সন্ধ্যাবেলা মেয়ে দেখতে আসবার কথা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে চৌধুরী সাহেব এসে হাজির। দবির মিয়া অতিরিক্ত রকমের ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
চৌধুরী সাহেব সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসার ঘরের চেয়ারে বসে রইলেন।
ছেলে নিজেই এল মেয়ে দেখতে। মুররির মধ্যে ছেলের বড়োভাই। ছেলে দেখে জহুর বেশ অবাক হল। সুন্দর চেহারা। কথায়বার্তায়ও চমৎকার। চুনীকে দেখে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল না বা বন্ধুবান্ধবকে খোঁচা দিয়ে ভ্যাভ্যাক করে হাসল না। বেকুবের মতো জিজ্ঞেস করল না, এক সের বেগুন ড়ুবাতে কত সের পানি লাগে?
টুনী চলে যাবার পর ছেলের বড়ভাই বললেন, চৌধুরী সাহেব, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে।
চৌধুরী সাহেব বললেন, আপনার পছন্দ হয়েছে বুঝলাম, ছেলের মত জিজ্ঞেস করেন।
হয়েছে, ছেলের হয়েছে। এখন আপনাদের যদি ছেলে পছন্দ হয় তাহলে দিনতারিখ করেন।
চৌধুরী সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, আমাদের একটা শর্ত আছে। যদি শর্তে স্বীকার হন, তাহলেই সম্বন্ধ হবে।
দবির মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ছেলের বড়োভাই নড়েচড়ে বসল।
শর্তটা কি?
মেয়ে বড়ো গায়িকা। তার গান শুনলে বুঝবেন। শর্ত হল মেয়েকে গান-বাজনা শিখাতে হবে। কি বল দবির?
দবির মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। চৌধুরী সাহেব বললেন, তোমার মেয়েকে ডেকে আন তো দবির। খালিগলায় একটা গান শুনিয়ে দিক।
টুনীকে আবার আসতে হল। গান শোনাতে হল। ছেলের বড়োভাই বললেন, আমাদের সাধ্যমত আমরা চেষ্টা করব।
কথা দিচ্ছেন তো?
জ্বি, কথা দিলাম।
তাহলে হাত তোলেন, মুনাজাত হোক।
বিয়ের তারিখ হল আষাঢ় মাসে। ছেলেদের দাবিদাওয়া কিছু নেই। মেয়েকে খুশি হয়ে যদি কিছু দেন, তাহলে সেটা তাদের ইচ্ছা।
দবির মিয়া চৌধুরী সাহেবকে এগিয়ে দিতে গেল। চৌধুরী সাহেব বললেন, ছেলে তোমার পছন্দ হয়েছে তো?
জ্বি, পছন্দ হয়েছে।
পছন্দ হওয়ারই কথা। বনেদি ঘরের ছেলে। এদের আচার-ব্যবহারই অন্য রকম।
তা ঠিক।
আর ছেলের পড়াশোনার কথা যা বলেছিলাম, তা ঠিক না। আই এ পাস করেছে।
দবির মিয়া অভিভূত হয়ে পড়ল। চৌধুরী সাহেব বললেন, আমি জহুরের চাকরিটার কথা বলে রেখেছি, জহুরকে লাগিয়ে দাও।
দবির মিয়া জবাব দিল না। চৌধুরী সাহেব অস্পষ্ট স্বরে বললেন, পুরনো কথা মনে রেখে লাভ নাই। আমার কিছু কিছু দোষ-ত্রুটি হয়েছে। সবারই হয়। ভুলের সংশোধন করার চেষ্টা করছি।
দবির মিয়া অস্পষ্ট স্বরে কী বলল, ঠিক বোঝা গেল না। চৌধুরী সাহেব বললেন, বহু ঝামেলা করতে হয়েছে, বুঝলে দবির। তিন বার মরতে মরতে বাঁচলাম। এক বার তো ঘরে ঢুকে কোপ দিয়েছিল। জান তো সব। জান না?
জ্বি, জানি।
টাকাপয়সা থাকলেই ঝামেলা হয়। এখন আর এই সব ভালো লাগে না।
দবির মিয়া বলল, আমি জহুরকে বলব, চৌধুরী সাহেব। আজ রাতেই বলব।
বাজারের বড় রাস্তায় উঠে আসার মুখে সাইফুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হল। তার দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত। সে চৌধুরী সাহেবকে দেখে প্রায় ছুটে এল।
চৌধুরী সাব, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।
কী ব্যাপার?
আমার ঘরে সন্ধ্যারাতে চুরি হয়েছে।
আছে কি তোমার ঘরে, যে চুরি হবে?
আমার হারমোনিয়ামটা চুরি হয়ে গেছে চৌধুরী সাব। ডবল রিডের হারমোনিয়াম।
দবির মিয়াকে স্তম্ভিত করে সাইফুল ইসলাম হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। চৌধুরী সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, এর মধ্যে কাঁদার কী আছে? যাও, থানায় গিয়ে ডাইরি করিয়ে আসা থানায় গিয়েছিলে?
জ্বি-না। আপনার বাড়িতে বসে ছিলাম।
আমার বাড়িতে কেন? আমি কে? যাও, থানায় যাও। এক্ষুণি যাও। সন্ধ্যারাতে চুরি-ডাকাতি হচ্ছে, এটা ভালো কথা না।
টুনী এবং অঞ্জু দুজনে এক খাটে শোয়। খাটটি প্রস্থে ছোট, দু জনের চাপাচাপি। হয়। এদের ঘরে কোনো ফ্যান নেই। বড় কষ্ট হয় গরমের সময়। সন্ধ্যার আগে। আগে বৃষ্টি হওয়ায় আজ অবশ্যি তেমন গরম লাগছে না। তবু টুনী বলল, গরম পড়েছে খুব। অঞ্জু কিছু বলল না। টুনী বলল, বাবা খাটটা একটু বড় করে বানালে পারতেন। তার সব কিছুতেই পয়সা বাঁচানর চেষ্টা।
অঞ্জু বলল, আমার একার জন্য খাটটা ঠিক আছে। আষাঢ় মাস পর্যন্ত কষ্ট করতে হবে।
টুনী কিছু বলল না। অঞ্জু বলল, ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে তো আপা?
মন্দ কী?
আমার কাছে ভালোই লাগল। ব্যবসা করে মনেই হয় না।
কেন, ব্যবসা করলেই মানুষ খারাপ হয় নাকি? সবাই তো আর বাবার মতো না।
কথার কথা বললাম, রাগছ কেন?
রাগছি না।
তোমার গানও থাকল।
ঐ সব থাকবে-টাকবে না। বলতে হয় তাই বলেছে। টুনী শুয়ে পড়ল। শোবার আগে জানালা বন্ধ করার নিয়ম। আজ আর কেউ জানালা বন্ধ করল না। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে, বেশ লাগছে। অঞ্জু এক বার বলল, জানালা খোলা থাকলে বাবা রেগে যাবে।
যাক রেগে।
অঞ্জু মৃদু স্বরে বলল, বিয়েটা তোমার ভালোই হবে আপা।
ভালো হলেই ভালো।
চৌধুরী সাহেব সম্পর্কটা ভালো এনেছেন, তাই না আপা?
কি জানি।
মানুষ তো আর চিরকাল খারাপ থাকে না।
হুঁ।
তোমার কি মনে হয়, মামা চৌধুরী সাহেবের চাকরিটা নেবে?
আমার কিছু মনেটনে হয় না। বকবক করিস না, ঘুমা।
অঞ্জুর হঠাৎ মনে হল টুনী কাঁদছে। সে অবাক হয়ে বলল, আপা কাঁদছ না-কি?
টুনী জবাব দিল না।