২৪. পৃথিবীর তাপমাত্রা : পৃথিবীর দুঃখ
গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং দৃঢ়ভাবে সন্দেহ করা হয়েছে যে এর জন্যে দায়ী হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। মানুষ জ্বালানি পুড়িয়ে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে, এই কার্বন-ডাই অক্সাইড অনেকটা গ্রীন হাউস বা কাচ ঘরের মতো–এর ভেতর থেকে তাপ বের হতে পারে না। তাই স্বাভাবিকভাবে পৃথিবী যে তাপটুকু বিকীরণ করে ছড়িয়ে দিতে পারত সেটা আর সেভাবে করতে পারছে না, সে কারণেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীর কার্বন-ডাই অক্সাইডের চার ভাগের এক ভাগই আসে মাত্র একটি দেশ থেকে, সে দেশটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মজার ব্যাপার হলো সে দেশের পরিবেশ সংক্রান্ত সিনেট কমিটির সভাপতি কিন্তু পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ব্যাপারটাই বিশ্বাস করতেন না, তার মতে এটা হচ্ছে, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের কাছে করা একটা বিশাল ধাপ্পাবাজি।” সবচেয়ে দুঃখের কথা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের বিলাসী জীবনযাপনের মূল্য দিতে হয় কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সাধারণ মানুষের। আমরা লক্ষ করেছি কী না জানি না পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিপদটা আমরা সম্ভবত টের পেতে শুরু করেছি। বাড়তি তাপমাত্রার কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গিয়েছে, এই দেশে তার সরাসরি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ দেশের মানুষ বন্যার সাথে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত কিন্তু এখন শুধু বন্যা নয় শুরু হয়েছে জলাবদ্ধতা। আগে হয়তো বিশ বছরে একটা প্রলয়ঙ্কর বন্যা আসত এখন প্রতি চার-পাঁচ বছরে একটা প্রলয়ঙ্কর বন্যা আসে–সেই বন্যার পানিও আর সহজে নামতে চায় না!
বিজ্ঞানীরা অবশ্যি খুব জোরেশোরে চিৎকার শুরু করেছেন এবং খুব ধীরে ধীরে তার ফল পাওয়া শুরু হয়েছে। পৃথিবীর যেসব দেশ কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করে তারা সেটা কমানোর উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। কিন্তু সেটা অনেক সময়ের ব্যাপার, পৃথিবীর মানুষ সম্ভবত তার অনেক আগেই একটা ভয়ঙ্কর বিপদের মাঝে পড়ে যাবে।
বড় বড় দেশের বড় বড় সরকারকে নাড়াচাড়া করানো খুব সহজ নয় কিন্তু সচেতন মানুষকে কিন্তু সহজেই ভালো কিছু করার জন্যে রাজি করানো যায়। পৃথিবী জুড়ে সেই কাজটি শুরু হয়েছে, সবুজ পৃথিবী আন্দোলন নামে পৃথিবীর অনেক মানুষ সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। কী কী কাজ করে পৃথিবীর কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমানো যায় তার তালিকা করা হচ্ছে, সেই তালিকা ধরে কাজ করা শুরু হয়েছে। সেই কাজের তালিকা দীর্ঘ এবং বিচিত্র। যেমন জাপানের মানুষ ঠিক করেছে তারা গ্রীষ্মকালে কোট-টাই পরা ছেড়ে দেবে। কোট-টাই না পরলে পৃথিবী কেমন করে সবুজ হবে সেটা চট করে বোঝা সম্ভব নয়, কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে শুধুমাত্র কোট-টাই না পরার কারণে জাপানে এক বছরেই 72 হাজার টন কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়েছে। কারণটা সহজ, কোট-টাই না পরার কারণে তাদের গরম লেগেছে কম তাই অফিসে এয়ারকন্ডিশন চালাতে হয়েছে কম, সে কারণে ইলেকট্রিসিটি খরচ হয়েছে কম, যে কারণে জ্বালানি তেলের সাশ্রয় হয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসও তৈরি হতো কম।
কিভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরির পরিমাণ কমানো যায় সেটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করে বিজ্ঞানীরা আরও মজার কিছু তথ্য আবিষ্কার করেছেন। যেমন, গরুর গোশত খাওয়া কমিয়ে দিলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটিতে রাশ টেনে ধরা সম্ভব। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর যে গ্যাসগুলো গ্রীন হাউস এফেক্টের জন্যে দায়ী তার পাঁচ ভাগের এক ভাগই আসে পৃথিবীর গরু, মহিষ, আর ভেড়া থেকে! পৃথিবীতে যত মানুষ সেই সংখ্যার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক গরু-মহিষ আর ভেড়া রয়েছে এবং সেটা বেড়েই চলছে। এই গরু-মহিষ-ভেড়ার গোবর থেকে আসে নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস, যেটার তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা তিনশ গুণ বেশি! গরু-মহিষ ভেড়ার খাওয়া আর হজম করার প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসে। মিথেন গ্যাস আর সেই গ্যাসের তাপ ধারণ করার ক্ষমতা 23 গুণ বেশি! বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখছেন যদি একজন মানুষ গরু-মহিষ-ভেড়ার গোশত খাওয়া ছেড়ে দেন তাহলে বছরে দেড় টন করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস তৈরি হবে। পৃথিবীর মোট কার্বন-ডাই-অক্সাইড হচ্ছে প্রায় ছাব্বিশ বিলিয়ন টন। পৃথিবীর মানুষ হচ্ছে ছয় বিলিয়নের কাছাকাছি, সবাই যদি দেড় টন করে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের দায়িত্ব নিয়ে নিত তাহলেই তো পুরো কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চার ভাগের এক ভাগের সমস্যা মিটে যেত!
কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ন্ত্রণে রাখার একটা খুব সহজ উপায় আছে, সেটা হচ্ছে গাছ। গাছ বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে সেটাকে ব্যবহার করে অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। একটা গাছ তার জীবদ্দশায় প্রায় এক টন কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে ব্যবহার করতে পারে। তাই পৃথিবীর সব মানুষ যদি বছরে একটা করে গাছ লাগায় তাহলেও আনুমানিক আরো ছয় বিলিয়ন টন কার্বন-ডাই অক্সাইডকে দূর করে ফেলা যেত! সব গাছই
কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে ব্যবহার করতে পারে, তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে দক্ষ হচ্ছে বাঁশ। আমাদের গ্রামবাংলার বাঁশঝাড় আসলে পরিবেশ রক্ষার মস্ত বড় সেনানী!
তবে এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের খানিকটা দ্বিমত আছে। গাছের পাতার রঙ সবুজ, যার অর্থ সে তাপমাত্রা শোষণ করে ধরে রাখে। তাই কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমিয়ে সে একটা বড় উপকার করলেও তাপ শোষণ করে তাপমাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারে। তবে সেটা সমস্যা হতে পারে শুধুমাত্র শীত প্রধান দেশগুলোর জন্যে–আমরা যারা উষ্ণ অঞ্চলে থাকি তাদের জন্যে গাছ এখনও আমাদের পরম বন্ধু।
পৃথিবীর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সমস্যাটি সৃষ্টি করেছে উন্নত দেশের মানুষরা এবং ঠিক করে বললে বলতে হয় সেই দেশের শহুরে মানুষেরা। কাজেই তাদের দায়-দায়িত্বটাও সবচেয়ে বেশি। সচেতন মানুষগুলো সেটা নিয়ে এর মাঝে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে এবং তার জন্যে কাজও করতে শুরু করেছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা আশি ভাগ মানুষ একা একা গাড়ি করে যায়। শুধুমাত্র কয়েক জন মিলে এক গাড়িতে যাবার চেষ্টা করেই সেই দেশে এখন 71 হাজার টন কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস কম তৈরি হচ্ছে। যেসব কোম্পানি বেশি পরিবেশ সচেতন তারা আর এক ডিগ্রি বেশি এগিয়ে গিয়েছে। আমাদের দেশে আমরা গাড়ি চালাই রাস্তার বাম দিকে তাই বাম দিকে কোনো রাস্তায় ঘুরে যাওয়া সহজ। ডান দিকে ঘুরতে হলে অপেক্ষা করতে হয় কখন সামনে থেকে গাড়ি আসা বন্ধ হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবাই গাড়ি চালায় রাস্তার ডান দিক দিয়ে তাই সেখানে ডান দিকে ঘুরে যাওয়া সহজ বাম দিকে ঘুরে যেতে হলে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। গাড়ি নিয়ে রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করা মানেই পেট্রোলের অপচয় আর পেট্রোলের অপচয় মানেই কার্বন-ডাই অক্সাইড! নিউইয়র্ক শহরে ই. পি. এস. কোম্পানি তাদের গাড়ির ড্রাইভারদের জন্যে ম্যাপ ঘেঁটেঘুঁটে কম্পিউটার ব্যবহার করে পথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, যে পথে গেলে তাদেরকে কখনোই আর বামে মোড় নিতে হবে না, তারা শুধু ডান দিকে মোড় নিয়ে নিয়েই তাদের গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারবে। শুধু একটা শহরে এই পদ্ধতি চালু করেই তারা এখন বছরে এক হাজার টন কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করছে তাই কয়েক বছরে সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব শহরে এই পদ্ধতি চালু করে ফেলতে যাচ্ছে।
শহুরে মানুষের বড় একটা বিলাসিতা হচ্ছে ইলেকট্রিক লাইট। এর মাঝে ছোট ছোট ফ্লোরোসেন্ট লাইট চলে এসেছে যার বিদ্যুৎ খরচ প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। সম্ভবত ভবিষ্যতের ইলেকট্রিক লাইট হবে লাইট এমিটিং ডায়োড বা এল.ই.ডি. দিয়ে যেখানে ইলেকট্রিসিটির প্রায় পুরোটুকু খরচ হয় আলো তৈরি করতে, যেখানে তাপ তৈরি করে কোনো শক্তির অপচয় করা হয় না। এর মাঝে ছোট ছোট উজ্জ্বল সাদা আলোর এল.ই.ডি. চলে এসেছে, শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা মাত্র যখন ঘরে ঘরে লাইট বাল্বের বদলে আমরা এল.ই.ডি, ব্যবহার করব।
পরিবেশবাদীরা এখন ঘরবাড়ি তৈরি করেন অনেক চিন্তাভাবনা করে। প্রকৃতিকে ব্যবহার করে গরমের সময় ঘরকে শীতল রাখা হয় শীতের সময় গরম। যতটুকু শক্তি খরচ করতে হয় তার বাইরে যেন কোনো অপচয় না হয়। কারণ অপচয় মানেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড মানেই গ্রীন হাউস এফেক্ট আর গ্রীন হাউস এফেক্ট মানেই পৃথিবীর মানুষের দুর্দশা ।
পৃথিবীর সচেতন মানুষেরা যখন কার্বন-ডাই অক্সাইডকে কমানোর কাজে লেগেছেন তখন বড় বড় বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদরা বসে নেই, তারা নামছেন তাদের বড় বড় পরিকল্পনা নিয়ে। সেই পরিকল্পনাগুলো প্রায় সময়েই অনেকটা কল্পবিজ্ঞানের মতো। যেমন মহাকাশে বিশাল একটা আয়না বসিয়ে সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে সরিয়ে দিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমিয়ে দিলে কেমন হয়? কিংবা বায়ুমণ্ডলের স্ট্রাটোস্ফিয়ারে সালফার ছড়িয়ে পৃথিবীটা শীতল করে ফেললে কেমন হয়? প্রায় নিরুপায় হয়ে বিজ্ঞানীরা আরো আজগুবি পরিকল্পনা করছেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড আলাদা করে সেটাকে মাটির নিচে পুঁতে
রাখবেন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি ইতোমধ্যে বিষয়টা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
সুইডেন ডেনমার্কে সেটা করার কাজও শুরু হয়েছে, শূন্য হয়ে যাওয়া গ্যাস ফিল্ডে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ভরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে সেটাকে সরিয়ে দেয়া হবে!
পৃথিবীকে রক্ষা করার পরিকল্পনার বিশাল তালিকার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর পরিকল্পনাটি হচ্ছে সবচেয়ে সহজ। সেটি হচ্ছে সবার জন্যে ভোগ-বিলাসহীন সহজ-সরল একটা জীবন। যে ভোগবাদী জীবনের লোভ দেখিয়ে সারা পৃথিবীকে ছুটিয়ে নেয়া হচ্ছে তার থেকে মুক্তি নিয়ে আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে আমাদের জীবনটি হতে হবে সহজ এবং সরল, আমরা ভোগ করব না, বিলাস করব না, একে-অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করব না–আমরা জীবনকে উপভোগ করব একে-অন্যকে সাহায্য করে।
আমার মনে হয় এটাই হবে নূতন মানব সভ্যতার প্রথম মাইলফলক।