১৭
পুরান ঢাকা
বর্তমান সময়, বেলা ৩টা ৩০ মিনিট
গাড়িটা পলাশির মোড়ে জ্যামে দাঁড়িয়ে আছে। চাচা ভিউ মিররে একবার ওদেরকে দেখল। বসুন্ধরা সিটির সামনে থেকে গাড়িতে ওঠার পর ওরা এখনও তেমন একটা কথাবার্তা বলেনি। শুধুমাত্র হাসান একবার চাচাকে বলেছে ওরা এখন টিকাটুলি যাবে। এরপর আর কোনো কথা হয়নি। একটু আগে পর্যন্ত দুজনেই হাঁপাচ্ছিল। এখনও দুজনে চুপচাপ বসে আছে। চাচা ভালোই বুঝতে পেরেছে তারা ওখানে বেশ কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে এসেছে।
“মামণি, আপনেরা ঠিক আছেন? কুনো সমস্যা নাই তো,” চাচা জানতে চাইল।
“না চাচা ঠিক আছে, এখন আর কোনো সমস্যা নেই,” অরণি জবাব দিল।
“আর সমস্যা, যে কাণ্ড ঘটিয়ে এসেছি, একমাত্র খোদা জানেন এখনও আর কী কী বাকি!” হাসান বিড়বিড় করে বলল।
“আচ্ছা এখন কী হবে? বসুন্ধরা সিটিতে যা ঘটেছে এরপর ব্যাপারটা নিয়ে তো আরও জল ঘোলা হবে। তোমার কী মনে হয় পুলিশের এখন পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে?” অরণি হাসানের দিকে তাকিয়ে আছে।
“বুঝতে পারছি না,” এই প্রথম হাসানকে একটু দিশেহারা লাগছে। এর আগ পর্যন্ত অরণির কাছে মনে হচ্ছিল বিপদে পড়লেও সে খুব একটা গায়ে লাগাচ্ছিল না। ভাবটা ছিল ‘আরে এরকম কত দেখলাম। কিন্তু এখন ওকে দেখে সত্যিই চিন্তিত মনে হচ্ছে। আর অরণির কাছে মনে হচ্ছে চিন্তার ব্যাপার আসলেই আছে। একদিকে ওর মায়ের মৃত্যু এবং ওটার অমীমাংসিত ব্যাপারগুলো, সেইসাথে পুলিশের তাড়া এবং তার সাথে এখন আরও যোগ হয়েছে আরও কিছু রহস্য যেগুলোর আসলে কোনো কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না।
“আচ্ছা আমাকে একটা ব্যাপার বলো তো, পুলিশ কীভাবে এত দ্রুত জানল আমরা বসুন্ধরা সিটিতে আছি?”
“আমার মনে হয় পুলিশ নজরদারিতেই ছিল, তার ওপর ওই কুরিয়ারের ছেলেটা শমিং মলের সিকিউরিটির সাথে কথা বলার পর মনে হয় ওদের কেউ পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছে। আর এই কারণেই পুলিশ এত দ্রুত চলে আসতে পেরেছে। আমার প্রশ্ন সেটা নয়,” বলে হাসান অরণির দিকে ফিরে তাকাল। এতক্ষণ সে বাইরে দেখছিল।
“আমি বুঝতে পারছি তোমার প্রশ্নটা কী?”
“হ্যাঁ, শপিং মলের ওই লোকটা। ওই লোকটা কে এবং সে আমাদেরকে সাহায্যই বা করল কেন?” হাসানের চোখে জিজ্ঞাসা। “তোমার কী মনে হয়?”
“আমি জানি না। তবে লোকটাকে দেখে আমার একদম প্রফেশনাল বলে মনে হয়েছে। তার কাছে পিস্তল এবং ধোঁয়া ছড়ানোর ওই জিনিসটা ছিল। একজন প্রফেশনাল ছাড়া ওই জিনিস অন্য কারও পক্ষে ক্যারি করা সম্ভব নয়। আমার ধারণা যদি বলি তবে ওই লোকটাই আমাদেরকে জজ কোর্টের ওখানে সাহায্য করেছিল। আমরা যখন ধরা পড়তে যাচ্ছিলাম ওখানেও দুটো জিনিস উড়ে এসে পড়ে যেগুলো থেকে ওই একইরকম ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। তার মানে এটা নিশ্চিত যে ওখানেও ওই লোকটাই ছিল,” অরণি ব্যাখ্যা করার মতো করে বলল।
“প্রশ্ন হলো, ওইরকম একজন প্রফেশনাল মানুষকে আমাদের পেছনে লাগাল কে?”
“পেছনে লাগিয়েছে না বলে আমাদের আসলে বলা উচিত আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য লাগাল কে?”
“তার মানে কেউ একজন চাইছে আমরা পুলিশের হাতে ধরা না পড়ি। আমরা ব্যাপারটা সমাধান করি। কিন্তু কেন? তার কী স্বার্থ থাকতে পারে এতে?”
“নাহ, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না,” হাসান অসহায়ভাবে হাত নড়ল। “আমি এত কিছু বুঝতে পারছি না। আর এসব প্রশ্নের উত্তর এখন এই মুহূর্তে দেওয়াও সম্ভব নয়। যে পর্যন্ত আমরা পুরো ঘটনার একটা সমাধান বের করতে না পারছি এগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে না। ম্যাডামের আসলে কী ঘটেছিল এবং কেন ঘটেছিল আমাকেই বা কেন ফাঁসানো হলো তার খুনের দায়ে আমাদেরকে আগে এগুলো বের করতে হবে।”
“মা আসলে কীসের সাথে জড়িয়েছিল বলে তোমার কাছে মনে হয়?” অরণি জানতে চাইলে হাসান আবারও মাথা নাড়ল। “তোমার কী মনে হয় মা’র দেওয়া ক্লুগুলো আমরা যেভাবে অনুসরণ করছি তাতে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছাব?”
“সেটা জানতে পারলে তো পুরো ব্যাপারটার সমাধানই হয়ে যেত। তবে নিশ্চয়ই এর কোনো শেষ আছে। আমাদেরকে ওখানে পৌঁছতে হবে। আর ম্যাডাম যেহেতু এই ব্যাপারটা এভাবেই সাজিয়ে গেছেন এবং সেটা তার মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে তার মানে এটার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো বড় ব্যাপার আছে। আমি জীবনেও তাকে কোনোদিন অযৌক্তিক কোনো কাজ করতে দেখিনি।”
অরণির আবারও মন ভার হয়ে উঠল। মায়ের সাথে ওর আর দেখা হলো না। যে অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে ও চলে গিয়েছিল দেশের বাইরে সেটার আর কোনো সমাধান হলো না। ওর মনে পড়ে গেল বাবা মারা যাওয়ার আগের দিন রাতে মা আর বাবার তীব্র ঝগড়ার কথা। ওইদিনই ও জানতে পারে….
“মামণি আমরা প্রায় চইলা আসছি,” চাচা হঠাৎ ঘোষণা করার মতো সুরে বলে উঠল। “আপনেরা কোথায় নামবেন?”
“চাচা, এই যে সামনে একপাশে সাইড করে নামিয়ে দেন,” হাসান চাচাকে টিকাটুলি মোড়ের একপাশে দেখিয়ে দিল।
“তুমি কি মার্কেটটা চেনো?” অরণি জানতে চাইল।
“না ঠিক চিনি বললে ভুল হবে। আবার চিনিও। মানে একসময় এদিকে খুব আসতাম,” ওরা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। “এই এলাকাটাতে একদম পুরান ঢাকার ফ্লেভার পাওয়া যায়। সরু সরু গলি আর ব্যস্ত এলাকা।” হাসান অরণিকে দেখিয়ে বলল, “এই জায়গাটার নাম বাবু বাজার। এই যে লাল বিল্ডিংটা দেখছ এটা বাবু বাজার পুলিশ ফাঁড়ি। অনেক পুরানো বিল্ডিং।” পুলিশ ফাঁড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে হাসান ফাঁড়ির অপজিটে কয়েকটা খাবারের দোকান দেখিয়ে বলল, “এখানে বেশ নামকরা কাশ্মীরি বিরিয়ানি পাওয়া যায়। হয়তো এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পেলে তোমাকে নিয়ে একদিন খেতে আসব।”
অরণি মৃদু হাসল। “আমরা এখন যাব কোন দিকে?”
“এই যে এই গলি দিয়ে। এদিক দিয়ে সোজা গেলেই টিকাটুলি,” ওরা হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগোল। আরও কয়েক মিনিট হাঁটার পর হাসান অরণিকে থামতে বলল। “এখানেই কোথাও থাকার কথা মার্কেটটা,” বলে হাসান আশেপাশে দেখতে লাগল।
“কই আমি এখানে সারি সারি চশমার দোকান ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না,” পাশ দিয়ে একটা ঠেলাগাড়ি চলে গেল। আরেকটু হলেই ওর গায়ে লেগে যেত। “হাসান খুঁজে পেয়েছ?” অতিরিক্ত ভিড় আর ঠেলাঠেলিতে চারপাশ মুখরিত। “উফফফ কী অবস্থা!” অরণির গলায় বিরক্তি।
“ও, হয়ে গেছে না?” হাসান অরণির দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারায় খানিকটা রাগ।
অরণি ওর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, “পেয়ে গেছ?”
হাসান ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কথা বলছে না। “কী ব্যাপার? পেয়ে গেছ? কথা বলছ না কেন?”
“নাহ তোমাকে দেখছিলাম। এই ভিড়ে গরম আর ঠেলাঠেলিতে খুব বিরক্ত লাগছে তাই না?” বলে একটু বিরতি দিল। অরণি এখনও বুঝতে পারছে না হঠাৎ হাসানের হলোটা কী? “হ্যাঁ, এই দেশ—মশা, গরম আর ধুলো ভরা এই দেশে মানুষ বাস করতে পারে! তাই না, ম্যাডাম? তোমারও হয়ে গেছে তাই না?”
“মানে কী বলতে চাইছ, কী হয়ে গেছে?”
“তোমাকে দোষ দিয়ে আর লাভ কী? সবাই এসবই বলে। এই দেশে জন্ম, এই দেশে বড় হওয়া আর কয়েক বছর দেশের বাইরে থেকে এখন ‘এই দেশে মানুষ বাস করে?” হাসান মেয়েদের মতো করে মুখ ভ্যাংচে উঠল “পাঁচ বছর দেশের বাইরে থেকে এখন তুমিও তাই হয়ে গেছ তাই না? শাবাশ।”
“হাসান বুঝে কথা বলো, আমি সেটা বলিনি, আমি দেশের বাইরে থাকলেও…” অরণি চুপ হয়ে গেল হাসানকে দোষ দিয়ে লাভ কী। সে নিজেও দেখেছে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ইউএস-এ থাকার সময়ও দেখেছে এই দেশের মানুষ বাইরে গিয়ে শুধু দেশের বদনাম করে। সবাই না তবে বেশিরভাগই। বিদেশ থেকে কিছু টাকাপয়সা করে দেশে ফিরে এসে দেশের প্রতিটা জিনিস নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে। হাসানের মনে হয় এই ব্যাপারে কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে তাই ক্ষেপে গেছে।
“আমি সরি হাসান, তুমি ভুল বুঝছ আমি ওভাবে বলিনি কথাটা,” হাসান জোরো জোরে হাঁটছে। অরণিকে ওর পাশে হাঁটতে রীতিমতো দৌড়াতে হলো।
“আমি সরি, আসলে আমিই বেশি রিঅ্যাক্ট করে ফেলেছি,” বলে হাসান মৃদু হাসল। “এই যে সারি সারি চশমা আর সানগ্লাসের দোকান দেখতে পাচ্ছ এখানে আগে কি ছিল জানো?”
“কী?”
“আগে এগুলো ছিল সব ক্যাসেটের দোকান। এখন পুরো ঢাকা খুঁজলেও একটা পাবা কি না সন্দেহ আছে। কালের বিবর্তন। আমার ধারণা যে মার্কেটটা আমরা খুঁজছি ওটাও একসময় গানের মার্কেটই ছিল। তার মানে ওটা এখানেই কোথাও আছে।”
“দাঁড়াও ব্যবস্থা করছি,” বলে অরণি একটা চশমার দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। দোকানে একজন বয়স্ক দোকানদার। অরণি চশমা দেখছে হাসান এগিয়ে গেল দোকানের দিকে।
“কী করো?”
“চশমা দেখি। তোমার জন্য একটা আর আমার জন্য একটা। আমাদের আগের চশমাগুলো হারিয়ে গেছে না,” এই পর্যন্ত বলে অরণি হাসানের কানের কাছে মুখ এনে বলল, “আমাদের চেহারা পালটানোর জন্য হলেও চশমা পরা দরকার।”
অরণি ওর আর হাসানের জন্য চশমা পছন্দ করে হাসানকে বলল দাম দিতে। হাসান মুখ ভোঁতা করে দাম দিল।
“দেখি দেখি,” বলে হাসানের চোখে চশমাটা পরিয়ে দিল। “এই তো ভালো লাগছে। মুখ ভোঁতা না রেখে একটু হাসো তো দেখি।”
বুড়ো দোকানদার ওদরেকে দেখে হাসল, “আপনার ওয়াইফের চয়েজ ভালো। আপনাকে মানিয়েছে।”
অরণি সুযোগটা কাজে লাগাল। “চাচা আমাদের নতুন সংসার তো কিছু ঘর সাজানোর জিনিস কিনব। এখানে নাকি ওরকম একটা দোকান আছে। মর্মর নাম। চেনেন?”
“হ্যাঁ চিনি তো, বুইরা মোল্লার দোকান। আমার বন্ধু মানুষ। বহু বছর বিদেশ ছিল। বেশ শিক্ষিত মানুষ। মাথায় কোন ভূত চাপল হুদাই ব্যবসায় নামল। একসময় ভালোই চলত। এহন আর চলে না। কে কেনে এইসব হাবিজাবি কও মা? আর এহন বড় বড় মার্কেটে কত রংবেরঙের জিনিস বেচে। এই চিপায় আইসা মোল্লার দোকানের জিনিস কেডা কিনব কও।”
“দোকানটা কোন দিকে বলতে পারবেন?”
“হুমমম ওই যে সাদা রঙের টাইলস্ লাগানো মার্কেটটা ওইটার পরের হলুদ বিল্ডিং। ওইটার তিন তলায়।”
ওরা চাচাকে ধন্যবাদ দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। “চলো চলো, পাওয়া গেছে। অরণি, গুড জব।”
“থ্যাঙ্ক।”
ওরা নির্দিষ্ট মার্কেটটার দিকে হাঁটা দিল। মার্কেটটার সামনে এসে পুরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো তিন তলায়। শাটারের ওপর পুরানো প্রায় আবছা হয়ে আসা লেখাটা দেখে বুঝল এটাই সেই দোকান
“যাহ্ শালা, দোকান দেখি বন্ধ।”
হাসান অরণির দিকে তাকিয়ে অসহায় একটা ভঙ্গি করল।
.
মাথার একপাশে ছোট্ট একটা ব্যান্ডেজ নিয়ে সে ডিসপেনসারি থেকে বেরিয়ে এলো। মেজাজটা চরম মাত্রায় গরম হয়ে ছিল। বসুন্ধরা সিটি থেকে বেরিয়ে আসাটা তার জন্য কোনো ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু কপাল ছিল খারাপ। বের হতে গিয়ে লোকজনের ঠেলাঠেলিতে মূল দরজার একপাশের একটা কাচ ভেঙে পড়ে একদম তার মাথার ওপরে। তবুও কপাল ভালো বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু সে ভয়ে আছে ছেলে আর মেয়ে দুটোকে আবার হারিয়ে ফেলেছে। বস না জানি কী বলে।
সাহস করে সে গাড়িতে উঠতে উঠতে কল দিল I
“হ্যাঁ বলো, আমি আরও আগেই তোমার কল আশা করছিলাম,” ওপাশের কণ্ঠস্বর বলে উঠল।
“স্যার আমি সামান্য আহত…”
“এখন ঠিক আছ?”
“জি স্যার কিন্তু…”
“তুমি বসুন্ধরা সিটিতে ভালো কাজ দেখিয়েছ। বিশেষ করে ফায়ার অ্যালার্মের আইডিয়াটা ভালো ছিল। আমি একটা এসএমএস পাঠাচ্ছি,” বলে কল রেখে দিল
সে হতভম্ব হয়ে ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে। এই লোক জানল কীভাবে সে ওখানে কী করেছে? এই মানুষটার তল সে কোনোদিনই পায়নি আর পাবেও না। এসএমএসটা আসার সাথে সাথে সে ওটা পড়ল। আবার তাকে কাজে নামতে হবে।
.
এএসপি আতিকুর রহমান গম্ভীর মুখে বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের সিকিউরিটি রুমে বসে আছে। কর্তৃপক্ষের সাথে তার ইতোমধ্যেই এক রাউন্ড তুমুল বাক—বিতণ্ডা হয়ে গেছে। ওপর মহল থেকেও প্রচুর ঝাড়ি খেতে হয়েছে তাকে। এবার সে কাজে নামবে। ইতোমধ্যেই সে তার ফোর্সকে বেশ কয়েক রাউন্ড নির্দেশ দিয়েছে অপেক্ষা করছে সেগুলোর ফিডব্যাকের জন্য। ওগুলো এলেই কাজে নেমে পড়বে সে।
হঠাৎ একজন এসআই দৌড়ে এলো। “স্যার, সব সিসি টিভির ফুটেজ চেক করা হয়েছে। তারা এই দিকে গেছে। সব জায়গার সঠিক হদিস হয়তো পাওয়া যায়নি। কারণ পুরো মলটা আসলে সিসি টিভি কভার করে না। তবে সম্ভাব্য জায়গাগুলো বোঝা যাচ্ছে।”
“ভেরি গুড়, এখন এই নির্দেশনা বুঝে প্রতিটা দোকানে জিজ্ঞাসাবাদ করো। ওরা যদি কারও সাথে কথা বলে থাকে তবে কী বিষয়ে কথা বলেছে আমি ডিটেইল জানতে চাই। প্রয়োজনে আমাকে ডাকবে আমি কথা বলব। আর শোনো, সাব্বিরকে পাঠিয়ে দাও।”
“ওকে স্যার।”
একটু পরেই সাব্বির আসার সাথে সাথে আতিকুর রহমান নির্দেশ দিল, “সাব্বির তুমি সাথে দুজন কনস্টেবল নেবে আর ওই ছেলেমেয়ে দুটোর ছবি দেখাবে বাইরের প্রতিটা দোকানে। বিশেষ করে শপিং মলের সামনে চায়ের দোকানগুলোতে। ওদেরকে যদি কেউ চিনতে পারে বিস্তারিত জানতে চাইবে। যদি ওদের সাথে আরও কেউ থেকে থাকে তার চেহারার বর্ণনা নেওয়ার চেষ্টা করবে। যদি ওরা কোনো গাড়িতে উঠে থাকে সেটার বর্ণনা, সম্ভব হলে সেটার নম্বর। বুঝেছ?”
“জি, স্যার।”
আরও আধা ঘণ্টা পর সে অ্যান্টিক ওয়ার্ল্ডের সামনে এসে দাঁড়াল। “তুমি শিওর এই দোকান?” ফুটেজ চেক করে ওদের সম্ভাব্য দিক-নির্দেশনা বের করেছে যে ছেলেটা তার কাছে জানতে চাইল সে।
“জি, স্যার। আমি শিওর ওরা কুরিয়ারের দোকানটা থেকে বেরিয়ে এখানেই এসেছিল।
“ভেরি গুড।”
.
“এখন কী করব? দোকান তো বন্ধ,” অরণি জানতে চাইল হাসানের কাছে। হাসান ডানে-বামে তাকাচ্ছে। পাশেই একটা গজ কাপড়ের দোকান। হাসান সেদিকে এগিয়ে গেল।
কম বয়স্ক এক দোকানদার বসে আছে ওখানে। বসে বসে মোবাইলে গেম খেলছে। সম্ভবত কোনো রেসিং গেম। কারণ মোবাইলের সাথে সাথে সে একবার ডানে একবার বামে দোল খাচ্ছে।
হাসান দোকানের সামনে গিয়ে মৃদু কাশি দিল। ছেলেটা ওর দিকে তাকাল আর সাথে সাথে মোবাইলটা থেকে কড়কড় একটা শব্দ ভেসে এলো। ছেলেটা আহহহ করে উঠল। মনে হয় তার গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে।
মোবাইল রেখে সে হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী কিনবেন? গজ কাপড় আছে, লুঙ্গি আছে। আর স্যান্ডোগেঞ্জি, জাইঙ্গা লাগলেও কইতে পারেন।”
“না কিছু কিনব না, আমি ওই পাশের দোকানটার ব্যাপারে জানতে চাচ্ছিলাম। ওটা কখন খুলবে?”
ছেলেটা আবারও চোখে বিরক্তি নিয়ে ওকে দেখল, আরেকবার অরণিকে দেখল। কাস্টমার না বুঝতে পেরে সে আবার হাতে মোবাইল তুলে নিল। “ও মোল্লা চাচার দোকান। হেইডা তো কয়দিন ধইরাই বন্ধ।”
হাসান অরণিকে দেখল। “হায় হায় আমার তো কিছু জিনিস কিনার ছিল।”
“এইহান থাইক্কা কী কিনবেন? হের দোকানে তো কিছুই নাই। কী পাথরের মূর্তি-ফুর্তি আছে। কেউই তো কিনে না। আপনের যদি জিনিস লাগে তো পাশের গল্লিতে আরেকটা দোকান আছে। ওইখানে ফুল-টুল, পাখি সব পাইবেন।”
“না আমি আসলে ওই কী যেন নাম বললেন তাকে দরকার ছিল।”
“ও মোল্লা চাচা। হেয় তো মনে অয় অসুস্থ। অসুখ না থাকলে হে দোকানে আইবোই।”
“তুমি বলতে পারবে সে কোথায় থাকে বা তার ফ্যামিলির কেউ?” এবার অরণি এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল।
“হের তো কেউই নাই, একলাই থাকে। পারুম না কেন। হেয় পাশের গল্লিতেই থাকে। ওই যে ওই পাশের গল্লিতেই,” বলে সে আবার মোবাইল তুলে নিল।
“একটু ভালো করে বলো তো কোথায়?”
“এই তো এহান থেইক্কা বাইর হইয়া সুজা যাইবেন বাম দিকে। বাবু বাজার পুলিশ ফাঁড়ির দিকে যাইতে থাকবেন। হেইদিকে যাইতে হাতের বাম দিকে পাইবেন একটা বড় রাস্তা। ওইহানে মোড়ে একটা ফাইভ স্টার হোটেল আছে। ওই রাস্তা দিয়া কতদূর গেলে দেখবেন পুরান একটা পানির টাংকি আছে। টাংকির লগেই ছালচুল উড়া একটা পুরান বাড়ি। ওইডাই। ওইডার উপরে ছাদের লগে একটা রুম আছে। ওইহানেই থাকে হেয়। আর যদি তাও না পান তাইলে টাংকির লগে দেখবেন একটা বড় মিষ্টি পানের দোকান আছে। ওই দোকানের দোকানদাররে চাচার নাম কইলেই দেহায়া দেব,” সে আবারও মনোযোগ দিয়ে গেম খেলতে শুরু করেছে।
“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ,” অরণি অন্তরিক ধন্যবাদ জানাল ছেলেটাকে। সে অরণির দিকে ফিরেও তাকাল না। আবারও রেসিং গেমের ছন্দে সে ডানে—বামে দুলতে শুরু করেছে।
“দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, কাপড়ের দোকানদারও এখন অ্যান্ড্রয়েডে রেসিং গেম খেলে,” হাসান হাসতে হাসতে বলল।
“তোমার হাসি পাচ্ছে,” অরণি ঝামটে উঠল। “আমি চিন্তায় আছি যদি ওখানেও ওই লোককে না পাই তাহলে কী হবে?”
“কী আর হবে, অ্যান্ড অভ স্টোরি,” হাসান হাসতে হাসতেই বলল। “রিল্যাক্স করো বেগম। একটা না একটা রাস্তা বেরিয়েই যাবে। আগে তাকে খুঁজে তো দেখি। কিন্তু ছেলেটা বলল। ওখানে মোড়ের মাথায় একটা ফাইভ স্টার হোটেল আছে। আমরা কিন্তু ওইদিক দিয়েই এসেছি কোনো ফাইভ স্টার হোটেল তো দেখিনি।”
ওরা নির্দেশনা অনুযায়ী হাঁটতে লাগল। মোড়টার কাছে এসে হোটেলটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে হঠাৎ অরণি জোরে জোরে হেসে ফেলল।
“কী ব্যাপার কী হয়েছে? হাসছ কেন?” হাসানের হাত ওর প্যান্টের জিপারের কাছে চলে গেল। ওটা আবার খোলা না তো। একবার ওর জিপার খোলা ছিল ওর এক বান্ধবী তা দেখে ঠিক এভাবে হেসে উঠেছিল। হাসানের ইচ্ছে হয়েছিল শালির গলা টিপে ধরে। নাহ জিপার তো বন্ধই আছে।
“ওই দেখো তোমার ফাইভ স্টার হোটেল,” অরণি সামনে দেখাল।
দেখে হাসানও হেসে ফেলল। ভাঙাচোরা একটা বিল্ডিং। বহু পুরানো হবে। নিচে বোরখার দোকান। ওটার ওপরেই হোটেলটা। নাম ‘আযম ফাইভ স্টার হোটেল’। “হা হা হা,” হাসানও হেসে ফেলল। “এই তাহলে ফাইভ স্টার হোটেল। দারুণ। বড়জোর এটা একটা বোর্ডিং হাউজ হতে পারে। ব্যাপক। বাঙালি আসলেই ক্রিয়েটিভ। মানে না হোক নামে তো ফাইভ স্টার হোটেল।”
ওরা মোড় থেকে বামে রওনা দিল। পানির ট্যাংকিটার কাছে এসে ওটার পাশেই দেখতে পেল পানের দোকানটা। দোকানদারের কাছে খলিল চাচার বাড়ি কোনটা জানতে চাইলে সে দেখিয়ে দিল।
ওরা সামনে এসে দাঁড়াল বাড়িটার। পুরানো একটা বাড়ি। আগের দিনের ভাষায় এধরনের বাড়িকে বলে, আড়াইতলা।
নিচতলা, দোতলা আর ওপরে ছাদের সাথে হাফ ফ্লোর। এই কারণেই আড়াইতলা। এই বাড়িটাও সেরকম আড়াইতলা একটা বাড়ি। পানের দোকানদার এবং কাপড়ের দোকানের ওই ছেলেটার ভাষায় চাচা ওপরের আড়াইতলায় থাকে।
ওরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে এলো। বাড়িটা অনেক পুরানো। সম্প্ৰতি মেরামত করা না হলে এর পরিণতি কী হবে একমাত্র খোদাতালা জানেন। ওরা সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় মানে ছাদে চলে এলো। ছাদের একপাশে দুটো রুম। আলাদা বাথরুম আর কিচেন চোখে পড়ল। থাকার মতো রুম যেহেতু এই দুটোই, ওরা দরজায় নক করল।
একবার… দুবার… তিনবার… কোনো সাড়াশব্দ নেই। দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
“কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না,” অরণি মন্তব্য করল।
“অবশ্যই আছে, না হলে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকত না,” হাসান পাশের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করছে। ভেতরে অন্ধকার ছাড়া কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
“কী করব?”
হাসান আবার নক করল। এবার আরেকটু জোরে। “হ্যালো, মোল্লা চাচা আছেন?… হ্যালো”
“নাহ মনে হচ্ছে কাজ হচ্ছে না।”
ওরা হতাশ হয়ে বুঝতে পারছে না কী করবে… খটখট শব্দ করে দরজটা খুলে গেল।