২৪. সুরতুন পঙ্গু বনবিড়ালটাকে

সুরতুন পঙ্গু বনবিড়ালটাকে কোলে করে গ্রামের পথে চলছে। পথে লোকজন ।আছে। সুরতুনের দিকে অনেকেরই লক্ষ্য আছে তাও বোঝা গেলো। অন্তত দু-একজন লোক তার সঙ্গে সঙ্গে চলবার জন্য নিজেদের দল থেকে পিছিয়ে পড়েছিলো। দু-দুবার সেও দুজন অপরিচিতের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলো, যেন কথা বলাই তার প্রয়োজন।

উঁচু সড়কটার বাঁদিক থেকে একটা পায়ে-চলা পথ কখনো মাঠ কখনো আল ধরে পদ্মার জল থেকে এগিয়ে এসে যেখানে সড়কটায় মিশেছে সেখানে এসে সুরতুন ইয়াজকে দেখতে পেলো। যেন ইয়াজকেই সে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো পথে পথে, যেন সে জানতো তাকে এদিকেই পাওয়া যাবে এমনভাবে মুখে হাসি নিয়ে সুরতুন দাঁড়ালো।

ইয়াজ?

সুরো?

কতি যাও, ইয়াজ?

বুধেডাঙায়।

ইয়াজ এবং সুরতুন পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো।

ইয়াজ বললো, কেন্ সুরো, এই গাঁয়ে আমার আম্মা থাকে।

এটা তার প্রশ্ন নয়। কথাটিকে নিজের মনের সম্মুখে ধরে অনুভব করা।

সুরো জিজ্ঞাসা করলো, ফতেমার সঙ্গে দেখা হয় নাই?

হইছে।

এই গাঁয়েই থাকো?

চেরকাল থাকবো।

সুরতুন ইয়াজের কাঁধের উপরে একখানা হাত রাখলো।

কিছুদূর গিয়ে সুরতুন আবার প্রশ্ন করলো, তোমার ভাইরা কনে?

জান্‌নে।

এখানে যদি পুলিস আসে?

আম্মা কোনো বুদ্ধি করবি।

এখানে যে চেরকাল থাকবা, করবা কী?

কে, মাছের ব্যবসা করবো।

সে কি?

গাঙে জালের কাছে মাছ নিয়ে গাঁয়ের পথে পথে বেড়াবো।

তাতে কী হবি?

কোনোদিন হয়, কোনোদিন হয় না।

তা হোক, তোমার ব্যবসায় আমাকে নিয়ে।

ইয়াজ বিস্মিত হলো। সুরতুনকে সে ফতেমার চাইতেও পাকা ব্যবসাদার বলে স্থির করেছিলো। তার মুখে একথা রসিকতা বলে মনে হয়।

ইয়াজ একটু চিন্তা করে বললো, কেন্, সুরো, তোমাক যেন খুব দুক্কা লাগে। অসুখ করছে?

সুরতুন সম্বিৎ পেয়ে ইয়াজের কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে নিলো।

.

সকালে ফতেমা যখন উঠে গেলো অভ্যাসমতো সুরতুনও শয্যা ত্যাগ করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার মনে হলো উঠে দাঁড়ানোর মতো কোনো উদ্দেশ্যও নেই তার চোখের সম্মুখে। সে অন্ধকারের দিকে মুখ করে শুয়ে রইলো। ঘরের কোণে বনবিড়ালটা পড়ে আছে। কাল সন্ধ্যায় হলুদ-চুন দিয়ে ইয়াজ তার ভাঙা পায়ের ডাক্তারি করেছিলো। ঘরের কোণে মাচাটার নিচের গাঢ়তম অন্ধকারে সেটা লুকিয়ে আছে। ঘরে কারো পায়ের শব্দ হলে দিনের বেলার জোনাকির আলোর মতো চোখ দুটি খুলছে, পরক্ষণেই আবার বন্ধ করছে। সেটার দিকেই মুখ ফিরিয়ে শুয়েছিলো সুরতুন। তার মনে হতে লাগলো সে-ও বনবিড়ালটার মতো অসহায়। একথা তার মনে হলো, ও যদি ব্যথা সারাতে পড়ে থাকে, আমি থাকলে দোষ কী!

দুপুরে ফিরে এসে ফতেমা সুরতুনকে তার শুয়ে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করেও উত্তর পেলো না।

বিকেলের দিকে ইয়াজের গলার সাড়া পাওয়া গেলো। খুশিতে ডগমগ হয়ে সে বললো, মস্ত এক রুই উঠছিলো, তা জালেরা বলে দিঘায় নিয়ে যাতে হবি। আমি কই–আমাক দেও, গাঁয়ে বেচবো। গাং থেকে সড়কে উঠতি না-উঠতি একজন কয়–মাছ যাবি সান্যালবাড়ি। আমি কই–হয়। বুদ্ধি আলো। তা সেখানে গেলাম, কলাম–এই মাছ আনছি আপনাদের জন্যি।-কনে থাকো তুমি? কলামবুধেডাঙা। একজন মাছ নিয়ে গেলো আর একজন দশ টাকার এক লোট দিয়ে কলোবকশিশ। জালেদের কলাম–তোমরা পাঁচ ট্যাকা ল্যাও আর আমার পাঁচ, এ তো বেচাকেনা না। তা ওরা কলে–ল্যাও। চাল আনছি আর জালেদের থিকে এই মাছ।

আরও পরে ইয়াজ আর রজব আলি খেতে বসলো বারান্দায়। তারা খেয়ে গেলে ফতেমা এলো, কী রে, ওঠ, খাওয়াদাওয়া কর। ছাওয়াল চাল আনছে, মাছ আনছে।

সুরতুন বললো, আজ ডাকো না, কাল উঠলিও উঠবো।

সুরতুনের রোগটা এমন নয় যে বিশ্রামে ও অন্ধকারে কমে যাবে। অনেকক্ষেত্রে বিশ্রামের অবকাশে এর বৃদ্ধি হয়। কিন্তু সুরতুনের একটা উপকার হলো। মাথায় কিছু ধরছিলোনা, জ্বরের ঘোরের মতো লাগছিলো, সেটা কমেছে।

পথে বেরিয়ে সে লক্ষ্য করলো পাঁচু সান্দারের ভগ্নদশাগ্রস্ত কুটিরটির কাছে একজন লোক বসে আছে। তার মনে হলো বেল্লাল সান্দারের বাড়িতেও কে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। বুড়ো। আলতাফের মতো তার মনে হলো–এর চাইতে গোরু-ভেড়া নিয়ে পথে পথে বেড়ানো ভালো। কিছুপরে সে একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ধরার চেষ্টা করতে লাগলোকী করা যাবে যদি এই ব্যর্থতাই তার ভাগ্য। এখানেই থাকতে হবে, এখানেই থাকতে হবে। মাঝখানে কিছুকাল নিজে ব্যবসা করে। নিজের পেট চালাতে শিখেছিলে, দু বেলা আহার পেতে, সেটা চিরকাল থাকার নয় এটাই বুঝে নাও। এই বুধেভাঙা এখন তোমার পরবাস নয়, তিনপুরুষ হলো এখানে। কোণঠাসা হয়ে সে চিন্তা করতে লাগলো : ভাগ্যের দিগন্তে মাধাই উঁকি দিয়েছিলো একদিন, এই বলে শোকই যদি করতে হয় তো পথে পথে পাগল হয়ে বেড়াতে হবে কেন, এখানেই কাদা যেতে পারে। দু একদিন পরে এই চিন্তার সঙ্গে সংযুক্ত করে আর একটি বাক্য সে মনে মনে তৈরি করলো : হয়তো বা ফতেমাও এমনি কাঁদে।

তখনো খুব ভালো করে আলো ফোটেনি। বারান্দার নিচে মাটিতে বসে ইয়াজ বাঁশের চাচাড়ি দিয়ে কী একটা তৈরি করছে। কিছু দূরে রজব আলি উবু হয়ে বসে তামাক টানছে। তারা দুজনে নিচু গলায় কি একটা আলাপও করছে।

সুরো বললো, কী হবে ও দিয়ে?

কে, মাছ ধরবো।

এখন ও দিয়ে কনে মাছ পাবা?

এখন কে, বর্ষার পর লাগবি।

ততদিন এখানে থাকবা?

ফতেমা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলো, বললো, মাথাল বুনছে দ্যাখোনাই, সুরো? বিশ দিন আসছে, তার বিশ ফরমাস। কয় যে জমি নিবি, চাষ করবি।

রজব আলি মাথা দোলাতে লাগলো।

রজব আলি এখন গোৰু চরায়। সান্দাররা যখন যাযাবর ছিলো তখন গোরু মোষ ভেড়া চরানোই তাদের অন্যতম পেশা ছিলো। কিন্তু এখন যেন এটা রজব আলিকে মানায় না। গ্রামে আর দু’একজন বয়স্ক লোক রাখালি করে, তারা হয় পঙ্গু নতুবা জড়বুদ্ধি। রজব আলি তাদের পর্যায়ে নেমে গেছে। বোগা, খানিকটা বাকুঁজো, মাথার চুলগুলিবড়োবড়োশাদা শাদা। কিছুক্ষণ পরে ফতেমা তাকে নুন-পাস্তা বেড়ে দেবে, সারাদিনের মতো রজব আলি বেরিয়ে পড়বে গোরু চরাতে। আঘাতটা কঠিন কিন্তু কাটিয়ে উঠবার চেষ্টাও করলো না সে।

রজব আলি বললো, শালা, বানাবের জানো ভারি।

ইয়াজ রাগের অভিনয় করে বললো, শালা কয়োনা,কলাম। কিন্তু হাতের দারকি ও বাঁশের চাচাড়িগুলো রজব আলির দিকে এগিয়ে দিলো।

সুরতুন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটার অর্থগ্রহণের চেষ্টা করতে লাগলো, যেন এই সাধারণ ব্যাপারটায় ঘটনার বেশি কিছু আছে।

পেট চালানোর জন্য গ্রামের পথে পথে ছুঁড়ে বেড়াতে হয় সুরতুনকে। অধিকাংশ দিন কাজ পাওয়া যায় না। ফিরতি-পথে অনেকবারই সে ভাবে এবার ইয়াজকে আর দেখা যাবে না। ফতেমাকে সে আম্মা বলে বটে কিন্তু সেটা এমন কিছু বন্ধন নয়। তার পুলিসের ভয়টা এখন। আর নিশ্চয়ই নেই। কিন্তু প্রতিবারেই গ্রামে ফিরে ইয়াজের সঙ্গে তার দেখা হয়।

সানিকদিয়ারে ছোটো একটা হাট হয়। সেই হাটে নিজের হাতের তৈরি গোটাদুয়েক মাথাল বিক্রি করতে গিয়েছিলো ইয়াজ, সঙ্গে একটা ছোটো ঝুড়িতে কিছু পানিফলও ছিলো। সে ফিরছিলো ব্যবসা করে, সুরতুন আসছিলো সানিকদিয়ারের হাজিসাহেবের বাড়ির দাওয়া নিকোনোর কাজ সেরে।

ধুলোর পথ। অনেক লোকের পায়ে পায়ে যে ধুলো উড়েছে, এখনো সেটা মাটিতে ফিরে আসেনি, বাতাসে ভাসছে, ফলে শূন্যটা যেন চোখে দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যার অস্পষ্ট অন্ধকারে এই ধুলোর আবরণ যেন একটা রেশমি বোরখার মতো।

দিনচর সব প্রাণীর বিশ্রামের সময় সন্ধ্যা, কাজেই সব শ্রেণীর মানুষের চিন্তায় এই সময়ে বিশ্রামের ও ঘরে ফেরার কথা। বিনা উত্তেজনায় এখন কেউ জোরে কথা বলে না, অকারণে দ্রুতগতিতে চলে না কেউ।

সুরতুন বললো, কে, ইয়াজ যে!

হয় সুরো? কখন নাগাল ধরলে, টের পাই নাই তো?

পথটা সংকীর্ণ। একটু সরে গিয়ে ইয়াজ নিজের পাশে সুরতুনের পথ চলার জায়গা করে দিলো।

একসময়ে সুরতুন বললো, ইয়াজ, তোমার ভাইগরে দেখবার মন কয় না?

অভ্যাসমতো উত্তরটা তাড়াতাড়ি দিতে গিয়ে থামলো ইয়াজ, একটুপরে সে বললো, কে, সুরো, তুমি কি ওগরে খবর রাখো? জয়নুল কেমন আছে জানো?

না।

যদি যাই দিঘায়, একবার দেখে আসবো ওগরে।

তাইলে পরান পোড়ে? তা যাবাই যদি আসবা কেন্‌?

সেখানে আমার কে আছে, কও? এখানে আম্মা আছে, তুমি আছো।

কিন্তু কথাগুলি যেন নিজের কানেই অবিশ্বাস্য শোনালো। যেন যে-মন্ত্রে আধখানা বিশ্বাস জন্মেছে তার এবং আধখানা অবিশ্বাস নিয়ে যাকে সে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে, কেউ সে মন্ত্রের ব্যর্থতার দিকে ইঙ্গিত করেছে। ইয়াজ রাগ করে বললো, বেশ, তাই যদি কও চলে যাবো একদিন।

সুরতুন বললো, রাগ করে চলে যাবের কইনাই। আমি ভাবতেছিলাম তুমি কী করে বেভ্রমে থাকো। সে ভাইয়ের জন্যি বাপের মাথায় লাঠি মারলা তার কথা মনে পড়ে না!

মানুষে মানুষে সম্বন্ধই বা কী আর বিমুখতাই-বা কোথায়। কোথাকার ইয়াজ আর কোথাকার ফতেমা।

তা তো হয়ই, বলে হাসিমুখে ভাবলো সুরতুন, ধরো হাতের কাছে এই ফতেমার কথা। বাপ নয়, মা নয়, এমন কী ভালোবাসার মানুষ ইয়াকুব পর্যন্ত নয়; বুড়ো রজব আলিকে মাঝখানে বসিয়ে ফতেমা একটা ফাঁকা জাল যেন বুনছে সংসারের। এই জালে এসে পড়লো ইয়াজ।

ইয়াজ বললো, কেন, সুরো, জয়নুল আর সোভানের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ কী? সে তো ঐ কসাইয়ের ছাওয়াল। তাদের আমি দেখবো শুনবো ভালোবাসবো, আমাক বাসে কে?

জয়নুল-সোভান ইয়াজের আপন কিংবা নয়, এটা বড়ো প্রশ্ন নয়। সুরতুনের মনে হলো ভালোবাসাইয়াজ জীবনে কখনো পায়নি, কেউই তাকে আপন করে কখনো কাছে টেনে নেয়নি।

সহসা সুরতুনের নিজেকেও অপরিসীম ক্লান্ত বোধ হলো। সানিকদিয়ারের হাজিসাহেবের বাড়ি থেকে পাওয়া চালের ছোটো পুটুলিটা সুরতুন কাকাল বদলে নিলো।

এখন সে যাবে ফতেমার বাড়িতে। ফতেমা চিরকালই হাসিমুখে অভ্যর্থনা করে, এবারও করবে, কিন্তু তাহলেও সেটা ফতেমার বাড়ি। রোজ এটা মনে না হলেও একদিন হতে পারে, যেমন এখন হলো।

সুরতুন ইয়াজের দিকে ফিরে বললো, কে ইজু, আমি তোমার আম্মা না, তাই বুঝিন দ্যাখো না?

অবাক হয়ে ইয়াজ প্রশ্ন করলো, কী দেখি না?

কথাটা হঠাৎ বলে ফেলে সুরতুন থেমে গেলো। চাপা লোক হঠাৎ মনোভাব প্রকাশ হয়ে গেলে যেমন করে তেমনি করতে লাগলো সে। সারাদিনের কায়িক পরিশ্রমের ও অনাহারের ক্লান্তি মানসিক ক্লান্তিতে সংযুক্ত হয়েছে। তার মনে হলো যেন এই পৃথিবীতে সে আর ইয়াজ ছাড়া সব নিবে গেছে।

সে ফিসফিস করে বললো, কে, আম্মা হলে কি চালের পুটুলিটা নিতে না? সুরতুনের ভঙ্গিটা বিস্ময়কর, সম্পূর্ণ ভাবটা গ্রহণ করতে পারলো না ইয়াজ। সে বললো, দেও না কেন, দেও, মাথায় করে নিয়ে যাই।

পথ প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো। পাশাপাশি চলতে চলতে গায়ে-গায়ে লেগে যাচ্ছে। সুরতুনের ইচ্ছা হলো ইয়াজের ডান হাতখানা নিজের কোমরের উপরে রেখে নিজের হাত দিয়ে সেটাকে ধরে রাখবে কিছুকাল।

বাড়ির সামনের মাঠটুকু পার হতে হতে সুরতুন বললো, কে, ইজু, আম্মাকে কবা নাকি এ সব কথা?

বস্তুত সুরতুন যা চিন্তা করেছিলো সেগুলি যে সে ভাষায় প্রকাশ করেনি এ সম্বন্ধে তার নিজেরই সন্দেহ হচ্ছিলো।

ইয়াজ মৃদু হেসে বললো, যদি কও তোমাক বু কবের পারি।

সুরতুন আর ইয়াজের পায়ের শব্দে আকৃষ্ট হয়ে উঠোনের নেড়ি কুকুরটা ডেকে উঠলো।

রসিকতা করা ফতেমার স্বভাব, রসিকতার সুরেই সে বললো, কেন্‌, সুরো, মনে পড়লো আমার কথা, আমার মনে হয় একবার যদি ভুলে যাও।

সুরতুন দাওয়ায় উঠতে উঠতে বললো, ভুলে গেলি কী তুমি ভুলবা না?

অ মা, ভুলবো কেন্?

ইয়াজ মাথার ঝাঁকা নামিয়ে ততক্ষণে তামাকে আগুন দিতে বসেছে। তামাক শেষ হলেই ভাতের জন্য সে তাগাদা দেবে। আলাপটা এগোলো না।

.

একদিন ইয়াজ এসে খবর দিলো গ্রামে দারোগা এসেছে। সঙ্গে পনেরো-বিশজন কনস্টেবল তার, চৈতন্য সার বাড়ি খানাতল্লাসি করছে। তার বাড়ির উঠোনে, বাগানে কোদাল চালাচ্ছে।

ব্যাপারটা এইরকম: দশ-পনেরোদিন আগে ছমিরুদ্দিন ও চৈতন্য সাহা দিঘা থানায় এজাহার দিয়ে এসেছিলো–সদর থেকে চিনি, কেরোসিন, তেল ও কাপড় আসছিলো। সন্ধ্যার কিছু আগে চরনকাশির বড়ো মাঠটার ধারে গাড়ি লুঠ হয়ে গেছে। গাড়োয়ান গাড়ি ফেলে পালিয়েছিলো প্রাণের ভয়ে। লুঠেরাদের পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়।

চৈতন্য সাহা কী ভেবে এত সাহস পেয়েছিলো বলা কঠিন, হয়তো সে ভেবেছিলো কনক দারোগা দিঘা থানায় নেই। কিন্তু কনক দারোগা দিঘা থানায় ছিলো না বটে, দিঘা সার্কেলের ইনসপেক্টর হয়ে ফিরে এসেছে–এ খবরটা চিকন্দিতে আসার কথা নয়, তাই আসেনি। দিঘার বড়ো দারোগা একজন কনস্টেবল ও একজন এ. এস. আই. পাঠিয়ে তদন্ত শেষ করবে ভেবেছিলো কিন্তু কনক বলে পাঠালো–আমি নিজেই যাবো তদন্তে, এবং অকস্মাৎ দিঘার দারোগাকে সঙ্গে নিয়ে কনক চিকন্দিতে এসে চৈতন্য সাহার বাড়িতে দুদণ্ড আলাপ করে বললো, আমার সঙ্গে ওয়ারেন্ট আছে, চৈতন্য সাহা এবং ছমিরুদ্দিনের বাড়ি আমি সার্চ করবো। যারা চুরির খবর পেয়ে গল্পগুজবের আশায় এসেছিলো তারা ব্যাপারটা শুনে বিস্মিত হলো এবং কৌতূহল নিয়ে চৈতন্য সাহার বাড়িতে পুলিসের অনুসন্ধানী দাপট লক্ষ্য করতে লাগলো। শুধু। চৈতন্য সাহা শাস্ত্রোক্ত উদাসীন পুরুষের মতো তার দোকানে বসে কুঁড়োজালিতে হাত রেখে। মালা টকাতে লাগলো।

কিছু পাবার কথা নয়, পাওয়া গেলো না, হতাশার ভঙ্গিতে কনক দলবল নিয়ে ফিরে চললো। যাওয়ার সময়ে চৈতন্য সাহার কাছে অত্যন্ত বিনয় করে বললো, আমি খুব দুঃখিত চৈতন্যবাবু, যে, আপনি চুরির এজেহার দিলেন আর চোরাই মালের জন্য আপনার বাড়িতেই সার্চ করতে হলো। এ আজকালকার নতুন এক কায়দা যা আমি ভালোবাসি নে, কিন্তু উপায় নেই। নিজের দোকানের মাল চুরি করা আজকাল যেমন দোকানীদের একটা প্রথা হয়েছে, আমাদেরও তেমনি প্রথা হয়েছে যার চুরি যায় তাকেই সার্চ করা।

চৈতন্য সাহা মুখে বললো, না না, তাতে আর কী। কিন্তু মনে মনে উচ্চারণ করলো, প্রায় ধরে ফেলেছিলো আসল চুরি। তুমি দিঘার ধারে কাছে আছে জানলে এ কাজ আর নয়।

দিঘা থানার দারোগার মনে একটু আনন্দ হয়েছিলো কনকের এ হেন পরাজয়ে। উপরওয়ালা, তাই খোলাখুলি না বলে সে বললো, ছমিরুদ্দিনের বাড়িটা আর সার্চ না করলেও চলবে?

তা চলবে। চোরেরা অনেকসময়ে মাল রাখবার ব্যাপারে নির্বোধ হয়, চৈতন্য নির্বোধ কিনা দেখলাম। আসলে তার সাধারণ জ্ঞান আছে। চুরিটা হয়েছে সদরেই, অর্থাৎ চৈতন্য গাড়িতে মাল আদৌ চাপায়নি।

তার চারিদিকে যে ভিড় হয়েছিলো সেদিকে লক্ষ্য করে কনক ধমকে উঠলল, তোমরা যাও, দারোগার রসিকতা শুনে কী হবে।

ধমক খেয়ে ভিড়ের লোকরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো, কিন্তু একজন হো হো করে হেসে উঠলো। সে ছিদাম। কনক তাকে চিনতে পারলো না।

কনক তার ঘোড়ায় চাপতে চাপতে দারোগাকে বললো, আপনার কনস্টেবলরা গ্রামের বন বাদা খুঁজে দেখুক। আপনি সান্যালদের নায়েবমশায়ের বাড়িতে দুপুরের আহারাদির প্রস্তাব করে পাঠান। চৈতন্য সাহা আপনার কনস্টেবলদের চাল ডাল আটা ইত্যাদি দেবে, রান্নার বাসনও দেবে। ওর দোকানে যথেষ্ট ঘি আছে, কনস্টেবলরা যেন শুকনো রুটি না খায়।

আপনি থানায় যাচ্ছেন, স্যার?

না, আমাকে একটু তদন্ত করতে হবে সান্দারপাড়াতে।

.

ইয়াজ বললো, কেন, সুবো, দারোগা কি এতদিন পরে আমাক নিতে আসলো? ইয়াজ দাওয়ায় উঠে মুখ গম্ভীর করে বসে রইলো।

সুরতুন ইত্যাদি কেউই ভাবতে পারেনি কনক সত্যি বুধেডাঙায় আসবে। শুধু বুধেডাঙায় আসা নয়, কনক রজব আলির বাড়ির উঠোনে ঘোড়ায় চড়েই ঢুকে পড়লো। ঘোড়ার পিঠে থেকেই সে ইয়াজকে দেখে বললো, এদিকে আয়।

ইয়াজ কাছে এলে সে বললো, উঁহু, সান্দার নয়। তোকে আমি কোথায় দেখেছি বল তো? দিঘার কসাইপাড়ায়?

জে।

তোমার বাপের মাথা ফেটেছিলো, তুমিই নাকি সেই ওস্তাদ? এখানে কী হচ্ছে, খুন না চুরি?

ইয়াজ ‘আম্মা বলে ডাক দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। কনক দারোগার ভ্রুকুটি সহ্য করা তার পক্ষে অসম্ভব।

ফতেমা ঘর থেকে বেরুলো। ভয়ে ভয়ে কিন্তু সুচিন্তিত ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বললো, হুজুর, ও আমার ছাওয়াল।

তোর ছেলে?

জে।

এমন সময়ে ঘরের পিছন থেকে রজব আলি আত্মপ্রকাশ করলো।

সেলাম।

কে? আরে তুমি রজব আলি না? কনক ঘোড়া থেকে নামলো। বেঁচে আছো? খুব খুশী হলাম তোমাকে দেখে। তোমার ছেলের আর কোনো খোঁজই পাওনি, না? বড়ো বুড়িয়ে গেলে তুমি। তোমার এখানে একটু বসি। না, না, ব্যস্ত হয়োনা। ইয়াজকে বললো কনক, ঘোড়াটাকে বাঁধ আর ওর জিনের তলা থেকে আলগা গদিটা খুলে আন।

ঘরের ছায়ায় জিন-এর গদিতে বুটপরা পা দুখানা ছড়িয়ে বসলো কনক। চুরুট টানতে টানতে সকলের খোঁজ খবর নিলো। ফতেমাকে উপদেশ দিলো, ছেলে ঘরে রাখতে হলে টুকটুকে বউ। এনে দিতে হবে।

সবচাইতে কৌতুকের খবর এই দিলো সে, যে তার এলাকা এখন অনেক বড়ো এবং সে এই এলাকার মধ্যে আরও অনেক সান্দারের খোঁজ পেয়েছে। তাদের মধ্যে এখনো কেউ কেউ চুরিচামারি করে ভালোই আছে, কিছু অন্য ধরনেরও আছে। সে নিজে স্থির করেছে তাদের মধ্যে যাদের পরিবার আছে তাদের কাউকে কাউকে এনে বুধেডাঙায় বসানো যায় কিনা চেষ্টা করবে। তারা এলে সান্দারদের আবার লোকবল হয়। কোনো বলই নেই, সেটা হলে তবু কিছু হলো।

প্রায় আধ ঘণ্টা পরে ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে কনকের বিবেকটা বোধহয় কামড়ালো। সে একটু ঝুঁকে পড়ে রজব আলিকে প্রশ্ন করলো, এদিকে একটা বড়ো ধরনের চুরি, মানে, লুঠ হয়েছে। নাকি?

লুঠ?

হ্যাঁ। এক গাড়ি তেল চিনি কাপড়।

রজব আলি বললো, লুঠ হয় নাই। লুঠ করবার মতো একজনই হইছিলো, সে ইয়াকুব। সে তো নাই।

কনক চলে যাওয়ার পর ইয়াজ বললো, সুরা, শুনলা না দারোগা সাহেব কী কলো? এ গাঁয়ে সত্যি নোক আসবি?

তা আনবের পারে কনকদারোগা।

ইয়াজ কী ভাবতে লাগলো। কয়েকদিন পরে ইয়াজ বললো, জমি লিবো একটু। সুরো, চরনকাশির বুড়া মিঞার কাছে আমাক একটু নিয়ে যাবা?

ফতেমা বললো, ট্যাকা লাগে। হাল বলদ কেনা লাগে।

ইয়াজের মুখ ফ্যাকাশে হলে গেলো।

পরিহাস করে সুরতুন বললো, মাছের ব্যবসা কর গা।

মাছের ব্যবসা?

ওই যে সেদিন কী বুনলি, তাই দিয়ে মাছ ধর গা।

বিদ্রূপটা ইয়াজ বুঝতে পারলো, ক্রোধে তার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

কিন্তু ইয়াজের যেন ইতিমধ্যে জ্ঞান হয়েছে, জমি ক্রোধের চাইতে মূল্যবান। সে রজব আলির কাছাকাছি গিয়ে তামাক সাজতে বসলো। বললো, নানা, জমি লিবো একটু।

‘নানা’ সম্বোধনটা রজব আলির কানে লেগেছিলো, একটুপরে বোধ হয় বুকে গিয়েও বিধলো। হাতের কাছে একটা বাখারি পড়ে ছিলো, সেটা উদ্যত করে সেশাসিয়ে উঠলো, শালা রে শালা! কোনকার কোন অনজাতের চারা। তুই কি সান্দার? তুই কি ইয়াকুবের ছাওয়াল!

তা নানা, একটু সরে বাখারির আওতার বাইরে বসে বললো ইয়াজ, তা নানা, ধরো যে আমি তোমার ইয়াকুবের ছাওয়াল না হলাম। ফতেমা আমার আম্মা কিনা শুধাও।

কথা বলতে বলতেই সেক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলো,বললো, তাঁ, আজই তার ফায়সালা করা।

একটা উদাসীন নিস্পৃহভাব যেন রুক্ষ বুধেডাঙায় ইতস্তত ছড়ানো আছে। সেটা সুরতুনকে অধিকার করে কখনোবা কয়েক মুহূর্তের জন্য, কখনো দু-একটি দিন তার প্রভাব থাকে। কতকটা যেন দূরে সরে যাওয়ার মতো ব্যাপার। দূরে সরে এলে অনেকসময়ে কোনো কোনো বিষয়ের সমগ্র রূপটা চোখে পড়ে। সমগ্র বুধেডাঙা যেন একত্রে মনে ধরা যায়। কনকদারোগা বলে গেছে তার এক্তিয়ার থেকে সান্দার কুড়িয়ে এনে এনে এখানে জমা করবে। মানুষ যেন গাছের চারা। আগুনে পুড়ে গেছে, সেখানে লাগানোর জন্য অন্য জায়গা থেকে কুতি: আনা চারাগাছ লাগানো হচ্ছে, আর ইয়াজ যেন বাতাসে ভেসে আসা বীজ।

অন্য আর একদিন এই তুলনাটা পূর্বশ্রুত গল্পের মতো মনে পড়লো সুরতুনের। সে তখন নিজের কথা ভাবছিলো। আমনের চারার মতো সযত্নে মাধাইয়ের স্নেহে লালন করে কোনো এক বোকা চাষী তাকে এই কাশের খেতে বুনে দিয়েছে।

একটা বিরক্তিবোধ তাকে হিংস্র করলো। বনবিড়ালটার কথা মনে পড়লো তার। ধরতে গেলে ফ্যাঁসফ্যাঁস করে উঠেছিলো, শেষে তার হাত আঁচড়ে দিয়ে পালিয়েছে। ইয়াজ ব্যাপারটায় হো হো করে হেসে উঠেছিলো। পরে সে নিজেও সে হাসিতে যোগ দিয়েছিলো। যতদিন তার পা সারেনি অন্ধকারে মাচার তলে পড়ে থাকতো। কেউ দয়া করে আহার্য দিলে খেত। দিঘার ওদিকে কোন বনে জন্ম। বুধেভাঙা ও চিকন্দির জঙ্গলে কেউ তার পরিচিত নয়, কিন্তু সে কি একা একা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে না?

কিন্তু আকস্মিকভাবে মনে পড়ে : আর মাধাই—

হায় মাধাই!

ময়লা আঁচলে চোখ মুছতে গিয়ে আর-কিছু বালি পড়লো চোখে। হায়, হায়! মাধাই তো আসমানের জুন!

আর সে নিজে তত বনবিড়াল নয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *