চতুর্বিংশ অধ্যায় – শিবের অন্তর হইতে মায়ার অপসারণ ও শিবের তপস্যা
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,– অনন্তর, হিমালয় পর্বতপ্রস্থে শিপ্র-সরোবরতীরে আসীন মহেশ্বর, নিকটবর্তী সেই সরোবর অবলোকন করিতে লাগিলেন। ১
ব্ৰহ্মা এবং বিষ্ণু, ধ্যান করিতে বারংবার অনুরোধ করায় তিনি ধ্যান করিতে মনস্থ করিলেন। ২।
সেই স্মরহর আত্ম-সাহায্যে আত্মাতেই আত্ম-দর্শন করিবার জন্য দৃঢ়চিত্তে ধ্যান করিতে পরম যত্নশীল হইলেন। ৩
মহাদেবের চিত্ত ধ্যানপ্রবণ হইয়াছে দেখিয়া ব্ৰহ্মাদি দেবগণ ভাবিলেন, শিব, মায়া-মোহিত হওয়াতেই সতীশোকে আকুল হইয়া সাতিশয় বিলাপ করিতেছেন; জগজ্জননী মায়াই ইহার মোহকারণ। অতএব এই মায়াকে নিঃসারিত করিয়া শিবের চিত্তকে ধ্যানে আসক্ত নিরাকুল ও নিরঞ্জন করিব। অতএব সংযত চিত্তে বিষ্ণুশক্তি মায়াকে স্তব করা যাক। সতী পুনরায় জন্ম গ্রহণ করিয়া যতদিন না শিবের অঙ্কশায়িনী হন, ততদিন ইনি শোকহীনচিত্তে নিষ্কল পরমব্রহ্ম ধ্যান করুন। ৪-৯
মনে মনে ইহা চিন্তা করিয়া ব্ৰহ্মাদি দেবগণ, মহামায়া যোগনিদ্রাকে স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন। ১০
পরমনিষ্কলা মহত্তত্ত্ব প্রকৃতিরূপা স্থূল-সূক্ষ্ম-কাৰ্য-কারণ-জ্ঞান-অজ্ঞান রূপিণী ঐকান্তিক প্রীতি ও পুষ্টিস্বরূপা পবিত্রা পাবনী ক্ষেমঙ্করী শ্ৰীশক্তি শিবাকে আমরা মহা ভক্তিসহকারে স্তব করি। ১১-১২
তুমি মেধা, তুমি ধৈৰ্য্য, তুমি লজ্জা, তুমি একা হইয়াও সৰ্বব্যাপিনী; তুমি আত্মপ্রপঞ্চ জগতের প্রকাশকারিণী দিবাকরদীধিতি। ১৩
যাহা ব্রহ্মাণ্ডের আধার; যাহা জগতের কারণ এবং জগৎ; যাহা ব্রহ্মাদিকে আপ্যায়িত করে; তুমি সেই জল এবং তুমিই নদী। ১৪
একমাত্র যে সদাগতি, সৰ্ব্বজগতের প্রাণ ও দেবগণের আধার, সেই বায়ু তোমারই অংশ। ১৫
যে এক জ্যোতি সৰ্বত্ৰসমিদ্ধ সৰ্বব্যাপক ও জগৎকারণ আর বহুধা পরি দৃশ্যমান হইয়া থাকে, সেই জ্যোতি তোমারই রূপ। ১৬
যে বস্তু–ব্রহ্মলোক পাতাল ও উহার মধ্যবর্তী সমুদায় লোক ব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছে, তুমিই সেই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্য বাহ্য ও সৰ্ব্বত্র অবস্থিত আকাশ। ১৭
প্রপঞ্চ-প্রসবিনী তুমিই কুলাচল-কুল-নিয়ন্ত্রিতা লোকমাতা জগদ্ধাত্রী অচলা মাধবী ধরণী। ১৮
তুমি বুদ্ধি, তুমি বুদ্ধির বিষয় পদার্থসমূহ; তুমি মা! ছন্দোগতি; তুমি বেদমাতা গায়ত্রী সাবিত্রী সরস্বতী। ১৯
তুমি নিখিল জগতের বার্তা, তুমি কামরূপিণী ত্রয়ী (ঋগ যজুঃ সাম)। ২০
তুমি নিদ্রারূপে, স্বর্গাদিনিবাসী অমরাদি প্রাণিগণকে সুখী করত মুগ্ধ কর। ২১
তুমি ধর্মিষ্ঠদিগের সুখ; পাপিষ্ঠদিগের দুঃখ; তুমি নীতিজ্ঞদিগের সুখ দায়িনী লক্ষ্মী, তুমি অন্তকালস্থায়িনী ও ধৈর্য্যস্বরূপা। ২২
তুমি সৰ্ব্বজগতের শান্তি, তুমি শশধরের কান্তি, তুমি সৰ্ব্বভূতের জননী, তুমিই নারায়ণ-বিমোহিনী লক্ষ্মী। ২৩।
তুমি পঞ্চভূতের সারকী তত্ত্বরূপিণী, তুমিই ত্রৈলোক্যরূপা মহামায়া, তুমি জনগণ-বিমোহিনী তন্দ্রা। ২৪
পরমেশ্বর যাহার সাহায্যে সৰ্ব্বভূতকে সংসারচক্রে আরোহণ করাইয়া ভ্রমণ করাইতেছেন, হে মহেশ্বরি! তুমি সেই মায়া। ২৫
তুমি জয়যুক্তদিগের জয়শক্তি, তুমি লজ্জা ও উত্তম নীতি, তুমি সামবেদের গীতি, তুমিই যজুর্বেদের নিগদময় মন্ত্র। ২৬
সমস্ত দেবগণের শক্তিরূপিণী জ্যোতির্ময়ী যে দেবীকে একমাত্র সত্ত্বগুণের সাহায্যে সাক্ষাৎ করা যায় ও যিনি রজোগুণপ্রপঞ্চ সাহায্যে জগতের উপাদান কারণ হইতেছেন, আমরা তাহাকে স্তব করিতেছি, তিনি আমাদিগের মঙ্গল দায়িনী হউন। ২৭
হে শিবে! তুমি চৈতন্যশক্তিহীন প্রকৃতি, তুমি সংসারসমুদ্রের ভীষণ তরঙ্গ স্বরূপ দুঃখজাল হইতে নিস্তারকারিণী, যোগের অষ্টাঙ্গরূপ পারসাধন কেনিপাত (দাঁড়) বিক্ষেপে বেগবতী তরণী; তোমাকে আমরা প্রণাম করি। ২৮
যিনি নিদ্রারূপে ত্রিলোকবাসীদিগের নাসিকা, মুখ, চক্ষু, বাহু, বক্ষঃস্থল এবং মন অবলম্বন করিয়া নিরন্তর সুখ সম্পাদন করেন, সেই ধৃতি-স্মৃতি-বৃত্তি রূপিনী দেবী আমাদিগের প্রতি প্রসন্ন হউন। ২৯
যিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়রূপিণী, এবং সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-শক্তি, সেই মায়া আমাদিগের প্রতি প্রসন্ন হউন। ৩০
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–তখন মহামায়া যোগনিদ্রা, দেবগণকৰ্ত্তক এইরূপ স্তুত হইয়া মহাদেবের হৃদয় হইতে সত্বর সম্পূর্ণরূপে নিঃসৃত হইলেন। ৩১
মায়া নিঃসৃত হইলে, বিশ্বরূপী স্বয়ং মধুসূদন শান্তিসম্পাদনাৰ্থ শিবের অন্তরে প্রবেশ করিলেন। ৩২
যেরূপে প্রতিকল্পে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় হয়, অচ্যুত তাহার অন্তরে প্রবিষ্ট হইয়া তাহা দেখাইতে লাগিলেন। ৩৩
তিনি যেরূপে সতী শিবের ভাৰ্য্য হন, সতী যে বস্তু, যাহার কন্যা এবং যেরূপে দেহত্যাগ করেন–তৎসমস্ত দেখাইলেন। ৩৪
তিনি, বহির্ব্যক্ত, অন্তঃসারশূন্য এই রাজসপ্রপঞ্চ মুহুর্মুহুঃ দেখাইয়া শিবের মনকে পরম তেজে সন্নিবেশিত করিয়া দিলেন। ৩৫
তখন মহাদেবও সেই সমস্ত প্রপঞ্চ বারংবার দর্শন করিয়া নিঃসারবোধে সার বস্তুতে মনোনিবেশ করিলেন। ৩৬
তখন দেববৃন্দবন্দিতা মায়া ব্ৰহ্মাদিসমীপে কৰ্ত্তব্য-পালনে অঙ্গীকার করিয়া সত্বর অন্তর্হিত হইলেন। ৩৭
ভগবান্ নারায়ণ, শিবের মন পরম পদে নিবেশিত করিয়া সূৰ্যমণ্ডল হইতে চন্দ্রের ন্যায় তদীয় অভ্যন্তর হইতে নিঃসৃত হইলেন। ৩৮
তখন ব্রহ্মা বিষ্ণু প্রভৃতি সকলে, কৃতকার্য হইয়া মহাদেবকে সেই পৰ্বতে পরিত্যাগপূর্বক প্রীতি-যুক্ত-চিত্তে স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন। ৩৯
ইন্দ্রাদি দেবগণ, ধ্যানাসক্ত ব্ৰহ্মরূপী চন্দ্রশেখর মহেশ্বরকে প্রণাম করিয়া স্ব স্ব স্থানে গমন করিলেন। ৪০
সেই দেবগণ, গমন করিলে বৃষবাহন মহেশ্বর, দিব্যমানে সহস্র বৎসর পরম জ্যোতি ধ্যান করিতে লাগিলেন। ৪১
ঋষিগণ বলিলেন,–মধুসূদন, শম্ভু-হৃদয়ে প্রবিষ্ট হইয়া কিরূপে প্রতিকল্পের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় যথার্থরূপে প্রদর্শন করিলেন? ৪২
আর সেই কৈটভসূদন রাজস জগৎপ্রপঞ্চ এবং তাহার সারশূন্যতা প্রদর্শন করিলেন কিরূপে? ৪৩
কিরূপেই বা তিনি সেই পরমগুহ্য সনাতন পরম জ্যোতি দেখাইলেন? হে দ্বিজবর! আমরা তোমার নিকট হইতে এই পরম মঙ্গলপ্রদ অদ্ভুত উৎকৃষ্ট ধর্মকথা শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি। ৪৪-৪৫
মার্কণ্ডেয় বলিলেন–হে দ্বিজসত্তমগণ! আমি বরাহ-কল্পীয় সৃষ্টির কথা বলিতেছি। সৃষ্টি বরাহ-কল্পে যেরূপ, অন্যান্য কল্লেও সেইরূপ জানিবে। ৪৬
হরি, শিবকে আদি সৃষ্টি প্রদর্শন করিয়া যেরূপ প্রতিসৃষ্টিতে প্রলয়াদি দেখিলেন, তাহা শ্রবণ কর। ৪৭
হে বিপ্রগণ! প্রথমতঃ প্রলয় বর্ণন, তৎপরে বরাহ-কল্পীয় আদি সৃষ্টি ও প্রলয় কীৰ্ত্তন করিব–শ্রবণ কর। ৪৮
এক এক নয়ন-নিমীলনে এক এক নিমেষ, ইহা কালের অংশবিশেষ। অষ্টাদশ নিমেষে এক কাষ্ঠা, ত্রিংশৎ কাষ্ঠায় এক কলা। ৪৯
ত্রিংশৎ কলাতে এক ক্ষণ, দ্বাদশ ক্ষণে এক মুহূর্ত,–ত্রিংশৎ মুহূর্তে মনুষ্যের এক অহোরাত্র। ৫০
পঞ্চদশ অহোরাত্রে এক পক্ষ, দুই পক্ষে, মনুষের এক মাস, পিতৃগণের এক অহোরাত্র। ৫১
দ্বাদশ মাসে মনুষ্যদিগের এক বৎসর–দেবগণের এক অহোরাত্র। কৃষ্ণ পক্ষ-পিতৃ-দিন, অতএব পিতৃকাৰ্য্য তাহাতেই কর্তব্য। ৫২
আর শুক্লপক্ষ তাহাদিগের নিদ্রোপযোগিনী রজনী বলিয়া কীৰ্ত্তিত। উত্তরায়ণ ছয়মাস-দেবগণের দিন, দক্ষিণায়ন ছয়মাস দেবগণের নিদ্রোপযোগিনী রজনী। নিম্নলিখিত সৌর দুই দুই মাসে এক এক ঋতু, তিন ঋতুতে মনুষ্যদিগের অয়ন, ছয় ঋতুতে বৎসর। ৫৩-৫৫
হে দ্বিজগণ! চৈত্র প্রভৃতি দুই দুই মাসে ঋতু; ঋতুগণের বিশেষ বিশেষ সংজ্ঞা আছে, তাহা পৃথক পৃথক্ শ্রবণ কর। ৫৬
চৈত্র-বৈশাখ বসন্তঋতু, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় গ্রীষ্মঋতু, শ্রাবণ-ভাদ্র বর্ষাঋতু, আশ্বিন কার্তিক শরৎ-ঋতু, অগ্রহায়ণ-পৌষ হেমন্ত-ঋতু, আর মাঘ-ফাল্গুন শিশিরঋতু; এই ছয় ঋতু কথিত হইল। কোন যজ্ঞাদি কার্যের কাল বসন্ত, কোন যজ্ঞাদি কার্যের কাল গ্রীষ্ম, এইরূপে সকল ঋতুই যজ্ঞাদি-কার্য্যের বিহিত কাল। ৫৭-৫৮
মনুষ্য-পরিমাণে সপ্তদশ লক্ষ অষ্টাবিংশতি সহস্র বৎসর সত্যযুগের পরিমাণ। ৫৯
তন্মধ্যে চারিশত বৎসর সন্ধ্যা এবং চারিশত বৎসর সন্ধ্যাংশ। ইহা লইয়া সত্যযুগের পরিমাণ সপ্তদশ লক্ষ অষ্টাবিংশতি সহস্র। ৬০
মনুষ্য পরিমাণে বার লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার বৎসর–ত্রেতাযুগের পরিমাণ। তন্মধ্যে তিন শত বৎসর সন্ধ্যা ও তিন শত বৎসর সন্ধ্যাংশ। ৬১-৬২
মনুষ্য পরিমাণে আট লক্ষ চৌষট্টি হাজার বৎসর দ্বাপরযুগের পরিমাণ, তন্মধ্যে তিনশত বৎসর সন্ধ্যা ও তিনশত বৎসর সন্ধ্যাংশ। ৬৩
চারি লক্ষ বত্রিশ হাজার বৎসর কলিযুগের পরিমাণ, তন্মধ্যে দেড় শত বৎসর সন্ধ্যা আর এক শত বৎসর সন্ধ্যাংশ। ৬৪-৬৫
সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি–এই চারিযুগ, মনুষ্য প্রমাণে এইরূপ হইয়া থাকে অর্থাৎ সন্ধ্যা-সন্ধ্যাংশ-সমন্বিত এই চারিযুগের পরিমাণ ত্ৰিচত্বারিংশৎ লক্ষ বিংশতি সহস্র বৎসর। ৬৬-৬৭
মনুষ্যের এক বৎসরে এক দৈব অহোরাত্র; এইরূপ নিয়মানুসারে গণনা করিলে মনুষ্যদিগের চতুর্যুগে দেবতাদিগের বার হাজার বৎসর। ৬৮
তাহা মনুষ্যদিগের সন্ধ্যা-সন্ধ্যাংশ-সংযুক্ত চারিযুগ। পাপপুণ্যাদি ব্যবস্থানুসারে সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি–এইরূপ যুগভেদ ব্যবহার দেবগণের নাই। ৬৯-৭০
মনুষ্যদিগের চারি যুগে এক দৈব যুগ হয়; একসপ্ততি দৈবযুগে এক মন্বন্তর। ৭১
দৈব দুইসহস্র যুগে এবং মনুষ্যদিগের দুই সহস্র চতুর্যুগে ব্ৰহ্মার অহোরাত্র। ৭২
এক ব্ৰহ্মদিনে চতুর্দশ মনুর অধিকার। মনুষ্যদিগের ন্যায় এইরূপ ব্রাহ্মদিব-মানানুসারে তিনশত ষাট দিনে ব্রহ্মার এক বৎসর হইয়া থাকে। ৭৩
ব্ৰহ্মার পঞ্চাশৎ বৎসরে এক পরার্দ্ধ–তাহাই ঈশ্বরের দিন, ঈশ্বরের রাত্রিও ঐ পরিমাণ। ৭৪
ব্ৰহ্মার একশত বৎসরে দ্বিপরার্দ্ধ কাল, এই দ্বিপরার্দ্ধকাল অতীত হইলে ব্ৰহ্মার লয় হয়। ৭৫
ব্ৰহ্মা পরমবস্তুতে লীন হইলে, জগন্মণ্ডলের প্রাকৃত লয় হইয়া থাকে। যিনি সমস্ত জগতের আধার পরাৎপর অব্যয় ব্রহ্ম, তাহার অহোরাত্র “পর” নামে অভিহিত; তাহার অর্ধের নাম পরার্দ্ধ। ৭৬-৭৭
জগৎস্বরূপী অক্ষয় অব্যয় ভগবান্ পরমাত্মা–স্থূল হইতে স্থূলতম, সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতম। ৭৮
তাঁহার আবার দিবারাত্রি ও বৎসরাদির ব্যবহার কি? ৭১
কিন্তু পূর্বে পৌরাণিকগণ এবং তাহাদিগের পথাবলম্বী আমরাও সৃষ্টি প্রলয়ের বোধ-সৌকাৰ্য্যার্থে তাহার অহোরাত্র কল্পনা করিয়া লইয়াছি। ৮০
তিনিই দিবা রাত্রি, তিনিই বৎসর, তিনিই পৃথিবী, তিনিই সৃষ্টিকর্তা আবার তিনিই সংহারকর্তা; সেই পুরাণ-পুরুষ বিশ্বরূপী এবং সমস্ত বিশ্ব তাহাতেই প্রকাশিত। ৮১
ব্ৰহ্ম, নিত্য পরমাত্মায় বিলীন হইলে, সমস্ত জগৎই ক্রমে ক্রমে সেই পরমাত্মভাবে পরিণত হইতে থাকে। ৮২
ব্রহ্মার শতবর্ষ-শেষে রুদ্ররূপী জনার্দন, জগৎ সংহার করিয়া স্বয়ং পরম বস্তুতে লীন হন। ৮৩
সূৰ্য্য, প্রথমে সমুদয় স্থাবর জঙ্গমকে তীব্র কিরণে বিশোষিত করিয়া সমস্ত জলাংশ গ্রহণ করেন। ৮৪
একশত দৈববৎসরে বৃক্ষ, তৃণ প্রাণী ও পৰ্বতগণ–শুষ্ক, চূর্ণ এবং বিশীর্ণ হইয়া যায়। ৮৫
তখন দ্বাদশ সূর্যের কিরণ-জাল অত্যন্ত প্রবল হয় এবং দ্বাদশ সূর্যও জগৎ শোষণের জন্য উদ্দীপ্ত হন। ৮৬
সেই সমস্ত সূৰ্য্য, রশ্মি দ্বারা সমস্ত ভুবনমণ্ডল দাহ করেন; তাহাতে স্বর্গ মর্ত্য স্বেদহীন এবং অতিশয় উষ্ণভাবাপন্ন হইয়া থাকে। ৮৭
অনন্তর সকল স্থাবর জঙ্গম বিনষ্ট হইলে, রুদ্ররূপী জনার্দন, সূর্য-রশ্মি হইতে নিঃসৃত হইয়া প্রথমে পাতালে, পরে অতলে গমন করেন। ৮৮-৮৯
অনন্তর তিনি, প্রধান শূল ধারণপূর্বক সপ্তপাতালস্থিত সমুদায় দেব, ঋষি, নাগ, গন্ধৰ্ব্ব ও রাক্ষসদিগকে নিহত করেন। ৯০
এইরূপে সেই লোক-সংহারক রুদ্র, স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল এবং সমুদ্রবাসী সকল প্রাণীদিগকে বধ করেন। ৯১
অনন্তর রুদ্র, স্বয়ং মুখমণ্ডল হইতে মহাবায়ু সৃষ্টি করেন, সেই অব্যাহত গতি বায়ু শত বৎসর যাবৎ ভুবনমধ্যে পরিভ্রমণ করত যাহা কিছু ছিল, তৎসমস্তই তৃণরাশির ন্যায় উৎসাদিত করিয়া থাকে। ৯২-৯৩
অতি বেগশালী সেই বায়ু জগতের সমস্ত বস্তু চারিদিক হইতে উৎসারিত করত দ্বাদশ সূৰ্যে প্রবিষ্ট হয়। ৯৪
রুদ্রপ্রেরিত বায়ু তেজোরাশি-সহ দ্বাদশ-সূর্যমণ্ডলে প্রবিষ্ট হইয়া সুবিশাল জলদাবলী সঞ্চার করিয়া দিতে আরম্ভ করে। ৯৫
তখন অতি-বেগ-সম্পন্ন বায়ু এবং অতি রৌদ্ররূপী ‘রুদ্র’ কর্তৃক প্রেরিত জলদাবলী গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন করে। ৯৬
দলিতাঞ্জন-পুঞ্জসন্নিভ, ধুম্রবর্ণ, রক্তবর্ণ, শুক্লবর্ণ, নীলবর্ণ, বকসন্নিভ, পৰ্বতাকার, কুঞ্জরাকার, প্রাসাদ-সদৃশ ভীষণ ভীষণ সেই সকল মহা-ঘন-ঘটা ত্রিলোক প্লাবিত করত মহাশব্দে শতবর্ষেরও অধিককাল বৃষ্টি করিয়া থাকে। ৯৭-৯৯
তাহাদিগের স্তম্ভসদৃশ স্থূল ধারাপাতে ত্রিভুবন পূর্ণ হইয়া যায়। ১০০
ধ্রুবলোক হইতে সমস্ত স্থান জল-প্লাবিত হইলে রুদ্ররূপী জনার্দন, নিজ মুখ হইতে পুনরায় বায়ু সৃজন করিলেন। ১০১
সেই মেঘমালা অব্যাহতগতি প্রবল-বায়ুবেগে শতবৎসর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইয়া ক্রমে বিনষ্ট হইয়া যায়। ১০১
মেঘ সকল বিনষ্ট হইলে, রুদ্র ব্রহ্মলোক জনলোকাদি সমস্তই নির্দয়ভাবে সংহার করেন। ১০৩
সমস্ত জগৎ বিশেষতঃ ব্রহ্মলোক বিনষ্ট হইলে রুদ্র, দ্বাদশসূৰ্য্য সন্নিধানে উপস্থিত হন। ১০৪
সংহারকর্তা রুদ্রদেব, মহাবেগে তথায় উপস্থিত হইয়া দ্বাদশ সূৰ্য্যকে গ্রাস করেন; দিবাকরগণ উদরস্থ হইলে তাহার প্রোজ্জ্বলতা সাতিশয় বৃদ্ধি পায়। ১০৫
কালান্তক-যমোপম মহাবল রুদ্র, মুষ্টিপেষণে সমস্ত ব্ৰহ্মাণ্ড চূর্ণীকৃত ও পৃথিবী চূর্ণীকৃত হয়। ১০৬
তখন, হরি, সমস্ত জলরাশি যোগবলে ধারণ করেন। সুতরাং ব্রহ্মাণ্ডের বাহ্যস্থিত অভ্যন্তরস্থিত সমুদয় জলই তখন মিলিত হইয়া থাকে। ১০৭
ব্ৰহ্মাণ্ড-খণ্ড চূর্ণ ও চূর্ণিত পৃথিবীর অংশ সেই একীভূত সৰ্বব্যাপী জল, রাশির উপর নৌকার মত ভাসিতে থাকে। ১০৯
অনন্তর জল, পৃথিবীর সারভাগ–সমুদায় গন্ধতন্মাত্ৰ ক্ৰমে ক্ৰমে গ্রহণ করে তাহাতেই পৃথিবী বিনষ্ট হয়। ১১০
অনন্তর সেই ভয়ঙ্কর রুদ্র, নিজগর্ভস্থ পুঞ্জীভূত তেজরাশিকে পুনরায় নিঃসারিত করেন। ১১১
ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরে বাহিরে যেখানে যতটুকু তেজ থাকে, তৎসমস্তই সেই তেজোরাশির সহিত মিলিত হইয়া পড়ে। ১১২
জগতের সমস্ত তেজ গ্রহণে উজ্জ্বল একীভূত তেজোরাশি ব্রহ্মাণ্ডখণ্ড চূর্ণ ও দগ্ধ করিয়া আরও উজ্জ্বলিত হইয়া থাকে। ১১৩
অনন্তর সেই তেজ জলের সার রসতন্মাত্র গ্রহণ করিলে, তেজঃপ্রভাবে জল রাশি বিনষ্ট হয়। ১১৪
জল বিনষ্ট হইলে, একীভূত মহাবেগসম্পন্ন সকল বায়ু তেজোমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া রূপতন্মাত্র গ্রহণ করে। ১১৫
রূপতন্মাত্র গৃহীত হইলে, সমুদায় তেজ বিনষ্ট হয়; অনন্তর বায়ু, অবারিত ভাবে প্রবল হয়। ১১৬
রুদ্র, ঘোরনিস্বন প্রভঞ্জন বহিতেছে দেখিয়া স্বয়ং আকাশ-মণ্ডলকে বিক্ষোভিত করেন। ১১৭
আকাশ তাহাতে সংক্ষুব্ধ হইয়া পবনের স্পৰ্শতন্মাত্র গ্রহণ করে, তাহাতেই পবন বিনষ্ট হয়। ১১৮
বায়ু নষ্ট হইলে রুদ্র, আকাশের সার শব্দতন্মাত্র গ্রহণ করিলে আকাশ বিনষ্ট হয়; তখন রুদ্র, ব্রহ্মার দেহে বিলীন হন। ১১৯
তখন, ব্ৰহ্ম শরীর নিরাধার এবং অত্যন্ত আকুল হইয়া শঙ্খ-চক্র-গদা-শাঙ্গ ও উত্তম-খড়্গ-সম্পন্ন পাঞ্চভৌতিক চিরন্তর নিজ দেহ হইতে সৰ্ব্বতোভাবে সার গ্রহণ পূর্বক স্বীয় শক্তি দ্বারা অতি শীঘ্র সংহার করেন। ১২০-১২২
তখন তিনি নিরাধার নিরাকার নির্বিকার নিঃসত্ব, বিশেষণ-বর্জিত ন-স্থূল, ন-সূক্ষ্ম, নির্লেপ “একমেবাদ্বিতীয়ং” সচ্চিদানন্দ স্বপ্ৰকাশ সৰ্বব্যাপী পরম ব্রহ্মরূপে বর্তমান থাকেন। ১২৩-১২৪
তখন দিবা-রাত্রি থাকে না আকাশ পৃথিবী থাকে না, জ্যোতি-অন্ধকার–বা আর কিছুই থাকে না। তখন, শ্রবণাদি-ইন্দ্রিয়ে অতীত বুদ্ধির অগোচর প্রকৃতি জড়িত ব্ৰহ্ম-পুরুষ বর্তমান থাকেন। ১২৫
সৃষ্টি যতকাল থাকে, ততকাল অর্থাৎ ব্রহ্মার শতবর্ষ, এক পরমতত্ত্ব ব্ৰহ্মও সৃষ্টিহীন অবস্থাতে বর্তমান থাকেন, অনন্তর সৃষ্টি প্রবৃত্তি হয়। ১২৬
তন্মাত্রগণ অহঙ্কার এবং মহতত্ত্ব, সকলই–এমন কি, অন্যান্য প্রলয়ে স্থায়ী এই সকল ব্যক্ত পদার্থ তখন প্রকৃতিরূপে পর্যবসিত হয় বলিয়া ইহার নাম প্রকৃত প্রলয়। ১২৭-১২৮
বিপ্রগণ! এই আমি তোমাদিগকে প্রাকৃত মহাপ্রলয় কীৰ্ত্তন করিলাম, এই আদি-সৃষ্টির বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি শ্রবণ কর। ১২৯
চতুর্বিংশ অধ্যায় সমাপ্ত ॥ ২৪