ঘুম থেকে উঠে সুদীপ বেরিয়ে গিয়েছিল। চোখ খোলামাত্র খবরের কাগজগুলো ওকে টানছিল। শত্রুপক্ষ কি ভাবছে, পাবলিকের কি রিঅ্যাকশন; এই ছাদের ঘরে বসে জানা যায় না। যদিও সে বাইরে বের হচ্ছে, তবু গায়ে পড়ে কারও সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে সাহস হয় না। তার ছবি দেখে যদিও কেউ চিনতে পারবে না তবু বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে। সে যখন বেরিয়েছিল তখন বন্ধুবা ঘুমিয়ে। হঠাৎ নিজেদের খুব অ্যামেচার বলে মনে হয়েছিল ওর। পুলিশ যাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে তারা এমন পাহারা না রেখে মড়ার মত ঘুমায় না। কিন্তু অ্যামেচারিশ বলেই মনের মধ্যে কোন পাপবোধ নেই। তারা নিজেদের জন্যে কিছু করছে না, এমন কি মানুষ খুনও। কল্যাণের হাত নিশ্চয়ই সেট হতে চলেছে, নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে ও। আনন্দ বেশি রাত জেগেছিল, এখন হুঁস নেই। আর জয়িতা? দরজায় দাঁড়িয়ে জয়িতার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত অসাড় হয়ে ছিল সুদীপ। পরনে প্যান্ট আর শার্ট থাকা সত্ত্বেও শোওয়ার ভঙ্গি বদল হওয়ায় শরীর থেকে এক ধরনের মেয়েলি আভা বেরিয়ে আসছে। ঘুমিয়ে পড়লে মানুষ অর্কপট হয়ে যায়। তাই আনন্দ কল্যাণকে কি সরণ বালক এবং জয়িতাকে রহস্যময়ী বলে মনে হচ্ছে। সুদীপ এগিয়ে গিয়ে পাশে পড়ে থাকা চাদরটা জয়িতার শরীরে ছড়িয়ে দিতেই সে একটি সরল বালক হয়ে গেল। ছাদে পা দিতে দিতে সুদীপের মনে হল ঘুমন্ত অবস্থায় তার নিজের মুখ কেমন দেখায় তা সে কোনদিন দেখতে পাবে না। জয়িতাকে বলতে হবে তার ঘুমন্ত মুখ লক্ষ্য করে যেন তার কাছে বর্ণনা করে। ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করল না বলেই সে যাওয়ার সময় বন্ধুদের ডাকেনি।
গলির মধ্যে ভোরবেলায় কারও কৌতূহল নেই। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই সময়টাতেই বোধ হয় পৃথিবীর মানুষেরা অত্যন্ত শান্ত এবং শান্তিপূর্ণ থাকে। ভোরবেলাতেই কেউ কারও দিকে সন্দেহের চোখে তাকায় না। অতএব খুব সহজ মনে হেঁটে মোড়ের মাথায় এল সুদীপ। এবং তখনই লোকটিকে দেখতে পেল। একটা ফুটের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন গেলাস হাতে। তাকে দেখে একটু বিব্রত হলেন। কিন্তু তার মুখে হাসি ফুটল, চা খাবেন? ভাল করে ও।
মাথা নাড়ল সুদীপ। এই সময় চা তো অমৃত। সে আশেপাশে কোন খবরের কাগজের হকারকে দেখতে পেল না। এখনও কাগজ এদিকে আসেনি বোধ হয়। লোকটি সুদীপকে বললেন, আপনি আমাকে কাল বাঁচিয়েছেন। চিন্তায় আমার!
কেমন আছেন উনি? রাত্রে ঘুম হয়েছিল? সুদীপ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল।
ঘুম! ঘুম কি মশাই, খেয়ে দেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। এত ঘুম। আপনি যে ক্যাপসুলটা দিয়েছিলেন ওর মুখে জে সেটা কি আপনার পকেটেই ছিল? ডেঞ্জারাস লোক তো। কখন কাকে দিতে হবে জানেন না তবু পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ান! মাঝ বাতে চোখ মেলে বলল খিদে পেয়েছে। শরীরে অবশ্য বল ছিল না। আমিই খাইয়ে দিলাম। এখনই দুতিনটে কথা বলল। আপনি ওর মুখে ক্যাপসুল গুঁজে দিয়েছেন বলল। তাই খেয়ে নাকি বিয়ের ক্রিয়া বন্ধ হয়েছে। আমি বিশ্বাস করলাম না কথাটা। অনেকক্ষণ জেগে থাকার পর যখন বুঝলাম শাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক তখন চোখ বন্ধ করলাম। ভাবুন তো, হাসপাতালে এই কেস নিয়ে গেলে কি হুজ্জোত হত। ছেলে পড়িয়ে খাই, আমার কি আর খাবার জুটত? লোকটি যখন কথা বলছিল তখন সুদীপ তাকিয়ে ছিল। সত্যি সরল মানুষ। বউ যা বোঝান তাই বোঝেন। নইলে ক্যাপসুলের গল্প বিশ্বাস করার কোন কারণ ছিল না। অথচ লোকটিকে নির্বোধ বলে মনে হচ্ছে না।
চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে সূদীপ কোন কথা না বলে চুমুক দিল। যুবতীর উদ্দেশ্য কি? স্বামীর কাছে চটপট মিথ্যে কথা বলার কি কারণ থাকতে পারে? এর পরে লোকটি তার প্রচণ্ড বা হলেও যুবতীকে কোন কটু কথা বলতে সাহস পাবে না। এইটেই হয়তো কাম্য ছিল যুবতী। কিন্তু যদি উলটো হত, যদি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হত তাহলে তো ডাক্তাররা বলেই দিত সত্যি কথাটা! এ রকম ঝুঁকি নিল কেন যুবতী? সে লোকটিকে বলল, সাততাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়েছেন।
আমি তো রোজই এই সময় এখানে সি চা খেতে। ফার্স্ট কাপ টি। ওর তো চা তৈরি করতে করতে সাতটা বেজে যায়। আর ভাবছি আমিই এখান থেকে চা নিয়ে যাই, কি বলেন?
নিশ্চয়ই। লোকটির ওপর রাগ করা যাচ্ছে না কিন্তু মোটেই খুশী হচ্ছিল না সুদীপ! একজন মাস্টারমশাই এত ক্যালস হন কি করে! সে জিজ্ঞাসা করল, কিছু মনে কববেন না, আপনাদের কতদিন বিয়ে হয়েছে?
দিন কি বলছেন? পাঁচ বছর!
ছেলেমেয়ে হয়নি, না?
লোকটির মুখ অন্য রকম হয়ে গেল। সেটাকে কাটাতেই বোধ হয় চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, কপাল! অনেক ট্রিটমেন্ট করালাম। সবার তো সব হয় না, আমারও হল না। যাক, আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আসুন না আমার ওখানে। ও খুব খুশী হবে! কালই বলছিল, দিদিমার বাড়িতে লোক এসেছে। ওখানে যে কেউ থাকবে তা কখনও ভাবিনি। আপনারা দুই বন্ধুতে এসেছেন?
হ্যাঁ।
কথাটা বলেই সুদীপ দখল কাগজ নিয়ে হকার আসছে। সে চা শেষ করে দাম দিতে যাচ্ছিল কিন্তু লোকটা সরবে প্রতিবাদ জানাল, ছি ছি ছি! আপনি রাখুন। গরীব মাস্টার হতে পারি, তাই বলে একটু চা খাওয়াতে পারব না ভাবলেন কি কবে!
সুদীপ যুক্তিটা কাটাতে পারত কিন্তু আর কথা না বাউয়ে সে এগিয়ে গিয়ে কাগজ কিনল। চারটে কাগজ। খুচরো ফেরত নেবার সময় একটা কাগজের প্রথম পাতায় নজব পড়তেই ওর মেরুদণ্ডে যেন শীতল বাতাস লাগল।
এই সময় লোকটি এর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। সুদীপ ওর গলা শুনতে পেল, কি আরম্ভ হল বলনু তো! দেশটা পাঞ্জাব হয়ে গেল নাকি! দুটো খুন! যাক, একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। নকশালরা তাহলে এখনও অ্যাকটিভ, কি বলেন?
সুদীপ ওর দিকে তাকাল, নকশালরা এসব করছে তা আপনাকে কে বলল?
লোকটি বিন্দুমাত্র বিব্রত না হয়ে বলল, ওরাই তো এসব করে। কি লাভ হয় কে জানে!
সুদীপ অনেক কষ্টে তর্ক করার লোভ সংবরণ করল। তারপর বলল, আমি যাচ্ছি।
যাচ্ছেন? বাড়িতে? চলুন, আমিও তো ফিরবো। লোকটি ওর সঙ্গ নিল।
আপনি চা নিয়ে যাবেন বলছিলেন না?
চা! ও হ্যাঁ। কিন্তু এখন নিয়ে গেলে জল হয়ে যাবে। আবার আসতে হবে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, ওই যারা প্যারাডাইস পুড়িয়েছে, বড়বাজারে খুন করেছে তারা নকশাল হোক বা না হোক আমি কিন্তু সমর্থন করি না। আমার স্কুলের অনেক মাস্টার অবশ্য ওদের সমর্থন করছে, কিন্তু এই আইন নিজের হাতে নেওয়া ব্যাপারটা খুব খারাপ। তাহলে দেশটাই পাঞ্জাব হয়ে যাবে। বোজ খুন, বোজ লুঠপাট, ভারতবর্ষ আর ভারতবর্ষ থাকবে না। পাবলিক তো তা বোঝে না, এই সব দেখলেই তেতে ওঠে। খুব বিরক্ত গলায় কথা বলতে বলতে পাশে হাঁটছিল লোকটি। সুদীপ এবারেও কিছু বলল না। তার ভয় হচ্ছিল, সে যদি কথা বলতে শুরু করে তাহলে লোকটির সঙ্গে সম্পর্ক ভাল থাকবে না। এবং এই সময় খামোকা একজনকে শত্রু বানিয়ে কোন লাভ নেই।
লোকটি বলল, আমি আমাদের ইংরেজি মাস্টারমশাইকে বলেছিলাম এটা সম্ভব নয়। এই দেশে কেউ খুন করে, প্যানিক তৈরি করে জিতে যেতে পারে না। ধরা এদের পড়তেই হবে। চারজন ছেলেমেয়ে কোন রকম ট্রেনিং ছাড়াই এত বড় একটা অর্গানাইজড সরকারী শক্তিকে কত দিন ঠেকিয়ে রাখতে পারে? তাই তো হল! ধরা একজন পড়ল ওদের! এবার কান টানলেই মাথা আসবে। বাকি তিনজনের ধরা পড়তে বেশি দেরি হবে না। আপনি কি বলেন? খুশী মনে প্রশ্ন করলেন লোকটি। একজন ধরা পড়লে তো সবাই ধরা পড়বে। সুদীপ বিরস গলায় উত্তর দিল।
বাড়ির কাছে পৌঁছে গিয়েছিল ওরা। লোকটি বললেন, তাহলে এখন আসি। একটু বেলায় চলে আসুন। গল্প করা যাবে।
উঠোনের দরজা খোলাই ছিল। এটা স্বাভাবিক নয়। তারপর নজরে এল বৃদ্ধা উঠোনে বসে আছেন চাদর গায়ে দিয়ে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে মোটেই সুস্থ নন। সুদীপ কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে আপনার? এভাবে বসে আছেন কেন?
জ্বর। কাল রাতেই চেপে ধরেছে। আমার তো ম্যালেরিয়া আছে, মাঝে মাঝেই ঘুরে ফিরে আসে। ও কিছু নয়। আমি ভাবছি তোমাদের ভাত রাঁধব কি করে? বুড়ির শরীর কাঁপছিল।
আমাদের জন্যে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। কোন ওষুধ খেয়েছেন?
ওষুধ লাগবে না। একবেলা শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে। আমাকে আর কোন্ যমে নেবে?
ঠিক আছে, আমি ওষুধ এনে দিচ্ছি একটু পরে। আপনাকে আজ কিছু করতে হবে না। কি কি অসুবিধে হচ্ছে বলুন। সুদীপ হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধার কপাল স্পর্শ করে দেখল জ্বর বেশ।
আর মায়া বাড়িও না তো। ওষুধ আমার লাগবে না। দরজাটা বন্ধ করে দিও। কাঁপতে কাঁপতে বৃদ্ধা যখন মোড়াটা নিয়ে উঠে বারান্দার দিকে এগোচ্ছেন তখন চকিতে ওঁর চোখ ওপচানো জল দেখতে পেল সে। সুদীপ আবিষ্কার করল ওর বুকের ভেতরটা টনটন করছে।
দরজা বন্ধ করে ওপরে এসে দেখল বন্ধুরা উঠে পড়েছে। জয়িতা চা করছিল। ওকে দেখামাত্র বলল, তুই নিশ্চয়ই এক সকালে দুবার চা খাবি না?
আনন্দ ওকে বল, আজ কিন্তু তুই প্রথমে ওর পেছনে লাগছিস! কাগজ দে।
সুদীপ দুটো কাগজ আনন্দর দিকে ছুঁড়ে বসে পড়ল। তারপর হেডলাইনে নজর রেখে নিজের মনে উচ্চারণ করল, ডেঞ্জারাস! এ কি ব্যাপার?
হেস্টিংসের ঘোড়ার আস্তাবলে অগ্নিকাণ্ড। আটটি ঘোড়া মৃত, দুজন খুন, একজন ধৃত। নিজের কাগজে চোখ রাখতেই আনন্দও সোজা হয়ে বসেছিল। ওরা চারজন এখন কাগজগুলোর ওপর উপুড় হয়ে পড়ল। গতরাত্রে কলকাতা রেসকোর্সে যে সব ঘোড়া দৌড়ায় তাদের আস্তানায় চারজনের দুবৃত্ত দল হানা দেয়। বেপরোয়াভাবে বোম মেরে তারা প্রহরীদের ভীত করে তোলে। বোমার আঘাতে দুজন প্রহরী সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারায়। আক্রমণকারীরা তারপর আস্তাবলে আগুন ধরিয়ে দেয়। অসহায় জীবগুলো সেই আগুনে আত্মরক্ষা করার কোন সুযোগ পায়নি। আটটি ঘোড়া জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যায়। চারটি এত পুড়েছে যে তারা আর কোনদিন দৌড়াতে পারবে না বলে রেসকোর্সের ডাক্তার জানিয়েছেন। এদের জীবনহানির সম্ভাবনা যায়নি। মধ্যরাত্রে কিছু পরে এই নৃশংস কাজ শুরু হয়। আক্রমণকারীরা সংখ্যায় চারজন ছিল। পালাবার সময় ওদের একজন ধরা পড়ে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, প্যারাডাইস এবং বড়বাজারের ঘটনার পর হুমকি দেওয়া হয়েছিল রেসকোর্স আক্রমণ করা হবে। সেই হুমকির ফলে রেসুড়েরা গতকাল রেসকোর্সে ঢুকতে সাহস না করায় কর্তৃপক্ষ রেস বাতিল করে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু মধ্যরাত্রে এই ধরনের আক্রমণের কথা কেউ কল্পনা করেনি। যে বারোটি ঘোড়া মৃত এবং অকেজো হয়ে গেল তাদের ক্রয়মূল্য ছিল আঠারো লক্ষ টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষতির পরিমাণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। আক্রমণকারীরা যে সাধারণ ডাকাত নয় বা তারা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্যে এই কাজ করেনি তা পরিষ্কার। মধ্যরাত্রে পুলিশ কমিশনার জানান, যে আক্রমণকারীকে ধরা হয়েছে তার বয়স একুশ। সংঘর্ষে আহত হওয়ায় তাকে এখন হাসপাতালে রাখা হয়েছে। জ্ঞান ফিরলেই জেবা শুরু হবে। এবং তাহলে ওর দলের অন্যান্যদের ধরা অসম্ভব হবে না। তিনি বলেন, প্যারাডাইস এবং বড়বাজারের বিপ্লবীদের দিন শেষ হয়ে এসেছে।
এর পরে কাগজগুলো বিশদ বিবরণ দিয়েছে কিভাবে ঘটনাটা ঘটে। তার পাশেই বক্স করে ওরা সুদীপের টেলিফোনের খবরটাও ছেপেছে। তারপর সংযোজিত হয়েছে, কিন্তু টেলিফোন যিনি করেছিলেন তিনি জানাননি যে আর কিছুক্ষণ পরে যে কাজ করতে যাচ্ছেন তাতে জনসাধারণের সমর্থন পাবেই না বরং কতগুলো নিরীহ প্রাণীকে হত্যা করে তারা নিছক খুনী বলেই প্রতিভাত হবে।
কল্যাণ বলল, এটা কি ব্যাপার? আমি তো মাথামুণ্ডু বুঝতেই পারছি না।
আনন্দ ঠোঁট কামড়ে বসেছিল। জয়িতা বলল, ওই চারজনের মধ্যে কোন মেয়ে আছে কিনা তা লেখেনি! একজন ধরা পড়েছে। আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে।
সুদীপ বলল, বুঝতেই পারছি ওই চারজন আমাদের কাজ দেখে উদ্দীপ্ত হয়ে এই কাণ্ডটা করল। একবারও ভেবে দেখল না এটা আমাদের কিরকম বিপক্ষে যাবে। অবলা জানোয়ার পুড়িয়ে মারল ওরা, পুরো পাবলিক সিমপ্যাথি নষ্ট হয়ে গেল! কিন্তু এই চারজন যে খুব বিক্ষিপ্ত কোন ছেলেব দল তা মনে হচ্ছে না। উগ্রপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী কোন দল এটা করিয়েছে। যেভাবে মূর্তি ভাঙত, পুলিশ মারত, ঠিক সেইভাবে ঘোড়া পোড়াল। ইডিয়ট!
আনন্দ কিছু বলছিল না। একটা চিন্তা ওর মাথায় কেবলই পাক খাচ্ছিল। কোন দল বা স্বার্থ আছে এমন কেউ বা কারা তাদের সম্পর্কে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার জনোই এমন কাণ্ডটা করালো না তো! এই ঘটনার পরে যাতে সারা দেশে ওই প্রতিবাদ ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা। কিন্তু দুটো লোক খুন হয়েছে, যে ধরা পড়েছে তার তো মৃত্যুদণ্ড অনিবার্য। ফলে আদালতে সে সত্যি কথা বলবেই। সে ক্ষেত্রে নিয়োগকারীদের উদ্দেশ্য বানচাল হয়ে যাবে। তারা কখনই চাইবে না ছেলেটা মুখ খুলুক। এখন যদি ওর জ্ঞান না ফেরার ব্যবস্থা করতে পারে ওরা! আনন্দ প্রচণ্ড অস্বস্তির মধ্যে আবার কাগজে চোখ বোলাল। বড়বাজারের ঘটনাটার পরিপ্রেক্ষিতে মোহনলালের সম্পর্কে আরও তথ্য বেরিয়েছে। সে যে শুধু জাল ওষুধের কারবার করত তাই নয়, অনেকরকম দুনম্বরী ব্যবসা ছিল তার প্রমাণ পুলিশের হাতে এসেছে। প্রথম পাতাটা জুড়েই তাদের খবর। পুলিশ একে কিছুতেই রাজনৈতিক কার্যকলাপ বলতে চাইছে না। অস্থিরমতি কিছু বিপথগামী ছেলেদের কীর্তি এটা। পুলিশের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে কিছু রাজনৈতিক দল। একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা বলেছেন, বিপ্লবের কোন সংজ্ঞায় এরা পড়ে না। জনসাধারণের সামনে বিপ্লবের নামে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যেই কায়েমীস্বার্থরক্ষাকারীরা এদের নিয়োগ করেছেন। কয়েকটি উগ্রমতাবলম্বী দল স্পষ্ট বিবৃতি দিয়ে জনসাধারণকে সতর্ক করেছে এই বলে যে তাদের সঙ্গে এই কাজের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু পুলিশ যদি আজ সকালে সন্তুষ্ট হয়, যে চারজন আগের কাজ দুটো করেছে তাদের একজনকে যখন ধরা সম্ভব হল তখন বাকি তিনজনও ধরা পড়বে সেই সন্তুষ্টি দূর হতে বেশি সময় লাগবে না। ছেলেটির পরিচয় জানামাত্র পুলিশ বুঝবে আনন্দ কল্যাণ এবং সুদীপের সঙ্গে ওর কোন সম্পর্ক নেই। ওদের সঙ্গে কোন মেয়ে নেই এটাও ওরা জানতে পারবে। তবে এটা ঠিক, এতে পুলিশের সমস্যা বাড়বে। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তুই চুপচাপ যে!
আনন্দ হাসল অনেকক্ষণ পরে, কি বলব! এরকম হোক আমি চাইনি। যদি কোন সাধারণ ছেলের দল কাজটা করে থাকে তাহলে বলব ভুল করেছে। আটটা ঘোড়াকে না পুড়িয়ে আটজন অসৎ ব্যবসায়ী কিংবা ধান্দাবাজ রাজনৈতিক নেতাকে পুড়িয়ে মারলে মনে করতাম আমাদের উদ্দেশ্য সফল হতে চলেছে। আর এরা ধরা পড়লেই পুলিশ জানবে আমরা কাজটা করিনি। সেটা যদি প্রেস জানতে পারে তাহলে পাবলিক জানবে। আমাদের তরফ থেকে আজ আবার প্রেসকে জানাতে হবে এই ব্যাপারটা সমর্থন করি না আমরা। যারা আমাদের কাজের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে জনসাধারণের স্বার্থ বক্ষা করতে উদ্যোগ নেবে তারা যেন প্রতিটি পরিকল্পনা হাতে নেবার আগে খুঁটিয়ে দেখে নেয় কি ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটবে। কাগজগুলো যদি এই বিবৃতি ছাপে তাহলে আর জনসাধারণ আমাদের ভুল বুঝবে না। চা দে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
কল্যাণ বলল, আগেভাগে প্রেসকে জানালে বোকামি হবে না? পুলিশ ভাবছে কাজটা আমরাই করেছি। ছেলে তিনটে ধরা পড়লে আমাদের ওপর থেকে পুলিশের নজর সরে যাবে। অথচ আগেভাগে জানালে আমরা এই সুযোগটা সদ্ব্যবহার করতে পারব না, তাই না?
আনন্দ আবার হাসল, এরকম হলে আমিও খুশ হতাম। কিন্তু যে ছেলেটি ধরা পড়েছে তার পরিচয় জানার পর পুলিশের বুঝতে অসুবিধে হবে না আমরা আলাদা। আমরা তাই বেশিক্ষণ নিশ্চিন্ত থাকার সুযোগ পাচ্ছি না কল্যাণ।
সকাল নটা নাগাদ যে বাংলা খবর হয় সেটাতে নতুন কোন তথ্য জানা গেল না। ধরা পড়ার পর আস্তাবলের লোকজন ছেলেটিকে এমন মারধোর করেছে যে এখনও তার জ্ঞান ফেরেনি। সামান্যতম সুযোগেই পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। যে ট্যাকসি কবে ওরা এসেছিল সেটিকে সল্ট লেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। পুলিশ সেখানে অনেকের হাতের ছাপ পেয়েছে। এই হাতের ছাপের সঙ্গে পূর্ববর্তী দুটি ঘটনার জন্যে দায়ী সন্দেহভাজনদেব হাতের ছাপ মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।
আনন্দ বলল, এই ঘটনাটার কথা আমরা ভুলে যাব অথব! উপেক্ষা করব। আগামীকাল সন্ধ্যেবেলা কলকাতায় আপাতত তৃতীয় অ্যাকশনটি করব। আবে দুটি ঘটনায় আমরা দুটো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছি। এবারে আমাদের লক্ষ্য ব্যক্তি। এমন একটি ব্যক্তি যিনি জনদরদী সেজে উসাধারণের সর্বনাশ করছেন! ভারতবর্ষের নাগরিক হয়েও ভারতবিরোধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন ভোটে জেতার জন্যে। পার্টি তাকে মন্ত্রীত্ব দিয়েছে যাতে তিনি পার্টির স্বার্থ বজায় রাখেন। এই লোকটি নিজের বান্ধেব জমানো টাকার পরিমাণ বেআইনী পথে শুধু বাড়াচ্ছেন না, একটি বিশাল এলাকায় তিনি স্মাগলারদের কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে সাহায্য করছেন। তোরা কি সবাই একমত এই ব্যক্তিটির পৃথিবীতে থাকার প্রয়োজন আছে কি নেই সেই ব্যাপারে?
সুদীপ বলল, এত ভূমিকা করার কোন দরকার নেই। এই মন্ত্রী যিনি ষড়যন্ত্রী তার বিসর্জনের বাজনা শুনতে পাচ্ছি। আগামী সন্ধ্যায় ভাসান দিয়ে আসব।
কল্যাণ বলল, এই ব্যক্তিহত্যায় কোন পাপ নেই।
জয়িতা খিঁচিয়ে উঠল, পাপ! ওসব ফালতু কথা বলিস না। পাপ পুণ্য বলে কোন কথা নেই। আসল ব্যাপার হল ভাল এবং মন্দ। শুধু মন্ত্রী নয় ওই নানভাইটাকেও সরাতে হবে। কারণ মন্ত্রীকে মারলে নানুভাই আর একটা লোককে মন্ত্রী বানিয়ে দিতে দেরি করবে না। শেকড় না ওপড়ালে অ্যাকশনটা করার কোন মানে হয় না। কি ভাবে করবি প্ল্যান করেছিস?
অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। আজকে একবার মন্ত্রীর বাড়িটা দেখতে যাব। এই সব জনতাব সেধক বাড়িতে বেশি পুলিশ প্রটেকশন রাখবে। তাছাড়া নানুভাই এলে তার সঙ্গীবাও থাকবে। অতএব যা করতে হবে খুব ভেবেচিন্তে করতে হবে। আমি রিপোর্টার হয়ে যাব, সঙ্গে থাকবে ক্যামেরা নিয়ে সুদীপ।
আনন্দকে বাধা দিল জয়িতা, ক্যামেরা নিয়ে তোর সঙ্গে আমিও ভেতরে যেতে পারি।
পারিস কিন্তু এক্ষেত্রে নয়। কলকাতার কোন কাগজেব মহিলা কামেরাম্যান নেই।
সুদীপ হেসে বলল, মহিলা ক্যামেরাম্যান? কানে লাগলেও চালাতে পারিস শব্দটাকে।
নেই বলে হবে না কেন? এককালে তো খবরের কাগজে মেয়েদের চাকরি দেওয়া হত না। এখন সাব এডিটিং তো অবশ্যই, বিজ্ঞাপন এমন কি সম্পাদনার কাজেও বড় কাগজগুলো মেয়েদের চাকরি দিচ্ছে। অতএব ক্যামেরা নিয়ে যেতে দোষ কি? জয়িতা প্রতিবাদ জানাল।
দোষ আছে আমি বলিনি। যতদিন না চোখ সওয়া হচ্ছে ততদিন আমাদের পক্ষে এই কাজটা তোকে দিয়ে করানো ঝুঁকি হয়ে যাবে। যাক, আজ আমরা বের হব। আমি আর সুদীপ। তাদের আগেও বলেছিলাম, মাঝে হয়তো কিছুদিনের জন্যে কলকাতা থেকে আমাদের দূরে চলে যেতে হতে পারে। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটবে ভাবিনি। ভারতবর্ষের কোন জায়গায় আমাদের চারজনের পক্ষে লুকিয়ে থাকা নিরাপদ হবে না। আমরা যাব ভুটান বা নেপাল সীমান্ত পেরিয়ে একটা পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে যোগাযোগের কোন সুবিধে নেই। কিছুদিন সেখানে থেকে যখন এদিকে আমাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার ইচ্ছেয় ঢিলে পড়বে তখন আবার ফিরে আসা যাবে। তাছাড়া এই সময়টুকুতে দেশের লোকের কি প্রতিক্রিয়া হল তাও জানতে পারব আমরা। কাল রাত্রে অ্যাকশনের পরই আমরা বেরিয়ে যাব। মালপত্র নিয়ে আমরা যাব বাই বোড় এবং বাই ট্রেন। কল্যাণ আর জয়িতা যাবি বাই প্লেন। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে প্লেনে কলকাতা ছাড়াই নিরাপদ। ওরা মনে করতে পারবে না বাঙালিরা প্লেনে পালাতে পারে।
জয়িতা বলল, প্লেনে কোথায় যাব?
সেসব ডিটেলস আজ রাত্রে আলোচনা কবব। তার আগে সারাদিন কিছু কেনাকাটা আছে। শীতপ্রধান অঞ্চলে যাতে বেশ কিছুদিন থাকা যায় সেই রকম ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। সুদীপ বলছে বুড়ির জ্বর হয়েছে। অতএব আজ দুপুরে খাবার পাওয়া যাবে না নিচ থেকে। তোর এখানে যা আছে তাই খেয়ে নে, ফেরার সময় আমি খাবার কিনে নিয়ে আসব। আজ অন্তত তোরা সেফ, বুড়ি হঠাৎ ওপরে উঠে আসবে না। সুদীপ, আমি আগে বেরিয়ে যাচ্ছি। আমার লিস্টটা সঙ্গে থাকল। যত তাড়াতাড়ি পারিস ফিরে আসিস। গতরাত্রেই টাকা আর লিস্ট দুজনে ভাগ করে নিয়েছিল।
জয়িতা বলল, চুপচাপ এখানে বসে থাকতে আর ভাল লাগছে না আনন্দ।
বুঝতে পারছি। আর একটা দিন! তারপর যে ছোটা শুরু হবে তখন বলবি আর ছুটতে পারছি না আনন্দ, এবার চুপচাপ বসতে চাই। আমি আসছি তাহলে। সুদীপ তুই একটু পরে বের হবি। নিচে আয় দরজাটা বন্ধ করে দে। আনন্দ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লে সুদীপ তাকে অনুসরণ করল।
আজ দিনটা বেশ মেঘলা। নিচে নেমে আনন্দ একবার বৃদ্ধার বারান্দার দিকে তাকাল। ঘরের দরজা আধাভেজানো। সে ইশারা করতে সুদীপ ওর সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলল। খাটের ওপর বৃদ্ধা কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে আছেন। সুদীপ কাছে গিয়ে ডাকল, কেমন লাগছে এখন?
বৃদ্ধা চোখ মেললেন। তারপর কোনমতে উচ্চারণ করলেন, জ-ল। জল দেবে?
আনন্দ চটপট পাশের কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে সুদীপের হাতে দিতে সে বৃদ্ধার সামনে গ্লাসটা ধরল। শুয়ে শুয়েই মুখ পাশ ফিরিয়ে বৃদ্ধা খানিকটা খেয়ে বললেন, বেঁচে থাক বাবা, ভীষণ শীত করছে আমার। তোমাদের বেঁধে দিতে পারলাম না। অতিথি উপোস করে রইলে!
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওরা বেবিফে এল ঘর ছেড়ে। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কি ওষুধ আনা যায় বল তো! শীত করছে যখন তখন ম্যালেরিয়া। কুইনাইন খায় না এই সময়? নাকি কোন ডাক্তারকে গিয়ে সিমটমগুলো বলব?
সুদীপ মাথা নাড়ল, তুই চলে যা। অ্যালোপাথি ওষুধ খায় কিনা তাই জানি না। আমি আর একটুখানি দেখি, যদি না কমে তাহলে পাশের বাড়ির ভদ্রলোককে ডাক্তারের কাছে পাঠাব।
আনন্দ বেরিয়ে গেলে দরজা বন্ধ করে সুদীপ আকাশের দিকে তাকাতেই নিমগাছটার পাতা দেখতে পেল। বেশ ঝাকড়া হয়েছে গাছটা। অথচ বৃদ্ধা এই গাছ থেকে কোন উপকার নেন কিনা কে জানে! এসে অবধি তো দ্যাখেনি। অবশ্য কে যেন বলেছিল নিমগাছের বাতাস নাকি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। আবার ঘরটার দিকে তাকাল সুদীপ। খুব খারাপ লাগছিল ওর।
দরজায় কয়েকবার শব্দ করার পর সাড়া মিলল। লোকটি সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে দেখে যেন পুলকিত হল, আরে, আসুন আসুন। আমি বললাম ওকে বলে এলাম তবু এলেন না কেন। ভেতরে আসুন।
সুদীপ মাথা নাড়ল, না। মানে, আপনার কাছে অন্য উদ্দেশ্যে এলাম। পিসীমার শরীর খুব খারাপ হয়েছে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে, ম্যালেরিয়ার লক্ষণ। একটু ডাক্তারকে বলে ওষুধ আনা দরকার।
ডাক্তার! মুশকিলে ফেলে দিলেন–! লোকটিকে চিন্তিত দেখাল।
অবশ্য আপনার কাছে যদি জ্বরের, মানে এই ধরনের জ্বরের কোন ওষুধ থাকে তাহলে–।
না না। আপনি বুঝতে পারছেন না। উনি তো অ্যালোপাথি ওষুধ খাবেন না। জোর দিলে হিতে বিপরীত হবে। মানসিক রোগ। বেহালা চৌরাস্তার মোড়ে একজন হোমিওপ্যাথের কাছে ওষুধ এনে খান দরকার হলে। আমিও দু-একবার এনে দিয়েছি। কিন্তু আজ সেই ডাক্তার এবেলা বসবেন না বলেই মুশকিল শব্দটা বললাম, ট্যাবলেট ক্যাপসুল দিলে খাবেন ভেবেছেন? জ্ঞান থাকতেও না। এক কাজ করি বরং, দুপুরের পরে যখন ফিরব তখন আমি ওষুধ নিয়ে আসব। জুর, কাঁপুনি! কত জ্বর?
সেটা তো জানি না। তবে বেশ জ্বর। দাঁড়াতে পারছেন না।
পায়খানা হয়েছে? খেয়েছেন কিছু? লোকটি যেন ডাক্তার হয়ে গেল এই মুহূর্তে।
সে-কথা জিজ্ঞাসা করিনি।
ঠিক আছে তাতেই চলবে। আমি তো স্নান খাওয়া সেরে বের হচ্ছিলাম, এই সময় আপনি–।
তাহলে আমি চলি। আপনি দয়া করে ওষুধটা আনবেন। কত দিতে হবে?
কত আর, পাঁচ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়! হোমিওপ্যাথি ওষুধ গরিবদের জন্যে, বুঝলেন!
সুদীপ পকেট থেকে সন্তর্পণে টাকা বের করতে গিয়ে একটা একশ টাকার নোট বের করে ফেলল। সে ভয় পেল, পালটে আর একটা বের করতে চেষ্টা করলে যদি আরও একশ বেরিয়ে পড়ে। তার পকেটে অত টাকা দেখে নিশ্চয়ই লোকটি স্বস্তি পাবে না। সে টাকাটা লোকটির দিকে এগিয়ে ধরল, আমার কাছে খুচরো নেই, এটা রাখুন।
কি আশ্চর্য পাঁচ টাকার জন্যে একশ দিচ্ছেন কেন? ঠিক আছে, আমি নিয়ে আসি, তারপর ও নিয়ে–ভাবা যাবে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না দরজা থেকে আপনি চলে যাবেন কেন? আসুন, ভেতরে আসুন। লোকটি প্রায় হাত ধরেই টানল ওকে।
সুদীপ শেষবার আপত্তি জানাল, আপনি তৈরি হয়ে নিয়েছেন, বেরোবেন বললেন, এই সময় আসা মানে বিরক্ত করা, তাই না?
লোকটি এবার মুখ নামিয়ে আনল সুদীপের কাছে, কাল থেকে শুয়ে আছে। সকালে কোনমতে কলপায়খানা সেরেছে। বলছে মাথা ঘুরছে আর দুর্বল লাগছে। তা আমি নিজেই সব কিছু করলাম। চা খাওয়ালাম, রান্না করলাম। ওর জন্যে ভাত ডাল ভাজা আর ডিমের ঝোল করে ঢেকে রেখে দিয়েছি। বলেছি যতক্ষণ ইচ্ছে ঘুমাক। এই অবস্থায় বেশি নড়াচড়া করতে হবে না। শিবের আশীর্বাদ যে কাল তিনি দেহ রাখেননি। যদি আপনার কাছে ক্যাপসুলটা–। হঠাৎ লোকটি থেমে গেল, লোকে কপালে বিশ্বাস করে না। কিন্তু আপনার পকেটে এত ক্যাপসুল থাকতে, ঠিক বিষ নষ্ট করার ক্যাপসুল থাকতে যাবে কেন? আপনি তো জানতেন না ও তখন বিষ খাবে!
লোকটি কথাটা বলে সুদীপের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। অর্থাৎ এখন লোকটির মনে সন্দেহ ঢুকেছে। অথচ এ নিয়ে বোধ হয় কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারছে না। সুদীপ চটজলদি জানাল, আমার বন্ধুর খুব ভয় যে ওকে সাপে কামড়াবে। মানে ওর ধারণা এসব অঞ্চলে প্রচুর সাপ আছে। ওই আমাকে ক্যাপসুলটা রাখতে দিয়েছিল। সাপ কামড়ালে ওটা ওর মুখে দিয়ে দিলে রক্ত বিষকে আর গ্রহণ করবে না। সেটাই পকেটে ছিল আমার। এর চেয়ে বেশি মিথ্যে ওর মাথায় এল না। যদিও তার বলতে ইচ্ছে করছিল, আপনার স্ত্রীর কিছুই হয়নি। তিনি স্রেফ ভড়কি দিয়েছেন আপনাকে।
লোকটি এবার তৃপ্তির হাসি হাসল। মানুষ কত সহজে খুশী হয়। সে নিজেও যখন জানে বোকামি করছে কিন্তু তা যদি আনন্দদায়ক হয় তখন বোকা সাজতে তার দ্বিধা থাকে না। লোকটিকে দেখে সুদীপের এখন সেই রকম মনে হচ্ছিল। যেন একটা মেঘ সরে গেছে এমন ভঙ্গি করছিল লোকটি।
কাল রাত্রের ঘরটিতে লোকটিকে অনুসরণ করে ঢুকল সুদীপ। রাতে যা আড়াল থাকে দিনে তা পরিষ্কার। লোকটির আর্থিক অবস্থা মোটই সুবিধের নয়। সংসার চালাতে যে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় তা বোঝাই যাচ্ছে। ঘরের আসবার, রেডিওর চেহারা এবং আপনার জামাকাপড় একটি বিশেষ শ্ৰেণীকেই চিহ্নিত করছে। লোকটির এগিয়ে দেওয়া কাঠের চেয়ারটায় বসে সামনে তাকাল সুদীপ। যুবতী উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন বালিশে মুখ গুঁজে। এখন ওঁর পরনে গতরাতের শাড়িটি নেই। কিন্তু এই ঘর, আসবার জিনিসপত্র এবং এই লোকটির সঙ্গে ওর শোওয়ার ভঙ্গি শাড়ি এবং স্বাস্থ্য একদম বেমানান। সুদীপ যে এই ঘরে ঢুকেছে তাও যেন টের পায়নি যুবতী। লোকটি বলল, এখন কি করা যায় বলুন তো! এই যে ঝিমুনি, ঘুম-ঘুম ভাব, এসবই নিশ্চয় বিষের প্রতিক্রিয়া। ইঁদুর মারার বিষ এনেছিলাম তাই খেয়েছিল। এখনও ভাবলে আমার গায়ের নোম সোজা হয়ে যায়। মরে গেলে হাতে দড়ি পড়ত আমার। বিষটার প্যাকেটে বড় বড় অক্ষরে পয়জন লেখা আছে।
সুদীপ অনেক চেষ্টা করল অভিনয় ঠিক রাখতে, ফাঁড়া যখন কেটে গেছে তখন আর চিন্তা করছেন কেন? রেস্ট নিতে দিন, ঠিক হয়ে যাবে। তবে আর যেন এমন না হয় তাই দেখবেন।
সঙ্গে সঙ্গে লোকটি মাথা নাড়ল, ক্ষেপেছেন! ন্যাড়া কবার বেলতলায় যায়? আমি কি পাগল?
সুদীপ বলল, দুবার। একবার বেল মাথায় পড়ে, দ্বিতীয়বার পড়ে যাওয়া বেলটা কুড়িয়ে আনতে।
শোনামাত্র লোকটি হ্যাঁ হ্যাঁ করে খানিকটা হাসল। সুদীপ আড়চোখে লক্ষ্য করল শুয়ে থাকা শরীরটার পিঠ কয়েকবার কেঁপে উঠল। লোকটি বলল, কতক্ষণ বাদে একটু মন খুলে হাসলাম। যাক, বলছেন তাহলে এখন আর কোন ভয় নেই! ওষুধপত্র দিতে হবে না তাহলে! কথাগুলো বলে লোকটি উঠে বিছানার পাশে দাঁড়াল, শুনছ! ওগো শুনছ! দ্যাখো কে এসেছে। ও-বাড়ির দিদিমার খুব অসুখ, বুঝলে!
সুদীপ বলল, আঃ, ওঁকে বিরক্ত করছেন কেন? আপনি তো বের হবেন, আমি চলি!
লোকটি বলল, সেই তো মুশকিল! আমি বেরিয়ে গেলে তো দরজা দিতে হবে।
সুদীপ উঠে দাঁড়িয়েছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, একটা কথা বলুন তো–ওর বিষ খাওয়ার দরকার হল কেন? আমোক তো কেউ আত্মহত্যা করতে চায় না। নিশ্চয়ই একটা কারণ থাকবে।
এবার লোকটি কুঁকড়ে গেল। তারপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, কাল থেকে আমি ভাবছিলাম কখন এই প্রশ্নটা শুনতে হবে। দোষ আমার। ও খুব বড় ঘরের মেয়ে। পড়াতে গিয়ে যা হয় আর কি! সবার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করি। তারপর এই অভাব, ওর একটা সাধআহ্লাদ রাখতে পারিনি, বয়সেরও পার্থক্য, সব মিলিয়ে সুখী তো করতে পারলাম না। ওর বাপের বাড়ির লোক বলে দিয়েছে আমাকে ত্যাগ করে যদি যেতে পারে তাহলে গ্রহণ করবে! অতএব সে-দরজা বন্ধ। তারপর বাচ্চাকাচ্চাও হল না আমাদের! কম ডাক্তার দেখালাম না তো! বয়স অল্প, চঞ্চল মন, মাঝে মাঝে দু-একটা ভুল করে ফেললে পাড়ার লোক কুকথা বলে। শুনে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারিনি গতকাল। তবে হ্যাঁ, কাল রাতে প্রতিজ্ঞা করেছি আর কিছু বলব না। যাতে ও সুখ পায় তাই করুক। আমাকে ছেড়ে না গেলেই হল।
সুদীপ অবাক হয়ে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়েছিল। এই মুহূর্তে ওকে কর্ণের মত দেখাচ্ছিল। আর তখনই যুবতী পাশ ফিরল। ধীরে ধীরে চোখ মেলল সে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করল, কেমন লাগছে এখন? ভাল আছ তো?
যুবতী ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ভাল। তারপর সুদীপের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসল।
লোকটি বলল, ইনি দিদিমার বাড়িতে এসেছেন। খুব ভাল লোক। কাল এর ওষুধেই–।
সুদীপ যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল, আমি চলি। তার আর এই অভিনয় ভাল লাগছিল না।
যুবতী বলল, আপনি দাঁড়ান। নিমপাতা দেননি বলে এখান থেকে চা না খেয়ে যাবেন তা হবে না।
সুদীপ উত্তর দিল, আপনি অসুস্থ! আমার মনে হয় শুয়ে থাকলেই আপনার ভাল হবে।
কিসে ভাল হবে আমি জানি। তুমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? দেরি হয়ে যাচ্ছে না?
প্রায় ধমকের গলায় যুবতী কথাগুলো বলতেই লোকটি শশব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। বিকেলের মধ্যেই আমি দিদিমার ওষুধ নিয়ে আসব। খাবারদাবার সব-।
যুবতী ওকে থামাল, বিকেলের মধ্যে নয়। স্কুলে গিয়ে দু-ঘণ্টা ছুটি নিয়ে এবেলাতেই ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওষুধ নিয়ে এস। রাত্রে জ্বর হয়েছে আর তিনি তোমার ওষুধের জন্যে বিকেল পর্যন্ত বসে থাকবেন?
লোকটি সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করল তাই করবে। তারপর আর কথা ব্যয় না করে পাশের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। এবার যুবতী উঠে দরজাটা বন্ধ করে ফিরে এসে বলল, কথা কানে যায়নি? বসুন। আমিও চা খাব।
সুদীপ খোলাখুলি জিজ্ঞাসা করল, আপনি এই নাটকটা করলেন কেন? আর করলেনই বা তো আমাকে এর সঙ্গে জড়ালেন কেন? আপনার স্বামী মানুষ হিসেবে খারাপ নন। ওঁকে ঠকাতে আমার খারাপ লাগছে।
কে কাকে ঠকায়! তাছাড়া আপনি যে এসে হাজির হবেন তা আমি জানতাম না। যুবতী জানাল।
কিন্তু এটা আমার প্রশ্নেব উত্তর হল না। আপনি কেন এমন করলেন? সুদীপ জেদী গলায় প্রশ্ন করল।
বেশ করেছি। আমি আজ এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব ভেবেছিলাম। যাওয়ার আগে ওকে জব্দ করতে চেয়েছি। একটা মানুষের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে তাকে চিরকাল বাধ্য হয়ে ভালবাসতে হবে? তার সঙ্গে আমার মনের কোন মিল না থাকলে, তাকে অসহ্য মনে হলেও চিরকাল একসঙ্গে থাকতে হবে? কত বড় বড় লোকের সম্পর্ক তো না বলেই ভেঙে যায়, দুটো দেশের কত চুক্তি তো এক মুহূর্তেই বানচাল হয়ে যায়! তাহলে একটা মানুষকে চিরকাল কেন বাধ্য করা হবে সহ্য করতে? বাপের বাড়িতে আমি ফিরে যাব না, কারণ আমি কাবও করুণা নিতে চাই না। এসবই তো কাল ভেবেছিলাম। যুবতী ঠিক উত্তেজিত নয় কিন্তু সাধাবণ গলায় কথা বলছিল না।
ঠিক তখনই ওপাশের দরজায় শব্দ হল! একটা চোরা গলার ডাক ভেসে এল, এই, শুনছ, এই, আমি এসেছি। আমি তৈরি হয়ে এসেছি! যাবে তো?
যুবর্তী সুদাপকে বলল, একটা উপকার করবেন? দরজাটা খুলে ছেলেটাকে বলুন আমি বিষ খেয়েছি। ও যদি এখানে দাঁড়ায় তাহলে পুলিশ ওকে ধরবে।
সুদীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কি ব্যাপার। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আপনাকে কিছুই বুঝতে হবে না। যা বলছি তাই দয়া করে করবেন?
সুদীপ কৌতূহলী হয়ে উঠল। দরজাটা খুলতেই তাকে দেখে একটি যুবক থতমত হয়ে গেল। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কাকে চাই?
যুবক বলল, নামানে-কিছু নয়–। তারপর পাশে রাখা স্যুটকেসটা তুলে নিয়ে যেতে চাইল।
সুদীপ বলল, এই যে মশাই, আপনি দাঁড়ান। আপনাদের কি কোথাও যাওয়ার কথা ছিল?
যুবক মাথা নাড়ল। তারপর বলল, আমাকে যেতে দিন।
সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কেন? এসেছিলেন কেন?
আপনার এখানে থাকার কথা ছিল না।
ও! শুনুন। উনি গতরাত্রে বিষ খেয়েছেন।
অ্যাঁ! যুবকটির চোখ বিস্ফাবিত হল। সুদীপ স্পষ্ট বুঝতে পারল ও খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছে। হসপিটালে আছেন। চলুন, দেখতে যাবেন না?
যুবকটি আর দাঁড়াল না। শেয়ালের ভঙ্গিতে দৌড়ে পালাল সে। দরজা বন্ধ করে ভেতরে আসতেই যুবতী বলল, ধন্যবাদ। আর একবার।
সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, একে তাড়ালেন কেন?
যুবতী বলল, আজ ভোর থেকেই মনে হচ্ছিল চলে যাওয়াটা হয়তো ভুল হবে। শেষবার যাচাই করলাম। এ যাত্রায় আপনার জন্যে বেঁচে গেলাম আমি। নেবা উনুন থেকে গরম কড়াইতে পড়তাম আমি। দেখি কতদিন এখানে মানিয়ে থাকতে পারি! আসুন, আমার হাতের চা খাবেন না? যুবতীর ঠোঁটে সেই হাসি ফিরে এল।
সুদীপ মাথা নাড়ল, না। আমার হাতে অনেক কাজ আছে। তারপর আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বৃদ্ধার দরজা পেরিয়ে সেটাকে বন্ধ করল।
এবং এবার লোকটার জন্যে কষ্ট হচ্ছিল।