মাওলানা ইদরিস মহাবিপদে পড়েছেন। কোনোদিন বগুড়ার মহাস্থান নামের জায়গা খুঁজে বের করতে পারবেন। এরকম মনে হচ্ছে না। পদে পদে বিপদে পড়ছেন। খাওয়া খাদ্য নিয়েও সমস্যা। চারদিকে অভাব। ভাতের দোকান বেশির ভাগই বন্ধ। তার খুঁতিতে টাকা আছে। টাকা দিয়েও খাওয়া পাওয়া যাচ্ছে না। কালীঘাটা নামে এক লঞ্চঘাটে নামার সময় তার ব্যাগ চুরি হয়ে গেল। তাকে একবস্ত্ৰে নামতে হলো। ব্যাগে কম্বল ছিল। রাত কাটত কম্বল মুড়ি দিয়ে। প্রচণ্ড শীতে এখন গায়ের পাঞ্জাবি সম্বল। কালীঘাটা থেকে এক্কা গাড়ি চলাচল করে। এক্কাওয়ালা তাকে উল্টোপথে নিয়ে গেল। জনমানবহীন এক বিরানভূমিতে নামিয়ে দিয়ে বলল, নাক বরাবর। হাঁটেন। জঙ্গলা পাবেন। জঙ্গলা পার হবেন, মহাস্থান পাবেন।
দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হেঁটে তিনি জঙ্গলা পার হলেন। মহাস্থান নামের এক কালীমন্দিরের দেখা পেলেন। মন্দিরের সেবায়েত ছোটখাটো মানুষ। মুখভর্তি জঙ্গুলো দাড়ি। দেখে মনে হয় মুসলমান। সে চাপা গলায় বলল, আপনে যাবেন বগুড়া। এটা রংপুর।
ইদরিস বললেন, এখন কী করব?
আপনি মুসলমান?
জি জনাব।
সঙ্গে টাকা পয়সা আছে?
আছে।
কত টাকা?
দুইশ টাকার সামান্য বেশি। পঁচিশ কিংবা ত্রিশ। শুনা নাই। টাকা রেখেছেন কোথায়?
আমার খুঁতিতে বান্ধা আছে।
দেখি।
ইদরিস কোমরে বাঁধা কাপড়ের থলি বের করে টাকা দেখালেন। লোকটা টাকা দেখতে চাচ্ছে কেন এটা বুঝলেন না।
সেবায়েত বলল, আপনি বোকা কিসিমের মানুষ। আমি টাকা দেখতে চেয়েছি আপনি দেখালেন। কাজটা ঠিক হয় নাই। আপনি বলবেন, আমি ফকির মানুষ, টাকা পয়সা নাই।
টাকা তো আছে। মিথ্যা বলা ঠিক না। আপনি যখন বলেছেন তখন মিথ্যা বলব। বাচার জন্যে মিথ্যা বলায় দোষ নাই।
সেবায়েত বলল, খাওয়াদাওয়া হয়েছে?
জি-না জনাব।
আমার বাড়িতে চলেন। খাওয়াদাওয়া করবেন। তারপরে দেখি কী করা যায়।
আপনার অনেক মেহেরবানি।
উঠানে বসে খাওয়াদাওয়া করবেন। মুসলমানকে বাড়িতে ঢুকাব না। এত বড় পাপ করতে পারব না।
ইদরিস বললেন, আপনার অনেক মেহেরবানি। আমাকে একটা চাদর কিনার ব্যবস্থা করে দেন। শীতে কষ্ট পাইতেছি।
চাদর পাবেন না। আশেপাশে দোকান নাই। থাকলেও সেখানে কাপড় নাই। বাড়িতে চলেন দেখি কথা দেওয়া যায় কি-না। মেয়েছেলের ব্যবহারী কাঁথা গায়ে দিতে আপনাদের ধর্মে কি বাধা আছে?
জি-না জনাব, আপনার অনেক মেহেরবানি।
ভাত খাওয়াতে পারব না। দেশে ভাত নাই। মিষ্টি আলু সিদ্ধ খাবেন। নুন কাঁচামরিচ দিয়ে মিষ্টি আলু সিদ্ধ পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু।
জনাব, রিজিকের মালিক আল্লাহপাক। উনি যা নির্ধারণ করে দেন। তাই খাওয়া লাগে। উনার কঠিন হিসাব, সেই হিসাবের বাইরে রাজা মহারাজাও যেতে পারেন না। আর আমি একজন নাদান মানুষ।
গ্রামের বাইরে ঝুপড়ি জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি। পাকাবাড়ি, তবে এখন ভগ্নদশা। বাড়িতে মনে হয় লোকজনও নাই। চারদিক সুনসান নীরব। বারান্দায় কুপি জুলছে। কুপির আলোয় অন্ধকার আরো বেড়েছে। অসুস্থ কোনো অতি বৃদ্ধা আছেন। তিনি ক্ৰমাগত কাশছেন। কাশির দমক একটু থামলেই বলছেন— যম কই রে। আয়। আমারে নিয়া যা। তোর চরণে ধরি।
ইদরিসের কয়েক বেলার নামাজ কাজী হয়ে গিয়েছিল। মাওলানা কাজা নামাজ শেষ করে খেতে বসলেন। বড় ঝকঝকে কাঁসার থালায় তাকে খেতে দেয়া হয়েছে। শুধু যে মিষ্টি আলু তা না, গুড় মাখানো ছাতু এবং একটা কলাও আছে। মাওলানা বসেছেন উঠানের এককোণে। তার সামনে কুপি জুলছে। মাওলানা খাওয়া শেষ করে হাত তুলে মোনাজাত শুরু করলেন
হে আল্লাহপাক। চরম অভাবের দিনে যারা আমাকে এত যত্ন করে খাইয়েছে তুমি তাদের প্রতি দয়া করা। তোমার রহমতের দরজা তুমি এদের জন্যে খুলে দাও। গাফুরুর রহিম তুমি দয়া কর। এদের প্রতি দয়া কর।
কপালে চওড়া করে সিঁদুর দেয়া ঘোমটা পরা একটা মেয়ে মাওলানার সামনে দাঁড়াল। তার হাতে ফুলতোলা কথা। মেয়েটা নরম গলায় বলল, কাঁথাটা গায়ে দেন। শীত অনেক বেশি।
মাওলানা বললেন, মা শুকারিয়া।
বৌটি গলা নামিয়ে বলল, এখন আমার কথা মন দিয়া শুনেন। সে আঙুল উঁচিয়ে বলল, তালগাছ কি দেখা যায়?
মাওলানা মাথা নাড়লেন। অনেক দূরে কুয়াশার মতো তালগাছ দেখা যাচ্ছে।
দৌড় দিয়া তালগাছ পর্যন্ত যাবেন। সেখানে নদী পাবেন। নদীর নাম করতোয়া। নদী বরাবর দক্ষিণমুখী হাঁটবেন। সারারাত হাঁটবেন। থামবেন না। আমার স্বামী লোক খারাপ। আপনার সঙ্গে টাকা পয়সা আছে আপনি তাকে বলেছেন। সে লোক আনতে গেছে। টাকা পয়সা কেড়ে নিবে। আপনাকে মেরেও ফেলতে পারে। এই কাজ সে আগেও কয়েকবার করেছে। দাঁড়ায়া আছেন কেন? দৌড় দেন।
মা, আপনার নাম?
আমার নামে আপনার প্রয়োজন নাই। যা করতে বললাম করেন। হাতে সময় নাই।
নামটা বলেন মা! কোনো একদিন খাস দিলে আল্লাহ পাকের দরবারে দোয়া করব।
আমার জন্যে দোয়া করতে হবে না। আমার স্বামীর জন্যে প্রার্থনা করবেন। যেন সে ভালো হয়ে যায়। আমার স্বামীর নাম লক্ষণ দেওয়ান।
বৃদ্ধা মহিলা ঘরের ভেতর থেকে কাশতে কাশতে ডাকছে, ও বৌমা! ও বৌমা!
বৌটি কুপি নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। মাওলানা দৌড়াতে শুরু করলেন। অচেনা অজানা বৌটির কথা ভেবে চোখে পানি আসছে। এখন অশ্রুবর্ষণের সময়। মেয়েটার জন্যে আল্লাহপাকের দরবারে খাস দিলে প্রার্থনা করতে হবে। মেয়ের স্বামীর জন্যেও করতে হবে। স্বামীর নাম লক্ষণ দেওয়ান। আজকাল তার নাম মনে থাকে না। এই নাম কি মনে থাকবে? লক্ষণ দেওয়ান, লক্ষণ দেওয়ান, লক্ষণ দেওয়ান। বিপদ থেকে উদ্ধার পেলেই নফল রোজা রেখে এই কাজটা করবেন।
রাত দশটার মতো বাজে। শীতের রাত বলেই নিশুতি মনে হচ্ছে। বান্ধবপুর বাজারের সব ঘরের বাতি নেভানো। লঞ্চঘাটায় কিছু আলো আছে। লাবুস পাকা পুলের উপর বসে আছে। পুলের মাথায় প্রকাণ্ড জামরুল গাছ। গাছভর্তি জোনাকি পোকা একসঙ্গে জুলছে নিভছে। দেখতে সুন্দর লাগছে। একটি জোনাকি অন্য একটির সঙ্গে কথা কীভাবে বলে? আলোর সংকেতে? জোনাকি পোকাদের কথা বুঝতে পারলে কত কী জানা যেত।
গায়ে কালো কম্বল জড়িয়ে কে যেন এদিকেই আসছে। লাবুসকে দেখে সে জামরুল গাছের আড়ালে চলে গেল। লাবুস বলল, কে?
আমি করিম। ইমাম করিম।
গাছের পিছনে লুকায়ে আছেন কেন?
তোমাকে দেখে শরমিন্দা হয়েছি বিধায় লুকায়ে আছি।
শরমিন্দা হয়েছেন কেন?
আমি সবের কাছেই শরমিন্দা। যার স্ত্রী অন্যের দখলে সে তো শরমিন্দা হবে। এটা জগতের নিয়ম। স্ত্রী অন্যের সঙ্গে ঘুমায়, এই কষ্ট তুমি বুঝবা না। তুমি শাদি করা নাই।
জোর করে কেউ আপনার স্ত্রী দখল করে নাই।
তাও ঠিক। আমার কপাল মন্দ।
আপনি সামনে আসেন। একটা বিষয় নিয়া আলাপ করি।
করিম এগিয়ে এলেন। লাবুসের পাশে বসলেন।
লাবুস বলল, আপনার স্ত্রীকে আমি যে মা ডাকি এটা কি আপনি জানেন?
করিম বিস্মিত হয়ে বলল, না। তবে তার সঙ্গে তোমার যে দেখা হয়েছিল। এই বিষয়টা জানি।
লাবুস বলল, একজন পুরুষ যেমন তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে একজন স্ত্রী কি স্বামীকে তালাক দিতে পারে না? তাহলে আপনার স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিয়ে আপনার কাছে চলে আসতে পারেন।
স্ত্রীদের এই ক্ষমতা নাই। এই ক্ষমতা শুধু পুরুষের। স্ত্রী যদি তালাক চায় তাকে তার স্বামীকে টাকা পয়সা দিয়ে কিংবা হাতেপায়ে ধরে মানাতে হবে যেন স্বামী তালাক দেয়। এটা সহি হাদিস। বোখারি শরিফ।
এটা কি ভুল না?
আসমানি কানুনের ভুল ধরা ঠিক না।
লাবুস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। করিম বললেন, আমি তোমার মা’কে একটা পত্ৰ দিয়েছি। সেই পত্রে তাকে বলেছি। পালায়া চলে আসতে। সে যদি পালায়া আসে। তখন তারে নিয়া দূরদেশে চলে যাব। যেখানে কেউ তারে চিনে না। আমারেও চিনে না। আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাস করব।
পত্র কি পাঠায়া দিয়েছেন?
হুঁ। ধনু শেখের মেয়ে আতরের হাতে দিয়েছি। সে বলেছে পত্র পৌঁছায়ে দিবে। একটাই সমস্যা— তোমার মা বাংলা পড়তে জানে না।
আতর পড়ে শুনাবে।
করিম চুপ করে রইল। লাবুস বলল, শুনেছি ইমামের চাকরি আপনার চলে গেছে। নতুন ইমাম আসবে। আপনার এখন চলে কীভাবে?
করিম জবাব দিল না।
লাবুস বলল, আজ কি আপনার খাওয়া হয়েছে?
করিম এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। উঠে দাঁড়িয়ে যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে দ্রুত চলে গেল।
করিম যাচ্ছে ধনু শেখের বাড়ির দিকে। খুব কাছে সে যাবে না। দূর থেকে বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকবে। ধনু শেখের শোবার ঘরে আলো জ্বলছে। করিম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ জ্বালা করছে।
শরিফা মাথা নিচু করে খাটে বসে আছে। ধনু শেখ বসেছেন তার সামনে। দু’জনের হাতেই গ্রাস। ধনু শেখ যতবার বলছেন ততবারই শরিফা গ্লাস ঠোঁটে লাগাচ্ছে। শরিফা এমনভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে যেন তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ধনু শেখ আদুরে ভঙ্গিতে ডাকলেন, শরিফা রানি।
জি।
এখন থেকে তোমারে ডাকব রানি। স্বামী আদর করে রানি ডাকে, এটা অনেক বড় ব্যাপার। বুঝেছ?
বুঝেছি।
চুমুক দাও। গ্লাস হাতে নিয়া বইসা থাকবা না। এইটা একটা ঢং। ঢং করবা না। ঢং আমার পছন্দ না।
শরিফা গ্লাসে চুমুক দিল।
ধনু শেখ বললেন ,তোমার বিষয়ে আমার দিলখোশ হয়েছে। তোমারে নিয়া আমি কিছুদিনের জন্যে কলিকাতা যাব। ফুর্তির জায়গা দুনিয়াতে একটাই। কলিকাতা। বায়োস্কোপ দেখবা। বাইজি নাচ দেখবা। ঠিক আছে?
জি।
হাসিমুখে বলো ঠিক আছে। প্যাঁচার মতো মুখ কইরা কথা বলব না। তুমি প্যাচা না। এক অক্ষরের কথা বলাও বন্ধ করা। তুমি টিকটিকি না যে সবকিছুতে বলবা- টিক টিক। এখন হাসিমুখে বলবা, আমি বাইজি নাচ দেখব।
শরিফা হাসিমুখে বলার চেষ্টা করল, আমি বাইজি নোচ দেখব। বলতে পারল না। মুখ আরো বিকৃত হয়ে গেল। ধনু শেখ এতেই সন্তুষ্ট হলেন। নেশাগ্ৰস্ত হয়ে তাঁর এমনই অবস্থা যে হাসি এবং কান্নার তফাৎ তিনি ধরতে পারলেন না।
ধনু শেখের মুখ দিয়ে লালা পড়ছিল। তিনি মুখের লালা মুছতে মুছতে বললেন, কলিকাতায় তোমার জন্যে ড্যান্স মাস্টার রেখে দিব। ড্যান্স মাস্টার তোমারে নাচ শিখাবে। ঘুংগুর, পইরা তুমি নাচবা। ঝুমঝুম ঝুমঝুম ঝুমঝুমি। চুমুক দেও।
শরিফা চুমুক দিল।
ড্যান্স মাস্টারের কাছ থাইকা নাচ শিখার পর তুমি আমার সামনে ন্যাংটা নাচ নাচবা। স্বামীর সামনে ন্যাংটা নাচে অসুবিধা নাই। স্বামী যদি সুখী হয় তার জন্যে আলাদা সোয়াব। বুঝেছ?
জি।
আতর শরিফাকে চিঠি দেয় নি। চিঠি প্রসঙ্গে কিছু বলেও নি। সে শুধু বলেছে, আমার কাছে আপনার একটা জিনিস আছে। যেদিন লেখাপড়া শিখবেন সেদিন দিব। তার আগে না।
শরিফা লেখাপড়া শিখছে। আরবি পড়া সে খুব সহজে শিখে ফেলেছিল। বাংলা বড়ই কঠিন লাগছে।
জায়গাটার নাম কালীবাড়ি। মাওলানা ইদরিস সন্ধ্যাবেলা কালীবাড়ি পৌঁছলেন। শ্মশানের মতো জায়গা। লোকজন কিছু নেই। লঞ্চঘাটে একটা বাতি জ্বলছে। সব কেমন ভুতুড়ে লাগছে। রাতটা কোথাও কাটানো দরকার। মাওলানার হাঁটার অবস্থা নেই। পা ফুলে গেছে। পায়ের পাতায় ফোসকা পড়েছে। পায়ের কষ্টের চেয়েও ক্ষুধার কষ্ট প্রবল হয়েছে। ক্ষুধায় তিনি অবসন্ন। ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে, কিন্তু ক্ষুধার কারণে ঘুম আসবে বলেও মনে হয় না। ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। থালাভর্তি গরম ভাত হলেই হবে। আর কিছু লাগবে না। ভাতের ওপর লবণ ছিটিয়ে খেয়ে ফেলবেন। ভাত খাওয়ার পর এক জগা পানি।
মাওলানা খাবারের কোনো ব্যবস্থা করতে পারলেন না। তবে রাতে থাকার ব্যবস্থা হলো। মসজিদে থাকবেন। পাকা মসজিদ। মেঝেতে পাটি বিছানো। মসজিদে তিনি একা না। একজন সঙ্গীও আছে। সঙ্গীর নাম সরফরাজ। সুন্দর চেহারা। গোলগাল মুখ। কানঢাকা টুপি পরে আছেন। তিনি যাবেন কোলকাতা। কালীবাড়িতে লঞ্চ বদল করতে হয়। রাতে কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে মসজিদে উঠেছেন।
সরফরাজ সঙ্গী হিসেবে ভালো। মাওলানাকে দেখে বললেন, আপনার পায়ের যে অবস্থা তিন-চার দিন নড়তে পারবেন না। ফোসকার চিকিৎসা না করলে পায়ে ঘা হয়ে যাবে। রাতে কিছু খেয়েছেন?
মাওলানা বললেন, জি-না জনাব।
আমার কাছে আখের গুড় আছে, খাবেন? দুর্ভিক্ষের কারণে দেশের অবস্থা এমন যে টাকা থাকলেও খাওয়া পাওয়া মুশকিল। আখের গুড় খেয়ে পানি খান, ক্ষুধা কমবে।
সরফরাজ গুড় বের করে দিলেন। নিজেই মাটির সরায় করে পানি এনে দিলেন। মাওলানা তৃপ্তি করে পানি খেয়ে বললেন, জনাবের এশার নামাজ কি পড়া হয়েছে? পড়া না হয়ে থাকলে আসুন দুই ভাই মিলে নামাজটা পড়ে ফেলি।
সরফরাজ বললেন, আমি মুসলমান না। যখন মসজিদে থাকার দরকার পড়ে তখন মুসলমান নাম নেই।
আপনি কোন ধর্মের?
আমি কোনো ধর্মেরই না। মহাত্মা কবীরের অনুসারী বলতে পারেন। (ধর্মগুরু। গুরু নানকের সমসাময়িক।) মহাত্মা কবীরের নাম শুনেছেন?
জি-না জনাব। আমি মুর্থ মানুষ।
মহাত্মা কবীর বলেছেন
পাথর পূজে হরি মেলে তো হাম পূজেঙ্গে পাহাড়।
অর্থ বুঝেছেন?
জি-না।
অর্থ হলো পাথর পূজা করে যদি ভগবান পাওয়া যেত তাহলে ছোট্ট পাথর পূজা না করে আমি পাহাড় পূজা করতাম। শুয়ে পড়ুন। আপনাকে খুবই কাহিল দেখাচ্ছে। নামাজ টামাজ যা পড়ার কাল পড়বেন। কাজা পড়ে ফেলবেন। তাছাড়া ভ্রমণের সময় নামাজের ব্যাপারে আপনাদের কিছু রেয়াত আছে না?
জি আছে।
তাহলে আর কথা কী। টেনে ঘুম দিন।
মাওলানা ইদরিস ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর গাঢ় ঘুম হলো। ফজরের ওয়াক্তে মুসল্লিরা এসে তার ঘুম ভাঙাল। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করলেন, কোমরের সঙ্গে বাধা খুঁনিটা নেই।
নিশিসঙ্গী কবীরভক্তও নেই। শরীর কাঁপিয়ে তার জ্বর এলো। ইদরিস মসজিদের বারান্দায় কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে রইলেন। ভাগ্যকে দুষতে ইচ্ছা করছে। দুষতে পারছেন না। আল্লাহপাক বলেছেন, ‘তুমি ভাগ্যকে দোষ দিও না। কারণ আমিই ভাগ্য।’
কালীবাড়ির মসজিদে তিনদিন তিন রাত প্রায় অচেতন অবস্থায় কাটালেন। চতুর্থদিনে মুসল্লিরা তাকে কোলকাতার এক লঞ্চে তুলে দিলেন। মসজিদে মরে পড়ে থাকার চেয়ে লঞ্চে মরে থাকুক।
মাওলানা লঞ্চের খোলা ডেকে শুয়ে আছেন। তাঁর মুখের ওপর মাছি ভনভন করছে। ডেকের এক কোনায় বাদ্য বাজনার দল বসেছে। শীত কাটানোর জন্যে তারা গান করছে। গান জমছে না। বারবার তাল কাটছে। মূল গায়ক বড়ই বিরক্ত হচ্ছে।
কালী, হলি মা রাসবিহারী
নটবর বেশে বৃন্দাবনে।
বৃন্দাবনে এ এ এ এ…
লঞ্চ বড় নদীতে পড়ে খুব দুলছে। মাওলানার মনে হচ্ছে তিনি গড়িয়ে পানিতে পড়ে যাচ্ছেন। গানের দলের মূল গায়েনকে বললেন, বাবা, আমাকে একটু ধরেন। গায়েন তাঁর কথা শুনতে পেল না। সে কানে হাত দিয়ে লম্বা করে সুর টানল— বৃন্দাবনে এ এ এ।
রাত অনেক।
ধনু শেখ দলবল নিয়ে লাবুসের বাড়িতে এসেছেন। পান্ধিতে করে এসেছেন। পাল্কির ভেতরই বসে আছেন। তার হাতে পােচ ব্যাটারির টর্চ। তার সঙ্গীদের মধ্যে একজনের হাতে হ্যাজাক বাতি। হ্যাজাকের ঝকঝকে সাদা আলোয় লাবুসের বাড়ির উঠান আলোকিত। লাবুস এগিয়ে এলো। এত রাতে ধনু শেখের আসার কারণ সে বুঝতে পারছে না। নিশ্চয়ই বড় কোনো ঘটনা ঘটেছে।
কেমন আছ লাবুস?
ভালো আছি।
সবকিছু কি ঠিকঠাক?
জি ঠিকঠাক।
কোনোখানে বেতাল কিছু আছে?
লাবুস বিস্মিত হয়ে বলল, না! লাবুসের পাশে শ্ৰীনাথ এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হৈচৈ শুনে জেগেছেন। আচমকা ঘুম ভাঙায় ব্যাপার কিছু বুঝতে পারছেন না।
ধনু শেখ বললেন, আমার স্ত্রী শরিফা কি তোমার বাড়িতে লুকায়ে আছে?
জি না।
হুট কইরা না বলব না। চিন্তা ভাবনা কইরা বল। তোমার এই বিশাল বাড়ির কোনো চিপায় চাপায় লুকায়া থাকতে পারে। ভালোমতো সন্ধান না কইরাই সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। তুমি নিজে সন্ধান কর। আমার লোকজনও সন্ধান করবে।
জি আচ্ছা।
শরিফার সাথে আমার সামান্য মনকষাকষি হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এইসব হয়। সে রাগ করে বের হয়ে গেছে। বুঝেছ?
জি। আপনি কি ভেতরে এসে বসবেন?
আমারে ভিতরে নেওয়া আরো ঝামেলা। কোলে কইরা নিতে হবে। তার প্রয়োজন নাই। যেখানে আছি ভালো আছি। তোমার এখানে কি তামাকের ব্যবস্থা আছে? ব্যবস্থা থাকলে তামাক দিতে বলো।
হাদিস উদ্দিন তামাক সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। ধনু শেখ গুড়ুক গুড়ুক করে নল টানছেন। তামাকের ধোঁয়া চিন্তা পরিষ্কারক। ধনু শেখ হাদিস উদিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর নাম কী?
হাদিস উদ্দিন।
লোকমুখে শুনি শশাংক পাল মরে প্রেতিযোনি প্ৰাপ্ত হয়েছেন। এই বাড়ির আশেপাশে তারে দেখা যায়। কথা কি সত্য?
জি সত্য। ষোল আনা সত্য।
তুই কোনোদিন দেখেছিস?
জে না।
তাহলে কীভাবে বললি ষোল আনা সত্য?
শ্ৰীনাথ বাবু দেখেছেন।
শ্ৰীনাথটা কে?
গোমস্তার কাজ করে।
সো কই?
এতক্ষণ আপনার সামনেই ছিল, এখন ছোটকর্তার সঙ্গে অন্দরে গেছেন।
তারে ডাক দিয়া আন। ভূতের কী ঘটনা শুনি।
হাদিস উদ্দিন এক দৌড়ে অন্দরে ঢুকল। গভীর রাতে হঠাৎ এই কর্মব্যস্ততায় সে আনন্দ পাচ্ছে। ধনু শেখ আরাম করে হুক্কা টানছেন, এটাও তার জন্যে আনন্দের। ভালো জিনিসের মর্ম সবাই বুঝে না।
তোমার নাম শ্ৰীনাথ?
জি।
চেহারা-ছবি তো ভালো না। শ্ৰীনাথ নাম না হয়ে বিশ্ৰীনাথ নাম হলে মানানসই হতো। হা হা হা।
নিজের রসিকতায় মুগ্ধ হয়ে ধনু শেখ অনেকক্ষণ হাসলেন। শ্ৰীনাথ শুকনা মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।
শশাংক পালের ভূত তুমি নাকি দেখেছ?
আজ্ঞে দেখেছি।
কী দেখেছি গুছায়া বলো। তার আগে বলো কতবার দেখেছ?
অনেকবার দেখেছি।
সর্বশেষ কবে দেখেছ? কী দেখেছ?
শ্ৰীনাথ গলা খাঁকারি দিয়ে গল্প শুরু করল। এ ধরনের গল্প বলতে সে খুবই পছন্দ করে। তবে আজ গল্প বলে আরাম পাওয়া যাচ্ছে না। যারা ভূত বিশ্বাস করে না তাদের সঙ্গে ভূতের গল্প করে আরাম নেই। এরা হঠাৎ বেমাক্কা প্রশ্ন করে গল্প উলট-পালট করে ফেলে।
সন্ধ্যাবেলা আমি বাগানে গিয়েছি নিমের ডাল আনব। দাঁত মাজবি। ডাল ভেঙেছি। কী কারণে যেন গাছের উপর চোখ গিয়েছে, দেখি সেখানে কে যেন বসে আছে।
গাছে কি শশাংক পাল বসা?
জি। আমার দিকে তাকায়া আছেন, মুখে হাসি।
তুমি কী করলা? ঝাঁকি দিয়া তারে গাছ থাইকা ফেললা?
শ্ৰীনাথ গল্প বন্ধ করে দিল। এই মানুষকে ভূতের গল্প শোনানোর কোনো অর্থ হয় না। যে-কেউ গাছে ভূত দেখলে দৌড়ে পালাবে। গাছে ঝাঁকি দিয়ে ভূত মাটিতে ফেলবে না। ভূত তো ফল না যে ঝাঁকি দিয়ে গাছ থেকে ফেলতে হবে।
চুপ করলা কেন? তারপর কী হলো বলো। শশাংক পালের ভূত কী করল? গাছের উপর থেকে তোমার শরীরে পেসাব করে দেয় নাই তো? শুনেছি। অনেক দুষ্টভূত এই কাজ করে। পেসাব কি করেছে?
শ্ৰীনাথ কী বলবে ভেবে পেল না।
শরিফাকে পাওয়া গেল না। ধনু শেখ পান্ধি উঠাতে বললেন। এখন যাবেন রঙিলা বাড়িতে! নটিবাড়িগুলো সুন্দরী মেয়েদের পালায়া থাকার জন্যে ভালো জায়গা। বাড়ির মালেকাইন এদের আগ্রহ করে স্থান দেয়। গানবাজনা শিখিয়ে একসময় কাজে লাগিয়ে দেয়। নটিবাড়িগুলোতে মেয়ের অভাব কখনোই হয় না।
রঙিলা বাড়িতে যাবার পথে ধনু শেখের সঙ্গে করিমের দেখা হয়ে গেল। করিম লঞ্চঘাটে হাঁটাহাঁটি করছে। ধনু শেখ পান্ধি থামিয়ে বললেন, কে? ইমাম করিম না?
করিম উঠে দাঁড়াল। যন্ত্রের মতো বলল, আসসালামু আলায়কুম।
ধনু শেখ বললেন, ওয়ালাইকুম।
শরিফা যে পালায়ে গেছে এই খবর শুনছ?
জি।
নটিবাড়িতে যাইতেছি তার সন্ধানে। যদি দেখি সে নটিবাড়িতে দাখিল হয়েছে তাহলে আর ফিরায়া আনব না। এটা দস্তুর না। আমোদ ফুর্তি করতে চাইলে তখন নটিবাড়িতে যাব। ইচ্ছা করলে তুমিও যাইতে পারবা। নটিবাড়ির মেয়েগুলার সুবিধা আছে। তারা একজনের বউ না। সকলের বউ। ভালো বলেছি না?
করিম তীব্ৰ চোখে তাকিয়ে আছে। ধনু শেখ করিমের তীব্ৰ চাউনি উপেক্ষা করে বললেন, শরিফা জঙ্গলেও লুকায়ে থাকতে পারে। জঙ্গলে লোক পাঠায়েছি। ইচ্ছা করলে তুমিও যেতে পার। ঘোষণা দিয়েছি, যে শরিফারে খুঁজে পাবে তার জন্যে তিনশ’ টাকা পুরস্কার।
করিমের বড় বড় নিঃশ্বাস পড়ছে। সে কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলাল। তার চোখের সামনে দিয়ে ধনু শেখের পালকি নটিবাড়ির দিকে যাচ্ছে। পাল্কি মাত্র দু’জন টানছে। বিশাল বাপু ধনু শেখকে টানতে তাদের কষ্ট হচ্ছে। এই প্ৰবল শীতেও তাদের সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে।
শরিফা লুকিয়ে আছে ধনু শেখের বাড়িতে। সে আছে আতরের ঘরে রাখা প্ৰকাণ্ড কাঠের সিন্দুকের ভেতরে। সিন্দুক তালাবন্ধ। চাবি আতরের ঘরের আলমারির ওপর। সিন্দুকের ওপর বিছানা করা। সেই বিছানায় ঘুমায় হামিদা। শরিফাকে লুকিয়ে রাখায় হামিদার ভালো ভূমিকা আছে। হামিদা নৌকা ঠিক করে রেখেছে। সময় সুযোগ মতো নৌকা শরিফাকে ভাটির দিকে নিয়ে যাবে। ভাটি অঞ্চলে শরিফার দেশ। কেউ-না-কেউ তাকে আশ্রয় দিবে।
শরিফাকে লুকিয়ে রাখার অসীম সাহসী কাজটি আতর করেছে, কারণ শফিফা তার এই মেয়ের কাছে ধনু শেখের কর্মকাণ্ড সবই কাঁদতে কাঁদতে বলেছে। তাকে কোলকাতায় নিয়ে নাচ শেখানো হবে, তাকে স্বামীর সামনে নগ্ন নৃত্য করতে হবে এই তথ্যও গোপন করে নি।
আতর বলেছে, নয়া মা! বাপজানের কলিকাতা যাওয়ার আগেই আমি ব্যবস্থা নিব। আপনি চিন্তা নিয়েন না।
ধনু শেখের আগামীকাল ভোরেই কোলকাতা যাবার কথা। নিজের লঞ্চে করে যাবেন। কেবিনের ঘর ঝাড়পোছ করা হয়েছে। বিছানা বালিশ তোলা হয়েছে। তখনই আতর ব্যবস্থা নিয়েছে। ধনু শেখকে গিয়ে বলেছে, বাপজান, নয়া মা তো ঘরে নাই। লাবুস চাচার বাড়ির দিকে দৌড়ায়া যাইতে দেখেছি।
ধনু শেখ রঙিলা বাড়িতে। তাকে যত্ন করে রুপার বাটায় পান দেয়া হয়েছে। গোলাপ জলের হুক্কায় তামাক দেয়া হয়েছে। ধনু শেখ নিশ্চিত হয়েছেন রঙিলা বাড়িতে শরিফা নেই। তিনি ফিরে আসতে চাচ্ছেন। মালেকাইন তাকে ছাড়ছেন না। হাতজোড় করে বলেছেন, হুজুর এতদিন পর দয়া করেছেন। আজ রাতে আপনাকে ছাড়ব না। আপনার সম্মানে সারারাত গানবাজনা হবে। ভালো বিদেশী পানি আছে। এক চুমুক হলেও মুখে দিতে হবে। ধনু শেখ দেটিানায় পড়ে গেছেন। মালেকাইন বলল, তের বছরের একটা মেয়ে নতুন এসেছে। ডানাকাটা পরী কেউ দেখে নাই, এই মেয়ে ডানাকাটা পরী।
মেয়ের নাম কী?
মেয়ের নতুন নাম এখনো দেওয়া হয় নাই। আপনি একটা নাম দেন।
আমি নাম দিলাম আঙুর।
ভালো নাম দিয়েছেন। তবে এই মেয়ে আঙুরের অধিক মিষ্ট। তারে কি আনব?
আনো।
শরিফাকে খুঁজতে আজ অনেক পরিশ্রম হয়েছে। এখন বিশ্রাম দরকার।
হামিদ শরিফাকে বোরকা পরিয়ে নৌকায় তুলে দিয়েছে। ছইওয়ালা বড় নৌকা। চারজন মাঝি। এরা সারারাত নৌকা বেয়ে শরিফাকে সেতাবনগরে পৌঁছে দিবে। সেতাবনগরে শরিফার এক ফুফু আছেন। শরিফাকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। আপাতত শরিফা সে বাড়িতেই থাকবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
নৌকার ছাঁইয়ের দু’পাশ শাড়ি দিয়ে পর্দা দেয়া। ভেতরটা অন্ধকার। অন্ধকারে গুটিসুটি মেরে শরিফা বসে আছে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না সে মুক্তি পেয়েছে।
গভীর রাতে নৌকা হাওরের মুখে পড়ল। হাওর এখন শুকিয়ে গেছে। হাওরের মাঝখােন দিয়ে মূল নদীতে সামান্য পানি। নৌকা থেমেছে। মাঝিরা বিড়ি খাচ্ছে। বিড়ির উৎকট গন্ধে শরিফার বমি আসছে। সবাই নৌকা থামিয়ে একসঙ্গে বিড়ি খাচ্ছে কেন শরিফা বুঝতে পারছে না। পর্দার ফাঁক দিয়ে শরিফা দেখল মাঝিদের একজন কুপি জ্বালাচ্ছে। শরিফা বলল, নৌকা থামা কেন?
কুপি যে জ্বালাচ্ছে সে বলল, এত দূরের পথ যাব, আমরা চারজনে পাইছি মাত্র দশ টেকা। এইজন্য ঠিক করেছি আপনারে নিয়া আমরা রঙতামাশা করব। চিৎকার দিয়া লাভ নাই। কোনোদিকে জনমানুষ্যি নাই। আপোসে রঙতামাশা করলে আপনের ভালো আমরারও ভালো।
মাঝির কথা শেষ হবার আগেই পেছন দিকের পর্দা সরিয়ে একজন ঢুকে শরিফার মুখ চেপে ধরল। ভারী গলায় বলল, একজন আসা, ঠ্যাং চাইপা ধর। ঠ্যাং দিয়া লাখি দিতে পারে। আরেকজন খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলল, আমি ‘বুনি’ চাইপা ধরব। ঠ্যাং ধরব কোন কামে। হিহিহি।
সারারাত রঙতামাশা করে তারা অচেতন শরিফাকে ফেলে গেল পরিত্যক্ত এক বিষ্ণুমন্দিরে। সেখান থেকে তার স্থান হলো রঙিলা নাটিবাড়িতে।
মাওলানা ইদরিস শুয়ে আছেন শিয়ালদা রেলষ্টেশনের প্লাটফরমে। তিনি একা না। তাঁর মতো আরো অনেকেই আছেন। এদেরকে আলাদা করা হয়েছে, কারণ এরা মারা যাচ্ছে।
হাসপাতালে রোগীর জায়গা নেই। স্বেচ্ছাসেবীরা কিছু সাহায্যের চেষ্টা করছে। সেই সাহায্য কোনো কাজে আসছে না। মাওলানাকে সকালবেলা একটা রুটি দেয়া হয়েছে। মাওলানা রুটি খান নি। রুটি তার পাশে পড়ে আছে, সেখানে পিপড়া উঠেছে। মাওলানা আছেন প্রবল ঘোরে। সারাক্ষণই তাঁর মনে হচ্ছে মাথার ভেতর দিয়ে ট্রেন চলাচল করছে।
কংগ্রেসকমীরা সাহায্যে নেমেছে। ব্যাগে ওষুধপত্র নিয়ে এসেছে। তারা রোগীদের তালিকা তৈরির চেষ্টাও করছে। একজন খাতকলম নিয়ে মাওলানার পাশে বসিল।
আপনার নাম?
ইদরিস। মাওলানা ইদরিস।
গ্রাম? গ্রামের নাম বলুন।
বান্ধবপুর।
কী বললেন? বান্ধবপুর? জেলা কি ময়মনসিংহ?
জি।
আপনি কি কোরানে হাফেজ?
জি।
যমুনা নামের কাউকে চেনেন?
জি-না জনাব।
যমুনার বিয়ে হয়েছিল সুরেন নামে একজনের সঙ্গে। ডাক্তার সুরেন। যমুনা বান্ধবপুরের মেয়ে। চিনেছেন?
না। জনাব আমি আর কথা বলতে পারতেছি না। আমারে ক্ষমা দেন।
মাওলানা ইদরিস প্রবল ঘোরে তলিয়ে গেলেন। ঘোর ভাঙলো অনেক পরে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন একটা মেয়ে তার দিকে ঝুকে আছে। মেয়েটা ব্যাকুল গলায় বলল, কাকু, আমাকে চিনেছেন?
চিনেছি।
বলুন তো আমি কে?
তুমি ললিতা। বগুড়ার।
ভালো করে আমাকে দেখে তারপর বলুন। আমি ললিতা না।
তুমি জমিদার শশাংক পালের মেয়ে ললিতা। মা কেমন আছ? তোমার পিতা শশাংক পালের ইন্তেকাল হয়েছে।
যমুনা বলল, কাকু, আমি আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। যখন আমার কোনো আশ্রয় ছিল না। তখন আপনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন।
ইদরিস ক্ষীণ স্বরে বললেন, কাঁদছ কেন ললিতা?
কাকু, আপনাকে এই অবস্থায় দেখে কাঁদছি।
মাওলানা চোখ বন্ধ করলেন। তার মাথার ভেতর দিয়ে আবার ট্রেন চলাচল শুরু করেছে। একটা না, অনেকগুলো ট্রেন একসঙ্গে চলছে। ট্রেনগুলো আবার লঞ্চ ইষ্টিমারের মতো ভোঁ ভো শব্দে ভেঁপু বাজাচ্ছে।
যমুনার বাড়ি বাগবাজারে। দু’কামরার একতলা বাড়ি। ছোট্ট বারান্দা। বারান্দায় যমুনা আগ্রহ করে অনেক ফুলের টব রেখেছে। প্রতিটি ফুলের টবে মাধুরীলতা। এই ফুল যমুনার খুব পছন্দ। সুরেন মাধুরীলতা বলে না। সুরেন বলে যমুনা লতা।
বাড়ির দু’টি কামরার একটি যুমুনা আলাদা করে রেখেছে। সেখানে তরুণ এক কংগ্রেস কমী থাকেন। মানুষের সেবা করার জন্যে এই মানুষটা সবসময় ব্যস্ত হয়ে থাকেন। যমুনা তাকে বড়দা ডাকে। যমুনার বড়দা লেখালেখি করেন। তিনি লেখেন মেঝেতে বসে। তাঁর সামনে থাকে মাড়োয়ারিদের ক্যাশবাক্সের মতো ছোট্ট টেবিল। যমুনা তরুণ এই লেখকের লেখার জন্যে পশমের একটি আসন নিজের হয়তে বানিয়ে দিয়েছে।
এই ঘরের খাটে মাওলানা ইদরিসকে শোয়ানো হয়েছে। যমুনার বড়দা বললেন, আমার ঘর বেদখল হয়ে গেল।
যমুনা বলল, বড়দা! পৃথিবীর পাঁচজন শ্ৰেষ্ঠ মানুষের মধ্যে উনি একজন।
পৃথিবীটাকে এত ছোট করে দেখা কি ঠিক?
মধ্যে একজন। উনার অবস্থা ভালো না। সুরেন বলেছে শ্বাসতন্ত্রে জটিল সংক্রমণ হয়েছে। বড়দা, আমি উনাকে এদেশের সবচে’ বড় ডাক্তার দেখাতে চাই। তুমি বিধানচন্দ্র রায়কে নিয়ে আসবে।
সর্বনাশ উনাকে কীভাবে আনবে।
যমুনা বলল, কীভাবে আনবে আমি জানি না। তোমাকে আনতে হবে।
বাংলার কিংবদন্তি ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় রোগী দেখতে এসেছেন। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, রোগীর ঘরে পা দেয়া মাত্র তিনি রোগ ধরতে পারেন। রোগীর গা থেকে আসা গন্ধ তাকে রোগ বলে দেয়।
বিধানচন্দ্র বললেন, রোগীর অবস্থা ভালো না। নিশ্চয় রোগীর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। রোগীর দুটা বুকেই নিউমোনিয়া, একইসঙ্গে প্রবল ম্যালিরিয়ার সংক্রমণও হয়েছে। নিউমোনিয়ার চিকিৎসা আগে হওয়া দরকার। কিন্তু আমি ম্যালেরিয়াকে আগে ধরব। রোগীকে গরম পানিতে শুইয়ে রাখতে হবে।
যমুনা বলল, উনি বাঁচবেন?
বিধানচন্দ্র বললেন, মা, তুমি বিধানচন্দ্ৰকে এনেছ? রোগী না বাঁচলে বিধানচন্দ্রের মান কি থাকে?
মাওলানা ইদরিস তাকিয়ে আছেন। তাঁর গায়ে কম্বল। খোলা জানোলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে কম্বলের ওপর। মাওলানা কিছুক্ষণ রোদ দেখলেন, তারপর দৃষ্টি ফেরালেন ঘরের মেঝের দিকে। সেখানে কৃশকায় কৃষ্ণবর্ণের এক যুবক মাটিতে আসন করে এই শীতে খালি গায়ে বসেছে। তার গায়ের পৈতা ঝকঝক করছে।
যুবক একমনে লিখে যাচ্ছে। একসময় এই যুবক লেখা থেকে চোখ তুললেন।
তখনি মাওলানা ইদরিসের সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হলো।
যুবক বললেন, আজ কি একটু ভালো বোধ করছেন? মাওলানা বললেন, জি জনাব। আপনার নাম?
আমার নাম তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়।
কী লিখছেন?
একটা উপন্যাস লিখছি। উপন্যাসের নাম ‘গণদেবতা’। ভারতবর্ষে নামে একটা পত্রিকা আছে সেখানে ধারাবাহিকভাবে বের হয়।
মাওলানা বললেন, আমি গল্প-উপন্যাস কোনোদিন পাড়ি নাই। হাদিস কোরান পড়েছি। কী লিখেছেন একটু পড়ে শুনাবেন?
তারাশংকর বললেন, অবশ্যই।
সোঁ সোঁ শব্দে প্রবল ঝড়। ঝড়ে চালের খড় উড়িতেছে, গাছের ডাল ভাঙিতেছে। বিকট শব্দে ওই কার টিনের ঘরের চাল উড়িয়া গেল। কিছুক্ষণ পরই নামিল ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি। দেখিতে দেখিতে চারদিক আচ্ছন্ন করিয়া মুষলধারে বর্ষণ। আঃ পৃথিবী যেন বাঁচিল। ঠান্ডা ঝড়ো হাওয়ায় ভিজা মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধ উঠিতে লাগিল।
নোবেল সাহিত্য পুরস্কার কমিটির দুর্ভাগ্য, তারা বাংলার এই ঔপন্যাসিকের খোঁজ বের করতে পারেন নি। তাদের পুরস্কারের খাতায় এই মহান কারিগরের নাম উঠে নি।
হে মহান বিশ্ব ঔপন্যাসিক! আপনি মধ্যাহ্নেীর এক সামান্য লেখকের ভক্তি, শ্ৰদ্ধা ও ভালোবাসা গ্ৰহণ করুন।
‘গণদেবতা’ উপন্যাসের জন্যে তারাশংকর ১৯৬৬ সনে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পান।