শেষ কথা
দিন হয়ে এল গত।
ভাবিতেছি বসি নীরব আঁধারে
আঘাত করিছে হৃদয় দুয়ারে
দুর প্রভাতের ঘরে ফিরে আসা
পথিক দুরাশা যত।
আমার এই অকিঞ্চিৎকর জীবনকথা শেষ হল। অনেক আশা, অনেক কিছু শিখবার ইচ্ছে নিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম। তার শতকরা দশ ভাগ পূর্ণ হয়েছে। আশাতীত সৌভাগ্যও হয়েছে। আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে অফুরন্ত স্নেহ-ভালবাসা যা পেয়েছি তার কোনও পরিমাপ হয় না। সর্বোপরি লীলালক্ষ্মী আবির্ভূত হয়েছেন। আমার ভাগ্যে এত আনন্দও লেখা ছিল কখনও কল্পনা করিনি।
অন্য ব্যর্থতাবোধ ছাড়িয়ে নিজের সম্বন্ধে শুধু একটা ক্ষোভই রয়ে গেল। যৌবনে নিজস্ব জীবনদর্শনের কেন্দ্রে একটি তত্ত্ব ছিল, যা আমাকে নানা সংঘাতের ভিতর সুবুদ্ধি বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। এখনও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ব্যক্তি-মানুষের ব্যবহারে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ তার চেহারার মতো মানুষের স্বভাবও প্রকৃতিদত্ত। এর উপর কারও হাত নেই। এই কথা ভেবে নানা সময়ে নানা লোকের শত্রুতার শান্ত মনে মোকাবিলা করতে পেরেছি। বার্ধক্যে এই সুবুদ্ধি আমার লোপ পেয়েছে। কিছু তথাকথিত বন্ধুর (যাদের কেউ কেউ আমার দ্বারা বিশেষভাবে উপকৃত) নিরবচ্ছিন্ন গোপন শত্রুতার ফলে তাদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ বোধ করি। এতে ক্ষতি আমার, তাদের না। আশা করি এই অযৌক্তিক প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তি পেয়ে শান্তিতে মরতে পারব। তবে যে সব মানুষ নামের অযোগ্য নিকৃষ্ট জীব বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের সর্বনাশ ঘটাতে উদ্যোগী তাদের প্রতি অন্তহীন ঘৃণা যেন পরম পূণ্য জ্ঞানে আমরণ চিত্তে ধারণ করি। এ ব্যাপারে আমার কোনও অপরাধবোধ নেই।
গত ৮ মে ২৫ বৈশাখ (তারিখটি লক্ষণীয়) আমার আশি বছর পূর্ণ হয়েছে। শরীরে একটা জন্মগত সমস্যা আছে—aortal stenosis। যে-বৃহৎ ধমনীটি বয়ে রক্ত হৃৎপিণ্ডে যায় সেটি বুজে আসছে। ডাক্তার এবং যমদেব নোটিশ দিয়েছেনবছর দেড়েকের মধ্যে কিছু করা দরকার, নতুবা… কিছু করা মানে হৃৎপিণ্ডের একটি ভালভ কেটে কোনও শুয়ারহৃদয় থেকে তার বিকল্প নিয়ে জুড়ে দেওয়া। ওয়েবসাইটে এই তথ্য পেলাম যে, এ অস্ত্রোপচারে চারটি কমপ্লিকেশন হতে পারে—রক্তপাত, সন্ন্যাস, কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়া, আর চতুর্থ, মৃত্যু। শেষোক্তটি কি কমপ্লিকেশন? ও তো সব সমস্যার সমাধান। এই আসুরিক চিকিৎসায় শতকরা দশ জন ঘায়েল হয়। সুতরাং ওটা করাব না ঠিক করেছিলাম। তা ছাড়া অন্যায় বিনিময় বলে একটা কথা আছে। কোনও শুয়ারকে ডেকে ‘তোমার হৃদয় আমার হোক’ বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কারণ পরিবর্তে শ্রীযুক্ত বা শ্ৰীমতী শুয়ার তো কিছু পাবেন না, নেহাতই বেধড়ক মারা যাবেন। ব্যাপারটা ন্যায়সঙ্গত হবে না। তাই নিজের ঐতিহ্যের আশ্রয় নিয়েছি। প্রাণায়ামাদি করছি। দেখা যাক, কদ্দিন চলে। তবে শেষ অবধি ডাক্তার এবং বরাহের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া পথ নেই। আপাতত বন্ধুগণ, বিদায়।
শেষ কথার পরের কথা
প্রথম সংস্করণের শেষ পরিচ্ছেদের নাম ‘শেষ কথা’। লজ্জার মাথা খেয়ে আবারও লিখতে বসেছি, কারণ যমদেব ছুঁয়েও ছুঁলেন না, আমি এমনি পাপিষ্ঠ, যাকে বলে যমেরও অরুচি। যাক গে, পাপিষ্ঠ হলে সত্যিই যদি যম হোয়াচ বাঁচিয়ে চলেন, তবে আমি জন্ম জন্ম পাপিষ্ঠ হতে রাজি। কারণ বেঁচে থাকার কোনও বিকল্প নেই। আর সকলেই জানেন, পাপিষ্ঠ হওয়া মহা সুখের ব্যাপার। আমাদের এই পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে পাপিষ্ঠরাই তো সবচেয়ে সুখে আছে। তারাই আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তারাই আমাদের পয়সায় কেনা ট্রামবাস পুড়িয়ে রাজা উজির হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তারাই গণহত্যা করে বা করিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য দাবা খেলায় নামে। তারাই সহস্র কোটি টাকার কালোবাজারি করে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র বলে পরিগণিত হয়। অতএব আমার প্রস্তাব আমাদের জনগণের নতুন স্লোগান হোক–পাপিষ্ঠগুষ্ঠি জিন্দাবাদ, অপাপিষ্ঠরা নিপাত যাক। আর আমাদের নতুন জাতীয় সংগীত তোক
আমরা সবাই ছ্যাঁচোর
আমাদের এই চোরের রাজত্বে
নইলে মোরা চোরের সনে
মিলব কী স্বত্বে?
এতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি যে এত শ্রদ্ধা তাও অটুট রইল, আর আমাদের গৌরবময় রাজনীতির প্রকৃত অবস্থাটাও ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের জন্য অবিস্মরণীয় ভাষায় বিধৃত হল।
কিন্তু এসব হল বাজে কথা। বর্তমান বইটির সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে বৃহত্তর পটভূমিটা বুঝতে সুবিধে হবে বলে লিখলাম। আমার বয়সের মানুষ কথা বলতে গেলে কিছু বাজে কথা বলবেই। সুতরাং ব্যাপারটা ক্ষমার্হ।
২০০৭ সনের ৬ এপ্রিল দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রীয় সম্মান পেলাম আমাদের তখনকার রাষ্ট্রপতির হাত থেকে। তিনি পেশায় বৈজ্ঞানিক, জাতিতে মুসলমান। যাঁরা সম্মান পাবেন তাদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় বসে সামনে উপবিষ্ট অভ্যাগতদের দেখলাম। প্রথম সারিতে পুরানো সহকর্মী আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, মাথায় পাগড়ি, জাতিতে শিখ। তার পাশে সাদা ধুতি পাঞ্জাবিতে শশাভিত আমাদের লোকসভার স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, শতকরা ১৫০% বাঙালি। যাঁরা সম্মানিত হবেন তারা। ভারতবর্ষের সব অঞ্চল থেকে এসেছেন, গায়ে বিচিত্র আঞ্চলিক পোশাক। অভ্যাগতদের মধ্যে তাদের আত্মীয়স্বজন, অনেকেরই অঙ্গে আঞ্চলিক বেশবাস। তাঁদের মধ্যে আমার স্ত্রীকন্যা এবং সালোয়ার-কামিজে সজ্জিতা শ্রীমতী লীলালক্ষ্মী। মনে হল আমার সামনে আমার চারপাশে আমাদের বাল্য আর প্রথম যৌবনের কল্পনার ভারতবর্ষ–যথা নদীনাং বহবায়ু বেগাঃ। সেই স্বপ্নের ভারতবর্ষ আজ পোকায় খাওয়া, দুর্নীতিগ্রস্ত, নানা বিভেদে হতশ্বাস, দরিদ্র ভারতবাসীর অনাহার দূর করতে অক্ষম। তবুও কি আমরা সফলস্বপ্ন? না, কিন্তু যা পেয়েছি তাকে উপেক্ষা করার মতো মনোবল আমার নেই। মাথা পেতে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে রাষ্ট্রীয় সম্মান গ্রহণ করলাম। আমার জীবন সার্থক হল।
দেশ থেকে শ্বেতদ্বীপ ফিরে গেলাম, রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার ঠিক বারো দিন পরে অস্ত্রিচিকিৎসা হল, বক্ষ বিদারণ করে, হৃৎপিণ্ডের একটি ভালভ কেটে বাদ দিয়ে তার জায়গায় শূয়ার, না গোরুর হৃৎপিণ্ড থেকে একটি ভালভ (এই শব্দের বাংলা কোনও প্রতিশব্দ থাকলে তা আমার জানা নেই) নিয়ে বসিয়ে দেওয়া হল। ফলে সঙ্ঘ পরিবারের চোখে আমি পবিত্র জীব হলাম, না গো-হত্যার জন্য অপ্রত্যক্ষ ভাবে হলেও দায়ী হলাম, জানি না। ভয়ে ভয়ে আছি। কারণ তেনাদের মতিগতি সহজবোধ্য নয়। সম্প্রতি এক ফতোয়া দিয়েছেন যার অর্থ–কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়া চলবে না। যারা ফতোয়াটা দিয়েছেন তাঁরা সম্ভবত টেলিভীষণী রামায়ণ ছাড়া আর কিছু পড়েননি।
অস্ত্রোপচারের জন্য যখন আমাকে নিয়ে গেল তখন আমি বিশেষ দাওয়াইয়ের কৃপায় সুখসাগরে ভাসমান। চেতনা যেটুকু ছিল তার মারফত বার্তা পেলাম, মরি তো সুখেই মরব। মরব এই বিশ্বাস নিয়েই অস্ত্রোপচারে রাজি হয়েছিলাম, কারণ উপায়ান্তর ছিল না। বিশ্বাসটা শতকরা ১০০% যুক্তিযুক্ত ছিল না, তবে এই চিকিৎসায় দশ জনে একজন ঘায়েল হয়, আমার বয়সে শতাংশটা আর একটু বেশিও হতে পারে।
প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পরে জ্ঞান ফিরে এল। বেঁচে আছি, এই কথাটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগল। বুঝলাম নিতান্তই আটপৌরে এক শারীরিক অভিজ্ঞতা থেকে। হাসপাতালের বিছানার ফেনশুভ্র চাদরের উপর আমার একটা হাত পড়ে ছিল। সুখশীতল সেই চাদরের স্পর্শ থেকে হঠাৎ আশ্বাস পেলাম যে আমি বেঁচে আছি। এই সংবাদে সারা শরীর এক গভীর স্নায়বিক সুখে প্লাবিত হল। দেহ মনের এমন গভীর তৃপ্তির অভিজ্ঞতা এর আগে কখনও হয়নি। জানলাম, মরণশীল জীবের চরম সৌভাগ্য শুধু বেঁচে থাকা, নীরোগ যন্ত্রণামুক্ত শরীরে। এর তুলনায় আর সব কিছুই তুচ্ছ। নানা আশা-নিরাশা ছোট বড় ব্যর্থতাবোধ হঠাৎ অবান্তর মনে হল। চেনা অচেনা সব মানুষ নিতান্ত প্রিয়জন বলে জানলাম। জানালা দিয়ে দেখলাম দূর পাহাড়ের গায়ে রাইসরষের ক্ষেত ফুলে ফুলে হলুদ হয়ে আছে। মনে হল স্বর্গের দৃশ্য দেখছি। চেতনা, শুধু বেঁচে থাকার চেতনা, কোটি মণিমুক্তার চেয়ে মূল্যবান এই বোধ দেহমনে একটা সুখের আস্তরণ বিছিয়ে দিল। আমাদের দর্শনে উল্লিখিত কৈবল্য আর এই বোধ কি এক না হলেও সমগোত্রীয়?
তারপর প্রায় দু’বছর কেটে গেছে। এই সময়কালের প্রধান ব্যক্তিগত খবর, ‘বাঙালনামা’র প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হল, প্রচুর বিক্রি হওয়ায় ঘরে কিছু অর্থ সমাগম হল, লেখা থেকে যার তুলনীয় অর্থ আগে কখনও পাইনি। এর মধ্যে দুনিয়ার বাজারে মহামন্দা শুরু হয়ে গিয়েছে। তার ধাক্কা আমার মতো মিশকিন মোবারক লোকেরও গায়ে এসে লেগেছে। মিশকিন মোবারক শব্দ জুটির সঙ্গে যারা পরিচিত নন তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, ওর মানে পবিত্র ভিখারি। বাবা কথাটা প্রায়ই ব্যবহার করতেন, নিতান্ত বেচারা মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে। সেই থেকে কথাটা আমাদের পরিবারে চালু, প্রয়োগটা অভিধান-সম্মত কি না জানা নেই। মোট কথা বই বিক্রি হওয়ায় আমি উপকৃত। ক্রেতাদের ধন্যবাদ।
কিন্তু জনপ্রিয়তার জন্য এ দেশে একটি বিশেষ মূল্য দিতে হয়, সে ব্যাপারটা খুব স্বাস্থ্যকর কি না আমার সন্দেহ আছে। উপযুক্ত বিশেষ্যর অভাবে আমি সেই প্রবণতাটিকে আমড়াগাছি সংস্কৃতি বলে বর্ণনা করছি। এই সংস্কৃতির প্রধান লক্ষণ–সাধারণত অযোগ্য কোনও ব্যক্তিকে মহাপুরুষ বলে বন্দিত করা। লক্ষণীয় এই যে ব্যাপারটায় স্তুতিকারদের কোনও স্বার্থ নেই। ওঁরা যা করেন তা নিতান্তই অকারণ পুলকে। পুলকের যিনি লক্ষ্যস্থল, সম্ভবত তিনিও এতে অন্তত কিছুদিন পুলকিত হন, যদিও জীবধর্মের অধীন হলে যে কোনও মানুষেরই কয়েক দিনেই এতে দমবন্ধ হয়ে আসার কথা। আমার ক্ষেত্রে আমড়াগাছি সাময়িক সুখেরও কারণ হয়নি। কারণ দুনিয়ার হাটে আমার বাজার দর আমার ভালই জানা আছে।
সেটা যে খুব উঁচু নয়, তার অন্যতর প্রমাণ ইংরাজিতে একটি আত্মজীবনী লিখেছি (সেটা কোনও অর্থেই ‘বাঙালনামার অনুবাদ নয়), তার জন্য প্রকাশক খুঁজে পাচ্ছি না। বিলেতে পাইনি তার কারণ মন্দার ভয়ে সবাই বস্ত, বিশেষ করে যে বইয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে চুটিয়ে গালিগালাজ করা হয়েছে তা ছাপালে বিক্রি হবে কি না সন্দেহ। এক প্রকাশক নিতে রাজি হয়েছিলেন, আমার এক ‘বন্ধু’ হামলে পড়ে প্রস্তাবটা বানচাল করেন। বোধহয় সাম্রাজ্যের আলোচনাটা তার ঠিক হজম হয়নি। হ্যাঁ, ওদেশেও আমি সম্পূর্ণ বন্ধুহীন না, যদিও স্বদেশের তুলনায় তারা সংখ্যায় নগণ্য। আর দেশে এক সময় যাঁরা প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন তাঁদের আবিষ্কৃত মহাপুরুষরা এখন নানা ক্ষেত্রে কর্তাব্যক্তি। রাজধানীতে তো তারা রীতিমতো রাজত্ব করছেন। আমার মতো অকিঞ্চন লোকের বই ছাপানো বন্ধ করা তাদের তো বাঁ হাতের খেল। অতএব আমাকে যারা আমড়াগাছি করেন তারা অবহিত হোন–আমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ, আমার খ্যাতির যৌক্তিকতা নিয়ে যথাযথ কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে। অতএব ক্ষ্যামা দিন, আমাকে আর বেশি বাড়াবেন না, বাড়ালে আখেরে আপনাদেরই অনিষ্টের সম্ভাবনা।
এই দুই বছরে আমাদের রাজনৈতিক জীবনে কতগুলি বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটল যা আমার ব্যক্তিগত ভালমন্দ বোধকে স্পর্শ না করে পারেনি। প্রথমেই নন্দীগ্রাম। আমাদের উদারপন্থী রাজ্যে এমন ঘটনা দেখতে হবে এ কথা কখনও কল্পনাও করিনি। বিরোধী দলের প্রধান নেত্রীর কার্যকলাপ এতই জনস্বার্থবিরোধী, এতই সুবুদ্ধিবিরহিত যে তিনি কখনও সিংহাসন অধিকার করবেন ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। অপর পক্ষে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তসলিমা রাজ্য থেকে বিতাড়িত হলেন। এ নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিলাম। কিছু ফল হল না। ওঁকে কলকাতায় থাকতে দিলে সত্যিই কি মুসলমানরা বিরুদ্ধে ভোট দিতেন? তাদের অধিকাংশ লোক ধর্মান্ধ এমন মনে করার কী হেতু আছে? মুসলমান-প্রধান রাজ্য বাংলাদেশেও মৌলবাদীরা শতকরা দশের বেশি ভোট পায় না।
সম্ভবত রাজনৈতিক নেতাদের হিসাব নিকাশ আর সাধারণ মানুষের চিন্তা এক পথে চলে। ওঁরা আমাদের চেয়ে বেশি সাবধানী, কোনও ঝুঁকি নিতে নারাজ। আমরা রোজ রাস্তায় বের হই মিনিবাসে চাপা পড়ার ঝুঁকি নিয়ে, কাটা তেলের ধোঁয়ায় ফুসফুসে ক্যানসার হবার সম্ভাবনাটা প্রতিদিন আরেকটু বাড়িয়ে। অবশ্য ওই বিষ যাঁরা ছড়ান, তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকার এবং বিরোধী পক্ষ উভয়ই সমান ব্যাকুল। কাটা তেল বিক্রি বন্ধ হলে ষাট হাজার লোক খাবে কী? তাতে যদি এক কোটি লোক ক্যানসারে মরে তো কী করা যাবে? সংগ্রামশাস্ত্রে এ ধরনের মৃত্যুকে কোল্যাটারাল ড্যামেজ বলে। ওসব মেনে নিতে হয়। বৃথা ঝামেলা করবেন না, আপনার প্রাণটা কি ভোটে জেতার চেয়ে বেশি দামি? যত্ত সব!
মৃত্যুর কথা ওঠায় মনে পড়ল, গত দেড় বছরে আমার চারপাশে মৃত্যুর উৎসব শুরু হয়ে গ্যাছে। কুমার মুখার্জির উৎসাহে ‘বাঙালনামা’ লেখা শুরু করি। ওর খুব ইচ্ছে ছিল বইটা প্রকাশিত দেখে যাওয়ার। দু’সংখ্যা ছাপা হওয়ার পর ও চলে গেল। ওর ইংরিজিতে লেখা হিন্দুস্থানি মার্গ সংগীতের ইতিহাস মৃত্যুর ক’দিন আগে প্রকাশিত হল। বই পড়ার ক্ষমতা তখন আর নেই। সদ্য প্রকাশিত বইটি পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দেখছিল কুমার। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান ক’জনের জীবনেই বা লোপ পায়?
কুমারের পরেই গেল অমর সান্যাল। সেদিন দুপুরেই এক সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খেয়েছি। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে শুনলাম ও চলে গেছে। নানা গুণে গুণী মানুষটিকে কেউ চিনল না। অবশ্যি তা নিয়ে ওর যে খুব মাথাব্যথা ছিল এমন নয়। অদম্য প্রাণশক্তির এমন প্রকাশ আর কোনও মানুষের মধ্যে আমি দেখিনি।
তারপর গেলেন কল্যাণ সেন, রেভিন বোর্ডের অবসর প্রাপ্ত সভ্য, ঔদ্ধত্যবর্জিত ডাকসাইটে অফিসার, ‘৪৩ সন থেকে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শেষ ক’দিন বড় কষ্ট পেলেন। আমি তখন বিদেশে।
আর অরুণ দাশগুপ্ত। যৌবনের সহকর্মী, আমার বিদ্যাচর্চার প্রথম পৃষ্ঠপোষক, গান্ধীবাদ যাঁর জীবনের কেন্দ্র জুড়ে ছিল। সম্পূর্ণ শুদ্ধ চরিত্র মানুষ। আমাদের দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন সমাজে উনি কী করে বেঁচে ছিলেন সে প্রশ্নর সদুত্তর কখনও পাইনি।
সম্প্রতি গেলেন রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত– অসহ্য কষ্ট পেয়ে। ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষটির এই অন্যায় পরিণতি দেখে আমার অবিশ্বাস আরও দৃঢ় হল। রবিবাবু উনিশ শতকে বাঙালির নব জাগরণের শেষ প্রতিনিধি। মানবিক বিদ্যার এমন কোনও দিক ছিল না যা নিয়ে উনি গভীর পড়াশুনা করেননি। এই মানুষটি চলে গেলেন, বাঙালি ওঁকে নীরবে যেতে দিল। কোনও উল্লেখযোগ্য সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান ওঁর স্মরণে একটা সভা করা প্রয়োজন মনে করল না। শুনলাম তার অন্যতর কারণ, উনি ওদের লোক। উনি কারও লোক ছিলেন না। ওঁর চোখে যা কিছু অন্যায় মনে হত সহাস্য বিদ্রুপের ভাষায় উনি তার সমালোচনা করতেন। আদর্শবাদী মানুষটির বিচার সবসময় হয়তো ঠিক হত না। কিন্তু দেয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারার মতো কোনও অপরাধ এই অজাতশত্রু মানুষটি করেননি।
মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু। আমার চারপাশে যে দিকে তাকাই শুধু মৃত্যুই চোখে পড়ে। বুঝতে পারি, নিজের মৃত্যুও আর খুব দূরে নয়। মৃত্যুচিন্তার আলোয় পৃথিবীটাকে অপরিচিত মনে হয়। সব আশা আকাঙক্ষা, ব্যর্থতা বোধ অবান্তর হয়ে যায়। মনে হয় আর অল্পদিন পরে এইসব আশা নিরাশা ভালমন্দ বিচার কিছুরই কোনও অর্থ থাকবে না। হঠাৎ সব কিছু বড় প্রিয় বড় মূল্যবান হয়ে ওঠে। চেতনা লুপ্ত হয়ে যাবে, এই রূপ রস শব্দ গন্ধের বর্ণময় জগৎ আমার নাগালের বাইরে চলে যাবে–এই চিন্তা মনে একটা বিষণ্ণতার আবরণ টেনে দেয়। আমার চেনার জগতে লীলালক্ষ্মী থাকবে না, কারণ সেই জগৎটাই বিনষ্ট হয়ে যাবে। মৃত্যুর আর সব পরিণাম মেনে নিতে পারি, শুধু ওই অবর্ণনীয় ভালবাসার পাত্রী ছোট্ট মানুষটি আমার বিনষ্ট চেতনার বাইরে চলে যাবে এই সত্য মেনে নেওয়ার শক্তি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।