে-ও ঠিক এই ব্যাপারেই জানতে চেয়েছিল?”

“কোন ব্যাপারে? এই ছবি আর কয়েন?”

“না সে আমাকে এগুলো দেখায়নি। দেখালে আমি তাকে সাবধান করে দিতাম। এগুলোর জন্য মানুষের ক্ষতি হতে পারে। এবং তোমাদেরকেও বলছি, এগুলো সাবধানে রাখবে এবং তোমরাও সাবধানে থাকবে। সবখানে এগুলো বের করবে না, দেখাবে না।”

“কিন্তু চাচা জিনিসগুলো আসলে কী?” হাসানের আর তর সইছে না। “আর ম্যাডাম মানে ওর মাকে,” অরণিকে দেখিয়ে বলল। “তাকে আপনি কী বলেছিলেন?”

“একটা একটা করে বলছি। এই জিনিসগুলো বিশেষ করে কয়েনটা ধরে নেওয়া হয়। এই কারণেই ‘ধরে নেওয়া হয়’ বলছি কারণ কোনো প্রমাণ নেই। এই প্রথম আমি একটা প্রমাণ দেখলাম। এই কয়েনটা। এটা একটা মিথ প্রাচীন ভারতে একটা কাল্ট ছিল। যারা সিপাহি বিদ্রোহের পর সংঘটিত হয় বলে কথিত আছে। ওদের সিম্বল ছিল এই কয়েন এবং এই ঘোড়া। যে ঘোড়ার একটা পা ভাঙা।”

“চাচা আমাদের কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। যদি কোনো কাল্ট থেকে থাকে…”

“মনে রেখো অস্তিত্বহীন কাল্ট। কারণ আজকের আগ পর্যন্ত আধুনিক যুগে এর কোনো প্রমাণ ছিল না। এই কয়েনটা প্রমাণ করে ওরা ছিল।”

“ঠিক আছে ধরে নিলাম কাল্টের ব্যাপারটা কিন্তু সেটার সাথে আমার মায়ের সম্পর্ক কী?”

“সেটা তো আমি বলতে পারব না। একসময় যখন যুবক ছিলাম, ইতিহাসের ছাত্র থাকা অবস্থায় আমি আমার মাস্টার্স থিসিস করেছিলাম প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন কাল্টের ওপর এই যেমন ধরো ঠগি, মা কালীর ভক্ত, মা ভবানীর ভক্ত, তুসুমবাজ এই ধরনের কাল্টদের নিয়ে। তখন আমি প্রথম জানতে পারি নাম না জানা এই কাল্টের কথা। আমিও বিশদ জানি না।”

“এদের ব্যাপারে কোথায় গেলে আমরা জানতে পারব?”

“ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিল তোমার মা। তাকে আমি যেটা বলেছিলাম তোমাদেরকেও সেটাই বলব। তোমরা এই ব্যাপারে জানতে পারবে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন লাইব্রেরিতে গেলে।”

“সেটা আবার কোথায়? পাবলিক লাইব্রেরি, নাকি আগারগাও ন্যাশনাল লাইব্রেরি?” হাসান প্রশ্ন করল।

“না কোনোটাই না। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন লাইব্রেরি, ব্রাহ্ম লাইব্রেরি। ওটাই বাংলাদেশের প্রথম লাইব্রেরি ছিল এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরানো বইগুলো ওখানেই পাবে। এই কাল্টের ব্যাপারে জানতে চাইলে তোমাকে ওখানেই যেতে হবে। তোমার মাকেও আমি ওখানকার কথাই বলেছিলাম।”

“এই লাইব্রেরিটা কোথায়?” অরণি প্রশ্ন করল।

“পাশেই। তোমরা এই রাস্তা থেকে বেরিয়ে মূল রাস্তায় উঠবে। পুলিশ ফাঁড়িটা বামে ধরে দাঁড়াও ডান দিকে হাঁটা দেবে। মিনিট দশেক হাঁটলেই হাতের বামে দেখবে লাল একটা বড় পুরানো বাড়ি আছে। গেটের ওপরে এবং বাড়িটার ওপরে লেখা আছে ব্রাহ্মসমাজ উপাসনালয়। ওখানে গেলেই পাবে।”

“ঠিক আছে চাচা, আমরা তাহলে উঠি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অসুস্থ অবস্থায় আপনাকে কষ্ট দিলাম,” অরণি হাসিমুখে বলল।

“তবে একটা উপকার চাইব, আমি,” চাচাও হাসিমুখে বলল। এই গোটা ব্যাপারটার যদি সমাধার পাও তবে একসময় এসে আমাকে জানিয়ে যেয়ো।”

“ঠিক আছে চাচা খোদা হাফেজ,” হাসান বিদায় জানাল।

চাচাকে বিদায় জানিয়ে দুজনেই বেরিয়ে এলো বাইরে। প্রায় পাঁচটা বাজতে চলেছে। শেষ বেলার আলো পুরান ঢাকার আকাশে ছড়াতে শুরু করেছে। “হাসান আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে,” অরণি কথাটা না বলে পারল না।

“আমারও, চলো দ্রুত কিছু খেয়ে নেই,” বলে ওরা হাঁটা দিল। কাছেই একটা হোটেলে ঢুকে হালকা কিছু খেয়ে বেরিয়ে এলো দুজনে। “এবার তাহলে গন্তব্য ব্রাহ্ম লাইব্রেরি। চলো দ্রুত যাওয়া যাক। লাইব্রেরি কয়টা পর্যন্ত খোলা থাকে কে জানে।”

দুজনেই রওনা দিল লাইব্রেরির দিকে।

.

তার কপালটা ভালোই বলা চলে। শুধু ভালো না, বেশ ভালো। পাটুয়াটুলিতে এসে সে ঘোরাঘুরি করছিল এদিক-সেদিক। কিন্তু কোন দিকে যাবে সঠিক নির্দেশনা পাচ্ছিল না। নির্দিষ্ট দোকানের ঠিকানাটা দেখে ওখানে গিয়ে দেখে ওটা বন্ধ। আশেপাশে খোলা আর কোনো দোকানও নেই যে জিজ্ঞেস করবে। কাজেই বেহাল এক দশায় পড়ে গিয়েছিল সে। দিশা না পেয়ে একটা দোকানের সামনে এসে সিগারেট ধরিয়ে দুটো টান দেওয়ার সাথে সাথে দেখে দুজন একটা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসছে। মনে মনে সে একটা খুশির চিৎকার করে উঠল। যাক পাওয়া গেছে। আবার শুরু হবে অনুসরণ করা।

.

“কই হাঁটতে হাঁটতে প্রায় পয়েন্টের কাছাকাছি চলে এলাম, ব্রাহ্ম উপাসনালয় তো দেখি না,” হাসান রাস্তার দুই পাশে দেখতে দেখতে মন্তব্য করল।

“পয়েন্ট মানে কোন পয়েন্ট?” অরণি জানতে চাইল। হোটেলে ঢুকে খানিকটা ফ্রেশ হয়ে হালকা খেয়ে এখন অনেকটা ভালো লাগছে।

“ওই তো সামনে গেলেই পয়েন্ট। ওখান থেকে একদিকে জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি, বাংলাবাজার, সদরঘাট সব। ও তুমি চিনতে পারবে সকালে জজ কোর্টে ছিলে না ওখানেই প্রায় বলা চলে। জজ কোর্ট আর সিএমএম কোর্ট পাশাপাশি। এখান থেকে সদরঘাট আর বুড়িগঙ্গা নদী কিন্তু একদম কাছেই। আমি শুনেছি বুড়িগঙ্গা নাকি একসময় এখান দিয়ে বয়ে যেত।”

“এখান দিয়ে মানে?” অরণি বেশ অবাক।

“এখান দিয়ে মানে এই যে আমরা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি এখান দিয়ে।”

“তাই নাকি! আশ্চর্য তো। তারপর কি মানে নদীর গতিপথ পালটে সরে গেছে নাকি?”

“তাই তো মনে হয়, এছাড়া আর কী হতে পারে। কিন্তু এই ব্ৰাহ্ম উপাসনালয় গেল কই?”

“যমুনা ক্লিনিক,” অরণি আনমনে সাইনবোর্ড পড়তে পড়তে এগোচ্ছিল হঠাৎ জোরে ডেকে উঠল হাসানকে। “ওই যে, ওটাই মনে হয়।”

হাসান অরণির নির্দেশনা অনুযায়ী তাকিয়ে দেখল, “হ্যাঁ, এটাই মনে হচ্ছে। ওই যে গেট,” ওরা এগিয়ে গেল গেটের দিকে।

“গেট তো বন্ধ,” হাসান গেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতে দিতে বলল। জায়গাটা বেশ বড় এবং সুন্দর। চমৎকার গোলাপি রঙের পুরানো আমলের একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। উপরে বড় বড় করে লেখা ব্রাহ্মসমাজ উপাসনালয়। সামনে ছোট্ট একটা বাগান। বাড়িটাতে যাওয়ার জন্য ঘাসে ঢাকা একটা রাস্তা। রাস্তার পাশেই একটা ছোট্ট সুন্দর বাসা। বাসাটার একটা অংশ এক ধরনের সবুজ লতানো গাছে ছাওয়া। আজকাল বলতে গেলে ঢাকায় এই ধরনের বাড়ি দেখাই যায় না। ওটার ঠিক পাশেই একটা পুরানো জীর্ণ দোতলা বাড়ি। দেখলেই মনে হয় ভেঙে পড়বে। অরণির মনে হলো যেকোনো সময় এটা পড়ে যেতে পারে। ওটার ওপর প্রায় পড়াই যায় না এমনভাবে লেখা ব্রাহ্মসমাজ লাইব্রেরি।

“হাসান, ওই যে দেখো ওটাই লাইব্রেরি,” অরণি হাসানকে দেখিয়ে বলল।

“হায় হায় এটা তো দেখি যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে! এটাতে কোনো বইপত্র আছে বলেও তো মনে হচ্ছে না।”

 “কিন্তু এটাতে ঢুকব কোন দিক দিয়ে?” হাসান উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। ভেতরে কাউকে দেখাও যাচ্ছে না। হঠাৎ ওর চোখ পড়ল ভবনটার বাম দিকে। ওখানে একটা সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। ‘ব্রাহ্মসমাজ অফিস’।

“এই অরণি, ওইদিকে মনে হয় এটার অফিস। চলো ওদিকে যাই। ওরা গেটের কাছ থেকে সরে বাম দিকে চলে এলো সুমনা ক্লিনিকের পাশ দিয়ে চলে এলো অফিস লেখা সাইনবোর্ডটার কাছে। ওটার সামনে দাঁড়িয়ে দুজনের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। অফিসটাতে অনেক লোকজন ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। বেশিরভাগই বেরোচ্ছে প্যান্ট ঠিক করতে করতে।

“হায় হায় এটা দেখি পাবলিক টয়লেট,” হাসানের মুখ দিয়ে কথাটা আনমনে বেরিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *