পরদিন অফিসে এসেই দীপনাথ শুনল, আমেদাবাদ থেকে স্বয়ং বড় মালিক এসেছেন। বোস সাহেবের সঙ্গে রুদ্ধদুয়ার আলোচনা চলছে। অফিসে জোর কানাঘুষো, বড় মালিক বোস সাহেবকে ছাড়তে রাজি নন। তার জন্য বোস সাহেবকে আরও অনেক বেশি মাইনে দিতেও তিনি প্রস্তুত।
অফিস বলতে চল্লিশ বাই কুড়ি একটা হলঘর। গাদাগাদি স্টিলের টেবিল-চেয়ার, ফাইল ক্যাবিনেট লোহার আলমারি। শুধু বোস সাহেবের জন্য আলাদা একটা কাঠের ঘেরা দেওয়া চেম্বার।
দীপনাথ সম্পর্কে অফিসের সকলেরই প্রথম-প্রথম একটু সন্দেহের ভাব ছিল। সম্ভবত তাকে বোস সাহেবের স্পাই বলে মনে করত। এখন আর সে ভাবটা নেই। বরং দীপনাথ যে এখনও পাকা চাকরি পায়নি তার জন্য কারও কারও কিছু সহানুভূতি আছে।
আগে এ অফিসে বাঙালি প্রায় ছিলই না। ইদানীং বোস সাহেব কিছু বাঙালি ছেলেকে চাকরি দিয়েছেন। কম বেতনের কেরানি বা টাইপিস্ট নেওয়ার ক্ষমতা বোস সাহেবের হয়তো আছে।
দীপনাথ গিয়ে টাইপিস্ট রঞ্জন রায়ের মুখোমুখি চেয়ারে বসল। রঞ্জন একদম হালে ঢুকেছে। মাস দুই হবে বোধ হয়। চেহারাটা খুব রোগা, মুখে শুকনো খড়ি-ওঠা ভাব, চোখ গর্তে, গাল ভাঙা। তবে লম্বা চুল আর জঁদরেল জুলপি আছে। কিন্তু রঞ্জনের পোশাক-আশাক খুবই সাদামাটা। সাধারণ একটা লাল-সাদা চেককাটা হাওয়াই শার্ট আর পবনে বোধ হয় এসপ্লানেডের ফুটপাথ থেকে কেনা স্ট্রেচলনের সস্তা বেলবটম, পায়ে চটি। ছেলেটা সর্বদাই খুব গম্ভীর থাকে। কিন্তু কথা শুরু করলে আবার অনেক কথা কয়।
দীপনাথ জিজ্ঞেস করল, বোস সাহেবের ঘরে কনফারেন্স কতক্ষণ চলছে?
রঞ্জনের এখন কোনও তেমন কাজ নেই বোধ হয়। ডান হাতের মুঠোটা মুদ্রাদোষবশত সব সময়ে মুখের সামনে মাউথপিসের মতো ধরে রাখে। ওই ভঙ্গিতেই বলল, তা ঘণ্টা খানেক হয়ে গেল।
মালিকের চেহারা কেমন দেখলে? খুব বুড়ো?
না, তেমন বুড়ো নয়। বছর খাটের হবে। একেবারে আমার মতো দেখতে। রোগা চিমসে চেহারা। তবে ভীষণ লম্বা। ছ’ফুটের ওপর। সঙ্গে আরও সাঙ্গোপাঙ্গ আছে।
ক’জন হবে?
জনা চারেক। সবাই নাকি মালিক। বড় মেজো সেজো।
তা হলে খুব লড়ালড়ি হচ্ছে, কী বলো?
রঞ্জন হাসল। বলল, তাই তো মনে হচ্ছে।
কোনদিকে ফয়সালা হবে মনে হয়?
কী করে বলি? বোস সাহেব চলে গেলে আমাদের চাকরিরও বারোটা বাজবে। কদিন হল এসব ভেবে আরও শুকিয়ে যাচ্ছি। মালিক যখন নিজে এসেছেন তখম…
মালিক কি খুব বড় অফার দিয়েছে?
সবই গুজব। তবে অতদূর থেকে তো কেবল মিঠা বাত বলতে আসেনি। মালকড়ির কথাই হচ্ছে বোধ হয়।
দীপনাথ একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। বোস থাকলে তার সব দিক দিয়েই সুবিধে। বলল, কনফারেন্স আর কতক্ষণ চলবে?
বলতে পারি না। শুনেছি আজই হেস্তনেস্ত যা হয় হয়ে যাবে। ফেলাদা অবশ্য কালই আমাকে বলেছে অন্য জায়গায় চাকরির চেষ্টা করতে।
সবিস্ময়ে দীপনাথ বলে, ফেলাদা কে?
রঞ্জন একটু হেসে বলে, ফেলাদা বোস সাহেবের ডাকনাম।
তুমি ওঁকে চেনো নাকি?
চিনি না আবার! আমার পিসতুতো দাদা।
বলো কী? এতদিন জানতাম না তো?
অফিসে আত্মীয়তার ব্যাপারটা গোপন রাখাই ভাল।
সে অবশ্য ঠিক। তোমার আপন পিসির ছেলে?
হ্যাঁ। তবে তেমন ঘনিষ্ঠতা তো নেই। ফেলাদাও এখন টপ বস। ফান্ডাই আলাদা।
দীপনাথ বুঝল, সম্পর্কে ভাই হলেও রঞ্জন বোধ হয় বোস সাহেবের ওপর তেমন সন্তুষ্ট নয়। সাবধানে জিজ্ঞেস করল, তোমার বাবা বেঁচে আছেন?
রঞ্জন একটু অবহেলার মুখভঙ্গি করে বলল, আছে না-থাকার মতোই। মাথার গোলমাল।
বোস সাহেব মামাকে দেখতে-টেখতে যান না?
নাঃ। ওসব ফেলাদা পছন্দ করে না। আত্মীয়তা তো সব বোগাস ব্যাপার ওদের কাছে।
তবু তো তোমাকে চাকরি দিয়েছেন।
দিয়েছেন।–রঞ্জনের গলার স্বরে কোনও কৃতজ্ঞতা ফুটল না, আমাকে না দিলেও আর কাউকে তো দিতেই হত।
নোস সাহেবের নিজের মা-বাবা নেই?
কেন থাকবে না? টালিগঞ্জে ওদের বিরাট জয়েন্ট ফ্যামিলি।
সেই ফ্যামিলির সঙ্গে বোস সাহেবের যোগাযোগ নেই?
একটু-আধটু কি নেই! তবে না থাকার মতোই। ফেলাদার মা-বাবা অর্থাৎ আমার পিসি আর পিসেমশাই খুব ভাল মানুষ। বলতে কী তাদের জন্যই আমার এই চাকরি। কিন্তু ফেলাদা দারুণ সেলফিশ।
মা-বাবাকে দেখেন না বুঝি?
এমনিতে দেখার দরকার নেই। ফেলাদার আর দুই ভাইও ভাল চাকরি করে, পিসেমশাই পেনশন পান। ওদের ভালই চলে যায়। কিন্তু টাকাটাই তো বড় কথা নয়। সোজা কথা ফেলাদার কোনও দরদ নেই। বউটাও হয়েছে তেমনি। আপনি তো ওদের ভালই চেনেন!–বলে একটু ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসল রঞ্জন।
আমি কর্মচারী। যেটুকু চিনি তা কর্মচারী হিসেবে। মানুষ কেমন তা তো বিচার করিনি।
কিন্তু আপনি তো ওদের সঙ্গে টুরেও যান শুনেছি।
তা অবশ্য যাই। কিন্তু দুরত্ব থাকে।
বউটাকে আপনার কেমন মনে হয়?
কেন, এমনিতে তো ভালই।
রঞ্জন একটু করুণার হাসি হাসল। চাপা গলায় বলল, কিছুই জানেন না। একটা আস্ত ভ্যাম্প। ফেলাদার বারোটা না বাজিয়ে ও মেয়ে ছাড়বে না।
মণিদীপা সম্পর্কে এসব কথা শুনতে খুব ভাল লাগছিল না দীপনাথের। সে উদাসভাবে বলল, তাই নাকি?
জিনস পরা মেয়ে পথেঘাটেই দেখতে ভাল, কিন্তু আমাদের মতো মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে ওসব মেয়ে চলে না। আমার ও রকম বউ হলে থাপ্পড় মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম।
দীপনাথ একটু চিন্তা করে বলে, তোমার কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবে সব কিছুর জন্য তো কেবল মেয়েদেরই দোষ দেওয়া যায় না।
মেয়েদের দোষ দিচ্ছে কে? ফেলাদা যে তার বউকে কন্ট্রোল করতে পারে না তার জন্য ফেলাদাই দায়ী। অথচ ওদের লাভ-ম্যারেজও নয়।
জানি। শুনেছি মিসেস বোস গরিব ঘরের মেয়ে।
গরিব মানে একদম ভুখখা পার্টি। বাপ পলিটিকস করত। চাকরি-বাকরি করেনি কোনওদিন। পার্টি থেকে কিছু কিছু পেয়ে টেনেমেনে সংসার চালাত। ওদের বাড়ির সবাই পলিটিকসের পোকা।
মিসেস বোসের বাবা কি কোনও নেতা-টেতা?
না না। স্রেফ ক্যাডার।
ও–বলে দীপনাথ চুপ করে থাকে।
রঞ্জন তার মুঠোর মাউথপিস সরিয়ে নিয়ে চুল ঠিক করছিল। ঠোঁট সামান্য ফাঁক। দীপনাথ চকিতে দেখতে পেল, রঞ্জনের সামনের সামান্য উঁচু দুটো দাঁতের রং কালচে। বোধ হয় পোকা লেগেছে। একটা দাঁত বোধ হয় আধখানা ভাঙাও।
রঞ্জনকে কেন মাউথপিস সামনে রাখতে হয় তা বুঝতে পারল দীপনাথ। মানুষের যে কত কমপ্লেক্স থাকে!
রঞ্জন আবার মাউথপিস সামনে ধরে বলল, শুনেছি ফেলাদায় আর বউদিতে নাকি খুব খাড়াখাড়ি। ডিভোর্সও হয়ে যেতে পারে।
তাই নাকি?— বলে বিস্ময়ের ভান করে দীপনাথ।
শুনেছি। যদি ডিভোর্স হয় তো ফেলাদা জোর বেঁচে যাবে।
তোমার সঙ্গে মিসেস বোসের ভাল আলাপ আছে?
না। তবে দেখেছি। আমাদের পাত্তাই দিতে চায় না। তাকালে যেন মনে হয় পোকামাকড় দেখছে।
একটু ডাঁটিয়াল, না?
সেন্ট পারসেন্ট। অথচ ডাঁটের কী আছে বলুন? গায়ের রং তো টেলিফোনের মতো। বাপেরও কিছু মালকড়ি নেই। তবু এমন রং নেবে যে আপনার গায়ে বিচুটি লেগে যাবে। লোয়ার ক্লাস থেকে আপার ক্লাসে উঠে এখন চোখে ভেলভেট দেখছে।
দীপনাথ আড়চোখে দেখল, উর্দিপরা একজন বেয়ারা ট্রে-ভর্তি কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে বোস সাহেবের চেম্বারে ঢুকছে। সাদা গুলো বোতলের মুখ থেকে উঁচু হয়ে আছে। দৃশ্যটা সুন্দর দেখায়।
দীপনাথ চেম্বারের দরজার দিকে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে কত পাচ্ছো?
রঞ্জন বলল, মোটে আড়াইশো। ফেলাদা ইচ্ছে করলেই তিনশো সাড়ে তিনশো করতে পারত। কিন্তু করবে না। হি ইজ সেলফিশ।
আত্মীয়রা কেউই বোধহয় মিস্টার বোসের ওপর খুব খুশি নয়, না?
কেউ না। ফেলাদার মা-বাবা পর্যন্ত ওকে পছন্দ করে না।
দীপনাথ চুপ করে বসে রইল। বোস সাহেব যে কেন এত একা তা বুঝতে আর কষ্ট হয় না তার। গতকাল সন্ধ্যায় বোস সাহেব যে কেন তার বন্ধুত্ব চেয়েছিল তা স্পষ্ট হয়ে গেল এখন।
রঞ্জন বলল, আমি শুনেছি আপনি নাকি খুব এফিসিয়েন্ট লোক। অথচ ফেলাদা আপনাকে লেজে খেলাচ্ছে, চাকরি দিচ্ছে না। অফিসে এ নিয়ে কথা হয়।
দীপনাথ কথাটা কানে নিল না। বরং অন্য দিকে চেয়ে হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল, ওঁর ডাকনাম ফেলা কেন বলো তো?
ফেলা? ও। ফেলাদার আগে বোধহয় পিসির আরও ছেলেমেয়ে হয়ে বাঁচেনি। তাই এই ছেলের নাম ফেলা। খুব আদরের ছিল।
দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, বেশি আদরের ছেলেরা একটু বখা হয়।
রঞ্জন হাসল। বলল, আদরের ছেলেরা বখা হলে আপত্তি নেই। বখা ছেলেরাও অনেক সময়ে মা-বাপকে হ্যাটা করে না। কিন্তু ফেলাদা তো বখা ছেলে নয়। বরং ভাল রেজাল্ট করে পাশ করেছে বরাবর, ভাল চাকরি করছে। একে তো বখা বলে না। এ তো সেলফিশনেস। আদরের ছেলেরা সেলফিশ হবে কেন?
দীপনাথ ভ্রু কুঁচকে ভেবেও এই রহস্যের সমাধান খুঁজে পেল না। কিন্তু বোস সাহেবের একাকিত্বের ব্যাপারটা বুঝতে পারল। লোকটা খুবই আনপপুলার সন্দেহ নেই। সে মাথা নেড়ে হঠাৎ একটু হেসে ঘোষণা করল, মিসেস বোস কিন্তু সেলফিশ নন।
রঞ্জন স্থির চোখে দীপনাথকে একটু মাপজোখ করে নিয়ে বলে, বউদি ফেলাদার চেয়েও বেশি সেলফিশ। আপনি ওকে চেনেন না।
চেম্বারের দরজা হঠাৎ খুলে গেল। জনা চারেক লোক বেরিয়ে এল কথা বলতে বলতে। তিনজনের পরনে ঝকঝকে স্যুট। শুধু খুব লম্বা এবং রোগা মানুষটির পরনে ধুতি এবং গলাবন্ধ সুতির কোট, মাথায় সাদা পাগড়ি। সকলের পিছনে বোস সাহেব। তাদের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল না, ডিসিশন কোন দিকে গেছে। তবে তাদের কারও মুখেই গাম্ভীর্য বা হাসিখুশি ভাব নেই।
বোস সাহেব ওদের সঙ্গেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে চারদিকে চেয়ে দেখে নিল একবার। দীপনাথ নিজের উপস্থিতি জানান দিতে উঠে দাঁড়িয়েছিল। বোস সাহেব একবার তাকালও তার দিকে, কিন্তু কোনও ইশারা করল না।
দীপনাথ আবার বসে পড়ল। এই দাঁড়ানোর অবস্থায় তাকে দেখলে মণিদীপা অবশ্যই চাপা হিংস্র গলায় বলত, স্লেভ! স্লেভ! বন্ডেড লেবারার।
ওরা বেরিয়ে যেতেই অফিসে একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল, নানা রকম অনুমান, আন্দাজ।
হাতে একটা কাজ আছে। সেরে ফেলি। বলে রঞ্জন তার টাইপ মেশিনে খটাখট শব্দ তুলতে লাগল।
দীপনাথ উঠে সামনের দিকে জানালায় এসে উঁকি দিয়ে দেখল, মস্ত একটা গাড়িতে বোঝাই হয়ে বোস সাহেব সমেত মালিকরা কোথাও যাচ্ছে। অর্থাৎ এখন তার কোনও কাজ থাকছে না।
দীপনাথ বোকা নয়। সে জানে এই কোম্পানির যা ক্যাপিট্যাল ইনভেস্টমেন্ট আছে তাতে অনায়াসে এটাকে উঁচু গ্রেডে তোলা যায়। কিন্তু ব্যবসায়িক কারণে মালিকরা তা চাইছে না। বোস চাইছে। শুধু ব্যক্তিগত বেতন বা ভাতা বাড়ালেই বোস খুশি হওয়ার লোক নয়। সে যে এ কোম্পানিকে হায়ার গ্রেডে তুলেছে তার স্বীকৃতি না দিলে সে খুশি হবেও না। টাকার সঙ্গে প্রেস্টিজও তার দরকার! মালিকরা সেই মৌলিক ব্যবসাগত নীতিতে নরম হল কি না সেটাই বড় কথা।
সুতরাং দীপনাথের অনিশ্চয়তা কাটে না।
বোস সাহেবের বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, সাহেব লাঞ্চের পর অফিসে আসবে।
লাঞ্চের এখনও দেরি আছে দেখে দীপনাথ সন্তর্পণে গিয়ে বোস সাহেবের চেম্বারে ঢুকে দরজাটা টেনে দিল। এই চেম্বারে ঢুকতে তার কোনও বাধা নেই। প্রায়ই ঢোকে।
চেম্বারে এয়ারকন্ডিশনার চলছে। বিশাল ঝকঝকে সেক্রেটারিয়েট টেবিল, ঘোরানো চেয়ার। মেঝেয় সত্যিকারের উলের কার্পেট। মালিকরা বোস সাহেবকে যথেষ্ট আদরে রেখেছে। এত আদরে থাকলে দীপনাথ বর্তে যেত, আর কিছু চাইত না। মালিকদের কথায় উঠত, বসত। কিন্তু নাল্পে সুখমন্তি। বোস আরও চায়। কেন চায় কে জানে! এ পৃথিবীতে কিছু মানুষের আছে রাক্ষুসে চাওয়া। আলাদিনের দৈত্য কিংবা জিন পরিরাই বোধহয় সেই চাহিদা কেবলই মিটিয়ে যাচ্ছে। দীপনাথ খবর রাখে, এক আধা-সাহেবি কোম্পানির এক ডিরেক্টর বিশ হাজার টাকা মাইনে এবং আর-সব খরচপত্র পায়। এত পাওয়া পছন্দ করে না দীপ। এত পেলে কি জীবনটা বিস্বাদ হয়ে যায় না!
ডাইরেক্ট লাইনে সে বোস সাহেবের বাড়ির নম্বর ডায়াল করল।
মণিদীপা বোধ হয় আর-কারও অপেক্ষায় টেলিফোন কোলে করেই বসে ছিল। প্রথম রিং-এর শব্দটা হতে না হতেই রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো।
আমি দীপ।
হুঁ। কী খবর?
একটা খবর বোধহয় দিতে পারি।
কী সেটা?
খবরটা ভাল হলে খাওয়াবেন তো!
আপনার প্রিমিটিভিনেসটা কবে যাবে বলুন তো?
ব্যথাহত দীপনাথ বলে, কেন? প্রিমিটিভিনেসটা কী দেখলেন?
ওই যে খাওয়ার কথা। খাওয়াটা এমন বড় প্রবলেম কি?
দীপনাথ বিষণ্ণ হেসে বলে, আপনার মতো একজন মার্কসবাদীর মুখে কথাটা কি মানাল? দেশের লক্ষ মানুষের মূল প্রবলেমটাই তো এই প্রিমিটিভ প্রবলেম। যা নিয়ে আপনি ভাবছেন, স্নিগ্ধদেব ভাবছেন।
স্নিগ্ধর কথা ওঠে কেন? কথা হচ্ছে আপনার আর আমার মধ্যে। লিভ স্নিগ্ধ।
আমি ওঁর নাম উচ্চারণ করলেও বুঝি ওঁকে অপমান করা হয়?
মণিদীপা অধৈর্যের গলায় বলে, ইউ আর স্টিল প্রিমিটিভ। ইউ আর জেলাস।
দীপনাথ একটু চোখ বুজে দম ধরে রইল। তারপর বলল, আমার জেলাসির কোনও কারণ নেই। নিশ্চয়ই জেলাস। আপনি জেলাস, মিস্টার বোস জেলাস। আপনারা স্নিগ্ধকে হিংসে করেন, কারণ আপনারা জন্মেও ওর মতো হতে পারবেন না।
সবাই কি নেতা হতে পারে? কাউকে কাউকে তো জনগণও হতে হবে।
স্নিগ্ধ নেতা নয়। আমরা ব্যক্তিপূজায় বিশ্বাস করি না, নেতৃত্বেও নয়।
তা হলে কি কালেকটিভ লিডারশিপ?
ও বাবা। তাও জানেন দেখছি।
একটু একটু শিখছি।
এবার খবরটা কি দয়া করে বলবেন?
তাই তো বলতে চাইছিলাম। কিন্তু আপনি বলতে দিচ্ছেন কই?
সরি। এবার বলুন।
বোস সাহেব বাংগালোরের চাকরি নাও নিতে পারেন। আজ মালিকদের সঙ্গে কনফারেন্স হল।
শুনে মণিদীপা একটু চুপ করে থাকে। তারপর নিস্পৃহ গলায় বলে, তাতে আমার কী?
কিছুই কি নয়?
বোস সাহেবের বাংগালোরে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে তো কোনও প্রবলেম হয়নি। আমাদের প্রবলেম অন্য। সে আপনি বুঝবেন না।
দীপনাথ বিষণ্ণ হয়ে বলে, ও। আমি অবশ্য আপনাদের প্রাইভেট ব্যাপারে কিছু জানতে চাইছিলাম না। জাস্ট খবরটা দিলাম, যদি তাতে আপনার মত বদলায়।
না, খবরটার তেমন কোনও দাম নেই আমার কাছে। বোস কি ফাইন্যালি ডিসিশন চেঞ্জ করেছে?
তা এখনও জানি না। তবে ভাবসাব দেখে মনে হয়, মালিকরা এ রকম একজন এফিসিয়েন্ট লোককে ছাড়বে না।
এফিসিয়েন্ট!–বলে একটু শ্লেষের হাসিই যেন হাসল মণিদীপা। তারপর বলল, আপনি কষ্ট করে খবরটা দিলেন বলে ধন্যবাদ। যদিও খবরটার কোনও ইমপট্যান্সই আমার কাছে নেই।
শুনুন, মিসেস বোস।
শুনছি। কিন্তু মিসেস বোস নয়, মণিদীপা। আমার নিজস্ব পরিচয়টাই আমার একমাত্র পরিচয়, কথাটা কতবার বলেছি?
মনে রাখতে পারি না। আমরা একটু সেকেলে।
হ্যাঁ, আপনারা কিছু অভ্যাসের দাস।
তাই হবে।
কী বলছিলেন?
কাল রাতে আমি আপনাকে যা বলেছি তার জন্য খুব লজ্জিত।
লজ্জার কী আছে? ফ্র্যাংকনেস আমি পছন্দই করি। আমিও তো আপনাকে কিছু কথা বলেছি।
ওসব তো সত্যি নয়।
কোনটা সত্যি নয়?
ওই যা সব বললেন।
বোস সাহেব আপনাকে আর আমাকে সন্দেহ করে কি না?
দীপনাথের কান লাল হল এত দূরে থেকেও। বলল, ওসব উনি যদি ভেবে থাকেন তো ভুল ভেবেছেন।
ভুল ভাবতে পারেন। তবে সত্যি হলেও লজ্জার কিছু নেই।
কী যে বলেন!
আপনি মেয়েদের বোকা ভাবেন, না?
না তো। কেন?
সব পুরুষই তাই ভাবে।
আমি ভাবি না।
আর মেয়েরাও আবার পুরুষদের বোকা ভাবে।
এসব কথা হচ্ছে কেন?
ভাবছিলাম, আপনি আমাকেও বোকা ভাবেন কি না?
মোটেই না।
ভাবলেই ভাল। কারণ, আমি বোকা নই।
আপনি তো খুবই বুদ্ধিমতী।
খুব না হলেও মোটামুটি।
কিন্তু কী বলতে চাইছেন?
বলছি যে, আমি পুরুষদের ভাবসাব এবং মতলব টের পাই।
ঠিক বুঝলাম না।
আমি জানি আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন।
না না। ছিঃ ছিঃ কী যে বলছেন সব…
আর তাতে আমি মোটেই রাগ করিনি। বরং খুশি হয়েছি।
কিন্তু ব্যাপারটাই যে সত্যি নয়।–দীপনাথ মিথ্যেটাকে সত্যি বলে চালাবার চেষ্টা করে।
ওপাশ থেকে মণিদীপা খুব আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলে, আমি মানুষে মানুষে ভালবাসায় বিশ্বাসী। বরং ভাল না বাসাটাই সন্দেহজনক।
কিন্তু সে তো অন্য ভালবাসা।
আমার কাছে সব ভালবাসারই অর্থ এক। ভালবাসা মানেই তো আর বিয়ে বা সেক্স নয়।
তা হলে মিস্টার বোস কী দোষ করলেন? উনি কেন আপনার ভালবাসা পাচ্ছেন না?–খুব বুদ্ধিমানের মতো পট করে কথাটা পেড়ে ফেলল দীপনাথ।
মানুষ হিসেবে ওঁর প্রতিও আমার ভালবাসা এবং সহানুভূতি আছে। তবে আমরা শ্রেণিশত্রুর প্রতি কিছুটা নির্দয়।
মিস্টার বোস আপনার শ্রেণিশত্রু হতে যাবেন কেন? আপনাদের শ্রেণি তো এক।
মোটই নয়। দেয়ার ইজ এ গ্রেট ডিফারেন্স।
কিসের ডিফারেন্স?
আমি তো আপনাকে আগেও বলেছি আমি হচ্ছি শ্রমিকশ্রেণির মানুষ।
বলেছেন, কিন্তু আমি কথাটা আজও বুঝতে পারিনি।
কারণ আপনার সেই মানসিকতা বা ট্রেনিং নেই।
তা অবশ্য ঠিক।
অথচ শুনেছি আপনি এক সময়ে ছাত্র আন্দোলন করতেন। এবং সেটা করতেন শিলিগুড়িতেই, যেখানে অনেক বিপ্লবীর জন্ম।
দীপনাথ সত্যিকারের অবাক হয়ে বলে, এ কথা আপনাকে কে বলল?
বলেছে শিলিগুড়িরই একটা ছেলে। জেসপের ইঞ্জিনিয়ার। একটা পার্টিতে কিছুদিন আগে আলাপ হল। সে শিলিগুড়ির ছেলে শুনে আপনার রেফারেন্স দিয়েছিলাম।
আমাকে চিনল?
খুব চিনল। নইলে জানলাম কী করে?
তখনকার ছাত্র আন্দোলন তো এখনকার মতো ছিল না।
তা হতে পারে। তবু আপনি যে কোনওদিন কোনও আন্দোলন করেছেন তাতেই প্রমাণ হয় যে, আপনার ব্যাকবোন ছিল।
এখন কি নেই?
না। মিস্টার বোসের তাঁবেদারি করে করে আপনার বাকবোন ভেঙে গেছে। সোজা কথা, মিস্টার বোসরা অন্যের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার জন্যই অত মাইনে পান।
তাই নাকি?
ঠিক তাই। আর সেইজন্যই মিস্টার বোস আমার শ্রেণিশত্রু। আপনারও।
দীপনাথ ঠিক করেছিল, কথাটা বলবে না। কিন্তু এখন একটু গুমগুম রাগ আর উত্তেজনার মাথায় কথাটা এসে গেল। সে বলেই ফেলল, কিন্তু আপনাকেও যে কেউ কেউ চরম শ্রেণিশত্রু মনে করে।
করতে পারে। তারা কারা?
আপনারই আত্মীয়স্বজন কেউ কেউ।
আমার আত্মীয়দের আপনি চেনেন?
আপনার এক দেওরের সঙ্গে আলাপ হল। দূর-সম্পর্কের দেওর। সে আপনাকে পছন্দ করে না।
সে কি খুব গরিব?
বেশ গরিব। কেন?
যদি গরিব হয় তবে তাকে আমার ভালবাসা জানিয়ে দেবেন। যে-কোনও গরিবেরই অধিকার আছে আমাকে ঘৃণা করার। কারণ দুর্ভাগ্যবশত আমি একজন ওপরওয়ালার স্ত্রী। কিন্তু যে-কোনও গরিবই আমার পরম শ্রদ্ধার পাত্র।
এ কথাও কি তাকে জানাব?
নিশ্চয়ই। কিন্তু জানানোর সাহস আপনার হবে না।
কেন?
কারণ চুকলি যারা করে তাদের সৎসাহস থাকে না।
তার মানে?
আপনি কার কথা বলছেন তা আমি জানি। রঞ্জন। সে যদি কোনও কথা আপনাকে বলেই থাকে তবে সেটা আমার কাছে ফাঁস করা আপনার উচিত হয়নি, দীপবাবু। একে সাদা বাংলায় চুকলি করা বলে।
দীপনাথের মাথা ঝা ঝা করছিল অপমানে। এই মেয়েটার কাছে সে কেন বারবার এ রকম হেরে যায়? এত নির্মমই বা কেন মণিদীপা?
মণিদীপার শান্ত স্বর ওপাশ থেকে শোনা গেল, শুনুন দীপবাবু, আমি আপনার ভাল চাই বলেই আপনাকে ছোট হতে দেখলে খারাপ লাগে। মনে রাখবেন আপনিও একজন গরিব, আর গরিবের জন্য সামনে বিশাল লড়াই পড়ে আছে। কূটকচালির মধ্যে জড়িয়ে পড়লে লড়াইটা করবে কে?
দীপনাথ অস্ফুটস্বরে বলল, মাপ করবেন। ঠিক চুকলির জন্য কথাটা বলা নয়।
তাও জানি। আপনি আমাকে একটু চিমটি কাটতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অত সহজে জব্দ হওয়ার মানুষ তো আমি নই। আমার ট্রেনিং আছে।
টেলিফোনটা কান থেকে নামিয়ে সভয়ে দীপনাথ সেটার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। ওপাশে মণিদীপা এখনও কিছু বলছে। কিন্তু সেটা শুনল না দীপনাথ।
আস্তে টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে বেরিয়ে এল।
অল্পের জন্য বেঁচে গেল দীপনাথ। বেরোতেই মুখোমুখি বোস সাহেব।
খুবই গম্ভীর মুখ বোস সাহেবের। দীপনাথের দিকে চেয়ে বলল, চেম্বারে আসুন। কথা আছে।