চার্লস নদীর এক পারে বস্টন শহর, অন্য পারে কেমব্রিজ। না, কলকাতা-হাওড়ার সঙ্গে কোনোমতেই তুলনা করা চলে না। এখানকার এই দুই সহোদরা নগরীই বড় চোখ জুড়োনো সুন্দর। এর মধ্যে কেমব্রিজের ছোট ছোট বাড়ি ও নিরিবিলি রাস্তাগুলির সঙ্গে যেন পুরোনো লন্ডনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জনস্রোতে ঝলমলে পোশাকে ছাত্র-ছাত্রীদেরই বেশী করে চোখে পড়ে বলে কেমব্রিজকে মনে হয় যৌবনের শহর।
এক একদিন বিকেলবেলা শর্মিলা অতীনকে নিয়ে শহর চেনাতে বেরোয়। শীতের বাতাস শেষ বিদায় নিয়েছে, এখন সত্যি সত্যি বসন্তকাল। চতুর্দিকে ফুলের সমারোহ। এদেশের শহরগুলি অনেকখানি যান্ত্রিক হলেও প্রকৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টা আছে, যত্নও আছে। গাছের পাতাগুলি খাঁটি সবুজ, ধুলোর আস্তরণে মলিন নয়। একদিন এক বাগানের মালিকে বড় বড় গাছের ডগায় পাইপে করে জল ছিটিয়ে দিতে দেখে অতীন বিস্মিত হয়েছিল। ভারতে কৃষ্ণচূড়া বা দেবদারু গাছের পাতা জল দিয়ে ধুইয়ে দিতে কে কবে দেখেছে?
একদিন কেমব্রিজ শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে, যেখানে চার্লস নদীর ওপরে একটা বাঁধ দেওয়া হয়েছে, তার কাছেই সায়েন্স মিউজিয়াম দেখতে গেল ওরা দু’জনে। ভিড় নেই, ঠেলাঠেলি নেই, লোকেরা চেঁচিয়ে কথা বলে না, এখানকার মিউজিয়ামগুলিতে তিন চার ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে।
সারা দুপুর সেই প্রদর্শনী দেখে, নদী পেরিয়ে ওরা বস্টনের দিক দিয়ে হাঁটতে লাগলো উদ্দেশ্যহীনভাবে। শর্মিলা হাঁটতে ভালোবাসে, তার ধারণা হেঁটে হেঁটে না ঘুরলে কোনো শহরকেই ভালোভাবে চেনা যায় না। অতীনের অবশ্য শহর চেনার জন্য এমন কিছু ব্যস্ততা নেই, এখানেই যখন বেশ কিছুদিন থাকতে হবে, তখন আস্তে আস্তে সব কিছু তো চেনা হবেই। কিন্তু এই বসন্তকালে শর্মিলা ঘরের মধ্যে বা রেস্তোরাঁয় বেশীক্ষণ বসে থাকতে রাজি নয়।
অতীন বাস কিংবা ট্রেন নিতে চাইছে কিন্তু শর্মিলা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে যে আজ সে অতীনের সঙ্গে লংফেলো ব্রীজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নদী দেখবে। যেন ওই ব্রীজের সঙ্গে তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। শর্মিলার এরকম থাকে। অন্য লোকেরা যেরকমভাবে সিনেমা-থিয়েটার কনসার্টে যায়, শর্মিলাও সেইরকম মাঝে মাঝেই কোনো বিশেষ রাস্তা কিংবা পার্ক কিংবা গীজা দেখার কথা ঠিক করে ফেলে। যেমন দুদিন আগেই সে সকালবেলা অতীনকে ফোন করে বলেছিল, সে সমারভিল-এ স্প্রিং ফিলড স্ট্রিটের একটি ছোট দোকানে চা খেতে যাবে। সেই দোকানটির চায়ের আলাদা কোনো খ্যাতি নেই, তবু অতদুরের ওই বিশেষ দোকানটিতেই কেন চা খেতে যেতে হবে, তার যুক্তি অন্য কেউ বুঝবে না। সেই দোকানটার সামনের পেভমেন্টে অনেকগুলো পায়রা এসে খেলা করে, ঘুম থেকে উঠেই যেন শর্মিলার চোখে ঝকঝকে রোদূরে সেই পায়রাদের ওড়াউড়ির দৃশ্যটা ভেসে উঠেছে। তক্ষুনি একবার গিয়ে সেই দৃশ্যটা না দেখলে তার চলবে না।
মুখে আপত্তি জানালেও অতীন শর্মিলার এই সমস্ত পাগলামি পছন্দই করে।
কিন্তু আজ মিউজিয়ামে অনেকক্ষণ দু পায়ে খাড়া থাকতে হয়েছে, তারপরে হাঁটতে হয়েছে যথেষ্ট, এরপর আর অতীনের ব্রীজ দেখার শখ নেই। অবশ্য নদী পারাপারের জন্য ওরা হাভার্ড ব্রীজই বেশী ব্যবহার করে, লংফেলো ব্রীজে তেমন আসা হয় না, কিন্তু দুটো ব্রীজে তফাত কী আছে, তা অতীন বোঝে না। একজন কবির নামে ব্রীজ বলেই সেটা বিশেষ দর্শনীয় হবে? একথা শুনে শর্মিলা যেন আকাশ থেকে পড়ে। একটা সেতুর সঙ্গে আর একটা সেতুর কোনো মিল থাকতে পারে? প্যারিস শহরে প্রত্যেকটি সেতুই কি বিশেষ দ্রষ্টব্য নয়? প্রতিটি সেতু থেকেই শহরকে অন্যরকম দেখায়।
অতীন প্যারিসে যায়নি, সে আর তর্ক করে না শর্মিলার সঙ্গে।
লংফেলো ব্রীজের ওপর কিছুটা আসতেই হাওয়ায় উড়তে থাকে শর্মিলার জদা রঙের সিল্কের শাড়ির আঁচল। যেন তার মাথার ওপর একটা পতাকা ছটফট করছে। এমনই প্রবল বাতাস এখানে যে শর্মিলা সামলাতেই পারছে না তার শাড়ি, অতীন মজা পেয়ে হাসছে হা-হা করে। অন্য কয়েকজন নারী-পুরুষ শর্মিলাকে সকৌতুকে দেখতে দেখতে চলে গেল।
সায়েন্স মিউজিয়াম থেকে পাওয়া কতকগুলো বুকলেট খসে পড়ে গেল শর্মিলার হাত থেকে, সে কোনোক্রমে দাঁড়ালো রেলিং ঘেঁষে। অতীন বই-কাগজপত্রগুলো কুড়িয়ে নিয়ে বললো, হার্ভার্ড ব্রীজে কোনোদিন আমি এরকম অবাধ্য বাতাস দেখিনি, এই ব্রীজটা সত্যি আলাদা।
শর্মিলা বললো, সিল্কের শাড়ি না পরে আসাই উচিত ছিল। এমন মুশকিল হয়…
অতীন শর্মিলার কাঁধে হাত রেখে বললো, আমি তোমাকে ধরে থাকছি!
বিকেল শেষ হয়ে আসছে, আকাশে লাল রঙের আভা। নদীর জলও এখন রঙীন। কিন্তু এখানে নিস্তব্ধতা কিংবা নিঃসঙ্গতা বোধ করার কোনো উপায় নেই। ব্রীজের মাঝখান দিয়ে। যাচ্ছে অনবরত গাড়ি, নদীর জলও চূর্ণ-বিচূর্ণ করছে অনেকগুলি স্পীড বোট। এখানকার আকাশে সন্ধেবেলা ঘরে-ফেরা পাখির ঝাঁক চোখে পড়ে না। ফট ফট ফট ফট শব্দ করে ঘুরছে। দুটো হেলিকপ্টার। আবহাওয়া সুন্দর বলে পায়ে-হেঁটে ব্রীজ পারাপার করছে অনেক মানুষ। তবু এর মধ্যেও আলাদা হয়ে যাওয়া যায়। অতীন শর্মিলাকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে, শর্মিলার গালের সঙ্গে ঠেকে গেছে তার গাল, কিন্তু কেউ তাদের দিকে তাকাচ্ছে না, কেউ তাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না।
কলকাতায় যে দুটো ব্রীজ আছে, হাওড়া ব্রীজ আর বালি ব্রীজ, দুটো কি একরকম? হাওড়া ব্রীজ দিয়ে কক্ষনো হাঁটতে ইচ্ছে করে না কিন্তু বালি ব্রীজ দিয়ে বেড়াতে কী ভালো লাগে!
অতীন বললো, আমি তো বালি ব্রীজের ওপর দিয়ে কোনোদিন বেডাইনি! ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে দু’একবার গেছি দক্ষিণেশ্বরে, কিন্তু বালি ব্রীজে উঠেছি কি না মনে পড়ে না!
আমার মামার বাড়ি দক্ষিণেশ্বরে। আমি কতবার গেছি! তুমি তো নিউ ইয়র্ক শহরে এতগুলো দিন রইলে, ব্রুকলীন ব্রীজ আর ওয়াশিংটন ব্রীজ দেখোনি? কত তফাত! ব্রুকলিনের দিক থেকে এইরকম কোনো শেষ বিকেলে ম্যানহাটনের দিকে তাকিয়ে দেখেছো? সারা পৃথিবীতে এরকম দৃশ্য আর নেই। ঠিক মনে হবে সোনা দিয়ে তৈরি এক স্বৰ্ণনগরী।
–স্বৰ্ণনগরী, না স্বর্ণলঙ্কা?
–তুমি কোনোদিন কোনো নদীতে সাঁতার কেটেছো?
–আমি সাঁতারই জানি না!
শর্মিলা যেন প্রায় শিউরে উঠে অতীনের দিকে ফিরে বললো, এত বড় ছেলে, তুমি সাঁতার জানো না? এই সামারেই তুমি পাবলিক সুইমিং পুলে সাঁতর শিখে নেবে!
কয়েক মুহূর্তের জন্য অতীনের কাছে সেই অনুভূতিটা ফিরে এলো। সে ডুবে যাচ্ছে, চতুর্দিকে জল, লোহার মতন কঠিন জল, সেই জল তার গলা টিপে শ্বস বার করে নিতে চাইছে। হঠাৎ দেখতে পেল কাছে তার দাদার মুখ, দাদা তাকে বাঁচাবে, সে প্রাণপণে জড়িয়ে। ধরলো দাদাকে…।
ছবিটাকে মুছে ফেলার জন্য সে টপ করে শর্মিলার ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো।
শর্মিলা ছটফটিয়ে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো নিজেকে। এদেশে ছেলেমেয়েদের প্রকাশ্য চুম্বন একেবারেই অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু শর্মিলার খুব লজ্জা। এর আগে অতীন কয়েকবার পীড়াপীড়ি করলেও সে রাজি হয়নি, তার মতে, শাড়ি পরা মেয়েদের এরকম তাসভ্যতা মানায় না।
অতীন আজ কিছুতেই শর্মিলাকে ছাড়লো না, সে একেবারে বজ্র আঁটুনিতে চেপে ধরে রাখলো শর্মিলার মাথাটা, জোর করে এমন দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন দিল যে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসার মতন অবস্থা।
শর্মিলা অতীনের বুকে কিল মারতে মারতে বলতে লাগলো, অসভ্য! তুমি এমন খারাপ আর পাজী–
অতীন হাসছে, তার মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেছে।
শর্মিলা একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিল কেউ তাদের লক্ষ করছে কি না। কেউ তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপও করেনি। শর্মিলা তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে লিপস্টিক বার করলো, অতীন এত হাওয়ার মধ্যেও কায়দা করে ধরালো একটা সিগারেট।
শর্মিলা বললো, খবরদার আবার যদি কক্ষনো এরকম করো, তোমার সঙ্গে কথা বলবো না!
অতীন শর্মিলার কোমর জড়িয়ে ধরে বললো, চুমু খাবার পরেই ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে নেই। একটুবাদে টয়লেটে যাবার ছুতো করে ঠোঁটের রঙ ফিরিয়ে আসতে হয়। এদেশে এতদিন আছো, এই এটিকেট শেখোনি?
শর্মিলা ভুরু কুঁচকে বললো, তুমি শিখলে কী করে? অন্য কোনো মেয়ে বলেছে বুঝি?
–টিভি দেখলেই শেখা যায়। দুপুরবেলার টিভি প্রোগ্রামগুলো সবই তো চুম্বনের সহজপাঠ! কতরকমভাবেই যে এরা চুমু খেতে পারে!
–দুপুরবেলা বসে বসে বুঝি ওই অখাদ্য সিরিয়াল গুলো দেখা হয়?
–নিউ ইয়র্কে সিদ্ধার্থর সঙ্গে যখন থাকতাম, দুপুরে কোনো কাজ ছিল না, টিভি শুনে শুনে অ্যাকসেন্ট শিখতাম।
–ছাই শিখেছো! তুমি এখনো শিডিউলড বলো, স্কেজুউল বলতে পারো না!
–মিলি, তোমাকে আমার আগে আর কেউ চুমু খায়নি?
–ভ্যাট। আবার অসভ্যের মতন কথা। তোমাকে বলেছি না, আমার কোনো বন্ধু ছিল না, আমি এত লাজুক ছিলুম, অচেনা কারুর সঙ্গে কথা বলতে পারতুম না। শুধু তোমার সঙ্গেই যে কী করে এই সব হয়ে গেল।
–বন্ধু না থাক, তোমার কোনো মাসতুতো দাদা কিংবা জামাইবাবু, এরকম কেউও চুমু খায়নি? বলো না, আমি কিছু মনে করবো না!
–কী অদ্ভুত কথা বলছো, এরকম আবার হয় নাকি? মাসতুতো দাদা, জামাইবাবু যাঃ। মেয়েরা কক্ষনো এত শক্ত হয় না। এর আগে আমার গায়ে কেউ সামান্য হাত ছোঁয়াতে সাহস। করেনি। এক তুমিই একটা ডাকাত …
–-তোমার ছেলেবেলার কথা আমার জানতে ইচ্ছে করে। বাচ্চা বয়েসে তুমি ফ্রক পরে কোথায় দৌড়োদৗড়ি করতে? জামশেদপুরেই ইস্কুলে পড়েছো?
–না, তখন বাবা বদলি হয়েছিলেন পাটনায়। একদিন বেশ তুমি আর আমি পা ছড়িয়ে বসে ছেলেবেলার গল্প করবো!
–আমার ছেলেবেলাটা খুব খারাপ কেটেছে। শোনাবার মতন কিছু নেই!
–তোমাদের দেশ তো ছিল পূর্ববঙ্গে। তুমি মা-বাবার সঙ্গে গিয়েছো নিশ্চয়ই। তোমার কিছু মনে আছে?
–মিলি, এত হাওয়ায় আমার একটু শীত শীত করছে। চলো এবার বাড়ি যাই!
–তোমার শীত করছে? ওই দ্যাখো, ছেলেরা শুধু গেঞ্জি পরে যাচ্ছে! আলোগুলো জ্বলুক, তখন এখান থেকে দুদিকের দুটো শহর কী সুন্দর যে দেখাবে!
কয়েকদিন ধরেই বিকেল বেশ দীর্ঘ। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে না। গাড়ি গুলো এখনও হেডলাইট জ্বালেনি। এক দঙ্গল জার্সি পরা ছেলে কোনো ফুটবল মাঠ থেকে হৈ হৈ করে ফিরছে।
কেউ একটা খবরের কাগজ ফেলে রেখে গেছে, সেটা রেলিং-এ আটকে ফরফর করে উড়ছে। অতীন সেটা তুলে নিয়ে জলে ফেলে দিতে যেতেই শর্মিলা তার হাত চেপে ধরে বললো, এই, এই, কী করছো!
–খবরের কাগজের শব্দ আমার ঠিক পছন্দ হয় না!
–তা বলে নদীতে ফেলবে? এইভাবেই নদীগুলো পলিউটেড হয়!
–এটা তো ভাই কোনো সাহেবই ফেলে গেছে, আমি তো ফেলিনি। একটু বাদে জলে গিয়ে পড়তোই। পলিউশানের জন্য আমি দায়ী নই!
–ওটা হাতে রেখে দাও, পরে কোনো ট্র্যাশ ক্যান-এ ফেলে দেবে!
অতীন কাগজটা চোখের সামনে মেলে একপলক দেখলো। শস্তা ধরনের পত্রিকা, প্রথম পাতাতে শুধু রগরগে খবর। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চিত্রতারকাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ। একটি ন-দশবছরের ফুটফুটে বালিকার মুখের প্রায় সিকি পৃষ্ঠা জোড়া ছবি, তার নীচে ষাট পয়েন্টের টাইপে রোমহর্ষক হেডিং।
শর্মিলা কাগজের পৃষ্ঠাটির দিকে একবার মাত্র অন্যমনস্কভাবে তাকিয়েই চোখ বুজে ফেললো। ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার মুখ, ঠোঁট কাঁপছে। হঠাৎ সে রেলিং-এর ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে দিল।
অতীন তখনও সিগারেট টানতে টানতে কাগজটা পড়ে যাচ্ছে, ওদিকে শর্মিলার যেন হঠাৎ বদলে যাচ্ছে সমস্ত জীবন। পৃথিবীটা ঘুরছে। এই ঘুরন্ত পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে সে, অতীন তাকে ধরে রাখতে পারবে না। অতীন তাকে ধরতে চাইবে না, বরং সে-ও যেন তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে।
অতীন অন্যমনস্ক ভাবে শর্মিলার হাতটা ধরতে গেল, শর্মিলা সেটা ছাড়িয়ে নিল।
অতীন তার পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো, কী হলো?
মুখ না তুলেই শর্মিলা বললো, আমার শরীর খারাপ লাগছে! আমি মরে যাচ্ছি!
–কী হয়েছে? কী রকম খারাপ লাগছে?
–আমার মাথা ঘুরছে! সারা শরীর ঝিমঝিম করছে, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না! বাবলু, বাড়ি চলো!
–চলো তা হলে!
–আমি হাঁটতে পারছি না। আমার ভীষণ মাথা ঘুরছে!
–কিন্তু এই ব্রীজের মাঝখানে তো বাসটাসে উঠতে পারবো না। ট্যাক্সিও থামবে না। চলো, আমি তোমাকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছি! হঠাৎ কেন এরকম হলো তোমার?
শর্মিলাকে একেবারে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কয়েক পা মাত্র গেল অতীন। যতই শরীর খারাপ লাগুক, কোনো মাতালকে তার সঙ্গী যেভাবে টেনে নিয়ে যায়, সেইভাবে রাস্তা দিয়ে যেতে পারবে না শর্মিলা। বাবলুকে ছেড়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু চোখ খুলে রাখতে পারছে না। অতীনের হাত ধরে বললো, চলো, আমি যেতে পারবো!
অতীন বেশ ঘাবড়ে গেছে। এরকম আকস্মিক অসুস্থতা শুধু বুঝি মেয়েদেরই হয়! শর্মিলা যেরকম করছে, এর মধ্যে যদি অজ্ঞান হয়ে যায়, তা হলে সে কী করবে? রাস্তার কোনো চলন্ত গাড়ি থামিয়ে লিফট চাইবে?
কোনোক্রমে ব্রীজটা পেরিয়ে এলো শর্মিলা। এর মধ্যে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। ব্রীজ থেকে আলোকময় নগর দেখার এত ইচ্ছে ছিল শর্মিলার, এখন সে চোখই খুললো না। একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল সামনেই।
ট্যাক্সিতে ওঠার পরেও মাথাটা হেলিয়ে চোখ বুজে রইলো শর্মিলা। অতীন জিজ্ঞেস করলো, খুব কষ্ট হচ্ছে?
শর্মিলা কাতরভাবে বললো, হ্যাঁ। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও, বাবলু! আমি আর পারছি না! সহ্য করতে পারছি না!
–এই তো সোজা বাড়িতেই যাচ্ছি। তার আগে, কোনো ডাক্তারের কাছে যাবে?
–না। ডাক্তার দরকার নেই। বাড়ি গেলেই ঠিক হয়ে যাবে! অতীন শর্মিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গেলে সে সরিয়ে দিল হাতটা। সারা রাস্তা সে আর একটাও কথা বললো না।
পাল স্ট্রিটে মামাতো বোনের সঙ্গে একখানা ঘর ভাগাভাগি করে থাকে শর্মিলা। ঘরখানা একতলাতেই। বয়েসে একটু ছোট হলেও সুমি যেন শর্মিলার অভিভাবিকা। তাকে শর্মিলা ভয় পায়। তার জন্যই অতীনকে কখনো এ বাড়িতে আসতে বলে না শর্মিলা। আজ অতীন ঠিক করলো, শর্মিলাকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সুমিকে বলবে কোনো ওষুধ-উষুধের ব্যবস্থা করতে।
কিন্তু ট্যাক্সি থেকে নামার পরই শর্মিলা প্রায় যেন রুক্ষ ভাবে বললো, ঠিক আছে, তুমি এবার যাও! তারপর সে প্রায় দৌড়ে ঢুকে গেল ভেতরে।
কয়েক মুহূর্ত হতবুদ্ধির মতন দাঁড়িয়ে রইলো অতীন। তার একটা অপরাধবোধ হচ্ছে। শর্মিলার কি সত্যি শরীর খারাপ হয়েছে, না মেজাজ খারাপ হলো? ব্রীজে দাঁড়িয়ে অতীন কি তাকে এমন কিছু বলেছে, যাতে সে আঘাত পেয়েছে? এমনভাবে চলে গেল কেন শর্মিলা?
অতীন কি তাকে কোনো সাহায্যই করতে পারতো না? ওষুধ-টষুধ এনে দিতে পারলে অন্তত দরকার হলে।
ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়েছে, এবার হাঁটতে আরম্ভ করলো অতীন। এখান থেকে তার বাড়ি বেশ দূর। দুবার বাস বদল করতে হবে বলে সে আর সেই ঝাটে গেল না। হঠাৎ কী হলো শর্মিলার? না, প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার জন্য রাগ এটা নয়। ওতে শর্মিলা লজ্জা পেয়েছে বেশী, রাগেনি। ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতেই শর্মিলার সারা মুখখানা উষ্ণ হয়ে উঠেছিল, তার মধ্যে প্রত্যাখ্যান ছিল না। তা হলে কী জন্য সে এমন বদলে গেল। যদি শরীর খারাপ হয়েও থাকে, তাতে সে অতীনের সঙ্গে ভালো করে কথা বলবে না? বাড়ির সামনে থেকে তাকে বিদায় করে দিল ঠিক একটা এলেবেলে লোকের মতন!
অতীন আশঙ্কা করেছিল, ট্যাক্সির ভাড়া মেটাবার জন্য তাকে শর্মিলার ব্যাগ খুলে পয়সা নিতে হবে। তা অবশ্য হয়নি, ভাড়া উঠেছিল দশ ডলার, ড্রাইভারকে এক ডলার টিপস দিতে হয়েছে, এখন অতীনের পকেটে খুচরো কিছু পয়সা পড়ে আছে। এই পয়সায় এক প্যাকেট সিগারেটও হয় না। অতীনের সিগারেট ফুরিয়ে গেছে, এমন জ্বালাতন, এদেশে এক প্যাকেটের কম সিগারেট কেনার উপায় নেই।
আস্তে আস্তে অভিমানের বাষ্পে ভরে যাচ্ছে অতীনের মন। কেন শর্মিলা ততক্ষণ চোখ বুজে রইলো? এমনকি বাড়িতে ঢোকার সময়েও সে একবারও অতীনের দিকে তাকালো না!
মেয়েদের কি বুকের ভেতরটাও দেখে ফেলার বিশেষ কোনো ক্ষমতা আছে? আজ ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে সিগারেট টানার সময় দু-একবার অলির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। সেই সে সেবারে নবদ্বীপ থেকে নৌকোয় গঙ্গা পার হয়ে কৃষ্ণনগরের দিকে আসা, তারপর অন্ধকারের মধ্যে বসে অলি গান গাইলো…সেই দিনটা কত দূরে সরে গেছে, অলি এখন পৃথিবীর উল্টোপিঠে, তবু হঠাৎ হঠাৎ অলির মুখটা মনে পড়া তো কেউ আটকাতে পারবে না। শর্মিলা কি টের পেয়ে গিয়েছিল যে তার পাশে দাঁড়িয়েও অতীন অন্য একটি মেয়ের কথা ভাবছে? সে শর্মিলাকে ঠকাচ্ছে?
একদিন না একদিন শর্মিলাকে বলতেই হবে অলির কথা। তখন অতীন একথাও জানাবে। যে, সে আর কোনোদিন অলির কাছে ফিরে যাবে না বটে, কিন্তু অলিকে সে তার জীবন থেকে একেবারে বাদ দিতেও পারবে না! এ ব্যাপারটা কি শর্মিলা মেনে নেবে? হ্যাঁ, মানবে, তাকে। মানতেই হবে। শর্মিলা খুব নরম, সুন্দর মনের মানুষ, সে ঠিকই বুঝবে।
প্রায় এক ঘণ্টার রাস্তায় অতীন একবারও অন্য কোনোদিকে তাকায়নি। শুধু শর্মিলার সঙ্গে মনে মনে কথা বলতে বলতে এলো। এখনো সে বুঝতে পারেনি, শর্মিলা কোন কারণে রেগে গেল তার ওপর!
লিভিং রুমে টিভি চলছে, সেখানে বসে আছে সোমেন। সে প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা নিয়ম করে খবর শোনে। ওয়াল্টার কনক্রাইটের গলা না শুনলে বুঝি তার ঘুম হয় না। পর্চে দাঁড়িয়ে সত্যকিঙ্কর দেখছেন রাত্রির আকাশ। আস্ট্রোনমিতে তাঁর খুব উৎসাহ। আজ রাতের আকাশ প্রচুর নক্ষত্রময়।
এদেশীয় ভদ্রতা অনুযায়ী চেনা কারুর সামনে দিয়ে যেতে হলে দুটো কথা বলতেই হয় তার সঙ্গে। তা সে যত অকিঞ্চিৎকর কথাই হোক। এমনকি পথ চলতি অচেনা মানুষের চোখে চোখ পড়ে গেলেও মুখ ফিরিয়ে নেবার নিয়ম নেই, মুখে হাসি ফুটিয়ে বলতে হয়, হাই! ইংল্যান্ডে এসব ব্যাপার নেই, তাই প্রথম প্রথম আমেরিকায় এসে অচেনা মানুষের মুখে এরকম সম্বোধন শুনে অতীন চমকে চমকে উঠতো।
বাড়িওয়ালার সঙ্গে রোজ রোজ কী আর কথা বলা যায়! সত্যকিঙ্করকে দূরে সরিয়ে দেবার একমাত্র উপায়, ওঁর সামনে সিগারেট ধরানো। উনি ধোঁয়া সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু এখন অতীনের পকেটে সিগারেটও নেই।
অতীন বললো, “ইভনিং! আজকের আকাশটা খুব পরিষ্কার। এত তারা কোলকাতার আকাশে কোনোদিন দেখা যায় না।
বয়েসে অনেক বড় হলেও সত্যকিঙ্কর তাঁর কোনো ভাড়াটেকে তুমি বলেন না। তাঁর কণ্ঠস্বর সবসময় মৃদু। তিনি বললেন, আমার ছেলেবয়েস কেটেছে পাবনায়। সেখানেও পরিষ্কার আকাশ দেখেছি। ওই দেখুন, গ্রেট বীয়ার আর লিটল বীয়ার দুটোই আজ এত স্পষ্ট…গ্রেট বীয়ারকে কী যেন বলে বাংলায়?
নামটা জানা থাকলেও অতীন মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ঠিক জানি না।
এখন গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে আলোচনা করার একটুও উৎসাহ নেই অতীনের। সে চাঞ্চল্য গোপন করতে পারছে না। সত্যকিঙ্কর আঙুল তুলে আরও নক্ষত্রের নাম বলে যাচ্ছেন, তিনি মুখখানা নামালে অতীন বিদায় নিতে পারছে না।
সুরেশ নামে গুজরাতি ছেলেটি এই সময় এসে পড়ায় অতীন মুক্তি পেল। সুরেশ বেশ জমিয়ে গল্প করতে পারে, পৃথিবীর যে কোনো বিষয়েই তার কিছু কিছু জ্ঞান আছে।
দু’তিন ধাপ সিঁড়ি একসঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে এসে অতীন নিজের ঘরে ঢুকে বেশ জোরে শব্দ করে বন্ধ করে দিল দরজাটা। এখন এই ঘরের মধ্যে তার ছোট্ট নিজস্ব জগৎ, এখানে কেউ তাকে বিরক্ত করতে আসবে না।
সারাদিন ধরে দরজা-জানলা বন্ধ, ঘরটা বশ গরম হয়ে আছে। পদাগুলো সব টানা। জামা-প্যান্ট খুলতে লাগলো অতীন, ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো প্যান্ট-শার্ট। বাড়ির পোশাক পরে নেবার বদলে সে ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলো নগ্ন হয়ে। ঘরটা আজ অসম্ভব খালি খালি লাগছে। যেন এটা তার নিজের ঘর নয়। এরকম একটা ছাদ-নীচু ঘরে সে মাসের পর মাস কাটাবে কী করে?
কথা ছিল, সায়েন্স মিউজিয়াম থেকে ফেরার পথে কিছু খাবার-টাবার কিনে এনে শর্মিলা আর সে এই ঘরে সারা সন্ধেটা কাটাবে। শর্মিলা তাকে একটা সেকেণ্ড হ্যান্ড রেকর্ড প্লেয়ার কিনে দিয়েছে। রেকর্ডও জোগাড় হয়েছে কয়েকটা, গানবাজনা শুনতে শুনতে গল্প আর ভালোবাসাবাসি। হঠাৎ সব কিছু বদলে গেল।
ব্রীজের ওপর অমন চমৎকার হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কী এমন অসুখ হতে পারে? পেট ব্যথা, মাথার যন্ত্রণা? শর্মিলার এরকম কোনো রোগের কথা অতীন শোনেনি। শর্মিলার মাঝে মাঝে মাথা ধরে, একটু রোদ লাগলেই তাকে ওষুধ খেতে হয়। সব মেয়েরই নাকি একটু আধটু মাথা ধরার রোগ থাকে। পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের মাথার বেশী স্পর্শকাতর। আজ তো সে রকম চড়া রোদ ছিল না! অতীন একবার শর্মিলার মাথায় হাত রাখতেই সে জোর করে সরিয়ে দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেও তার আপত্তি? মাথা ধরাটা এমন কিছু রোগ নয় যে তার মধ্যে কোনো কথা বলা যাবে না!
টেবিলের ওপর একটা সিগারেটের প্যাকেট আছে। পোশাক না পরেই অতীন একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা জানলা খুলে দিল। তার ঘরটা অন্ধকার, অন্য কোনো বাড়ি থেকে তাকে–দেখা যাবে না। একেবারে গায় ঘেঁষাঘেষি অন্য কোনোও বাড়িও নেই।
শর্মিলা, আমি কী খারাপ ব্যবহার করেছি তোমার সঙ্গে? একবার বুকে হাত লেগে গিয়েছিল, কিন্তু তা তো আমি ইচ্ছে করে দিইনি? এদেশে অনেক লোকের চোখের সামনে চুমু খাওয়া যায়। কিন্তু তার বেশী কিছু করাটা রুচিহীনতা। আলিঙ্গন চলে কিন্তু বুকে হাত দেওয়া চলে না, অতীন তা ভালোই জানে। হঠাৎ বুকে একবার হাত লেগে যাওয়াটা দোষের কিছু নয় শর্মিলা, তুমি কি তা বুঝতে পারোনি? তাও তো বেশ কিছুক্ষণ আগে, তার পরেও তুমি আমার সঙ্গে কথা বললে, হাসলে! আর কী দোষ করেছি? এর আগে কোনোদিন তুমি আমাকে এরকমভাবে অগ্রাহ্য করোনি!…
অতীন মজুমদার, অতীন মজুমদার, তোমার এতদূর অধঃপতন হয়েছে যে তুমি আধঘণ্টা ধরে ন্যাংটা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের কথা চিন্তা করে যাচ্ছো? তোমার আর কোনো কাজ নেই? একটা মেয়েই তোমার কাছে এখন সব কিছু?
অতীন ঠাস ঠাস করে নিজের দু গালে দুটো চড় কষালো বেশ জোরে। অভিমান কিংবা হতাশার বদলে এখন তার শরীর জ্বলছে রাগে! শর্মিলা ভালো মেয়ে, সরল মেয়ে, কিন্তু বড় জেদী। সে কি ভেবেছে, অতীনের সঙ্গে যেমন খুশী ব্যবহার করা যায়? কোনো কারণে যদি তাকে শর্মিলার ভালো না লাগে, তা হলে কক্ষনো সে আর শর্মিলাকে বিরক্ত করতে যাবে না! শর্মিলা এরকম যখন-তখন মেজাজ দেখালে অতীন মজুমদার কিছুতেই তা সহ্য করবে না। এরপর শর্মিলা যদি আবার নিজে থেকে তার কাছে আসে, তাহলে শর্মিলাকেই ক্ষমা চাইতে হবে।
এখন শর্মিলার কথা একেবারে ভুলে যাওয়া দরকার।
অতীন দ্রুত একটা প্যান্ট পরে নিয়ে টেবিলে বসলো। ঘরে আধ বোতল মদ আর এক প্যাকেট কুকি ছাড়া আর কোনো খাদ্য পানীয় নেই। না, অতীন এখন মদ খাবে না। একটা মেয়ের ওপর রাগ করে একা বসে বসে মদ্যপান করা টিপিক্যাল দেবদাসের ব্যাপার। তার খিদে পেয়েছে, কিন্তু বাইরে বেরিয়ে খাবার কিনে আনার একটুও ইচ্ছে নেই।
দরকারি বই খুলে সে মিষ্টি নারকোলি বিস্কুটই দাঁতে কাটতে লাগলো একটা একটা করে। অতীনের এই ক্ষমতাটা আছে, যখন সে বই পড়ায় মন দেয় তখন সে আর অন্য কোনো কথা ভাবে না। খাতায় সে নোট নিতে লাগলো গভীর মনোযোগ দিয়ে। পি-এইচ ডি করে ফেলতেই হবে এক বছরের মধ্যে।
রাত সাড়ে এগারোটায় অতীনের সিগারেট শেষ, মিষ্টি বিস্কুট শেষ। এবার পড়া বন্ধ করে ঘুমোনো যায়। একটা হাই তুলে বই বন্ধ করতেই শর্মিলার মুখচ্ছবি ফিরে এলো আবার!
আজ এত উৎসাহ করে শর্মিলা নিয়ে গেল লংফেলো ব্রীজে, কত হাসি আর গল্প, তার মধ্যে হঠাৎ শর্মিলার এই ভাবান্তর, এই রহস্যটা কী সেটাই অতীনের জানা দরকার। শর্মিলা না চাইলে অতীন আর তার সঙ্গে দেখা করবে না। কিন্তু সে কী জন্য…
আবার অতীনের মন অনুশোচনায় ভরে গেল। ইস, ছি ছি, সে শুধু নিজের দিকটাই ভাবছে! শর্মিলার যদি সত্যি সত্যি কোনো কঠিন অসুখ হয়ে থাকে? সে হয়তো অতীনকে কোনো দায়িত্বের মধ্যে ফেলতে চায়নি বলেই মুখ ফুটে কিছু বলেনি। তা বলে অতীন স্বার্থপরের মতন দূরে সরে থাকবে?
দরজা খুলে সে দৌড়ে নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে। লিভিং রুমে এখন কেউ নেই। আলো জ্বেলেই অতীন ফোনটা তুলে নিল।
ওদিক থেকে ফোন ধরলো সুমি। সে নীরস গলায় বললো, শর্মিলা এখন ঘুমোচ্ছে!
অতীন জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে শর্মিলার?
সুমি বললো, তার শরীর খারাপ!
অতীন অস্থিরভাবে বললো, তা জানি! তার কী অসুখ হয়েছে? ডাক্তারকে কিছু জানানো হয়েছে? এখানে ডাক্তার সবাধিকারী আছেন আমাদের চেনা।
সুমি বললো, না, আজ আর কিছু করা হয়নি। ওর মাথা ধরেছিল, এখন ঘুমিয়ে পড়েছে।
–সুমি, আমি ওর সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই।
–এখন সম্ভব নয়। আমি ডাকতে পারবো না। গুড নাইট।
লাইন কেটে দিয়েছে সুমি। এই মেয়েটা যে কেন গোড়া থেকেই অতীনকে অপছন্দ করেছে, তা কে জানে? মরালিস্ট? কিন্তু ওরও তো বয় ফ্রেন্ড আছে একজন। কিন্তু সুমি অতীনের সঙ্গে কথা বলতেই চায় না।
অতীন আবার টেলিফোন তুললো। শুধু মাথা ধরা? না, হতেই পারে না।
এবার অতীনের গলার স্বর শুনেই লাইন কেটে দিল সুমি। অতীনের মুখের চামড়ায় জ্বালা করছে! বাড়ি ফিরেও শর্মিলা তাকে কোনো কিছু বলতে পারতো না? সাড়ে এগারোটা এমন কিছু রাত নয়, এখন শর্মিলাকে ডাকা যাবে না কেন? অতীন কি একটা এলেবেলে মানুষ!
আবার ফোন করতেই অতীন শুনতে পেল এনগেজড টোন। অর্থাৎ সুমি রিসিভারটা নামিয়ে রেখেছে। সারারাত আর ফোন করা যাবে না। ছোট্ট একটা ঘরে, দুটো খাটের মাঝখানে ফোন। দু বার ফোন বাজলো, তবু শর্মিলা শুনতে পায়নি? কিংবা শর্মিলা ইচ্ছে করে ফোন। ধরছে না?
শর্মিলা, তুমি তবে এখনো অতীন মজুমদারকে ভালো করে চেনোনি!