লক্ষ্ণৌ নগরী আবার ইংরেজমুক্ত। দিল্লিতে স্বাধীন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর প্রতিদিন কোলাহলমুখর দরবারে বসছেন এবং এখন সত্যিকারের ফরমান জারি করছেন। সারা উত্তর ভারত জুড়ে চলছে হানাহানি, কাটাকাটি। বিদ্রোহী সিপাহীরা যে ঠিক কতখানি এলাকা দখল করেছে কিংবা ইংরেজ বাহিনী কত জায়গায় পরাজিত হয়েছে বা কোন কোন শহর পুনর্দখল করতে পেরেছে, তা সঠিকভাবে জানিবার উপায় নেই। ঘটনার চেয়ে রটনার রূপ অনেক বেশী বিচিত্র এবং গতিবেগও প্রচণ্ড।
ইংরেজরা যাকে সিপাহী বিদ্রোহ নাম দিয়েছে, ইতিমধ্যে পৃথিবীর অনেকের কাছে তা বিপ্লব বলে প্রতিভাত হচ্ছে। নিষ্পন্দ, ঘুমন্ত, অতিকায় ভারত বুঝি জেগে উঠলো। এইবার। ভারতীয় বিপ্লবের ফলাফলের ওপরেই নির্ভর করছে এশিয়ায় ইওরোপীয় উপনিবেশগুলির ভবিষ্যৎ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্ৰান্তের মানবপ্ৰেমিক এবং বিপ্লববাদীরা প্ৰকাশ্যে সমর্থন ও অভিনন্দন জানাচ্ছেন ভারতীয় যোদ্ধাদের। কার্ল মার্কস্ নামে এক উনপঞ্চাশ বৎসর বয়স্ক ইহুদী দার্শনিক এবং সমাজতাত্ত্বিক অত্যন্ত উৎসাহিত ও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন ভারতের সিপাহী যুদ্ধের ঘটনায়। স্বদেশ থেকে নির্বাসিত এই দার্শনিকটি জীবিকার জন্য মাঝে মাঝে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের ডেইলি ট্রিবিউন পত্রিকায় প্ৰবন্ধ লেখেন। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর লেখনী যেমনই ক্ষুরধার, তার মতামতও সেরকমই সুচিন্তিত।। ভারতে না এসেও তিনি ভারত সম্পর্কে অনেকদিন ধরেই পড়াশুনো করছেন। তাঁর মতে, ইংরেজ যদিও জঘন্য, বর্বরোচিত স্বাৰ্থ নিয়েই ভারত শাসন ও শোষণ করতে এসেছে, তবু এই ইংরেজ শাসনের পরোক্ষ প্রভাবে ভারতের অনেক উন্নতি হয়েছে। ভারতের মৃতকল্প, গ্রামকেন্দ্রিক, সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এই উনবিংশ শতাব্দীর নতুন যুগে। ব্রিটিশের আনা বাষ্পযান, বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটিয়েছে ভারতীয় জীবনযাত্রায়। ইংরেজ বুর্জোয়া শিল্পপতিরা নিজেদের প্রয়োজনেই রেলপথ এবং নতুন নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ করছে, তার ফলে এক শিল্প প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে ভারতে। এর পর ভারতের জনগণ সবল হয়ে ইংরেজের শাসনযন্ত্রকে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলতে পারলেই পরিপূর্ণভাবে আসবে জনগণের মুক্তি। আর ভারত তথা এশিয়ায় সমাজ সংগঠনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এলে তবেই মানবজাতি পৌঁছোতে পারবে পরিপূর্ণ লক্ষ্যে।
কার্ল মার্কস ভাবলেন, ভারতে এই সেই মুক্তির সময়। সিপাহীদের সংগ্রাম সার্থক হবে। তিনি দারুণ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলেন যুদ্ধের অগ্ৰগতি। তিনি লিখলেন :
There cannot, however, remain any doubt but that the misery inflicted by the British on Hindusthan is of an essentially different and infinitely more intensive kind than all Hindusthan had to suffer before.
এত নিপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় এবার মুক্তি আসবেই।
মুঘল ভারতের রাজধানী দিল্লি এখন আবার মুঘল সম্রাটের অধিকারে। কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা কবে মুক্ত হবে? বাঙালীদের প্রতি সিপাহীদের কোনো আস্থা নেই। বাঙালীদের মধ্যে বিশেষত হিন্দুরা ইংরেজের তল্পিবাহক, তাই বাঙালীদের নাম শুনলেই সিপাহীদের নাসিকা কুঞ্চিত হয়। উত্তর ভারতে সিপাহীরা ইংরেজদের সঙ্গে সঙ্গে, দ্বিতীয় শ্রেণীর শোষণের প্রতিনিধি বাঙালী হাকিম-উকিল, ডাক্তার-মোক্তার-কেরানীদেরও পেটাবার জন্য ধাবিত হয়।
খিদিরপুরে জনাব আবদুল লতীফের বাড়িতে এক অপরাহ্রে একটি নিভৃত বৈঠক বসেছে। মুন্সী আমীর আলী দুজন অপরিচিত ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। একজন বেশ তরুণ বয়স্ক, অত্যন্ত সুপুরুষ, ধপধপে সাদা চুন্তু ও শেরওয়ানী পরা, মাথায় আলমপসন্দ, অর্থাৎ সূচোলো টুপী, গলায় একটি মোতির মালা। এর নাম আগা আলী হাসান খাঁ, ইনি এসেছেন লক্ষ্মেী থেকে এবং এর বেশভূষা দেখলে বোঝা যায়, ইনি খাস নবাবী দরবারের কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। অন্য জনের পরনে ধুতি এবং সবুজ রঙের বেনিয়ান, মাথায় ফেজ, মধ্যবয়স্ক, ঐর নাম মুহম্মদ গরিবুল্লা।
এ কক্ষের জানালা ও দ্বার বন্ধ, বাইরে আবদুল লতীফের বিশ্বস্ত নিজস্ব ভৃত্য প্রহরায় রয়েছে। এরা কথা বলছেন ফিসফিস করে। আগা আলী হাসান খাঁ গোপনে লক্ষ্ণৌ থেকে এসেছেন বিদ্রোহীদের দূত হয়ে। কলকাতা দখল করতে না পারলে হিন্দুস্তান থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করা যাবে না। সেজন্য কলকাতাবাসীরা কী করছে? কলকাতার হিন্দুরা কী বলে?
মুন্সী আমীর আলী বললেন, বেয়াদব, বাঙালী হিন্দুদের ওপর কোনো ভরসা করে লাভ নেই। বাঙালী হিন্দু একে তো লড়তেই জানে না, তার ওপর কলকাতার মাথা মাথা বড় মানুষ হিন্দুরা সবাই ইংরেজের তাঁবেদার। যত সব হাঁড়ি, মুচি, শুদূর আর গরীব বামুন-কায়েত ইংরেজের গোড় চোট দশ আধলার লায়েক হয়েছে। ও হারামখোরদের কথা বাদ দাও! আমাদের মুসলমানদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য আবদুল লতীফের মতন খানদানী ধনী ব্যক্তিদের সাহায্য চাই।
আবদুল লতীফ বললেন, আমি তৈয়ার। মুসলমানের ইমান রক্ষার জন্য আমি যথাসর্বস্ব দিতে প্রস্তুত।
আগা আলী হাসান খাঁ উর্দুতে বললেন, লক্ষ্ণৌতে, কানপুরে কিন্তু হিন্দু-মুসলমান এক সঙ্গে লড়ছে। আপনারা জানেন বোধ করি, আওয়ধে অনেক হিন্দু তালুকদারের নিজস্ব রাজোয়ারা বাহিনী আছে। সেইসব রাজোয়ারা বাহিনী এখন সিপাহীদের সঙ্গে লড়ছে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। হিন্দুদের খুশী করার জন্য আমরা ওদিকে এখন গো-হত্যা নিষেধ করে দিয়েছি।
মুন্সী আমীর আলী বললেন, সে আপনাদের ওদিকে হতে পারে। কিন্তু আমাদের এদিকের হিন্দুরা বড় বেয়াড়া, বদ-নসীব।
গরিবুল্লা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, আমি একটা কথা কইতে পারি?
মুন্সী আমীর আলী বললেন, হাঁ হাঁ, বলুন, বলুন।
তারপর অন্যদের সঙ্গে ভালো করে পরিচয় করে দিয়ে বললেন, এই জনাব গরিবুল্লা এসেছেন ঢাকা থেকে। ইনি একজন ফরাজী। দুদু মিঞার সাগরেদদের সব খবরাখবর ইনি রাখেন। ইনি গ্রাম দেশের কথা ভালো বলতে পারবেন। আমারও বিশ্বাস, গ্ৰামদেশ থেকেই আগে লড়াই শুরু করতে হবে।
গরিবুল্লা বললেন, আপনেরা কইলকেতার লোক, আপনেরা সকলেই নিশ্চয় জানেন যে আমাগো দুদু মিঞারে পুঙ্গিরপুত ইংরাজরা কইলকাতার জ্যালখানায় আটক কইরা রাখসে? হ্যারে আমরা ছাড়ামু, জালখানা ভাইঙ্গা, দুদু মিঞারে বাইর করুম। আমাগো পঁচিশ হাজার লাইঠয়াল আসে, এক সাথে সব হুড়মুড় কইরা আইস্যা পড়ুম।
মুন্সী আমীর আলী মোটামুটি এই বক্তব্য অনুবাদ করে বোঝালেন আগা আলীকে। তিনি জানালেন যে বাংলার মুসলমানরা কিছুকালের মধ্যে দুবার বিদ্রোহে মেতে উঠেছিল। প্রথমে তাদের বিদ্রোহ স্থানীয় অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে হলেও ক্রমে সরকারের সঙ্গেও সংঘর্ষ হয়। বারাসতে আর নদীয়ায় কৃষকরা তীতু মীরের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান করেছিল। এই তীতু মীর বিখ্যাত ওয়াহাবী নেতা সৈয়দ আহমদের শিষ্য। আগা সাহেব সৈয়দ আহমদের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই।
আগা আলী বললেন, উনি তো সুন্নি?
মুন্সী আমীর আলী বললেন, বাংলার অধিকাংশ মুসলমানই সুন্নি। দয়া করে এখন আর শিয়া সুন্নির প্রশ্ন তুলবেন না। সৈয়দ আহমদের শিষ্য এই ওয়াহাবীরা হিন্দু জমিদার আর নীলকরদের বিরুদ্ধে তো লড়েছেই, এমনকি ইংরেজ কম্পানির ফৌজের সঙ্গেও মুখোমুখি লড়াই দিয়েছে। যুদ্ধে তীতু মীর মারা যান। আর তাঁর সহকারীর ফাঁসী হয়। ওয়াহাবীরা সাময়িক ভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় বটে কিন্তু এখন তারা আবার জমায়েত হচ্ছে। বিদ্রোহী সিপাহীরা বাঙ্গলা আক্রমণ করলে ওয়াহাবীরাও তাদের সঙ্গে হাত মেলাবে। ঠিক কিনা, গরিবুল্লা সাহেব?
গরিবুল্লা বললেন, হ ছায়েব, আপনে ঠিকই কইসেন। এবার শোনেন, আমাগো ফরাজীগো কথা কই।
মুন্সী আমীর আলী বললেন, দাঁড়ান, আমি ওঁকে বুঝিয়ে বলছি। ফরিদপুর থেকেই এই আন্দোলনের শুরু। শরিয়ৎউল্লা নামে এক তেজী মুসলমান মক্কা থেকে হাজী হয়ে আসেন, তারপর তিনি প্রচার করতে থাকেন যে আল্লার রাজত্বে সব মানুষই সমান, গরীবের ওপর কর বসাবার কোনো অধিকার জমিদারদের নেই। জমিদার যেমন দরিদ্র প্রজাদের দুশমন, সেই রকম জমিদারদের মদৎ দেয় যে ইংরেজ সরকার, তারাও সাধারণ মানুষের দুশমন। হাজী শরিয়ৎউল্লার ইন্তেকালের পর তাঁর পুত্র দুদু মিঞা ফরাজীদের নেতা হন। শুনেছি প্রায় লাখখানেক ফরাজী এই দুদু মিঞার নেতৃত্বে জান দেবার জন্য তৈয়ার ছিল। কয়েক জায়গায় লড়াইয়ের পর দুদু মিঞা ইংরেজের হাতে ধরা পড়েছেন এবং জেলে আছেন। কিন্তু দুদু মিঞার শিষ্যরা এখন ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য প্রস্তুত। কী, ঠিক বলেছি?
গরিবুল্লা বললেন, হা। জ্যালখানা থিকা দুদু মিঞা তেনার দোমাদরে পাত্তর ল্যাখসেন যে তেনারে একবার বাইর করাইতে পারলেই তিনি পুঙ্গির পুত ইংরাজদের ঘেটি ভাঙবেন! আমি সেই খবর লইয়া আইসি।
মুন্সী আমীর আলী বললেন, খুব ভালো কথা!
গরিবুল্লা বললেন, আরও একটা কথা আসে। ছায়েব, আপনেরা হিন্দুগো বাদ দেওয়ার কথা কইলেন না? তাইলে শোনেন। আমি মাহেদিগঞ্জ থানার করপায়া গোরামে গোলাম নবী কাসেন্দের বাড়ি গেসিলাম। হেহানে গিয়া দেহি, ফরাজীগো মইধ্যে কিছু হিন্দু লাইঠ্যালও বইস্যা আছে। তারাও ফরাজীগে লগে লগে ইংরাজদের সাথে যুইদ্ধ করতে চায়। তারাও গরীব পরাজা। গোলাম নবী কাসেদ কইলেন, হ, আমরা হিন্দুগোও দলে নিমু। আমরা ফরাজীরা মনে করি, সব গরীব মানুষই সমান। তয়। হিন্দু গো বাদ দিমু ক্যান? হিন্দু জমিদার, মুসলমান জমিদার হক্কলডিই আমাগো দুশমন।
জনাব আবদুল লতীফ সন্দেহসঙ্কুল নয়নে চাইলেন গরিবুল্লার দিকে। এ যে অন্য সুরে কথা বলে! মুন্সী আমীর আলী অতিশয় বুদ্ধিমান, তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গটি চাপা দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভালো কথা। কিছু হিন্দু লাঠিয়ালকে যদি আমরা সঙ্গে পাই তো বেশ কাজে লাগানো যাবে তাদের। এখন আমাদের প্রধান শত্ৰু ইংরেজ, সেই কথাই ভাবুন, অন্য প্রসঙ্গ আনবেন না। আমরা হিন্দুস্তানে আবার মুঘল শাসন কায়েম করতে চাই।
আগা আলী বললেন, না, লক্ষ্মৌতে আমরা মুঘল শাসন চাই না। মুঘলরা সুন্নি। আমাদের আয়ওধে পবিত্র শীয় ইসনা আশীরী ধর্ম মানি। মুঘলরা দিল্লিতে থাক, কিন্তু আওয়ধ পৃথক থাকবে।
মুন্সী আমীর আলী বিচলিত ভাবে বললেন, আগা সাহেব, ও কথাও এখন তুলবেন না। শীয়া হোক, সুন্নি হোক, ইংরেজ হটিয়ে ইসলামেরই তো জয় হবে। আওয়ধের নবাব ওয়াজীদ আলী শাহ তো কখনো শীয়া-সুন্নির বিভেদ মানেননি শুনেছি। ওসব থাক, এখন লক্ষ্ণৌয়ের কী হাল আমাদের বলুন।
আগা আলী বললেন, লক্ষ্ণৌ এখন পরিপূর্ণ স্বাধীন। মীরাট থেকে বাগী সিপাহীরা গেছে দিল্লি দখল করতে আর এলাহাবাদ–ফয়জাবাদ থেকে বাগী সিপাহীরা লক্ষ্ণৌতে এসে লাগিয়ে দিয়েছিল গদর। স্থানীয় লোকরাও যোগ দিল তাদের সঙ্গে। ইংরেজরা ভয়ে পালিয়ে বেলি গারদে আশ্রয় নিয়েছে। বিদ্রোহীরা লক্ষ্ণৌয়ের সিংহাসনে বসিয়েছিল নবাব ওয়াজীদ আলী শাহেরই এক পুত্রকে। তার নাম বীরজীস কদু, তার উমর মাত্র দশ বৎসর।
আবদুল লতীফ বললেন, দশ বৎসরের বালক নবাব? বলেন কী?
আগা আলী বললেন, শাহী বংশের কারুকে তো বসতে হবে। লক্ষ্ণৌয়ে আর কেউ নেই ও বংশের। বীরজা কদুসের জননী বেগম সাহেবা হযরত মহল হয়েছেন তার মুগতার। তিনিই আড়াল থেকে দরবার চালাচ্ছেন।
মুন্সী আমীর আলী বললেন, কিন্তু এক বালক আর এক নারী কতদিন আওয়ধের স্বাধীনতা রক্ষা করবে? সৈন্যদের পরিচালনা করবে কে?
আগা আলী বললেন, সিপাহীদের সামলানোই মুশকিল। প্রত্যেকেই নিজেকে মনে করছে নবাব। ফয়জাবাদের বিদ্রোহীদের নেতা এহমদউল্লাহ শাহ একজন নামকরা যোদ্ধা। তিনি নিজেই সেনাপতি হয়ে পৃথক দরবার বসাচ্ছেন। বেগম সাহেবা হযরত মহল এক রকম ফরমান দিচ্ছেন আবার এহমদউল্লা অন্য রকম ফরমান দিচ্ছেন। প্রচুর গোলমাল। আমি চেষ্টা করেছি। দুই দরবারের সংযোগ সাধন করতে। তবু লক্ষ্ণৌ ছেড়ে এই সময় আমায় কলকাতায় আসতে হলো।
বাকি সকলে নীরব রইলেন কিছুক্ষ। কল্পনায় অঙ্কিত করবার চেষ্টা করলেন লক্ষ্ণৌয়ের দৃশ্য। মুন্সী আমীর আলী সারা ভারত পরিভ্রমণ করেছেন, সেইজন্য অনেকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে। কিন্তু অন্য দুজন বাংলার বাইরের অবস্থা সম্পর্কে প্রায় অজ্ঞ।
আগা আলী গম্ভীরভাবে বললেন, আমার আগমনের উদ্দেশ্য দুটি। সুবে বাংলায় সিপাহী গদরের শুরু। কিন্তু তারপর আর কিছু হলো না। এখানকার সিপাহীদের জাগাতে হবে এবং তাদের সঙ্গে হাত মেলাবার জন্য আপনাদের সাহায্য চাই। এবং বাদশা ওয়াজীদ আলী শাহকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে লক্ষ্মেী নগরীতে। সবচেয়ে ভালো হয়, তিনি যদি এখানকার বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন, তাদের সাহায্যে কলকাতা দখল করেন। তা হলে বিজয়ীর বেশে তিনি ফিরতে পারবেন। লক্ষ্মেীতে।
মুন্সী আমীর আলী এবং আবদুল লতীফ পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর দুজনেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
মুন্সী আমীর আলী আড়ষ্টভাবে বললেন, জনাব, এ চিন্তা আগেই আমার মাথায় এসেছিল। বাংলার মুসলমান আর সিপাহীদের নেতৃত্ব দেবার প্রস্তাব নিয়ে আমরা দুজন দেখা করবার চেষ্টা করেছিলাম নবাব সাহেবের সঙ্গে। কিন্তু আমাদের নিরাশ হতে হয়েছে।
আগা আলী জিজ্ঞেস করলেন, বাদশা আপনাদের প্রস্তাব মানলেন না?
মুন্সী আমীর আলী বললেন, ওয়াজীদ আলী শাহের কাছে পৰ্ছছোতেই পারলাম না। নবাবের সুযোগসন্ধানী দোস্ত শাগিদ-এর অন্ত নেই। তারা অন্য লোকদের নবাবের কাছ ঘেঁষতে দেয় না। আপনাকে কী বলবো আগা সাহেব, ইসলামে নাচগান অতি গুনাহ। আর নবাব কি না সৰ্বক্ষণ তা নিয়েই মেতে আছেন। আরো ছিয়া ছিয়া তোবা তোবা!
আগা আলী বললেন, ও সব কথা আমি জানি। বাদশাহের ওখানে গিয়ে আর কী দেখলেন বলুন।
মুন্সী আমীর আলী বললেন, দেখে শুনে মনে হয়, নবাব আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোরা মনে করছে, তারা যেন লক্ষীয়ের কায়সর বাগেই রয়েছেন। শুধু বিলাসিতার স্রোত। রাজ্য গেচে সেদিকে ইশ নেই, নবাব এখনো রমণী সম্ভোগেই মত্ত। চাকরাণী মেথরাণী জাতীয়া স্ত্রীলোকদেরও তিনি মুত্ত্মা করে বেগম মহলে স্থান দিচ্ছেন।
আগা আলী বললেন, নবাবকে এই পঙ্কিল অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে হবে। আপনারা একটু ব্যবস্থা করে দিন, যাতে নবাবের সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে পারি।
মুন্সী আমীর আলী বললেন, সে বড় শক্ত কাজ হবে।
আগা আলী বললেন, শুনুন, স্বয়ং বাদশাহ আমাকে দেখলেই চিনবেন। তাঁর শাগিদিরাও অনেকেই আমাকে চেনে। মুখ দেখে না চিনলেও নামে চিনবে। আমার পক্ষে দেখা করা শক্ত কাজ নয়। কিন্তু আমার ওপর ইংরেজদের নজর আছে। জানেন, আমি এখানে এসেছি অতিশয় গোপনে। ইংরেজ একবার আমার সন্ধান পেলে আমার এই প্ৰিয়তম মুণ্ডটি আর আমার ধড়ের ওপর শোভা পাবে না। সেইজন্যই আমি আপনাদের সাহায্যপ্ৰাৰ্থী। আপনারা এমন কোনো ব্যবস্থা করুন, যাতে আমি কোনো কৌশলে, ইংরেজের অগোচরে বাদশাদের নূর মহলে পেঁহুছোতে পারি। আমি শুধু বিলাসপ্ৰমত্ত বাদশাহের সামনে গিয়ে বলবো, অ্যায় খুল বতুখুর সনদম তু বুঅ্যায় কসে দারী (ওগো ফুল এখনো আমি তোমার প্রতি মুগ্ধ, তোমাতে ও কিসের সৌরভ!)
মুন্সী আমীর আলী একটুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, একটি মাত্র উপায়ই বাৎলানো যায়। আমি যতদূর জানি, নবাব ওয়াজীদ আলী শাহ যে এই বিলাসের স্রোতে ড়ুবে আছেন, এতে কোম্পানির সরকারের প্রশ্ৰয়ই আছে। নবাব এখনো ইংরেজের কাছ থেকে খোরপোশ গ্ৰহণ করেননি, নিজেকে এখনো তিনি রাজ্যচ্যুত স্বাধীন নবাবই মনে করেন। নবাবের জননী ইংলণ্ডে গেছেন। হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা করতে।
আগা আলী বললেন, এ সব তো আমরা জানি, আপনি এখন কী করা যায়, সেই কথা বলুন!
মুন্সী আমীর আলী পেশায় আইনজীবী, তাই যে-কোনো বক্তব্যই তিনি সবিস্তারে এবং পটভূমিকা অঙ্কিত করে বলতে ভালোবাসেন। অন্য সকলকে তাঁর চেয়ে অজ্ঞ মনে করাও তাঁর স্বভাব। তিনি হাত তুলে বললেন, আগে সব শুনুন, তা হলে বুঝবেন। যা বলছিলাম, ব্রিটিশ আদালত ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির খেয়াল খুশী অনুযায়ী চলে না। কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে জেনারেল উট্রাম বেআইনীভাবে আওয়ধ দখল করেছে। ব্রিটিশ আদালতের মামলায় কোম্পানি হেরে যেতে পারে। নবাব ওয়াজীদ আলী শাহ আবার ফিরে পেতে পারেন তাঁর রাজ্য। সেইজন্য কোম্পানি চাইছে…
—মুন্সীজী, এ সব কুট কথা পরে শোনা যাবে। আমি চাই তুরন্ত বাদশাহের সঙ্গে দেখা করতে।
—কোম্পানীর ফৌজ ওয়াজীদ আলী শাহের বাড়ির ওপর নজর রেখেছে। দেখা করতে গেলেই আপনি ধরা পড়ে যাবেন। সেইজন্যই বলছিলাম, দেখা করার একটাই উপায় আছে। কোম্পানি চায় নবাব যত খুশী বিলাসে মত্ত থাকুক। নবাবের সঞ্চিত অর্থ খরচ হয়ে যাক।
—আমাদের বাদশাহের কাছে প্রচুর ধনরত্ন আছে।
—আপনি ওয়াজীদ আলী শাহকে বাদশাহ বলছেন। কিন্তু আমাদের কাছে হিন্দুস্তানের বাদশাহ একজনই, তিনি বাহাদুর শাহ জাফর। সে যাই হোক, আপনি নবাবের বিলাসের বহর দেখেননি, দেখলে বুঝবেন, দৈনিক কত মুদ্রা ব্যয় হয়। তাঁর শত শত মুসাহিব আর শাগিদ। আর আছে হাজার হাজার জানোয়ার আর চিড়িয়া আর স্ত্রীলোক। এ সব পুষতে কত খরচ হয় জানি না। যেখানে আয় নেই। শুধু ব্যয় সেখানে অফুরন্ত ধনরত্নও একদিন ফুরিয়ে যায়। ইংরেজ কোম্পানি চায় নবাবের অর্থ ফুরিয়ে যাক। তারপর নবাব কোম্পানির কাছে খেসারত আর পেনসনের তনখা চাইতে বাধ্য হোক। ব্যস, একবার নবাব কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নিলেই মামলা চুকে গেল। আয়ওধের ওপর নবাবের আর কোনো দাবি থাকবে না। বীরজীস কদু যতদিন লক্ষীয়ের সিংহাসনে আছে, তার মধ্যে এটা হয়ে গেলেই ইংরেজের লাভ। কারণ, লক্ষ্ণৌ এখন ইংরেজের অধিকারে নেই। সুতরাং লক্ষ্মেী ফিরিয়ে দেবার মামলা এখন অচল।
—আমরা দেশ থেকে ইংরেজকেই তো উচ্ছেদ করে দিচ্ছি। তার মধ্যে এত মামলা মোকদ্দমার কথা কেন? মামলায় কিছু হবে না। তলোয়ার বন্দুকে ফয়সালা করতে হবে। আপনি ওয়াজীদ আলী শাহের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিন আমার।
—নবাবের সঙ্গে দেখা করতে গেলে রেণ্ডী কিংবা নাচনেওয়ালী সাজতে হবে, পারবেন? আপনার চেহারা খাপসুরৎ আছে, আপনাকে মানিয়ে যাবে, কিন্তু এই বুড়ো বয়েসে আমি মাগী সাজবো কী করে? রেণ্ডি, নাচনেওয়ালী ছাড়া আর অন্য কারুকে এখন ইংরেজের প্রহরীরা নবাবের বাড়ির কাছ ঘেঁষতে দিচ্ছে না!
আগা আলী অধীরভাবে বললেন, মুন্সীজী, আপনি অযথা সময় বরবাদ করছেন। শহর কলকাত্তায় কি ঘুংঘটওয়ালী, নাটকনওয়ালীর অভাব আছে? শুনেছি তো রাতের সময় এখানে হুরীর মেলা বসে। যত টাকা লাগে লাগুক, আপনি দু-চারটি বেশ মনজিলওয়ালী ধরনের রেণ্ডী ভাড়া করুন। তাদের সঙ্গে
—আপনি খানদান বংশের লোক, আপনি কি ওরকম ভেক ধরতে পারবেন?
—ইংরেজ হঠাবার জন্য আমি এখন সব কিছু করতে পারি।
অল্পক্ষণ পরে সেদিনকার মতন গোপন সভা ভঙ্গ হলো। ঠিক সুবিধা মতন রূপসী নর্তকী সংগ্ৰহ করতে সময় লেগে গেল আরও দুদিন। মৌলা আলীর দরগার কাছেই চাঁদবিবি নামে এক নামকরা মালকান আছে, তার কুঠীতে সে দশ-বারোটি বিদ্যুৎ প্রভাময়ী রূপসী গুণবতী তয়ফাওয়ালী পোষে। তার মধ্য থেকে বেছে বেছে, এক নজরেই মস্তক ঘূর্ণিত হবার মতন চেহারার দুটি যুবতীকে ভাড়া করা হলো অগ্নিমূল্যে।
মুন্সী আমীর আলী এবং আগা আলী নিপুণভাবে ছদ্মবেশ ধারণ করলেন। দুদিন তাঁরা মুখমুণ্ডন করেননি, পরণে ঢোলা পাজামা ও শস্ত সিল্কের বেনিয়ান। মুখ ভর্তি পান, সেই পানের পিক গড়িয়ে পড়েছে জামায়, গলায় লাল রঙের রেশমী রুমাল বাঁধা, মাথায় চকচকে জরির টুপী উল্টাভাবে বসানো। মুন্সী আমীর আলী জীবনে কখনো সুরা পান করেননি, তবু চক্ষু দুটি ঢুলু ঢুলু করে রেখেছেন, হাতে সারেঙ্গী, কিন্তু তিনি ছড় টানতেও জানেন না।
মেটিয়াবুরুজে পর পর অনেকগুলি বাড়ি নিয়ে সাঙ্গোপাঙ্গো সমেত আস্তানা গেড়েছেন নবাব ওয়াজীদ আলী শাহ। পাল্কি থেকে সেখানে নেমে আগা আলী বুঝলেন যে মুন্সী আমীর আলী ঠিক কথাই বলেছেন। একদল গোরা সৈন্য সেখানে পাহারা দিচ্ছে, উটকো লোক নবাব মহলে প্ৰবেশ করতে চাইলে জিজ্ঞেসবাদ করা হচ্ছে তাদের।
মুন্সী আমীর আলীর কাজ পাকা। তিনি সঙ্গে করে একটি নকল এত্তেলা পত্র নিয়ে এসেছেন। গোরা সৈন্যরা কিছু প্রশ্ন করার আগেই তিনি পত্রটি দাখিল করে বোঝাতে চাইলেন যে নবাবের দরবারের আহ্বানেই তাঁরা এসেছেন। গোরা সৈনিক দেখে আগা আলীর মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল, জোর করে তিনি মাতালের ভান করতে লাগলেন। ইংরেজ প্রহরীরা অবশ্য বাধা দেবার কোনো করলো না, পত্রখানি যাচাই করলো না তারা, জড়ির চুমকি বসানো নীল ওড়না পরা দুই সুন্দরীকে দেখেই তারা মৃদু হাস্য করলো এবং হাতের ইঙ্গিতে জানালো, যাও, যাও।
সদর পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে আগা আলী এবং মুন্সী আমীর আলী হাঁফ ছাড়লেন। আর কোনো ভয় নেই, নবাব মহলের মধ্যে সম্পূর্ণ অরাজকতা, কে কোন দিকে আসছে না যাচ্ছে, তাতে কারুর কোনো খেয়াল নেই। এখন প্রশ্ন, নবাবকে খুঁজে বার করা। এর মধ্যে একটি উৎপাত এই যে, যার কাছেই কিছু প্রশ্ন করা যায়, সে-ই আগে টাকা চায়। উৎকোচ বা বখশিশ, না পেয়ে কেউ মুখ খুলবে না। যাই হোক, কোনোক্রমে জানা গেল যে নবাব এখন আছেন সুরসেস মঞ্জিলে। পাশের উদ্যানটি পার হলেই সেই মঞ্জিল।
সেই মঞ্জিলে প্রবেশ করার পর সমস্যা হলো, কোন কক্ষে নবাব আছেন সেটা জানা। পরপর দুজন ভৃত্যকে উৎকোচ দেবার পর, তৃতীয় জনের ক্ষেত্রে আগা আলী উগ্ৰমূর্তি ধারণ করলেন। সেই ভূত্যের টুটি চেপে ধরে আগা আলী বললেন, বেওকুফ,বল কোথায় বাদশা আছেন? সে ভৃত্যটি জোর করে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতেই আগা আলী বসনের অভ্যন্তর থেকে একটি ছুরি বার করে বললেন, এখনি তোর কলিজা ছিঁড়ে নেবো!
ভৃত্যটি কাঁপতে কাঁপতে তখন দ্বিতলের একটি কক্ষের কথা জানালো। সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময় আরও দু-একজন লোক বাধা দেবার চেষ্টা করতেই আগা আলী সাবলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন তাদের। তারপর নর্তকী দুটির দিকে চেয়ে চক্ষু নরম করে বললেন, তোদের কাম ফতে হয়ে গেছে, এখন যেখানে খুশী যা। খবর্দার কারুর কাছে মুখ খুলবি না।
আগা আলী গলা থেকে রুমাল খুলে ফেললেন এবং ছুরিকাটি আবার গোপন করলেন। তারপর এক ধাক্কায় খুলে দিলেন নির্দিষ্ট কক্ষটির দ্বার।
বিকেল ও গোধূলির সন্ধিক্ষণে নবাব ওয়াজীদ আলী শাহ পাঁচজন সঙ্গীসহ সেই কক্ষে নামাজ আদায় করছিলেন। আগা আলী ঈষৎ অপ্ৰস্তুত হয়ে টুপী খুলে নত মস্তকে অপেক্ষা করতে লাগলেন। একটু পরেই নামাজ শেষ হলো, নবাব মুখ তুলে চাইলেন আগন্তুকদের দিকে। আগা আলী কুর্নিশ করতে করতে পাঁচ পা এগিয়ে তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন এবং নবাবের পা ছুঁয়ে কদমবুসী করলেন। তারপর ফারসী ভাষায় বললেন, বাদশাহের ভৃত্য আগা আলী হাসান খাঁ অনেক কষ্টে হুৰুমীপে হাজির হয়েছে। বাদশাহ দীর্ঘজীবী হন। হুজুর তাঁর এই ভূতাটিকে লিতে পেরেছেন নিশ্চয়ই।
নবাবের অঙ্গে সাদা রেশমের আঙরাখা, তার তলায় হালকা নীল রঙের শালুকা (ছোট জামা)। প্রখর গ্ৰীষ্মে তাঁর ললাট ঘর্মসিক্ত। আগা আলীর কথা শোনার পর তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন মুসী আমীর আলীর দিকে। এত রকম উত্তেজনার মধ্যে মুন্সী আমীর আলী গলায় রুমাল এবং মাথায় টুপী খুলতে ভুলে গিয়েছিলেন, তাড়াতাড়ি সেগুলি খুলে বারবার কুর্নিশ করতে লাগলেন।
নবাব দণ্ডায়মান দুই আগন্তুকের উদ্দেশে বললেন, বয়ঠো!
আগা আলী বললেন, হে বাদশা, আপনার সঙ্গে আমার কয়েকটি অতি জরুরি ও গোপন কথা আছে, সেগুলি আমি আপনাকে নিভৃতে বলতে চাই।
নবাব এ কথার কোনো উত্তর দিলেন না এবং তাঁর সঙ্গীদেরও যেতে বললেন না। আগা আলী নিজেই গরম চক্ষে লোকগুলির দিকে তাকালেন। সেই লোকগুলি সম্ভবত আগা আলীকে চিনতে পেরেছে, তাই তারা বিনা বাক্যব্যয়ে নিজেরাই উঠে গেল।
আগা আলী নবাবের উদ্দেশে বললেন, হুজুরে আলম নিশ্চয়ই আমাকে চিনতে পেরেছেন? যে মসীহউদ্দীন খাঁ-কে আপনি মুখতার-এ আম দিয়ে বিলায়েতে পাঠিয়েছেন মামলা দাখিল করবার জন্য, আমি সেই মসীহউদ্দিন খাঁ-এর ভ্রাতুষ্পুত্র। হুজুরে আলম অনেকবার আমাকে দেখেছেন।
নবাব নীরব রইলেন।
তারপর আগা আলী শোনালেন বর্তমান লক্ষীয়ের অবস্থা। ওয়াজীদ আলীর সন্তান বিরজীস কদু এখন লক্ষ্মেীয়ের সিংহাসনে আসীন, তার নামে মুদ্রাও বার করা হয়েছে, প্ৰজারা আবার কর দিচ্ছে। এখন সকলেরই ইচ্ছা বাদশাহ আবার লক্ষ্ণৌতে ফিরে আসুন। বাঙ্গালায় মুসলমানরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত। হুজুরে আলম একবার ডাক দিলেই সকলে তাঁর অধীনে জমায়েত হবে, তখন সহজেই কলকাতা দখল করা যাবে।
মুন্সী আমীর আলী এবার শোনালেন ফরাজী এবং ওয়াহাবীদের প্রস্তুতির কথা। চট্টগ্রাম, ঢাকা, মেদিনীপুরে সিপাহী ব্যারাকেও উত্তেজনা চলছে, যে-কোনো দিন সিপাহীরা বিদ্রোহ করতে পারে। শুধু শাহী বংশের কারুর নেতৃত্বের অপেক্ষা।
নবাব সম্পূর্ণ নীরব রইলেন। পর্যায়ক্রমে তিনি দুই বক্তার মুখের ওপর দৃষ্টি স্থাপন করতে লাগলেন, কিন্তু একটি কথাও উচ্চারণ করলেন না।
আগা আলী আরও বিশদভাবে ফুটিয়ে তুললেন বিদ্রোহের চিত্র। দিল্লিতে সিপাহীদের জয়লাভের কাহিনী। লক্ষ্মৌতে এখন বইছে খুশীর জোয়ার। নবাবেরই বেগম হযরত মহলের নামে প্রজারা দিচ্ছে জয়ধ্বনি।
মুন্সী আমীর আলী বললেন, নবাব যদি এখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গোপনে কোথাও অবস্থান করতে চান, তাহলে সে ব্যবস্থাও করা আছে।
নবাব ওয়াজীদ আলী শাহ সময় বিশেষে বাকসংযমী হিসেবে বিখ্যাত। এখন তিনি একেবারে পাথরের মূর্তির মতন নীরব নিথর হয়ে গেছেন। তাঁর মুখে কোনো ভাবের রেখাই ফুটলো না।
আগা আলী কাতরভাবে বললেন, হুজুরে আলম, কিছু বলুন!
কোনো উত্তর না দিয়ে নবাব উঠে দাঁড়ালেন। পেছনের দরজা দিয়ে তিনি চলে গেলেন পাশের কক্ষে। তারপর সেখানে একেবারে সাদা একটি দেয়ালের কাছে চলে গিয়ে, দেয়ালে নাসিক ঠেকিয়ে তিনি কেঁদে উঠলেন উচ্চস্বরে।
নবাবের কান্নার আওয়াজ শুনে তাঁর অনেক সহচর-অনুচর ভিড় করে দাঁড়ালো সেই কক্ষের কাছে। আগা আলী এবং মুন্সী আমীর আলীও অপ্ৰস্তুত।
বেশ খানিকক্ষণ ধরে দেয়ালের দিকে মুখ করে ক্ৰন্দন করলেন নবাব। তারপর মুখ ফেরালেন এক সময়। তাঁর বস্ত্র ভিজে গেছে অশ্রুধারায়। নবাব অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, খোআব থা। জো কুছভী দেখা, জো সুনা আফসানা থা। যা কিছু দেখেছি, সবই স্বপ্ন, যা কিছু শুনেছি, সবই কাহিনী।
তারপরই তিনি ডাক পাঠালেন কলমচীর উদ্দেশে। সে হাজির হতে তৎক্ষণাৎ মুসাবিদ করা হলো একটি পত্রের। নবাব কোম্পানির সরকারকে জানিয়ে দিলেন যে বিদ্রোহীরা এসে তাঁকে উস্কানি দিচ্ছে, তিনি এর মধ্যে জড়িয়ে পড়তে চান না একটুও। ইংরেজের বিরুদ্ধে আগেও লড়াই করেননি, এখনো লড়াই করবেন না। এবং এই অবস্থায় তাঁর পক্ষে বাইরে থাকাও নিরাপদ নয়, সরকার বাহাদুর যেন তাঁকে কেল্লার মধ্যে স্থান দেন।
পত্রপাঠ ইংরেজ সরকার নবাবকে নিয়ে গেল ফোর্ট উইলিয়ামে। আগা আলী এবং মুন্সী আমীর আলীও বন্দী হলেন, তাঁদের রাখা হলো ফৌজি গারদে।
কেল্লায় নিরাপদে অবস্থানের জন্য নবাবের নিজস্ব জিনিসপত্রের সঙ্গে এলো সতেরোটি বালিশ। দুদিকে পাশ ফিরে শোবার সময় নবাবের দুই কানের জন্যও ছোট দুটি কান-বালিশ লাগে। সেই বালিশের স্তুপের মধ্যে নিশ্চিন্তে শুয়ে থেকে নবাব আবার মন দিলেন কবিতা রচনায়। গভর্নর জুড়ে কানিয়ের মহানুভবতার জন্য তাঁর প্রতি প্রশস্তিমূলক এক দীর্ঘ কবিতা রচনা করে পাঠিয়ে দিলেন।