২৪. সুন্দর একটা পাঞ্জাবি

হোসেন সাহেব সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পরেছেন। গলার কাছে কাজ করা শাদা পাঞ্জাবি। গায়ে হালকা সেন্ট দিয়েছেন। সকালে সেলুনে চুল কাটাতে গিয়েছিলেন। মূল উদ্দেশ্য চুল কাটা না, কানের দুপাশে যেখানে চুল বেশি শাদা হয়ে গেছে সেখানে হালকা করে কলপ দেয়া। সেলুনের নাপিত কাজটা ভাল করেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হল–বয়স বেশ কয়েক বছর কমে গেছে।

তিনি অপেক্ষা করছেন আতাহারের জন্যে। আতাহারকে নিয়ে আজ তিনি নীতুর বিয়ের কয়েকটা চিঠি বিলি করবেন। সেই কয়েকটা চিঠির একটা হচ্ছে ফরিদার। মেয়ের মা হিসেবে দাওয়াতের একটা চিঠি ফরিদার প্রাপ্য। সেই চিঠি যদি তিনি নিয়ে যান তাতে ক্ষতি কিছু নেই বরং সেটাই স্বাভাবিক। মেয়ে তার নিজের বিয়ের চিঠি নিজে নিয়ে যাবে এটা লজ্জা ও অস্বস্তির ব্যাপার। সাজ্জাদের তো কিছুদিন ধরে কোন খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না। নিমন্ত্রণের এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি তিনি ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে পারেন না। কিংবা ডাকেও পাঠাতে পারেন না। সঙ্গত কারণেই তাকে যেতে হচ্ছে।

চিঠি দিয়েই চলে আসবেন সেটাও ভাল হবে না। কিছুক্ষণ বসতে হবে। সাধারণ কিছু কথাবার্তা বলতে হবে। যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে ছেলেটা কেমন–এইসব কথা বলতে তার অস্বস্তি লাগবে। যে মেয়েটি এক সময় তার স্ত্রী ছিল সে অন্যের স্ত্রী। তার সঙ্গে কথা বলার মধ্যেও এক ধরনের গ্লানি আছে। থাকলেও কি আর করা। সহজ স্বাভাবিকভাবে গল্প করে চলে আসবেন। চা তো দেবেই। চা খাবেন। চা যখন দেবে তখন লক্ষ্য রাখতে হবে তিনি যে চায়ে এক চামচ চিনি খান এটা ফরিদার মনে আছে কি না। অবশ্যই মনে থাকবে। মেয়েরা এইসব খুঁটিনাটি জিনিস খুব মনে রাখে। ফরিদার স্বামী বাসায় থাকলে খারাপ হবে না। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হবে।

সৌজন্যমূলক কথা। ভদ্রলোকের সঙ্গে কি নিয়ে কথা বলবেন তাও মোটামুটি ঠিক করে রেখেছেন–তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব। বৃদ্ধ বয়সে ধর্ম নিয়ে কথা বলতে সবাই ভালবাসে। ভদ্রলোকও নিশ্চয়ই তার মতই বুড়ো। বিজ্ঞান নিয়েও আলোচনা করা যায়। স্টিফেন হকিংসের नळून বইটা–কি যেন নাম Baby Universe … বইটা কিনেছেন। এখনো পড়া হয়নি।

ফরিদার জন্যে একটা উপহার-টুপহার কিছু নেবেন কি-না এটা অনেক দিন ধরেই ভেবেছেন। সাধারণ উপহার। যেমন ফুলের তোড়া … না, ফুলের তোড়া নেয়া ঠিক হবে না–বই নেয়া যেতে পারে। এক প্যাকেট চকলেট নেয়া যায়। এতে দোষের কিছু নেই।

আতাহারের আসার কথা ঠিক দশটায়। আতাহার দশটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই চলে এল। ভালই হল, মিনিট দশেক সময় পাওয়া গেল। এক কাপ কফি খেয়ে বিসমিল্লাহ করে রওনা দেয়া।

কেমন আছ আতাহার?

জ্বি চাচা, ভাল।

তোমাকে খুব ফ্রেস লাগছে।

আপনি বলেছিলেন গোসল-টোসল করে ফ্রেস হয়ে আসবে। তাই এসেছি।

গুড, ভেরী গুড। নানান জায়গায় যাব তো—প্রেজেন্টেবল হয়ে যাওয়াই ভাল। এক কাপ কফি খেয়ে রওনা দি–কি বল?

জ্বি আচ্ছা।

নীতুর আবার জ্বর এসেছে–বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে মেয়েটা দুদিন পরপর অসুখে পড়ছে। টেনশন থেকে হচ্ছে। বিয়ের ব্যাপারে এক ধরনের টেনশন সব সময় কাজ করে। এমন একটা মেয়েকে তুমি বিয়ে করছ যার সঙ্গে তোমার দীর্ঘদিনের পরিচয় কিংবা ইয়ে কি যেন বলে প্রণয়। তার সঙ্গে বিয়ে হলেও তুমি টেনশনে ভুগবে।

জ্বি, ঠিকই বলেছেন।

নীতুর মার সঙ্গে আমার যখন বিয়ে ঠিক হল–সে সময়ের কথাই ধর–তার সঙ্গে আমার অবশ্যি পূর্ব পরিচয় ছিল না। এরেঞ্জড ম্যারেজ। যাই হোক, বিয়ের দিনতারিখ ফাইন্যাল হবার পর–টেনশনে রাতে আমি এক ফোটা ঘুমাতে পারি না। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার আমাকে লিকুইড ব্রোমাইড দিল। শুতে যাবার আগে দুচামচ খেলে মরার মত ঘুম হবার কথা। আমি তিন চামুচ খেয়ে শুয়েছি, তারপরেও এক ফোটা ঘুম হয়নি।

বলেন কি?

তুমি বস। আমি কফির কথা বলে আসি। না-কি চা খাবে?

একটা কিছু খেলেই হয়।

আরেকটা কথা–নীতুর মার জন্যে কোন উপহার-টুপহার কি কিছু নিয়ে যাব? ধর বই বা ফুল এই জাতীয় কিছু?

নিতে পারেন।

ও চকলেট পছন্দ করত। এক প্যাকেট ভাল চকলেট নিলে কেমন হয়?

ভালই হয়।

শুধু চকলেট নেব না। ফুলও নেব?

দুটাই নিন।

অন্য কিছু ভাববে না তো আবার?

ভাবাভাবির কি আছে। একটা আনন্দ সংবাদ দিতে যাচ্ছেন–ফুল নিয়ে যাচ্ছেন। এতে ভাবাভাবির কি আছে?

তুমি ঠিকই বলেছ। আমি এই লাইনে চিন্তা করিনি। ঠিকই তো, আনন্দ সংবাদ দিতে যাচ্ছি, ফুল নিয়ে তো যাবই। এই ফুল হচ্ছে–মিলির বিয়ে হচ্ছে সেই আনন্দের ফুল। ধর, কোন রকম কারণ ছাড়া যদি আমি যেতাম, সঙ্গে এক গাদা ফুল, তাহলে তার ভিন্ন অর্থ হত। তা তো যাচ্ছি না। কথাটা তো তুমি খুবই ভাল বলেছ আতাহার। বাংলা প্রবচনে আছে–বুদ্ধি নিতে হলে তিন মাথাওয়ালা বুড়োর কাছে যাও। এখন তো মনে হচ্ছে তরুণদের মাথা বুড়োদের চেয়ে অনেক পরিষ্কার। ভাল চকলেট কোথায় পাওয়া যায় জান আতাহার?

জ্বি না।

গুলশানের দিকে পাওয়া যাবে। ঐখানে কিছু ভাল ভাল দোকান আছে।

জ্বি, চলুন যাই।

কফি খেয়ে যাই। কফি খেতে আর কতক্ষণ লাগবে।

 

ফরিদার গুলশানের বাড়িটা দোতলা। লাল এবং হলুদ বাগানবিলাসে ঝলমল করছে। মূল বাড়ি ঢাকা পড়েছে রঙের ভিড়ে। বাড়ির দারোয়ান তাদের নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসোল। ছিমছাম সুন্দর ড্রয়িং রুম। নিচু দুসেট সোফা, দেয়ালে কয়েকটা পেইনটিং। এতেই ঘরটা এত সুন্দর লাগছে! ঘরের দুই কোণায় মার্বেলের টেবিলে দুটা ক্রিস্টালের মূর্তি। মূর্তি দুটা দেখার মত। এসব বাড়িতে সাধারণত খুব দামী পার্সিয়ান কর্পেট থাকে। এ বাড়িতে কার্পেটের বদলে শীতল পাটি। আতাহার বলল, ড্রয়িং রুমটা তো সুন্দর করে সাজানো। হোসেন সাহেব তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, ঘর-দুয়ার সাজানোর ব্যাপারে ফরিদার খুব ঝোঁক।

কাজের একটা মেয়ে দোতলা থেকে নেমে এসেছে। হোসেন সাহেব ফরিদা এসেছে। ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার দেখাদেখি আতাহারও উঠে দাঁড়াল। কাজের মেয়েটিকে দেখে হোসেন সাহেব খুব লজ্জা পেলেন। মেয়েটি বলল, কার কাছে আসছেন?

ফরিদার কাছে। ও আছে না?

জ্বি আছেন। আপনারা কি জন্যে এসেছেন? আপনাদের নাম?

তুমি গিয়ে বল নীতুর বাবা এসেছেন–হোসেন সাহেব। এই কার্ডটা নিয়ে দাও। কার্ড হাতে দিলেই বুঝবে।

কাজের মেয়েটা কার্ড হাতে নিয়ে চলে গেল। হোসেন সাহেব আনন্দ নিয়ে বসার ঘরের সাজসজ্জা দেখতে লাগলেন। তার কাছে মনে হচ্ছে ঘরের পর্দাগুলি একটু যেন ময়লা। ঝকঝকে ইস্ত্রি করা পর্দা ছাড়া এ বাড়ি মানায় না। ফরিদাকে পর্দার কথাটা বলবেন কি-না বুঝতে পারছেন না। বললে মনে কষ্ট পেতে পারে। একটা আনন্দের দিনে মনে কষ্ট পাওয়া যায়, এমন কিছু বলা উচিত না।

কাজের মেয়েটি নেমে এল। আগের মতই গম্ভীর গলায় বলল, আম্মার শরীর ভাল না। শুয়ে আছে। নিচে আসতে পারবে না। বলেছে আপনাদের চা খেয়ে যেতে।

হোসেন সাহেব অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন মেয়েটার কথা তিনি বুঝতে পারছেন না। আতাহার বলল, আমরা চা খেয়ে এসেছি। চা খাব না। আপনি ফুল আর চকলেটগুলি উপরে নিয়ে যান।

 

বর্ষা শেষের রৌদ্রকরোজ্জল দিন। ড্রাইভার গাড়ি চালাছে। হোসেন সাহেব এবং আতাহার পেছনের সীটে বসে আছে। আতাহার বলল, চাচা, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?

না।

বাকি কার্ডগুলি কি আজ বিলি করবেন?

না, আজ থাক।

চলুন কোন জায়গা থেকে ঘুরে আসি।

কোথায় যাবে?

চিড়িয়াখানায় যাবেন চাচা? মাঝে মাঝে চিড়িয়াখানায় যেতে খুব ভাল লাগে।

চল যাই।

আতাহার গাড়ির ড্রাইভারকে মীরপুরের দিকে যেতে বলল। হোসেন সাহেব ডাকলেন, আতাহার!

জ্বি চাচা।

ফরিদার ব্যবহারে তুমি মনে কষ্ট পাওনি তো?

জ্বি না?

কষ্ট পেও না–বোধহয় কোন কারণে মন-টন খারাপ ছিল এই জন্যে দেখা করেনি। মানুষের মন বড় বিচিত্র আতাহার। মন একমাত্র জিনিস যার উপর মস্তিকের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।

জ্বি চাচা।

আমরা ইচ্ছা করলে চোখের পাতা বন্ধ করি। হাত নাড়তে পারি, পা নাড়তে পারি কিন্তু ইচ্ছা করলেই হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বন্ধ করতে পারি না। কেন পারি না জানি আতাহার?

জ্বি না, চাচা।

কারণ মন বাস করে হৃদপিণ্ডে। মনের উপর মস্তিক্ষেকের নিয়ন্ত্রণ নেই–এই কারণে।

আতাহার দীর্ঘশ্ববাস ফেলল। এই বৃদ্ধ মানুষটির প্রতি মমতায় তার চোখে পানি এসে যাবার মত হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *