২৪. তিনকড়ি নিজেই একদিন

তিনকড়ি নিজেই একদিন অকপটে দেবুর কাছে সব খুলিয়া বলিল। ঘর খানাতল্লাশ করিয়া কিছু মিলিল না। কিন্তু ছিদাম জীবনে প্রথম ডাকাতি করিতে গিয়া, ধরা পড়িয়া পুলিশের কাছে আত্মসংবরণ করতে পারে নাই, সে কবুল করিয়াছে। তাহার উপর মৌলিক-ঘোষপাড়ার যে গৃহস্থের বাড়িতে ডাকাতি হইয়াছিল, তাহাদের বাড়ির দুজনে তিনকড়ি, রাম এবং তারিণীকে দেখিবামাত্র চিনিয়া ফেলিল। পুলিশের প্রশ্নের সম্মুখে স্বর্ণও যাহা শুনিয়াছিল, বলিয়া ফেলিল। তিনকড়ি পাথরের মূর্তির মত নিম্পলক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চাহিয়া রহিল।

তারপর বিচারকালে—তিনকড়ি তখন হাজতে—দেবু একজন উকিল লইয়া তিনকড়ির সঙ্গে যেদিন দেখা করিল, সেইদিন তিনকড়ি অকপটে দেবুর কাছে সব খুলিয়া বলিল।

সমস্ত জানিয়া-শুনিয়াও দেবুকে তিনকড়ির মামলার তদবির করিতে হইল। নিজের মনের সঙ্গে এই লইয়া যুদ্ধ করিয়া সে ক্ষতবিক্ষত হইয়া গেল। তিনু-কাকা ডাকাতের দলে মিশিয়া ডাকাতি করিয়াছে—পাপ সে করিয়াছে তাহার পক্ষে থাকিয়া মকদ্দমার তদবির করা কোনোমতেই উচিত নয়। কিন্তু অন্যদিকে স্বর্ণ এবং স্বর্ণের মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া সে কোনোমতেই নিজেকে নিরপেক্ষ রাখতে পারিতেছে না। শুধু মমতার কথাই নয়, আজ যদি তিনকড়ির মেয়াদ হইয়া যায় তবে স্বর্ণ এবং স্বর্ণের মাকে লইয়া তাহাকে আবার বিপদে পড়িতে হইবে। ত্রিসংসারের মধ্যে তাহাদের অভিভাবক কেহ নাই। গৌর সেইদিন সন্ধ্যায় যে কোথায় পালাইয়াছে—তাহার আর কোনো উদ্দেশ নাই। জীবনে এমন জটিল অবস্থার মধ্যে সে কখনও পড়ে নাই।

প্রতিদিন রাত্রে একাকী বসিয়া শত চিন্তার মধ্যে তাহার মনে হয়-ঘর ছাড়িয়া চলিয়া যাওয়াই শ্রেয়। এখান হইতে চলিয়া গেলেই তাহার মুক্তি সে জানে; কিন্তু তাহাও সে পারিতেছে। না। সে ইতিমধ্যে স্বর্ণদের সংস্রব এড়াইয়া চলিবার চেষ্টা করিল; তিনদিন সে স্বর্ণদের বাড়ি গেল না। চতুর্থ দিনে মা এবং একজন ভল্লার ছেলেকে সঙ্গে লইয়া স্বর্ণ ম্লানমুখে তাহার বাড়ির উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল; কম্পিতকণ্ঠে ডাকিল—দেবু-দা!

দেবু ব্যস্ত হইয়া উঠিল, মনে মনে অপরাধের গ্লানি তাহাকে চঞ্চল করিয়া তুলিল; সে বাহিরে আসিয়া বলিল—স্বৰ্ণ! খুড়ীমা! আসুন—আসুন। ওরে দুর্গা, ওরে কোথা গেলি সব! এই যে এই মাদুরখানায় বলুন। বাহিরের তক্তপোশর মাদুরখানা তাড়াতাড়ি টানিয়া আনিয়াই সে মেঝেতে পাতিয়া দিল।

স্বর্ণের মা পূর্বে দেবুর সঙ্গে কথা বলিত না। এখন কথা বলে ঘোমটার ভিতর হইতে। সে বলিল-থাক্ বাবা, থাক্।

স্বৰ্ণ দেবুর পাতা মাদুরখানা তুলিয়া ফেলিল।

দেবু বলিল–ও কি, তুলে ফেলছ কেন?

স্বর্ণ একটু হাসিয়া বলিল—উল্টো করে পেতেছেন। উল্টো মাদুরে বসতে নেই। … বলিয়া। সে মাদুরখানা সোজা করিয়া পাতিতে লাগিল।

–ও। অপ্রতিভ হইয়া দেবু বলিল—আপনারা কষ্ট করে এলেন কেন বলুন তো? আমি তিন দিন যেতে পারি নি বটে। শরীরটা তেমন ভাল ছিল না। আজই যেতাম।

স্বর্ণ বলিল—একটা কথা, দেবুদা।

—কি, বল।

দাদার জন্যে খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিলে হয় না? কাল একটা পুরনো কাগজে দেখছিলাম একজনরা বিজ্ঞাপন দিয়েছে–ফিরে এসো বলে।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ। কথাটা দেবুর মনেই হয় নাই। সে বলিল–হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছ। তাই দিয়ে দেখি। আজই লিখে বরং ডাকে পাঠিয়ে দোব।

স্বর্ণ আপনার আঁচলের খুঁট খুলিয়া দুইটি টাকা দাওয়ার উপর রাখিয়া দিয়া বলিল—কত লাগবে, তা তো জানি না। দুটাকায় হবে কি?

–টাকা তোমার কাছে রাখ। আমি সে ব্যবস্থা করব’খন।

ঘোমটার ভিতর হইতে স্বর্ণের মা বলিলটাকা দুটি তুমি রাখ বাবা। তুমি আমাদের জন্যে অনেক করেছ। মাঝে মাঝে টাকাও খরচ করেছ জানি। এ দুটি আমি গৌরের নাম করে নিয়ে এসেছি।

দেবু টাকা দুটি তুলিয়া লইল। স্বর্ণের মায়ের কথা মিথ্যা নয়। তবে সে-কথা দেবু নিজে ঘৃণাক্ষরেও প্রকাশ করে নাই। কেবল স্বর্ণের পরীক্ষার ফিয়ের কথাটাই তাহারা জানে। পরীক্ষা দেওয়ার সংকল্প আজও স্বর্ণ অটুট রাখিয়াছে, মেয়েটির অদ্ভুত জেদ। সে তাহাকে বলিয়াছিল–দেবুদা, বাবার তো এই অবস্থা! দাদা চলে গিয়েছে। যেটুকু জমি আছে, তাও থাকবে না। এর পর আমাদের কি অবস্থা হবে? শেষে লোকের বাড়ি ঝিগিরি করে খেতে হবে?

দেবু চুপ করিয়াই ছিল। এ কথার উত্তরই বা কি দিবে সে?

স্বর্ণ আবার বলিয়াছিল—সেদিন জংশনে গিয়েছিলাম, বালিকা বিদ্যালয়ের দিদিমণির সঙ্গে দেখা হল। তিনি আমাকে বললেন– মাইনর পাস কর তুমি, তোমাকে আমাদের ইস্কুলে নেব। ছোট মেয়েদের পড়াবে তুমি। দশ টাকায় ভর্তি হতে হবে। তারপর বাড়িয়ে দেবেন।

দেবু নিজেও অনেক ভাবিয়া দেখিয়াছে। এ ছাড়া স্বর্ণের জন্য কোনো পথ সে দেখিতে পায় নাই। আগেকার কালে অবশ্য এ পথের কথা কেহ ভাবিতেও পারিত না। বিধবার চিরাচরিত পথ বাপ-মা অথবা ভাইয়ের সংসারে থাকা। কেহ না থাকিলে, অন্যের বাড়িতে চাকরি করা। যাহারা শূদ্ৰ, বামুন-বাড়িতে ঝিয়ের কাজ অথবা অবস্থাপন্ন স্বজাতীয়ের বাড়িতে পাচিকার কাজই ছিল দ্বিতীয় উপায়। আর এক উপায়—শেষ উপায়—সে উপায়ের কথা ভাবিতেও দেবু শিহরিয়া ওঠে। মনে পড়ে শ্ৰীহরিকে, মনে পড়ে পদ্মকে। সে মনে মনে বার বার স্বর্ণকে ধন্যবাদ দিয়াছে, সে যে এরূপ সাধু সংকল্প করিতে পারিয়াছে, এজন্যও তাহাকে অনেক প্ৰশংসা করিয়াছে। ভাবিয়া আশ্চর্যও হইয়াছে—মেয়েটি আবেষ্টনীর প্রভাব কাটাইয়া এমন সংকল্পের প্রেরণা কেমন করিয়া পাইল?

প্রাচীন লোকে বলে—কাল-মাহাত্ম্য! কলিকাল।

চণ্ডীমণ্ডপে, লোকের বাড়িতে, স্নানের ঘাটে এই কথা লইয়া ইহারই মধ্যে অনেক সবিদ্রুপ আলোচনা চলিতেছে।

দেবুকেও অনেকে বলিয়াছে—পণ্ডিত, এ কাজ ভাল হচ্ছে না। এর ফল পরে বুঝবে। অনেক কুৎসিত ইঙ্গিত করিয়াছে ইহার ভবিষ্যৎ লইয়া আলোচনা প্রসঙ্গে।

—মেয়েতে বিবি সেজে জংশনে চাকরি করতে যাবে কি হে? তখন তো সে যা মন চাইবে—তাই করবে।

দেবু যে এ কথা মানে না এমন নয়। জংশনের বালিকা বিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষয়িত্ৰী এখান হইতে ভীষণ দুর্নাম লইয়া চলিয়া গিয়াছে। সদরের হাসপাতালের একজন লেডি ডাক্তারকে লইয়া একজন হোমরা-চোমরা মোক্তার বাবুর কলঙ্কের কথা জেলায় জানিতে কাহারও বাকি নাই। কিন্তু পরের ঘরে ঝিয়ের কাজ করিলেও তো সে অপযশ সে পাপের সম্ভাবনা হইতে পরিত্রাণ নাই। জংশনের কলেও তা কত মেয়েছেলে কাজ করিতে যায়। সেখানেও কি তাহারা নিষ্কলঙ্ক থাকিতে পারে? কিন্তু এসব যেন লোকের সহিয়া গিয়াছে। দেবুর মুখে তিক্ত হাসি ফুটিয়া উঠিয়ছিল। এ ছাড়াও স্বর্ণের উপর তাহার বিশ্বাস আছে, শিক্ষার প্রতি তাহার শ্ৰদ্ধা আছে। স্বর্ণ লেখাপড়া শিখিলে, তাহার জীবন উজ্জ্বলতর হইবে বলিয়া তাহার দৃঢ় ধারণা।

তিনকড়িকেও সে স্বর্ণের সংকল্পের কথা বলিল—তিনকড়িও বলিল–ওর আর কথা নাই। বাবা! তুমি তাই করে দাও। স্বনের জন্যে নিশ্চিন্ত হলে আর আমার কোনো ভাবনাই রইল না। কালাপানি কি ফাঁসি হলেও আমি হাসতে হাসতে যেতে পারব।

দেবু চুপ করিয়া রহিল। স্বর্ণের কথা–প্রসঙ্গে তিনকড়ি নিজের অপরাধের কথাটা তুলিতেই সে মনে অশান্তি অনুভব করিল।

তিনকড়ি মনের আবেগে অকপটে সব খুলিয়া বলিল।

বলিল–দেবু, এ আমার কপালের ফের বৈকি! চিরকালটা রামাদের এই পাপের জন্যে গাল দিয়েছি, মেরেছি, দু মাস তিন মাস ওদের মুখ পর্যন্ত দেখি নি। বাবা, জীবনের মধ্যে পরের পুকুরের দুটো-একটা মাছ ছাড়াপরের একটা কুটোগাছা কখনও নিই নি। সেই আমার কপালের দুৰ্ম্মতি দেখ! আমার অদেষ্ট আমাকে যেন ঘাড়ে ধরে এ পথে নিয়ে এল। বানে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেল। দেবু, তোমাদিকে লুকিয়ে প্রথম প্রথম থালা-কাসা বেচলাম, তারপর অন্ধকার হল চারিদিক। ভাবলাম, তোমাদের সাহায্য-সমিতিতে যাই। কিন্তু লজ্জা হল। বীজধান নিয়ে এলাম প্রথম, তাও অর্ধেকের উপর খেয়েই ফেললাম। তখন রামা একদিন এল। বললে—মোড়লদাদা, আমাদিগকে তুমি কিছু বলতে পাবে না। আমরা তোমার ওই সমিতির ভিক্ষে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারব। বাপ্পী লাঠিয়াল, আমরা ডাকাত, চিরকাল জোর করে। খেয়েছি-আজ ভিক্ষে নিতে পারব না। ও মাগা চালের ভাত গলা দিয়ে নামছে না। আমাদের যা হয় হবে। তুমি আমাদের পানে চোখ বুজে থেকো। আমরা আমাদের উপায় করে নেব।… আমি বলেছিলাম-আমি ভিক্ষা নিতে পারলে তোরা পারবি না কেন? রামা বলেছিল—তোমাকেও ও ভাত খেতে দোব না। ভিস্থ মাতে দোব না তোমায়। তুমি মোড়ল—তুমি তোমার বাপপিতেমা চিরকাল মাথা উঁচু করে রয়েছ-পাঁচজনাকে খাইয়েছ, ভিক্ষে লিতে শরম লাগে না তোমার? বরং যার বেশি আছে, তার কেড়ে লিই এস… তবু আমি বলেছিলাম এ পাপ! এ পাপ। করতে নাই! রামা বললে—আমরা কালীমায়ের আজ্ঞা নিয়ে যাই মোড়ল, পাপ হলে, মা আজ্ঞে দিবে কেন? বেশ, তুমি মায়ের মাথায় ফুল চড়াও, ফুল যদি পড়ে—তবে বুঝবে মায়ের আজ্ঞে তাই। আর না পড়ে—তুমি যাবে না।… তা শ্মশানে কালীপুজো হল সেদিন রাত্রে। ফুল চড়ালাম মাথায়; ফুল পড়ল।…

তিনকড়ি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিল। তারপর হাসিয়া বলিল—আমার কপালে এই ছিল বাবা। আমিই বা কি করব! তুমি উকিল দিলে—বেশ করলে। আর এসব নিয়ে নিজেকে জড়িও না। এরপর পুলিশ তোমাকে নিয়ে হাঙ্গামা করবে। তুমি বরং মায়ের একটা ভাল ব্যবস্থা করে দিয়ে। তা হলেই আমি নিশ্চিন্ত। বল, আমাকে কথা দাও, স্বন্নের ব্যবস্থা করবে তুমি?

দেবুকে সমর্থন করিয়াছে কেবল জগন ডাক্তার। ডাক্তার দোষেগুণে সত্যই বেশ লোক। যেটা তাহার ভাল লাগে সেটা সে অকপটে সমর্থন করে। যেটা মন্দ মনে হয় সেটার গতিরোধ করিতে পারুক নাই পারুক-আকাশ ফাটাইয়া চিৎকার করিয়া বলেনা না। এ অন্যায়-এ হতে পারে না।

আর সমর্থন করিয়াছে অনিরুদ্ধ।

মাস দেড়েক হইয়া গেল—অনিরুদ্ধ এখনও রহিয়াছে। চাকরির কথা বলিলে সে বলে–আমার চাকরির ভাবনা! হাতুড়ি পিটব আর পয়সা কামাব। পয়সা সব ফুরিয়ে যাক-আবার চলে যাব। কেয়া পরোয়া? মাগ না ছেলে, ঢেঁকি না কুলো—শালা বোঝার মধ্যে শুধু একটা সুটকেস। হাতে ঝুলিয়ে যোব আর চলব মজেসে!

সে এখন আড্ডা গাড়িয়াছে দুর্গার ঘরে। দুর্গার ঘরে ঠিক নয়—থাকে সে পাতুর ঘরে। ওইখানেই তার আড্ডা। দেবু বুঝিতে পারে অনিরুদ্ধ দুর্গাকে চায়। কিন্তু দুর্গা অদ্ভুত রকমে পাল্টাইয়া গিয়াছে; ও-ধার দিয়াও ঘেঁষে না; দেবুর ঘরে কাজ-কর্ম করে, দুইটা খায়, রাত্রে গিয়া ঘরে খিল অ্যাঁটিয়া শোয়। প্রথম প্রথম শ্রীহরির রটনায় দেবুকে জড়াইয়া যে অপবাদটা উঠিয়াছিল—সেটা ওই দুর্গার আচরণের জন্যই আপনি মরিয়া গিয়াছে সকালের আকাশে অকালের মেঘের মত। তাহার উপর বন্যার পরে দেবু যখন সাহায্য-সমিতি গঠন করিয়া বসিল, দেশ-বিদেশ হইতে দেবুর নামে টাকা আসিল, দেবুকে কেন্দ্ৰ করিয়া পাঁচখানা গ্রামের বালকসম্প্রদায় আসিয়া জুটিলচাষীর ছেলে গৌর হইতে আরম্ভ করিয়া জংশনের স্কুলের ছেলেরা পর্যন্ত ভিক্ষা করিয়া দেবুর ভাণ্ডার পূর্ণ করিয়া দিল এবং দেবুও যখন সকলকে সাহায্য দিল—ভিক্ষা দেওয়ার ভঙ্গিতে নয়—আত্মীয়কুটুম্বের দুঃসময়ে তত্ত্বতল্লাশের মত করিয়া সাহায্য দিল, তখন লোকে তাহাকে পরম সমাদরের সঙ্গে মনে মনে গ্রহণ করিল, তাহার প্রতি অবিচারের ত্রুটিও স্বীকার করিল। সমাজের বিধানে দেবু পতিত হইয়াই আছে। পাঁচখানা গ্রামের মণ্ডলদের লইয়া শ্ৰীহরি যে ঘোষণা করিয়াছে—তাহার প্রকাশ্য প্রতিবাদও কেহ করে নাই। কিন্তু সাধারণ জীবনে চলাফেরায়—মেলামেশায় দেবুর সঙ্গে প্রায় সকলেরই ঘনিষ্ঠতা বজায় আছে এবং সে ঘনিষ্ঠতা দিন দিন গাঢ়তর হইয়া উঠিতেছে। শ্ৰীহরি চণ্ডীমণ্ডপে দাঁড়াইয়া সবই লক্ষ্য করে। দু-চারজনকে সে প্রশ্ন করিয়াছিল—দেবুর ওখানে যে এত যাওয়া-আসা কর—জান দেবু পতিত হয়ে আছে?

শ্ৰীহরি একদিন প্রশ্ন করিয়াছিল রামনারায়ণকে। সে তাহার তাবের লোক। অন্তত শ্ৰীহরি তাই মনে করে। রামনারায়ণ ইউনিয়ন বোর্ড পরিচালিত প্রাইমারি স্কুলের পণ্ডিত। রামনারায়ণ শ্ৰীহরিকে খাতিরও করে; এক্ষেত্রে সে বেশ বিনয়ের সঙ্গেই উত্তর দিয়াছিল—তা যাই আসি ভাই বন্ধুলোক, তার ওপর ধরুন সাহায্য-সমিতি থেকে এ দুর্দিনে সাহায্যও নিতে হয়েছে। দশখানা গায়ের লোকজন আসে। যাই, বসি, কথাবার্তা শুনি। পতিত করেছেন পঞ্চায়েত–দশখানা গায়ের লোক যদি সেটা না মানে, তবে একা আমাকে বলে লাভ কি বলুন!

শ্ৰীহরি রাগ করিয়াছিল। দশখানা গাঁয়ের লোকের উপরেই রাগ করিয়াছিল; কিন্তু সে রাগটা প্রথমেই পড়িয়াছিল–রামনারায়ণের উপর। ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বর সে, কৌশল করিয়া অপর সভ্যদের প্রভাবান্বিত করিয়া রামনারায়ণের উপর এক নোটিশ দিয়াছিল। তোমার অনুপযুক্ততার জন্য তোমাকে এক মাসের নোটিশ দেওয়া যাইতেছে। কিন্তু দেবু সে নোটিশের উত্তরে—ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টর অব স্কুল-এর নিকট একখানা ও সার্কেল অফিসারের মারফত এস্-ডিওর কাছে বহু লোকের সইযুক্ত একখানা দরখাস্ত পাঠাইয়া রামনারায়ণের উপযুক্ততা প্রমাণ করিয়া সে নোটিশ নাকচ করিয়া দিয়াছে।

তারা নাপিতকেও শ্রীহরি শাসন করিয়াছিল—তুই দেবুকে ক্ষৌরি করিস কেন বল্ তো? ধূর্ত তারার আইন-জ্ঞান টনটনে; সে বলিয়াছিল—আজ্ঞে, আগের মতন ধান নিয়ে কামানো আজকাল উঠে গিয়েছে। ধরুন যারা পতিত নয়—তাদের অনেকে নিজে ক্ষুর কিনে কামায়, রেল জংশনে গিয়ে হিন্দুস্থানি নাপিতের কাছে কামিয়ে আসে; আমি পয়সা নিতে কত বাইরের লোককেও কামাই। পণ্ডিত পয়সা দেন-আমি কামিয়ে দিই। আমার তো পেট চলা চাই। আপনি মস্ত লোক যারা ক্ষুর কিনেছে, কি যারা অন্য নাপিতের কাছে কামায়, তাদের বারণ করুন দেখি; তখন একশো বারঘাড় হেঁট করে আমি হুকুম মানব; পণ্ডিতকে কামাব না আমি।

শ্ৰীহরি ব্যাপারটা লইয়া আর কোনো উচ্চবাচ্য করে নাই; কিন্তু সাক্ষাতে সে সমস্তই লক্ষ্য করিতেছে। তিনকড়ির মামলায় সে যথাসাধ্য পুলিশ-কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করিতেছে। তিনকড়ি ডাকাতির মামলায় ধরা পড়ায় সে মহাখুশি হইয়াছে—সে কথা সে গোপন করে না।

ঘটনাটা যখন সত্য, তখন পুলিশকে সাহায্য করায় দেবু শ্রীহরিকে দোষ দেয় নাই। কিন্তু আক্রোশবশে শ্রীহরি তাহার ঝুনা গোমস্তা দাসজীর সাহায্যে মিথ্যা সাক্ষী খাড়া করিবার চেষ্টা করিতেছে। দাসজী নিজে নাকি পুলিশকে বলিয়াছে যে, সে স্বচক্ষে তিনকড়ি ও রামভল্লাদের লাঠি হাতে ঘটনার রাত্রে তিনটার সময় বাঁধের উপর দিয়া ফিরিয়া আসিতে দেখিয়াছে। সে নিজে সেদিন জংশনে রাত্রি দেড়টার ট্রেনে নামিয়া ফিরিবার পথে রাস্তা ভুল করিয়া দেখুড়িয়ার কাছে। গিয়া পড়িয়াছিল।

এই কথা মনে করিয়া দেবুর মন শ্ৰীহরির উপর বিষাইয়া ওঠে। ঘৃণাও হয় যে তিনকড়ির বিপদে শ্রীহরি হাসে, সে খুশি হইয়াছে। সে আরও জানে—অদূর ভবিষ্যতে তিনকড়ির জেল হইবার পর, শ্ৰীহরি আবার একবার পড়িবে স্বর্ণকে লইয়া। তাহার আভাসও সে পাইয়াছে। সে বলিয়াছে জুতো পায়ে দিয়ে জংশনের ইস্কুলে মাস্টারি করবে বিধবা মেয়ে! … আচ্ছা, দেখি কেমন করে করে! আমি তো মরি নাই এখনও!…

 

সন্ধ্যাবেলায় আপনার দাওয়ায় বসিয়া দেবু এই সব কথাই ভাবিতেছিল। আজ তাহার মজলিসে কেহ আসে নাই। দূরে ঢাক বাজিতেছে। আজ রাত্রে জগদ্ধাত্রী প্রতিমার বিসৰ্জন উৎসব। কঙ্কণার বাবুদের বাড়িতে তিনখানি জগদ্ধাত্রী পূজা হইয়া থাকে। সে এক পূজার প্রতিযোগিতা। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কে কত আগে খাওয়াইতে পারে এবং কাহার বাড়িতে কতগুলি মাছতরকারি, এই লইয়া প্রতিবারই পূজার পরও কয়েক দিন ধরিয়া আলোচনা চলে। বিসর্জন উপলক্ষে বাজি পোড়ানো লইয়া আর একদফা প্রতিযোগিতা হয়।… সকলেই প্রায় বাজি পোড়ানো দেখিতে ছুটিয়াছে। জগন ডাক্তার, হরেন ঘোষাল পর্যন্ত গিয়াছে পাতুদের দলবলসহ। দুৰ্গাও গিয়াছে। শ্ৰীহরিও গিয়াছে সন্ধ্যার আগেই। শ্ৰীহরির বাহারের টাপর-চাপানো গাড়িখানা দেবুর দাওয়ার সুমুখ দিয়াই গিয়াছে। গলায় ঘণ্টার মালা পরানো তেজী বলদ দুইটা হেলিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল। গাড়ির পাশে লাল পাগড়ি বাঁধিয়া কালু শেখ এবং চৌকিদারি নীল উর্দি ও পাগড়ি অ্যাঁটিয়া ভূপাল বাণীও গিয়াছে। সে জমিদার শ্রেণীর মানুষ এখন; তাহার বিশেষ নিমন্ত্ৰণ আছে।

গ্রামের মধ্যে আছে যাহারা, তাহারা বৃদ্ধ অক্ষম, অথবা রুগণ কিংবা সদ্যশোকাতুর। শোকাতুর এ অঞ্চলে প্রায় প্রতিটি মানুষ। বন্যার পর করাল ম্যালেরিয়া অঞ্চলটার প্রতি ঘরেই। একটানা-একটা শেল হানিয়া গিয়াছে। তাহাদের অধিকাংশ লোক-ওই সদ্য-শোকাৰ্তরা ছাড়া সকলেই গিয়াছে। ভাসান দেখিতে, আলো-বাজনা-বাজি পোড়ানোর আনন্দে মাতিতে এই পথে দেবুর চোখের উপর দিয়া সব গিয়াছে। তৃষ্ণার্ত মানুষ যেমন বুকে হটিয়া মরীচিকার দিকে ছুটিয়া যায় জলের জন্য—তেমনি ভাবেই মানুষগুলি ছুটিয়া গেল—ক্ষণিকের মিথ্যা আনন্দের জন্য। কিছুক্ষণ আগে একা একটি লোক গেল-মাথায় কাপড় ঢাকিয়া, দেবু তাহাকেও চিনিয়াছে। সে ও-পাড়ার হরিহরপরশু তাহার একটা ছেলে মারা গিয়াছে। দেবু একটা। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। উহাদের কথায় মনে পড়িল নিজের কথা—বিলুকে, খোকাকে। সেই বা বিলুকে খোকাকে কতক্ষণ মনে করে। তাহার মুখে বাঁকা হাসি ফুটিয়া উঠিল।… কতক্ষণ? দিনান্তে একবার স্মরণ করে না। হিসাব করিয়া দেখিল-মাসান্তে একদিন একবার হইবে কিনা সন্দেহ। কেবল কাজ কাজ পরের কাজের বোঝ ঘাড়ে করিয়া ভূতের ব্যাপার খাঁটিয়া চলিয়াছে। সে। এ বোঝ কবে নামিবে কে জানে!–

তবে এইবার হয়ত নামিবে বলিয়া মনে হইতেছে।

সাহায্য-সমিতির টাকা ও চাউল ফুরাইয়া আসিয়াছে। অন্যদিকেও সাহায্য-সমিতির প্রয়োজনও কমিয়া আসিল। আশ্বিন চলিয়া গিয়াছে—কার্তিকও শেষ হইয়া আসিল। এখানে ওখানে দুই-চারিটা আউশ ইতিমধ্যেই চাষীর ঘরে আসিয়াছে। ভাষা ধানও কাটিয়াছে। অগ্রহায়ণের প্রথমেই নবীনা ধান উঠিবে, তাহার পর ধান কাটিবে আমন। পঞ্চগ্রামের মাঠই এ অঞ্চলের মধ্যে প্রধান মাঠ—সেই মাঠে অবশ্য এবার কিছুই নাই। কিন্তু প্রতি গ্রামেরই অন্যদিকেও কিছু কিছু জমি আছে। সেই সব মাঠ হইতে ধান কিছু কিছু আসিবে। সদ্য অভাবটা ঘুচিবে। দু-মাসের মধ্যে ম্যালেরিয়া অনেকখানি সহনীয় হইয়া উঠিয়াছে। এখন তাহার তেজ কমিয়াছে—আর সে মড়কের ভয়াবহতা নাই। ছেলে অনেক গিয়াছে; বয়স্ক মরিয়াছেও কম নয়। গরু-মহিষ প্রায় অর্ধেক উজাড় হইয়াছে। সেই অর্ধেক গরু-মহিষ লইয়াই লোকে আবার চাষের কাজে নামিয়াছে। রামের একটা শ্যামের একটা লইয়া রাম-শ্যাম দুজনে গাতো করিয়া কিছু কিছু রবি ফসল চাষের উদ্যোগ করিতেছে।

 

দেবু দেখে আর ভাবে—আশ্চর্য মানুষ! আশ্চর্য সহিষ্ণুতা! আশ্চর্য তাহার বাঁচিবার ঘরকন্না করিবার সাধ-আকাঙ্ক্ষা! এই মহাবিপর্যয়—বন্যারাক্ষসীর করকরে জিভের লেহনচিহ্ন সর্বাঙ্গে অঙ্কিত; এই অভাব, এই রোগ, ওই মড়কের মধ্যে ঘরের ভাঙন, জমির বালি, ক্ষেতের গর্ত-সমস্তই মানুষ এক লহমায় মুছিয়া ফেলিল। কালই সে পঞ্চগ্রামের মাঠ দেখিয়া আসিয়াছে। দেখুড়িয়ায় গিয়াছিল–স্বর্ণদের তল্লাস করিতে। পঞ্চগ্রামের মাঠের মধ্য দিয়া আল-পথের দুই ধারের জমিগুলিতে কিছু কিছু চাষ হইয়াছে। এখন ছোলা, মশুর, গম, যব, সরিষার বীজ সগ্ৰহ করার দায়টাই সাহায্য-সমিতির শেষ দায়। এই কাজটা করিয়া ফেলিতে পারিলেই সাহায্য সমিতি সে বন্ধ করিয়া দিবে।

সাহায্য-সমিতির দায়ের বোঝা এইবার ঘাড় হইতে নামিবে।

আর এক বোঝা—তিনকড়ির সংসারের বোঝা। এই নূতন দায়টি লইয়াই তাহার চিন্তার অন্ত নাই। তিনকড়ির মামলার শেষ হইতে আর দেরি নাই। শোনা যাইতেছে শীঘ্রই বোধ। হয় এক মাসের মধ্যে দায়রায় উঠিবে। দায়রার বিচারে তিনকড়ির সাজা অনিবার্য। তারপর স্বর্ণ ও তিনকড়ির স্ত্রীকে লইয়া সমস্যা বাঁধিবে। এ দায় সত্যকার দায়, মহাদায়। শ্ৰীহরির শাসনবাক্য সে শুনিয়াছে। কাহারও শাসনবাক্যকে সে আর ভয় করে না। শাসনবাক্য শুনিলেই তাহার মনের আগুনের শিখা জ্বলিয়া ওঠে। তারা নাপিতের কাছে কথাটা শুনিয়া সেদিন তাহার মনে হইয়াছিল—তিনকড়ির জেল হইলে সে স্বর্ণ এবং তাহার মাকে নিজের বাড়িতে আনিয়া রাখিবে। স্বর্ণ যে রকম পরিশ্রম করিতেছে এবং যে রকম তাহার ধারালো বুদ্ধি, তাহাতে সে এম-ই পরীক্ষায় পাস করিবেই। জংশনের স্কুলে সে নিজে উদ্যোগী হইয়া তাহার চাকরি করিয়া দিবে, এবং স্বর্ণ যাহাতে ম্যাট্রিক পাস করিতে পারে, তাহাও সে করিবে। শ্ৰীহরি বলিয়াছে জুতা পায়ে দিয়া বিধবা মেয়ে চাকরি করিলে, সে সহ্য করিবে না। তবু স্বর্ণকে সে রীতিমত আজকালকার শিক্ষিত মেয়ের মত সাজপোশাক পরাইবে। সাদা থানকাপড়ের পরিবর্তে সে তাহাকে রঙিন শাড়ি কাপড় পরিবার ব্যবস্থা করিয়া দিবে। বিধবা! কিসের বিধবা স্বর্ণ? সঁচ বৎসর বয়সে বিবাহ-সাত বৎসর বয়সে বিধবা বিদ্যাসাগর মহাশয় এই সব বিধবার বিবাহের জন্য প্ৰাণপাত করিয়া গিয়াছেন। আইন পর্যন্ত পাস হইয়া রহিয়াছে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথা তাহার মনে পড়িল–

হা ভারতবর্ষীয় মানবগণ! আর কতকাল তোমরা মোহনিদ্রায় অতিভূত হইয়া প্রমোদশয্যায় শয়ন করিয়া থাকিবে! …হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে ভারতবর্ষে আসিয়া জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পার না।… স্বর্ণের একটা ভাল বিবাহ দিয়া তাহাদের লইয়াই সে আবার নূতন করিয়া সংসার পাতিবে।

এসব তাহার উত্তেজিত মনের কথা। স্বাভাবিক শান্ত অবস্থায় স্বর্ণদের চিন্তাই এখন তাহার বড় চিন্তা হইয়াছে। অভিভাবকহীন স্ত্রীলোক দুটিকে লইয়া কি ব্যবস্থা সে যে করিবেস্থির করিতে পারিতেছে না। গৌর থাকিলে সে নিশ্চিন্ত হইত। লজ্জায়-দুঃখে সে কোথায় চলিয়া গেল—তাহার কোনো সন্ধানই মিলিল না! খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হইয়াছিল, তাহাতেও কোনো ফল হয় নাই। হঠাৎ একটা কথা তাহার মনে হইয়া গেল। সে কয়েক মুহূর্ত স্থির হইয়া ভাবিয়া উঠিল। উপায় সে পাইয়াছে।

দূরে দুমদাম ফটফাট শব্দ উঠিতেছে। বোম-বাজি ফাটিতেছে। কদম গাছের ফুল ফাটিতেছে। ওই যে আকাশের বুকে লাল-নীল রঙের ফুলঝুরি ঝরিতেছে, হাউই বাজি পুড়িতেছে!….

উপায় সে পাইয়াছে! সাহায্য-সমিতির দায় হইতে মুক্তি পাইলেই সে তাহার নিজের জমি-বাড়ি স্বর্ণ এবং স্বর্ণের মাকে ভোগ করিতে দিয়া একদিন রাত্রে উঠিয়া চলিয়া যাইবে। স্বর্ণ এবং তাহার মায়ের বরং জংশনে স্কুলের শিক্ষয়িত্রীদের কাছাকাছি কোথাও থাকিবার একটা ব্যবস্থা করিয়া দিবে। স্বর্ণ স্কুলে চাকরি করিবে, তাহার জমিগুলি সতীশ বাউরির হাতে চাষের ভার দিবে; সে ধান তুলিয়া স্বৰ্ণদের দিয়া আসিবে। তারপর গৌর কি কোনো দিনই ফিরিবে না? ফিরিলে সে-ই এই সব ভার লইবে।

এই পথ ছাড়া মুক্তির উপায় নাই। হ্যাঁ, তাই সে করিবে! সংসার হইতে বন্ধন হইতে মুক্তিই সে চায়। প্রাণ তাহার পাইয়া উঠিয়াছে। আর সে পারিবে না। আর সে পরের বোঝ। বহিয়া ভূতের ব্যাগার খাঁটিতে পারিতেছে না। তাহার বিলুতাহার খোকাকে মনে করিবার অবসর হয় না, রাজ্যের লোকের সঙ্গে বিরোধ মনান্তর করিয়া দিন কাটানো, কলঙ্ক-অপবাদ অঙ্গের ভূষণ করিয়া ওয়া—এসব আর তাহার সহ্য হইতেছে না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া অতল শান্তির মধ্যে নিরুদ্বেগ আনন্দের মধ্যে দিন কাটাইতে চায় সে। সে তাহার বৈচিত্র্যময় ব্যথাতুর অতীতকে পিছনে ফেলিয়া গ্রাম হইতে বাহির হইয়া পড়িবে। প্রাণ ভরিয়া সে খোকনকে বিলুকে স্মরণ করিবেভগবানকে ডাকিবেতীর্থে তীর্থে ঘুরিয়া বেড়াইবে। যাইবার আগে সে অন্তত একটা কাজ করিবে—খোকন এবং বিলুর চিতাটি সে পাকা করিয়া বাঁধাইয়া দিবে। আর শ্মশানঘাটে একখানি ছোট টিনের চালাঘর করিয়া দিবে। জলে, ঝড়ে, শিলাবৃষ্টিতে, বৈশাখের রৌদ্রে শ্মশানবন্ধুদের বড়। কষ্ট হয়। একখানি মার্বেল ট্যাবলেটে লিখিয়া দিবে বিলু ও খোকনের স্মৃতিচিহ্ন।

খোকন ও বিলু! আজ এই নির্জন অবসরে তাহারা যেন প্ৰাণ পাইয়া জাগিয়া উঠিয়াছে মনের মধ্যে। খোকন ও বিলু। সামনেই ওই শিউলিগাছটার ফাঁকে জ্যোত্সা পড়িয়াছে মনে হইতেছে বিলুই যেন দাঁড়াইয়া আছে, পদ্মের মত আসিয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে হাতছানি দিয়া ডাকিতেছে। তাহার খোকন ও বিলু!

দেবু চমকিয়া উঠিল। মাত্র একটুখানি সে অন্যমনস্ক হইয়াছিল, হঠাৎ দেখিল শিউলিতলার পাশ হইতে কে বাহির হইয়া আসিতেছে। ধবধবে কাপড় পরা নারীমূর্তি। বিলু—বিলু! হা … ওই যে তাহার কোলে খোকন। খোকনকে কোলে করিয়া সে দাওয়ায় আসিয়া উঠিল। দেবুর সর্বশরীরে একটা শিহরন বহিয়া গেল। শিরায়-শিরায়—যেন রক্তধারায় আগুন ছুটিতেছে। সে তক্তপোশে বসিয়া ছিল–লাফ দিয়া উঠিয়া গিয়া অন্ধ আবেগে দুই হাতে বিলুকে বুকে টানিয়া চাপিয়া ধরিল, মুখকপাল চুমায় চুমায় ভরিয়া দিল। বঁচিয়া উঠিয়াছে—বিলু তাহার বাঁচিয়া উঠিয়াছে।

—এ কি জামাই, ছাড় ছাড়! ক্ষেপে গেলে নাকি?

দেবু চমকিয়া উঠিল। আর্তম্বরে প্রশ্ন করিল—কে? কে?

—আমি দুগ্‌গা। তুমি বুঝি–

–অ্যাঁ, দুর্গা। … দেবু তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া যেন পাথর হইয়া গেল।

দুর্গা বলিল–ঘোষেদের ছেলেটা ভিড়ের ভেতর সঙ্গ হারিয়ে কাঁদছিল, নিয়ে এলাম কোলে করে। মরণ আমার দিয়ে আসি বাড়িতে।

দেবু উত্তর দিল না। পক্ষাঘাতগ্ৰস্তের মত সে অসাড়ভাবে দাওয়ার উপর বসিয়া পড়িল। দুর্গা চলিয়া গেল।

দুর্গা ফিরিয়া আসিয়া দেখিল—দেবু তক্তপোশের উপর উপুড় হইয়া শুইয়া আছে।

সে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল—মুখে তাহার বিচিত্ৰ হাসি ফুটিয়া উঠিল; সে মৃদুস্বরে ডাকিল—জামাই-পণ্ডিত!

দেবু উঠিয়া বসিল–কে, দুর্গা?

–হ্যাঁ!

–আমাকে মাফ করিস দুর্গা, কিছু মনে করি না।

–কেন গো, কিসের কি মনে করব আবার! … দুর্গা খিলখিল করিয়া হাসিয়া সারা হইল।

–আমার মনে হল দুর্গা, শিউলিতলা থেকে বিলু যেন খোকনকে কোলে করে বেরিয়ে আসছে। আমি ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম, থাকতে পারলাম না।

দুর্গা একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল—কোনো উত্তর দিল না। নীরবেই ঘরের শিকল খুলিয়া ঘরের ভিতর হইতে লণ্ঠনটা আনিয়া তক্তপোশের উপর রাখিয়া বলিল–অ্যাঁধারে কত কি মনে হয়। আলোটা নিয়ে বসলেই।… কথা বলিতে বলিতেই সে আলোর শিখাটা বাড়াইয়া দিতেছিল; উজ্জ্বলতর আলোর মধ্যে দেবুর মুখের দিকে চাহিয়া সে অকস্মাৎ স্তব্ধ হইয়া গেল। তারপর সবিস্ময়ে বলিল—এর জন্যে তুমি কাঁদছ জামাই-পতি!

দেবুর দুই চোখের কোল হইতে জলের রেখা আলোর ছটায় চকচক করিতেছে! দেবু ঈষৎ একটু ম্লান হাসিয়া হাত দিয়া চোখের জল মুছিয়া ফেলিল।

দুর্গা বলিল-জামাই-পণ্ডিত! তুমি আমাকে ছুঁয়েছ বলে কাঁদছ?

দেবু বলিল চোখ থেকে জল অনেকক্ষণ থেকেই পড়ছে দুর্গা; আজ মনে পড়ে গেল–খোকন আর বিলুকে। হঠাৎ তুই এলি ছেলে কোলে করে—আমার কেমন ভুল হয়ে গেল।… দেবুর চোখ দিয়া আবার জল গড়াইয়া পড়িল।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া দুর্গা বলিল—তোমার মত লোক জামাই-পণ্ডিত—তোমাকে। কি কাঁদতে হয়?

হাসিয়া দেবু বলিল-কাঁদতেই তো হয় দুর্গা। তাদের কি ভুলে যেতে পারি?

দুর্গা বলিলতা বলছি না জামাই। বলছি তোমার মত লোক যদি কাঁদবে, তবে গরিবদুঃখীর চোখের জল মোছাবে কে বল?

দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সম্মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

ওদিকে ময়ূরাক্ষীর তীরের বাজনা থামিয়া গিয়াছে। দূরে লোকজনের সাড়া পাওয়া যাইতেছে, সাড়া আগাইয়া আসিতেছে।

দুর্গা বলিল—উনোনে আগুন দিই, জামাই। অনেক রাত হল, ওঠ।

–নাঃ, আজ আর কিছু খাব না।

–ছিঃ! তোমার মুখে ও কথা সাজে না। ওঠ, ওঠ। না উঠলে তোমার পায়ে মাথা ঠুকব আমি। দেবু হাসিয়া বলিল—বেশ। চল।

হঠাৎ নিকটেই কোথাও ঢোল বাজিয়া উঠিল! বিস্মিত হইয়া দেবু বলিল–ও আবার কি? দুর্গা হাসিয়া বলিল—কম্মকার, আবার কে!

–অনিরুদ্ধ?

–হ্যাঁ। ভাসান দেখতে গিয়ে—যা হুল্লোড় করলে! আজ আবার পাকী মদ এসেছিল। পাড়ার লোককে খাইয়েছে। এই রেতে আবার মঙ্গলচণ্ডীর গান হবে। তাই আরম্ভ হল বোধ হয়।

দেবু হাসিল। অনিরুদ্ধ ফিরিয়া আসিয়া ওই পাড়াটাকে বেশ জমাইয়া রাখিয়াছে। জমাইয়া রাখিয়াছেই নয়—অনেককে অনেক রকম সাহায্যও করিয়াছে।

দুর্গা বলিল—দাদা যে কৰ্মকারের সঙ্গে কাজ করতে কলকাতা চলল, শুনেছ?

—এমনি শুনেছি! অনিই একদিন বলছিল।

—আরও সব কজনা কৰ্ম্মকারকে ধরেছে। তা কম্মকার বলেছে—সবাইকে নিয়ে কোথা যাব আমি? পাতু আমার পুরনো ভাবের লোক, ওকে নিয়ে যাব। তোরা সব জংশনেৰ কলে গিয়ে কাজ কর।

—তাই নাকি?

–হ্যাঁ। আজই সব সন্ধেবেলায় ভাসান দেখতে যাবার আগে, খুব কলকল করছিল সব। সতীশ দাদা বলছিল—কলে খাটতে যাবি কি? আর আর সবাই বলছিল—আলবত যাব, খুব যাব। কন্মকার ঠিক বলেছে। সে সব লাফানি কি! মদের মুখে তো!

দেবু চুপ করিয়া রহিল। দুর্গার কথাটার মধ্যে দেবুর মন চিন্তার বিষয় খুঁজিয়া পাইয়াছে। কলে খাঁটিতে যাইবে! ওপারে জংশনে কল অনেক দিন হইয়াছে। কিন্তু আজও পর্যন্ত এ গ্রামের দীনদরিদ্র ও অবনত জাতির কেহই খাঁটিতে যায় নাই। সাঁওতাল এবং হিন্দুস্থানি মুচিরাই কলে মজুর খাঁটিয়া থাকে। কলের মজুরদের অবস্থাও সে জানে। পয়সা পায় বটে, মজুরিও বাধা বটে, কিন্তু কলে যে সব কাণ্ড ঘটিয়া থাকে, তাহাতে গৃহস্থের গৃহধর্ম থাকে না। গৃহও না—ধৰ্মও না। এতদিন ধরিয়া কলের লোকেরা অনেক চেষ্টা করিয়াছে, অনেক লোভ দেখাইয়াছে, কিন্তু তবুও গৃহস্থের একজনও ওপথে হাঁটে নাই। কালবন্যায় গৃহস্থের ঘর ভাঙিয়াছে। অনিরুদ্ধ আসিয়া। ধর্মভয়ও ফুৎকারে উড়াইয়া দিল নাকি?

দুর্গা বলিল নাও, আবার কি ভাবতে বসলে? রান্না চাপাও।

দেবু রান্নার হাড়িটা আনিবার জন্য ঘরে প্রবেশ করিল। দুর্গা বলিল–দাঁড়াও দাঁড়াও।

–কি?

—কাপড় ছাড়।

–কেন?

সলজ্জভাবেই দুর্গা হাসিয়া বলিল—আমাকে ছুঁলে যে!

—তা হোক।

উনানের উপর দেবু হাঁড়ি চড়াইয়া দিল।

বাউরিপাড়ায় কলরব উঠিতেছে। উন্মত্তের মতই বোধহয় সবাই মাতিয়া উঠিয়াছে। অনিরুদ্ধ একটা ঝড় তুলিয়াছে যেন। ঢোল বাজিতেছে, গান হইতেছে। নিস্তব্ধ রাত্রি। গান স্পষ্ট শোনা যাইতেছে।

মঙ্গলচণ্ডীর পালা-গানই বটে। বারমেসে গাহিতেছে।–

আষাঢ়ে পূরয়ে মহী নব মেঘ জল। বড় বড় গৃহস্থের টুটিল সম্বল।।
সাহসে পসরা লয়ে ভ্ৰমি ঘরে ঘরে। কিছু খুদকুঁড়া মিলে উদর না পুরে।।
বড় অভাগ্য মনে গণি, বড় অভাগ্য মনে গুণি।
কত শত খায় জোঁক নাহি খায় ফণী।।

দেবু আপন মনেই হাসিল। সাপে খাইলে মরিয়া গরিবের হাড় জুড়ায়। ভারি চমৎকার বর্ণনা কিন্তু।

তাহার আগাগোড়া–ফুল্লরার বারোমাস্যার বর্ণনা মনে পড়িয়া গেল।

বসিয়া চণ্ডীর পাশে কহে দুঃখ-বাণী।
ভাঙ্গা কুঁড়েঘর তালপাতের ছাউনি।।
ভেরেণ্ডার খুঁটি তার আছে মধ্য ঘরে।
প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে।।
পদ পোড়ে খরতর রবির কিরণ।
শিরে দিতে নাহি অ্যাঁটে খুঁটের বসন।।

দুর্গা বলিয়া উঠিল—উনোনের আগুন যে নিভে গেল গো! কাঠ দাও।

দেবু উনানের দিকে চাহিয়া বলিল—দে বাপু, তুই একখানা কাঠ দে।

দুর্গা একখানা কাঠ ফেলিয়া দিয়া বলিল–না, তুমি দাও।

ওদিকে গান হইতেছে–

দুঃখ কর অবধান, দুঃখ কর অবধান। লঘু বৃষ্টি হইলে কুঁড়ায় আসে বান।।
ভাদ্রমাসেতে বড় দুরন্ত বাদল। নদ-নদী একাকার আট দিকে জল।।

দেবুর মন কবির প্রশংসায় যেন শতমুখ হইয়া উঠিল; আট দিকে জল কেবল ঊর্ধ্ব এবং অধঃ ছাড়া আর সব দিকে জল।

দুর্গা বলিল–আমাদের এবারকার মতন বান হলে মাগী আর বাঁচত না।

দেবুর মনে আবার একটা চকিত রেখার মত চিন্তার অনুভূতি খেলিয়া গেল; যে ছেলেটা ফুল্লরার গান গাহিতেছে, তাহার কণ্ঠস্বর ঠিক মেয়েদের মত, সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত জোরালো। মনে। হইতেছে, ফুল্লরাই যেন ওই পাড়ায় বসিয়া বারমেসে গান গহিতেছে। ওপাড়ার যে-কোনো ঘরই। তো ফুল্লরার ঘর; কোনো প্ৰভেদ নাই। তালপাতার ছাউনি, দেওয়ালও ভাঙা, খুটি শুধু ভেরেণ্ডার। নয়—বাঁশের। দু-একজনের বটের ডালের খুঁটিও আছে।

গান চলিতেছে। ভদ্রের পর আশ্বিন। দেশে দুর্গাপূজা। সকলের পরনে নূতন কাপড়। অভাগী ফুল্লরা করে উদরের চিন্তা। আশ্বিনের পর কার্তিক। হিম পড়িতেছে; ফুল্লরার গায়ে কাপড় নাই।

দুর্গা হাসিয়া বলিলতা আমাদের চেয়ে ভাল ছিল ফুল্লরা। মালোয়ারী ছিল না।

দেবু হাসিল।

মাসের পর মাস দুঃখ-ভোগের বর্ণনা চলিয়াছে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন–।

দুঃখ কর অবধান-দুঃখ কর অবধান।
আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান।
মধুমাসে মলয় মারুত মন্দ-মন্দ।
মালতীর মধুকর পিয়ে মকরন্দ।।

গান শেষ হইয়া আসিয়াছে। দেবু ওই গানেই প্রায় তন্ময় হইয়া গিয়াছে।

দারুণ দৈবরোষে, দারুণ দৈবরোষে।
একত্ৰ শয়নে স্বামী যেন যোল কোষে।।

 

গান শেষ হইল। দেবুর খেয়াল হইল—ভাত নামানো দরকার। সে বলিল–দুর্গা, ভাত হয়ে গিয়েছে বোধহয়। নামিয়ে ফেলি, কি বল্‌?

কেহ উত্তর দিল না।

দেবু সবিস্ময়ে ডাকিল–দুৰ্গা!

কেহ উত্তর দিল না। দুর্গা চলিয়া গিয়াছে? কখন গেল? এই তো ছিল।

—দুর্গা?

দুর্গা সত্যই কখন চলিয়া গিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *