গুপী স্যাকরার বরাত ফিরেছে। রাইমোহনের দৌলতে দু-চারটি বড় বড় মানুষের বাড়ির কাজ ধরবার ফলে বিশেষ সমৃদ্ধি ঘটেছে তার। আর সে আগেকার মতন সন্ধেবেলা দুগ্নাপিদিম জ্বলিয়ে এক একা হাপর চালায় না, এখন তার দোকানে পাঁচ ছজন কর্মচারী খাটাখাটনি করে, সে নিজে উঁচু জাজিমের ওপর বসে আরামে গড়গড়া টানে। ধন্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে মেদ বৃদ্ধিও হয়ে চলেছে সমান তালে, মুখমণ্ডলেও দেখা দিয়েছে বেশ একটা তেল চুপচুপে ভাব। সমাজে মান বাড়াবার জন্য গুপীও এখন রামবাগানে একটি পশ্চিমা মেয়েমানুষ রেখেছে।
অনেকদিন পর রাইমোহন এলো তার দোকানে। দীর্ঘকায় রাইমোহনের এখন আর ছাতে মাথা ঠুকে যাবার ভয় নেই, কারণ গুপী তার পুরোনো দোকানঘর ভেঙে নতুন পাকা বাড়ি বানিয়েছে, দেয়ালজোড়া বেলজিয়ান আর্শি, সামনে লোহার গেট। রাইমোহন সাধারণত আসে দোকান বন্ধ হবার মুখটায় যখন আর খদেরপাতি থাকে না। আজও গুপী স্যাকরা যখন তার কর্মচারীদের বিদায় করছে। সেই সময় সে এসে উপস্থিত হলো।
গুপী তাকে খাতির দেখাবার জন্য দাঁড়িয়ে উঠে হৈ হৈ করে বললো, আসুন, আসুন, ঘোষালমশাই, আসতে আজ্ঞা হোক, বসতে আজ্ঞা হোক। ওরে পান নিয়ায়, গড়গড়া নিয়ায়। ঘোষালমশাইয়ের জুতো জোড়া ওপাশে রেকে দে।
রাইমোহন জাজিমের ওপর বাবু হয়ে বসে একটি বেশ বড় রকমের উদগার তুলে বললো, এক ঘটি জল খাওয়া তো বাপ। ঘি খেতে খেতে বায়ু রোগ ধরে গ্যাল!
গুপীর আদেশে এক ছোঁকরা কর্মচারী এক কাসার ঘটি ভর্তি জল নিয়ে এলো, আলগোছে রাইমোহন তার জলটুকু শেষ করে ফেলে। আর একটি উদগার তুলে তৃপ্তির সঙ্গে বললো, আঃ!
গুপী জিজ্ঞেস করলো, কোতায় এত ঘি খেলেন, ঘোষালমশাই?
রাইমোহন বললো, আর বলিস কেন? এক একজন বড় মানুষ মরে, আর তাদের শ্ৰাদ্ধ খেতে খেতে আমাদের পেটের ব্যামো ধরে যায়।
গুপী বললো, আপনারও আহারে অরুচি? এ যে দেখছি। অগ্নিরও অগ্নিমান্দ্য!
—বয়েস হলো রে গুপী, আর তেমন খাওয়ার ঢাক নেই।
–তা কার ছোরাদে এত খেলেন?
—কেন, রামকমল সিংগীর ছোরাদে তোর নেমন্তন্ন হয়নি?
—হ্যাঁ তা তো হয়েচে। আমি ভাবলুম বুঝি আবার কেউ মারা গেল।
—রামকমল সিংগী মারা যাওয়ায় মনে বড় দাগা পেয়িচি রে। বড় দিলদার মানুষ ছেল, এমনটি আর হবে না।
—আহা হা, সে কথা আর বলতে! মহাদেব তুল্য লোক, কোনোদিন দরকষাকষি করেননি, ভালো মালের কদর বুঝতেন, যেন একটি নক্ষত্র খসে গেল!
—তা যা বলিচিস! কারুর কাচে কখনো হাত পাতেনি রামকমল সিংগী, সব সময় উপুড়হস্ত। তাতেও অগাধ সম্পত্তি রেখে গ্যাচেন।
—আর দেশের কী হালচাল বলুন, ঘোষালমশাই!
-বড় খারাপ রে, বড় খারাপ! মানী মানী লোকেরা চলে যাচ্চে, এখন যত চ্যাংড়াদের উৎপাত, জাত ধম্মো আর কিছু রইলো না, দেশটা রসাতলে যাবে এবার।
—আমাদের মহল্লাতেও এক কলেজী ছোঁকরা গত পরশু কেরেস্তান হয়েচে। এভাবে যদি ভদ্রঘরের ছেলেরা কেরেস্তান হয়ে যায়–
—আরে কেরেস্তান হবে, সেটা আশ্চর্য কিচু নয়। হাজার হোক রাজার জাত, যদি জোর করে নিজের পাতে ঝোল টানে, তাতে করার কিচু নেই। কিন্তু হিন্দুরাই যে হিন্দুদের ইয়েতে হুড়কো দিচ্চে। পিরিলি বামুনরাই দেশটার সৰ্ব্বেবানাশ করে দিলে। দ্বারকানাথ ঠাকুর বিদেশে বেঘোরে মলো, শুনলুম নাকি তেনার শবদাহ পর্যন্ত হয়নি, বিলেতে মাটির নীচে পুঁতে রেখেচে, তার ওপর দিয়ে হেঁটে চলে বেড়াচে। ভাব একবার কাণ্ডটা, অত বড় মানী লোক, মরার পর ছেলের হাতে মুখে আগুনটা পর্যন্ত পেলে না। দেবেন। ঠাকুর তো বাপের শ্ৰাদ্ধটাও করলে না।
—ছি ছি ছি ছি ছি ছি।–তারপর দেবেন। ঠাকুর এখন চ্যালাচামুণ্ডো নিয়ে চারদিকে হামলে বেড়াচ্চে, বলচে আমাদের ঠাকুর দেবতা কিচু নেই, বেদ নাকি চাঁড়ালেও শুনতে পারে!
—ছি ছি ছি ছি ছি ছি।
—বামুন-কায়েত-সুদুর গা ঘেঁষাঘেষি করে পংক্তি ভোজনে বসে।
—ছি ছি ছি ছি ছি ছি।
—আজই দুকুরে কী দেকে এলুম জানিস? পটলডাঙ্গার মোড়ে একটা ছোঁড়া, কলেজে পড়া ছোঁড়াই মনে হলো, সে বিস্কুট খাচ্চে!
–বিস্কুট কী?
—বিস্কুট জানিস না? ঐ যে একরকম আটা-ময়দা গোলা শুকিয়ে গোল গোল চাক্তি বানায়। মোছলমান আর ফিরিঙ্গিদের দোকানে বিক্কিরি হয়।
—দেকিনি কখনো!
—সাহেবের সিকনি না মেশালে সে জিনিসের তার হয় না। মোছলমান কারিগররা রোজ দু বেলা সাহেবপাড়ায় গিয়ে মদ-মাগীদের সিকনি নিয়ে আসে ডালায় করে। তারপর তা আটা-ময়দা গোলার সঙ্গে মেশায়, আরও প্যাঁজ রসুন কত কী মেশায় কে জানে, তার ওপর মোছলমানরা দাঁড়িয়ে পা দিয়ে ডলে খুব করে, তারপর তৈরি হয় বিস্কুট। সেই জিনিস হিন্দু ছেলেরা খাচ্চে! আজি দেকলুম, তিনটে ছোঁড়া এ ওকে ঠ্যালাঠেলি কচ্চে, এই তুই বিস্কুট খেতে পারবি? এক টাকা বাজি! অমনি একটা ছোঁড়া দৌড়ে গিয়ে বিস্কুট কিনে কচর মচার করে খেতে লাগলো, রাস্তার মধ্যে, সব্বার সামনে!
—ছি ছি ছি ছি ছি ছি।
—এসব কাঁদের শিক্ষা? ঐ বেহ্ম হারামজাদারাই তো শিখুচ্চে! বেহ্ম হতে গেলে শেরি আর বিস্কুট খেতে হয়। ঐ খেয়ে তারা উদ্ধার হয়ে যায়।
—বলেন কী?
দোকানের কয়েকজন কর্মচারী এই সব বাক্যালাপ গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে শুনছিল। রাইমোহন কথা থামিয়ে তাদের তাড়া লাগিয়ে বললো, বাড়ি যাও, বাপধনেরা এবার বাড়ি যাও!
তারা বেরিয়ে যাবার পর গুপী দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিয়ে এসে বললো, ঘোষালমশাই, আজ একটা অদ্ভুত মানুষ দেকলুম। অমন আমি কক্ষনো দেকিনি। মানুষ না পুতুল তা বোঝা যায় না। মনে হয় যেন পুতুলই গুড়গুড়িয়ে হাঁটে আর ওঁয়াও মৌয়াও করে কতা বলে। তাকে সাহেবদের মতন দেখতেও না। আবার হিন্দুস্থানীর সঙ্গেও মিল নেই। গায়ের রং হলদে মতন, খুব বেশী লম্বা চওড়া নয়, মাতায় আবার মস্ত বড় বেণী, সে মেয়েছেলে না ব্যাটাছেলে তাও বোজবার জো নেই।
রাইমোহন বললো, বুজিচি, ও তো চায়নম্যান। তুই আগে দেকিসনি কখনো? ওরা তো অনেক দিন থেকেই আসচে। আছু নামে একটা চায়নাম্যানের নামে অছিপুর গ্রাম হয়ে গেল। ওরা একটা চিনির কল বানিয়েচে। এখুন তো চায়নাম্যান অনেক এয়েচে এ দেশে।
—আমি কিন্তু বাপের জন্মে দেকিনি। আমার দোকানে আজ এয়েছেল লণ্ঠন বেচিতে। একটা কতাও বোঝার উপায় নেই।
-হিমালয় পর্বতের ওপাশে চীন দেশ, ওরা সেখান থেকে এয়েচে। সে দেশের মাগী মদ সব দেকতে একরকম। সব্বাইকে দোকতে একরকম, ঠিক যেন যমজ। দেশসুদ্ধ সব লোক যমজ।
—কী সব্বোনেশে দেশ রে বাবা! তা ওরা হিমালয় পাহাড় ডিঙিয়ে এলো কী করে?
—পাহাড় ডিঙিয়ে কী আর আসতে পারে? হিমালয় পাহাড় ডিঙোনো মানুষের সাধ্যি নেই, বাবা মহাদেবের চ্যালারা সে জায়গা সৰ্ব্বক্ষণ পাহারা দিচে। ওরা এয়েচে জাহাজে। রুস্তমজীদের জাহাজ চলে যে চীন দেশ পর্যন্ত। আসবে আসবে, আরও কত রকমের লোক আসে দেকবি। গুড় থাকলেই পিপড়ে ছুটে আসে। এখন কালকেতা শহরে ছড়ানো যে অনেক গুড় আর মধু। জাহাজঘাটায় দেকাগে যা কত হরেক জাতের মানুষ আর কত কিচিরমিচির ভাষা। একটা মুস্কো জোয়ান দেকলুম, তার গায়ের রং কী কালো, যেন বাদুড়ে রং মোকেচে। ওরা হলো গে কাফ্রি। তারপর দেকলুম গ্ৰীক, সে মোগল পাঠানদের চেয়েও দড় চেহারা, ওরা আসে। সেকেন্দার শার দেশ থেকে। সেকেন্দার শার নাম শুনিচিস?
–আজ্ঞে না।
—তুই এখুনো মুখুই রয়ে গেলি। আবার শুনচি নাকি রুশীরা কালকেতার ওপর হামলা করবে। একটা জিনিস দেকলুম বটে, সবাই জানতো ইংরেজ সাহেবরা কারুকে ভয় পায় না। এখুন দেকচি, ইংরেজ ব্যাটারাও রুশীদের ভয় পায়। যখন তখন রব ওঠে যে রুশীরা আসচে। কোনো আপিসে একবার রুশীদের কেউ নাম কল্পে হলো, অমনি সাহেব সুবোরা তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে। সত্যি যদি রুশীরা আক্রমণ করে, তাহলে ইংরেজরা পোঁ পোঁ করে পালাবে।
—সত্যিই আসবে নাকি রুশীরা?
—আসতেও পারে। শুনিচিতো রুশীরা মস্ত বীর। জগমোহন সরকারের বৈঠকখানায় একদিন কথা হচ্চেলে। সবচে ভালো বেরাণ্ডি তৈরি হয় যে দেশে, তার নাম ফরাসী দেশ। ফরাসী জাতের লোক দেকিচিস তো, চন্নাননগরেই রয়েচে। সে দেশে নেপো নামে একটা লোক ছেল, তার মতন বীর নাকি পৃথিবীতে আর জন্মায়নি। সেই নেপোর নাম শুনলেও ইংরেজরা ভিমি যেত, জ্যান্ত মানুষ চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো নেপো। সেই রকম বীরও রুশীদের কাচে ঘায়েল হয়ে গ্যাচে। দু লাখ না পাঁচ লাখ কত যেন সৈন্য নিয়ে নেপো গেসলো রুশীদের সঙ্গে লড়তে, সব সেখেনে মাটিপোঁতা হয়ে গেল। নেপো।একলা পালিয়ে বেঁচে ছেল।
—বাবাঃ! সেই রুশীরা আসবে? আবার যুদ্ধ হবে?
—আমরা হলুম গে। উলুখাগড়া। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হবে, তাতে তোর আমার কী? বড়জোর ইংরেজ রাজার বদলে রুশী রাজা আসবে।
—তেনারা আবার কেমন কাঁচাখেগো দ্যাবতা হবেন কে জানে!
—যখন আসবে, তখন দ্যাক যাবে। এবার কাজের কতা বলি।
—মালপত্তর কিচু এনেচেন নাকি?
ট্যাঁক থেকে একটি গেঁজে বার করলো রাইমোহন। তারপর হাস্যময় মুখে বললো, বুড়ি ঠাকুমার বাক্স প্যাটরা ঘাঁটতে ঘাঁটতে বেশ কিচু সোনাদানা পেয়ে গেলুম রে! তখুনি বুজলুম, তোরই বরাত খুললো। এসব তো তোরই ভোগে লাগবে।
গুপীও হেসে বললো, আপনার ঠাকুমার যে দেকচি অক্ষয় ধন। এর আগেও তেনার প্যাটরা ঘাঁটতে ঘাঁটতে অনেক কিচু বেরিয়েচে না?
—কত বড় বাড়ির মেয়ে ছিলেন তিনি! হাত ঘুরোলেই সোনাদানা ঝরে পড়তো। আর হাসলেই মুক্তো। সেসব ছিল তাঁর বয়েস কালে, আমি তো চক্ষে দেকিনি, শুনিচি শুধু।
রাইমোহনের গেজে থেকে বেরুল এক ছড়া হার আর দুটি আংটি।
গুপী বললো, চেনাচেনা লাগে যেন। এ হারছড়া মনে হচে যেন আমিই বানিয়েচি!
রাইমোহন কৃত্রিম ধমক দিয়ে বলে উঠলো, চোকের মাতা খেয়িচিস নাকি? আমার ঠাকমার হার তুই কী করে বানাবি রে ব্যাটা? আজকালকার মত ফিনফিনে নয়, সেকেলে জিনিস, এ সবের চেকনাই-ই আলাদা।
—যাই বলুন ঘোষালমশাই, হাতে নিলেই যেন মনে হচ্চে। এ আমার নিজের হাতের কাজ।
–এক হতে পারে, তোর ঠাকুদা বানিয়েছেল। আমার ঠাকুমার জিনিস তোর ঠাকুদা বানাবে, তাতে আশ্চয্যি কিছু নেই। সেইজন্যিই তোর চেনী চেনা লাগচে।
–সেটা একটা কতা বটে। আর এই আংটির পাতরটা, পামারস্টোন কোম্পানি বাজারে ছেড়েচে এই দু বছর।
-আরে, পামারস্টোন কোম্পানিরও তো ঠাকুন্দা-কোম্পানি ছেল, ছেল না? সে আমলে কি লোকে আংটিতে পাতর বসাতো না? নে, নে, তোর অত কতায় কাজ কী, ওজন কর, ওজন করা!
যথারীতি এই প্রকার কৌতুক ও দরকষাকষি চললো কিছুক্ষণ। দাম বেশ ভালোই পাওয়া গেছে, নগদ টাকা গুণে নিয়ে পুনরায় সেই গেজেতে ভরে ট্যাঁকে গুজলো রাইমোহন। তারপর দুজনে একই সঙ্গে বেরুলো দোকান থেকে।
গুপীর অনুরোধে রাইমোহন তার সঙ্গে চললো রামবাগানে। গুপীর ভাড়া করা রমণীটিকে সে একবার দেখে আসবে। রাইমোহন সাত ঘাটের জল খাওয়া মানুষ, তার মতামতের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।
রাতের বেলা ড়ুলি পালকি সহজে পাওয়া যায় না। এক-ঘোড়ার কেরাঞ্চি গাড়িগুলোরও এই সময় বড় গুমোর বাড়ে, খদের ডাকাডাকি করলেও সে গাড়ির গাড়োয়ানরা মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। অনেক চেষ্টায় সে রকম একটি গাড়ি যোগাড় করা গেল।
রামবাগান পাড়া সারাদিন ঘুমিয়ে থাকে, সন্ধের পরই এখানে আসল রমরমা। সব বাড়িতে বাড়িতে আলো, হারমোনিয়াম আর ঘুঙুরের সুমিষ্ট ধ্বনিতে বার্তাস মন্দির। মাঝে মাঝেই শোনা যায় রমণীদের কাংস্য বিনিন্দিত স্বরের হাস্য।
গুপী স্যাকরা যে-বাড়িতে ঢুকলো, সে বাড়ির সামনেই খোলা নর্দমার পাশে একটি মাতাল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার ঠোঁটের কাছে ভনভন্ন করছে মাছি। পথ দিয়ে লোকজন আসছে যাচ্ছে, কেউ ভ্রূক্ষেপও করছে না। ওর দিকে। গুপী আর রাইমোহনও উঠে গেল ওপরে। তিনতলায় থাকে গুপীর সেই স্ত্রীলোকটি। কিছুকাল আগেও এই স্ত্রীলোকটির নাম ছিল ছুন্নিবিবি, এখন নাম নিয়েছে পদ্মবালা। বেশ মোটাসোটা চেহারা, গুপীর সঙ্গে মানিয়েছে ভালোই।
রাইমোহন সেখানে বসে কয়েক পাত্তর ব্র্যাণ্ডি পান করলো ও পদ্মবালার দুখানি গান শুনলো। পদ্মবালার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে কালীঘাটের হাঁড়িকাঠে মাথা দেওয়া বলির পাঠার শেষ আওয়াজের অনায়াসেই তুলনা দেওয়া যায়।
রাইমোহন গান শুনতে শুনতে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। তার চলাফেরা খানদানী ঘরের বড় মানুষদের সঙ্গে, দামী দামী মেয়েমানুষ দেখা তার অভ্যোস। এই সব কুঁচি পাঁচী ধরনের বারাঙ্গনাদের সে ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। গুপী স্যাকরার হাতে অনেক কাঁচ টাকা এলেও কৃপণ স্বভাবটি তো যায়নি, সুতরাং তার নজর আর এর থেকে উঁচুতে উঠবে কী করে। তবু রাইমোহন গুপীর দিকে চোখ টিপে ইশারায় জানালো, সরেস মাল, চালিয়ে যা!
অর্ধ সমাপ্ত ব্র্যাণ্ডির বোতলটি বগলের তলায় লুকিয়ে রাইমোহন উঠে পড়লো। আর বেশীক্ষণ এখানে বসলে আরও গান শুনতে হবে, তাহলে সে মারা পড়বে। আর যাই থাক না থাক রাইমোহনের সঙ্গীত রুচি সত্যিই উঁচু।
রাইমোহন যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো, তখনও সেই মাতালটি ঠিক একইভাবে পড়ে আছে নর্দমার ধারে। মাঝে মাঝে বুবু শব্দ করছে মুখ দিয়ে। মালকোচা মারা ধুতি আর বেনিয়ান পরা, বছর পঁচিশেক বয়েস, দেখলে মনে হয়। ভদ্রঘরের মানুষ। রাইমোহন লোকটিকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। নতুন কিছু ব্যাপার নয়, এরকম রোজই দেখা যায় দু একজনকে। এদের সকলেরই ইতিহাস এক, ইয়ার বক্সি নিয়ে ফুর্তি করতে এসেছিল, টাকা কড়ি সব ফুরিয়ে যাওয়ায় সঙ্গীরা এই অবস্থায় ফেলে পালিয়েছে। যাদের নিজেদের টাকা নেই, যারা পরের পয়সায় ফুর্তি করে, তারা কিন্তু কখনো এমনভাবে চেতনা হারিয়ে পথের পাশে পড়ে থাকে না।
রাইমোহন লোকটিকে টেনে তুলবার চেষ্টা করলো। কিন্তু অজ্ঞান মানুষ যেন দ্বিগুণ ভারী হয়ে যায়। রাইমোহন তখন লোকটির গালে চাপড়া মারতে মারতে বললো, এই, এই, ওঠ ওঠ! লোকটির তবু সাড় আসে না, বুঁ বুঁ শব্দ করে। রাইমোহনের টানাটানিতে যেন বিরক্ত হয়েই সে গড়িয়ে আরও নর্দমার দিকে যেতে চাইলো।
রাইমোহনের উদ্যম দেখে ইতিমধ্যেই একটা ছোট ভিড় জমে গেল। কেউ রাইমোহনকে সাহায্য করার চেষ্টা করলো না, শহুরে মানুষের সেরকম স্বভাব হয়, বরং নানান চুটকি টিপ্পনি শোনা যেতে লাগলো। একজন বললো, বৃথা চেষ্টা মোয়াই! ও বদ-নসীবকে আপনি গঙ্গায় ভাস্যে দিন, তাও ও চোক মেলবে না।
রাইমোহন তখন মুখ কুঁকিয়ে লোকটির কানে কানে বললো, এই, আর একটু মাল খাবি? তাতেই কাজ হলো, লোকটি এক হাত উঁচু করে আঙুলগুলো গেলাস ধরার ভঙ্গিতে রেখে বললো, মাল দে। মাল দে।
রাইমোহন বোতলটি লোকটির হাতে না দিয়ে বললো, হাঁ কর!
বাধ্য ছেলের মতন সে অমনি হাঁ করলো, রাইমোহন গপগপ করে বেশ খানিকটা ব্র্যাণ্ডি ঢেলে দিল তার মুখে। দারুণ বিষম খেয়ে লোকটি সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো। তারপর কোনোক্রমে সামলে নিয়ে চোখ মেলে বললো, আমি কোথায়?
রাইমোহন লোকটির কাঁধে হাত রেখে সমেহে বললো, চলো ভায়া, আমার সঙ্গে চলো, আমি তোমায় ঘরে পৌঁছে দেবোখন।
কাঁচা ব্র্যাণ্ডির তীব্র ঝাঁঝে লোকটির চৈতন্য ফিরে এসেছে, সে উঠে দাঁড়াতে পারলো এবং রাইমোহনের গায়ে ভর দিয়ে হাঁটতেও শুরু করলো।
ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে খানিকটা হটবার পর রাইমোহন জিজ্ঞেস করলো, মশায়ের কোথায় থাকা হয়? এখন কোন দিকে যাওয়া হবে?
লোকটি জড়িত স্বরে বললো, আমি এখন আরও মাল খাবো। কিন্তু আমার তো টাকা পয়সা নেই। টাকা কে দেবে?
রাইমোহন বললো, মাল খাবে তো খাও না, আমি দিচ্চি!
লোকটি একবার বোতলটার দিকে আর একবার রাইমোহনের মুখের দিকে চাইতে লাগলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে বাওয়া, দেবদূত?
রাইমোহন বললো, দেবদূতই বটে। চেহারাখানা দেখচো না!
লোকটি বোতলাটা হাতে নিয়ে রীতিমতন বিস্ময়ের সঙ্গে বললো, খাবো? সত্যি খাবো?
–হ্যাঁ, খাও।
—দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবো, না বসে বসে?
–যা তোমার ইচ্ছে।
–আমি ভদ্দরলোকের ছেলে, আমি তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাল খাই না।
–তবে বসে বসেই খাও।
কাছেই একটি গৃহের সদরের সিঁড়িতে গিয়ে বসে পড়লো লোকটি। বোতল থেকে একটি আরামের চুমুক দিয়ে রাইমোহনের উদ্দেশ্যে বললো, এসো দাদা, তোমার পায়ের ধুলো নিই।
রাইমোহনও লোকটির পাশে বসে পড়ে বোতলটা থেকে একটু চুমুক লাগালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, নাম কী?
–হরচন্দ্র সামন্ত। ইয়ার মোস্ট ওবিভিয়েন্ট সার্ভেণ্ট। অ্যালাউ মীট টেক দি ভাস্ট অফ ইয়োর ফিট, স্যার!
—হুঁ, পেটে বিদ্যে আচে দেখচি। তা নদ্দোমার ধারে পড়ে ছিলে কেন? আমন ভাবে থাকলে শেষ রাতের দিকে কুকুর-শেয়ালে যে গায়ের মাংস খুবলে নিতো!
হরচন্দ্ৰ উদাসীনভাবে বললো, তা নিতো নিতো!
—বাড়ি কোতায়?
–বাড়ি? আমার বাড়ি নেই। কেউ নেই!
—হুঁ, আমারই মতন অবস্থা দেখচি প্ৰায়। নেকাপড়া শিকোচো, কাজকম্মো কিচু করো না?
—নাঃ! কাজ শুধু মাল খাওয়া।
—তা মাথা গোঁজবার একটা কিছু জায়গা তো আচে? কাল ছিলে কোতায়?
— রাস্তায়।
–পরশু?
–রাস্তায়।
—বুঝলুম। নাও, বোতলটা শেষ করো, তারপর চলে আমার সঙ্গে।
লোকটিকে বেশ পছন্দ হয়েছে রাইমোহনের। এই ধরনের বিবাগী, বাউণ্ডুলে ধরনের মানুষদের প্রতি তার একটা টান আছে। যারা স্বেচ্ছায় নিজের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, যারা উচ্চাকাঙ্খার বশবর্তী হয়ে অপরকে প্রবঞ্চনা করার নেশায় মাতে না, রাইমোহনের মতে, তারাই খাঁটি মানুষ। এই সব লোকের সঙ্গে সে সময় কাটাতে ভালোবাসে। এর আগেও সে রাস্তা থেকে এমন লোক কুড়িয়ে নিয়েছে।
এত রাতে আর গাড়ি পাবার আশা নেই, লোকটিকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলে রাইমোহন। হরচন্দ্ৰ মাঝে মাঝে টাল খেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলেই রাইমোহন তার কাঁধ ধরে ফেলচে। এইভাবে বৌবাজারে পৌঁছোতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল।
রাইমোহন সেই যে হীরেমণির বাড়িতে আস্তানা গেড়ে ছিল, আর সে জায়গা ছাড়েনি। বেশ কিছুকাল কঠিন রোগভোগের পর হীরেমণি আস্তে আস্তে সেরে উঠেছে, ফিরে পেয়েছে আগেকার রূপ। আবার সে পূর্ব পেশায় ফিরে গেছে। হীরেমণি যখন বাবুদের মনোরঞ্জনের জন্য ব্যস্ত থাকে, তখন রাইমোহন হীরেমণির ছেলে চন্দ্রনাথের দেখাশুনো করে।
চন্দ্রনাথকে সে যদিও দত্তক নিয়েছে কিন্তু ও ছেলে কক্ষনো তাকে বাবা বলে ডাকে না। এ ব্যাপারে হীরেমণির কঠিন নিষেধ আছে। কেন যে হীরেমণির এই জেদ, তা রাইমোহন কিছুতেই বোঝে না। হীরেমণি চন্দ্রনাথের পিতৃপরিচয়ও জানাবে না। আবার রাইমোহনকেও পিতৃত্বের অধিকার দেবে না। চন্দ্রনাথ তাকে বলে রাইদাদা।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি বেশ জমকালো চেহারার জুড়িগড়ি, মনে হয় আজ কোনো শাঁসালে খদের এসেছে। দ্বিতলের কক্ষে উজজুল আলো এবং তবলার চটাং চটং বোল।
বাড়িতে ঢুকতে যাবার আগে থেমে গেল। হরচন্দ্ৰ। কোনো রকমে চোখ খুলে সে জিজ্ঞেস করলো, এটা কার বাড়ি?
রাইমোহন বললো, তা জেনে তোমার দরকার কী? মাতা গোঁজবার একটা ঠাঁই পেলেই তো হলো? চলো—
আমি যার তার বাড়ি যাই না। তুমি আমায় নিয়ে যাচ্ছে কেনবাওয়া? তোমার মতলোবখানা —ধরে নাও, এখেনে তোমার অন্ন বাঁধা আচে। তোমার নিয়তি তোমায় টেনে এনেচে! —আগেই বলে রাকচি, আমায় চুষে ছিবড়ে করে ফেললেও আমার কাঁচ থেকে কোনো মালকড়ি বেরুবে না। আমার সব ফিনিস!
—সে তোমায় দেকেই বুঝিচি!
—তবু তুমি আমায় থাকতে দেবে? শুতে দেবে! খেতেও দেবে? তুমি দেকচি স্বাগ্যো থেকে নেমে এলে!
হরচন্দ্রকে টানতে টানতে ভেতরে এনে রাইমোহন তাকে একতলার সিঁড়ির নীচের ঘরটায় বসালে। এ ঘরটা খালিই পড়েছিল, রাইমোহন সাফ সুতরো করে নিয়েছে। হীরেমণির কাছে যেসব সন্ধ্যেবেলা বাবুরা আসে, সেই সময় রাইমোহন এই ঘরে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে। সাধারণত বাবুরা সুন্দরী বারাঙ্গনার কাছে এসে পরপুরুষের মুখ দেখা পছন্দ করে না।
তক্তপোশের ওপর হরচন্দ্রকে বসিয়ে রাইমোহন বললো, শুয়ে পড়ো ভায়া। যদি খাবার-দাবার খেতে চাও, তাও দোবো। শুধু একটা কতা, এখানে টু শব্দ করা চলবে না।
হরচন্দ্রর চৈতন্য আবার লোপ পাবার পথে। সে কোনোক্রমে বললো, আরও মদ খাবো।
রাইমোহন বললে, বেশ তো, খাবেখন। এখন এক ঘুম ঘুমিয়ে নাও!
ওপরতলায় হীরেমণি গান ধরেছে। রাইমোহন উৎকৰ্ণ হলো। স্পষ্ট খুশীর ছায়া পড়লো তার মুখমণ্ডলে। রাইমোহনেরই রচিত গান গাইছে হীরেমণি, বড় সুন্দর তার কণ্ঠস্বর, নিখুঁত তার পরিবেশনা।
গানের জন্য শহরে বেশ নাম কাটছে হীরেমণির। এখন অনেকে তাকে হীরেমণির বদলে অন্য একটা নাম দিয়েছে। ভারী মানানসই নাম, হীরা বুলবুল।