২৫শে মার্চ – ১৮

১৮

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা
২৫শে মার্চ, ১৯৭১
সময় : রাত ১টা ৩০ মিনিট

জঘন্য একটা মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে। প্রথমে মনিরুজ্জামানই নড়ে উঠল, কোনোরকম দ্বিধা না করেই সে শরীরটাকে স্রেফ ছেড়ে দিল দেয়াল থেকে। আর লোকটাও উর্দু ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল ওপার থেকে।

মনিরুজ্জামান হ্যাঁচড়েপ্যাচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবু আর কবিরের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল, “দৌড়, দৌড় দৌড়া…” তিনজনই ঝেড়ে দৌড় দিল যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে। ঝড়ের বেগে দৌড়াতে লাগল অন্ধের মতো। ওপাশে কী হচ্ছে, শোনা বা বোঝার মতো অবস্থা নেই। তিনজনই এক দৌড়ে চলে এলো হলের পুকুর পাড়ে।

আবু হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে লাগল, “স্যার, স্যার…” মনিরুজ্জামান একটু পিছিয়ে পড়েছিল। সে কাছাকাছি এসে তাড়া দিয়ে বলল, “থামা যাবে না। এখন কোনোমতে কার্জন থেকে বেরোতে হবে। একটু দেরি হলেই এই জায়গা মরণ ফাঁদ হয়ে উঠবে। চল চল।”

তিনজনই আবার দৌড়াতে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এলো কার্জনের গেটের কাছে। গেটটা চেন দিয়ে তালা মারা। “স্যার গেট তো তালা মারা।”

“গেট খোলার সময় নেই। দেয়াল পার হয়ে যেতে হবে। এক্ষুনি,” মনিরুজ্জামান কথা শেষ করার আগেই ওপাশে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। নিশ্চিত ওদের খোঁজেই আসছে। তিনজনই একে একে কার্জনের নিচু দেয়াল টপকে মূল রাস্তা ধরে দৌড় দিল। ব্যাপারটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো মিলিটারি ট্রাক কিংবা জিপ ওদেরকে দেখে ফেলতে পারে। আর দেখলেই গুলি করে দেবে। গাড়ির আলোটা এখনও এগিয়ে আসছে। যেকোনো সময় দেখে ফেলতে পারে ওটা থেকে ওদেরকে।

দৌড়াতে দৌড়াতে তিনজনই চলে এলো সায়েন্স ফ্যাকাল্টির লাইব্রেরির দেয়ালের কাছে। এখানে নিচু দেয়ালের ওপরে গ্রিল দেওয়া। গ্রিলের মাথাগুলো একদম ছুরির মতো চোখা আর ধারালো। একটু এদিক-সেদিক হলেই খবর হয়ে যাবে। সবাই দেয়ালের গ্রিলের সামনে এসে হাঁপাতে লাগল। মনিরুজ্জামান চারপাশে দেখে নিল দ্রুত একবার। লুকানোর মতো কোনো জায়গায় নেই। মানে এই গ্রিল টপকাতেই হবে। “কবির, আমি ওপরে উঠে যাচ্ছি। আমি ঠিক যেভাবে উঠি খেয়াল করবি, তোরাও সেভাবে উঠে আসবি। আর ওপাশে নেমে তোদেরকে আমি সাহায্য করব। ঠিক আছে?”

ওদের উত্তর শোনার মতো পরিস্থিতি নেই। মনিরুজ্জামান একটানে নিজেকে গ্রিলের ওপরে তুলে ফেলল। সাবধানে গ্রিলের চোখা মাথাগুলো এড়িয়ে লাফিয়ে নামল অন্য পাশে। কবিরও উঠে এলো একইভাবে। আবু একটু দ্বিধা করছে। সময় নেই, সময় নেই, মনিরুজ্জামানকে ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল। কারণ গাড়ির আলোটা আরও অনেক কাছে চলে এসেছে।

“আবু, উঠে আয় আমি ধরছি,” বলে মনিরুজ্জামান গ্রিলের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। আবু তার হাতটা এক হাতে ধরে গ্রিলের ওপরে উঠে এলো, সে-ও সাবধানে চোখা মাথাগুলো এড়িয়ে এপাশে চলে আসার জন্য লাফ দেবে শার্টের একটা কোণা আটকে গেল গ্রিলের চোথা মাথায়। বেচারা লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে আটকে গেল।

আবু জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছে নামতে কিন্তু শার্ট আটকে যাওয়াতে নামতে পারছে না। মনিরুজ্জামান শেষ চেষ্টা করল। দুহাতে শক্ত করে আবুর কোমর ধরে জোরে টান মারল নিচের দিকে। শরীরের বেশ খানিকটা চামড়া সহ শার্টটা ফড়ফড় করে ছিঁড়ে নিচে নেমে এলো সে। ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল দুজনেই।

গাড়ির আলোটা প্রায় চলে এসেছে এখন দূরত্ব আর মাত্র পাঁচশ গজ হবে বড়জোর। যেকোনো সময় ওটার হেডলাইটের আলো এসে পড়বে ওদের গায়ে। মনিরুজ্জামান আবুকে ধরে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দিল বারান্দার দিকে। কবির আগেই বারান্দার রেলিঙের ওপাশে চলে গেছে সে দুই হাত বাড়িয়ে আবুকে টেনে নিল আর মনিরুজ্জামান লাফ দিয়ে রেলিং টপকে চলে এলো বারান্দায়। তিনজনই রেলিঙের নিচে বসে পড়ল।

ওদের পাশের রাস্তা কাঁপিয়ে মিলিটারি ট্রাকটা চলে গেল বাংলা একাডেমির দিকে।

তিনজনই বসে হাঁপাচ্ছে শব্দ করে। “উফফফ, আরেকটু হলেই গেছিলাম। উফফফ,” আবু জোরে জোরে দম ছাড়তে ছাড়তে বলল। “হুমমমম,” কবিরও মাথা নাড়ল তার যথাযথ গম্ভীর ভঙ্গিতে।

মনিরুজ্জামান কিছু বলল না। কারণ সে জানে আজ রাতে বিপদ কেবল শুরু হয়েছে। এর শেষ কোথায় হবে কে জানে। “তোর কি বেশি লেগেছে?” মনিরুজ্জামান আবুর কাছে জানতে চাইল। “দেখি।”

আবু তার ছেঁড়া শার্ট তুলে ক্ষতটা দেখাল। চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে হালকা। মনিরুজ্জামান পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে দিল। “বেশি ব্যথা পাচ্ছিস?”

“না, স্যার। একটু ছিলে গেছে আর কি! কাটেনি।”

আবু ভুল বলেনি, আসলেই কাটেনি। চামড়া ছিলে গেছে গভীরভাবে। রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেলে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। আবুর ক্ষতটার যত্ন নিয়ে সে হালকা রক্তে ভেজা রুমালটা আবার পকেটে গুঁজে উঠে দাঁড়াল।

“চল আমাদেরকে এগোতে হবে। যেভাবেই হোক হাফিজের জিনিসটা উদ্ধার করতে হবে। আজ রাতেই।”

.

“স্যার,” বলে সেনাবাহিনীর মেজর খট করে জোরে একটা স্যালুট ঠুকল।

কর্নেল হাবিব তার দিকে ফিরে তাকাল অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে। মাথায় খুব জটিল একটা হিসাব করছিল সে। এই স্যালুট ঠোকার শব্দে চিন্তা ভঙ্গ হয়ে গেছে। “ফয়সল, তোমাকে না বলেছি আমার সামনে জোরে স্যালুট ঠুকবে না,” কুচকুচে কালো হ্যাংলা-পাতলা মেজরের দিকে তাকিয়ে সে গজগজ করতে করতে বলল। এই ছেলেটা অদ্ভুত রকমের কালো, মনে মনে সে ভাবল। তার দেশে এত কালো লোক সে খুব কমই দেখেছে। “বলো, কী ব্যাপার?”

“স্যার এই রিপোর্টটা একটু দেখুন, প্লিজ।”

“কীসের রিপোর্ট এটা?”

“স্যার, কিছুক্ষণ আগে কার্জন হলের ওদিকে একটা ঘটনা ঘটেছে। আপনি যে তিনজন সাসপেক্টকে রেসকোর্সে ফলো করছিলেন তাদের অন্তত একজনের সাথে ওই ঘটনার সংযোগ আছে বলে মনে হয়।”

“মানে?”

“স্যার ওদেরকে তো রেসকোর্সের মন্দিরে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও স্যার আপনি বলেছিলেন কোনো না কোনোভাবে ওরা ওখান থেকে পালাতেও পারে। তাই যে তিনজনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল তাদের ব্যাপারে আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটা রেড অ্যালার্ট দিয়েছিলেন।”

“তুমি আমার কাজের বর্ণনা আমাকেই শোনাচ্ছ! কী ঘটেছে সেটা বলো।”

“জি, সার। একটু আগে আমাদের যে দলটা চানখারপুলের ওদিকে অভিযান চালাচ্ছিল ওদের একজন দলছুট হয়ে কার্জনের দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছিল।”

“কী করছিল?”

“স্যার, প্রস্রাব।”

“হ্যাঁ, তারপর?”

“তখন সে দেয়ালের ওপর একজনকে দেখতে পায়, সে সম্ভবত কাৰ্জন থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল। যে লোকটাকে সে দেখতে পায় তার চেহারা এক মুহূর্তের জন্য পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিল তাই সে তাকে চিনতেও পারে। কারণ এই লোকটার ছবিই সে আজ রাতে টিচার্স কোয়ার্টারে রেইড দেওয়ার সময় দেখেছিল। স্যার, সম্ভবত এই লোকটাই সেই শিক্ষক। এবং…”

“সে রেসকোর্সের ফায়ারিঙে মরেনি। হুমমম, এই প্রস্রাবওয়ালা কি নিশ্চিত?”

“জি, স্যার। সে এটা বলার পর আমি তাকে ডেকে ছবি দেখিয়ে চেক করেছি। সে নিশ্চিত।”

 “গুড গড। তার মানে ওই ব্যাটা মরেনি,” বলে সে চুপচাপ ভাবতে লাগল। মনে মনে হিসাব করার চেষ্টা করছে মনিরুজ্জামান নামের লোকটা কার্জনে কী করছিল, কেন করছিল এবং তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে। একটু ভেবে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিল।

“ফয়সল, তুমি আমাকে একটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ম্যাপ জোগাড় করে দেবে। এক্ষুনি। এবং…” সে চুপচাপ ভাবছে। আমাদের ফোর্সে সিন্ধি একটা ছেলে আছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে।

“জি, স্যার। মির্জা।”

“হ্যাঁ, ওর কি অন ডিউটি আছে?”

“জি, স্যার আছে। তবে ওকে মনে হয় অন্য কোনো এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”

ওকে যেখানেই দেওয়া হয়ে থাকুক আমার সামনে এনে হাজির করো। ম্যাপ এবং মির্জা এই দুটোই সংগ্রহের দায়িত্ব তোমার। বুঝেছ?”

“জি, স্যার।”

কর্নেল হাবিব মনে মনে হিসাব করে ফেলেছে তাকে কী করতে হবে। রেসকোর্সে ফায়ারিঙের পর সে ঠিক বুঝতে পারছিল না কী করবে। কারণ তার ইনফর্মারের সাথেও সে যোগাযোগ করতে পারছিল না। কোনোভাবেই মাথায় আসছিল না জিনিসটাকে কীভাবে উদ্ধার করবে। তবে এখন সে আবারও আলোর দিশা দেখতে পাচ্ছে। বুঝতে পারছে আবারও মাথার খেলা শুরু হয়ে গেছে। এবার সে জানে তাকে কী করতে হবে, কোথায় করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *