চব্বিশ
শহরের কয়েকটা রাস্তায় পাক দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটা চলে এসেছিল নির্জন এলাকায় যেখানে সাধারণত ধনী সম্প্রদায়েরা বাস করে থাকেন। বিশাল বাগান পেরিয়ে একটা প্রাচীন বাড়ির সিঁড়ির সামনে অ্যাম্বুলেন্স থামতেই কয়েকজন নেমে এল দৌড়ে, তাদের পেছনে হায়দার। খুব যত্নের সঙ্গে আকাশলালের শরীরকে স্ট্রেচারে শুইয়ে নামানো হল, নিয়ে যাওয়া হল বাড়িটির ভেতরে। ত্রিভুবনরা ভেতরে ঢুকতেই বড় কাঠের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আর অ্যাম্বুলেন্স অত্যন্ত নিরীহ ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল রাস্তায়, বাগান পেরিয়ে।
এই বাড়ির একটি বিশেষ কক্ষকে অপারেশন থিয়েটারে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বৃদ্ধ ডাক্তার অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন, তাঁকে সাহায্য করতে যে-কজন মানুষ সেখানে ছিল তাদের চেহারা বেশ কৃশ। বোঝাই যায় বেশ চাপের মধ্যে আছে তারা। অপারেশন থিয়েটারের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে হায়দার সেখানে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথাও কোনও অসুবিধে হয়নি তো?’
ত্রিভুবন জবাব দিল, ‘না। তবে ডেভিড মনে হয় একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিল।’
‘তার মানে?’
‘সে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ চালাতে অনর্থক দেরি করেছে। তাকে বারংবার মনে করিয়ে দিতে হচ্ছিল যে আমাদের হাতে সময় খুব অল্প আছে।’ ত্রিভুবন জানাল।
‘তোমরা ওখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় কোনও গোলমালের আওয়াজ পেয়েছ?’
‘না। আমরা চলে আসার মুখে ডেভিড আবার সুড়ঙ্গে ফিরে গিয়েছিল মাটি দিয়ে ভরাট করার কাজে। আমরা বিনা বাধায় রাস্তা পেরিয়ে এসেছি।’ ত্রিভুবন জানাল।
‘আশা করছি কেউ এই অ্যাম্বুলেন্সটার কথা পুলিশকে জানাবে না।’ হায়দার যেন নিজের মনেই কথাগুলো বলল। ত্রিভুবনের সন্দেহ হল, ‘কেন? কোনও ঘটনা ঘটেছে নাকি?’
‘হ্যাঁ। ডেভিড এবং তার সঙ্গীরা সুড়ঙ্গের মধ্যে আটকে পড়েছে।’
‘কি করে?’ চমকে উঠল ত্রিভুবন।
‘বিস্তারিত খবর আমি এখনও পাইনি। তবে কবরটা খুঁড়ে ফেলা হচ্ছে এবং পুলিশ মাটি ভর্তি বাড়িটাকেও আবিষ্কার করেছে। অনুমান করছি ডেভিড তার সঙ্গীদের নিয়ে ওই সুড়ঙ্গেই আটকে আছে। যদি ও সারেণ্ডার না করে তাহলে ভার্গিস ওকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেবে।’ হায়দার বলল।
‘ডেভিড সারেণ্ডার করবে?’ ত্রিভুবন বিশ্বাস করতে পারছিল না।
‘এছাড়া ওর সামনে কোনও পথ নেই।’ হায়দার চোখ বন্ধ করল, ভার্গিসের হাতে ও যদি একবার পড়ে তাহলে সে ওর মুখ খুলিয়ে ছাড়বেই। অপারেশনের জন্যে যা যা দরকার তুমি দায়িত্ব নিয়ে করো। আমি ওদিকের খবর নিচ্ছি।’
ত্রিভুবনের কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘যদি ডেভিড ধরা পড়ে তাহলে আমাদের এখনই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।’
‘ঠিকই।’ হায়দার মাথা নাড়ল, ‘কিন্তু ও যাতে ধরা না পড়ে তার ব্যবস্থা করছি।’
এলাকাটা এখন পুলিশের হাতে। কারফিউ যদিও চলছিল তবু পুলিশ মাইকে শেষ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে জনসাধারণের উদ্দেশে, ‘সামান্য কৌতূহল দেখাবেন না কেউ। রাষ্ট্রের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক কিছু মানুষকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা হচ্ছে। আপনারা নিজেদের বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ করে রাখুন।’ অস্ত্রধারীদের সংখ্যা বেড়ে গেছে রাস্তায়। এলাকার সমস্ত বাড়ি তাই শব্দহীন।
ভার্গিস কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কবরের মাটি অনেকটা নীচে বসে গিয়েছে। কারখানার কর্মচারীরা পেছনে সারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। তারা প্রত্যেকেই হলফ করে বলেছে ওখানকার মাটির নীচে গর্ত ছিল না। এই কবরখানায় কখনও এমন কাণ্ড হয়নি। ভার্গিস এখানে আসার আগেই অবশ্য একজন পুলিশ অফিসার জানতে পারে খানিক আগে একটি অ্যাম্বুলেন্স রাস্তার উল্টোদিকের গলি থেকে বেরিয়ে কোথাও চলে গিয়েছে। গলির ভেতরের কয়েকটা বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে কেউ অসুস্থ হয়নি। অ্যাম্বুলেন্সটিকে খুঁজে বের করার জন্যে ওয়ারলেসে খবর পাঠানো হয়েছে চারধারে।
একজন অফিসার ছুটে এল ভার্গিসের কাছে। স্যালুট করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার, ওই বাড়ির একটা ঘর থেকে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল। সুড়ঙ্গের মুখটাকে আমরা আবিষ্কার করেছি।’
‘হুম্। সুড়ঙ্গের মুখটাকে সিল করে দাও।’
‘আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমরা সুড়ঙ্গের মধ্যে নামতে পারি!’ উত্তেজিত অফিসারটি প্রস্তাব দিল সোৎসাহে।
ভার্গিস তাকে দেখলেন, ‘হামাগুড়ি দেবার ইচ্ছে হলে বাড়ি ফিরে বউয়ের সামনে দিয়ো। যা বলছি তাই করো। গেট আউট।’
‘ইয়েস স্যার।’ অফিসার স্যালুট সেরে আবার ছুটে গেল।
ভার্গিস অন্য পুলিশদের হুকুম দিলেন কবর খুঁড়তে। বলে দিলেন কফিন পাওয়ামাত্র সবাই যেন সতর্ক হয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করে।
কোদাল বসতে লাগল মাটিতে। দেখা গেল খুব বেশি জায়গা জুড়ে গর্তটা তৈরি হয়নি। মাটি উঠছে সহজেই। কবর খোঁড়ার সময় যেটুকু গর্ত খুঁড়তে হয়েছিল ঠিক ততটুকু জায়গার মাটিতে ধস নেমেছিল।
ভার্গিস উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওদের মতলব ছিল আকাশলালের মৃতদেহ কবর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু কেন? মৃতদেহটিকে পূর্ণ মর্যাদায় সমাধি দেওয়ার জন্যে? এখন এই পরিস্থিতিতে সেটা ওরা করতেই পারত না। তাহলে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্যে সুড়ঙ্গ খুঁড়বে কেন?
তারপরেই তাঁর মনে হল সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কি দরকার ছিল? আজ রাত্রে কবরখানায় এসে ওরা এখান থেকেই কফিনটাকে তুলে নিতে পারত। রাস্তার ওপার থেকে মাটির নীচে দিয়ে সুড়ঙ্গ একদিনে খোঁড়া সম্ভব নয়। ওরা যখন সেটা করার চেষ্টা করছে তখন পরিকল্পনা অনেকদিনের। আকাশলাল মারা গিয়েছে গতকাল। তার কবরের কাছে মাটির নীচে দিয়ে পৌঁছবার জন্যে ওরা দীর্ঘদিন ধরে সুড়ঙ্গ খুঁড়বে কেন? ওরা কি জানত গতকাল লোকটা মারা যাবে এবং এখানেই কবর দেওয়া হবে? তাহলে এই মৃত্যু সাজানো। ভার্গিস আচমকা চিৎকার করে উঠলেন। এবং তখনই খননকারীরা জানাল, নীচে কোনও কফিন নেই, তার বদলে একটা সুড়ঙ্গের মুখ দেখা যাচ্ছে। .
নিয়ে গিয়েছে। বডি নিয়ে গিয়েছে ওই অ্যাম্বুলেন্সে! রাগে অপমানে এবং হতাশায় ভার্গিসের মুখটা বুলডগের মত হয়ে গেল। তিনি হুকুম দিলেন সুড়ঙ্গের মধ্যে কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে। যদি কেউ এখনও ওখানে থাকে, তাকে বের করে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবেন তিনি।
সঙ্গে সঙ্গে সেলগুলি ছোঁড়া হল। ধোঁয়া বাইরে বেরিয়ে আসছে দেখে সরে এলেন ভার্গিস। একজন অফিসার বলল, ‘স্যার, রাস্তার পাইপ থেকে কানেকশন নিয়ে সুড়ঙ্গটা জলে ভরে দেব?’
ভার্গিস মাথা নাড়লেন, ‘তাতে সোনার চাঁদ তুমি কি পাবে? ভেতরে কেউ থাকলে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে? সেই ডেডবডি তোমার কোনও প্রশ্নের জবাব দেবে? আমি জ্যান্ত চাই লোকগুলোকে। মাস্ক পরে শেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগোও। ওরা বাধ্য হবে উল্টো দিক থেকে বেরিয়ে আসতে। কাজটা ওই দিক দিয়ে শুরু করো, আমরা এখানে ওদের অভ্যর্থনা জানাব।’
মিনিট তিনেকের মধ্যে আর্তনাদ শোনা গেল। এক একটা মাথা কবরের গর্তে বেরিয়ে আসামাত্র রাইফেলের বাঁটের আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। তাদের টেনে ওপরে তোলা হচ্ছে। শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে পাশাপাশি। যখন নিঃসন্দেহ হওয়া গেল আর কেউ নীচে নেই, যখন শূন্য কফিনটাকেও ওপরে নিয়ে আসা হয়েছে তখন ভার্গিস লোকগুলোর সামনে পিয়ে দাঁড়ালেন। বেশির ভাগ মানুষ তাঁর পরিচিত নয়, শুধু একজনকে তিনি এদের মধ্যে দেখতে পাবেন আশা করেননি। ডেভিড। এই হতচ্ছাড়া আকাশলালের সাকরেদ ছিল। নিশ্চয়ই ডেডবডি সরাবার দায়িত্ব নিয়েছিল লোকটা। কিন্তু কেন? অঘাত পেয়ে ওর মাথার পাশ দিয়ে রক্ত ঝরছে। চোখ বন্ধ কিন্তু মরে যাওয়ার মতো আহত হয়নি।
ভার্গিস বললেন, ‘একে আমার চাই। ডাক্তারকে বলো আধঘণ্টার মধ্যে একে কথা বলার মতো অবস্থায় এনে দিতে। বি কুইক।’
সঙ্গে সঙ্গে ডেভিডের জ্ঞানহীন শরীরটাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল বাইরে অপেক্ষমাণ একটি জিপের কাছে। ঝকিদের পাইকারি হারে তোলা হতে লাগল ভ্যানে।
আধঘণ্টার চার মিনিট পরে ডেভিডকে হাজির করা হল ভার্গিসের চেম্বারে। সে যে এখনও সুস্থ নয় তার মুখচোখ এবং হাঁটার ভঙ্গি বলে দিচ্ছিল।
ভার্গিস বসে ছিলেন বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে। তাঁর হাতের চুরুট আপনাআপনি জ্বলে যাচ্ছিল। গত মিনিট দশেক তাঁকে একটার পর একটা কৈফিয়ত দিতে হয়েছে মিনিস্টারের কাছে। লোকটা আজ তাঁর সঙ্গে শকুনের মতো ব্যবহার করছে। আকাশলালের মৃতদেহ খুঁজে বের করতে বারোটা ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছে তাঁকে। ফোন রেখেই ভার্গিস ম্যাডামকে টেলিফোনে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। ফোন বেজে গিয়েছে, ম্যাডাম বাড়িতে নেই। মিনিস্টারের চেয়ারটা তাঁর খুব কাছে চলে এসেছিল। হাত বাড়ালেই যেন ছুঁতে পারতেন। আকাশলাল মরে গিয়ে সেটাকে অনেক দূরে সরিয়ে দিল। এখন ওর ডেডবডি খুঁজে না পাওয়া গেলে— একমাত্র ম্যাডামই তাঁকে বাঁচাতে পারেন বলে ভার্গিসের বিশ্বাস। হঠাৎ ডেভিডের দিকে তাকিয়ে ওঁর মনে হল, এই লোকটাও পারে, এ যদি আকাশলালের হদিশ তাকে দিয়ে দেয় তাহলে তিনি লড়তে পারবেন।
ভার্গিস চোখ বন্ধ করলেন। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। তারপর হাসলেন, ‘আমি যদি ঘটনাস্থলে না থাকতাম তাহলে এতক্ষণে আপনার কবরের ব্যবস্থা করতে হত। আমার লোকগুলোর মাথা এত মোটা যে কি বলব! ওরা সুড়ঙ্গের ভেতরে জল ঢুকিয়ে আপনাদের ডুবিয়ে মারার পরিকল্পনা করেছিল। আপনি ভাগ্যবান।’
ডেভিডের মাথা ঝিমঝিম করছিল, শরীর গোলাচ্ছিল। পুলিশ কমিশনার ভার্গিসকে চিনতে তার কোনও অসুবিধে হয়নি। এই লোকটার মুখে হাসি কেন?
‘আমার পরিচয়টা আপনাকে দেওয়া হয়নি। আমি ভার্গিস।’
ডেভিড চুপ করে থাকল। ওরা এখন কি করছে? ত্রিভুবন কি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফিরে যেতে পেরেছে। ওই কবরটা যদি ধসে না পড়ত!
‘মিস্টার ডেভিড! আমি চাই আপনি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন। আমাদের খাতায় আপনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে সেগুলোও আমি ভুলে যেতে চাই। কিন্তু আমি চাইলেই তো সেটা সম্ভব হবে না, আপনাকেও সেটা চাইতে হবে। এখন বলুন, সেটা আপনি কি চান?’ ভার্গিস বেল টিপলেন।
ডেভিড চেয়ারে ধীরে ধীরে মাথা রাখল। তার মাথার অনেকখানি এখন ব্যাণ্ডেজের আড়ালে। মাথার ভেতরটা টনটন করে উঠল। ভার্গিস কি চাইছে?
একজন বেয়ারা ঢুকল, ঢুকে স্যালুট করল। ভার্গিস বললেন, ‘দুটো কফি!’ লোকটা মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল। ভার্গিস একটা ফাইল টেনে নিয়ে মন দিয়ে কাগজপত্র দেখতে লাগলেন। তিনি যে ডেভিডকে প্রশ্ন করেছেন, উত্তরের অপেক্ষা করছেন সে-ব্যাপারে কোনও আগ্রহ এই মুহূর্তে তাঁর আছে বলে মনে হল না।
ডেভিড উশখুশ করতে লাগল। শেষপর্যন্ত, জিজ্ঞাসা না করে পারল না, ‘আপনি কি চান?’ ফাইল থেকে মুখ তুললেন না ভার্গিস। ‘আগে কফি খান তারপর কথা।’
ডেভিড ঘরটি দেখল। এই ঘরের কথা সে আগেই শুনেছে। হেডকোয়ার্টার্সের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা এটি। এখন আর কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। সুড়ঙ্গের মধ্যে যখন বুঝতে পেরেছিল তারা ধরা পড়ে গিয়েছে তখন মনে হয়েছিল আত্মহত্যা করার কথা। ধরা পড়ে ওদের হাতে গেলে কি ঘটতে পারে তা তার অজানা নয়। তবু মনে হয়েছিল বন্ধুরা হয়তো শেষ মুহূর্তে একটা চেষ্টা করতে পারে যা থেকে বাঁচার উপায় হবে। তাছাড়া আজ সুড়ঙ্গের মধ্যে শুয়ে নিজেকে খুন করতে তার ভারী মায়া লেগেছিল। এখন পুলিশ কমিশনার তার সঙ্গে যে ব্যবহার করছে তা সে মোটেই আশা করেনি। লোকটার এত ভদ্রতা যে নিছকই মুখোশ তা না বোঝার মতো মূর্খ সে নয়। কিন্তু কেন করছে লোকটা?
কাফ এল। ডেভিডের সামনে কাপডিস রাখা হলে ভার্গিস বললেন, ‘নিন, খেয়ে দেখুন। এরকম কফি শহরের কোথাও পাবেন না। আচ্ছা, আপনি কখনও কোনও কফির বাগানে গিয়েছেন? এক্সপেরিয়েন্স আছে?’
‘না।’ বলল ডেভিড।
‘আমিও যাইনি। নিন, কাপ তুলুন।’
ডেভিড কফির কাপে চুমুক দিতেই একটা মোলায়েম আরাম টের পেল। শরীরের এই চাহিদাটার কথা যেন ভার্গিস জানত। কফি খেতে খেতে সে যতবারই চোখ তুলেছে ততবারই দেখেছে ভার্গিস তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোনও কথা বলছে না লোকটা। সে পেয়ালা শেষ করে বলল, ‘ধন্যবাদ।’
‘শব্দটা আমি উচ্চারণ করতে পারলে খুশি হব।’
‘তার মানে?’
‘আপনাকে আমি একটি প্রশ্ন করেছিলাম। আপনি দীর্ঘজীবন চান কি না?’
‘কে না চায়!’
‘আপনি?’
‘হ্যাঁ, আমিও।’
‘ধন্যবাদ মিস্টার ডেভিড।’ ভার্গিস সামান্য ঝুঁকলেন, ‘কিন্তু আপনাকে আমি এই রাজ্যে থাকতে দিতে পারছি না। আমার লোক আপনাকে সীমান্তে ছেড়ে দিয়ে আসবে। সেখান থেকে আপনি ইন্ডিয়ার যে কোনও বড় শহরে চলে যেতে পারেন। আমরা যদি না চাই তাহলে ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট আপনাকে কখনও বিরক্ত করবেন না। আপনি দীর্ঘ জীবন সেখানেই বাস করতে পারবেন। আপনার বয়স বেশি নয়, বিয়ে থা করে সংসারী হবার সময় এখনও আছে।
ডেভিড ঠোঁট কামড়াল।
ভার্গিস বললেন, ‘এ সবই সম্ভব হবে যদি আপনি আমার সঙ্গে হাত মেলান। আমি আপনাকে ছোট ছোট কয়েকটা প্রশ্ন করব, আপনি তার ঠিকঠাক জবাব দেবেন। ব্যস, আমার কথা আমি রাখব।’
‘আপনি কি প্রশ্ন করবেন?’
‘গুড। প্রথম প্রশ্ন, সুড়ঙ্গটা কেন খুঁড়েছিলেন?’
‘সেটা বুঝতে কি এখনও আপনার অসুবিধে হচ্ছে?’
ভার্গিস থমকে গেলেন। নিজেকে সামলালেন, ‘প্রশ্ন আমি করব, আপনি নন।’
ডেভিস হঠাৎ সাহসী হল, ‘আরে! সুড়ঙ্গ খুঁড়ে কবরের কাছে কেন পৌঁছেছিলাম সেটা কি বুঝতে কারও অসুবিধে হয়েছে? যে কেউ বুঝবে।’
আমি নির্বোধ তাই বুঝিনি। ঠিক আছে, আরও আগে থেকে প্রশ্ন করছি। ওই সুড়ঙ্গ খোঁড়া শুরু হয় কবে থেকে?’ চুরুট নামিয়ে রাখলেন ভাসি অ্যাসট্রের কানায়।
ডেভিডের শরীর শিরশির করে উঠল। এইবার ভার্গিস জাল গোটাতে শুরু করেছে। হয় তাকে সব কথা বলে দিতে হবে নয়—! জ্ঞান ফিরে আসার পরই মনে হয়েছিল তার ওপর অত্যাচারের বন্যা বইবে। এখনও সেটা হয়নি কারণ ভার্গিস তাকে বিশ্বাসঘাতক হবার সুযোগ দিচ্ছে। যে মুহূর্তে লোকটা বুঝবে মিষ্টি কথায় কাজ হবে না, তখনই নির্মম হয়ে উঠবে। ও ইচ্ছে করলে তাকে সারাজীবন জেলে পচিয়ে মেরে ফেলতে পারে, ফাঁসিতে ঝোলাতে একটুও সময় নেবে না। সে কি করবে? আধা সত্যি বলে সময় নেবে? সময় নিয়েই বা কি হবে? আধা সত্যি ধরা পড়ামাত্র ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। কি করা উচিত। একজন বিপ্লবীর এই অবস্থায় অত্যাচার সহ্য করে মারা যাওয়াটাই নিয়ম। ডেভিড দেখল ভার্গিস তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সে জবাব দিল, ‘কয়েকদিন হল।’
‘কয়েকদিন। তার মানে আকাশমাল ধরা পড়ার আগেই। তাই তো?’
‘সেরকমই দাঁড়ায়।’
‘মিস্টার ডেভিড, আমি বাঁকা কথা একদম পছন্দ করি না। আর আমার পছন্দের ওপর আপনার ইন্ডিয়ায় যাওয়া নির্ভর করছে। হ্যাঁ, আকাশলাল মারা যাওয়ার আগেই, অর্থাৎ সে যখন আপনাদের সঙ্গে ছিল তখনই ওই সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল। আপনারা কি করে জানতেন যে সে মারা যাবে; তার ডেডবডি কবর থেকে বের করতে হবে?’
‘আকাশলালই ব্যাপারটার পরিকল্পনা করেছিল।’
‘আপনারা কারণ জানতে চাননি?’
‘তার ধারণা ছিল আপনারা ওকে মেরে ফেলবেন।’
ভার্গিস হাসলেন। ‘লোকটাকে নির্বোধ ভাবার মতো নিবোধ আমি নই। আকাশলাল নিশ্চয়ই জানত আমরা ওর বিচার করব। বিচারটা সাতদিনেও শেষ হতে পারে, সাতমাসও লাগতে পারে। বিচারের শেষে হয়তো ওর মৃত্যুদণ্ড হত। কিন্তু ততদিন ধরে একটা চওড়া রাজপথের নীচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রাখার বোকামি সে করত না। সে মারা গেলে কবরের মাটি তোলার সময়েই তো ওই সুড়ঙ্গটাকে আমার পেয়ে যেতে পারতাম। না মিস্টার ডেভিড, আপনার এই মিথ্যাভাষণ আমার পছন্দ হচ্ছে না। আপনি সত্যি কথা বলুন।’
‘আমাকে হুকুম দেওয়া হয়েছে, আমি আদেশ পালন করেছি মাত্র।’
‘তার মানে আপনিও জানতেন না আকাশলাল ধরা পড়ার কিছু সময় পরেই মারা যাবে। খুব ভাল কথা। আকাশলালের মৃতদেহটা কোথায় পাঠিয়েছেন?’
মাথা নাড়ল ডেভিড, ‘সেটা আমার জানা নেই।’
ভার্গিসের মুখটা যেন আরও বড় হয়ে গেল, ‘আমার ধৈর্য বড় কম। একবার আপনার শরীরে হাত দিলে এতক্ষণ যে প্রস্তাব দিয়েছি তা আর মনে রাখা দরকার বলে ভাবব না।’
‘আপনি আমাকে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বলছেন।’
‘বিশ্বাসঘাতকতা? কার বিরুদ্ধে? নিজের দেশকে বিপন্ন করে বাইরের শক্তির সঙ্গে হাত মেলানো বিশ্বাসঘাতকতা নয়?’ ভার্গিস হাত নাড়লেন, নেমে এলেন আপনি থেকে তুমিতে, ‘তোমার সঙ্গে এসব আলোচনা করে সময় নষ্ট করব না। আকাশলাল মরেছে কিন্তু কিছু রহস্য রেখে গেছে। বাকি যারা আছে তাদের খুঁজে বের করতে আমার বেশি সময় লাগবে না। এই যে তুমি, তোমাকে আমি সুড়ঙ্গের মধ্যেই মেরে ফেলতে পারতাম। মারিনি কিন্তু তার জন্যে কৃতজ্ঞতাবোধও তোমার নেই।’
ডেভিডকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। শেষপর্যন্ত সে মাথা নাড়ল, ‘আমি জানি না।’
ভার্গিস আর সময় নষ্ট করলেন না। হেডকোয়ার্টার্সের সবচেয়ে নির্মম পুলিশ অফিসারকে ডেকে পাঠালেন তিনি ফোন তুলে। নামটা কানে যাওয়ামাত্র কেঁপে উঠল ডেভিড। এর কথা সে অনেকবার শুনেছে। কয়েদিদের ওপর অত্যাচার করার ব্যাপারে এর কোনও জুড়ি নেই। আজ পর্যন্ত মুখ খোলানোর কাজে লোকটা কখনওই বিফল হয়নি। কিন্তু ওদের দুর্ভাগ্য যাদের ধরেছিল তারা দলের খুব সামান্য খবরই জানত।
ডেভিড সোজা হয়ে বসল, ‘আপনি আর একটা ভুল করছেন!’
ভার্গিস কথা না বলে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন।
‘আমি যদি মুখ খুলতে না চাই তাহলে আমার মৃতদেহকে দিয়ে আপনাকে কথা বলাতে হবে। সেটা পারবেন কি না জানি না।’ ডেভিড হাসার চেষ্টা করল।
‘তুমি বেঁচে আছ না মরে গেছ তা নিয়ে আর আমার ভাবনা নেই। মরেই যদি যাবে তাহলে তার আগে আমার লোক শেষ চেষ্টা করুক।’ নির্লিপ্ত গলায় বললেন ভার্গিস, আমি এত কথা কারও সঙ্গে বলি না। যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহার করেছি।’
দরজায় শব্দ হতেই ভার্গিস হাঁকলেন, ‘কাম.ইন।’
বেঁটেখাটো চেহারার, প্রায় নেংটি ইঁদুরের মতো একটি লোক ঘরে ঢুকে স্যালুট করল। ভার্গিস বললেন, ‘এই লোকটি মুখ খুলবে কি না জানতে তিনঘণ্টা সময় নেবে। যদি প্রথম আড়াই ঘণ্টায় মুখ না খোলে তাহলে শেষ আধঘণ্টা তোমাকে দিলাম। ডেডবডি পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়া হবে।’
বেল টিপলেন ভার্গিস। বেয়ারা ঘরে ঢোকামাত্র ইশারায় ডেভিডকে নিয়ে যেতে বললেন তিনি। বেঁটে লোকটি দ্বিতীয়বার স্যালুট করামাত্রই টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই ম্যাডামের গলা শুনতে পেয়ে সোজা হয়ে বসলেন ভার্গিস, ‘ইয়েস ম্যাডাম।’
‘আপনি একটার পর একটা ভুল করছেন।’
‘আমি ঠিক, আসলে ডেডবডির জন্যে ওরা এমন কাজ করবে— ।’ বিড় বিড় করলেন ভার্গিস।
‘ডেডবড়ি কোথায়?’
‘এখনই বের করে ফেলব। আকাশলালের ডান হাত ডেভিডকে আমি ধরেছি। সোজা কথায় কাজ না হওয়ায় টর্চার সেলে পাঠাচ্ছি। ও মুখ খুলবেই।’
‘আর একটা ভুল করতে যাচ্ছেন। টর্চার করে কোনও লাভ হবে না। কথা বের করতে হলে অন্য উপায় খুঁজতে হবে। অবশ্য আপনার যা ইচ্ছে— ।’
‘না ম্যাডাম। আমার মনে হচ্ছে আপনিই ঠিক।’
‘তাহলে ওকে বসন্তলালের বাংলোয় নিয়ে আসুন। ব্যাপারটা যত কম জানাজানি হয় তত ভাল। মিনিস্টার তো আপনাকে আলটিমেটাম দিয়ে দিয়েছেন।’
‘হ্যাঁ ম্যাডাম।’
লাইন কেটে যেতেই ভার্গিস চিৎকার করলেন, ‘হেই দাঁড়াও।’
ওরা তখন ডেভিডকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল বাইরে। ভার্গিসের চিৎকার শুনে হকচকিয়ে গেল। ভার্গিস গলা নামালেন, ‘যে যার ডিউটিতে চলে যাও। এভরিবডি। ওকে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। গেট আউট।’
বিস্মিত লোকগুলো এবং বেঁটে মানুষটা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাওয়ার পর ভার্গিস ডেভিডকে চেয়ারটা দেখিয়ে দিল, ‘দয়া করে হেঁটে এসে ওখানে বোসো। তোমার জীবনের আয়ু আমি আর একটু বাড়িয়ে দিলাম।’