২৪. সোবাহান সাহেব বারান্দায় বসে আছেন

সোবাহান সাহেব বারান্দায় বসে আছেন। তার কোলে মোটা একটা খাতা, যে খাতায় গৃহহীন মানুষদের দুঃখ গাঁথা এবং তার দূরীকরণের নানান পদ্ধতি নিয়ে ক্ৰমাগত লিখে যাচ্ছেন। এখন অবশ্যি লিখছেন না। এখন ভাবছেন, তবে খাতা খোলা। মাঝে মাঝে চোখ বুলাচ্ছেন। ফরিদ এসে গম্ভীর মুখে পাশে দাঁড়াল। হাজত থেকে বের হয়ে এই প্রথম সে দুলাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে এসেছে। সোবাহান সাহেব বললেন, কিছু বলবে?

জ্বি।

কোন প্রসঙ্গে?

ছিনতাই প্রসঙ্গে। দুলাভাই আপনার হয়ত ধারণা হয়েছে। ঐ দিনের ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত।

সোবাহান সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, এখন অন্য কাজে ব্যস্ত আছি। তোমার প্রসঙ্গে নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।

আপনাকে কথা বলতে হবে না। আমি কথা বলব। আপনি শুনবেন।

আমি কিছু শুনতেও চাচ্ছি না।

ও আচ্ছা।

ফরিদ বিমর্ষ মুখে ঘরে ভেতর ঢুকল। মিলির সঙ্গে দেখা হল। সে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে। এখন তাকে কিছু বললেই সে বলবে, মামা আমি ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি। হাতে একদম সময় নেই। অদ্ভুত এই বাঙালি জাতি। হাতে কোন কাজ নেই। তবু সারাক্ষণ ব্যস্ত ভঙ্গি। এই ভঙ্গিটা বাঙালি জাতি কোথায় শিখল কে জানে।

মিলি।

জ্বি মামা।

খুব ব্যস্ত?

জ্বি না।

তাহলে তোর সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলি ঐ ছিনতাইটা প্রসঙ্গে। তোদের সবার হয়ত ধারণা হয়েছে। ঐ দিনকার ঘটনার পেছনে আমার হাত আছে। আসলে তা নেই। ব্যাপারটা হল কি…

মামা আমার তো এখন ক্লাস আছে। ক্লাসে যাচ্ছি।

তবে যে বললি- তুই ব্যস্ত না।

ব্যস্ত না তা ঠিক, ক্লাস আছে তাও ঠিক।

ও আচ্ছা তুই তাহলে আমার কথা শোনায় আগ্রহী না?

তুই ঠিকই ধরেছ মামা।

ঐদিনকার ঘটনার মূল নায়ক কাদেরকে আমি শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

খুব ভাল করেছে মামা। শাস্তি দাও। আমি এখন যাই?

কি শাস্তি দিচ্ছি সেটা শুনে যা। তোর ইউনিভার্সিটিতো পালিয়ে যাচ্ছে না। এক মিনিট লাগবে। আমি অবশ্যি চেষ্টা করব-তোর চেয়েও কম সময়ে কাজ সারতে। ধরা পাচ পঞ্চাশ সেকেন্ড।

বল কি বলবে।

কাদেরকে মানসিক শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কঠিন মানসিক শাস্তি। তার গলায় সাইনবোর্ড বুলিয়ে দেয়া হবে। সেখানে লেখা থাকবে-  আমি চোর। এই অপমান সূচক বিজ্ঞাপন গলায় বুলিয়ে সে এক লক্ষ বার কানে ধরে উঠবে এবং বসবে। প্রতি উঠবোসের সময় উঁচু গলায় বলবে। আমি চোর।

বাহ চমৎকার শাস্তি।

এখানেও শেষ না। প্রতি রাতে তাকে একটা করে শিক্ষামূলক ছবি দেখানো হবে। এটা করা হবে আত্মশুদ্ধির জন্যে।

এখন যাই মামা? তোমার কথা নিশ্চয়ই শেষ হয়েছে।

শেষ হয়নি।

সময়তো শেষ হয়ে গেছে। এক মিনিট চেয়েছিলে, তুমি কথা বলেছ। এক মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড। তেত্ৰিশ সেকেন্ড বেশি নিয়ে নিয়েছ। খোদা হাফেজ।

মিলি আর দাঁড়ালো না। চট করে চলে এলো বারান্দায়। বারান্দায় পা দিয়েই খানিকটা শংকিত বোধ করল— বাবার হাতে খাতাপত্ৰ। চট করে বলে বসতে পারেন— মা একটু শুনতো কি লিখলাম। মিলি অবশ্যই বলতে পারে আমি ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি। কিছু শুনতে পারব না। কিন্তু বলা সম্ভব না। কারণ সে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে না। যাচ্ছে মনসুরের কাছে। বাবার কাছে মিথ্যা বলা সম্ভব না। মিথ্যা কথাগুলো এই মানুষটার সামনে এলেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়।

সোবাহান সাহেব মিলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছিস? মিলি হ্যাঁ  না কিছুই বলল না। মধুর ভঙ্গিতে হাসল। সোবাহান সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, দুদিন হয়ে গেল অথচ আনিস আসছে না। ব্যাপারটা কি বলতো?

দু এক দিন থেকে, দেখে টেখে আসছে আর কি?

তবু চিন্তা লাগেছে। আজ না এলে মনে করিস তো— মেডিকেল কলেজের রেজিষ্ট্রারের বাসায় একটা টেলিফোন করব।

আচ্ছা।

তুই যাচ্ছিস কোথায়?

মনসুর সাহেবের ফার্মেসিতে যাচ্ছি বাবা।

যাচ্ছিস যখন ওকে বলিস আমার সঙ্গে দেখা করতে। জরুরি দরকার আছে।

কি দরকার বাবা?

এমদাদ সাহেব তার নাতনীকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে চান। তার ধারণা আমি বললেই হয়। ভদ্ৰলোকের যখন এত শখ বলে দেখি।

বললে লাভ হবে না। বাবা। উনি কিছুতেই পুতুলকে বিয়ে করতে রাজি হবেন না।

রাজি হবে না কেন? পুতুল মেয়েটাতো বড়ই ভাল। দেখতেও সুন্দর। মেয়েটা গরিব। গরিব হওয়াতো দোষের কিছু না। আমি বুঝিয়ে বললেই রাজি হবে।

মিলি কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সোবাহান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, সামান্য মুখের কথায় যদি মেয়েটার একটা গতি হয় তো মন্দ কি?

কিছু বলার দরকার নেই বাবা।

দরকার নেই কেন তুই আমাকে বুঝিয়ে বল।

শেষে রাজি হবে না। মাঝখান থেকে তুমি লজ্জা পাবে।

লজ্জার কি আছে? লজ্জার কিছুই নেই। তাছাড়া আমার ধারণা সে রাজি হবে।

আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি যদি মনে কর সে রাজি হবে তাহলে বলে দেখ।

তুই হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে গেলি কেন তাওতো বুঝলাম না।

মিলি কিছু না বলেই নিচে নেমে গেল। তার মন বেশ খারাপ হয়েছে।

মন আরো খারাপ হল যখন ডাক্তারকে ফার্মেসীতে পাওয়া গেল না। মিলি ঘণ্টা খানিক অপেক্ষা করে একটা চিঠি লিখে এল।

ডাক্তার সাহেব,

আপনাকে না পেয়ে চলে যাচ্ছি। একবার বাসায় আসবেন। বাবা আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। তবে দয়া করে বাবার সঙ্গে কথা বলার আগে আমার সঙ্গে কথা বলবেন। খুব জরুরি।

বিনীতা, মিলি।

 

মিলি বাসায় ফিরে দেখে কাদেরের শাস্তি পর্ব শুরু হয়েছে। তার গলায় সাইনবোর্ড আমি চোর। সে মহানন্দে উঠবোস করছে। ফরিদ উঠবোসের হিসাব রাখছে। প্ৰতি পঞ্চশবার উঠবোসের পর দশ মিনিট বিরতি। মিলি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এইসব ছেলে মানুষির কোন মানে হয়? কিন্তু মামাকে এই কথা কে বুঝাবে? এই বাড়ির সব মানুষ এমন পাগল ধরনের কেন?

মিলি মন খারাপ করে নিজের ঘরে ঢুকল। কেন জানি কিছু ভাল লাগছে। না। ঘর সংসার সবে ফেলে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। মাঝে মাঝে তার এরকম হয়। কদিন ধরে ঘন ঘন হচ্ছে। রহিমার মা ঘরে ঢুকল। তার মুখ ভর্তি হাসি। কাদেরের শাস্তিতে সে বড়ই আনন্দ বোধ করছে।

আফা আপনেরে বুলায়।

কে বুলায়?

টগরের আকবা।

উনি এসেছেন?

হ।

তুমি গিয়ে বল এখন যেতে পারব না। পরে এক সময় যাব।

জি আচ্ছা।

আরেকটা কথা শোন, ডাক্তার সাহেব এলেই তুমি আমাকে খবর দেবে।

রহিমার মা ফিক করে হেসেই সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল।

মিলি তিক্ত গলায় বলল, হাসলে কেন রহিমার মা?

বুড়ো হইছি তো আফা, মাথার নাই ঠিক। বিনা কারণে হাসি পায় আবার চউক্ষে পানি আয়!

ঠিক আছে তুমি যাও।

রহিমার মা আবার ফিক করে হাসল। তার বড় মজা লাগছে। চোখের সামনে ভাব ভালবাসা দেখতে ভাল লাগে। সে ফরিদের ঘরের দিকে রওয়ানা হল। কাদেরের শাস্তি আরো খানিকক্ষণ দেখা যাক। কাউকে শাস্তি পেতে দেখলেও মন ভাল হয়। কেন হয় কে জানে।

দশ মিনিট শাস্তির পর এখন বিরতি চলেছে। বিমর্ষ মুখে এমদাদ বসে। আছে। অনেকক্ষণ ধরেই সে একটা কথা বলতে চাচ্ছিল। সুযোগের অভাবে বলতে পারছিল না। এখন সুযোগ পাওয়ায় মুখ খুলল।

ভাইজান একটা কথা বলব?

বলুন।

এই শাস্তিতে চোরের কিছু হয় না। চোরের আসল শাস্তি হইল মাইর।

ফরিদ বলল, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। এ আপনি বুঝবেন না।

ছোট্ট একটা পরামর্শ দেই ভাইজান? রাখা না রাখা আপনার ইচ্ছা।

দিন পরামর্শ।

দুই হাতে দশটা কইরা ইট দিয়া রইদে খাড়া করাইয়া দেন, ইট হাতে লইয়া উঠি বোস।

আপনার পরামর্শ শুনলাম। দয়া করে আর কথা বলবেন না।

জি আচ্ছা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *