চতুর্বিংশ
পরিচ্ছেদ
মৃত্যু সম্বন্ধে স্বামীজীর শিক্ষা
আমাদের আচার্যদেব যে-সকল উপায় অবলম্বনে শিক্ষা প্রদান করিতেন, তাহার মধ্যে অন্যতম অতীব হৃদয়গ্রাহী হইল যে, তাহার সান্নিধ্যই শিষ্যের মধ্যে নীরবে অজ্ঞাতসারে একটা পরিবর্তন আনিয়া দিত। তাহার সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটিত, কোন একটি নির্দিষ্টভাবে সে অনুপ্রাণিত হইয়া যাইত, অথবা সহসা দেখিতে পাইত, কোন বিশেষভাবে চিন্তা করিবার সমগ্র অভ্যাস চলিয়া গিয়াছে এবং উহার স্থলে একটি নূতন মতের উদ্ভব হইয়াছে—অথচ ঐ বিষয়ে উভয়ের মধ্যে একটি কথারও আদানপ্রদান হয় নাই। মনে হইত, তাহার সান্নিধ্যে অবস্থানহেতুই যেন কোন বস্তু তর্কযুক্তির রাজ্য অতিক্রম করিয়া গিয়াছে এবং আপনা হইতে ঐ সম্পর্কে জ্ঞান জন্মিয়াছে। এইরূপেই রুচি ও মূল্য-সম্পর্কিত নানা প্রশ্ন যেন অবাস্তব হইয়া যাইত। এইরূপেই তাহার অন্তরঙ্গ ভক্তগণের হৃদয়ে ত্যাগের বাসনা জ্বলন্ত অনলশিখার ন্যায় উদ্দীপিত হইয়া উঠিত। আর তাহার সান্নিধ্যে মৃত্যু সম্বন্ধে লোকের মনে যে ধারণা সঞ্চারিত হইত, তৎসম্পর্কে এই কথাটি সর্বাপেক্ষা প্রযোজ্য।
তাহার জীবিতকালে এ-বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম প্রবর্তন করার ব্যাপারে তিনি ক্রমশঃ অধিকতর বিরোধী হইয়া উঠিয়াছিলেন। এই চিরন্তন সমস্যার সমাধানের চেষ্টায় তাহার মতামত কেহ জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি উত্তর দিতেন, “আমার মনে হয় এইরকম, আমি ঠিক জানি না।” সম্ভবতঃ তিনি অনুভব করিতেন, ভবিষ্যৎ সুখের আনন্দময় স্বপ্নের মধ্যে একপ্রকার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্বার্থপরতা থাকে এবং দেহত্যাগের পরের অবস্থার উপর ঝোক দিয়া লোকের বাসনাজনিত অজ্ঞতা বর্ধিত করিতে তিনি ভয় পাইতেন। তাহার নিজের পক্ষে জীবন ও মরণে ঈশ্বরই একমাত্র উপায় এবং নির্বাণই ছিল একমাত্র চরম লক্ষ্য। “সর্বোচ্চস্তরের সমাধিই একমাত্র প্রয়োজনীয় বস্তু, বাকি আর সবই বাজে জিনিস।” তথাপি এই তথ্য হইতেই স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, কিরূপে তাহার শিক্ষায় লোকের মৃত্যু সম্বন্ধে ধারণার পরিবর্তন ঘটিত, এবং যে দুই-তিনখানি পত্রে ব্যক্তিগত অনুভব ও সহানুভূতির প্রেরণায় এ সম্পর্কে তিনি নির্দিষ্ট একটি মত প্রকাশ করিয়াছিলেন, উহাই পত্রগুলিকে সমধিক মূল্যবান করিয়া তুলিয়াছে।
আমার নিজের কথা বলিতে গেলে যখন আমি স্বামীজীর প্রথম সাক্ষাৎ লাভ করি তার পূর্ব হইতেই এই ধারণা আমার হৃদয়ে বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল যে, আমাদের ইচ্ছা যাহাই হউক, শরীর ত্যাগের পরেও আমাদের ব্যক্তিত্ব বজায় থাকে, এরূপ কল্পনা করিবার কোন বাস্তব কারণ নাই। এরূপ ব্যাপার হয় অসম্ভব, না হয় অচিন্তনীয়। মন ব্যতীত যদি শরীরের অনুভূতি না হয় (কারণ, মন দ্বারাই আমরা ঐ অনুভূতি লাভ করিয়া থাকি), তাহা হইলে ইহাও সত্য যে, শরীর ব্যতীত মনের অস্তিত্বও আদৌ কল্পনা করিতে পারি না। সুতরাং মন যদি “বীণার তারে ঝঙ্কারের মতো” বাস্তবিক শরীরের পরিণাম না হয়, তাহা হইলেও অন্ততঃ আমাদের স্বীকার করিতে হইবে যে, শরীর ও মন উভয়ে একই বস্তুর বিপরীত প্রান্ত মাত্র। শরীর ও মন–জড়পদার্থ ও মন নয়—উহারা একই জিনিস, এবং মৃত্যুর পরেও ব্যক্তিরূপে অস্তিত্বের ধারণা জৈব-সংস্কারপ্রসূত একটা ছায়া মাত্র। নৈতিক আচরণ, এমনকি পূর্ণ আত্মত্যাগে যাহার পরিণতি, তাহাও আমাদের ব্যক্তিগতভাবে সমাজের পক্ষে কল্যাণকর ভোগগুলিকে গ্রহণ করা-রূপ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।(১)
ভারতের মনীষিবৃন্দ মনকেই জীবনের কেন্দ্রবিন্দু জ্ঞান করিয়া অভ্যাস অনুযায়ী উহার উপরেই সর্বপ্রকার জোর দিয়া থাকেন। আমার নিজের ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত ধারণাসমূহ তাহাদের ঐ প্রকার চিন্তা দ্বারা ব্যাহত হইয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক ব্যক্তির বিশ্বাস যে, মানুষ একটা দেহ। এ বিষয়ে প্রাচ্য পণ্ডিতগণ সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা পোষণ করেন, কারণ, ঐ সংস্কার তাহাদের মজ্জাগত। স্বামীজী যেমন নির্দেশ করিয়াছিলেন, “পাশ্চাত্যের সকল ভাষায় বলা হয়, মানুষ একটি দেহ এবং তার আত্মা আছে; কিন্তু প্রাচ্য ভাষাগুলিতে বলা হয় যে, মানুষ আত্মা; এবং তার একটা দেহ আছে।”
আত্মা ও দেহ সম্বন্ধে এই নূতন ব্যাখ্যার ফলস্বরূপ লোকদের সহিত কথা বলিবার সময় আমি ঐ বিষয়টি পরীক্ষামূলকভাবে নিজেকে বুঝাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম যে, বাহ্য শ্রবণেন্দ্রিয়ের পরিবর্তে আমি তাহাদের ভিতরের মনের সহিত কথা কহিতেছি। এই পরীক্ষায় যে বিপুল পরিমাণে সাড়া পাইল, তাহাই আমাকে ক্রমশঃ অগ্রসর করিয়া লইয়া চলিল; অবশেষে বৎসরান্তে সহসা একদিন আবিষ্কার করিলাম যে, মনকে প্রাধান্য দেওয়া আমার অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে। ফলে শরীর নাশের সঙ্গে সঙ্গে মনের বিনাশ আমি আর কল্পনা করিতে পারিলাম না। প্রত্যেক নূতন প্রচেষ্টা এই বিশ্বাস দৃঢ়তর করিতে লাগিল এবং ক্রমশঃ নিশ্চিতভাবে এই ধারণা হইয়া গেল যে, এই পরিদৃশ্যমান জগৎবাস্তবিকই মনঃপ্রসূত; এবং কোন এক নির্দিষ্ট মুহূর্তে (যেমন, দেহত্যাগকালে) চিন্তারাজ্যে কোন আকস্মিক বিরাট পরিবর্তন ঘটা অসম্ভব বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
কিন্তু ঐ বিষয়ে স্বামীজীর চিন্তা অনেক গভীরতর ছিল। তাহার সর্বদা চেষ্টা ছিল কোন প্রকারে যেন দেহাত্মবুদ্ধি না আসিতে পারে। ‘আমি’ শব্দটি তিনি কখনও এমনভাবে প্রয়োগ করিতেন না, যাহাতে কেহ ঐরূপ অর্থ করিতে পারে; বরং ঈষৎ অঙ্গভঙ্গির সহিত ‘এইটা বা এইসব’ বলিয়া শরীরকে নির্দেশ করিতেন। অবশ্য পাশ্চাত্যবাসীর কর্ণে উহা কিঞ্চিং অদ্ভুত শুনাইত। কিন্তু সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্ব দ্বারা সীমিত ইন্দ্রিয়নির্ভর জীবনকে জীবন বলিয়াই তিনি স্বীকার করিতে চাহিতেন না, কারণ উহাতে অনেক গোলমালের আশঙ্কা উঠিতে পারে। জয়-পরাজয়, ভালাবাসা-ঘৃণা, যোগ্যতা-অযোগ্যতা—প্রত্যেকটি ব্রহ্মের আংশিক প্রকাশ মাত্র এবং সেজন্য কখনই সম্মিলিতভাবে তাহারা সেই সচ্চিদানন্দস্বরূপ হইতে পারে না। স্বামীজী যেমন বলিতেন, আমাদের বর্তমান জীবনের ন্যায় শত শত জীবন, যথাকালে যাহার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী, তাহার দ্বারা অমৃতত্ব-পিপাসার নিবৃত্তি কদাপি সম্ভব নহে। অতএব মরণ-রহিত অবস্থালাভ ব্যতীত অপর কিছুই চলিবে না, এবং এই অবস্থাকে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সীমাবদ্ধ জীবনেরই বহুল পুনরাবৃত্তি, অথবা তাহারই কিঞ্চিৎ বিকাশপ্রাপ্ত অবস্থামাত্র বলিয়া কদাপি ব্যাখ্যা করা যায় না। এ বিষয়ে স্থির নিশ্চয়তার জন্য ইহজীবনেই অমৃতত্ব লাভ করা প্রয়োজন, নতুবা আর অন্য কোন উপায়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাইতে পারে যে, আমরা শরীরবোধকে অতিক্রম করিতে পারিতেছি? পাশ্চাত্যবাদীরা বলিতে অভ্যস্ত, ‘আত্মা আসেন এবং যান; এইরূপে তাঁহারা দেহাত্মবুদ্ধি প্রবণতার পরিচয় দেন; যেন তাহারা এক উচ্চতর সত্তার আগমনির্গম প্রত্যক্ষ করিতেছেন। সেন্ট অগাস্টিনকে অভিনন্দনপূর্বক কেন্টপ্রদেশবাসী ডুইড পুরোহিত প্রদত্ত বক্তৃতাই একশ্রেণীর লোকের ধর্মবিশ্বাসের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ইহাদের মতে, জগৎ একটি উষ্ণ, আলোকিত বৃহৎকক্ষ, এবং আত্মা যেন একটি পক্ষী, বাহিরে শীত ও ঝঞাবাত হইতে রক্ষা পাইবার নিমিত্ত ক্ষণকালের জন্য ঐ কক্ষে আশ্রয় লইয়াছে। তথাপি ইহার বিপরীত ধারণার ন্যায় এই ধারণাতেও, অনুরূপ বহু বিষয় সত্য বলিয়া ধরিয়া লওয়া হইয়াছে। যিনি বিচার দ্বারা দৃঢ়ভাবে এই ধারণায় উপনীত হন যে, আমরা আদৌ কতকগুলি ভৌতিক এককের সমষ্টি নই, পরন্তু ভৌতিক পদার্থের সীমানার বাহিরে এক অখণ্ড বস্তু, যাহা ঐ ভৌতিক পদার্থগুলিকে আলগাভাবে ধরিয়া রাখিয়াছে, তাহার নিকট সমভাবেই একথা সত্য যে, আমরা প্রকৃতপক্ষে এইমাত্র জানি “দেহই আসে ও যায়।”
এইরূপে ক্রমাগত মানুষকে শরীরের পরিবর্তে আত্মা বলিয়া চিন্তা করিবার উপর জোর দেওয়ায়, যাহারা স্বামীজীর সঙ্গলাভ করিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট মৃত্যু আর একটা অবশ্যম্ভাবী অন্তিম অবস্থা (যাহার পর আর কিছু নাই) বলিয়া বোধ হয় না; মৃত্যু তাহাদের নিকট আত্মার অবিচ্ছিন্ন অনুভূতিরূপ শৃঙ্খলের একটা আংটা মাত্র বলিয়া প্রতীত হয়। এইরূপে আমাদের সমগ্র দৃষ্টিকেন্দ্রের পরিবর্তন ঘটিয়া গেল। আলোকিত কক্ষের পরিবর্তে জীবন আমাদের নিকট মোহ ও অজ্ঞানময় কারাগারে অথবা বিচ্ছিন্ন ক্ষণিক চেতনাময় স্বপ্নে সঞ্চরণ বলিয়া বোধ হইল। বাক্যোচ্চারণ কি চিরকাল মানবীয় ভাষার দ্বারা পরিচ্ছিন্ন ও নিয়ন্ত্রিত থাকিয়া যাইবে? মধ্যে মধ্যে আমরা কি এই সকলের পারে অবস্থিত এমন একটা কিছুর ক্ষণিক আভাস পাই না, এমন এক সত্তার, বাক্যের সাহায্য ব্যতীত যাহা আমাদের কার্যে প্রবৃত্ত করায়, বাহ্য শিক্ষার অপেক্ষা না করিয়া যাহা আমাদের অন্তর জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করে যাহা অপরোক্ষ, গভীর এবং প্রাণে প্রাণে উপলব্ধিস্বরূপ? জ্ঞান কি চিরকালই সসীম এবং অস্পষ্ট পুরাতন ইন্দ্রিয়-অনুভূতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত থাকিবে আর চিরদিন কঠোর ও সঙ্কীর্ণ আচরণবিধির মাধ্যমেই আত্মপ্রকাশ করিবে? নিউ ইয়র্কে প্রদত্ত একটি বক্তৃতায় স্বামীজী যেন প্রাণের গভীর কাতরতা হইতে বলিয়া উঠিয়াছিলেন, “অনন্ত অসীম স্বপ্নদ্রষ্টী মানব সান্ত পরিচ্ছিন্ন স্বপ্নে মগ্ন!”
এইপ্রকার ধারণাসমূহ অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দর্শন, তাহার নিজের সর্বদা মৌনাবলম্বনপূর্বক গম্বরমাত্র হইয়া গঙ্গার তীরে প্রব্রজ্যার একান্ত আকাঙক্ষা, সমাধি অবস্থালাভই একমাত্র বাঞ্ছনীয় জ্ঞান বলিয়া অবিরত নির্দেশ প্রদান এবং আত্মার স্বাধীনতার পক্ষে জাগতিক সম্বন্ধগুলি বন্ধন ও বিঘ্নস্বরূপ এই দৃষ্টিভঙ্গি—প্রকৃতপক্ষে এইসকল উপায়ে স্বামী বিবেকানন্দ তাহার অন্তরঙ্গ ভক্তগণের হাতে যেন একটা মাপকাঠি দিয়া গিয়াছিলেন, যাহা দ্বারা প্রকৃত সত্তা কি, তাহা নিরূপণ করা চলে। ইহার ফলে শরীর নাশের সঙ্গে সঙ্গে ঐ প্রকৃত সত্তার মধ্যে কোন গুরুতর পরিবর্তন ঘটিতে পারে, এ ধারণা ক্রমশঃ তাঁহাদের নিকট অসম্ভব বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। এই ধারণা আমাদের মজ্জাগত হইয়াছিল যে, জীবনের আনুষঙ্গিক সুখ-দুঃখ প্রভৃতি একটা ক্ষণস্থায়ী স্বপ্নের বাহ্য অবয়ব মাত্র, এবং স্পষ্ট বোধ করিতাম, আমাদের এই জীবনযাত্রা মৃত্যুর পূর্বের ন্যায় মৃত্যুর পরেও বর্তমানের মতো অব্যাহত থাকিবে; কেবল এইটুকু পার্থক্য ঘটিবে যে, মৃত্যুর পরে সূক্ষ্মতর দেহ অবলম্বনহেতু গতির তীব্রতা বর্ধিত হইবে। আর ইহাও আমাদের নিকট স্পষ্টতর হইয়াছিল যে, তিনি যেমন বলিতেন—ইহজীবনের কর্মপ্রসূত ‘অনন্ত’ স্বর্গ অথবা নরক একটা অবাস্তব কথার কথামাত্র, সসীম কারণ কোন উপায়ের মাধ্যমেই অনন্ত ফল প্রসব করিতে পারে না।
তথাপি স্বামীজী এ বিষয়ে অপরের মানিয়া লইবার জন্য কোন বাধাধরা সিদ্ধান্ত নির্দেশ করেন নাই। যাহারা তাহার নিকট থাকিতেন, তাঁহাদের তিনি সত্য সম্পর্কে নিজ দর্শন-শক্তি সহায়ে এবং উপলব্ধ সত্যকে ভাষায় প্রকাশ করিবার জন্য যে চেষ্টা করিতেন তাহারই প্রভাবে, একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজ নিজ ক্ষমতানুযায়ী তাহারা যতদূর পারেন ততদূর তাহাদের লইয়া যাইতেন। কিন্তু কোন অপরিবর্তনীয় মতামতের তিনি ধার ধারিতেন না, এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার একান্ত বিরোধী ছিলেন। যেমন পূর্বেই বলা হইয়াছে, যত দিন যাইতে লাগিল, মৃত্যুর পর আত্মার কি গতি হয়?—এই প্রশ্নের উত্তরে তাহার একমাত্র বক্তব্য হইয়া দাঁড়াইল, “আমি বলতে পারি না।” তাহার মতে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করিয়া নিজের বিশ্বাস গঠন করিয়া লইতে হইবে। কাহারও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের স্বাধীন পরিণতির পথে তাঁহার মুখের কোন কথা যেন বাধা প্রদান না করে।
তবে কয়েকটি জিনিস আমরা লক্ষ্য করিয়াছিলাম। মৃত্যুর পর যাহারা অর্থে চলিয়া গিয়াছেন সেই সব পরলোকগত ব্যক্তির সহিত আমরা মিলিত হই এবং নানা বিষয়ের প্রসঙ্গ করিয়া থাকি, লোকের এই প্রচলিত বিশ্বাস তাহারও ছিল বলিয়া বোধ হয়। শ্রীরামকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করিয়া খেয়ালী অথচ কোমল ভাষায় হাসিতে হাসিতে তিনি বলিতেন, “যখন বুড়োর সামনে দাঁড়াব, তখন যেন আমাকে জবাবদিহি না করতে হয়। এই ধারণার বিরুদ্ধে তাহাকে প্রবল ওজর-আপত্তি করিতে শুনি নাই। জীবনের নানা সত্য ঘটনার অন্যতমরূপে ইহাকে তিনি অতি সহজভাবে গ্রহণ করিতেন।
যিনি একবার নির্বিকল্প সমাধিতে আরোহণ করিয়াছেন, গন্তব্যপথে তিনি নিশ্চয়ই নানাপ্রকার মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়া গিয়াছেন, যাহা অশরীরী অবস্থারই অনুরূপ। ঐকালে তাহার এমন অনেক উপলব্ধি হইয়া থাকিবে, সাধারণতঃ আমরা যাহা হইতে বঞ্চিত। স্বামীজী বিশ্বাস করিতেন যে, মধ্যে মধ্যে মৃত ব্যক্তিগণের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হইয়াছে। অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা সম্বন্ধে (ভূতপ্রেতাদি) একজন নিজের ভয়ের বিষয় উল্লেখ করিলে স্বামীজী বলেন, “ইহা কাল্পনিক মাত্র। যেদিন তুমি সত্যই ভূত দেখবে, সেদিন তোমার আর কোন ভয় থাকবে না।” তাহার গুরুভ্রাতাদের মধ্যে এই সম্বন্ধে একটি গল্প প্রচলিত আছে। একবার মাদ্রাজে কয়েকজন আত্মহত্যাকারীর প্রেতাত্মা স্বামীজীর নিকট আর্বিভূত হইয়া তাহাদের দলে যোগ দিবার জন্য তাহাকে পীড়াপীড়ি করে। তাহার জননী পরলোকগমন করিয়াছেন এই বলিয়া ঐ প্রেতাত্মারা তাহাকে বিলক্ষণ বিচলিত করে। অনুসন্ধান দ্বারা স্বামীজী জানিতে পারেন, তাঁহার মাতা কুশলে আছেন। অতঃপর ঐ প্রেতাত্মাগণকে তিনি মিথ্যাভাষণের জন্য তিরস্কার করেন। উত্তরে তাহারা বলে, তাহারা বর্তমানে এত অশান্তি ও যন্ত্রণার মধ্যে রহিয়াছে যে, সত্য অথবা মিথ্যা বলা সম্পর্কে তাহাদের কোন খেয়াল নাই। মুক্তিলাভের জন্য তাহারা স্বামীজীর নিকট প্রার্থনা করে। তিনিও রাত্রিকালে তাহাদের শ্রাদ্ধকৰ্ম করিবার উদ্দেশ্যে সমুদ্রতীরে গমন করেন। কিন্তু শ্রাদ্ধকৰ্ম উপলক্ষে যেখানে পিণ্ডদানের ব্যবস্থা আছে, সেখানে গিয়া যখন দেখিলেন, পিণ্ড দিবার কোন ব্যবস্থা নিকটে নাই তখন, প্রথমে তিনি কি করিবেন ভাবিয়া পাইলেন না। অতঃপর এক প্রাচীন শাস্ত্রবচন তাহার মনে পড়িল যে, অন্ন পিণ্ডের অভাবে বালুকার পিণ্ড দেওয়া যাইতে পারে। তখন তিনি অঞ্জলি ভরিয়া বালুকা গ্রহণ করিয়া সমুদ্রতটে দাঁড়াইয়া মৃত ব্যক্তিগণের উদ্দেশে সর্বান্তঃকরণে আশীর্বাদ করিতে করিতে ঐ পিণ্ড সমুদ্রে নিক্ষেপ করিলেন। সেইসব প্রেতাত্মারাও শান্তিলাভ করে এবং আর কখনও তাহাকে বিরক্ত করে নাই।
আর একটি অভিজ্ঞতাও তিনি কখনও বিস্মৃত হইতে পারেন নাই—শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পরবর্তী সপ্তাহে তাঁহার চকিত দর্শনলাভ। তখন রাত্রিকাল; স্বামীজী ও অপর একজন কাশীপুরের বাড়ির বাহিরে বসিয়া কথাবার্তা বলিতেছিলেন। যে দুর্বিষহ শোক ঐকালে তাহাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত করিয়া রাখিয়াছিল, সন্দেহ নাই, তাহারই প্রসঙ্গ চলিতেছিল। মাত্র কয়েকদিন পূর্বে গুরুদেব তাহাদের পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। সহসা স্বামীজী দেখিলেন, এক জ্যোতির্ময় মূর্তি উদ্যানে প্রবেশপূর্বক তাহাদের দিকে অগ্রসর হইতেছে। কয়েক মুহূর্ত পরে তাহার বন্ধু রুদ্ধকণ্ঠে অস্ফুটস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “ওকি দেখলাম, কি দেখলাম?” দুই ব্যক্তির একই সময়ে কোন ছায়ামূর্তি দর্শনের ঘটনা অতি বিরল। বর্তমান ক্ষেত্রে কিন্তু তাহাই ঘটিয়াছিল।
এই প্রকার অনুভূতি যিনি লাভ করেন, তাহার মনের মধ্যে উহা সহজেই কতকগুলি বিশ্বাস উৎপাদন করিয়া থাকে। ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দের আগস্ট মাসে ‘সহস্র দ্বীপোদ্যান’ হইতে লিখিত এক পত্রে স্বামীজী উক্ত বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, “যতই বয়স বাড়িতেছে, ততই স্পষ্টই দেখিতে পাইতেছি, কেন হিন্দুগণ মানুষকেই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী বলিয়া থাকেন। যাহারা পরলোক গমন করিয়াছে, তাহারাই একমাত্র তথাকথিত উচ্চতর শ্রেণী, কিন্তু তাহারাও অপর সূক্ষ্মদেহধারী মানুষ ব্যতীত আর কিছু নয়। সত্য, ঐ দেহ সূক্ষ্মতর কিন্তু হস্তপদবিশিষ্ট মানুষেরই দেহ। তাহারা এই পৃথিবীর অপর কোন স্তরে বাস করে, এবং একেবারে অদৃশ্যও নহে। তাহারাও চিন্তা করে, আমাদের মতো তাহাদেরও মন, চৈতন্য ইত্যাদি সবই আছে। অতএব তাহারাও মানুষ। দেবগণ ও দেবদূতগণও তাহাই। কিন্তু কেবল মানুষই ব্ৰহ্মস্বরূপ হয় এবং ঐ ব্ৰহ্মত্ব লাভ করিবার জন্য অপর সকলকে পুনরায় মানবজন্ম গ্রহণ করিতে হয়।”
আমাদের গুরুদেবকে ‘আপ্তপুরুষ’ বলিয়া যাহাদের বিশ্বাস, তাহাদের নিকট পূর্বোক্ত উক্তিসকলের একটি নিজস্ব মূল্য থাকিবে। তারা প্রাণে প্রাণে অনুভব করিবেন, যেখানে স্বামীজী শুধু কোন অনুমান অথবা মত প্রকাশ করিতেছেন মাত্র, সেখানেও ঐ মতবাদ কোন অনন্যসাধারণ উপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত।
আমেরিকায় তাঁহার প্রথম পর্বের কাজ প্রায় শেষ হইবার পর, ১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে ইংলণ্ড আগমনের অব্যবহিত পূর্বে, তিনি তাঁহার ধর্মপ্রচার কার্য সুসম্বদ্ধ করিবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন বলিয়া বোধ হয়। মনে হয়, প্রথমে তাহার জ্ঞান ও চিন্তাসম্পদ অকাতরে দান করিবার পর, তিনি উহাদের বিশালতা উপলব্ধি করেন, স্পষ্টভাবে উহাদের বিশেষত্ব দেখিতে পান এবং বুঝিতে পারেন যে, এখন কয়েকটি প্রধান ভাবাদর্শকে কেন্দ্র করিয়া উহাদের একত্র গ্রথিত ও সংহত করা চলিতে পারে। সম্ভবতঃ ঐ কার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াই তিনি হৃদয়ঙ্গম করেন যে, সর্বসম্মতরূপে বেদান্তকে গ্রহণীয় করিতে হইলে দেহান্তে আত্মার গতি সম্পর্কে কিছু বলা অবশ্যই প্রয়োজন। ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্রথম ইংলণ্ড আগমনকালে জনৈক ইংরেজ বন্ধুকে লিখিত তাঁহার পত্র হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কোন ধর্মমতকে সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ করিবার জন্য, উহাতে কোন্ কোন্ বিষয়ের সমাবেশ থাকা আবশ্যক, সে সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন। বর্তমান ক্ষেত্রে দুইজন যুবকের সাক্ষাৎকার কর্মকাণ্ডের আবশ্যকতার প্রতি তাহার দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। যুবকদ্বয় সেই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, “যাহারা দর্শনশাস্ত্রের দিক হইতে ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করিয়া থাকেন, অলৌকিক রহস্যাদির সহিত কোন প্রকার সম্পর্ক রাখেন না।” তিনি লিখিয়াছিলেন, “এই ব্যাপার আমার চোখ খুলিয়া দিয়াছে। সাধারণ লোকের জন্য কোন প্রকার অনুষ্ঠান অত্যন্ত আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ দৃষ্টিতে ধর্ম শুধু প্রতীকাদি ও কর্মকাণ্ডের সাহায্যেই বাস্তব দর্শনে পরিণত হয়। কেবল শুষ্ক দর্শন মানুষের উপরে তেমন প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না।”
এইরূপে যে সংগঠনমূলক কল্পনা (যাহা শুধু ভাঙে না, নূতন কিছু গড়িতে চায়) তাহার মধ্যে উদ্বুদ্ধ হইয়াছিল, তাহার উল্লেখ উপরি-উক্ত বন্ধুকে লিখিত পরবর্তী দুই-তিনখানি পত্রে দেখিতে পাওয়া যায়। জনৈক বিখ্যাত তড়িৎ-তত্ত্ববিদের সহিত আলাপ-আলোচনার উত্তেজনা তখনও পর্যন্ত মনে ক্রিয়াশীল থাকায় তিনি একখানি পত্রে প্রাণ ও জড়ের সম্পর্করূপ সমস্যাটির সম্মুখীন হন, এবং মৃত্যু সম্বন্ধে হিন্দুশাস্ত্রে নিহিত যে তথ্য তাহার নিকট তাৎপর্যপূর্ণ বলিয়া বোধ হয়, উহার একটি সংক্ষিপ্ত সার সঙ্কলন করিয়া দেন। পত্রখানি পড়িলেই সহজেই বুঝা যায় যে, প্রাচীন ভারতীয় চিন্তা ও আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে সাদৃশ্য দেখিয়া তিনি বিশেষ আনন্দ অনুভব করেন। তিনি লেখেন, “আমাদের বন্ধু বেদান্তোক্ত প্রাণ, আকাশ ও কল্পের তত্ত্বশ্রবণে মুগ্ধ হইয়াছেন; তাহার মতে এইসব তত্ত্বই কেবল আধুনিক বিজ্ঞানের গ্রাহ্য। এই প্রাণ ও আকাশ উভয়েই সমষ্টি মহৎ বা সমষ্টি মন বা ব্রহ্মা অথবা ঈশ্বর হইতে উৎপন্ন। তিনি মনে করেন, গণিতশাস্ত্রের দ্বারা প্রমাণ করা যায় যে, প্রাণ ও জড় উভয়কেই অব্যক্ত শক্তিতে পরিণত (রূপান্তরিত করা যাইতে পারে। আগামী সপ্তাহে তাহার নিকট গিয়া ঐ নূতন গণিতের প্রমাণ দেখিয়া আসিব, এইরূপ স্থির আছে।
“তাহা হইলে বৈদান্তিক সৃষ্টিতত্ত্ব অতীব দৃঢ়ভিত্তির উপর স্থাপিত হইবে। বর্তমানে আমি বেদান্তের সৃষ্টিতত্ত্ব ও জীবাত্মার গতি সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করিতেছি। আধুনিক বিজ্ঞানের সহিত উহাদের সম্পূর্ণ ঐক্য আমি স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি, এবং একটি তত্ত্বের সরল প্রতিপাদন দ্বারা অপর তত্ত্বটিও সহজ হইয়া যাইবে। পরে প্রশ্নোত্তর আকারে একখানি গ্রন্থ লিখিবার ইচ্ছা আছে। ঐ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় হইবে সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক, এবং উহাতে বৈদান্তিক তত্ত্বসমূহ ও আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে সামঞ্জস্য প্রদর্শন করা হইবে।
“জীবাত্মার গতি কেবল অদ্বৈত দৃষ্টিকোণ হইতে ব্যাখ্যা করা হইবে। অর্থাৎ দ্বৈতবাদীর মতে মৃত্যুর পর জীবাত্মা যথাক্রমে সূর্যলোক, চন্দ্রলোক ও বিদ্যুৎ-লোকে উত্তরণ করেন, সেখান হইতে এক অলৌকিক পুরুষ তাহাকে সঙ্গে করিয়া ব্ৰহ্মলোকে লইয়া যান। (অদ্বৈতবাদী বলেন, সেখান হইতে তিনি নির্বাণ প্রাপ্ত হন।)
“অদ্বৈতমতে আত্মা গমনাগমন করেন না, এবং এই সব লোক বা জগতের বিভিন্ন স্তর আকাশ ও প্রাণের সংযোগে উৎপন্ন বিভিন্ন পরিণাম মাত্র। অর্থাৎ সর্বনিম্ন বা সর্বাপেক্ষা ঘনীভূত স্থূল স্তর হইল সূর্যলোক—যেখানে প্রাণের প্রকাশ জড়শক্তিরূপে এবং আকাশ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জড়পদার্থরূপে প্রকাশ পায়। ইহার পর সূর্যলোক বেষ্টন করিয়া অবস্থিত চন্দ্রলোক। চন্দ্রলোক বলিতে আদৌ চন্দ্ৰ বুঝায় না—পরন্তু উহাদেবতাদের আবাসস্থল, অর্থাৎ প্রাণ মনঃশক্তিরূপে এবং আকাশ তন্মাত্রারূপে প্রকাশ পায়। অতঃপর বিদ্যুৎ-লোক, অর্থাৎ এমন একটি অবস্থা যেখানে প্রাণ আকাশ হইতে প্রায় অবিচ্ছেদ, এবং বিদ্যুৎ প্রাণ অথবা জড়, তাহা ঠিক করিয়া বলা কঠিন। পরবর্তী স্তর ব্রহ্মলোক, সেখানে প্রাণ বা আকাশ কিছুই নাই, উভয়েই মহৎ অথবা আদিশক্তিতে লীন হইয়া গিয়াছে। প্রাণ অথবা আকাশ কিছুই না থাকায় এই অবস্থায় জীব সমগ্র জগৎকে সমষ্টি মহৎরূপে ভাবনা করেন। এই অবস্থা বৈরাজ-পুরুষরূপে প্রতিভাত হয়, তথাপি ইহা ব্ৰহ্ম নহে, কারণ তখনও বহুত্বের ভাব রহিয়াছে। এখান হইতে অবশেষে জীব সেই একত্বে উপনীত হন, উহাই চরম লক্ষ্য। অদ্বৈতবাদ বলে, এই বিভিন্ন অবস্থান্তর বা পরিণাম জীবের মনে ক্রমান্বয়ে উদিত কল্পনামাত্র; জীব স্বয়ং আসেন না বা যান না; এবং এইরূপেই বর্তমান পরিদৃশ্যমান জগতের সৃষ্টি হইয়াছে। সৃষ্টি ও প্রলয় একই পর্যায়ক্রমে ঘটিয়া থাকে, কেবল একটির অর্থ বিকাশ অন্যটির অর্থ সঙ্কোচ।
“এখন যেহেতু প্রত্যেক ব্যক্তি কেবল নিজের মধ্যেই জগৎ উপলব্ধি করিতে পারে, সেই হেতু ঐ জগৎ তাহার বন্ধনের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্ট এবং তাহার মুক্তিতেই উহার লয়—যদিও অন্যান্য বদ্ধ ব্যক্তিগণের পক্ষে উহা বর্তমান থাকে। নামরূপ লইয়াই জগৎ। সমুদ্রের একটি তরঙ্গ ততক্ষণই তরঙ্গ, যতক্ষণ উহা নামরূপের দ্বারা পরিচয়। তরঙ্গ অবস্থা চলিয়া গেলে উহা সমুদ্র হইয়া যায়, কিন্তু তখন ঐ নামরূপ তৎক্ষণাৎ চিরদিনের মতো অন্তর্হিত হইয়া যায়। অতএব যে জল নামরূপ দ্বারা পরিচ্ছিন্ন হইয়া তরঙ্গাকারে পরিণত হইয়াছিল, সেই জল ব্যতীত তরঙ্গের ঐ নামরূপের অস্তিত্ব থাকিতে পারে না, কিন্তু নামরূপ তরঙ্গ নয়। তরঙ্গ জলে মিলিয়া যাইলেই ঐ নামরূপ চিরকালের জন্য বিনাশপ্রাপ্ত হয়, কিন্তু অন্যান্য তরঙ্গের সম্বন্ধে অপরাপর নামরূপ তখনও বিদ্যমান থাকে। এই নামরূপই মায়া, আর ঐ জল ব্ৰহ্ম। তরঙ্গ সর্বদা জল ব্যতীত অন্য কিছুই ছিল না, তথাপি যতক্ষণ উহা তরঙ্গপদবাচ্য ছিল, ততক্ষণ উহার নামরূপও ছিল। আবার ঐ নাম রূপ এক মুহূর্তের জন্যও তরঙ্গ হইতে পৃথক থাকিতে পারে না যদিও জলাকারে ঐ তরঙ্গ অনন্তকাল নামরূপ হইতে পৃথক থাকিতে পারে। কিন্তু যেহেতু নামরূপকেকোন পদার্থ হইতে পৃথক করা যায় না, সেই হেতু নামরূপ সৎ পদার্থ এ কথা বলা চলে না—অর্থাৎ তাহাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নাই। তথাপি তাহারা শূন্য নহে—ইহাই মায়া।
“এই সব আমি সাবধানে ও বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করিতে চাই, কিন্তু আপনি এক নজরেই বুঝিতে পারিবেন যে, আমি ঠিক পথে চলিয়াছি। এই কাজের জন্য আমাকে আরও বেশি করিয়া শারীরবিজ্ঞান পড়িতে হইবে, উচ্চতর ও নিম্নতর কেন্দ্রগুলির পরস্পরের মধ্যে কি সম্বন্ধ তাহা নির্ণয় করিতে হইবে। মনস্তত্বের মন, চিত্ত, বুদ্ধি ইত্যাদি কাহার কতটুকু ক্রিয়া প্রভৃতি সব ঠিক করিয়া লইতে হইবে। কিন্তু এখন আমি স্পষ্ট আলো দেখিতে পাইতেছি, তাহার মধ্যে আর কোন ভোজবাজি বা অস্পষ্টতা নাই।”
আবার এই পত্রে, অন্যান্য বহুস্থলের ন্যায়, আমরা স্বামীজীর প্রতিভার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান ও সংগঠন করিবার শক্তির পরিচয় পাই। আচার্য শঙ্কর যে উচ্চাদর্শ স্থাপন করিয়া গিয়াছেন, তাহার কোনরূপ নড়চড় হইবে না। “আত্মা আসেনও না, যানও না”, এই বাক্য চিরকালের জন্য সকল সত্যের উপর প্রাধান্য লাভ করিবে। কিন্তু যাহারা অপর প্রান্ত হইতে কার্য আরম্ভ করিয়াছেন, তাহাদের পরিশ্রমও বৃথা যাইবে না, অদ্বৈতবাদীর দার্শনিক সূক্ষ্মদৃষ্টি এবং দ্বৈতবাদীর মনের পূর্বাপর বিভিন্ন অবস্থার বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ—উভয়ই পরস্পরের এবং নূতন ধর্মব্যাখ্যার পক্ষে আবশ্যক।(২)
মৃত্যু জিনিসটা অবশ্য বাহির হইতে দেখিলেই যথার্থ অনুধাবন করা যায়। ব্যক্তিগত বিচ্ছেদের মধ্যে এই চিরন্তন নিয়তির মহান সত্যগুলি আমরা তত স্পষ্টরূপে দেখিতে পাই না; গভীর বন্ধুত্ব ও ভালবাসার প্রভাবে যখন অপরের দুঃখে আমাদের সহানুভূতি বিচিত্রভাবে উদ্বেলিত হয়, তখনই উহাদের স্পষ্ট উপলব্ধি হয়। যে সান্ত্বনার উপর আমরা নিজেদের বেলায় নির্ভর করিতে সাহসী হই না, তাহা অপরের জন্য অন্বেষণ করিতে গেলে মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট, দৃঢ় বিশ্বাসরূপে প্রতিভাত হয়। স্বামীজীও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিলেন না, এবং সম্ভবতঃ আমাদের মধ্যে অনেকে এ সম্বন্ধে তাঁহার সর্বশ্রেষ্ঠ উক্তি একখানি পত্রের মধ্যে দেখিতে পাইবেন। পত্রখানি যে আমেরিকাবাসিনী মহিলাকে তিনি ধীরামাতা’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন, তাঁহার পিতৃবিয়োগ উপলক্ষে লিখিত। এই পত্রে তাহার বিশ্বাসের সারবত্তা গভীর আত্মীয়তা ও সহানুভূতির দ্বারা সঞ্জীবিত দেখিতে পাই, এবং মৃত্যুর পর আমাদের প্রিয়জনের গতি সম্পর্কে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়।
১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ব্রুকলীন হইতে তিনি এই শোকসন্তপ্তা মহিলাকে লেখেন, “আপনার পিতা যে তাহার জীর্ণ শরীর ত্যাগ করিবেন, তাহার কতকটা আভাস আমি পূর্বেই পাই, আর যখন কোন ভাবী অপ্রিয় মায়ার তরঙ্গ কাহাকেও আঘাত করিতে উদ্যত দেখি, তখন তাহাকে পত্র লেখা আমার ___ । কিন্তু এইগুলিই জীবনের মহাসন্ধিক্ষণ, এবং আমি জানি, আপনি _____ বিচলিত আছেন। সমুদ্রের উপরিভাগ পর্যায়ক্রমে উঠে ও নামে বটে, কিন্তু সেই সাক্ষিস্বরূপ, জ্যোতির তনয়ের নিকট প্রত্যেক পতন সমুদ্রের গভীরতা এবং তাহার তলদেশস্থ অসংখ্য মণি-মুক্তা ও প্রবালস্তরকে অধিকতররূপে প্রকাশ করিয়া থাকে। আসা-যাওয়া সম্পূর্ণ ভ্ৰমমাত্র। আত্মা কখনও আসেনও না, যানও না। যখন সমুদয় দেশই আত্মার মধ্যে অবস্থিত, তখন সে স্থানই বা কোথায়, যেখানে আত্মা যাইতে পারেন? যখন সমগ্র কালই আত্মাতে অবস্থিত, তখন সে সময়ই বা কোথায় যখন, আত্মা শরীরাভ্যন্তরে প্রবেশ এবং তাহা পরিত্যাগ করিবেন?
“পৃথিবী ঘুরিতেছে, তাহাতেই ভ্রম হয়, সূর্য আকাশ পরিক্রম করিতেছে; সূর্য কিন্তু স্থির আছেন। সেইরূপ প্রকৃতি বা মায়া অথবা স্বভাব গতিশীল, পরিবর্তনশীল—আবরণের পর আবরণ উন্মোচন করিতেছেন, এই মহান গ্রহের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাইতেছেন, আর সাক্ষিস্বরূপ আত্মা অবিচলিত, অপরিবর্তিত থাকিয়া জ্ঞানামৃত পানে বিভোর। যত জীবাত্মা পূর্বে ছিল, বর্তমানে আছে, অথবা ভবিষ্যতে থাকিবে, সকলেই এখনই রহিয়াছে, আর জড় জগতের একটি উপমা গ্রহণ করিলে বলা যায়, তাহারা সকলেই এক জ্যামিতিক বিন্দুতে অবস্থিত। যেহেতু আত্মাতে দেশবোধ নাই, অতএব যাহারা আমাদের ছিলেন, রহিয়াছেন এবং ভবিষ্যতে আমাদের হইবেন, তাহারা সকলেই সর্বদা আমাদের সঙ্গে রহিয়াছেন, সর্বদা সঙ্গে ছিলেন এবং পরেও সর্বদা আমাদের সঙ্গে থাকিবেন। আমরা তাঁহাদের ভিতর রহিয়াছি, তাহারাও আমাদের ভিতর অবস্থিত।
“এই কোষগুলির কথা ধর। যদিও তাহারা প্রত্যেকটি পৃথক, তথাপি সকলেই ক ও খ-তে সম্মিলিতভাবে যুক্ত। এইখানে তাহারা এক। প্রত্যেকে এক একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি (বস্তু), তথাপি সকলেই ঐ ক, খ অক্ষরেখায় এক। কেহই ঐ অক্ষরেখা হইতে সরিয়া যাইতে পারে না, এবং উহাদের কোনটি অক্ষরেখা হইতে যতই পৃথক্ হইয়া যাইবার চেষ্টা করুক, তথাপি ঐ অক্ষরেখায় দণ্ডায়মান হইয়া আমরা যে কোন কক্ষে প্রবেশ করিতে পারি। এই অক্ষরেখাই ঈশ্বর। এখানে আমরা তাহার সহিত এক, এখানে আমরা সকলেই পরস্পরের মধ্যে এবং সকলেইঈশ্বরে অবস্থিত।
চাঁদের উপর দিয়া মেঘ চলিয়া যায়; এবং তাহাতেই ভ্রম হয় যেন চাঁদ চলিয়া যাইতেছে। সেইরূপ প্রকৃতি, দেহ ও জড় পদার্থ সকলেই গতিশীল, তাহাতেই ভ্রম হইতেছে যেন আত্মা গতিশীল। সুতরাং অবশেষে আমরা দেখিতে পাই যে, যে সহজাত জ্ঞান (অথবা দৈব প্রেরণা?) বশে সর্বজাতির উচ্চ-নীচ সবরকম ব্যক্তি মৃতব্যক্তিগণের সান্নিধ্য—যেন তাহারা নিকটে আসিয়াছে এইরূপ অনুভব করে, যুক্তির দৃষ্টিতেও উহা সত্য।
“প্রত্যেক জীবাত্মাই এক একটি নক্ষত্রস্বরূপ, আর এই সব নক্ষত্ররাজি ঈশ্বররূপী সেই অনন্ত নীলিমায়, সেই অনাদি অনন্ত আকাশে বিন্যস্ত। সেখানেই প্রত্যেক জীবাত্মার মূল, যথার্থ সত্তা এবং প্রকৃত ব্যক্তিত্ব নিহিত। কতকগুলি জীবাত্মারূপ তারকা, যাহারা আমাদের চক্রবালের বহির্ভূত হইয়া গিয়াছে তাহাদের অন্বেষণেই ধর্মের সূত্রপাত, এবং তাহাদের সকলকে সেই ঈশ্বরে এবং আমাদেরও সেই একই স্থলে অর্থাৎ ঈশ্বরের মধ্যে দেখিতে পাওয়ার মধ্যেই ধর্মের সমাপ্তি। সুতরাং সমগ্র রহস্য এই যে, আপনার পিতা পরিহিত জীর্ণ বস্ত্রখানি পরিত্যাগ করিয়াছেন, এবং যেখানে তিনি অনাদি অনন্তকাল ধরিয়া অবস্থিত সেখানেই রহিয়াছেন। এই জগতে বা অপর কোন জগতে তিনি কি আর একখানি অনুরূপ বস্ত্র সৃষ্টি করিবেন? আমার আন্তরিক প্রার্থনা যেন তাহাকে আর তাহানা করিতে হয়—যতক্ষণ না পূর্ণ জ্ঞানের সহিত তিনি উহা পারেন। ভগবৎসমীপে প্রার্থনা, কেহ যেন নিজ কৃতকর্মের অলক্ষ্য শক্তির দ্বারা বলপূর্বক কোথাও নীত না হয়। প্রার্থনা করি, সকলেই যেন মুক্ত হইয়া যাইতে পারে, অর্থাৎ জানিতে পারে যে, তাহারা মুক্তই আছে। আর যদি পুনরায় তাহাদের স্বপ্ন দেখিতে হয়, তবে আসুন আমরা সকলে প্রার্থনা করি, যেন তাহাদের স্বপ্ন শান্তি ও আনন্দপূর্ণ হয়।”
———–
১ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউবোপের মৃত্যু সম্পৰ্কীয় ধারণা কতকটা এইরূপ বলা যাইতে
পারে। একজন মনীষী বলিয়াছেন,
“আত্মা কি বীণাব তাকে উৎপন্ন ঝঙ্কারের মতো, অথবা বৈঠা
ধরিয়া নৌকায় উপবিষ্ট মাঝির মতো?” জড়পদার্থের সূক্ষ্মাবস্থাপ্রাপ্তি সম্বন্ধে অধুনা
প্রচলিত কথাবার্তা বৈজ্ঞানিকদের পক্ষেও একথা বলা সহজ করিয়া দিয়াছে যে, “একটা পরিণাম
অবস্থা (cycle)
কল্পনা করা—উহাকে মন’ বলিতে পার—যাহাতে জড়পদার্থ একপ্রকার নাই
বলিলেই চলে। কিন্তু তাহা হইলেও পাশ্চাত্য দেশমূহের জন্য বিশেষভাবে দেখানো প্রয়োজন যে, কিরূপে
ব্যষ্টি শরীর-মন এই সমষ্টি জড়পদার্থ ও মনকে আশ্রয় করে যাহাতে উভয়ই একাকার হইয়া যায়।
এখানে একথা বলা অভিপ্রায় নহে যে, সকল ধর্মে নীতিসম্মত আচরণ শেষ পর্যন্ত আত্মার
অমরত্বে বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে; এখানে শুধু অজ্ঞেয়বাদী ও হিন্দুধর্মের
মধ্যে যে বৈপরীত্য তাহাই প্রদর্শন করা হইতেছে। অজ্ঞেযবাদী নিচ হইতে উপরে উঠিয়া আধ্যাত্মিক
জীবন গঠন করিতে চাই;
হিন্দুধর্মমতে বিচার করিয়া দেখিলে আমাদের দেহবুদ্ধি আধ্যাত্মিক
জীবনের স্কুল বিকাশ ও আবরণ মাত্র। এই অধ্যাত্ম জীবনের অদম্য আকাঙক্ষা আত্মরক্ষার জন্য
নহে, আত্মোৎসর্গই উহার উদ্দেশ্য। আধুনিকগণ বিচার দ্বারা সৃষ্ট পদার্থ হইতে অদৃশ্যে পেীছাইতে
চান, বিশেষ হইতে সামান্যে-উপনীত হন, হিন্দুগণ সাধারণ বা সর্বজনীন হইতে
বিশেষের বিচার করেন এবং এই অভিমত পোষণ করেন যে, মৃত্যুর পর কিরূপ অবস্থা হয়, তাহা জানিবার
উহাই প্রকৃষ্ট বিচার পন্থা,
কারণ, প্রকৃতপক্ষে আমরা একমাত্র আত্মার জীবন সম্বন্ধেই
অবগত আছি।
২ স্বামীজীর প্রশ্নোত্তর আকারে একখানি পুস্তক লিখিবার সঙ্কল্পকার্যে পবিণত হইতে পারে নাই। কিন্তু ১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে তিনি লণ্ডনে যে-সকল বক্তৃতা প্রদান করেন, তাহা পাঠে সহজেই বুঝা যায় যে, এ-স্থলে তিনি যে-সব ভাবের ইঙ্গিত দিয়াছেন, ঐ সম্বন্ধে তখনও চিন্তা করিতেছেন। ব্রহ্ম’ ও ‘মায়া; ‘বহির্জগৎ’ এবং তাহার আমেরিকায় প্রদত্ত মানবের প্রকৃত স্বরূপ ও আভাসিক সত্তা এবং ‘সৃষ্টিতত্ত্ব’বক্তৃতাগুলি বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য।