২৫। সত্য-অসত্য
বেশ কিছুটা হেঁটে আসার পর একসময় ঋষভ থামল। তারা এখন এসে দাঁড়িয়েছে একটি অনুচ্চ টিলার সামনে। গাছগাছালির মধ্যে থাকার জন্য টিলাটিকে দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়নি। অগস্ত্য দেখল টিলার মাঝের অংশটি ফাঁপা, এর ফলে টিলার মধ্যে একটি গুহার সৃষ্টি হয়েছে। গুহামুখের সামনে এসে দাঁড়াল তারা। ভিতর থেকে সেই উজ্জ্বল নীল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। হ্রদের জল একটি সরু প্রাকৃতিক নালার মধ্য দিয়ে এই গুহার মধ্যে প্রবেশ করেছে। ঋষভ বলল, ‘এই হল পুন্ত শহরের আরাধ্যা দেবীর মন্দির। মন্দিরে প্রবেশের আগে আপনারা আপনাদের মুখ ও হাত-পা এই হ্রদের জলে ধুয়ে নিন।’
ঋষভের দেখাদেখি হ্রদের শীতল জলে হাত-মুখ প্রক্ষালিত করে নিল তারা তিনজন। ঋষভ এবার গুহামুখের সামনে হাঁটু মুড়ে বসল, বসে নিজের ডান হাত বুকের বাম পাশে নিয়ে এসে চোখ বন্ধ করে মৃদু স্বরে এক মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল। মন্ত্রের শব্দগুলি ওদের কারোরই কানে পৌঁছচ্ছিল না। কিন্তু এই সময়ে ইরতেনসেনুর নজর এড়িয়ে অগস্ত্য আর উপল দুজনের মধ্যেই দৃষ্টি বিনিময় হল। ওদের দুজনের চোখেই বিস্ময়! ঋষভ যেভাবে বুকে হাত দিয়ে দেবীর আরাধনা করছে তা তাদের খুব পরিচিত! এ কী ভাবে সম্ভব! অগস্ত্য আর উপল দুজনেরই মুখ থমথমে হয়ে গেল। ঋষভ উঠে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসুন, এবারে আমরা মন্দিরে প্রবেশ করি।’
গুহার মুখটি খুব একটা প্রশস্ত না হলেও দু’জন মানুষ পাশাপাশি অনায়াসে হেঁটে যেতে পারে। তাদের পায়ের পাশ দিয়ে অগভীর নালার মধ্য দিয়ে হ্রদের জল বয়ে চলেছিল। তারা দেখল সেই জলে শুভ্র আলোর আভা যেন আরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই আলোয় এবং মন্দির গুহার ভিতর থেকে আসা আলোয় গুহার দেওয়াল পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছিল। সেখানে পাথরে লাল, সাদা, হলুদ এবং নীল রঙ দিয়ে বেশি কিছু চিত্র তৈরি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আছে পুন্তের জনজীবনের ছবি, শ্বেতপুষ্পের ছবি, এই হ্রদ থেকে জন্ম নেওয়া নীলনদের ছবি। পাশাপাশি রাখা কয়েকটি ছবির দিকে আঙুল নির্দেশ করে ঋষভ বলল, ‘এই দেখুন। এগুলি ফারাও মেন্তুহোতেপের চিত্র।’
ইরতেনসেনুরা দেখল সেই চিত্রগুলি অনেকটাই মেন্তুহোতেপের মন্দিরের দেওয়াল-চিত্রের মতো। তাতে বর্ণিত হয়েছে নুবিয়দের সঙ্গে মেন্তুহোতেপের যুদ্ধ, তার এই নগরীতে আসার গল্প। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে পুন্তের এক নাগরিকের হাত থেকে মেন্তুহোতেপ দুটি কিশলয় গ্রহণ করছেন। বোঝা যায় সে দুটি শ্বেতপুষ্পেরই। আশ্চর্য জন্তু কামারুর চিত্রও আছে সেখানে। হলুদ রঙের শরীরে কালো রঙের ছোপ, চিতাবাঘের মতো। কাঁধের কাছ থেকে শুরু হয়েছে ময়াল সাপের দেহ। সাপটির মুখ হাঁ হয়ে আছে, মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি লিকলিকে জিহ্বা, জিহ্বার সামনের অংশটি চেরা। এই নীল আলোতে দানবটিকে যেন জীবন্ত লাগছিল। কামারুর চোখের উপরে কোনও রত্ন নিশ্চয়ই বসানো ছিল, তাই সেই চোখ জ্বলজ্বল করছিল আলোতে, যেন সে এই গুহামন্দিরের অতন্দ্র প্রহরী।
গুহার ভিতরের পথটি কিছুটা গিয়ে শেষ হয়েছে একটি মাঝারি আকৃতির ঘরে। সেখানে এসে দাঁড়াল তারা চারজন। ঋষভ সামনের দিকে হাত দেখিয়ে বলল, ‘ইনি হলেন পুত্তের আরাধ্যা দেবী সিন্ধু। আর এই হল আলোর প্রকৃত উৎস।’
এই ঘরটি অনেকটা বৃত্তাকার। প্রকৃতির খেয়ালেই টিলার মধ্যে এই গর্ভগৃহের সৃষ্টি হয়েছে। ঘরের পাথরের মেঝের মাঝখানে একটি বর্তুলাকার ফাঁকা যায়গা, গুহার মুখ থেকে যে নালা দিয়ে হ্রদের জল গুহার মধ্যে প্রবেশ করেছিল তা এই প্রশস্ত গর্তে এসে শেষ হয়েছে। ঘরের যে অংশের দিকে ঋষভ নিৰ্দেশ করছিল সেখানে মাটির উপর থেকে ছয়টি ধাপে পাথুরে সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। সিঁড়িগুলি শেষ হয়েছে একটা পাথরের তৈরি চাতালে। সেখানে শ্বেতপ্রস্তরের সিংহাসনে বসে আছেন এক মাতৃমূর্তি। মূর্তিটি কালো পাথরে নির্মিত, উচ্চতায় দু’হস্তের সমান।
সিংহাসনে আসীন এই দেবী পৃথুলা। তাঁর মুখমণ্ডল গোলাকার, বড় বড় আয়ত চোখ, টিকালো নাক, পুরুষ্টু ঠোঁট। সেই ওষ্ঠে যেন স্মিত হাসি লেগে রয়েছে। দেবীর হাত এবং পাগুলি সরু নয়, তাতে মেদের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। দেবীর দুই স্তন স্ফীত এবং নিচের দিকে নেমে আছে, যেন মাতৃদুগ্ধে ভরে রয়েছে তা। দেবীর উদর দেশও স্ফীত, যদিও তার মাঝখানে একটি গোলাকার ফাঁকা অংশ আছে। তার ভিতরে বসানো আছে একটি আশ্চর্য রত্নকে।
রত্নটি আকারে ডিম্বাকৃতি, ইরতেনসেনুর হাতের তালুর মতো তার আয়তন। রত্নটি থেকে উজ্জ্বল নীল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সেই আলোর দিকে একটানা কয়েক পলের বেশি তাকিয়ে থাকা যায় না। এই আলোই এতক্ষণ ধরে তারা দেখতে পাচ্ছিল। ঘরের দেওয়ালগুলির উপরের অংশে অনেকগুলি গবাক্ষ। বোঝা যায় এই গবাক্ষ আর ওই গুহামুখ দিয়ে এই আলো বাইরে বেরিয়ে আসে, ছড়িয়ে পড়ে সেশেনুর অরণ্যে। ইরতেনসেনু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল এই আশ্চর্য দেবী মূর্তির দিকে। গর্ভে এই অমূল্য রত্নকে ধারণ করে না জানি কত বছর ধরে এই সিন্ধুদেবী সেশেনুর এই অরণ্যের মধ্যে আসীন হয়ে আছেন। এই সেই সম্পদ যাকে রক্ষা করার জন্য পুন্তের নাগরিকরা বাইরের বিশ্ব থেকে নিজেদের গোপন করে রেখেছে।
আচমকাই ধপ করে একটা আওয়াজ হল ইরতেনসেনুর পিছনে। সে পিছনে ঘুরে দেখল অগস্ত্য মন্দিরে মাটিতে বসে পড়েছে, উপল নীচু হয়ে তাকে তোলার চেষ্টা করছিল। ইরতেনসেনু উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘কী হল অগস্ত্য? তোমার শরীর ঠিক আছে তো?’
যেন বহু বছর ঘুমোয়নি অগস্ত্য, এমন ক্লান্তির ছাপ তার চোখে মুখে। সে মুখে হাসি টেনে এনে বলল, ‘ক্ষণিকের জন্য ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি ঠিক আছি, তুমি চিন্তা কোরো না। একটু ক্ষণ বসে থাকলেই ভালো বোধ করব।’
এই বলে গুহার ভিতরের দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসল অগস্ত্য। ইরতেনসেনু তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাতে সঙ্গে করে নিয়ে আসা পশুচামড়ার একটি থলি দিল, তা থেকে জল পান করল সে। কিছুটা জল হাতের মধ্যে নিয়ে ইরতেনসেনু অগস্ত্যর চোখে মুখে দিল। অগস্ত্য বলল, ‘এবার ভালো লাগছে একটু। আমি এখানে বিশ্রাম নিই। তুমি মন্দিরটি দর্শন করে নাও। তারপর ফিরব আমরা।’
অগস্ত্যর কথায় আশ্বস্ত হয়ে ইরতেনসেনু সিন্ধুদেবীর মূর্তিটিকে আবার চারপাশ থেকে ঘুরে দেখতে লাগল। উপল পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার অতিক্রম করছিল। ঋষভ বলল, ‘মাফ করবেন। ওই সিঁড়িতে ওঠার অধিকার একমাত্র পুন্তের সবচেয়ে প্রবীন মানুষটির থাকে। বর্তমানে অনিকাদেবী ছাড়া আর কারোরই ওই সিঁড়িতে ওঠার অনুমতি নেই। তাঁকে আমরা প্রতি মাসে একবার করে মন্দিরে নিয়ে আসি। তিনি তখন হ্রদের জল দিয়ে সিন্ধুদেবীর মূর্তির প্রক্ষালন করেন, শ্বেতপুষ্প দিয়ে দেবীর আরাধানা হয় তখন।’
বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উপল সামান্য অপ্রস্তুত বোধ করে, বলল, ‘ওহো, ভীষণ দুঃখিত। আমি আসলে রত্নটিকে আরও একটু কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করছিলাম।’
ইরতেনসেনু সিংহাসনটিকে একটু পাশ থেকে পর্যবেক্ষণ করছিল, সে এবারে বলল, ‘দেবীর নাম সিন্ধু? কিন্তু আমি জানতাম সিন্ধু ছিল…’
‘ভারত ভূখণ্ডের এক প্রাচীন জনপদের নাম। সরস্বতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল সেই সভ্যতা।’ বলল ঋষভ।
‘হ্যাঁ তাই তো!’
‘সিন্ধুদেবীর এই মূর্তিটি সেই নদীর উৎসে অধিষ্ঠান করত দু’হাজার বছর আগে।’
ঋষভের এই কথায় ইরতেনসেনু অবাক হয়ে গেল! পুন্তের অধিবাসীদের কথ্য ভাষায় প্রাকৃতের ব্যবহারের কারণ এবার সে বুঝতে পারছে। ইরতেনসেনু বলল, ‘তাহলে আপনারা সেই প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার নাগরিক!’
ঋষভ সামান্য হেসে বলল, ‘শুধু আমি নই, তুমিও ইরতেনসেনু। তোমার রক্তেও সিন্ধুর ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ভারত ভূখন্ডে বাস করতেন। কিন্তু সেখান থেকে চলে আসতে হয় আমাদের, এই অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী রত্নটিকে রক্ষা করার জন্য।’
‘কেন? কী ঘটেছিল সেখানে?’
‘একদল হীনমনস্ক তস্করের জন্য সেই সভ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখান থেকে রত্নটির উপরিভাগকে ভালো ভাবে নজর করে দেখ। কিছু বুঝতে পারছ?’
ঋষভের কথা শুনে ইরতেনসেনু আবার মন দিয়ে রত্নটি নিরীক্ষণ করতে লাগল। খানিকক্ষণ পরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘রত্নটি ডিম্বাকৃতি, কিন্তু এর গা একেবারে মসৃণ নয়! উপরের কিছুটা অংশ যেন ভাঙা!’
‘হুম, ঠিক। ওই অংশটিকে ভেঙে নিয়ে যায় কিছু অবমানবের দল। সৌমিরদের নাম শুনেছ তুমি?
সৌমিরদের নাম শোনেনি এমন মানুষ মনে হয় কমই আছে। ভারতবর্ষ থেকে তাদের কুখ্যাতি মিশরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম জনজাতি তারা। যে ভূমিকম্পের জন্য সরস্বতী নদী নষ্ট হয়ে যায় তার জন্য নাকি সৌমিররাই দায়ী। ইরতেনসেনু আগ্রহ ভরে ঋষভের কথা শুনছিল। সে শুধু মাথা নাড়িয়ে নিঃশব্দে জানাল যে সৌমিরদের নাম তার কাছে অজ্ঞাত নয়।
ঋষভ বলে চলল, ‘সৌমিররা সমৃদ্ধশালী সিন্ধু সভ্যতার নষ্টের মূল কারণ। কিন্তু ঠিক কী ঘটেছিল তা বাইরের পৃথিবীতে কেউ জানে না। সৌমিররা এখন পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে। আর আমরাও কখনও সেই ঘটনাটিকে নিয়ে মুখ খুলিনি। এই রত্নকে রক্ষা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য ছিল।’
‘কী এমন ঘটিয়েছিল সৌমিররা?’
এই প্রশ্নে ঋষভের মুখে যেন কালো ছায়া নেমে এল, তারপর ধীরে ধীরে তা বদলে গেল ঘৃণায় এবং রাগে। সে বলল, ‘রাত গভীর হচ্ছে, এই মন্দিরে আর বেশিক্ষণ থাকলে সিন্ধুদেবীর নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটবে, চলো আমরা এবার ফিরি। যাত্রাপথে তোমাদের সব বলব।
গুহামন্দির থেকে বেরিয়ে এসে আবার তারা হ্রদের ধার দিয়ে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে ঋষভ তাদের বলতে লাগল সেই অন্ধকারতম দিনের কথা, ‘সরস্বতী নদীর তীরে তিলে তিলে গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা। সেই সভ্যতার প্রাণ ছিল সেই নদী। এবং সেই নদী বইত সিন্ধুদেবীর আশীর্বাদে। নদীর উৎসস্থলে ছিল দেবীর মন্দির, তখন থেকেই তার গর্ভে ছিল এই রত্নটি। এই রত্নের অলৌকিক ক্ষমতার বলে সরস্বতী নদীর জল কোনদিন শুকিয়ে যেত না। তার দু’পাশ উর্বর হয়ে উঠেছিল। সিন্ধু রাজ্য হয়ে উঠেছিল এই পৃথিবীর অন্যতম বিত্তশালী এক জনপদ। তখন সিন্ধুর উপকূল থেকে অন্যান্য দেশগুলিতে বাণিজ্যও চলত। মিশরে এসে পৌঁছত সিন্ধু রাজ্যের নৌকা।
‘এই সরস্বতী নদীর পশ্চিম দিকে ছিল আরও একটি অপেক্ষাকৃত ছোট জনজাতির বাস, তাদের নাম ছিল সৌমির। সৌমিররাও এই নদী মায়ের আশীর্বাদ পেয়েছিল। তাদের খাদ্য, পানীয়, বাসস্থান কোন কিছুর অভাব ছিল না। কিন্তু সৌমিররা এতে সন্তুষ্ট হয়নি কখনও। তারা সিন্ধুরাজ্যের সমৃদ্ধিকে হিংসা করত। বাণিজ্যের ফলে সিন্ধুর প্রতিপত্তি বাড়ে, কিন্তু সৌমিরদের অঞ্চলে নদীর যে শাখাটি প্রবাহিত হতো তা খুব একটা প্রশস্ত ছিল না, বাণিজ্য তরী ভাসানো যেত না তাতে।
‘সৌমিররা জানত যে নদীর জলপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে এই রত্নটি। তাই তারা এক ভয়ঙ্কর কাণ্ড করে বসে। একদিন রাত্রে সিন্ধুদেবীর মন্দিরে হানা দেয় সৌমিররা। তারা রত্নটিকে চুরি করার চেষ্টা করে। কিন্তু মন্দিরে নিযুক্ত সেনাদল তাদের প্রতিহত করে। তখন তারা প্রবল আক্রোশে রত্নটিকে মাটিতে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে নষ্ট করে দিতে চায়। রত্নটি মাটিতে পড়লে তার উপরের ছোট একটি অংশ ভেঙে যায়।
‘সেই অংশটিকে নিয়ে পালায় সৌমির তস্করের দল। কিন্তু এই ঘটনায় সিন্ধুদেবী রুষ্ট হন। তার প্রকোপে এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয়। সরস্বতী নদী হারিয়ে যায় ভূগর্ভে। শুকিয়ে যাওয়া নদীর পাড়ে সিন্ধু সভ্যতাকে আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। বহু মানুষ এরপর খাদ্যের অভাবে প্রাণ হারায়, বহু মানুষ ভাগ্যান্বেষণে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তাদের মধ্যে আমাদের পূর্বপুরুষরাও ছিলেন।
ইরতেনসেনু ভাবছিল, মানুষের লোভ তাকে কত নীচে নিয়ে যেতে পারে। একটি ভরভরন্ত সভ্যতা নষ্ট হয়ে গেল কিছু মানুষের নীচতার কারণে। ঋষভ বলে যেতে লাগল, ‘সিন্ধুদেবীর মন্দিরের কার্যে নিযুক্ত পুরোহিত, সৈন্যদল, পরিচারকেরা তাদের পরিবারকে নিয়ে এক সঙ্গে ভারত ভূখণ্ড ত্যাগ করে। তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসে এই দেবী মূর্তি এবং রত্নটিকে। পুন্তের লোককথায় কথিত আছে, বহু দেশ ঘুরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা একসময় উপস্থিত হন এই মিশর দেশে।
দেশের দক্ষিণে সেশেনুর গভীর জঙ্গলের মধ্যে তারা স্থাপন করেন পুন্ত নগরীর। কয়েক হাজার বছর আগে তারা পাহাড়ের উপরে এই গুহার খোঁজ পান। যেন প্রকৃতি বহুবছর আগে এই আশ্রয়ের সৃষ্টি করে রেখে নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিলেন এই দেবীমূর্তির জন্য। এই গুহায় তৈরি হয় সিন্ধুদেবীর নতুন মন্দির, সেই থেকে এই মন্দিরেই অধিষ্ঠিতা দেবী। তাঁর আশীর্বাদে এবং এই রত্নের ক্ষমতায় গুহার বাইরে অবস্থিত হ্রদের জল নাকি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
নীলনদ না জানি কত হাজার বছর ধরে এই ভূখণ্ডের উপর দিয়ে বইত। কিন্তু এই রত্নের প্রভাবে নদীর জল বাড়ে, তা গভীর এবং প্রশস্ত হয়। তার সুফল লাভ করে মিশরীয় সভ্যতা। নদীর তীরের ছোট ছোট জনপদগুলি এক হতে শুরু করে। যে ফারাওরা আগে কেবল মাত্র উত্তর মিশরের একটি ছোট গোষ্ঠির নেতা ছিল তাঁরা ক্রমে হয়ে ওঠেন সমগ্র মিশরের অধিপতি। বর্তমানের মিশরীয় সভ্যতা এই নীলনদের দান। আর এই নীলনদের মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে এই রত্ন।
এই নদী এখন সিন্ধুদেবীর সন্তান। এই রত্নকে রক্ষা করার জন্য আমরা হাজার হাজার বছর ধরে এই অরণ্যের মধ্যে বাস করছি। একবার একটি ভুলের জন্য একটি সভ্যতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই ভুল আমরা আর হতে দেব না। এই রত্নকে রক্ষা করতে পুন্তের প্রতিটি নাগরিক দায়বদ্ধ।
‘আমুন-রা!’
হঠাৎই বলে উঠল অগস্ত্য। এতক্ষণ চুপ ছিল সে।
‘…কামারু রক্ষা করে আমুন-রাকে!’
মেন্তুহোতেপের প্রহেলিকার সেই আমুন-রা তাহলে এই রত্ন! যার আলোয় পুন্ত নগরী আলোকিত হয়। যার আশীর্বাদে নীলনদে জল প্রবাহিত হয়।
‘হ্যাঁ, ফারাও মেন্তুহোতেপ এই রত্নের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন মিশরের সূর্যদেব আমুন-রাকে।’
‘কিন্তু কামারু রক্ষা করে…এই অংশটার অর্থ কী? এই কামারুও কি তাহলে এই রত্নের সৃষ্টি?’
‘না। সেশেনুর এই আশ্চর্য অরণ্যের বয়স পুন্তের জনজাতির থেকেও বেশি। পুন্তের লোককথায় কামারুর উল্লেখ বারবার আসে। এই জন্তুটির সঙ্গে কোনওভাবে পুত্তের নাগরিকদের সখ্যতা হয়েছিল। সে তাদের কোনও ক্ষতি করেনি। তারপর কোনও একসময়ে সে হারিয়ে যায়। তবে পুন্তের অধিবাসীরা আজও বিশ্বাস করে যে এই রত্নটিকে রক্ষা করছে কামারু নামের সেই দানব। সে এই হ্রদের নীচে ঘুমিয়ে আছে শত শত বছর ধরে।’
হ্রদের বুকের উপর দিয়ে শীতল হাওয়া বয়ে এসে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল ইরতেনসেনুর শরীরে। সে একবার হ্রদের দিকে তাকাল। শান্ত জল হ্রদের, তার উপরে খেলা করছে অসংখ্য অত্যাশ্চর্য শুভ্র আলোক বিন্দু। ইরতেনসেনু বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, সে বুঝতে পেরেছে খানিক আগে মন্দিরে দেখা রত্নটির কোনও ক্ষমতা নিশ্চয়ই আছে যাকে হয়তো বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে তা তার বোধের বাইরে। এই হ্রদের গভীরে এক অতিকায় দানব ঘুমিয়ে রয়েছে এই কথাও বিশ্বাস করতে তার মন চায় না। কিন্তু এই আলো-আঁধারি যেন এক রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছে হ্রদটিকে ঘিরে।
‘আর সেই হারিয়ে যাওয়া রত্ন খণ্ডটির কী হল?’ জানতে চাইল ইরতেনসেনু।
‘সেটিকে আর পাওয়া যায়নি। সিন্ধুদেবীর অভিশাপে নাকি সৌমিরদের সমগ্র জনজাতির মৃত্যু হয়। তাদের সঙ্গেই ওই রত্নখণ্ডটিও হারিয়ে গিয়েছে। গর্ভরত্নটি খণ্ডিত হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে তার শক্তিকে হারাচ্ছে। গত কয়েকশো বছরে এর ঔজ্জ্বল্য কিছু হলেও কমেছে। হ্রদে এখনও অফুরন্ত জল থাকলেও এভাবে রত্নের শক্তি যদি হ্রাস পেতে থাকে তাহলে একসময় নীলনদও শুকিয়ে যাবে। অদৃষ্টেই হয়তো এমনটা লেখা আছে। হারিয়ে যাওয়া রত্নখণ্ডটিকে তো আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়!’
‘তাহলে মিশরীয় সভ্যতার কী হবে!’
‘নদী ব্যতীত যে সভ্যতা বাঁচে না তা তো তুমি বুঝতেই পারছ ইরতেনসেনু। আমরা জানি না সেই দিন কবে আসবে, হয়তো আরও কয়েকশো বছর পর, হয়তো বা এক সহস্র বছর পর। কিন্তু এই রত্ন এভাবে শক্তি হারাতে হারাতে একদিন নষ্ট হয়েই যাবে, এটা অবশ্যম্ভাবী।’
ঋষভের এই কথার পর অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে এল বাকিদের মধ্যেও। বাকি পথে কেউ আর কোন কথা বলল না। মন্দির থেকে বেরোবার পর থেকে উপলও অদ্ভুত ভাবে চুপ করে আছে, যা একেবারেই তার স্বভাববিরুদ্ধ। নগরীতে পৌঁছে তারা দেখল ছোট জনপদটি উৎসবের আমেজে মেতে উঠেছে। নগরীর মধ্যে একটি ফাঁকা জায়গায় শুকনো কাঠ এবং পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালানো হয়েছে। তার চারদিকে ভিড় করে রয়েছে এই জনপদের সকল অধিবাসীরা। নারী, পুরুষ, বয়স্ক, শিশু কেউই বাকি নেই। তারা কেউ নিজেদের মধ্যে জটলা বেঁধে গল্প করছে, কেউ বা হাত ধরাধরি করে বাজনার তালে তালে নাচছে।
কয়েকজনকে দেখা গেল আগুনের কুণ্ডের চারপাশ পরিষ্কার করে নরম কাপড়ের আসন বিছাতে। ওখানে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে মহাভোজ। পুন্তের জনপদের সবাই একসঙ্গে নৈশাহার করবে আজ। অগ্নিকুণ্ডের কিছুটা দূরে দেখা যাচ্ছে বাকারিকে। সে রান্নার তদারকি করছে। অগস্ত্যরা এগিয়ে গেল তার দিকে। উজ্জ্বল মুখে বাকারি বলল, ‘ও তোমরা এসে গেছ? কিশলয়টিকে আমি একটি মাটির পাত্রে রোপণ করেছি। এদিকে রান্নাও প্রায় হয়ে এসেছে। তোমরা আহার করে নাও একটু পরেই।
কেউ কিছু বলার আগেই অগস্ত্য বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই। তবে এখন আমার শরীরটা ঠিক ভালো লাগছে না। সামান্য বিশ্রাম করি, তারপর আসছি তোমাদের সঙ্গে যোগ দিতে। ইরতেনসেনু আর উপল, তোমরাও আমার সঙ্গে এসো। আগামীকাল যাত্রার আগে কিছু গোছগাছ করে নেওয়ার আছে। তারপর আমরা না হয় একসঙ্গে ভোজন করব।’
অগস্ত্য উপল এবং ইরতেনসেনুকে নিয়ে এল তাদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে। ঋষভ থেকে গেল বাকারিকে সাহায্য করার জন্য। কক্ষের দরজা ভিতর থেকে লাগিয়ে দিয়েই গম্ভীর গলায় অগস্ত্য বলল, ‘তোমাকে আমার কিছু জানানোর আছে ইরতেনসেনু। উপল তুমিও এখানে থাকো, তোমাকেও কিছু বলার আছে আমার।’
‘হুম, জানি।’
এই বলে গম্ভীর মুখে উপল একটি চৌপায়ার উপরে বসল। ইরতেনসেনু অগস্ত্যর কণ্ঠের গাম্ভীর্যকে হয়তো অতটা গুরুত্ব দেয়নি। সে তার ক্লান্ত শরীর শয্যায় এলিয়ে দিয়েছিল। চোখ বোঁজা অবস্থাতেই সে বলল, ‘হ্যাঁ বলো। রাতের আহারের পরই তো বলতে পারতে।’
‘না, আমার পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এখনই বলতে হবে। তুমি একটু উঠে বসবে?’
অগস্ত্যর কথায় এবারে ইরতেনসেনু শয্যায় উঠে বসল। তার চোখে কৌতূহল। অগস্ত্য ইরতেনসেনুর সামনে হাঁটু মুড়ে বসল। ইরতেনসেনু দেখল অগস্ত্যর মুখে যেন গ্লানির ছাপ স্পষ্ট। সিন্ধুদেবীর মন্দির থেকেই সে এটি লক্ষ করেছে।
‘কী হয়েছে অগস্ত্য?’
অগস্ত্য ইরতেনসেনুর হাতদুটিকে নিজের দু’হাতের মধ্যে ধরল। তারপর ধীর স্বরে বলল, ‘তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে ইরতেনসেনু? যদি জানো এক বিরাট সত্যিকে আমি তোমার থেকে লুকিয়েছি?
‘কোন সত্যি?’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি ইরতেনসেনু। প্রাণের থেকেও প্রিয় তুমি। তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নেই। কিন্তু…তবু…’
‘কিন্তু কী?’
‘কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যিটিকে আমি গোপন করেছি তোমার থেকে। শুধু তুমি নও। এই পৃথিবীতে উপল ছাড়া আর কেউই জানে না সত্যিটিকে। কিন্তু আজ এখন তাকে তোমার সামনে আনতেই হবে। এই দিনটির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমার অদৃষ্ট আমাকে আজকে এই চরম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, কোন প্রকার প্রস্তুতি ছাড়াই।’
উপল এই সময় চৌপায়া থেকে উঠে অগস্ত্যর পিছনে এসে দাঁড়াল। অগস্ত্য উপলের মুখের দিকে চাইল। ইরতেনসেনু দেখল অগস্ত্যর চোখে জল। সে বলল, ‘তুমি কী বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না অগস্ত্য। কোন সত্যের কথা বলছ?’
অগস্ত্য কিছুক্ষণ চুপ রইল, তারপর মৃদুস্বরে বলল, ‘আমি একজন সৌমির।
ইরতেনসেনুর কর্ণকুহরে কথাগুলি যেন ঠিক ভাবে পৌঁছয়নি। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কী বললে তুমি?’
‘আমি একজন সৌমির ইরতেনসেনু। আমি আর উপল দুজনেই সৌমির। এই পৃথিবীর নিকৃষ্টতম জনজাতির দুই শেষ প্রতিনিধি।’
সহসা যেন বিদ্যুৎপৃষ্ট হল ইরতেনসেনু! অগস্ত্যর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা পিছনের দিকে সরে গেল সে। এ সে কী শুনল! অগস্ত্য সৌমির! যে সৌমিরদের কলঙ্কের কথা সে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে? যে সৌমির সিন্ধু জাতির ধ্বংসের কারণ? সে নিজে যে সভ্যতার সন্তান সেই সভ্যতাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া এক সৌমির তার স্বামী? বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বিস্ফারিত চোখে অগস্ত্যর দিকে তাকিয়ে রইল ইরতেনসেনু। তার মুখ দিয়ে কথা সরছে না, জিহ্বা যেন তার শক্তি হারিয়েছে। অগস্ত্য মাথা নামিয়ে নিয়েছে। একজন বালকের মতো কাঁদতে কাঁদতে সে শুধু বলছে, ‘আমাকে ক্ষমা করো ইরতেনসেনু, আমাকে ক্ষমা করো…’
স্বামী এবং স্ত্রীর জীবন যে অপার বিশ্বাসের সুদৃঢ় স্তম্ভকে ঘিরে আবর্তিত হয় তা যেন কয়েক লহমায় টলে গেল। দুজনের মধ্যে যেন এখন কয়েক যোজন দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তার সামনে বসে থাকা যুবা পুরুষটিকে অচেনা মনে হতে লাগল ইরতেনসেনুর।
‘অগস্ত্যর কোনও দোষ নেই ইরতেনসেনু।’
উপলের কথায় ইরতেনসেনু মুখ তুলে উপলের দিকে চাইল। উপল বলল, ‘আমাদের সত্য আমরা নিজেদের প্রাণ দিয়ে রক্ষা করতে দায়বদ্ধ। কিন্তু আজকে সময় হয়েছে তাকে সামনে আনার। হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে জঘন্যতম কাজটি করেছিলেন তার গ্লানি আমরা দু’জন সর্বদা বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াই। সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর সৌমিরেরা ভারত ভূখণ্ড ত্যাগ করে পূর্বের দিকে যাত্রা করে। কিন্তু হয়তো সিন্ধুদেবীর অভিশাপেই কয়েক বছরের মধ্যেই অজানা জরার কবলে পড়ে মৃত্যু হয় বেশিরভাগ সৌমিরের।
‘যারা বেঁচেছিল তারা কোনক্রমে নিজেদের দিনযাপন করেছে। তারা পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেও তখন আর কিছু করার ছিল না। একে একে সবকটি সৌমির পরিবার শেষ হয়ে যায়। আমাদের কৈশোরে আমরা দু’জনেই কয়েক মাসের ব্যবধানে আমাদের মাতা এবং পিতাকে হারাই। বারো বছরের দুই কিশোর তখন এই পৃথিবীর শেষ দুই সৌমির। আমরাই তখন আমাদের একমাত্র পরিবার। চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও কীভাবে যে নিজেরা বেড়ে উঠেছি তা আমরাই জানি। হয়তো এই চরম গ্লানিকে ঢাকা দেওয়ার জন্য নিজেদের ক্রমাগত আরও প্রশিক্ষিত করে গেছি, চেষ্টা করেছি যে কার্যে নিয়োজিত তার শ্রেষ্ঠ স্থানে পৌঁছবার।
‘আমি খুব কম বয়স থেকে নৌবিদ্যার জ্ঞান আহরণ করা শুরু করি। অগস্ত্য নিজেকে নিমগ্ন রাখে বিজ্ঞানের আরাধনায়। যৌবনে আবার ভারতবর্ষে ফিরে আসি আমরা দুজনে। নিজেদের স্বীয় জ্ঞানের মাধ্যমে চেষ্টা করতে থাকি দেশটির উন্নতি করার। এই ভূখণ্ড থেকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যা কেড়ে নিয়েছে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা বলতে পারো। এক মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করে গেছি আমরা। হয়তো সিন্ধুদেবীর কোন ইচ্ছা ছিল, তাই আমরা আজও বেঁচে আছি এই গ্লানিকে বুকে নিয়ে। তুমি অগস্ত্যকে ক্ষমা করো ইরতেনসেনু। বিশ্বাস করো, তোমার কাছ থেকে এতদিন ধরে এই সত্যিকে গোপন করার জন্য ওর নিজের মনের মধ্যে ক্রমাগত রক্তপাত হয়ে চলেছে।’
ইরতেনসেনু উপলের বলা প্রতিটি শব্দকে মন দিয়ে শুনেছে। সে কিছুক্ষণ এক ভাবে বসে রইল শয্যার উপরে। তারপর উঠে এসে অগস্ত্যর সামনে বসল হাঁটু মুড়ে। শান্ত স্বরে বলল, ‘তোমাকে আমি ক্ষমা করলাম।’
ইরতেনসেনুর এই কথায় অগস্ত্য চমকে উঠে তার দিকে তাকাল। অশ্রুর অবিশ্রাম ধারা তখনও তার দু’চোখ বেয়ে বয়ে চলেছে। সে জড়িয়ে ধরল ইরতেনসেনুকে। বলল, ‘আমি তোমাকে কেবল নিজের স্ত্রী না, নিজের আত্মার অংশ বলে ভাবি ইরতেনসেনু। এই জগতে উপল ব্যতীত আমার আপন বলে আর কেউ নেই তুমি ছাড়া। আমার মধ্যে সৌমিরদের লোভ, হিংসা, চৌর্যবৃত্তির কোনটিই অবশিষ্ট নেই, বিশ্বাস করো।’
‘তা আমি জানি অগস্ত্য। তোমার মনকে এইটুকু বুঝতে আমি পেরেছি। কিন্তু আজকেই এই কথাগুলি আমাকে বলা কেন? জানি সিন্ধুদেবী তোমাদের আরাধ্যা। আজ হঠাৎই কোনও দৈববলে সেই দেবীর দর্শন পাওয়াতে হয়তো তোমাদের দুজনের মন দুর্বল হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তো তোমরা এই সত্য আমার কাছ থেকে গোপন করে যেতে পারতে। আগামীকাল ভোরে আমরা এই শহর ত্যাগ করে চলে যাব। এই জীবনে এখানে আর তো ফিরে আসব না। তোমাদের পরিচয়ের কথা তো তোমরা গোপনই রাখতে পারতে।
‘না, তা আর সম্ভব নয়। আমি জানি ওই মন্দিরে প্রবেশের পর থেকে উপলের মনে কী চলছে। ওর সঙ্গে কোনও কথা না হলেও আমি জানি। আমাদের সৌমির পরিচয়ের গ্লানি আজ আমাদের দুজনের কাছে আবার খুব বড় আকারে দেখা দিয়েছে। সিন্ধুদেবীর গর্ভের রত্নটির একটি অংশ নেই তা দেখেছিলে তো?’
‘হ্যাঁ। যে টুকরোটি সৌমিররা চুরি করে পালায়।’
‘একটি নয়, সেদিন দুটি টুকরো চুরি করেছিল সৌমিররা। আজ সেই দুটি টুকরোকে বহন করছি আমি আর উপল।’
বিস্মিত ইরতেনসেনুর দিকে তাকিয়ে অগস্ত্য আবার বলল, ‘আমার বাঁ-হাতে এই কাটা দাগটিকে তুমি বহুবার খেয়াল করেছ জানি। উপলের বাঁ-কাঁধেও এমন একটি কাটা দাগ আছে। তোমাকে আমি বলেছিলাম ছোটবেলায় খেলবার সময়ে ধারাল এক জাঁতির উপরে পড়ে আমি আর উপল দু’জনে আহত হই। তাই থেকে এই দাগ দুটি তৈরি।’
হ্যাঁ বলেছিলে। এখন বুঝছি সেটিও মিথ্যা ছিল, তাই তো?’
অগস্ত্য লজ্জিত কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, এই দাগ দুটি দুর্ঘটনা জনিত নয়, অস্ত্রপচারের ফলে তৈরি।’
‘মানে?’
‘আমাদের দুই পরিবার ছিল দুই শেষ সৌমির পরিবার। দুই পরিবারেরই সদস্যরা একের পর এক মারা যেতে থাকে। আমি আমার মাকে এবং উপল তার বাবা-মা দু’জনকেই হারায়। আমার পিতাও তখন অসুস্থ, বোঝা যায় এই পৃথিবীতে তার আর বেশিদিন নেই। সিন্ধুদেবীর গর্ভরত্নটির সেই দুটি খণ্ড আমাদের দুই পরিবারের কাছে ছিল। আমার পিতা সেই খণ্ডদুটিকে আমাদের শরীরে চর্ম আর মাংসের নীচে প্রোথিত করেন। আমার হাতের এই কাটা দাগের নীচে আছে সেই রত্নের একটি খণ্ড, উপলের বাম কাঁধে রয়েছে ওপর খণ্ডটি। এই দুটিকে সেই থেকে আমরা আমাদের শরীরের মধ্যেই বহন করছি। আমার পিতা ওই কাজ করেছিলেন যাতে কোনওভাবেই খণ্ডদুটিকে আমরা না হারাই। তার আশা ছিল আমরা যদি কোনওদিনও মূল রত্নটির কাছে এই খণ্ডদুটিকে ফিরিয়ে দিতে পারি।’
এবারে ইরতেনসেনুর চোখের সামনে যে কুয়াশা জন্মেছিল তা পরিষ্কার হল। অগস্ত্যরা তাহলে চায় এই রত্নখণ্ডদুটিকে দেবীর গর্ভে আবার ফিরিয়ে দিতে? এই প্রশ্ন করাতে অগস্ত্য বলল, ‘এখানেই আমার দ্বিধা।’
উপল বলল, ‘অগস্ত্য কোনওদিনই চায়নি রত্নখণ্ডদুটিকে ফিরিয়ে দিতে। তাই মূল রত্নটির কোন খোঁজ করিনি আমরা। কিন্তু আজ হয়তো কোন দৈববলেই আমরা সেই রত্নটির খোঁজ পেলাম। আমি চাই এই রাত্রেই সিন্ধুদেবীর কাছে এদেরকে ফিরিয়ে দিয়ে এই ভার লাঘব করতে। নিজেকে সৌমির বলে ভাবতে আমার আজও ঘৃণা হয়। আমি চাই না আর এই কলঙ্ককে বয়ে নিয়ে বেড়াতে।’
‘উপল, আমি এখনও নিশ্চিত নই যে রত্নখণ্ড দুটিকে ফিরিয়ে দেওয়া সঠিক কাজ হবে কি না। সৌমির হওয়ার গ্লানি আমাকে এখনও ন্যুব্জ করে রেখেছে। খণ্ডদুটিকে ফিরিয়ে দিলে পুন্তের মানুষ আমাদের আসল পরিচয় জানতে পারবে। তাদের সেই ঘৃণার দৃষ্টি আমি সহ্য করতে পারব না। তার চেয়ে এই গ্লানিকে নিজের মধ্যেই বয়ে নিয়ে বেড়াই।’
‘তুমি কী বলছো অগস্ত্য! আজ চাইলে আমরাই কেবলমাত্র আমাদের পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারব!’
‘কীসের প্রায়শ্চিত্ত উপল? যে অগণিত প্রাণ নষ্ট হয়েছিল শুকিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর তীরে, তারা কি আর ফিরে আসবে? সরস্বতী আবার প্রাণ ফিরে পাবে? এদের কোনটিই তো সম্ভব নয়।
‘কিন্তু ঋষভের মুখে শুনলে না রত্নটি তার শক্তি হারাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া খণ্ডদুটিকে ফিরিয়ে দিতে না পারলে নীলনদও একসময়ে শুকিয়ে যাবে!’
‘উপল, যা বিজ্ঞানের দ্বারা ব্যখ্যা করা যায় না তাকে আমি বিশ্বাস করি না। সিন্ধুদেবী আমার একমাত্র ঈশ্বর। তার গর্ভরত্ন থেকে যে অদ্ভুত আলোক বিচ্ছুরিত হয় তা আমরা তিনজনই দেখেছি। কিন্তু ওই রত্নের প্রভাবে সরস্বতী নদীতে জল বইত এ আমার যেমন বিশ্বাস হয় না। তেমনই, এখন নীলনদের জলপ্রবাহের জন্য ওই রত্ন দায়ী তাতেও আমি বিশ্বাসী নই।
‘হাজার বছর আগে ভূমিকম্পের নিশ্চয়ই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। রত্নখণ্ডটি চুরি যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ভূমিকম্প হওয়াটা দৈব অভিশাপ নয়, নিতান্তই কাকতালীয়। কিন্তু তাই দিয়ে চুরির ঘটনাকে যথার্থতা দেওয়ার চেষ্টা আমি করছি না। সেই কাজ পাপই। কারণ তার ফলে মানুষের ঈশ্বর-বিশ্বাস আহত হয়েছিল। এই আঘাতকে সামলানো কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ যখন বোঝে স্বয়ং ঈশ্বরই চান না সে বেঁচে থাকুক তখন তার বাঁচার আগ্রহ কমে যায়। প্রতিকূল প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করার মানসিকতা হারায় তখন সে।
‘তাই সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রত্যক্ষ ভাবেই দায়ী। তুমি জানো আমি দৈবে বিশ্বাসী নই। আজকে আমাদের এই নগরীতে আসা এবং এখানেই গর্ভরত্নের সন্ধান পাওয়াটা নিছক কাকতালীয় নয়, এর পিছনে কোন এক কারণ নিশ্চয় আছে। কিন্তু এখন আমার মস্তিষ্কের সেই কারণ খুঁজে বার করার ক্ষমতা নেই।’
অগস্ত্যর এই কথায় হতোদ্যম হয়ে চৌপায়ার উপরে বসে পড়ল উপল।
‘তুমি তাহলে রত্নখণ্ডটিকে ফিরিয়ে দেবে না? আচ্ছা, তবে তাই হোক, কিন্তু আমি আজ রাত্রেই গুহামন্দিরে যাব। আমার অংশের খণ্ডটিকে রেখে আসব সেখানে। আশা করি আমার ইচ্ছার উপরে তোমার কোন অধিকার নেই।’
অগস্ত্য এই সময়ে বলল, ‘এখনই একটি ভাবনা আমার মনে এল। অনিকাদেবী বলেছিলেন আমাদের মনের মধ্যে কোন সংশয়ের উদ্রেক হলে আমরা যেন কোনও কর্ম করার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তাহলে কি উনি আমাদের চিনতে পেরেছিলেন? কীভাবে? উনি জানতেন আমাদের কাছে রত্নখণ্ডদুটি আছে এবং তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ভেবে আমরা দ্বিধাগ্রস্থ হব, কী করে জানলেন?’
‘অগস্ত্য, আমি জানি বুদ্ধিতে এবং প্রজ্ঞায় তোমার সমকক্ষ আর কেউ নেই। কিন্তু এই জগতের সব রহস্যকে তুমি এখনও বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবে না। আমিও তোমারই মতো বিজ্ঞানের উপাসক। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি বিজ্ঞানের উপরেও কিছু আছে যা আমাদের বোধের বাইরে। হয়তো কোনও একদিন আমরা তাকেও বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারব। কিন্তু যতদিন না তা পারছি ততদিন আমি তাকে ঈশ্বরের অলৌকিক ক্ষমতাই ভাবব।
‘অনিকাদেবী কীভাবে জানতে পেরেছিলেন তোমাদের পরিচয় তা আমি জানি না, কিন্তু তিনি যে সাধারণ মানুষ নন এই বোধ আমার হয়েছিল আজ সকালের সাক্ষাতেই। তোমার বিজ্ঞানের বিশ্বাস যে তোমার দম্ভে পরিণত হচ্ছে তা তুমি বুঝতে না পারলেও আমি দেখতে পাচ্ছি। আজ একটিবারের জন্য সেই দম্ভকে সরিয়ে রাখো।’
ইরতেনসেনুর বলা কথাগুলোয় যে দৃঢ়তা ছিল তা যেন নাড়িয়ে দিয়ে গেল অগস্ত্যকে। সে বলল, ‘আচ্ছা, তাহলে এখনই অনিকাদেবীর সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন আমাদের। তিনিই হয়তো সঠিক পথ নির্দেশ করবেন।’
নিজেদের কক্ষ থেকে বেরিয়ে অনিকাদেবীর ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল তারা তিনজন। তাদের মনে হল চারপাশ যেন বড় বেশিই শান্ত। উৎসবের যে বাজনা, গীত, আনন্দ কলরবের মধ্য দিয়ে এসেছিল তারা, তাদের কোন আওয়াজই আর বাইরে থেকে ভেসে আসছে না। হয়তো নৈশাহারের পর সবাই বাড়ি ফিরে গেছে। অনিকাদেবীর কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে তারা দেখল কক্ষের দরজা সামান্য খোলা। তাঁর নাম ধরে কয়েকবার ডাকল ইরতেনসেনু, কোনও সাড়া না পেয়ে দরজাটি খুলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল তারা।
বাইরের চত্বরে জ্বলতে থাকা অগ্নিকুণ্ডের আলো গবাক্ষ বেয়ে ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে। নিজের শয্যার উপরে বসে আছেন অনিকাদেবী। পাশে রাখা প্রদীপটি নিভে গেছে। বৃদ্ধার সামনে একটি পুঁথি খোলা, বোঝা যায় পুঁথিটি পাঠ করছিলেন তিনি, তারপর হয়তো বসে থাকা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে গেল তারা তিনজন। ইরতেনসেনু হাঁটু মুড়ে বসল। ইরতেনসেনু বৃদ্ধার গায়ে হাত রাখল আলতো করে। হাত দিয়েই সে চমকে উঠল! বৃদ্ধার শরীর বরফের মতো ঠান্ডা!
তখনই তাদের নজর গেল সামনে খুলে রাখা পুঁথির দিকে। পুঁথির পাতায় লেগে রয়েছে রক্ত! সেই রক্ত বয়ে আসছে অনিকাদেবীর শরীরের উপর দিয়ে, রক্তের উৎস তার গলার একটি গভীর ক্ষত! আড়াআড়ি ভাবে গলার উপর দিয়ে চলে গেছে ক্ষতটি। অনিকাদেবীর মুখ বিশ্রীভাবে বুকের উপরে ঝুঁকে পড়েছে, চোখ দুটি বিস্ফারিত! এমন অবস্থা দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল ইরতেনসেনু। ঠিক তখনই মাথার পিছনে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল অগস্ত্য।
কোনক্রমে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বাকারিকে, সে একটি প্রস্তরখণ্ড হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে! তার চোখ মুখে হিংস্রভাব ফুটে উঠেছে! নিজের ভারসাম্য বজায় না রাখতে পেরে অগস্ত্য মাটির উপরে পড়ে গেল। জ্ঞান হারানোর আগে সে দেখল উপল বসে আছে মাটিতে পড়ে থাকা ইরতেনসেনুর বুকের উপরে। তার বলিষ্ঠ হাত চেপে বসে আছে ইরতেনসেনুর গলায়!