২৪. গাযওয়ায়ে বদরে কুবরা- ইসলামের প্রথম ফায়সালাকারী যুদ্ধ

যুদ্ধের কারণ (سَبَبُ الْغَزْوَةِ):

গাযওয়ায়ে উশায়রার আলোচনায় এটা উল্লেখিত হয়েছে যে, একটি কুরাইশ কাফেলা মক্কা হতে সিরিয়া যাওয়ার পথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র পাকড়াও হতে বেঁচে গিয়েছিল। এ কাফেলাটি যখন সিরিয়া থেকে মক্কায় ফিরে যাচ্ছিল তখন নাবী কারীম (ﷺ) ত্বালহাহ ইবনু উবাইদিল্লাহ (রাঃ) এবং সাইদ ইবনু যায়দ (রাঃ)-কে তাদের অবস্থা ও অবস্থানের প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য উত্তর দিকে প্রেরণ করেন। এ সাহাবীদ্বয় (রাঃ) ‘হাওরা’ নামক স্থান পর্যন্ত গমন করেন এবং সেখানে অপেক্ষমান থাকেন। আবূ সুফইয়ান যখন কাফেলাটি নিয়ে ঐ স্থানটি অতিক্রম করছিলেন তখন সাহবীদ্বয় অত্যন্ত দ্রুত গতিতে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বিষয়টি অবহিত করেন।

এ কাফেলায় মক্কাবাসীদের প্রচুর ধন-সম্পদ ছিল। এক হাজার উট ছিল এবং এ উটগুলো কম পক্ষে পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা মূল্যের মালপত্র বহন করছিল। শুধুমাত্র এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাফেলার সঙ্গে চল্লিশ জন কর্মী ছিল।

মদীনাবাসীদের ধনদৌলত লাভের জন্য এটা ছিল অপূর্ব এক সুযোগ। পক্ষান্তরে এ বিশাল পরিমাণ ধনমাল থেকে বঞ্চিত হওয়ার ব্যাপারটি ছিল মক্কাবাসীদের জন্য সামরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট ক্ষতি। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিমদের মধ্যে ঘোষণা করে দিলেন যে, ‘সিরিয়া থেকে মক্কা প্রত্যাবর্তনকারী এক কুরাইশ কাফেলার সঙ্গে প্রচুর ধনমাল রয়েছে। সুতরাং তোমরা এর জন্য বেরিয়ে পড়। হয়ত আল্লাহ পাক গণীমত হিসেবে এ সকল মালপত্র তোমাদের হাতে দিয়ে দিবেন।

কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ উদ্দেশ্যে গমন কারো উপর জরুরী বলে উল্লেখ করেননি। বরং এটাকে তিনি জনগণের ইচ্ছা এবং আগ্রহের উপর ছেড়ে দেন। কেননা এ ঘোষণার সময় এটা মোটেই ধারণা করা হয়নি যে, এ কাফেলার সঙ্গে যুঝাযুঝির পরিবর্তে শক্তিশালী কুরাইশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে বদর প্রান্তরে ভয়াবহ এক রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষের মোকাবেলা করতে হবে। আর এ কারণেই বহু সাহাবী মদীনাতেই রয়ে গিয়েছিলেন। তাদের অভিযানগুলোর মতই সাধারণ একটা কিছু হবে। আর এ কারণেই যারা এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেননি তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও উত্থাপিত হয় নি।

 মুসলিম সৈন্যসংখ্যা ও তাঁদের নেতৃত্বের বিন্যাস (مَبْلَغُ قُوَّةِ الْجَيْشِ الْإِسْلَامِيْ وَتَوْزِيْعُ الْقِيَادَاتِ ):

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বদর অভিযানে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তাঁর সঙ্গী হলেন তিন শতাধিক সাহাবী (রাঃ)। তিন শতাধিক বলতে সে সংখ্যাটি হতে পারে ৩১৩, ৩১৪ কিংবা ৩১৭ যাদের মধ্যে ৮২, ৮৩ কিংবা ৮৬ জন ছিলেন মহাজির এবং অন্যেরা ছিলেন আনসার। আনসারদের মধ্যে আবার ৬১ জন ছিলেন আউস গোত্রের এবং ১৭০ জন ছিলেন খাযরাজ গোত্রের লোক। যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীর যে প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন এ রকম কোন প্রস্তুতিই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাহিনীর ছিল না। এমন কি যুদ্ধ প্রস্তুতির কোন ব্যবস্থাও ছিল না। তিন শতাধিক লোক বিশিষ্ট এ বাহিনীর জন্য মাত্র দুটি ঘোড়া ছিল। যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ)-এর ছিল একটি এবং মিক্বদাদ ইবনু আসওয়াদ কিনদী (রাঃ)-এর ছিল অপরটি। উট ছিল সত্তরটি, এক এক উটের উপর পালাক্রমে আরোহণ করতেন দুই কিংবা তিন জন লোক। রাসূলুল্লাহ (ﷺ), আলী (রাঃ) এবং মারসাদ ইবনু আবী মারসাদ গানাভী (রাঃ)-এর জন্য বরাদ্দ ছিল একটি উট। তাঁরা তিন জন পালাক্রমে আরোহণ করতেন সেই উটটির উপর।

মদীনায় ব্যবস্থাপনা ও সালাতে ইমামত করার দায়িত্ব প্রথমে অর্পণ করা হয়েছিল ইবনু উম্মু মাকতুম (রাঃ)-এর উপর। কিন্তু ‘রাওহা’ নামক স্থানে পৌঁছার পর নাবী কারীম (রাঃ) আবূ লুবাবাহ ইবনু আবদিল মুনযির (রাঃ)-কে মদীনার ব্যবস্থাপক নিযুক্ত করে পাঠিয়ে দেন।

এরপর আসে যুদ্ধ পূর্ব অবস্থার কথা। সার্বিক নেতৃত্বের পতাকা প্রদান করা হয় মুস’আব ইবনু ‘উমায়ের (রাঃ)-কে। এ পতাকার রঙ ছিল সাদা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিম বাহিনীকে দুটি দলে বিভক্ত করেন :

১। মুহাজিরদের সমন্বয়ে গঠিত যার পতাকা দেয়া হয় আলী ইবনু আবী (রাঃ) তালেবকে। যাকে ইক্বাব বলা হয়।

২। আনসারদের সমন্বয়ে গঠিত যার পতাকা দেয়া হয় সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ)-কে। এ দুটি পতাকা ছিল কালো বর্ণের।

সেনাবাহিনীর ডান দিকের দলপতি নিযুক্ত করা হয় যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ)-কে এবং বাম দিকের দলপতি নিযুক্ত করা হয় মিক্বদাদ ইবনু ‘আমর (রাঃ)-কে। কারণ, সমগ্র সেনাবাহিনীর মধ্যে মাত্র এ দুজনই ছিলেন অশ্বারোহী। সেনাবাহিনীর পশ্চাদ্ভাগের দলপতি নিযুক্ত হন ক্বায়স ইবনু আবী সা’সা’আহ (রাঃ) আর প্রধান সেনাপতি হিসেবে সমগ্র বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তম প্রস্তুতিবিহীন সেনাবাহিনী নিয়েই অগ্রযাত্রা শুরু করেন। তাঁর বাহিনী মদীনার মুখ হতে বের হয়ে মক্কাগামী সাধারণ রাজপথ ধরে চলতে থাকেন এবং ‘বি’রে রাওহা’ গিয়ে পৌঁছেন। অতঃপর সেখান থেকে অগ্রসর হয়ে বাম দিকে মক্কাগমী রাজপথ ছেড়ে দেন এবং ডান দিকের পথ ধরে চলতে থাকেন। চলার এক পর্যায়ে ‘নাযিয়াহ’ নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছেন (গন্তব্য স্থল ছিল বদর)। তারপর নাযিয়ার এক প্রান্ত দিয়ে অগ্রসর হয়ে ‘রাহকান’ উপত্যকা অতিক্রম করেন। এটা হচ্ছে ‘নাযিয়াহ’ ও ‘দাররার’ মাঝে একটি উপত্যকা দিয়ে গমণ করেন। তারপর ‘দাররাহ’ থেকে নেমে সাফরার নিকট গিয়ে পৌঁছেন। সেখান হতে ‘জুহাইনা’ গোত্রের দুজন লোককে যথা বাবীস ইবনু উমার ও আদী ইবনু আবী যাগবাকে কুরাইশ কাফেলার অবস্থা ও অবস্থান লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যে বদর অভিমুখে প্রেরণ করা হয়।

 মক্কায় বিপদের ঘোষণা (النَّذِيْرُ فِيْ مَكَّةَ):

পক্ষান্তরে কুরাইশ কাফেলার অবস্থা এই ছিল যে, এর নেতা আবূ সুফইয়ান ছিলেন সুচতুর সতর্ক এবং অত্যন্ত সচেতন ব্যক্তি। এ প্রেক্ষিতে তিনি অব্যাহতভাবে পথের খবরাখবর নিতেই থাকতেন। পথে যে কাফেলার সঙ্গেই সাক্ষাৎ হতো তাদের সকলকেই তিনি পথের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। সুতরাং বিভিন্ন সূত্রে তিনি অবগত হতে সক্ষম হন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর সাহাবীদেরকে কাফেলার উপর আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন। তাই তৎক্ষণাৎ তিনি যমযম ইবনু ‘আমর গিফারীকে কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কা পাঠিয়ে দেন এবং তার মাধ্যমে এ মর্মে সংবাদ প্রেরণ করেন যে, ‘কাফেলা ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন, হিফাযতের জন্য সাহায্যের আশু প্রয়োজন।’ যমযম অত্যন্ত দ্রুত গতিতে মক্কায় আসে এবং আরব সমাজের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নিজের উটের নাক চাপড়ালো, হাওদা উলটালো, জামা ছিঁড়ে ফেলল, মক্কা উপত্যাকায় উটের উপর দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকল, ‘হে কুরাইশগণ! কাফেলা (আক্রান্ত কাফেলা, আক্রান্ত আবূ সুফইয়ানের সঙ্গে তোমাদের ধনমাল রয়েছে, তার উপর আক্রমণ চালানোর জন্য মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং তার সাহাবীরা উদ্যত হয়েছেন। সুতরাং আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা যে, তোমরা তা পাবে। অতএব, সাহায্যের জন্য এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো।’)

 মক্কাবাসীগণের যুদ্ধ প্রস্তুতি (أَهْلُ مَكَّةَ يَتَجَهَّزُوْنَ لِلْغَزْوِ):

কাফেলা আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ শ্রবণে সমগ্র মক্কা উপত্যকায় একদম হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। চতুর্দিক থেকে সকলে দৌঁড়ে এসে বলতে থাকল, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং তার সঙ্গী সাথীরা কি মনে করেছে যে, এ কাফেলাও ইবনু হাযরামীর কাফেলার মতই? না, না, কখনই না। আল্লাহর শপথ! এ কখনই সেরূপ নয়। শীঘ্রই তারা জানতে পারবে যে, আমাদের ব্যাপারটি অন্য রকম।’

সমগ্র মক্কা শহরে তখন দু’শ্রেণীর লোক চোখে পড়ছিল। এক শ্রেণীর লোক যুদ্ধ প্রস্তুতি সহকারে যুদ্ধ গমন করছিল এবং অন্যদল নিজের পরিবর্তে অন্যকে যুদ্ধে প্রেরণ করছিল। আর এভাবে প্রায় সবাই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। বিশেষ করে মক্কার সম্মানিত ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ কেউই পিছনে ছিলেন না। শুধু আবূ লাহাব নিজে না এসে তার একজন ঋণী ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন। আশে-পাশে অন্যান্য আরব গোত্রগুলোকেও তারা দিজেদের দলভুক্ত করে নিল। কুরাইশ গোত্রসমূহের মধ্যে একমাত্র বনু আদী ছাড়া আর কোন গোত্রই পিছনে রইল না। বনু আদী গোত্রের কোন লোকই এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করল না।

 মক্কা সেনাবাহিনীর সংখ্যা (قَوَامُ الْجَيْشِ الْمَكِّيْ):

প্রথমাবস্থায় মক্কা বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল তের শত। তাদের কাছে ছিল একশ ঘোড়া এবং ছয়শ লৌহবর্ম। উটের সংখ্য এত বেশী ছিল যে, তার কোন হিসাব কিতাবই ছিল না। সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিল আবূ জাহল ইবনু হিশাম। এ বাহিনীর রসদ পত্রের দায়িত্বে ছিল নয় জন সম্ভ্রান্ত কুরাইশ। কোন দিন নয়টি এবং কোন দিন দশটি এভাবে প্রতিদিন উট জবেহ করা হতো।

 বনু বাকর গোত্রের সমস্যা (مُشْكِلَةُ قَبَائِلِ بَنِيْ بَكِر):

সর্বাত্মক প্রস্তুতি সহকারে মক্কা সেনাবাহিনী যখন অগ্রগমনে উদ্যত এমতাবস্থায় কুরাইশদের মনে পড়ে গেল বনু বাকর গোত্রের কথা। বনু বাকর গোত্রের সঙ্গে তখন তারা ছিল যুদ্ধরত। এ কারণে তাদের আশঙ্কা হল যে, হয়ত বনু বাকর পিছনে থেকে তাদের আক্রমণ করবে এবং ফলে দুই জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের মধ্যে তাদের নিপতিত হতে হবে। এ ধারণা তাদেরকে যুদ্ধের সংকল্প থেকে বিরত রাখার মতো মানসিক পরিবেশ সৃষ্টি করল। কিন্তু এমন সময়ে অভিশপ্ত ইবলীস শয়তান বনু কিনানাহ গোত্রের নেতা সুরাক্বাহ ইবনু মালিক ইবনু জু’শুম মুদলিজীর রূপ ধরে প্রকাশিত হল এবং বলল, ‘আমিও তোমাদের বন্ধু এবং আমি তোমাদের নিকট এ বিষয়ের জামিন হচ্ছি যে, বনু কিনানাহ তোমাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে না কিংবা কোন অশোভনীয় কাজও করবে না।’

 মক্কা সেনাবাহিনীর যুদ্ধযাত্রা (جيش مكة يتحرك):

সুরাক্বাহ ইবনু মালিকরূপী অভিশপ্ত ইবলীস শয়তান বনু কিনানাহর ব্যাপারে জামিন হওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করায় কুরাইশগণ আশঙ্কামুক্ত হয়ে মক্কা থেকে বেরিয়ে পড়ল। আল্লাহ তা‘আলা যেমনটি বলেন,

‏(‏بَطَرًا وَرِئَاء النَّاسِ وَيَصُدُّوْنَ عَن سَبِيْلِ اللهِ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏47‏]‏

‘‘তারা শক্তিমত্তায় গর্বিত হয়ে জনগণকে (নিজেদের শক্তিমত্তা) দেখাতে দেখাতে আল্লাহর পথে বিঘ্ন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নিজেদের গৃহ হতে বহির্গত হলো।’ (আল-আনফাল ৮ : ৪৭)

আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যেমনটি বলেছেন, ‘নিজেদের ক্ষুরধার অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর নিকটে অপমানিত হয়ে প্রতিশোধ নেয়ার ও আত্ম-অহমিকার নেশায় উন্মত্ত হয়ে এ বলে যুদ্ধে বেরিয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাথীগণ মক্কাবাসীগণের ব্যবসায়ী দলের উপর চক্ষুত্তোলনের হিম্মত পেল কোথায় থেকে?’

মক্কা বাহিনী খুব দ্রুত গতিতে উত্তর মুখে বদর প্রান্তরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। অগ্রযাত্রার এক পর্যায়ে তারা উসফান ও কুদায়েদ উপত্যকা অতিক্রম করে যখন জুহফা নামক স্থানে উপস্থিত হল তখন আবূ সুফইয়ানের লোক এসে সংবাদ দিল যে, ‘কাফেলা নিরাপদে চলে এসেছে সুতরাং সামনে আর অগ্রসর না হয়ে এখন ফিরে যাওয়ার পালা।’

 কাফেলার নিরাপদ অগ্রযাত্রা (العِيْرُ تَفَلَّت):

আবূ সুফইয়ানের কাফেলার নিরাপদে অগ্রযাত্রার বিস্তারিত বিবরণ হচ্ছে এ কাফেলা সিরিয়া হতে রাজপথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিল বটে, কিন্তু আবূ সুফইয়ান অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করে চলছিলেন। পথ চলার বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি ক্রমাগত খবরাখবর নিতেই থাকছিলেন। বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী হয়ে তিনি কাফেলাকে থামালেন এবং নিজেই সম্মুখে অগ্রসর হয়ে মাজদী ইবনু আমরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে মদীনার সেনাবাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। মাজদী বলল, ‘এ রকম কোন সেনাবাহিনী তো আমি দেখিনি, তবে দু’জন উটারোহীকে দেখেছি যারা টিলার পাশে তাদের উটকে বসিয়ে নিজেদের মশকে পানি ভর্তি করে নিয়ে চলে গেছে।’

এ কথা শুনেই আবূ সুফইয়ান অত্যন্ত দ্রুতবেগে অগ্রসর হয়ে সেই স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন এবং তাদের উটের গোবর ভেঙ্গে দেখলেন। তখন ঐ গোবরের মধ্যে থেকে খেজুরের আঁটি বেরিয়ে পড়ল। এ দেখে তিনি বলে উঠলেন আল্লাহর কসম! এটা হচ্ছে ইয়াসরিবেরই (মদীনার) খেজুরের আঁটি। তারপর তিনি দ্রুতগতিতে কাফেলার কাছে ফিরে গেলেন এবং তাদেরকে পশ্চিম দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। বদর অভিমুখী পথ বাম দিকে ছেড়ে দিয়ে কাফেলাকে উপকূল অভিমুখে অগ্রসর হতে বললেন। এভাবে কাফেলাকে তিনি মদীনা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করলেন। একই সঙ্গে মক্কা বাহিনীর নিকট কাফেলার নিরাপদ থাকার সংবাদ পাঠিয়ে বাহিনীকে মক্কায় ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। জুহফাহ’তে অবস্থানকালে মক্কা বাহিনী এ সংবাদ পেয়েছিল।

 মক্কায় প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে মক্কা বাহিনীর মধ্যে মতভেদ (هَمُّ الْجَيْشِ الْمَكِّيْ بِالرُّجُوْعِ، وَوُقُوْعُ الْاِنْشِقَاقِ فِيْهِ ):

আবূ সুফইয়ানের পয়গাম প্রাপ্ত হয়ে মক্কা বাহিনীর প্রায় সকল সদস্যই মক্কায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করল। কিন্তু কুরাইশ নেতা ও মক্কা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আবূ জাহল অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমরা এখান থেকে ফিরে যাব না। বরং আমরা বদর যাব, সেখানে তিন দিন অবস্থান করব এবং এ তিন দিন যাবৎ উট জবেহ করব, পানভোজন ও আমোদ আহ্লাদ করব। এর ফলে সমগ্র আরব জাতি আমাদের শক্তি সামর্থ্যের কথা অবগত হবে, আর এভাবে চিরদিনের জন্য তাদের উপর আমাদের প্রভাব প্রতিফলিত হবে।

আবূ জাহলের এ কথার পরেও আখনাস ইবনু শুরায়েক ফিরে যাবারই পরামর্শ দিল। কিন্তু অধিক সংখ্যক লোকই তার কথায় কান দিল না। তাই, সে বনু যুহরার লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে মক্কায় ফিরে গেল। কেননা, সে ছিল বনু যুহরা গোত্রের মিত্র এবং বাহিনীতে সে ছিল তাদের নেতা। তাদের কোন লোকই বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে নি। পরবর্তীতে বনু যুহরা গোত্রের লোকেরা আখনাস ইবনু শুরায়েকের এ সিদ্ধান্তের কারণে খুব আনন্দ প্রকাশ করেছিল এবং তাদের অন্তরে তার প্রতি শ্রদ্ধা চিরদিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের সংখ্যা ছিল তিন শত।

বনু যুহরার মতো বনু হাশিমও মক্কায় ফিরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আবূ জাহল অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করায় তাদের পক্ষে মক্কায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হল না। সে কঠোর কণ্ঠে বলল, আমরা ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত এ দলটি আমাদের থেকে পৃথক হতে পারবে না। মোট কথা, ঐ বাহিনী তাদের সফরসূচী বহাল রাখল। বনু যুহরা গোত্রের লোকজনদের মক্কা প্রত্যাবর্তনের ফলে তাদের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজারে এবং তারা ছিল বদর অভিমুখী। বদরের নিকটবর্তী হয়ে তারা একটি টিলার পিছনে শিবির স্থাপন করে। এ টিলাটি বদর উপত্যকার সীমান্তের উপর দক্ষিণমুখে অবস্থিত।

 মুসলিম বাহিনীর স্পর্শকাতর অবস্থা (مَوْقِفُ الْجَيْشِ الْإِسْلَامِيْ فِيْ ضَيْقٍ وَحُرْجٍ ):

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পথিমধ্যেই ছিলেন এমতাবস্থায় তিনি আবূ সুফইয়ানের বাণিজ্য কাফেলা এবং মক্কা সেনাবাহিনী সম্পর্কে অবহিত হন। উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আসন্নপ্রায় সমস্যাটির খুটিনাটি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনার পর তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, এখন একটি রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সুতরাং এখন এমনভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন যে দুর্দমনীয় সাহস, বীরত্ব এবং নির্ভীকতার উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কারণ, এটা নিশ্চিত সত্য যে, মক্কা বাহিনীকে যদি এ এলাকায় যথেচ্ছ চলতে ফিরতে দেয়া হয় তাহলে তাদের সামরিক মর্যাদা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়ে যাবে এবং রাজনৈতিক প্রাধান্য বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়বে। পক্ষান্তরে এর ফলে মুসলিমদের শক্তি হ্রাস পাবে এবং আঞ্চলিক সুযোগ সুবিধাও সীমিত হয়ে পড়বে। এর ফলশ্রুতিতে ইসলামী দাওয়াতকে একটি নিষ্প্রাণ আদর্শ মনে করে যাদের অন্তরে ইসলামের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা রয়েছে এরূপ প্রত্যেক লোক ইসলামের ক্ষতি সাধনে উঠে পড়ে লেগে যাবে। এ ছাড়াও মক্কা বাহিনীর মদীনার দিকে অগ্রসর হয়ে এ যুদ্ধকে মদীনার চার প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে মুসলিমগণকে যে তাদের আবাসস্থানেই ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সাহস ও চেষ্টা করবে না তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। ‘জী হ্যাঁ’ মুসলিম সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যদি সামান্য পরিমাণও অবহেলা, আলস্য কিংবা কাপুরুষত্ব প্রদর্শিত হতো তাহলে এ সবের যথেষ্ট সম্ভাবনা ও আশঙ্কা ছিল। আর যদি এরূপ নাও হতো তাহলেও মুসলিমদের সামরিক প্রভাব প্রতিপত্তি এবং সুখ্যাতির উপর যে এ সবের একটি মন্দ ও প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হতো তাতে কোনই সন্দেহ নেই।

পরামর্শ সভার বৈঠক (المَجْلِسُ الْاِسْتِشَارِيْ ):

অবস্থার এ আকস্মিক ভয়াবহ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উচ্চ পর্যায়ের এক সামরিক পরামর্শ সভার আয়োজন করলেন। এ সভায় তিনি বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে নেতৃস্থানীয় ও সাধারণ সৈনিকদের সঙ্গে মত বিনিময় করলেন। অবস্থার এ আকস্মিক মোড় পরিবর্তনের ফলে আসন্ন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কথা অবগত হয়ে একটি দলের হৃৎকম্প উপস্থিত হল। এ দলটি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করলেন,

‏(‏كَمَا أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِن بَيْتِكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ فَرِيْقاً مِّنَ الْمُؤْمِنِيْنَ لَكَارِهُوْنَ يُجَادِلُوْنَكَ فِي الْحَقِّ بَعْدَمَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُوْنَ إِلَى الْمَوْتِ وَهُمْ يَنظُرُوْنَ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏5، 6‏]‏

‘(তারা যেমন প্রকৃত মু’মিন) ঠিক তেমনি প্রকৃতভাবেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে তোমার ঘর হতে বের করে এনেছিলেন যদিও মু’মিনদের একদল তা পছন্দ করে নি। ৬. সত্য স্পষ্ট করে দেয়ার পরও তারা তোমার সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছিল, (তাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল) তারা যেন চেয়ে চেয়ে দেখছিল যে, তাদেরকে মৃত্যুর দিকে তাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে।’ (আল-আনফাল ৮ : ৫-৬)

কিন্তু সামরিক বাহিনীর নেতৃস্থানীয় লোকদের মধ্য থেকে আবূ বাকর (রাঃ) উঠে দাঁড়ালেন এবং অতি চমৎকার কথা বললেন। তারপর উমার (রাঃ) উঠে দাঁড়িয়ে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে যে পথ প্রদর্শন করেছেন সে পথে আপনি চলতে থাকুন। আমরা সর্বাবস্থায় আপনার সঙ্গে রয়েছি। আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে ঐ কথা বলব না, যে কথা ইসরাঈল মুসা (আঃ)-কে বলেছিল তা হলঃ

‏(‏فَاذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلا إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ‏)‏ ‏[‏المائدة‏:‏24]‏

‘‘কাজেই তুমি আর তোমার প্রতিপালক যাও আর যুদ্ধ কর, আমরা এখানেই বসে রইলাম।’ (আল-মায়িদাহ ৫ : ২৪)

কিন্তু আমাদের ব্যাপার ভিন্ন। আমরা বরং বলব, ‘আপনি ও আপনার প্রভু যুদ্ধ করুন, আমরা সর্বাবস্থায় আপনাদের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করব। যিনি আপনাকে এক মহা সত্য প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! যদি আপনি আমাদেরকে বারকে গিমাদ পর্যন্ত নিয়ে যান তবুও আমরা পথরোধকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আপনার সঙ্গে সেখানেও গমন করব।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের সম্পর্কে উত্তম কথা বললেন, এবং তাদের জন্য দুআ করলেন। এ তিনজন নেতাই ছিলেন মুহাজির। সেনাবাহিনীতে আনসারদের তুলনায় মুহাজির সৈন্যের সংখ্যা ছিল অনেক কম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আনসারদেরও মতামত জানার প্রয়োজন বোধ করলেন। কেননা, সেনাবাহিনীতে সংখ্যায় তাঁরাই ছিলেন অধিক এবং যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনের চাপও ছিল প্রকৃতপক্ষে তাঁদের উপরেই বেশী। অবশ্য, ‘আক্বাবাহ’র বাইআতের স্বীকৃতি মোতাবেক মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করা তাদের জন্য অপরিহার্য ছিল না। এ প্রেক্ষিতে তিনি উপর্যুক্ত তিন মহান নেতার বক্তব্য শোনার পর পুনরায় বললেন, উপস্থিত ভ্রাতৃবৃন্দ! বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের করণীয় সম্পর্কে তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও।’

আনসারদের উদ্দেশ্যেই তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন। আনসার অধিনায়ক ও পতাকাবাহক সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এ কথার প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! মনে হয় আপনি আমাদের মতামতই জানতে চাচ্ছেন।’

প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘হ্যাঁ’’।

তখন তিনি বললেন, ‘আমরা তো আপনার উপর ঈমান এনেছি, আপনার সত্যতা স্বীকার করেছি এবং এ সাক্ষ্য দিয়েছি যে, আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন সবই সত্য এবং ওগুলো শোনা ও মান্য করার পর আমরা আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। সুতরাং হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আপনি যা ইচ্ছা করেছেন তা পূরণার্থে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে যান। যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তার শপথ! আপনি আদেশ করলে আমরা উত্তাল সাগরেও ঝাঁপ দিতে পারি। জগতের দুর্গমতম স্থানকেও পদদলিত করতে পারি, ইনশাআল্লাহ! আমাদের একজন লোকও পিছনে থাকবে না। যু্দ্ধ বিগ্রহে আপনি আমাদের প্রত্যক্ষ করবেন সাহসী ও নির্ভীক বীর পুরুষের ভূমিকায়। সম্ভবতঃ আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে আমাদের মাঝে এমন নৈপুণ্য প্রদর্শন করাবেন যা প্রত্যক্ষ করে আপনার চক্ষুদ্বয় শীতল হয়ে যাবে। সুতরাং যেখানে ইচ্ছা আপনি আমাদেরকে নিয়ে চলুন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের কাজেকর্মে বরকত দান করুন।’

অন্য এক রেওয়ায়াতে আছে যে, সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আরয করেন, ‘আপনি হয়ত আশঙ্কা করছেন যে, আনসারগণ তাঁদের শহরে থেকেই শুধু আপনাকে সাহায্য করা কর্তব্য মনে করছেন। এ কারণে আমি তাদের পক্ষ থেকে বলছি এবং তাঁদের পক্ষ থেকেই উত্তর দিচ্ছি যে, আপনার যেখানে ইচ্ছা হয় চলুন, যার সঙ্গে ইচ্ছে সম্পর্ক ঠিক রাখুন এবং যার সঙ্গে ইচ্ছা সম্পর্ক ছিন্ন করুন। আমাদের ধন-সম্পদ হতে যে পরিমাণ ইচ্ছা গ্রহণ করুন এবং যা ইচ্ছে ছেড়ে দিন। তবে যেটুকু আপনি গ্রহণ করবেন তা আমাদের নিকট যেটুকু ছেড়ে দেবেন তার চাইতে অধিক পছন্দনীয় হবে। আর এ ব্যাপারে আপনি যে ফায়সালাই করবেন, আমাদের ফায়সালা তারই অনুসারী হবে। আল্লাহর কসম! আপনি যদি অগ্রসর হয়ে বারকে গিমাদ পর্যন্ত চলে যান তাহলেও আমরা আপনার সঙ্গেই যাব। আর যদি আপনি আমাদের নিয়ে ঐ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে চান তবে আমরাও এতে ঝাঁপিয়ে পড়ব।’

সা’দের এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চেহারা মুবারক আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন,

‏‏(‏سِيْرُوْا وَأَبْشِرُوْا، فَإِنَّ اللهَ تَعَالٰى قَدْ وَعَدَنِىْ إِحْدٰى الطَّائِفَتَيْنِ، وَاللهِ لَكَأَنِّيْ الْآنَ أَنْظُرُ إِلٰى مَصَارِعِ الْقَوْمِ‏)‏‏.‏

‘‘চলো এবং আনন্দিত চিত্তে চলো। আল্লাহ আমার সঙ্গে দুটি দলের মধ্য হতে একটির ওয়াদা করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি যেন এসময় (কাফির) সম্প্রদায়ের বধ্যভূমি দেখতে পাচ্ছি।

 মুসলিম বাহিনীর পরবর্তী অগ্রযাত্রা (الْجَيْشُ الْإِسْلَامِيْ يُوَاصِلُ سِيرَهُ):

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যাফরান হতে সামনে অগ্রসর হন এবং কয়েকটি পাহাড়ী মোড় অতিক্রম করেন যেগুলোকে আসাফির বলা হয়। সেখান থেকে আরও অগ্রসর হয়ে ‘দাব্বাহ’ নামক এক জনপদে অবতরণ করেন। তারপর ‘হিনান’ নামক পাহাড়কে ডান দিকে ছেড়ে দিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে বদরের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করেন।

 তথ্যানুসন্ধানের চেষ্টা (الرَّسُوْلُ ﷺ يَقُوْمُ بِعَمَلِيَةِ الْاِسْتِكْشَافِ):

এখানে পৌঁছেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার ‘সওর’ গুহার সঙ্গী ও সব চাইতে ঘনিষ্ট বন্ধু আবূ বাকর (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে শত্রু বাহিনীর সন্ধান নেয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। দুর হতে তাঁরা মক্কা বাহিনীর শিবির এবং অবস্থান সম্পর্কে সমীক্ষারত ছিলেন। এমন সময় একজন বৃদ্ধ আরবকে তাঁরা পেয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ বৃদ্ধকে কুরাইশ বাহিনী এবং মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সাহাবীদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। দু’বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্দেশ্য ছিল যেন সে তাঁকে চিনতে না পারে। বৃদ্ধ বললেন, ‘আপনারা কোন কওমের সম্পর্কযুক্ত তা না জানালে আমি কিছুই বলব না।’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন ঠিক আছে, ‘আপনি বলে দিলে আমরাও বলে দিব।’

সে বলল, ‘এটা ওটার বিনিমিয় তো?’

তিনি উত্তর দিলেন ‘হ্যাঁ’।

সে তখন বলল, ‘আমি জানতে পেরেছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং তাঁর সঙ্গীরা অমুক দিন মদীনা থেকে বের হয়েছেন। সংবাদ দাতা, আমাকে সঠিক বলে থাকলে আজ তারা অমুক জায়গায় রয়েছেন।

সে ঠিক ঐ জায়গাটিরই নাম ঠিকানা বলে দিল যেখানে ঐ সময় মুসলিম বাহিনী অবস্থান করছিলেন।

তারপর সে বলল, আমি এটাও অবগত হয়েছিল যে, কুরাইশ বাহিনী অমুক দিন মক্কা থেকে বের হয়েছে সংবাদ দাতা আমাকে সঠিক সংবাদ বলে থাকলে তারা আজ অমুক জায়গায় অবস্থান করছে।’

সে ঠিক ঐ জায়গারই নাম বলল, যেখানে ঐ সময় কুরাইশ বাহিনী অবস্থান করছিল।

বৃদ্ধ নিজের কথা শেষ করে বলল, ‘আচ্ছা তবে এখন বলুন, আপনারা কোন সম্প্রদায়ভুক্ত।’

উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘আমরা এক পানি হতেই (উদ্ভূত)।’

এ কথা বলেই তিনি ফিরে চললেন। আর বৃদ্ধ বক্ বক্ করতেই থাকল, কোন্ পানি হতে? ইরাকের পানি হতে কি?

 মক্কা বাহিনী সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যলাভ (الُحصُوْلُ عَلٰى أَهَمِّ الْمَعْلُوْمَاتِ عَنْ الْجَيْشِ الْمَكِّيْ):

ঐ দিনই সন্ধ্যায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শত্রুদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য নতুনভাবে এক গোয়েন্দা বাহিনী গঠন করেন। এ বাহিনীর ব্যবস্থাপনার জন্য আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রাঃ), যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ) এবং সা‘দ ইবনু ওয়াক্কাস (রাঃ)-কে প্রেরণ করেন। এ গোয়েন্দা বাহিনী সরাসরি বদরের প্রস্রবণে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানে দুজন গোলাম মক্কা বাহিনীর জন্য পানির পাত্র পূর্ণ করছিল। মুসলিম গোয়েন্দা বাহিনী এ দুজন পানি বাহককে বন্দী করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট হাযির করেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাতরত ছিলেন। উপস্থিত সাহাবীগণ ঐ গোলামদ্বয়কে বিভিন্ন ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকলেন। উত্তরে তারা বলল যে, ‘আমরা কুরাইশদের পানি বাহক। পাত্রে পানি ভর্তি করে আনার জন্য তারা আমাদের পাঠিয়েছিল।

তাদের এ জবাবে সাহাবীগণ সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তাদের আশা ছিল যে, এরা দুজন হবে আবূ সুফইয়ানের লোক। কেননা, তাদের অন্তরে তখনো এ ক্ষীণ আশা বিরাজমান ছিল যে, তারা আবূ সুফইয়ানের বাণিজ্য কাফেলার উপর জয়যুক্ত হবেন। সুতরাং তারা ঐ গোলামদ্বয়কে কিছু মারপিটও করেন। তারা তখন বাধ্য হয়ে বলল যে, তারা আবূ সুফইয়ানের কাফেলার লোক। এ কথা বলার পর তাদের মারপিট বন্ধ করা হয়।

ততক্ষণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সালাত আদায় শেষ করেছেন। সাহাবীগণের এহেন আচরণে বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, ‘গোলামদ্বয় যখন সত্য কথা বলল, তখন তোমরা তাদের মারপিট করলে, অথচ যখন মিথ্যা কথা বলল তখন তাদের ছেড়ে দিলে। আল্লাহর কসম! তারা দুজন সঠিক কথাই বলেছিল যে, তারা কুরাইশের লোক।’

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঐ গোলাম দ্বয়কে বললেন, আচ্ছা এখন আমাকে কুরাইশদের সম্পর্কে খবর দাও।’

তারা বলল, ‘ঐ যে টিলাটি, যা উপত্যকার শেষ প্রান্তে দেখা যাচ্ছে, কুরাইশরা তারই পিছনে অবস্থান করছে।’

তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তারা কতজন আছে’’? উত্তরে তারা বলল, ‘অনেক’।

তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, তাদের সংখ্যা কত?’ তারা বলল ‘আমাদের তা জানা নেই।’

তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ‘প্রত্যহ কটি উট জবেহ করা হয়?’

তারা জবাব দিল, ‘একদিন নয়টি এবং আরেক দিন দশটি’’। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মন্তব্য করলেন, ‘তাহলে তো তাদের সংখ্যা নয়শ ও এক হাজারের মাঝামাঝি হবে।’

তারপর তিনি তাদেরকে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ‘তাদের সঙ্গে সম্ভ্রান্ত কুরাইশদের কে কে আছে’’?

উত্তরে তারা বলল, ‘রাবী’আহর দু’পুত্র ‘উতবাহ ও শায়বাহ, আবুল বাখতারী ইবনু হিশাম, হাকীম ইবনু হিযাম, নাওফাল ইবনু খুওয়াইলিদ, হারিস ইবনু আমির, তোআইমাহ ইবনু আদী, নাযর ইবনু হারিস, যামআহ ইবনু আসওয়াদ, আবূ জাহল ইবনু হিশাম, উমাইয়া ইবনু খালফ এবং আরও অনেকে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘মক্কা তার কলিজার টুকরোগুলোকে তোমাদের পাশে এনে নিক্ষেপ করেছে।’

 রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ (نُزُوْلُ الْمَطَرِ):

মহা মহিমান্বিত আল্লাহ রাববুল আলামীন এ রাত্রেই বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। মক্কা বাহিনীর উপর বর্ষিত হল সেই বৃষ্টির ধারা মুষল ধারে। প্রবল বৃষ্টির কারণে মক্কা বাহিনীর অগ্রগমন কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হল। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর উপর তা বর্ষিত হল আল্লাহ পাকের বিশেষ এক রহমত রূপে। আল্লাহর রহমতের এ বৃষ্টি শয়তানের সৃষ্ট অপবিত্রতা থেকে মুসলিমদের পবিত্র করে এবং ভূমিকে সমতল ও মসৃন করে। এর ফলে বেশ অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করে। পদচারণার ক্ষেত্রে অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কারণে তাদের অন্তরেও দৃঢ়তার ভাব সৃষ্টি হয়ে যায়।

 গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কেন্দ্রস্থলের দিকে মুসলিম বাহিনীর অগ্রগমন (الجَيْشُ الْإِسْلَامِيْ يَسْبِقُ إِلٰى أَهَمِّ الْمَرَاكِزِ الْعَسْكَرِيَّةِ):

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বীয় সেনাবাহিনীকে দ্রুত পথে চলার নির্দেশ দেন যাতে তাঁরা মুশরিক বাহিনীর পূর্বেই বদরের প্রস্রবণের নিকট পৌঁছে যান এবং প্রস্রবণের উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। মুশরিক বাহিনী যাতে কোনভাবেই প্রস্রবণের উপর অধিকার লাভ করতে না পারে সেটাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। এ প্রেক্ষিতে তিনি এবং তাঁর বাহিনী এশার সময় বদরের নিকট অবতরণ করেন। এ সময় হাববাব ইবনু মুনযির (রাঃ) একজন অভিজ্ঞ সামরিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রশ্ন করলেন। ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এ স্থানে আপনি আল্লাহর নির্দেশ ক্রমে অবতরণ করেছেন, না শুধু যুদ্ধের কৌশল হিসেবেই আপনি এ ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন। ‘কেননা এর অগ্র কিংবা পশ্চাদগমনের আমাদের কোন সুযোগ নেই’’?

প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘শুধু যুদ্ধের কৌশল হিসেবেই আমি এ ব্যবস্থা অবলম্বন করেছি।’

এ কথা শুনে হুবাব (রাঃ) বললেন, ‘এটা উপযুক্ত স্থান নয়। আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলুন এবং কুরাইশ বাহিনীর সব চাইতে নিকটে যে প্রস্রবণ রয়েছে সেখানে শিবির স্থাপন করুন। তারপর অন্যান্য সব প্রস্রবণ বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের প্রস্রবণের উপর চৌবাচ্চা তৈরি করে তাতে পানি ভর্তি করে নেব। এরপর কুরাইশ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে আমরা পানি পাব কিন্তু তারা তা পাবে না।

তাঁর এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘তুমি উত্তম পরামর্শ দিয়েছ।’ এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর বাহিনীকে অগ্রগমনের নির্দেশ প্রদান করলেন এবং অর্ধেক রাত যেতে না যেতেই কুরাইশ বাহিনীর সব চাইতে নিকটবর্তী প্রস্রবণের নিকট পৌঁছে গিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। তারপর সেখানে একটি চৌবাচ্চা বা জলাধার তৈরি করে নিয়ে অবশিষ্ট সমস্ত প্রস্রবণ বন্ধ করে দিলেন।

 নেতৃত্বের কেন্দ্র (مُقِرُّ الْقِيَادَةِ):

প্রস্রবণের উপর মুসলিম বাহিনীর যখন শিবির স্থাপন কাজ সম্পন্ন হল তখন সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) প্রস্তাব করলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সৈন্য পরিচালনা বা নেতৃত্ব প্রদানের কেন্দ্রস্থল রূপে একটি ছাউনী নির্মাণ করে দেয়া হোক, যেখানে তিনি অবস্থান করবেন। আল্লাহ না করুন বিজয়ের পরিবর্তে আমাদেরকে যদি পরাজিত হতে হয় কিংবা অন্য কোন অসুবিধাজনক অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় তাহলে পূর্ব থেকেই তাঁর নিরাপত্তার জন্য আমরা যেন প্রস্তুত থাকতে পারি। তাঁর এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থিত হলো। তারপর তাঁরা আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা আপনার জন্য একটি বস্ত্রের ছাউনী নির্মাণ করার মনস্থ করেছি। আপনি ওর মধ্যে অবস্থান করবেন এবং আপনার সওয়ারীগুলো পাশে তৈরি অবস্থায় থাকবে। তারপর আমরা শত্রুদের সঙ্গে মোকাবেলা করব। যদি আল্লাহ পাক আমাদের মান মর্যাদা রক্ষা করে শত্রুদের উপর বিজয় দান করেন তবে সেটা তো হবে আমাদের একান্ত আকাঙ্ক্ষিত ও পছন্দনীয়। আর আল্লাহ না করুন যদি আমরা অন্য অবস্থার সম্মুখীন হই তবে আপনি সওয়ারীর উপর আরোহণ করে আমাদের কওমের ঐ সকল লোকের নিকট চলে যাবেন যারা পিছনে রয়ে গেছেন। হে আল্লাহর নাবী (ﷺ)! প্রকৃতপক্ষে আপনার পিছনে এরূপ লোকেরা রয়েছেন যাঁদের তুলনায় আপনার প্রতি আমাদের ভালবাসা বেশী নয়। যদি তারা অনুমান করতে পারতেন যে, আপনি যুদ্ধের সম্মুখীন হয়ে পড়বেন তবে কখনই তারা পিছনে থাকতেন না। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের মাধ্যমে আপনাকে হিফাযত করবেন। তাঁরা আপনার শুভাকফঙ্ক্ষী এবং তাঁরা আপনার সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করবেন।’

তাঁদের এ কথায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) খুশী হলেন ও তাদের প্রশংসা করলেন এবং তাঁদের কল্যাণের জন্যে দুআ করলেন।

সাহাবীগণ যুদ্ধ ক্ষেত্রের উত্তর পূর্বে একটি উঁচু টিলার উপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্য আরীশ (তাঁবু) নির্মাণ করলেন যেখান থেকে পূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রটি দৃষ্টি গোচর হতো। তারপর তাঁর ঐ আরীশের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ)-এর নেতৃত্বে আনসারী যুবকদের একটি বাহিনী নির্বাচন করা হলো।

 সেনা বিন্যাস ও রাত্রি যাপন (تَعْبِئَةُ الْجَيْشِ وَقَضَاءُ اللَّيْلِ):

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সৈন্যদেরকে বিন্যস্ত করেন[1] এবং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি স্বীয় পবিত্র হাত দ্বারা ইশারা করে করে যাচ্ছিলেন, ‘এটা হবে ভাবীকাল ইনশাআল্লাহ[2] অমুকের বধ্যভূমি এবং এটা আগামী কাল হলে ইনশাআল্লাহ অমুকের বধ্যভূমি।’ এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেখানে একটি গাছের মূলের পাশে রাত্রি যাপন করেন এবং মুসলিমরাও পূর্ণ শান্তিতে রাত্রি অতিবাহিত করেন। তাঁদের অন্তর আল্লাহর উপর ভরসায় পরিপূর্ণ ছিল। তাঁদের এ আশা ছিল যে, প্রত্যুষেই তাঁরা স্বচক্ষে প্রতিপালকের শুভ সংবাদের বাণী দেখতে পাবেন। আল্লাহ পাক বলেন,

‏(‏إِذْ يُغَشِّيْكُمُ النُّعَاسَ أَمَنَةً مِّنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُم مِّن السَّمَاء مَاء لِّيُطَهِّرَكُم بِهِ وَيُذْهِبَ عَنكُمْ رِجْزَ الشَّيْطَانِ وَلِيَرْبِطَ عَلٰى قُلُوْبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ الأَقْدَامَ‏) [‏الأنفال‏:‏11‏]‏‏.‏

‘‘স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তাঁর নিকট হতে প্রশান্তি ধারা হিসেবে তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেছিলেন, আকাশ হতে তোমাদের উপর বৃষ্টিধারা বর্ষণ করেছিলেন তোমাদেরকে তা দিয়ে পবিত্র করার জন্য। তোমাদের থেকে শায়ত্বনী পংকিলতা দূর করার জন্য, তোমাদের দিলকে মজবুত করার জন্য আর তা দিয়ে তোমাদের পায়ের ভিত শক্ত করার জন্য।’ (আল-আনফাল ৮ : ১১)

এ রাতটি ছিল হিজরী ২য় সনের ১৭ই রমাযানের জুমুআহর রাত। ঐ মাসেরই ৮ই অথবা ১২ই তারীখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনা থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন।

[1] জামে তিরমিযী ১ম খন্ড আবওয়াবুল জিহাদ, বাবু মা জাআ ফিস সাফফে ওয়াত তা’বিয়াতে ১ম খন্ড ২০১ পৃঃ।

[2] মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে আনাস (রাঃ) হতে, মিশকাত ২য় খন্ড ৫৪৩ পৃঃ।

 যুদ্ধ ক্ষেত্রে মক্কা সৈন্যদের আগমন এবং তাদের পারস্পরিক মতানৈক্য (الْجَيْشُ الْمَكِّيْ فِيْ عَرْصَةِ الْقِتَالِ، وَوُقُوْعُ الْاِنْشِقَاقِ فِيْهِ):

অপরপক্ষে কুরাইশরা উপত্যকার বাইরে দিকে তাদের শিবিরে রাত্রি যাপন করে। আর প্রত্যুষে পুরো বাহিনী সহ টিলা হতে অবতরণ করে বদরের দিকে রওয়ানা হয়। একটি দল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাউযের দিকে অগ্রসর হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘তাদেরকে ছেড়ে দাও।’ তাদের মধ্যে যেই পানি পান করেছিল সেই এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। শুধু হাকীম ইবনু হিযামের প্রাণ বেঁচেছিল। সে পরে মুসলিম হয়েছিল এবং পাকা মুসলিমই হয়েছিল। তার নিয়ম ছিল যে, যখন সে দৃঢ় শপথ করত তখন বলত ঐ সত্ত্বার শপথ! যিনি আমাকে বদরের দিন হতে পরিত্রাণ দিয়েছেন।

ওদিকে কুরাইশ সৈন্যদলে মহা কোলাহল শুরু হয়েছে। কেউ অহংকার ভরে চিৎকার করছে এবং কেউ ক্রোধভরে মাটিতে পদাঘাত করছে। এ সময় কুরাইশ দলপতির আদেশক্রমে উমায়ের ইবনু অহাব নামক এক ব্যক্তি মুসলিমদের সংখ্যা নির্ণয় করার জন্য অশ্বরোহণে তাদের চারদিক প্রদক্ষিণ করে চলে যায়। স্বদলে ফিরে এসে উমায়ের বলতে শুরু করে মুসলিমদের সংখ্যা কমবেশি তিনশ হবে এবং তাদের পশ্চাতে সাহায্য করারও কেউ নেই। তরবারী ছাড়া আত্মরক্ষার জন্যে কোন উপকরণ তাদের সাথে নেই, এটাও আমি উত্তমরূপে বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তারা এমন সুবিন্যস্তভাবে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে যে, আমরা আমাদের একটি প্রাণের বিনিময় ছাড়া তাদের একটি প্রাণনাশ করতে পারবো না। কাজেই এ যুদ্ধে আমাদের পক্ষের অন্তত তিনশত প্রাণ উৎসর্গ না করে আমরা কোন ক্রমেই বিজয় লাভে সক্ষম হব না। যদি তারা আমাদের বিশেষ বিশেষ লোকদেরকে হত্যা করে ফেলে তবে এর পরে বেঁচে থাকার সাধ আর কী থাকতে পারে? অতএব, আমাদের কিছু চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।’

উমায়েরের এ কথা শুনে যুদ্ধের ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পকারী আবূ জাহেলের সামনে আরেক সমস্যা দেখা দিল। লোকারো তাকে যুদ্ধ করা ছাড়াই মক্কায় ফিরে যেতে বললো। হাকীম ইবনু হিযাম নামক কুরাইশ দলপতির চৈতন্যেদয় হল। তিনি দাঁড়িয়ে এক নীতি দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন এবং সকলকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন যে, এ অন্যায় সমরে প্রবৃত্ত হওয়ার কোনই কারণ নেই, তিনশত প্রাণ বলি দিয়ে এ যুদ্ধে বিজয় লাভের সার্থকতাও কিছুই নেই। হাকীম বক্তৃতা দিয়ে ক্ষান্ত হলেন না। তিনি ‘উতবাহ ইবনু রাবীআহ নামক কুরাইশ দলপতির নিকট উপস্থিত হয়ে নিজের মনোভবতার কাছে ব্যক্ত করলেন। ‘উতবাহ হাকীমের কথার যৌক্তিকতা অস্বীকার করতে পারল না। হাকীম তখন আশান্বিত হয়ে বললেন, ‘দেখুন, আপনি ধনে মানে কুরাইশের একজন বরেণ্য ব্যক্তি। সুতরাং আপনি একটু দৃঢ়তা অবলম্বন করে এ অন্যায় যুদ্ধ হতে স্বজাতিকে বিরত রাখুন, তাহলে আরবের ইতিহাসে আপনার নাম চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ ‘উতবাহ উত্তরে বলল, ‘আমি তো প্রস্তুত আছি। এক ‘আমর বিন হাযরামীর (যে সারিয়্যায়ে নাখলাহতে মারা গিয়েছিল) রক্তপণ, সেটাও আমি নিজে পরিশোধ করে দিতে পারি। কিন্তু হানযালিয়ার পুত্রকে (আবূ জাহল) কোন যুক্তির দ্বারাই বিরত রাখা সম্ভব নয়। যাহোক, তুমি তার কাছে গিয়ে চেষ্টা করে দেখো, তোমার প্রস্তাবে আমার সম্মতি রয়েছে।’

তারপর ‘উতবাহ দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখতে লাগল। বলল, ‘হে কুরাইশগণ! তোমরা মুহাম্মাদ (ﷺ), তাঁর সঙ্গীদের সাথে যুদ্ধ করে কোন বাহাদুরী করবেনা। আল্লাহর শপথ! যদি তোমরা তাঁদেরকে হত্যা করে ফেল তাহলে এমন চেহেরাসমূহ দেখতে পাওয়া যাবে যেগুলোকে দেখা পছন্দনীয় হবে না। কেননা এ যুদ্ধে হয় চাচাতো ভাই নিহত হবে নতুবা খালাতো ভাই কিংবা নিজের গোত্রেরই লোক নিহত হবে। সুতরাং ফিরে চল এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) ও গোটা আরব দুনিয়াকে ছেড়ে দাও। যদি আরবের অন্য লোকেরা মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে হত্যা করে ফেলে তাহলে তো সেটা তোমাদের কাঙ্খিত কাজই হবে। অন্যথা মুহাম্মাদ (ﷺ) তোমাদেরকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখবেন যে, তোমরা তাঁর প্রতি তোমাদের করণীয় কাজটি করো নি।

এদিকে হাকীম আবূ জাহলের নিকট হাযির হয়ে নিজের ও ‘উতবাহর মতামত ব্যক্ত করলেন। হাকীমের কথা শুনে আবূ জাহলের আপাদমস্তক জ্বলে উঠল। সে ক্রোধান্বিত স্বরে বলতে লাগল, আল্লাহর শপথ, মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের দেখার পর ‘মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর যাদু ‘উতবাহর উপর বিশেষ কার্যকরী হয়েছে। কক্ষনো না, আল্লাহর শপথ! আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যে আল্লাহর ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না। না, না এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি, ‘উতবাহর পুত্র মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর দলভুক্ত (‘উতবাহর পুত্র আবূ হুযাইফা (রাঃ) প্রথম পর্যায়ের মুসলিম ছিলেন এবং হিজরত করে মদীনায় গিয়েছিলেন)। সে যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত। তার নিহত হওয়ার আশঙ্কায় নরাধম এমন বিচলিত হয়ে পড়েছে। ধিক্ শত ধিক তাকে।’

হাকীম তখন আবূ জাহলকে সেখানে রেখে ‘উতবাহর নিকট গমন করে সমস্ত বৃত্তান্ত প্রকাশ করলেন। ক্রোধ, অভিমান ও অহংকারে ‘উতবাহ একেবারে আতমবিস্মৃত হয়ে পড়লো। সে বলে উঠল, কী, আমি ভীরু? আমি কাপুরুষ? পুত্রের মায়ায় আমি বীরধর্মে জলাঞ্জলি দিচ্ছি। আচ্ছা, তাহলে আরববাসী দেখুক, জগদ্বাসী দেখুক যে, কে বীর পুরুষ, আমি ততক্ষণ ফিরব না যতক্ষণ না মুহাম্মাদের সঙ্গে একটা চূড়ান্ত বোঝাপড়া হয়। এ বলে সে সদল বলে সমরাঙ্গনে এগিয়ে চলল। আর ওদিকে আবূ জাহল ছুটে গিয়ে ‘আমির ইবনু হযরামীকে বলল, ‘দেখছ কি, তোমার ভ্রাতার প্রতিশোধ গ্রহণ আর সম্ভব হবে না। কাপুরুষ ‘উতবাহ সদল বলে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে যাচ্ছে। শীঘ্র উঠে আর্তনাদ করতে শুরু কর।’

আবূ জাহলের কথা শেষ হতে না হতেই ‘আমির তার সকল অঙ্গে ধূলো বালি মাখতে মাখতে এবং গায়ের কাপড় ছিঁড়তে ছিঁড়তে নিহত ভ্রাতার নাম নিয়ে আর্তনাদ করে বেড়াতে লাগল। আর যায় কোথায়, মুহূর্তের মধ্যে হাকীমের সমস্ত পরিশ্রম পশু হয়ে গেল। ক্ষণিকের মধ্যেই রণ পিপাসু মুশরিক বাহিনীর বীভৎস চিৎকার দিগ্বিদিক ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করে তুলল এবং রণাঙ্গন প্রকম্পিত হয়ে উঠল।

 মুশরিক ও মুসলিম বাহিনী পরস্পর মুখোমুখী (الجَيْشَانِ يَتَرَاآنِ):

‘‘হে আল্লাহ, এ মুশরিক কুরাইশগণ ভীষণ গর্বভরে তোমার বিরুদ্ধাচরণ করতে করতে এবং তোমার রাসূল (ﷺ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে করতে এগিয়ে আসছে। হে আল্লাহ, আমরা তোমার সাহায্যপ্রার্থী। হে আল্লাহ, তোমার এ দীন দাসদের প্রতি তোমার যে ওয়াদা রয়েছে তা আজ পূর্ণ করে দেখিয়ে দাও।’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘উতবাহ ইবনু রাবী’আহকে তার একটি লাল উটের উপর দেখে বললেন,

‏‏(‏إِنْ يَّكُنْ فِيْ أَحَدٍ مِّنْ الْقَوْمِ خَيْرٌ فَعِنْدَ صَاحِبُ الْجَمَلِ الْأَحْمَرِ، إِنْ يُّطِيْعُوْهُ يَرْشُدُوْا‏)

কওমের মধ্যে কারো কাছে কল্যাণ থাকলে লাল উটের মালিকের কাছে রয়েছে। জনগণ তার কথা মেনে নিলে তারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হবে।’

এ স্থানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিমদের সারিগুলো ঠিক করলেন। সারি ঠিক করা অবস্থায় একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাতে একটি তীর ছিল যা দ্বারা তিনি সারি ঠিক করছিলেন। ঐ সময় সাওয়াদ ইবনু গাযিয়্যাহ সারি হতে কিছু আগে বেড়েছিলেন। তার পেটের উপর তিনি তীরের ছোঁয়া দিয়ে বললেন, ‘হে সাওয়াদ সমান হয়ে যাও। তখন সাওয়াদ (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ), আমাকে আপনি কষ্ট দিয়েছেন, সুতরাং প্রতিশোধ প্রদান করুন।’ তার একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বীয় পেট খুলে দিয়ে বললেন, ‘প্রতিশোধ নিয়ে নাও।’ সাওয়াদ (রাঃ) তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং পেটে চুম্বন দিতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন তাকে বললেন, ‘হে সাওয়াদ (রাঃ) তোমার এরূপ করার কারণ কী?’ সাওয়াদ (রাঃ) উত্তরে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যা কিছু সামনে আছে তা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন। আমি চেয়েছি যে, এ স্থানে আপনার সাথে আমার শেষ আদান প্রদান যেন এটাই হয়, অর্থাৎ আমার দেহের চামড়া আপনার দেহের চামড়াকে স্পর্শ করে।’ তাঁর এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর জন্যে কল্যাণের দুআ করলেন। সারিসমূহ ঠিক ঠাক হয়ে গেল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সৈন্যদেরকে উপদেশ দিতে গিয়ে বললেন যে, তিনি তাদেরকে শেষ নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত যেন তারা যুদ্ধ শুরু না করেন। তারপর তিনি যুদ্ধনীতির ব্যাপারে বিশেষ একটি উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘মুশরিকরা যখন সংখ্যা বহুলরূপে তোমাদের নিকট এসে পড়বে তখন তাদের প্রতি তীর চালাবে এবং নিজেদের তীর বাঁচাবার চেষ্টা করবে[1] (অর্থাৎ প্রথম থেকেই অযথা তীরন্দাজী করে তীর নষ্ট করবে না।) আর যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাদের উপর ছেয়ে না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তরবারী উত্তোলন করবে না।[2]

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং আবূ বাকর (রাঃ) ছাউনির দিকে ফিরে গেলেন এবং সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) তাঁর রক্ষকবাহিনীকে নিয়ে ছাউনির দরজার উপর নিযুক্ত হয়ে গেলেন।

অপর পক্ষে মুশরিকদের অবস্থা এই ছিল যে, আবূ জাহল আল্লাহ তা‘আলার নিকট ফায়সালার দুআ করল। সে বলল, ‘হে আল্লাহ আমাদের মধ্যে যে দলটি আত্মীয়তার বন্ধন বেশী ছিন্নকারী ও ভুল পন্থা অবলম্বনকারী ঐ দলকে তুমি আজ ছিন্ন ভিন্ন করে দাও। হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে দল তোমার নিকট বেশী প্রিয় ও পছন্দনীয় আজ তুমি ঐ দলকে সাহায্য কর।’ পরবর্তীতে এ কথারই দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াতটি অবতীর্ণ করেন।

‏(‏إِن تَسْتَفْتِحُوْا فَقَدْ جَاءكُمُ الْفَتْحُ وَإِن تَنتَهُوْا فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَإِن تَعُوْدُوْا نَعُدْ وَلَن تُغْنِيَ عَنكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْئًا وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ اللهَ مَعَ الْمُؤْمِنِيْنَ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏19‏]‏

‘‘(ওহে কাফিরগণ!) তোমরা মীমাংসা চাচ্ছিলে, মীমাংসা তো তোমাদের কাছে এসে গেছে; আর যদি তোমরা (অন্যায় থেকে) বিরত হও, তবে তা তোমাদের জন্যই কল্যাণকর, তোমরা যদি আবার (অন্যায়) কর, আমিও আবার শাস্তি দিব, তোমাদের দল-বাহিনী সংখ্যায় অধিক হলেও তোমাদের কোন উপকারে আসবে না এবং আল্লাহ তো মু’মিনদের সঙ্গে আছেন।’ (আল-আনফাল ৮ : ১৯)

[1] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৬৮ পৃঃ।

[2] সুনানে আবূ দাউদ, বাবু ফী সাল্লিম সূযুফে ইনদাল্লিকা ২/১৩ পৃঃ।

শেষ মুহূর্ত ও যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন (سَاعَةُ الصِّفْرِ وَأَوَّلُ وُقُوْدُ الْمَعْرِكَةِ):

এ যুদ্ধের প্রথম ইন্ধন ছিল আসওয়াদ ইবনু আবুল আসাদ মাখযুমী। এ লোকটি ছিল বড়ই হঠকারী ও দুশ্চরিত্র। সে একথা বলতে বলতে যুদ্ধক্ষেত্রে বেরিয়ে আসলো ‘আমি এদের হাউযের পানি পান করব অথবা একে ভেঙে ফেলব নতুবা এজন্যে জীবন দিয়ে দিব।’ এ কথা বলে যখন সে ওদিক থেকে বেরিয়ে আসলো তখন এদিক থেকে হামযাহ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) এগিয়ে আসলেন। হাউযের পাড়েই দুজনের দেখাদেখি হলো। হামযাহ (রাঃ) তাকে এমনভাবে তরবারী দ্বারা আঘাত করলেন যে, তার পা অর্ধ পদনালী হতে কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং সে পৃষ্ঠভরে পড়ে গেল। তার পা হতে রক্তের ফোয়ারা ছুটছিল যার গতি তার সঙ্গীদের দিকে ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে হাঁটুর ভরে ছেঁচড়িয়ে চলে হাউযের দিকে অগ্রসর হলো এবং তাতে প্রবেশ করতেই চাচ্ছিল যাতে তার কসম পুরো হয়ে যায়। ইতোমধ্যে হামযাহ (রাঃ) দ্বিতীয়বার তার উপর তরবারী চালালেন এবং সে হাউযের মধ্যেই মৃত্যুমুখে পতিত হলো।

 যুদ্ধের সূত্রপাত (المُبَـــارَزَةُ):

এটা ছিল এ যুদ্ধের প্রথম হত্যা। এর ফলে যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল। তখন নিয়ম ছিল যে, যুদ্ধের পূর্বে প্রত্যেক পক্ষের বিখ্যাত বীর পুরুষরা রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হয়ে অন্যপক্ষকে সমরে আহবান করত। তখন ঐ পক্ষের নির্বাচিত কয়েকজন খ্যাতনামা বীর এ আহবানের উত্তর প্রদানের জন্যে বীরদর্পে অগ্রসর হতো। এ ক্ষেত্রেও তাই হলো। অভিযান ক্ষুব্ধ ‘উতবাহ ও তার সহোদর শায়বাহ ও পুত্র ওয়ালীদসহ চীৎকার করতে লাগল ‘কে আসবি আয়, আমাদের তরবারীর খেলা দেখে যা।’ তার এ আহবান শুনে তিনজন আনসার বীর উলঙ্গ তরবারী হাতে সেই দিকে ধাবিত হলেন। তারা হলেন আউয (রাঃ), মুআব্বিয (রাঃ), এরা দুজন হারিসের পুত্র ছিলেন এবং তাদের মাতার নাম ছিল আফরা-। তৃতীয় জন হলেন আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা। কুরাইশরা তাদের জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে? তাঁরা বললেন, ‘আমরা আনসার’। তখন তারা বলল, ‘আপনাদের আমরা চাচ্ছি না। আমরা আমাদের চাচাতো ভাইদের চাচ্ছি এবং একজন চিৎকার করে বলতে লাগল ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ), মদীনার এ চাষাগুলোর সাথে যুদ্ধ করা আমাদের পক্ষে অসম্মানজনক। আমাদের যোগ্য যোদ্ধা পাঠাও। তার একথা শুনে রাসূলুল্লাহ এ তিনজন আনসার বীরকে তাদের স্ব- স্ব স্থানে ফিরে যেতে বললেন। তারপর তিনি নিজের পরমাত্মীয়দের মধ্যে হতে হামযাহ (রাঃ), উবাইদাহ বিন হারিস (রাঃ) ও আলী (রাঃ)-কে সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমরা তাদের মোকাবেলায় অগ্রসর হও। এরা অগ্রসর হলে কুরাইশগণ বলল, ‘তোমরা কে?’ তাঁরা তাদের পরিচয় দান করলেন। কাফিররা তাদেরকে আক্রমণ করল। ওয়ালীদের সাথে আলী (রাঃ)-কে, শায়বাহর সাথে হামযাহর (রাঃ) এবং ‘উতবাহর সাথে উবাইদাহ (রাঃ)-এর যুদ্ধ বেধে গেল। মুহূর্তের মধ্যে শায়বাহ ও ওয়ালীদের মস্তক ভূলণ্ঠিত হয়ে পড়লো। উবাইদাহ (রাঃ) ছিলেন তখন সবার চেয়ে বৃদ্ধ। তিনি ও ‘উতবাহ পরস্পরে তরবারীর আঘাতে গুরুতররূপে আহত হয়ে পড়ল। ইতোমধ্যে আলী ও হামযাহ (রাঃ) নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীকে খতম করে এসে ‘উতবাহর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা কাজ শেষ করেন ও উবাইদাহকে তুলে আনলেন। তার মুখে আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং ক্রমাগতভাবে বন্ধই থাকল। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ৪র্থ বা ৫ম দিন যখন মুসলিমরা মদীনা প্রত্যাবর্তনের পথে সাফরা নাম উপত্যকা অতিক্রম করছিলেন ঐ সময় উবাইদাহ (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন।

আলী (রাঃ) আল্লাহর নামে শপথ করে বলতেন, ‘এ আয়াতটি আমাদেরই ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়,

‏(‏هٰذَانِ خَصْمَانِ اخْتَصَمُوْا فِيْ رَبِّهِمْ‏)‏ الآية ‏[‏الحج‏:‏19‏]‏‏

‘‘এরা বিবাদের দু’টি পক্ষ, (মু’মিনরা একটি পক্ষ, আর সমস্ত কাফিররা আরেকটি পক্ষ) এরা এদের প্রতিপালক সম্বন্ধে বাদানুবাদ করে।’ (আল-হাজ্জ ২২ : ১৯)

 সাধারণ আক্রমণ (الهُجُوْمُ الْعَامُ):

এ মল্ল যুদ্ধের পরিণাম মুশরিকদের জন্য খুবই মন্দ সূচনা ছিল। তারা একটি মাত্র লম্ফনে তাদের তিন জন বিখ্যাত অশ্বারোহী নেতাকে হারিয়ে বসেছিল। এ জন্যে তাঁরা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে একত্রিতভাবে মুসলিমগণকে আক্রমণ করল।

অপর দিকে মুসলিমরা তাঁদের প্রতিপালকের নিকট অত্যন্ত আন্তরিকতা ও বিনয়ের সাথে সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করার পর স্ব স্ব স্থানে অটল থাকলেন এবং প্রতিহত করার ব্যবস্থা অবলম্বন করলেন। তাঁরা মুশরিকদের একাদিক্রমিক আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকলেন এবং তাঁদের বিশেষ ক্ষতিসাধন করে চললেন। তাদের মুখে আহাদ আহাদ শব্দ উচ্চারিত হচ্ছিল।

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আকুল প্রার্থনা (الرَّسُوْلُ ﷺ يُنَاشِدُ رَبَّهُ):

এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সৈন্যদের শ্রেণী বিন্যাস কাজ শেষ করে ফিরে এসেই স্বীয় মহান প্রতিপালকের নিকট সাহায্যের ওয়াদা পূরণের প্রার্থনা করতে লাগলেন। তাঁর প্রার্থনা ছিল,

(‏اللهم أَنْجِزْ لِيْ مَا وَعَدْتَنِيْ، اللهم إِنِّيْ أَنْشُدُكَ عَهْدَكَ وَوَعْدَكَ‏)‏،

তারপর যখন উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল তখন তিনি এ প্রার্থনা করলেন।

‏‏(‏اللهم إِنْ تُهْلِكْ هٰذِهِ الْعِصَابَةَ الْيَوْمَ لَا تُعْبَدُ، اللهم إِنْ شِئْتَ لَمْ تُعْبَدْ بَعْدَ الْيَوْمِ أَبَدًا‏)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অত্যন্ত বিনয়ের সাথে প্রার্থনা করলেন এবং তিনি এমন আত্মভোলা হয়ে পড়লেন যে, তাঁর চাদরখানা তাঁর কাঁধ হতে পড়ে গেল। তখনও তিনি পূর্ববত তন্ময়ভাবে প্রার্থনায় নিমগ্ন থাকলেন। এ দৃশ্য দেখে ভক্ত প্রবর আবূ বাকর (রাঃ) দ্রুত ছুটে আসলেন এবং চাদরখানা দ্বারা তাঁর দেহ আচ্ছাদিত ক’রে তাকে আলিঙ্গন করে বলতে লগালেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ), যথেষ্ট হয়েছে। বড়ই কাতর কণ্ঠে আপনি প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করেছেন। এ প্রার্থনা ব্যর্থ হবে না। শীঘ্রই তিনি নিজের ওয়াদা পূর্ণ করবেন।’ এদিকে আল্লাহ তা‘আলা ফিরিশতাদেরকে ওহী করলেন,

‏(‏أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُوْا الَّذِيْنَ آمَنُوْا سَأُلْقِيْ فِيْ قُلُوْبِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا الرَّعْبَ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏ 12‏]

‘স্মরণ কর যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের প্রতি ওয়াহী পাঠিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গেই আছি; অতএব মু’মিনদেরকে তোমরা দৃঢ়পদ রেখ। অচিরেই আমি কাফিরদের দিলে ভীতি সঞ্চার করব।’ [আল-আনফাল (৮) : ১২]

আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আল্লাহ তা‘আলা ওহী পাঠালেন,

‏(‏أَنِّي مُمِدُّكُم بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلآئِكَةِ مُرْدِفِيْنَ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏9‏]‏

‘আমি তোমাদেরকে এক হাজার ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করব যারা পর পর আসবে।’ [আল-আনফাল (৮) : ৯]

 ফেরেশতাদের অবতরণ (نُزُوْلُ الْمَلَائِكَةِ):

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে একটু তন্দ্রা আসলো। তারপর তিনি স্বীয় মস্তক মুবারক উঠিয়ে বললেন,

‏‏(‏أَبْشِرْ يَا أَبَا بَكْرٍ، هٰذَا جِبْرِيْلُ عَلٰى ثَنَايَاهُ النَّقْعُ‏)

‘আবূ বাকর (রাঃ) খুশী হও। ইনি জিবরাঈল, (আঃ) তার দেহ ধূলো বালিতে ভরপুর।’ ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

‏‏(‏أَبْشِرْ يَا أَبَا بَكْرٍ، أَتَاكَ نَصْرُ اللهِ، هٰذَا جِبْرِيْلُ آخِذٌ بِعَنَانِ فَرْسِهِ يَقُوْدُهُ، وَعَلٰى ثَنَايَاهُ النَّقْعُ‏)

‘আবূ বাকর (রাঃ) আনন্দিত হও, তোমাদের কাছে আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে। ইনি জিবরাঈল (আঃ), তিনি স্বীয় ঘোড়ার লাগাম ধরে ওর আগে আগে চলে আসছেন। তার দেহ ধূলোবালিতে পরিপূর্ণ রয়েছে।’

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছাউনির দরজা হতে বাইরে বেরিয়ে আসলেন। তিনি লৌহ বর্ম পরিহিত ছিলেন। পূর্ণ উত্তেজনার সাথে তিনি সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন এবং মুখে উচ্চারণ করছিলেন,

‏(‏سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ‏)‏ ‏[‏القمر‏:‏45‏]

‘‘এ সংঘবদ্ধ দল শীঘ্রই পরাজিত হবে আর পিছন ফিরে পালাবে।’ (আল-ক্বামার ৫৪ : ৪৫)

তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক মুষ্টি পাথুরে মাটি নিলেন এবং কুরাইশদের দিকে মুখ করে বললেন,‏‏(‏شَاهَتِ الْوُجُوْهُ‏)‏ ‘চেহারাগুলো বিকৃত হোক’’। আর একথা বলার সাথে সাথেই ঐ মাটি তাদের চেহারার দিকে নিক্ষেপ করলেন। তারপর মুশরিকদের মধ্যে এমন কেউই ছিল না যার চক্ষুদ্বয়ে, নাসারন্ধ্রে ও মুখে ঐ এক মুষ্টি মাটির কিছু না কিছু যায় নি। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‏(‏وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلٰـكِنَّ اللهَ رَمَى‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏17‏]‏‏.‏

‘‘তুমি যখন নিক্ষেপ করছিলে তা তো তুমি নিক্ষেপ করনি, বরং আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন।’ (আল-আনফাল ৮ : ১৭)

 পাল্টা আক্রমণ (الهُجُوْمُ الْمَضَادِّ):

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাল্টা আক্রমণের নির্দেশ দেন এবং যুদ্ধের প্রতি উৎসাহ প্রদান করতে গিয়ে বলেন,

‏‏(‏وَالَّذِيْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَا يُقَاتِلُهُمْ الْيَوْمَ رَجُلٌ فَيَقْتُلُ صَابِرًا مُحْتَسِبًا مُقْبِلًا غَيْرَ مُدْبِرٍ، إِلَّا أَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ‏)

‘‘তোমরা আক্রমণ চালাও। যাঁর হাতে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর প্রাণ রয়েছে সেই সত্ত্বার শপথ! এদের মধ্যে যে ব্যক্তি যুদ্ধে অটল থেকে যুদ্ধ করাকে সওয়াব বা পুণ্য মনে করে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে পিছপা না হয়ে লড়াই করতে করতে মৃত্যুবরণ করবে আল্লাহ তাকে অবশ্য অবশ্যই জান্নাতে প্রবিষ্ট করাবেন।’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত ও উৎসাহিত করতে গিয়ে আরো বলেন,

‏‏(‏قُوْمُوْا إِلٰى جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمٰوَاتُ وَالْأَرْضُ‏)‏،

‘‘তোমরা ঐ জান্নাতের দিকে উঠে যাও যার প্রস্থ আসমান ও যমীনের সমান।’

একথা শুনে উমায়ের ইবনু হাম্মাম (রাঃ) বললেন, ‘খুব ভাল! খুব ভাল! রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এ কথা কেন বললে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমি আশা রাখি যে, আমিও ঐ জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হবো, এছাড়া অন্য কোন কথা নয়।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন ‘হ্যাঁ তুমিও ঐ জান্নাতবাসীদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।’ তারপর তিনি তার খাদ্য থলে হতে কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘যদি আমি এ খেজুরগুলো খেয়ে শেষ করা পর্যন্ত জীবিত থাকি তবে এটাও তো দীর্ঘ জীবন হয়ে যাবে।’ সুতরাং তিনি তার কাছে যে খেজুরগুলো ছিল সেগুলো ফেলে দিলেন। তারপর মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।

এভাবেই খ্যাতনামা মহিলা আফরার (রাঃ) পুত্র আউফ ইবনু হারিশ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের কোন্ কাজে খুশী হয়ে হেসে থাকেন’’? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘তিনি বান্দার ঐ কাজে খুশী হয়ে হেসে থাকেন যে, সে অনাবৃত দেহে (যুদ্ধে দেহ রক্ষক পোষাক পরিধান না করেই ) স্বীয় হাত শত্রুদের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়’। একথা শুনে আউফ (রাঃ) দেহ হতে লৌহবর্ম খুলে নিয়ে নিক্ষেপ করলেন এবং তরবারী নিয়ে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারপর যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।[1]

যে সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাল্টা আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাতে শত্রুদের আক্রমণের প্রচন্ডতা হ্রাস পেয়েছিল এবং তাদের উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। এজন্য এ কৌশলপূর্ণ পরিকল্পনা মুসলিমদের অবস্থান দৃঢ় করতে খুবই ক্রিয়াশীল হয়েছিল, কেননা, সাহাবীগণ (রাঃ) যখন আক্রমণ করার দির্দেশ পেলেন তখন ছিল তাঁদের জিহাদের উত্তেজনার যৌবনকাল। তাই তাঁরা এক দুর্দমনীয় ও ফায়সালাকারী আক্রমণ পরিচালনা করলেন। তাঁরা শত্রুদের সারিগুলোকে তছনছ ও এলোমেলো করে দিয়ে তাদের গলা কেটে কেটে সামনে অগ্রসর হয়ে গেলেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বর্ম পরিহিত অবস্থায় লাফাতে লাফাতে আসতে দেখে এবং শ্রীঘ্রই তারা পরাজিত হবে ও পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করবে, একথা স্পষ্টভাবে বলতে শুনে তাঁদের উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পেলো। এ জন্যেই মুসলিমরা বীর বিক্রমে যু্দ্ধ করলেন এবং ফিরিশতারাও তাঁদেরকে সাহায্য করলেন। যেমন ইবনু সা’দের বর্ণনায় ইকরামা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, ঐ দিন মানুষের মস্তক কেটে পড়ত, অথচ কে কেটেছে তা জানা যেত না এবং মানুষের হাত কর্তিত হয়ে পড়ে যেত, অথচ কে কর্তন করেছে তা জানা যেত না।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একজন মুসলিম একজন মুশরিককে তাড়া করছিলেন। হঠাৎ ঐ মুশরিকের উপর চাবুক মারার শব্দ শোনা গেল এবং একজন অশ্বারোহীর শব্দ শোনা গেল, যিনি বলছিলেন। ‘সম্মুখে অগ্রসর হও।’ মুসলিম মুশরিকটিকে তাঁর সামনে দেখলেন যে, সে চিৎ হয়ে পড়ে গেল, তিনি লাফ দিয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, তার নাকের উপর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং অবয়র ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে যেন চাবুক দ্বারা আঘাত করা হয়েছে। ঐ আনসারী মুসলিম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি সত্য কথা বলেছো। এটা ছিল তৃতীয় আসমানের সাহায্য।’’[2]

আবূ দাউদ মাযেনী বলেন, ‘আমি একজন মুশরিককে মারার জন্যে তাড়াতাড়ি করছিলাম। অকস্মাৎ তার মস্তকটি, আমার তরবারী ওর উপর পৌঁছার পূর্বে কেটে পড়ে যায়। আমি তখন বুঝতে পারলাম যে, তাকে আমি নই, বরং অন্য কেউ হত্যা করেছে।’

একজন আনসারী আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবকে বন্দী করে নিয়ে আসেন। তখন আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমাকে এ ব্যক্তি বন্দী করেনি। একজন চুলবিহীন মাথাওয়ালা লোক যিনি দেখতে অত্যন্ত সুন্দর এবং একটি বিচিত্র বর্ণের ঘোড়ার উপর সওয়ার ছিলেন তিনি আমাকে বন্দী করেছিলেন। তাকে এখন আমি লোকজনদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না।’ আনসারী বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তাকে আমি বন্দী করেছি।’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,

‏‏(‏اُسْكُتْ فَقَدْ أَيَّدَكَ اللهُ بِمَلَكٍ كَرِيْمٍ‏)‏‏

‘‘চুপ করো, আল্লাহ এক সম্মানিত ফিরিশতা দ্বারা তোমাকে সাহায্য করেছেন।’

‘আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে এবং আবূ বাকরকে বললেন, তোমাদের একজনের সাথে জিবরীল এবং আরেকজনের সাথে মিকাঈল ও ইসরাফীল (আঃ) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন।

[1] মুসলিম শরীফ ২/১৩৯ পৃঃ, মিশকাত ২/৩৩১ পৃঃ।

[2] মুসলিম শরীফ ২/৯৩ পৃঃ।

 ময়দান হতে ইবলীসের পলায়ন (إِبْلِيْسُ يَنْسَحِبُ عَنْ مَيْدَانِ الْقِتَالِ):

যেমনটি আমরা বলে এসেছি, অভিশপ্ত ইবলিস সুরাক্বাহ বিন মালিক বিন জুশুম মুদলিজীর সুরতে এসেছিল এবং এতক্ষণ পর্যন্তও সে মুশরিকগণ হতে পৃথক হয় নি। কিন্তু যখন সে মুশরিকদের বিরুদ্ধে ফিরিশতাগণের ভূমিকা প্রত্যক্ষ করল তখন সে পিছনে ফিরে পলায়ন করতে থাকল। কিন্তু হারিস বিন হিশাম তাকে আটকে রাখল। তার বিশ্বাস যে, সে প্রকৃতই সুরাক্বাহ। কিন্তু ইবলীস তার বুকে এত জোরে ঘুষি মারল যে, সে মাটিতে পড়ে গেল। ইত্যবসরে ইবলিস সেখান থেকে পলায়ন করল। মুশরিকগণ বলতে লাগল, ‘সুরাক্বাহ কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি বল নি যে, তুমি আমাদের সাহায্য করবে এবং কখনই আমাদের থেকে পৃথক হবে না?’

একথা শোনার পর ইবলীস বলল, ‏(‏إِنِّي أَرٰى مَا لاَ تَرَوْنَ إِنِّيَ أَخَافُ اللهَ وَاللهُ شَدِيْدُ الْعِقَابِ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏48‏]

‘‘আমি যা দেখছি, তোমরা তা দেখছনা। আল্লাহকে আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে। তিনি কঠিন শাস্তির মালিক।’ (আল-আনফাল ৮ : ৪৮)

এরপর পলায়ন করে সে সমুদ্রের ভিতরে যেতে থাকল।

 সাংঘাতিক পরাজয় (الهَزِيْمَةُ السَّاحِقَةِ):

অল্পক্ষণের মধ্যেই মুশরিকগণের সৈন্য বাহিনীতে অকৃতকার্যতা ও দুর্ভাবনার বিভিন্ন লক্ষণ পরিষ্ফুট হয়ে উঠল। মুসলিমদের কঠিন এবং অবিরাম আক্রমণের নির্ধারণের নিকটবর্তী হয়ে আসতে থাকল। এমনকি তারা দৌঁড় দিয়ে পিছু হটতে লাগল। এ সুযোগে মুসলিম বাহিনী তাদের হত্যা, জখম ও বন্দী করতে করতে পিছু পিছু ধাওয়া করে চলল। এমনকি দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা সম্পূর্ণরূপে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হল।

 আবূ জাহলের হঠকারিতা (صُمُوْدُ أَبِيْ جَهْلٍ):

কিন্তু বড় তাগুত আবূ জাহল যখন নিজ সারির সৈন্যদলের মধ্যে বিশৃঙ্খল অবস্থা প্রত্যক্ষ করল তখনও সে নিজ অবস্থানে সুদৃঢ় থাকার মনস্থ করল। কাজেই সে নিজ দলের সৈন্যগণকে উচ্চ কণ্ঠে এবং আত্মম্ভরিতার সঙ্গে বলতে থাকল যে, ‘যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সুরাক্বাহর সরে পড়ার কারণে তোমরা মনোবল হারিও না যেন, কারণ সে পূর্ব হতেই মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ‘উতবাহ, শায়বাহ এবং ওয়ালীদের হত্যার কারণেও তোমাদের ভীত হওয়ার কোন কারণ নেই। তাড়াহুড়োর মধ্যে কাজ করতে গিয়েই তাদের এ অবস্থা হয়েছে। লাত ও উযযার শপথ! তাদেরকে রশি দ্বারা শক্ত করে বেঁধে না ফেলা পর্যন্ত আমরা প্রত্যাবর্তন করব না। দেখ, তোমাদের কোন ব্যক্তি তাদের কাউকেও যেন হত্যা না করে। আমরা যেন তাদেরকে অন্যায়ের শাস্তি দিতে পারি এ উদ্দেশ্যে তাদেরকে ধর এবং বন্দী কর।’

কিন্তু তার এ অসার অহমিকার প্রতিফল শীঘ্রই তাকে অনুধাবন করতে হল। কারণ মুহূর্তের মধ্যেই মুসলিমদের পক্ষ থেকে পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলল। কিন্তু আবূ জাহল তার চতুষ্পাশের একদল জনতাকে বেশ সংঘবদ্ধ অবস্থাতেই রেখেছিল। এ জনতা তার চতুর্দিকে তরবারীর প্লাবন ও বর্শার জঙ্গল সৃষ্টি করে রেখেছিল। কিন্তু ইসলামী জনতার প্রলয়ঙ্করী তুফান তার তরবারীর প্লাবন এবং বর্শার জঙ্গলকে একদম তছনছ করে ফেলল। তারপর এ বড় তান্ডত মর্দে মু’মিনদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে এসে গেল। মুসলিম সৈন্যরা দেখতে পেলেন যে, সে এক ঘোড়ার পিঠে চড়ে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে আনসারী যুবকের হাতে তার মৃত্যু রক্ত চুষে নেয়ার অপেক্ষায় ছিল।

 আবূ জাহলের হত্যা (مَصْرَعُ أَبِيْ جَهْلٍ):

আব্দুর রহমান বিন আওফ হতে বর্ণিত আছে যে, ‘বদরের যুদ্ধের দিন আমি সৈন্যদের সারিতে ছিলাম। এমতাবস্থায় হঠাৎ ডানে এবং বামে অল্প বয়স্ক দুজন যুবককে দেখতে পেলাম। তাদের উপস্থিতিতে আমি নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারলাম না। এমন অবস্থায় ওদের একজন তার সঙ্গীকে এড়িয়ে আমার কাছে এসে বলল। ‘চাচাজান আবূ জাহল কোনটি, আমাকে দেখিয়ে দিন।’

আমি বললাম, ‘ভাতিজা, তাকে তোমার কী প্রয়োজন।’ সে বলল, ‘আমাকে বলা হয়েছে যে, সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে মন্দ বলেছে। সেই সত্ত্বার কসম! যার হাতে রয়েছে আমার জীবন, যদি আমি তাকে দেখতে পাই তাহলে যতক্ষণ আমাদের মধ্যে যার মৃত্যু পূর্বে অবধারিত হয়েছে সে মৃত্যুবরণ না করবে ততক্ষণ আমার অস্তিত্ব তার অস্তিত্ব থেকে পৃথক হবে না।’

তিনি বলেছেন যে, ‘আমি তার এ কথায় একদম অভিভূত হয়ে পড়লাম।’

তিনি আরও বলেছেন যে, ‘দ্বিতীয় জনও এসে ইঙ্গিতে আমাকে ঐ একই কথাই বলল। তারপর আমি প্রত্যক্ষ করলাম যে, আবূ জাহল লোকজনদের মাঝে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বললাম আরে দেখছ না, ঐ যে, তোমাদের শিকার যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলে।’

তিনি বর্ণনা করেছেন যে, ‘এ কথা শোনা মাত্র তারা উভয়ে তরবারী নিয়ে লাফ দিয়ে এগিয়ে চলল এবং সেই কুখ্যাত নরাধমকে হত্যা করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট প্রত্যাবর্তন করল।’

নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‘তোমাদের উভয়ের মধ্যে কে তাকে হত্যা করেছ?’

তারা উভয়েই বলল, ‘আমি হত্যা করেছি।’

নাবী কারীম (ﷺ) পুনরায় বললেন, ‘তোমরা কি নিজ নিজ তরবারী মুছে ফেলেছ?’

তারা বলল, ‘না’’।

তারপর নাবী কারীম (ﷺ) উভয়ের তরবারী দেখলেন এবং বললেন, ‘তোমরা উভয়েই তাকে হত্যা করেছ।’

অবশ্য আবূ জাহলের সামান অর্থাৎ জিনিসপত্রগুলো তিনি মু’আয বিন ‘আমর বিন জামুহকে প্রদান করেন। আবূ জাহলের এ দু’হত্যাকারীর নাম হল, (১) মু’আয বিন ‘আমর বিন জামুহ এবং (২) মু’আয বিন আফরা-।[1]

ইবনে ইসহাক্ব বর্ণনা করেছেন যে, মু’আয বিন ‘আমর বিন জামুহ বলেছেন, ‘আমি মুশরিকদিগকে আবূ জাহল সম্পর্কে বলতে শুনলাম যে, সে ঘন গাছগুলোর মতো বর্শা ও তরবারীর ভিড়ের মধ্যে ছিল। তারা একথাও বলছিল যে, আবুল হাকাম পর্যন্ত কেউ পৌঁছতে পারবে না।’

মু’আয বিন ‘আমর আরও বলেছেন যে, ‘যখন আমি একথা শুনলাম তখন তাকে আমার লক্ষ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে নিলাম এবং তার প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করে রাখলাম। তারপর যখন সুযোগ পেয়ে গেলাম তখনই আক্রমণ করে বসলাম এবং এমনভাবে আঘাত করলাম যে, তার পা দ্বিখন্ডিত হয়ে খুলে পড়ে গেল। আল্লাহর কসম! যখন তার পায়ের অর্ধাংশ খুলে পড়ে গেল তখন আমি তার সাদৃশ্য শুধু ঐ ফলের বীচি দ্বারা বর্ণনা করতে পারি যা হাতুড়ির সাহায্যে আলগা করা হয় এবং এর এক অংশ থেকে অন্য অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

তিনি আরও বর্ণনা করেছেন যে, ‘এদিকে আমি যখন আবূ জাহলকে আঘাত করলাম অন্য দিকে তখন তার ছেলে ইকরামা আমার কাঁধে তরবারীর আঘাত করল এবং তাতে আমার হাত কেটে গিয়ে চামড়ার সঙ্গে ঝুলে গেল এবং যুদ্ধের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। আমি সেটি পিছনে টেনে নিয়ে সাধারণভাবে যুদ্ধ করতে থাকলাম। কিন্তু সে যখন আমাকে খুবই কষ্ট দিতে লাগল তখন আমি তার উপর আমার পা রেখে জোরে টান দিয়ে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললাম।[2]

এরপর আবূ জাহলের নিকট পৌঁছে যান মু’আয বিন আফরা। তিনি তাকে এত জোরে আঘাত করেন যে, তার ফলে সে সেখানেই স্ত্তপে পরিণত হয়ে যায়। সে সময় শুধু তার শ্বাস-প্রশ্বাসটুকু অবশিষ্ট ছিল। এরপর মু’আয বিন আফরা যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যান।

যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘কে আছ এমন যে, দেখে আসবে আবূ জাহলের অবস্থা কি হল। এ কথা শুনে সাহাবীগণ (রাঃ) তার খোঁজে বিক্ষিপ্তভাবে নানাদিকে চলে গেলেন। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) তাকে এমন অবস্থায় পেলেন যে, তখনো তার শ্বাস-প্রশ্বাস যাওয়া আসা করছিল। তিনি তার গ্রীবার উপর পা রেখে মাথা কেটে নেয়ার জন্য দাড়ি ধরলেন এবং বললেন, ‘ওহে আল্লাহর শত্রু! শেষে আল্লাহ তোমাকে এভাবে অপমানিত করলেন? সে বলল, ‘আমাকে কী প্রকারে লাঞ্ছিত করলেন?’ যে ব্যক্তিকে তোমরা হত্যা করছো তার চেয়ে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন লোক কেউ আছে কি? অথবা যে লোকটিকে তোমরা হত্যা করছো তার চেয়ে উঁচু সম্মানের কোন লোক আছে কি?’ তারপর সে বলল, ‘যদি আমাকে কৃষকরা ছাড়া অন্য কেউ হত্যা করত তবে কতই না ভাল হতো!’ তারপর সে বলল, ‘আচ্ছা, আমাকে বলত আজ বিজয় লাভ কার হয়েছে?’ আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহ এবং তার রাসূল (ﷺ)-এর।’ তারপর সে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ)-কে বলল- যিনি তার গ্রীবার উপর পা রেখেছিলেন- হে বকরীর রাখাল! তুমি বড় উঁচু ও কঠিন জায়গায় চড়ে গিয়েছো। প্রকাশ থাকে যে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) মক্কায় বকরী চরাতেন।

এ কথোপকথনের পর আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) তার মস্তক কেটে নিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে নিয়ে গিয়ে হাজির করে দিলেন এবং আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এটা আল্লাহর শত্রু আবূ জাহলের মস্তক।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তিনবার বললেন,

‏‏(‏اللهُ الَّذِيْ لَا إِلٰهَ إِلَّا هُوَ‏؟‏‏)‏

‘‘সত্যিই, ঐ আল্লাহর শপথ যিনি ছাড়া অন্য কোন মা’বূদ নেই।’ তারপর বললেন,

‏‏(‏اللهُ أَكْبَرُ، الحَمْدُ لِلهِ الَّذِيْ صَدَقَ وَعْدَهُ، وَنَصَرَ عَبْدَهُ، وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ، اِنْطَلَقَ أُرْنِيَهُ‏)

অর্থঃ আল্লাহ সবচেয়ে মহান। ঐ আল্লাহর সমুদয় প্রশংসা যিনি তাঁর ওয়াদাকে সত্য প্রমাণিত করেছেন। স্বীয় বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই সমস্ত দলকে পরাজিত করেছেন।’

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘চলো আমাকে তার মৃত দেহ দেখাও।’ (আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, ‘আমি তাঁকে নিয়ে গিয়ে তার মৃতদেহ দেখালাম। তিনি বললেন, ‘ঐ ব্যক্তি এ উম্মতের ফিরাউন।’

[1] সহীহুল বুখারী ১/৪৪৪ পৃঃ, ২/৫৬৮ পৃঃ, মিশকাত ২/৩৫২ পৃঃ, অন্য বর্ণনায় দ্বিতীয় নাম মোআওয়ায বিন আফরা বলা হয়েছে। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৬৩৫ পৃঃ, আবূ জাহলের জিনিসপত্র এক জনকে এ কারণে দেয়া হয়েছিল যে, পরে মু’আয (মুআওয়ায) সেই যুদ্ধেই শহীদ হয়েছিলেন। তবে আবূ জাহলের তরবারী আব্দুল্লাহ বিন মাসউদকে দেয়া হয়েছিল। কারণ, সেই তার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। দ্রঃ সুনানে আবূ দাউদ, বাবু মান আজাযা আলা জীবীহিন ২য় খন্ড ৩৭৩ পৃঃ।

[2] মু’আয বিন আমর বিন জামুহ উসমান (রাঃ)-এর খিলাফত পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।

ঈমানের উজ্জ্বলতায় গৌরবোজ্জ্বল চিত্রাবলী (مِنْ رَوَائِعِ الْإِيْمَانِ فِيْ هٰذِهِ الْمَعْرِكَةِ):

উমায়ের ইবনু হাম্মাম (রাঃ) এবং আউফ ইবনু হারিস ইবনু আফরা’র (রাঃ) ঈমান দীপ্ত চরিত কথার বিষয়াবলী ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এ যুদ্ধে পদে পদে এমন সব দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়েছে যেগুলোতে ঈমানী শক্তি ও মৌলিক নীতিমালার পরিপক্কতা সুস্পষ্ট ও সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এ যুদ্ধে পিতা ও পুত্র এবং ভাই ও ভাইয়ের মধ্যে দল বিভাগ বা শ্রেণীবিন্যাস হয়েছে, আর মূল নীতির ব্যাপারে মতানৈক্যের কারণে তরবারী কোষমুক্ত হয়েছে। এভাবে অত্যাচারিত ব্যক্তিও অত্যাচারীর উপর আঘাত হেনে ক্রোধাগ্নি প্রশমিত করেছে। পরবর্তী আলোচানা থেকে এর যথার্থতা প্রমাণিত হবে।

১. ইবনু ইসহাক্ব ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, নাবী কারীম (ﷺ) সাহাবীগণ (রাঃ)-কে বলেন,

‏‏(‏إِنِّيْ قَدْ عَرَفْتُ أَنَّ رَجُالًا مِنْ بَنِيْ هَاشِمٍ وَغَيْرِهِمْ قَدْ أَخْرَجُوْا كُرْهًا، لَا حَاجَةَ لَهُمْ بِقِتَالِنَا، فَمَنْ لَقِىْ أَحَدًا مِنْ بَنِيْ هَاشِمٍ فَلَا يَقْتُلْهُ، وَمَنْ لَقِىَ أَبَا الْبَخْتَرِيِّ بْنِ هِشَامٍ فَلَا يَقْتُلْهُ، وَمَنْ لَقِىْ الْعَبَّاسَ بْنَ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَلَا يَقْتُلْهُ، فَإِنَّهُ إِنَّمَا أُخْرِجَ مُسْتَكْرَهًا‏)

‘আমি জানি যে, বনু হাশিম এবং আরও কোন কোন গোত্রের কতগুলো লোককে জোর করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আনয়ন করা হয়েছে। আমাদের যুদ্ধের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং বনু হাশিমের কোন লোক কারো তরবারীর সামনে পড়ে গেলে সে যেন তাকে হত্যা না করে। আবুল বাখতারী বিন হিশাম কারো সামনে এসে পড়লে তাকে যেন সে হত্যা না করে। আর আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব কারো সামনে পড়ে গেলে তাকেও যেন হত্যা করা না হয়। কেননা তাকে জোর করে এ যুদ্ধে নিয়ে আসা হয়েছে।’

এ কথা শুনে ‘উতবাহর পুত্র আবূ হুযাইফা (রাঃ) বললেন, ‘আমরা কি আমাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা ও আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করব, আর আব্বাস (রাঃ)-কে ছেড়ে দিব? আল্লাহর কসম! যদি তিনি আমার সামনে পড়ে যান তবে আমি তাকে তরবারীর লাগাম পরিয়ে দিব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এ খবর পৌঁছলে তিনি উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ)-কে বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চাচার চেহারার উপর কি তরবারীর আঘাত করা হবে?’ উত্তরে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমাকে ছেড়ে দিন, আমি তরবারী দ্বারা এ ব্যক্তির গর্দান উড়িয়ে দেই। কেননা, এ ব্যক্তি মুনাফিক্ব হয়ে গেছে।’

পরবর্তীকালে আবূ হুযাইফা (রাঃ) বলতেন, ‘ঐ দিন আমি যে কথা বলে ফেলেছিলাম তার কারণে আমি কোন সময় মনে শান্তি পাই না। এ ব্যাপারে বরাবরই আমার মনে ভয় থেকে যায়। এটা হতে মুক্ত হওয়ার একটি মাত্র উপায় হলো আমার শাহাদতের মাধ্যমে এর কাফ্ফারা হয়ে যাওয়া।’ অবশেষে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শহীদ হয়ে যান।

২. আবুল বাখতারীকে হত্যা করতে নিষেধ করার কারণ ছিল এ ব্যক্তি মক্কায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কষ্ট দেয়া হতে সবচেয়ে বেশী বিরত থেকে ছিল। সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কোন প্রকারের কষ্ট দিত না এবং তার পক্ষ হতে তিনি কখনো কোন অপছন্দনীয় কথা শোনেননি। আর এ ব্যক্তি ঐ লোকদের একজন ছিল যারা বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিবের বয়কট পত্রটি ছিঁড়ে ফেলেছিল।

কিন্তু তা সত্ত্বেও আবুল বাখতারী শেষে নিহতই হয়েছিল। ঘটনাটি হল মুজাযযার ইবনু যিয়াদ বালাভী (রাঃ)-এর সাথে তার লড়াই হয়। তার সাথে তার অন্য এক সঙ্গীও ছিল। দুজন এক সাথে যুদ্ধ করছিল। মুজাযযার (রাঃ) তাকে বলেন, ‘হে আবুল বাখতারী! আপনাকে হত্যা করতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে নিষেধ করেছেন।’ সে বলে ‘আমার সাথীকেও কি?’ মুজাযযার (রাঃ) উত্তরে বলেন, ‘না, আল্লাহর কসম! আপনার সাথীকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি না।’ সে তখন বলল, ‘আল্লাহর কসম! তাহলে আমি এবং সে দুজনই মরবো।’ এরপর দুজনই যুদ্ধ শুরু করে দেয়। মুজাযযার (রাঃ) বাধ্য হয়ে তাকেও হত্যা করেন।

৩. মক্কায় জাহেলিয়াত যুগে আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ) ও উমাইয়া ইবনু খালফের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ছিল। বদর যুদ্ধের দিন উমাইয়া ইবনু খালফ তার ছেলে আলীর হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল। এমন সময় আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ) সেখান দিয়ে গমন করেন। তিনি শত্রুর নিকট হতে কিছু লৌহ বর্ম ছিনিয়ে নিয়ে তা উটের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। উমাইয়া তাঁকে দেখে বলে, ‘তুমি আমার কোন প্রয়োজন বোধ কর কি? আমি তোমার এ লৌহ বর্মগুলো হতে উত্তম। আজকের মতো দৃশ্য আমি কোন দিন দেখিনি। তোমার দুধের কি প্রয়োজন নেই।’ সে একথা দ্বারা বুঝাতে চেয়েছিল যে, আমাকে বন্দী করবে তাকে মুক্তি পণ হিসেবে বহু দুগ্ধবতী উট প্রদান করব।’

তার এ কথা শুনে আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ) লৌহবর্মগুলো ফেলে দিয়ে পিতা-পুত্র দুজনকে গ্রেফতার করে সামনে অগ্রসর হলেন।

আব্দুর রহমান (রাঃ) বলেন, ‘আমি উমাইয়া এবং তার পুত্রের মাঝে হয়ে চলছিলাম এমতাবস্থায় উমাইয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি কে ছিল যে তার বক্ষে উটপাখির পালক লাগিয়ে রেখে ছিল।’ আমি উত্তরে বললাম উনি ছিলেন হামযাহ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)। সে তখন বলল এ সেই ব্যক্তি যে আমাদের মধ্যে ধ্বংস রচনা করে রেখেছিল।’

আব্দুর রহমান (রাঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি দুজনকে নিয়ে চলছিলাম অকস্মাৎ বিলাল (রাঃ) উমাইয়াকে আমার সাথে চলতে দেখে নেন। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, এ উমাইয়া মক্কায় বিলাল (রাঃ)-এর উপর অমানুষিক উৎপীড়ন করেছিল। বিলাল (রাঃ) বললেন, ‘এ হচ্ছে কাফিরদের নেতা উমাইয়া ইবনু খালফ । হয় আমি বাঁচবো না হয় সে বাঁচবে। আমি বললাম, হে বিলাল (রাঃ) এটা হচ্ছে আমার বন্দী। তিনি আবার বললেন, এখন দুনিয়াতে হয় আমি থাকবো, না হয় সে থাকবে।’ তারপর তিনি অত্যন্ত উচ্চৈঃস্বরে ডাক দিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর আনসারগণ! এ হচ্ছে কুফর নেতা উমাইয়া ইবনু খালফ। এখন হয় আমি থাকবো, অথবা সে থাকবে। আব্দুর রহমান (রাঃ) বললেন, ‘ইতোমধ্যে জনগণ আমাদেরকে কংকণের মতো বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে নিল। আমি তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু একটি লোক তার পুত্রের পায়ে তরবারীর আঘাত হেনে দিলো। আর সাথে সাথে সে পড়ে গেল। ও দিকে উমাইয়া এত জোরে চিৎকার করল যে, এরূপ চিৎকার আমি কখনই শুনিনি। আমি বললাম, ‘পালিয়ে যাও। কিন্তু আজ পালাবার কোন উপায় নেই। আল্লাহর কসম! আজ আমি তোমার কোন উপকার করতে পারবো না।’ আব্দুর রহমান (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, জনগণ তরবারী দ্বারা তাদের দুজনকে কেটে ফেলে তাদের জীবন লীলা শেষ করে দেয়। এরপর আব্দুর রহমান (রাঃ) বলতেন, ‘আল্লাহ বিলালের উপর রহম করুন। আমার লৌহবর্মও গেল এবং আমার বন্দীর ব্যাপারে আমাকে ব্যাকুলও হতে হলো।’

ইমাম বুখারী (রহ.) আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, উমাইয়াহ বিন খালফ এ মর্মে আমার সাথে একটি চুক্তিপত্র লিখেছিল যে, সে মক্কায় আমার পরিবার-পরিজনকে হেফাজত করবে আর আমি মদীনায় তার পরিবার-পরিজনকে হেফাজত করবো। অতঃপর বদর যুদ্ধের দিন মানুষেরা ঘুমিয়ে পড়ার পর পাহাড়ের দিকে গেলাম তাকে হেফাজ করার জন্য। কিন্তু পথিমধ্যে বিলাল দেখে ফেলে। অতঃপর আনসারদের দলে গিয়ে এ বলে ঘোষণা দেয় যে,হয় আমি মরব, অথবা উমাইয়া বিন খালাফ মরবে। এরপর বিলালের সাথে আনসারদের এক দল যোদ্ধা আমাদেরকে নিকেট আসতে থাকে। আমি যখন এ আশঙ্কা করলাম যে লোকেরা আমাদের ধরে ফেলবে তখন আমি উমাইয়ার ছেলেকে আমার পেছনে নিয়ে নিলাম যাতে তারা তাকে হত্যা করতে না পারে। কিন্তু লোকেরা তাকে হত্যা করে ফেলল। আর তার পিতার শরীর খুব ভারী ছিল। লোকেরা আমার কাছে পৌছলে আমি উমাইয়া ইবনু খালফকে বললাম, ‘তুমি হাঁটুর ভরে বসে পড়।’ সে বসে গেল এবং আমি তার উপর চড়ে বসলেন। কিন্তু লোকেরা নীচ দিয়ে তরবারী মেরে উমাইয়াকে হত্যা করল।

কোন একটি তরবারীর আঘাতে আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ)-এর পা আহত হয়েছিল।[1] আবদুর রহমান পরবর্তীতে তার পায়ের সেই আঘাতের চিহ্ন দেখিয়েছেন।

৪. উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) তার মামা আস ইবনু হিশাম ইবনু মুগীরাহকে হত্যা করেন। সেদিন আত্মীয় সম্পর্কের প্রতি ভ্রুক্ষেপই করেন নি। কিন্তু মদীনায় ফিরে আসার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র চাচা ‘আব্বাসকে বললেন, (সে সময় ‘আব্বাস বন্দী ছিলেন) হে ‘আব্বাস! আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন। আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমার পিতা খাত্তাব ইসলাম গ্রহণের চেয়ে আপনার ইসলাম গ্রহণটা অধিক প্রিয়। অধিকন্তু আপনার ইসলাম গ্রহণের ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যার পরই না খুশি হতেন।

৫. আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) স্বীয় পুত্র আব্দুর রহমানকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন যখন সে মুশরিকদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল ‘ওরে দুরাচার আমার মাল কোথায়’’? আব্দুর রহমান উত্তরে বলেছিল :

لَمْ يَبْقَ غَيْرُ شَكَّةٍ ويَعْبُوْب ** وصَارِمٍ يَقْتُلُ ضُلاَّل الشِّيَبْ

অর্থাৎ অস্ত্র, শস্ত্র, দ্রুতগামী অশ্ব এবং ঐ তরবারী ছাড়া কিছুই বাকী নেই যা বার্ধক্যের ভ্রষ্টতার সমাপ্তি ঘটিয়ে থাকে।

৬. যখন মুসলিমরা মুশরিকদেরকে গ্রেফতার করতে শুরু করেন তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছাউনীর মধ্যে অবস্থান করছিলেন এবং সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) তরবারী হাতে দরজার উপর পাহারা দিচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লক্ষ্য করলেন যে, সা‘দ (রাঃ)-এর চেহারায় মুসলিমদের এ কার্যকলাপ অপছন্দনীয় হওয়ার লক্ষণ প্রকাশিত হচ্ছে। তাই, তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে সা‘দ (রাঃ), আল্লাহর কসম! বুঝা যাচেছ যে, মুসলিমদের এ কার্যকলাপ তোমার পছন্দ হচ্ছে না, তাই নয় কি? সা‘দ (রাঃ) উত্তরে বললেন, ‘জ্বী হ্যাঁ’’, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! মুশরিকদের সাথে এটাই প্রথম যুদ্ধ, যার সুযোগ আল্লাহ তা‘আলা আমাদের দান করেছেন। সুতরাং মুশরিকদেরকে ছেড়ে দেয়ার পরিবর্তে অধিক সংখ্যায় হত্যা করে ফেলাই আমার নিকট বেশী পছন্দনীয়।’

৭. এ যুদ্ধে উকাশাহ ইবনু মুহসিন আসাদী (রাঃ)-এর তরবারী ভেঙ্গে যায়। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে হাযির হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে কাঠের একটা ভাঙ্গা থাম্বা প্রদান করেন এবং বলেন ‘উকাশাহ (রাঃ) তুমি এটা দ্বারাই যুদ্ধ কর’। উকাশাহ (রাঃ) ওটা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট হতে নিয়ে নড়ানো মাত্রই একটা লম্বা, শক্ত সাদা চকচকে তরবারীতে পরিবর্তিত হয়। তারপর তিনি ওটা দ্বারাই যুদ্ধ করেন এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমগণকে বিজয় দান করেন। ঐ তরবারীখানা স্থায়ীভাবে উকাশাহ (রাঃ)-এর কাছেই থাকে এবং তিনি ওটাকে বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যবহার করেন। অবশেষে আবূ বাকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি শহীদ হন। ঐ সময়েও ঐ তরবারীটি তার কাছেই ছিল।

৮. যুদ্ধ শেষে মুসআ’ব ইবনু উমায়ের আবদারী (রাঃ) তার ভাই আবূ উযায়ের ইবনু উমায়ের আবদারীর পার্শ্ব দিয়ে গমন করেন। আবূ উযায়ের মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল এবং ঐ সময় একজন আনসারী সাহাবী তাঁর হাত বাঁধছিলেন। মুসআব (রাঃ) ঐ আনসারীকে বললেন ‘এ ব্যক্তির মাধ্যমে আপনি আপনার হাতকে দৃঢ় করুন। এর মা খুবই ধনবতী মহিলা। অবশ্যই সে আপনাকে উত্তম মুক্তিপণ দিবে।’ একথা শুনে আবূ উযায়ের তার ভাই মুসআ’ব (রাঃ)-কে বলল, ‘আমার ব্যাপারে তোমার উপদেশ এটাই?’ মুসআ’ব (রাঃ) উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমার পরিবর্তে এ আনসারই আমার ভাই।’

৯. মুশরিকদের মৃতদেহগুলোকে যখন কূপে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়া হলো এবং ‘উতবাহ ইবনু রাবীআহকে কূপের দিকে হেঁচড়িয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার পুত্র আবূ হুযাইফা (রাঃ)-এর চেহারার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। তখন দেখলেন যে, তিনি দুঃখিত হয়েছেন এবং তার চেহারা পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবূ হুযাইফাহ, নিশ্চয়ই তোমার পিতার এ অবস্থা দেখে তোমার অন্তরে কিছু অনুভূতি জেগেছে, তাই না?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আল্লাহর শপথ! আমার পিতার ব্যাপারে এবং তার হত্যার ব্যাপারে আমার অন্তরে একটুও শিহরণ উঠেনি। তবে অবশ্যই আমার পিতা সম্পর্কে আমি জানতাম যে, তার মধ্যে বিবেক, বুদ্ধি, দূরদর্শিতা ও ভদ্রতা রয়েছে। এ জন্য আমি আশা করতাম যে, এ গুণাবলী তাকে ইসলাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিবে। কিন্তু এখন তার পরিণাম দেখে এবং আমার আশার বিপরীত কুফরের উপর তার জীবনের সমাপ্তি দেখে আমি দুঃখিত হয়েছি। তাঁর এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর মঙ্গলের জন্যে দুআ করলেন এবং তার সাথে উত্তমরূপে বাক্যালাপ করলেন।

[1] যা’দুল মায়া’দ ২য় খন্ড ৮৯ পৃঃ। সহীহুল বুখারীর ১ম খন্ড ১০৮ পৃঃ। কিতাবুল অকালাহ এর মধ্যে এ ঘটনাটি কিছু বেশী আংশিক ব্যাখ্যা সহ বর্ণিত হয়েছে।

 উভয় দলের নিহত ব্যক্তিবর্গ (قَتْلَى الْفَرِيْقَيْنِ):

এ যুদ্ধ মুশরিকদের প্রকাশ্য পরাজয় এবং মুসলিমদের সুস্পষ্ট বিজয়ের উপর সমাপ্ত হয়। এতে চৌদ্দজন মুসলিম শহীদ হন, ছয় জন মুহাজির এবং আট জন আনসার। কিন্তু মুশরিকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের সত্তর জন নিহত এবং সত্তর জন বন্দী হয়। এদের অধিকাংশই ছিল নেতৃস্থানীয় লোক।

যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিহতদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের নাবী (ﷺ)-এর কতই না নিকৃষ্ট গোষ্ঠী ও গোত্র ছিলে। তোমরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছ। তোমরা আমাকে বন্ধুহীন ও সহায়কহীনরূপে ছেড়ে দিয়েছো যখন অন্যরা আমার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। তোমরা আমাকে বের করে দিয়েছ, যখন অন্যরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে।’ এরপর তাঁর নির্দেশক্রমে তাদের টেনে হেঁচড়ে বদরের একটি কূপে নিক্ষেপ করা হয়।

আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নাবী (ﷺ)-এর আদেশক্রমে বদরের দিন কুরাইশদের চবিবশ জন বড় বড় নেতার মৃত দেহ বদরের একটি নোংরা কূপে নিক্ষেপ করা হয়।

তাঁর নিয়ম ছিল যখন তিনি কোন কাওমের উপর বিজয় লাভ করতেন তখন তিন দিন পর্যন্ত যুদ্ধ ক্ষেত্রেই অবস্থান করতেন। সুতরাং যখন বদরে তৃতীয় দিবস সূচিত হল তখন তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর সওয়ারীর উপর হাওদা উঠিয়ে দেয়া হলো। তারপর তিনি পদব্রজে চলতে থাকলেন এবং তাঁর পিছনে পিছনে তাঁর সাহাবীগণও চললেন। অবশেষে তিনি কূপের ধারে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাদেরকে তাদের নাম ধরে ও তাদের পিতাদের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। (তিনি বললেন) হে অমুকের পুত্র অমুক, হে অমুকের পুত্র অমুক! তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্য করতে এটা কি তোমাদের জন্য খুশীর বিষয় হতো না। কেননা, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমরা তো তা সত্য পেয়েছি। আর তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে যা কিছু বলেছিলেন তা তোমরা সত্যরূপে পেয়েছ কি?’ উমার (রাঃ) তখন আরয করলেন ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি এমন দেহসমূহের সঙ্গে কথা বলছেন যে গুলোর আত্মা নেই, ব্যাপার কী?’ নাবী (ﷺ) উত্তরে বললেন, ‘যে সত্ত্বার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! আমি যা কিছু বলছি তা এদের চেয়ে বেশী তোমরা শুনতে পাওনা।’ রেওয়াইয়াতে রয়েছে যে, নাবী (ﷺ) বলেন, ‘তোমরা এদের চেয়ে বেশী শুনতে পাওনা। কিন্তু এরা উত্তর দিতে পারে না।[1]

[1] সহীহুল বুখারী ও সহীহুল মুসলিম। মিশকাত, ২য় খন্ড ৩৪৫ পৃঃ।

 মক্কায় পরাজয়ের খবর (مَكَّةُ تَتَلَقّٰى نَبَأَ الْهَزِيَمْةِ):

মুশরিকরা বদর প্রান্তর হতে বিশৃঙ্খল, ছত্রভঙ্গ ও ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় মক্কামুখী হয়। শরম ও সংকোচের কারণে তাদের ধারণায় আসছিল না যে, কিভাবে তারা মক্কায় প্রবেশ লাভ করবে।

ইবনু ইসহাক্ব বলেন যে, যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম কুরাইশদের পরাজয়ের সংবাদ বহন করে মক্কায় পৌঁছেছিল, সে হলো হাইসামান ইবনু আব্দুল্লাহ কুযায়ী। জনগণ তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘যুদ্ধের খবর কী?’ সে উত্তরে বলল, ‘‘উতবাহ ইবনু রাবীআহ, শায়বাহ ইবনু রাবীআহ, আবুল হাকাম ইবনু হিশাম, উমাইয়া ইবনু খালফসহ আরো কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে যারা সবাই নিহত হয়েছে। সে যখন নিহতদের তালিকায় সম্ভ্রান্ত কুরাইশদের নাম উল্লেখ করতে শুরু করল তখন হাতীমের উপর উপবিষ্ট সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া বলল, ‘আল্লাহর কসম! যদি তার স্বাভাবিক জ্ঞান থেকে থাকে তবে তাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর?’ জনগণ তখন তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা বলত সাফওয়ান ইবনু উমাইয়ার কী হয়েছে?’ সে উত্তরে বলল ‘ঐ দেখ, সে হাতীমে উপবিষ্ট রয়েছে। আল্লাহর কসম! তার পিতা ও ভ্রাতাকে নিহত হতে স্বয়ং আমিই দেখেছি।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র আযাদকৃত দাস আবূ রাফি (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ ‘আমি ঐ সময় আব্বাস (রাঃ)-এর গোলাম ছিলাম। আমাদের বাড়িতে ইসলাম প্রবেশ করেছিল। আব্বাস (রাঃ) মুসলিম হয়েছিলেন, উম্মুল ফযল (রাঃ) মুসলিম হয়েছিলেন এবং আমিও মুসলিম হয়েছিলাম। তবে অবশ্যই আব্বাস (রাঃ) তার ইসলাম গোপন রেখেছিলেন। এদিকে আবূ লাহাব বদর যুদ্ধে হাযির হয়নি। যখন কুরাইশদের পরাজয়ের খবর তার কানে পৌঁছল তখন লজ্জায় ও অপমানে তার মুখ কালো হয়ে গেল। পক্ষান্তরে আমরা নিজেদের মধ্যে শক্তি ও সম্মান অনুভব করলাম। আমি দুর্বল মানুষ ছিলাম, তীর বানাতাম এবং যমযম কক্ষে বসে তীরের হাতল ছিলতাম। আল্লাহর কসম! ঐ সময় আমি কক্ষে বসে তীর ছিলছিলাম। উম্মুল ফযল (রাঃ) আমার পাশেই বসেছিলেন এবং যে খবর এসেছিল তাতে আমরা খুশী ও আনন্দিত ছিলাম। ইতোমধ্যে আবূ লাহাব জঘন্যভাবে তার পদদ্বয় টেনে টেনে আমাদের কাছে এসে কক্ষপ্রান্তে বসে পড়লো। তার পৃষ্ঠ আমার পৃষ্ঠের দিকে ছিল। হঠাৎ গোলমাল শোনা গেল, ‘আবূ সুফইয়ান ইবনু হারিস ইবনু আব্দুল মুত্তালিব এসে গেছে।’ আবূ লাহাব তাকে বলল, ‘হে আমার প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র। আমার কাছে এসো। আমার জীবনের শপথ! তোমার নিকট হতে খবর পাওয়া যাবে।’ তিনি আবূ লাহাবের কাছে বসে পড়লেন। জনগণ দাঁড়িয়ে ছিল। আবূ লাহাব বলল, লোকদের কী অবস্থা? ‘বল ভাতিজা, যুদ্ধের খবর কী?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘কিছুই নয়, এটুকুই বলা যথেষ্ট যে, লোকদের মুসলিমদের সাথে মোকাবেলা হয়েছে এবং আমরা আমাদের কাঁধগুলো তাদেরকে সোপর্দ করেছি। তারা আমাদের ইচ্ছামত হত্যা করেছে এবং বন্দী করেছে। তা সত্ত্বেও আমি আমাদের লোকদেরকে তিরষ্কার করতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের মোকাবালা এমন কতিপয় লোকের সঙ্গে হয়েছিল যারা আসমান ও জমিনের মধ্যস্থানে সাদাকালো মিশ্রিত ঘোড়ার উপর সওয়ার ছিল। আল্লাহর শপথ! না তারা কোন কিছু ছেড়ে দিচ্ছিল, না কোন জিনিস তাদের মোকাবালায় টিকতে পারছিল।’

আবূ রাফি (রাঃ) বলেন, আমি স্বীয় হাত দ্বারা তাঁবুর প্রান্ত উঠালাম, তারপর বললাম, ‘আল্লাহর শপথ! তারা ছিলেন ফিরিশতা’। আমার এ কথা শুনে আবূ লাহাব তার হাত উঠিয়ে ভীষণ জোরে আমার গালে এক চড় লাগিয়ে দিল। আমি তখন তার সাথে লড়ে গেলাম। কিন্তু সে আমাকে উঠিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর আমার উপর হাঁটুর ভরে বসে আমাকে প্রহার করতে লাগল। আমি দুর্বল প্রমাণিত হলাম। কিন্তু ইতোমধ্যে উম্মুল ফযল উঠে তাঁবুর একটি খুঁটি নিয়ে তাকে এমনভাবে মারলেন যে, তার মাথায় ভীষণভাবে আঘাত লাগল। আর সাথে সাথে উম্মুল ফযল (রাঃ) বলে উঠলেন, ‘তার মনিব নেই বলে তাকে দুর্বল মনে করছো। আবূ লাহাব তখন লজ্জিত হয়ে উঠে চলে গেল। এরপর আল্লাহর কসম! মাত্র সাত দিন অতিবাহিত হয়েছে এরই মধ্যে আল্লাহর হুকুমে সে আদাস নামক কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হলো এবং এতেই তার জীবনলীলা শেষ হয়ে গেল। আদাসার ফোড়াকে আরবরা বড়ই কুলক্ষণ মনে করত। তাই, তার মৃত্যুর পর তার পুত্ররা তার গোর-কাফন না করে তিন দিন পর্যন্ত তাকে উপরেই রেখে দেয়। কেউই তার নিকটে গেল না এবং তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থাও করলনা। অবশেষে যখন তার পুত্ররা আশঙ্কা করল যে, তাকে এভাবে রেখে দিলে জনগণ তাদেরকে তিরস্কার করবে তখন তারা একটি গর্ত খনন করে ঐ গর্তের মধ্যে তার মৃত দেহকে কাঠ দ্বারা ঢেকে ফেলে দিল এবং দূর থেকেই ঐ গর্তের মধ্যে পাথর নিক্ষেপ করে তাকে ঢেকে ফেললো।

মোট কথা, এভাবে মক্কাবাসীগণ তাদের লোকদের সুস্পষ্ট পরাজয়ের খবর পেলো এবং তাদের স্বভাবের উপর এর অত্যন্ত খারাপ প্রতিক্রিয়া হলো। এমনকি তারা নিহতদের উপর বিলাপ করতে নিষেধ করে দিল যাতে মুসলিমরা তাদের দুঃখে আনন্দিত হওয়ার সুযোগ না পায়।

এ ব্যাপারে একটি চিত্তাকর্ষক ঘটনা রয়েছে। তা হচ্ছে বদরের যুদ্ধে আসওয়াদ ইবনু আব্দুল মুত্তালিবের তিনটি পুত্র মারা যায়। তাদের জন্য সে কাঁদতে চাচ্ছিল। সে ছিল অন্ধ লোক। একদা রাত্রে সে এক বিলাপকারিণী মহিলার বিলাপের শব্দ শুনতে পেল। তৎক্ষণাৎ সে তার গোলামকে বলল ‘তুমি গিয়ে দেখ তো, বিলাপ করার কি অনুমতি পাওয়া গেছে? কুরাইশরা কি নিহতদের জন্য ক্রন্দন করছে? তাহলে আমিও আমার পুত্র আবূ হাকিমের জন্য ক্রন্দন করব। কেননা, আমার বুক জ্বলে যাচ্ছে।’ গোলাম ফিরে এসে খবর দিল ‘মহিলাটি তো তার এক হারানো উটের জন্য ক্রন্দন করছে।’ এ কথা শুনে আসওয়াদ নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। আবেগে সে নিম্নের বিলাপ পূর্ণ কবিতাটি বলে ফেললোঃ

أتبكي أن يضل لها بـعـير ** ويمنعها من النوم السهود

فلا تبكي على بكر ولكـن ** على بدر تقاصرت الجدود

على بدر سراة بني هصيص ** ومخزوم ورهط أبي الوليد

وبكى إن بكيت على عقيل ** وبكى حارثا أسد الأسود

وبكيهم ولا تسمى جميعـا ** وما لأبي حكيمة من نديد

ألا قد ساد بعدهـم رجال ** ولولا يوم بدر لم يسودوا

অর্থঃ ‘তার উট হারিয়ে গেছে এজন্যে কি সে কাঁদছে? আর ওর জন্যে অনিদ্রা কি তার নিদ্রাকে হারাম করে দিয়েছে। (হে মহিলা) তুমি উটের জন্যে ক্রন্দন করো না, বরং বদরের (নিহতদের) জন্যে ক্রন্দন করো, যেখানে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে গেছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বদরের (বেদনাদায়ক ঘটনার) জন্যে ক্রন্দন করো যেখানে বনু হাসীস, বনু মাখযূম, আবুল ওয়ালীদ প্রভৃতি গোত্রের অসাধারণ ব্যক্তিবর্গ (সমাধিস্থ) রয়েছে। যদি ক্রন্দন করতেই হয় তবে আকীলের জন্যে ক্রন্দন করো এবং হারিসের জন্যে ক্রন্দন করো যারা ছিল সিংহদের সিংহ। তুমি ঐ লোকদের জন্যে ক্রন্দন করো এবং সবার নাম নিও না। আর আবূ হাকীমার তো কোন সমকক্ষই ছিল না। দেখ ওদের পরে এমন লোকেরা নেতা হয়ে গেছে যে, ওরা থাকলে এরা নেতা হতে পারত না।’

 মদীনায় বিজয়ের শুভ সংবাদ (المَدِيْنَةُ تَتَلَقّٰى أَنْبَاءَ النَّصْرِ):

এদিকে মুসলিমদের বিজয় পূর্ণতায় পৌঁছে গেলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনাবাসীকে অতি শীঘ্র শুভ সংবাদ দেয়ার জন্যে দুজন দূতকে প্রেরণ করেন। একজন আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রাঃ) যাকে মদীনার উচ্চ ভূমি অঞ্চলের অধিবাসীদের নিকট প্রেরণ করা হয় এবং অপর জন যায়দ ইবনু হারিসাহ (রাঃ) যাকে মদীনার নিম্নভূমি অঞ্চলের অধিবাসীদের নিকট পাঠানো হয়।

ঐ সময়ে ইয়াহুদী ও মুনফিকরা এ গুজব রটিয়ে দিয়েছিল। যে মুসলিমরা পরাজিত হয়েছে। এমন কি এ গুজবও তারা রটিয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং একজন মুনাফিক্ব যখন যায়দ ইবনু হারিস (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উষ্ট্র কাসওয়ার উপর সাওয়ার হয়ে আসতে দেখলো তখন বলে উঠল ‘সত্যিই মুহাম্মাদ (ﷺ) নিহত হয়েছেন। দেখ, এটা তো তারই উট। আমরা এটাকে চিনি। আর এ ব্যক্তি যায়দ ইবনু হারিসাহ (রাঃ) পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসেছে এবং সে এত ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছে যে, কী বলবে তা বুঝতে পারছে না।’ মোট কথা, যখন দুজন দূত মদীনায় পৌঁছলেন তখন মুসলিমরা তাদেরকে ঘিরে নেন এবং তাদের মুখে বিস্তারিত খবর শুনতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তাদের দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, মুসলিমরা বিজয় লাভ করেছেন। এরপর চতুর্দিকে আনন্দের ঢেউ উথলে ওঠে এবং মদীনার আকাশ-বাতাস তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হতে থাকে। যে সব মর্যাদাসম্পন্ন নেতৃস্থানীয় সাহাবী মদীনাতেই রয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এ প্রকাশ্য বিজয়ের মুবারকবাদ জানাবার জন্যে বদরের রাস্তার উপর বেরিয়ে পড়েন।

উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘আমাদের নিকট এ সুসংবাদ ঐ সময় পৌঁছে যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কন্যা ও উসমান (রাঃ)-এর সহধর্মিনী রুকাইয়া (রাঃ)-কে দাফন করে মাটি বরাবর করা হয়েছিল। তাঁর শুশ্রূষার জন্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে উসমান (রাঃ)-এর সাথে মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন।

 মুসলিম সেনাবাহিনী মদীনার পথে (الجَيْشُ النَّبَوِيْ يَتَحَرَّكُ نَحْوَ الْمَدِيْنَةِ):

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধ শেষে তিন দিন বদরে অবস্থান করেন এবং তখনও তিনি যুদ্ধক্ষেত্র হতে যাত্রা শুরু করেন নি এর মধ্যেই গণীমতের মাল নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং এ মতভেদ চরম সীমায় পৌঁছে যায়। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নির্দেশ দেন যে, যার কাছে যা আছে তা যেন সে তাঁর কাছে জমা দেয়। সাহাবীগণ (রাঃ) তাঁর এ নির্দেশ পালন করেন এবং এরপর আল্লাহ তা‘আলা ওহীর মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করে দেন।

উবাদাহ ইবনু সামিত (রাঃ) বর্ণনা করেছেনঃ ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মদীনা হতে যাত্রা শুরু করে বদর প্রান্তরে উপনীত হলাম। লোকদের (মুশরিকদের) সাথে আমাদের যুদ্ধ হলো এবং আল্লাহ তা‘আলা শত্রুদেরকে পরাজিত করলেন। তারপর আমাদের মধ্যে একটি দল তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল এবং তাদেরকে ধরতে ও হত্যা করতে লাগল। আর একটি দল গণীমতের মাল লুট করতে ও জমা করতে থাকল। অন্য একটি দল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে চতুর্দিকে থেকে পরিবেষ্টন করে থাকলেন যাতে শত্রুরা প্রতারণা করে তাকে কোন কষ্ট দিতে না পারে। যখন রাত্রি হলো এবং প্রতিটি দল একে অপরের সাথে মিলিত হলো তখন গণীমত একত্রিতকারীরা বলল, ‘আমরা এগুলো জমা করেছি। সতুরাং এতে অন্য কারো কোন অংশ নেই।’ শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবনকারীরা বলল, ‘তোমরা আমাদের চেয়ে বেশী এর হকদার নও। কেননা, আমরা এ মাল হতে শত্রুদের তাড়ানো ও দূর করানোর কাজ করেছি।’ আর যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হিফাযতের কাজ করেছিল তারা বলল ‘আমরা এ আশঙ্কা করেছিলাম যে, আমাদের অবহেলার কারণে শত্রুরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে। এ জন্যে আমরা তার হিফাযতের কাজে নিয়োজিত থেকেছি। সুতরাং আমরা এর বেশী হকদার।’ তখন আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াত অবতীর্ণ করলেন :

(‏يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الأَنفَالِ قُلِ الأَنفَالُ لِلهِ وَالرَّسُوْلِ فَاتَّقُوْا اللهَ وَأَصْلِحُوْا ذَاتَ بِيْنِكُمْ وَأَطِيْعُوْا اللهَ وَرَسُوْلَهُ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِيْنَ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏1‏]‏‏

‘‘তারা তোমাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। বল, ‘যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের; কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আর নিজেদের সম্পর্ককে সুষ্ঠু সুন্দর ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত কর। তোমরা যদি মু’মিন হয়ে থাক তবে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর।’ (আল-আনফাল ৮ : ১)

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ গনীমতের মাল মুসলিমদের মধ্যে বন্টন করে দেন।[1]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তিন দিন বদরে অবস্থানের পর মদীনার পথে যাত্রা শুরু করেন। তাঁর সাথে মুশরিক বন্দীরাও ছিল এবং মুশরিকদের নিকট হতে প্রাপ্ত গণীমতের মালও ছিল। তিনি তাদের পাহারার দায়িত্ব আব্দুল্লাহ ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর উপর অর্পণ করেন। যখন তিনি সাফরা উপত্যকায় গিরিপথ হতে বের হয়ে একটি টিলার উপর বিশ্রাম গ্রহণ করেন তখন তিনি সেখানে গণীমাতের এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকী মাল মুসলিমদের মধ্যে সমভাবে বন্টন করে দেন। আর সাফরা উপত্যকাতেই তিনি নাযর ইবনু হারিসের হত্যার নির্দেশ দেন। এ ব্যক্তি বদরের যুদ্ধে মুশরিকদের পতাকা ধরে রেখেছিল এবং সে কুরাইশদের বড় বড় অপরাধীদের একজন ছিল। ইসলামের শত্রুতায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কষ্ট প্রদানে সে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশক্রমে আলী (রাঃ) তাকে হত্যা করেন।

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরকুয যুবয়্যাহ নামক স্থানে পৌঁছে উকবাহ ইবনু আবী মুআইত্বকে হত্যা করার আদেশ জারী করেন। এ লোকটি যেভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কষ্ট দিয়েছিল তার কিছু আলোচনা ইতোপূর্বে করা হয়েছে। এ সেই ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সালাতের অবস্থায় তাঁর পিঠের উপর উটের ভূঁড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল এবং সে তার গলায় চাদর জড়িয়ে দিয়ে তাঁকে মেরে ফেলার ইচ্ছা করেছিল এবং আবূ বাকর (রাঃ) সেখানে সময়মত এসে না পড়লে সে তো তাকে গলা টিপে মেরেই ফেলত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন তখন সে বলে ওঠে ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ) আমার সন্তানদের জন্য কে আছে?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘আগুন’’। তারপর আসিম ইবনু সাবিত (রাঃ) এবং মতান্তরে আলী (রাঃ) তার গর্দান উড়িয়ে দেন।[2]

সামরিক নীতি অনুযায়ী এ দুরাচার ব্যক্তিদ্বয়ের হত্যা অপরিহার্য ছিল। কেননা, তারা শুধু বন্দী ছিল না, বরং আধুনিক পরিভাষার দিক থেকে যুদ্ধ অপরাধীও ছিল।

[1] মুসনাদে আহমাদ ৫ম খন্ড ৩২৩ ও ৩২৪ পৃঃ এবং হাকিম ২য় খন্ড ৩২৮ পৃঃ।

[2] এ হাদীসটি সহীহুল গ্রন্থসমূহে বর্ণিত যথা সুনানে আবূ দাউদ , আওনুল মা’বুদে ৩য় খন্ড ১২ পৃঃ।

 অভ্যর্থনাকারী প্রতিনিধিদল (وُفُوْدُ التَّهْنِئَةِ):

এরপর যখন মুসলিম সেনাবাহিনী রাওহা নামক স্থানে পৌঁছেন তখন ঐ মুসলিম প্রতিনিধি দলের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয় যারা দূতদ্বয় মারফত বিজয়ের শুভ সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অভ্যর্থনার জন্যে এবং তাকে বিজয়ের মুবারকবাদ জানাবার জন্যে মদীনা হতে বের হয়ে এসেছিলেন। যখন তারা মুবারকবাদ পেশ করলেন তখন সালামাহহ ইবনু সালামাহ্ (রাঃ) বললেন, ‘আপনারা আমাদেরকে মুবারকবাদ দিচ্ছেন কেন? আল্লাহর শপথ! আমাদের মোকাবেলা তো টেকো মাথাবিশিষ্ট বুড়োদের সাথে হয়েছিল, যারা ছিল উটের মত।’ তার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুচকি হেসে বললেন, ‘ভ্রাতুষ্পুত্র, এরাই ছিল কওমের নেতৃস্থানীয় লোক বা নেতা।’

তারপর উসায়েদ ইবনু হুযায়ের (রাঃ) আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আল্লাহর জন্যেই সমস্ত প্রশংসা যে, তিনি আপনাকে সফলতা দান করেছেন এবং আপনার চক্ষুদ্বয় শীতল করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি একথা মনে করে বদরে গমন হতে পিছনে থাকি নি যে, আপনার মোকাবেলা শত্রুদের সাথে হবে। আমি তো ধারণা করেছিলাম যে, এটা শুধু কাফেলার ব্যাপার। আমি যদি বুঝতাম যে, শত্রুদের মুখোমুখী হতে হবে তবে আমি কখনো পিছনে থাকতাম না।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন তাকে বললেন? তুমি সত্য কথাই বলেছ।

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনা মুনাওওরায় বিজয়ীর বেশে এমনভাবে প্রবেশ করলেন যে, মদীনা শহর এবং তাঁর আশপাশের শত্রুদের উপর তাঁর চরম প্রভাব প্রতিফলিত হল। এ বিজয়ের ফলে মদীনার বহু লোক দলে দলে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এ সময়েই আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই এবং তার সঙ্গীরা শুধু লোক দেখানো ইসলাম গ্রহণ করে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মদীনায় আগমনের এক দিন পর বন্দীদের আগমন ঘটে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে সাহাবীগণের (রাঃ) মধ্যে বন্টন করে দেন এবং তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের পরামর্শ প্রদান করেন। এ পরামর্শের কারণে সাহাবীগণ (রাঃ) নিজেরা খেজুর খেতেন এবং বন্দীদেরকে রুটি খাওয়াতেন। কেননা মদীনায় খেজুর ছিল সাধারণ খাদ্য এবং রুটি ছিল বিশেষ মূল্যবান খাদ্য।

 বন্দীদের সম্বন্ধে পরামর্শ (قَضِيَّةُ الْأَسَارِى):

মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীদের সঙ্গে বন্দীদের ব্যাপারে পরামর্শ করেন। আবূ বাকর (রাঃ) নিবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এরা সবাই আমাদের চাচাত ভাই, বংশীয় লোক এবং আত্মীয়। আমার মতে মুক্তিপণ হিসেবে কিছু কিছু অর্থ নিয়ে এদেরকে মুক্তি দেয়া উচিত। এতে আমাদের সাধারণ তহবিল যথেষ্ট অর্থ সঞ্চিত হবে। পক্ষান্তরে অল্প দিনের মধ্যে এদের সবার পক্ষে ইসলাম গ্রহণ করাও সম্ভব হবে। তখন তাদেরকে আমাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে আমরা ব্যবহার করতে পারব।

তারপর নাবী কারীম (ﷺ) খাত্তাবের পুত্রকে (উমার (রাঃ)) সম্বোধন করে বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র, তোমার অভিমত কী? উত্তরে উমার (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! এ ব্যাপারে আমি আবূ বকরের সঙ্গে একমত হতে পারছিনা। আমার মত হচ্ছে যে, অমুককে (যিনি উমারের আত্মীয় ছিলেন) আমার হাওয়ালা করে দেন, আমি তাকে হত্যা করি। আকীল বিন আবি তালেবকে আলীর হাওয়ালা করে দিন। তিনি তাকে হত্যা করবেন এবং অমুককে (যিনি হামযাহর ভাই ছিলেন) হামযাহর হালওয়ালা করে দিন, তিনি তাকে হত্যা করবেন। যাতে করে আল্লাহ এটা বোঝেন যে, আমাদের অন্তরে মুশরিকদের সম্পর্কে কোন প্রকার দুর্বলতা নেই। আর এরা ছিল মুশরিকদের সার্বক্ষণিক অগ্রণী নেতা। এরা ইসলামের চির শত্রু এবং মুসলিমদের প্রাণের বৈরী। আমাদেরকে নির্যাতিত করতে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করতে এবং আল্লাহর সত্য ধর্মকে জগতের পৃষ্ঠ হতে মুছে ফেলতে এরা সাধ্যপক্ষে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। এরা অন্যায়, অধর্ম ও অত্যাচারের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। এদেরকে অবিলম্বে হত্যা করে ফেলা হোক। প্রত্যেক মুসলিম উলঙ্গ তরবারী হাতে দন্ডায়মান হোক এবং নিজ হাতে নিজের আত্মীয়বর্গের মুন্ডপাত করুক, আমার এটাই মত।’

উমার (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ বাকর (রাঃ)-এর মতকেই পছন্দ করলেন, আমার মতকে পছন্দ করলেন না। সুতরাং বন্দীদের নিকট থেকে মুক্তিপণ নেয়ার সিন্ধান্ত গৃহীত হলো। পরের দিন আমি সকাল সকাল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং আবূ বাকর (ﷺ)-এর খিদমতে হাযির হলাম। দেখি যে, তাঁরা দুজনই ক্রন্দন করছেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলুন, আপনারা কেন কাঁদছেন? যদি ক্রন্দনের কোন কারণ থাকে তাহলে আমিও ক্রন্দন করব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তরে বললেন ‘মুক্তিপণ গ্রহণ করার কারণে তোমার সঙ্গীদের উপর যে জিনিস পেশ করা হয়েছে সে কারণেই কাঁদছি।’ আর তিনি নিকটবর্তী একটি গাছের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, ‘আমার সামনে তাদের শাস্তিকে এ গাছের চেয়েও বেশী নিকটবর্তীরূপে পেশ করা হয়েছে।’ তারপর আল্লাহ তা‘আলা নিম্নলিখিত আয়াত নাযিল করেন,

(‏مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَن يَكُوْنَ لَهُ أَسْرَى حَتّٰى يُثْخِنَ فِي الأَرْضِ تُرِيْدُوْنَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللهُ يُرِيْدُ الآخِرَةَ وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ لَّوْلاَ كِتَابٌ مِّنَ اللهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيْمَا أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏67، 68‏]‏‏

‘‘কোন নাবীর জন্য এটা সঠিক কাজ নয় যে, দেশে (আল্লাহর দুশমনদেরকে) পুরোমাত্রায় পরাভূত না করা পর্যন্ত তার (হাতে) যুদ্ধ-বন্দী থাকবে। তোমরা দুনিয়ার স্বার্থ চাও আর আল্লাহ চান আখিরাত (এর সাফল্য), আল্লাহ প্রবল পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞানী। – আল্লাহর লেখন যদি পূর্বেই লেখা না হত তাহলে তোমরা যা (মুক্তিপণ হিসেবে) গ্রহণ করেছ তজ্জন্য তোমাদের উপর মহাশাস্তি পতিত হত।’ (আল-আনফাল ৮ : ৬৭-৬৮)

আল্লাহর পক্ষ থেকে আগিই সে নির্দেশ এসেছিল তা হল:

(‏فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاء‏)‏

‘অতঃপর তখন হয় অনুকম্পা; নয় মুক্তিপণ’। (মুহাম্মাদ : ৪ আয়াত)

যেহেতু এ বিধানে বন্দীদের নিকট হতে মুক্তিপণ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে সেহেতু মুক্তিপণ গ্রহণ করার কারণে সাহাবীগণ (রাঃ)-কে শাস্তি দেয়া হয় নি, বরং তাদেরকে শুধু তিরস্কার ও নিন্দা করা হয়েছে যে, ভালোভাবে কাফেরদেরকে উত্তম মাধ্যম দেয়ার আগেই বন্দী করে নিয়েছিলেন এবং এ জন্যও যে, তাঁরা এমন যুদ্ধ অপরাধীদের নিকট থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করেছিলেন যারা বড় অপরাধী ছিল, যাদের উপর আধুনিক আইনও মুকদ্দমা না চালিয়ে ছাড়ত না, এদের মুকদ্দমার ফায়সালাও সাধারণত মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতো।

যা হোক, আবূ বাকর (রাঃ)-এর অভিমত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল বলে মুশরিকদের নিকট হতে মুক্তিপণ গৃহীত হয়। মুক্তিপণের পরিমাণ চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত ছিল। মক্কাবাসীগণ লেখা পড়াও জানত, পক্ষান্তরে মদীনাবাসীগণ লেখাপড়া জানত না বললেই চলে। এ জন্যে এ সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছিল যে, যে মুক্তিপণ দিতে অসমর্থ হবে সে মদীনার দশজন ছেলেকে লেখাপড়া শিখাবে। যখন এ ছেলেগুলো উত্তমরূপে লেখাপড়া শিখে নিবে তখন এটাই তার মুক্তিপণ হিসেবে বিবেচিত হবে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কয়েকজন বন্দীর উপর অনুগ্রহও করেছেন এবং তাদেরকে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্ত করে দিয়েছেন। এ তালিকায় মুত্তালিব ইবনু হানতাব, সাইফী ইবনু আবী রিফাআহ এবং আবূ ইযযাহ জুমাহীর নাম পাওয়া যায়। শেষের দুজনকে উহুদের যুদ্ধে বন্দী ও হত্যা করা হয়। (বিস্তারিত বিবরণ সামনে আসছে)।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বীয় জামাতা আবুল আসকেও বিনা মুক্তিপণে এ শর্তে ছেড়ে দেন যে, সে তার কন্যা যায়নাব (রাঃ)-এর পথ রোধ করবে না। এর কারণ এই ছিল যে, যায়নাব (রাঃ) আবুল আসের মুক্তিপণ হিসেবে কিছু মাল পাঠিয়েছিলেন যার মধ্যে একটি হারও ছিল। এ হারটি প্রকৃত পক্ষে খাদীজাহ (রাঃ)-এর ছিল। যায়নাব (রাঃ)-কে আবুল আসের নিকট বিদায় দেয়ার সময় তিনি তাকে এ হারটি প্রদান করেছিলেন। হারটি দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মধ্যে ভাবাবেগ সৃষ্টি হয়। তাই, তিনি সাহাবীদের (রাঃ) নিকট অনুমতি চান যে, আবুল আসকে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্ত করে দেয়া হোক। সাহাবীগণ সন্তুষ্টচিত্তে এটা মেনে নেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবুল আসকে এ শর্তে ছেড়ে দেন যে, সে যায়নাব (রাঃ)-এর পথরোধ করতে পারবে না। এ শর্তানুসারে আবুল আস তাঁর পথ ছেড়ে দেয় এবং যায়নাব (রাঃ) মদীনায় হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যায়দ ইবনু হারিসাহ (রাঃ) এবং একজন আনসারী সাহাবী (রাঃ)-কে এ উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁরা বাতনে ইয়াজিজ নামক স্থানে অবস্থান করবেন, যায়নাব (রাঃ) তাদের পাশ দিয়ে গমনকালে তাঁরা তাঁর সাথী হয়ে যাবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এ নির্দেশ অনুযায়ী তাঁরা দুজন যায়নাব (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। যায়নাব (রাঃ)-এর হিজরতের ঘটনাটি খুবই দীর্ঘ ও হৃদয়বিদারক।

বন্দীদের মধ্যে সুহায়েল ইবনু ‘আমরও ছিল। সে ছিল বড় বাকপটু ভাল বক্তা। উমার (রাঃ) আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! সুহায়েল ইবনু আমরের সামনের দাঁত দুটি ভেঙ্গে দেয়া হোক, যাতে সে কোন জায়গায় বক্তা হয়ে আপনার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে না পারে।’ কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। কেননা এটা মুসলাহ (নাক, কান কর্তিত) এর অন্তর্ভুক্ত। যার কারণে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে পাকড়াও এর আশঙ্কা থাকবে।

সা‘দ ইবনু নু’মান (রাঃ) উমরাহ করার জন্যে বের হলে আবূ সুফইয়ান তাকে বন্দী করে ফেলেন। আবূ সুফইয়ানের পুত্র ‘আমরও বদরযুদ্ধে বন্দীদের একজন ছিল। ‘আমরকে আবূ সুফইয়ানের নিকট পাঠিয়ে দিলে তিনি সা‘দ (রাঃ)-কে ছেড়ে দেন।

 এ যুদ্ধ সম্পর্কে কুরআনের পর্যালোচনা (القُرْآنُ يَتَحَدَّثُ حَوْلَ مَوْضُوْعِ الْمَعْرِكَةِ):

এ যুদ্ধ সম্পর্কে সূরাহ আনফাল অবতীর্ণ হয়। প্রকৃতপক্ষে এ সূরাহটি এ যুদ্ধের উপর আল্লাহ প্রদত্ত এক বিশদ বর্ণনা। আর আল্লাহ তা‘আলার এ বর্ণনা বাদশাহ ও কমান্ডারদের বিজয় বর্ণনা হতে সম্পূর্ণ পৃথক। এ বিশদ বর্ণনার কয়েকটি কথা হচ্ছে :

আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম মুসলিমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ঐ অসতর্কতা ও চারিত্রিক দুর্বলতার প্রতি যা মোটের উপর তাদের মধ্যে বাকী রয়ে গিয়েছিল। আর যেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু এ যুদ্ধে প্রকাশও পেয়ে গিয়েছিল। তাদের এ মনোযোগ আকর্ষণের উদ্দেশ্য ছিল তারা নিজেদেরকে এ সব দুর্বলতা হতে পবিত্র করে পরিপূর্ণতা লাভ করবে।

এরপর মহান আল্লাহ এ বিজয়ে স্বীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও গায়েবী সাহায্যের অন্তভুক্তির বর্ণনা দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমরা নিজেদের সাহস ও বীরত্বের প্রতারণায় যেন না পড়ে। কেননা, এর ফলে স্বভাব ও প্রকৃতির মধ্যে গর্ব ও অহংকার সৃষ্টি হয়। বরং তারা যেন আল্লাহ তা‘আলার উপরই নির্ভরশীল হয় এবং তাঁর ও তাঁর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনুগত্য স্বীকার করে।

তারপর ঐ সব মহৎ উদ্দেশ্যের আলোচনা করা হয়েছে যার জন্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে পা রেখেছিলেন এবং এর মধ্যে ঐ চরিত্র ও গুণাবলী চিহ্ণিত করা হয়েছে যা যুদ্ধসমূহে বিজয়ের কারণ হয়ে থাকে।

তারপর মুশরিক মুনাফিক্ব, ইহুদী এবং যুদ্ধবন্দীদেরকে এমন মর্মস্পর্শী উপদেশ দেয়া হয় যাতে তারা সত্যের সামনে ঝুঁকে পড়ে এবং ওর অনুসারী হয়ে যায়।

এরপর মুসলিমগণকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ব্যাপারে সম্বোধন করে এ বিজয়ের সমুদয় বুনিয়াদী নিয়ম-কানুন ও নীতিমালা বুঝানো হয় ও বলে দেয়া হয়।

তারপর এ স্থানে ইসলামী দাওয়াতের জন্যে যুদ্ধ ও সন্ধির যে নীতিমালার প্রয়োজন ছিল ও গুলোর বিশ্লেষণ ও বিবরণ দেয়া হয়েছে। যাতে মুসলিমদের যু্দ্ধ এবং জাহেলিয়াত যুগের যুদ্ধের মধ্যে স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং চরিত্র ও কর্মের ক্ষেত্রে মুসলিমদের উৎকৃষ্টতা লাভ হয়, আর দুনিয়ার মানুষ উত্তমরূপে জেনে নেয় যে, ইসলাম শুধু মাত্র একটা মতবাদ নয়, বরং সে যে নীতিমালা ও রীতিনীতির প্রতি আহবানকারী, স্বীয় অনুসারীদেরকে ওগুলো অনুযায়ী আমল করার শিক্ষাও দিয়ে থাকে।

তারপর ইসলামী হুকুমতের কয়েকটি দফা বর্ণনা করা হয়েছে যেগুলো দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী হুকমতের গন্ডীর মধ্যে বসবাসকারী মুসলিম ও এর বাইরে বসবাসকারী মুসলিমদের মধ্যে কতই না পার্থক্য রয়েছে।

 বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীঃ

হিজরী ২য় সনে রমাযানের রোযা এবং সাদকায়ে ফিতর ফরজ করা হয়, আর যাকাতের বিভিন্ন নিসাব ও ধনের পরিমাণ যা থাকলে যাকাত ফরজ হয়, নির্দিষ্ট করা হয়। সাদকায়ে ফিতর ফরজ ও যাকাতের নিসাব নির্দিষ্ট করণের ফলে ঐ বোঝা ও কষ্ট অনেকাংশ হালকা হয়ে গেল যা বহু সংখ্যক দরিদ্র মুহাজির বহণ করে আসছিলেন। কেননা, তাঁরা জীবিকার সন্ধানে ভূপৃষ্ঠে ঘুরেও জীবিকার ব্যবস্থা করতে অপারগ হচ্ছিলেন।

তারপর অত্যন্ত সুন্দর ও মোক্ষম ব্যবস্থা এই ছিল যে, মুসলিমরা তাদের জীবনে যে প্রথম ঈদ উদযাপন করেছিলেন তা ছিল ২য় হিজরীর শাওয়াল মাসের ঈদ, যা বদর যুদ্ধের প্রকাশ্য বিজয়ের পর হাযির হয়েছিল। কতই না সুন্দর ছিল এ সৌভাগ্যের ঈদ, যে সৌভাগ্য আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের মস্তিষ্কে বিজয় ও সম্মানের মুকুট পরানোর পর দান করেছিলেন। আর কতই না ঈমানের ছিল এ ঈদের সালাতের দৃশ্য যা মুসলিমরা নিজেদের ঘর হতে বের হয়ে তকবীর তাওহীদ ধ্বনিতে গগণ পবন মুখরিত মাঠে গিয়ে আদায় করে থাকেন। ঐ সময় অবস্থা ছিল মুসলিমদের অন্তরে ছিল আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতরাশি ও তাঁর দেয়া সাহায্যের কারণে তাঁর করুণা ও সন্তুষ্টি লাভের আগ্রহে উচ্ছ্বসিত এবং বিজয়োন্মাদনার উল্লাসে পরিপূর্ণ। তাদের ললাটগুলো তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্যে ঝুঁকে পড়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা এ নিয়ামতের বর্ণনা নিম্নের আয়াতে দিয়েছেনঃ

(‏وَاذْكُرُوْا إِذْ أَنتُمْ قَلِيْلٌ مُّسْتَضْعَفُوْنَ فِي الأَرْضِ تَخَافُوْنَ أَن يَتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآوَاكُمْ وَأَيَّدَكُم بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏26‏]‏‏.

‘‘স্মরণ কর সে সময়ের কথা যখন তোমরা ছিলে সংখ্যায় অল্প, দুনিয়াতে তোমাদেরকে দুর্বল হিসেবে গণ্য করা হত। তোমরা আশঙ্কা করতে যে, মানুষেরা তোমাদের কখন না হঠাৎ ধরে নিয়ে যায়। এমন অবস্থায় তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দিলেন, তাঁর সাহায্য দিয়ে তোমাদেরকে শক্তিশালী করলেন, তোমাদের উত্তম জীবিকা দান করলেন যাতে তোমরা (তাঁর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (আল-আনফাল ৮ : ২৬)

 বদর পরবর্তী সময়ের তৎপরতা (النَّشَاطُ الْعَسْكَرِيْ بَيْنَ بَدْرٍ وَّأُحُدٍ)

বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলিম এবং মুশরিকদের মধ্যে সর্ব প্রথম অস্ত্রের লড়াই এবং মীমাংসাসূচক সংঘর্ষ। এ সংঘর্ষে মুসলিমগণ প্রকাশ্য বিজয় লাভ করেন এবং সমগ্র আরব তা প্রত্যক্ষ করে। এ যুদ্ধের ফলে যারা সরাসরি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারাই মর্মাহত হয়েছিল সব চাইতে বেশী অর্থাৎ মক্কার মুশরিকেরা। তাছাড়া ঐ সকল লোকও যারা মুসলিমদের বিজয় ও সফলতাকে নিজেদের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করেছিল, অর্থাৎ ইহুদীর। সুতরাং মুসলিমগণ যখন বদর যুদ্ধে কল্পনাতীতভাবে বিজয় লাভ করলেন তখন এ দুটি দল মুসলিমদের প্রতি ক্রোধ, ক্ষোভ ও মন পীড়ায় জ্বলে পুড়ে মরতে লাগল। কুরআনুল কারীমে যেমনটি ইরশাদ হয়েছেঃ

‏(‏لَتَجِدَنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَدَاوَةً لِّلَّذِيْنَ آمَنُوْا الْيَهُوْدَ وَالَّذِيْنَ أَشْرَكُوْا‏)‏ ‏[‏المائدة‏:‏82‏]‏

‘‘যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রতি মানুষের মধ্যে ইয়াহূদ ও মুশরিকদেরকে তুমি অবশ্য সবচেয়ে বেশি শত্রুতাপরায়ণ দেখতে পাবে।’ (আল-মায়িদা ৫ : ৮২)

মদীনায় কিছু লোক এ দুটি দলের সঙ্গী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। তারা যখন দেখল যে, তাদের মান মর্যাদা সমুন্নত রাখার এখন আর কোন পথ রইল না তখন তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামে প্রবেশ করল।

এটা ছিল আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার বন্ধু বান্ধবের দল। ইহুদী এবং মুশরিকদের তুলনায় মুসলিমদের প্রতি এরাও কম ক্ষোভ হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করত না।

এদের ছাড়া চতুর্থ একটি দলও ছিল। অর্থাৎ ঐ সব বেদুঈন যারা মদীনার চতুষ্পার্শে বসবাস করত। কুফর কিংবা ঈমান কোন কিছুর প্রতিই তাদের কোন আকর্ষণ কিংবা আবেগের প্রশ্ন জড়িত ছিল না। তারা ছিল লুণ্ঠনকারী দস্যু। এ কারণে বদর যুদ্ধে মুসলিমদের সাফল্যে তারাও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল যে, মদীনায় একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তাদের লুণ্ঠন ও দস্যুবৃত্তির পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে তাদের অন্তরেও মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা দানা বেঁধে ওঠে। যার ফলে তারাও মুসলিমদের শত্রু দলভুক্ত হয়ে পড়ে।

মুসলিমগণ এভাবে চতুর্দিক থেকে বিপদের সম্মুখীন হন। কিন্তু মুসলিমদের ব্যাপারে প্রত্যেক দলের কর্ম পদ্ধতি ছিল অন্যান্য দলের কর্ম পদ্ধতি হতে পৃথক। প্রত্যেক দল নিজেদের অবস্থার প্রেক্ষাপটে এমন সব পন্থা অবলম্বন করেছিল যা তাদের ধারণায় তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ছিল সহায়ক। সুতরাং মদীনাবাসী মুনাফিক্বগণ বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে গোপনে গোপনে ষড়যন্ত্র করে পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার পথ অবলম্বন করল। ইহুদীদের একটি দল খোলাখুলিভাবে মুসলিমদের প্রতি ক্রোধ ও শত্রুতা শুরু করল এবং প্রতিশোধ গ্রহণের প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে থাকল। তাদের সামরিক তৎপরতা এবং প্রস্তুতি ছিল খোলাখুলি, তারা যেন তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে মুসলিমগণকে নিম্নরূপ পয়গাম দিচ্ছিলঃ

ولا بد من يوم أغرّ مُحَجَّل ** يطول استماعي بعده للنوادب

অর্থাৎ এমন এক উজ্জ্বল ও আলোকময় দিনের প্রয়োজন, যার পরে দীর্ঘকাল ধরে বিলাপকারিণীদের বিলাপ শুনতে থাকবো।

আর বছর কাল পরে তারা কার্যতঃ যুদ্ধ করার জন্যে মদীনার উপর চড়াও হল, যা ইতিহাসে উহুদের যুদ্ধ নামে পরিচিত। মুসলিমদের খ্যাতি মর্যাদার উপর এর যথেষ্ট মন্দ প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল।

এ বিপদের মোকাবেলা করার জন্যে মুসলিমগণ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যোগ্য নেতৃত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রকাশ থাকে যে, মদীনার নেতা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চার পাশের এ সব বিপদের ব্যাপারে সদা সচেতন ও সতর্ক ছিলেন এবং এগুলো মোকাবেলা করার জন্য যে, ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন এখানে তারই একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হল।

১. কুদর* নামক স্থানে গাযওয়ায়ে বনী সুলাইমের যুদ্ধ (غَزْوَةُ بَنِيْ سُلَيْمٍ بِالْكُدْرِ):

বদর যুদ্ধের পর সর্ব প্রথম মুসলিম গোয়েন্দা বাহিনী সরবরাহ করেন তা ছিল গাত্বাফান গোত্রের শাখা বনু সুলাইমের লোকেরা মদীনার উপর চড়াও হওয়ার জন্যে সৈন্য সমাবেশ করছে। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে নাবী কারীম (ﷺ) দু’শ জন উষ্ট্রারোহীকে সঙ্গে নিয়ে আকস্মিকভাবে তাদের নিজেদের এলাকায় ধাওয়া করেন এবং কুদর নামক স্থানে তাদর মনযিল পর্যন্ত পৌঁছেন। বনু সুলাইম গোত্র এ আকস্মিক আক্রমণে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে এবং উপায়ন্তর না দেখে উপত্যকার মধ্যে পাঁচশটি উট ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। এগুলোর উপর মদীনার মুসলিম সেনাবাহিনী দখলদার হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এগুলোর এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে অবশিষ্ট মাল গণীমত হিসেবে মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন করে দেন। প্রত্যেকের অংশে দুটি করে উট পড়ে। এ গাযওয়ায় ইয়াসার নামক একটি গোলাম হাতে আসে যাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আযাদ করে দেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনু সুলাইমের বাসভূমিতে তিন দিন অবস্থান করার পর মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।

এ গাযওয়া হিজরী ২য় সনের শাওয়াল মাসে বদর হতে প্রত্যাবর্তনের মাত্র সাত দিন পরে সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধকালীন সময়ে সিবা’ ইবনু ‘উরফুত্বাহ (রাঃ)-কে এবং মতান্তরে ইবনু উম্মু মাকতূম (রাঃ)-কে মদীনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল।[1]

* কুদর প্রকৃত পক্ষে মেটোখাকীরং এর এক প্রকার পাখী। কিন্তু এখানে বানু সুলাইমের একটি প্রস্রবণ উদ্দেশ্য, এটা নজদের মধ্যে অবস্থিত। মক্কা হতে (নজদের পথে) সিরিয়াগামী রাজপথের উপর অবস্থিত।

[1] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯০ পৃঃ, ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৪৩-৪৪ পৃঃ, মুখতাসার সীরাহ শায়খ আব্দুল্লাহ প্রণীত ২৩৬।

 ২. নাবী কারীম (সাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র (مؤامرة لاغتيال النبي ﷺ):

বদর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুশরিকরা ক্ষোভে ও ক্রোধে অগ্নি শর্মা হয়ে ওঠে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হত্যা করে বদর যুদ্ধের গ্লানি ও অপমানের প্রহিশোধ গ্রহণের জন্য ভীষণ ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, দু’ যুবক নিজ বুদ্ধিবলে এ সকল মতভেদ ও এখতেলাফের বুনিয়াদ ও বদর যুদ্ধের অবমাননাকর পরিস্থিতির মূলোৎপাটন করবে অর্থাৎ নাবী (ﷺ)-কে হত্যা করবে।

ফলে বদর যুদ্ধের পরের ঘটনা হল ওহাব ইবনে উমায়ের জুমাহী, যে ছিল কুরাইশদের সব চাইতে বড় শয়তান এবং মক্কাতে নাবী কারীম (ﷺ) ও সাহাবীগণ (রাঃ)-কে যন্ত্রণা দেয়ার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করত তার পুত্র ওহাব ইবনে উমায়ের বদর যুদ্ধে মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়েছিল। এ উমায়ের এক দিন হাতীমে বসে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার সঙ্গে বদরের কূঁয়ায় নিক্ষিপ্ত ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে আলোচনা করছিল। এতে সাফওয়ান বলে উঠল, ‘আল্লাহর শপথ! এরপর আমাদের বেঁচে থাকার আর কোন আকর্ষণ থাকতে পারে না।’

উত্তরে উমায়ের বলল, ‘আল্লাহর কসম! তুমি সত্যই বলেছ। দেখ, আমার যদি ঋণ না থাকত যা পরিশোধ করার মতো অবস্থা বর্তমানে আমার নেই এবং আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যদি না থাকত যা আমার অভাবে বিনষ্ট হওয়ার সম্বাবনা রয়েছে, তবে এখনই আমি বাহনে আরোহণ করে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কাছে যেতাম এবং তাকে হত্যা করে ফেলতাম। কেননা, তার কাছে যাওয়ার কারণ আমার মজুদ রয়েছে। আমার পুত্র তার নিকট বন্দী রয়েছে। সাফওয়ান তার এ কথার উত্তরে বলল, বেশ, তোমার সমস্ত ঋণের আমি যিম্মাদার হচ্ছি এবং তোমার পরিবার প্রতিপালনের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। তোমার সন্তানেরা হবে আমার সন্তান।

উমায়ের বলল, ‘সাবধান! ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে।’ সিদ্ধান্ত হল, সে তার বন্দী সন্তানকে মুক্ত করার অজুহাত নিয়ে মদীনায় গমন করবে এবং সুযোগ মতো অতর্কিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র উপর তরবারী চালাবে। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এ কাজ করতে গিয়ে একাধিক বারের বেশী আঘাত করা হয়ত বা সম্ভব নাও হতে পারে এবং এর ফলে নাবী (ﷺ) আহত হয়েও বেঁচে যেতে পারেন। এ সব ভেবে-চিন্তে উমায়েরের তরবারী খানা তীব্র গরলে সিক্ত করা হল যাতে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে কোন রকমে আঘাত করতে পারলেই তার প্রাণ রক্ষার ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব হয়ে পড়বে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মসজিদে বসে রয়েছেন। উমার (রাঃ) এবং আরও কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) বাইরে বসে বদর যুদ্ধ সম্বন্ধে কথোপকথন করছেন, এমন সময় গলায় তরবারী ঝুলিয়ে উমায়ের মসজিদের দ্বারদেশে উপস্থিত হলো। তখন উমার (রাঃ) তাকে কুরাইশদের অন্যতম শয়তান বলে উল্লেখ করলেন। তার কুটিল চাহনি ও সন্দেহজনক হাবভাব দেখে উমার (রাঃ)-এর মনে খটকা লাগল। তিনি সকলকে সতর্ক হতে ইঙ্গিত করলেন এবং কয়েকজন আনসারকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চারদিকে উপবেশন করার আদেশ দিয়ে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে অবস্থা নিবেদন করলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একটু মধুর হাস্য করে বললেন, ‘বেশ, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ উমার (রাঃ) তখন উমায়েরের কণ্ঠ বিলম্বিত তরবারী ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে মসজিদের মধ্যে উপস্থিত হলেন। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ছেড়ে দিতে আদেশ করলেন এবং উমায়েরকে তাঁর কাছে আসতে বললেন। সে নিকটে এসে বলল, ‘আপনাদের প্রাতঃকাল শুভ হোক।’ নাবী (ﷺ) বললেন, ‘আল্লাহ আমাদেরকে এর চাইতে অনেক ভাল অভিবাদন দান করেছেন অর্থাৎ সালাম, যা হচ্ছে জান্নাতীদের অভিবাদন।’

তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উমায়েরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উমায়ের, কী মনে করে এসেছো?’ সে উত্তরে বলল, ‘হুযূর এ বন্দীদের জন্যে আপনি দয়া করুন।’ তিনি বললেন, ‘এ তো খুব ভাল কথা। কিন্তু এ তরবারী এনেছো কেন?’

উমায়ের উত্তরে দিলো ‘তরবারীর কপাল পুড়ুক, এটা আপনাদের কী ক্ষতি করতে পেরেছে?’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে পুনঃ পুনঃ সত্য বলতে নির্দেশ দিলেন, কিন্তু সে নানা প্রকার টাল বাহানা করে এ কথাই বলতে থাকল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, “তুমি ও সাফওয়ান হাতীমে বসে নিহত কুরাইশদের (বদরের) কুয়ায় নিক্ষেপ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেছিলে। অতঃপর তুমি বলেছ, আমার উপর যদি কোন ঋণ না থাকতো, এবং আমার পরিবারবর্গের ব্যাপারে আশংকা না করতাম- মদীনায় গিয়ে মুহাম্মাদকে হত্যা করতাম। তারপর সাফওয়ান আমাকে হত্যা করার বিনিময়ে তোমার ঋণ এবং পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করে। অথচ আল্লাহ তা’আলা আমার ও তোমার মাঝে বাধাদানকারী”।

‘উমায়ের ভয়-ভক্তি বিজড়িত কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলতে লাগল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহ রাসূল। আসমানী যে কল্যাণ আপনি নিয়ে এসেছেন ও আপনার উপর যে ওহী অবতীর্ণ হতো সেগুলোকে আমরা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছি। অতচ আপনি এমন বিষয় স্পষ্টভাবে বলে দিলেন যা আমি ও সাফওয়ান ব্যতীত আর কেউ জানেনা। অতএব আল্লাহর শপথ! আমি এক্ষণে জানতে পারলাম যে, এটা একমাত্র আল্লাহ আপনাকে জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা যে, তিনি আমাকে সত্যের জ্যোতি সুদর্শনের সৌভাগ্য প্রদান করেছেন এবং আমাকে এক পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। অতঃপর ‘উমায়ের সত্যের সাক্ষ্য দিলেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীদেরকে সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমাদের এ ধর্ম ভ্রাতাকে উত্তমরূপে ধর্ম ও কুরআন শিক্ষা দাও এবং তার প্রার্থিত বন্দীদের মুক্তি দাও।’

কিছুকাল পরে উমায়ের (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে নিবেদন করলেন, ‘মহাত্মন! আমি আল্লাহর জ্যোতিকে নির্বাপিত এবং সত্যের সেবকদেরকে নির্যাতিত করতে সাধ্যপক্ষে চেষ্টার ত্রুটি করিনি। এরূপে যে মহাপাপ আমি সঞ্চয় করেছি, এখন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। আপনি আমাকে অনুমতি দিন, আমি মক্কায় গিয়ে যথাসাধ্য ইসলাম প্রচার করতে থাকি।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উমায়ের (রাঃ)-কে অনুমতি দিলেন এবং স্পর্শমণির সংশ্রবে নতুন জীবন লাভ করে তিনি মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলেন।

এদিকে সাফওয়ান মক্কার লোকদেরকে ইঙ্গিতে বলে রেখেছিল, ‘দেখে নিয়ো, আমি শীঘ্রই এমন এক শুভ সংবাদ দিতে পারবো যার ফলে তোমরা বদর যুদ্ধের সমস্ত শোক ভুলে যাবে।’ কিন্তু উমায়েরকে দেখে সে অবাক হয়ে রইলো। একি! এহেন দুর্ধর্ষ উমায়ের; তার উপরও মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর যাদু খেটে গেল, যাহোক, উমায়ের আর কোন দিকে দৃকপাত না করে নিজের কর্তব্য পালন করে যেতে লাগলেন। তার আদর্শে ও প্রচার মাহাত্মে মক্কার বহু সংখ্যক নরনারী ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিলেন।[1]

[1] ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড ৬৬১-৬৬৩ পৃঃ।

 ৩. গাযওয়ায়ে বনী ক্বাইনুক্কা’ বা ক্বাইনুক্কা’ অভিযান (غَـزْوَةُ بَنِيْ قَيْنُقَـاع):

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় আগমনের পর ইহুদীদের সঙ্গে তিনি যে চুক্তি করেছিলেন তার দফাগুলো ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পূর্ণ চেষ্টা ও ইচ্ছা ছিল যে, এ চুক্তি পত্রে যে সব শর্ত আরোপিত হয়েছে সেগুলো যেন পুরোপুরিভাবে পালিত হয়। সুতরাং মুসলিমরা এমন এক পদও অগ্রসর হননি যা এ চুক্তি নামার কোন একটি অক্ষরেরও বিপরীত হয়। কিন্তু ইহুদীদের ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতা, হঠকারিতা এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গে পরিপূর্ণ। তারা অতি তাড়াতাড়ি তাদের পূর্ব স্বভাবের দিকে ফিরে গেল। তারা মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ এবং গন্ডগোল বাধাবার চেষ্টায় লেগে পড়লো। এর একটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হচ্ছে।

 ইয়াহুদীদের প্রতারণার একটি নমুনা (نَمُوْذَجٌ مِّنْ مَّكِيْدَةِ الْيَهُوْدِ‏‏):

 ইবনু ইসহাক্ব বর্ণনা করেছেন যে, শাস ইবনু ক্বায়স নামক একজন বৃদ্ধ ইয়াহুদী ছিল। তার পা যেন কবরে লটকানো ছিল (অত্যন্ত বৃদ্ধ ছিল)। সে মুসলিমদের প্রতি চরম শত্রুতা ও হিংসা পোষণ করত। সে একদা সাহাবীগণের (রাঃ) একটি মজলিসের পাশ দিয়ে গমন করছিল যে মজলিসে আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্রেরই লোকেরা পরস্পর কথোপকথন করছিলেন। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তার অন্তর হিংসায় জ্বলে উঠল এবং তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার পথ সে অন্বেষণ করতে লাগল। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ঐ দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘকালব্যাপী বিরাজিত শত্রুতা ইসলাম পরবর্তীকালে প্রেম প্রীতিতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল এবং এভাবে তাদের দীর্ঘ কালের দুঃখ-দুর্দশার অবসান হয়েছিল। সমবেত জনতাকে দেখে সে বলতে লাগল এখানে বনু কাইলার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ একত্রিত হয়েছে। আল্লাহর কসম! এ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের নিকট দিয়ে আমার গমন সঙ্গত হবে না। তাই সে তার এক যুবক সঙ্গীকে নির্দেশ দিল যে, সে যেন তাদের মজলিসে যায় এবং তাদের সঙ্গে বসে গিয়ে বুআস যুদ্ধ এবং তার পূর্ববর্তী অবস্থা আলোচনা করে এবং ঐ সময়ে উভয় পক্ষ হতে যে সকল কবিতা পাঠ করা হয়েছিল ওগুলোর কিছু কিছু পাঠ করে শুনিয়ে দেয়। ঐ যুবক ইহুদীকে যা যা বলা হয়েছিল ঠিক সে ঐ রূপই করল।

ঐ কবিতাগুলো শোনা মাত্রই উভয় গোত্রের লোকদের মধ্যে পুরনো হিংসা বিদ্বেষের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল এবং উভয় পক্ষের মধ্যে অনেক বাক বিতন্ডা হয়ে গেল। যুদ্ধের উন্মাদনা নিয়ে উভয় পক্ষের যোদ্ধাগণ হার্রাহ নামক স্থানে সমবেত হলেন।

এ দুঃসংবাদ পাওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুহাজির সাহাবীগণ (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের মাঝে আগমন করে বললেন,

‏‏(‏يا معشر المسلمين، الله الله، أبدعوي الجاهلية وأنا بين أظهركم بعد أن هداكم الله للإسلام، وأكرمكم به، وقطع به عنكم أمر الجاهلية، واستنقذكم به من الكفر وألف بين قلوبكم‏)‏

‘হে মুসলিম সম্প্রদায়! আল্লাহ ক্ষমা করুন, এ কী হচ্ছে? আমার জীবদ্দশাতেই জাহেলিয়াতের চিৎকার? অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে মুসলিম করেছেন, ইসলামের দ্বারা জাহেলিয়াতের মূলোৎপাটন করে তোমাদিগকে কুফর হতে মুক্ত করে তোমাদের পরস্পরের হৃদয়কে এক অপরের সাথে বেঁধে দিয়েছেন।’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এ কথা শুনে নিজেরা নিজেদেরকে সামলিয়ে নিলেন এবং অনুধাবন করলেন যে, এটা শয়তানের প্ররোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারপর তাঁরা পরস্পর গলায়-গলায় মিলে ক্রন্দন এবং তওবাহ করলেন। এভাবে শাস ইবনু কায়েসের প্রতি হিংসার আগুন নির্বাপিত হল।[1]

এটা হচ্ছে কুচক্রীপনা ও গন্ডগোলের একটা নমুনা যা ইহুদীরা মুসলিমদের মধ্যে সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে থাকত। এ কাজের জন্যে তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করত এবং মিথ্যা রটনা রটাতে থাকত। তারা সকালে মুসলিম হয়ে সন্ধ্যায় কাফির হয়ে যেত এবং এভাবে সরল প্রাণ মুসলিমদের অন্তরে সন্দেহের বীজ বপন করার চেষ্টায় লেগে থাকত। কোন মুসলমানের সাথে তাদের অর্থের সম্পর্ক থাকলে তারা তার জীবিকার পথ সংকীর্ণ করে দিত। আর তাদের উপর মুসলিমদের ঋণ থাকলে তারা তাদের ঋণ পরিশোধ করত না, বরং অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করত এবং বলত তোমাদের ঋণ তো আমাদের উপর ঐ সময় ছিল যখন তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মের উপর ছিলে। কিন্তু এখন তোমরা ঐ ধর্ম যখন পরিবর্তন করেছো তখন আমাদের নিকট হতে ঋণ আদায়ের তোমাদের কোন পথ নেই।[2]

প্রকাশ থাকে যে, ইহুদীরা এ সব কার্যকলাপ বদর যুদ্ধের পূর্বেই শুরু করেছিল এবং তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করার সূচনা করে ফেলেছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীদের অবস্থা এই ছিল যে, তারা ইহুদীদের হিদায়াত প্রাপ্তির আশা করে তাদের এ সব কার্যকলাপের উপর ধৈর্য ধারণ করে চলছিলেন। এছাড়া এটাও উদ্দেশ্য ছিল যে, যেন ঐ অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার কোন ব্যাঘাত না ঘটে।

[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৫৫৫-৫৫৬ পৃঃ।

[2] সূরাহ আল-ইমরান প্রভৃতির তাফসীর, মুফাসসিরগণ ইহুদীদের এ সব কার্যকলাপ বর্ণনা দিয়েছেন।

 বনু ক্বাইনুক্কা’র অঙ্গীকার ভঙ্গ (بَنُوْ قَينُقَاع يَنْقُضُوْنَ الْعَهْدَ):

ইহুদীরা যখন দেখল যে, আল্লাহ তা‘আলা বদর প্রান্তরে মুসলিমগণকে চরমভাবে সাহায্য করে তাদেরকে মর্যাদা মন্ডিত করলেন এবং দূরবর্তী নিকটবর্তী প্রতিটি স্থানের বাসিন্দাদের অন্তরে তাদের প্রভাব প্রতিফলিত হল, তখন তাদের প্রতি শত্রুতা ও হিংসায় তারা ফেটে পড়ল। প্রকাশ্যভাবে তারা শত্রুতার ভাব প্রদর্শন করতে লাগল এবং খোলাখুলিভাবে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করল ও দুঃখ কষ্ট দিবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল।

তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হিংসুটে ও প্রতিহিংসাপরায়ন ছিল কাব বিন আশরাফ, যার আলোচনা সামনে আসছে। অনুরূপভাবে ইহুদীদের তিনটি গোত্রের মধ্যে সর্বাধিক হিংসুটে ছিল বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্রটি। এরা সকলেই মদীনার মধ্যে অবস্থান করত এবং তাদের মহল্লাটি তাদের নামেই কথিত ছিল। পেশার দিকে দিয়ে তারা ছিল স্বর্ণকার, কর্মকার ও পাত্র নির্মাতা। এ কারণে ওদের প্রত্যেকের নিকটে বহুল পরিমাণে সমরাস্ত্র মওজুদ ছিল। তাদের যোদ্ধার সংখ্যা সাতশত। তারা ছিল মদীনার সবচেয়ে বাহাদুর ইহুদী গোষ্ঠী। তাদের সর্বপ্রথম অঙ্গীকার ভঙ্গের বিস্তারিত বিবরণ হচ্ছে নিম্নরূপ :

আল্লাহ তা‘আলা যখন বদর প্রান্তরে মুসলিমগণকে বিজয় দান করলেন তখন তাদের বিরুদ্ধাচরণ চরমে উঠল। তারা তাদের প্রতিহিংসা, অন্যায়াচরণ এবং ঝগড়া বাধানোর কার্যকলাপের সীমা আরো বাড়িয়ে দিল। সুতরাং যে মুসলিমই তাদের বাজারে যেতেন তাঁরই তারা ঠাট্টা তামাশা এবং বিদ্রূপাত্মক আচরণ শুরু করে দিত এবং নানাভাবে কষ্ট দিত। এমন কি মুসলিম মহিলাদের নিয়েও তারা উপহাস ও ঠাট্টা বিদ্রূপ করতে কসুর করত না।

এভাবে পরিস্থিতির যখন চরমে পৌঁছল এবং তাদের ঔদ্ধত্যপনা বেড়েই চলল তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং বনু ক্বাইনুক্কা’র বাজারে উপস্থিত হলেন এবং ইহুদীদেরকে ডেকে নানা প্রকার হিতোপদেশ প্রদান করলেন। ইমাম আবূ দাউদ এবং অন্যান্যরা ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বদর প্রান্তরে কুরাইশদেরকে পরাজিত করে যখন মদীনায় আগমন করলেন তখন বনু ক্বাইনুক্কা’র বাজারে ইহুদীদের একত্রিত করে বললেন, ‘হে ইহুদী সমাজ, তোমরা আনুগত্য স্বীকার কর, অন্যথায় কুরাইশদের মতো তোমাদেরকেও বিপন্ন হতে হবে।’

কিন্তু তারা তাঁর উপদেশ গ্রহণ করল না। চরম ধৃষ্টতা সহকারে তারা বলতে লাগল, ‘হে মুহাম্মাদ কতিপয় আনাড়ী কুরাইশকে হত্যা করেছ বলে গর্বিত হয়ো না। যুদ্ধ সম্বন্ধে তারা একেবারে অনভিজ্ঞ ছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যখন যুদ্ধ হবে তখন বুঝবে যে, ব্যাপারটি কত কঠিন।’ তাদের এ সবের জবাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‏(‏قُل لِّلَّذِيْنَ كَفَرُوْا سَتُغْلَبُوْنَ وَتُحْشَرُوْنَ إِلٰى جَهَنَّمَ وَبِئْسَ الْمِهَادُ‏ قَدْ كَانَ لَكُمْ آيَةٌ فِيْ فِئَتَيْنِ الْتَقَتَا فِئَةٌ تُقَاتِلُ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَأُخْرَى كَافِرَةٌ يَرَوْنَهُم مِّثْلَيْهِمْ رَأْيَ الْعَيْنِ وَاللهُ يُؤَيِّدُ بِنَصْرِهِ مَن يَشَاء إِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَعِبْرَةً لَّأُوْلِي الأَبْصَارِ‏)‏ ‏[‏آل عمران 12، 13‏]

‘‘যারা কুফরী করে তাদেরকে বলে দাও, ‘তোমরা অচিরেই পরাজিত হবে আর তোমাদেরকে জাহান্নামের দিকে হাঁকানো হবে, ওটা কতই না নিকৃষ্ট আবাসস্থান’! ১৩. তোমাদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন আছে সেই দু’দল সৈন্যের মধ্যে যারা পরস্পর প্রতিদ্বনদ্বীরূপে দাঁড়িয়েছিল (বাদ্র প্রান্তরে)। একদল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছিল এবং অপরদল ছিল কাফির, কাফিররা মুসলিমগণকে প্রকাশ্য চোখে দ্বিগুণ দেখছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে স্বীয় সাহায্যের দ্বারা শক্তিশালী করে থাকেন, নিশ্চয়ই এতে দৃষ্টিমানদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।’ (আলু-‘ইমরান ৩ : ১২-১৩)

মোট কথা, বনু ক্বাইনুক্কা’ যে জবাব দিয়েছিল তাতে পরিস্কারভাবে যুদ্ধের ঘোষণাই ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ক্রোধ সম্বরণ করে ধৈর্য্য ধারণ করেন। অন্যান্য মুসলিমগণও ধৈর্য্য ধারণ করে পরবর্তী অবস্থার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

এদিকে ঐ হিতোপদেশের পর বনু ক্বাইনুক্কা’র ইহুদীগণের ঔদ্ধত্য আরও বেড়ে যায় এবং অল্প দিনের মধ্যেই তারা মদীনাতে হাঙ্গামা শুরু করে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে তারা নিজের কবর নিজের হাতেই খনন করে এবং নিজেদের জীবন বিপন্ন করে তোলে।

আবূ আওন থেকে ইবনু হিশাম বর্ণনা করেছেন যে, এ সময়ে জনৈকা মুসলিম মহিলা বানুক্বাইনুক্কা’র বাজারে দুধ বিক্রী করে বিশেষ কোন প্রয়োজনে এক ইহুদী স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে বসে পড়েন। কয়েকজন দুর্বৃত্ত ইহুদী তাঁর মুখের অবগুণ্ঠন খোলাবার অপচেষ্টা করে, তাতে মহিলাটি অস্বীকার করেন। এ স্বর্ণকার গোপনে মহিলাটির পরিহিত বস্ত্রের এক প্রান্ত তার পিঠের উপরে গিরা দিয়েছিল, তিনি তা বুঝতেই পারলেন না। তিনি উঠতে গিয়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়লেন। এ ভদ্র মহিলাকে বিবস্ত্র অবস্থায় প্রত্যক্ষ করে নর পিশাচের দল হো হো করে হাত তালি দিতে থাকল। মহিলাটি ক্ষোভে ও লজ্জায় মৃত প্রায় হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন। তা শুনে জনৈক মুসলিম ঐ স্বর্ণকারকে আক্রমণ করে হত্যা করেন। প্রত্যুত্তরে ইহুদীগণ মুসলিমটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যা করে।

এরপর নিহত মুসলিমটির পরিবার বর্গ চিৎকার করে ইহুদীদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের নিকট ফরিয়াদ করলেন। এর ফলে মুসলিম ও বনু ক্বাইনুক্কা’র ইহুদীদের মধ্যে সংঘাত বেধে গেল।[1]

[1] ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৪৭ পৃঃ।

 অবরোধ, আত্মসমর্পণ ও নির্বাসন (الحِصَارُ ثُمَّ التَّسْلِيْمُ ثُمَّ الجلَاءُ):

এ ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। তিনি মদীনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আবূ লুবাবাহ ইবনু আব্দুল মুনযির (রাঃ)-এর উপর অর্পণ করে স্বয়ং হামযাহ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ)-এর হাতে মুসলিমদের পতাকা প্রদান করে আল্লাহর সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বনু ক্বাইনুক্কা’র দিকে ধাবিত হলেন। ইহুদীরা তাদেরকে দেখামাত্র দূর্গের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে দূর্গের দ্বারগুলো উত্তমরূপে বন্ধ করে দিলো। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কঠিনভাবে তাদের দূর্গ অবরোধ করলেন। এ দিনটি ছিল শুক্রবার, হিজরী ২য় সনের শাওয়াল মাসের ১৫ তারীখ। ১৫ দিন পর্যন্ত অর্থাৎ যুলকাদার নতুন চাঁদ উদয় হওয়া অবধি অবরোধ জারী থাকল। তারপর আল্লাহ তা‘আলা ইহুদীদের অন্তরে ভীতি ও সন্ত্রস্তভাব সৃষ্টি করলেন এবং তাঁর নীতি এটাই যে, যখন তিনি কোন সম্প্রদায়কে পরাজিত ও লাঞ্ছিত করার ইচ্ছা করেন তখন তিনি তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে থাকেন। অবশেষে বনু ক্বাইনুক্কা’ আত্মসমর্পণ করল এবং বলল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের জান মাল, সন্তান-সন্ততি এবং নারীদের ব্যাপারে যা ফায়সালা করবেন তারা তা মেনে নিবে। তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র নির্দেশক্রমে তাদের সকলকে বেঁধে নেয়া হয়।

কিন্তু এ স্থানে আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই তার কপট চাল চালবার সুযোগ গ্রহণ করল। সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অত্যন্ত অনুনয় বিনয় করে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ) আপনি এদের প্রতি সদয় ব্যবহার করুন।’ প্রকাশ থাকে যে, বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্র খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের ব্যাপারে বিলম্ব করলেন। সে পীড়াপীড়ি করতে থাকল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু শেষে সে তাঁর (ﷺ) জামার বুকের অংশবিশেষ ধরে ফেলল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিশেষ বিরক্তি ও ক্রোধ সহকারে পুনঃপুনঃ তাকে ছেড়ে দিতে বললেন, কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও সে পুনঃ পুনঃ উত্তর করতে লাগল ‘আমি কোন মতেই ছাড়বো না যে পর্যন্ত না আপনি তাদের উপর দয়াপরবশ হন। চারশ জন খোলা দেহের যুবক এবং তিনশ জন বর্মপরিহিত যুবককে আপনি একই দিনের সকালে কেটে ফেলবেন, অথচ তারা আমাকে কঠিন বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিল। আল্লাহর কসম! আমি কালচক্রের বিপদের আশঙ্কা করছি।

অবশেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের ধন মাল হস্তগত করলেন যেগুলোর মধ্যে তিনটি কামান, দুটি বর্ম, তিনটি তরবারী এবং তিনটি বর্শা নিজের জন্যে বেছে নেন এবং গনীমতের মালের এক পঞ্চমাংশ বের করেন। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) গণীমত একত্রিত করার কাজ সম্পাদন করেন।[1]

[1] যা’দুল মাআদ ২য় খন্ড ৭১ ও ৯১ পৃঃ এবং ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৪৭-৪৯ পৃঃ।

 ৪. গাযওয়ায়ে সাভীক বা ছাতুর যু্দ্ধ (غَزْوَةُ السَّوِيْقِ):

এদিকে সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া, ইহুদী এবং মুনাফিক্বরা নিজ নিজ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, অপরদিকে আবূ সুফইয়ানও এমন ব্যবস্থাপনা কার্যকরী করার সুযোগে ছিলেন যাতে কষ্ট কম হয় আর ফল ভাল হয়। তিনি এ ব্যবস্থাপনা তাড়াতাড়ি কার্যকরী করে স্বীয় কওমের মর্যাদা রক্ষা এবং তাদের শক্তি প্রকাশ করার ইচ্ছা করছিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, অপবিত্রতার কারণে তাঁর মস্তক পানি স্পর্শ করবে না যে পর্যন্ত না তিনি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। সুতরাং তিনি তাঁর এ প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করার জন্যে দুশ জন অশ্বারোহী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন এবং কানাত উপত্যকার শেষে অবস্থিত নীব নামক এক পর্বত প্রান্তে তাঁবু স্থাপন করেন। মদীনা হতে এ জায়গাটির দূরত্ব প্রায় বারো মাইল। মদীনার উপর খোলাখুলিভাবে আক্রমণ করার সাহস তাঁর ছিল না বলে তিনি এমন এক ব্যবস্থা কার্যকরী করলেন যেটাকে ডাকাতি বলা যেতে পারে। এর বিস্তারিত বিবরণ হল, তিনি রাত্রির অন্ধকারে মদীনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রবেশ করেন এবং হোয়াই ইবনু আখতাবের নিকট গিয়ে তার দরজা খুলিয়ে নেন। কিন্তু হোয়াই পরিণাম চিন্তা করে তাঁকে তার বাড়ীতে প্রবেশ করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। আবূ সুফইয়ান তখন সেখান হতে ফিরে গিয়ে বনু নাযীরের সালাম ইবনু মুশকিম নামক আর এক সর্দারের নিকট উপস্থিত হন। সে বনু নাযীর গোত্রের কোষাধ্যক্ষ ছিল। আবূ সুফইয়ান তার বাড়ির ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলে সে অনুমতি প্রদান করে। সে তার অতিথি সেবাও করে। খাদ্য ছাড়াও মদ্যও পান করায় এবং লোকদের গোপনীয় অবস্থা সম্পর্কেও অবহিত করে। রাত্রির শেষভাগে আবূ সুফইয়ান সেখান হতে বের হয়ে নিজের সঙ্গীদের সাথে মিলিত হন এবং একটি দল পাঠিয়ে মদীনার পার্শ্ববর্তী আরীয নামক একটি জায়গার উপর হামলা করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেন। ঐ দলটি তথাকার কিছু খেজুরের গাছ কর্তন করে এবং জ্বালিয়ে দেয়, আর একজন আনসারী ও তার মিত্রকে তাদের জমিতে পেয়ে হত্যা করে দেয় এবং দ্রুত বেগে পলায়ন করে মক্কার পথে ফিরে যায়।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই দ্রুত গতিতে আবূ সুফইয়ান এবং তার সঙ্গীদের পশ্চাদ্ধাবন করেন, কিন্তু তারা আরো দ্রুত গতিতে পলায়ন করে। সুতরাং তাদেরকে ধরা সম্ভবপর হয়নি। কিন্তু তারা বোঝা হালকা করার জন্যে ছাতু, পাথেয় এবং বহু আসবাব পত্র ফেলে দেয় যা মুসলিমদের হস্তগত হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কারকুরাতুল কুদর পর্যন্ত পশ্চাদ্ধাবন করে ফিরে আসেন। ফিরবার পথে তাঁরা ছাতু ইত্যাদি বোঝাই করে নিয়ে আসেন। এ অভিযানের নাম গাযওয়ায়ে সাভীক রাখা হয়। কারণ আরবী ভাষায় ছাতুকে সাভীক বলা হয়। এ যুদ্ধ বদর যুদ্ধের মাত্র দুমাস পর হিজরী ২য় সনের যুল হিজ্জাহ মাসে সংঘটিত হয়।[1]

এ যুদ্ধ কালীন সময়ে মদীনায় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আবূ লুবাবাহ ইবনু আব্দুল মুনযির (রাঃ)-এর উপর অর্পণ করা হয়।

[1] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯০-৯১ পৃঃ, ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৪৪-৪৫ পৃঃ।

 ৫. গাযওয়ায়ে যূ ‘আমর (غَزْوَةُ ذِيْ أَمْرٍ):

বদর ও উহুদ মধ্যবর্তী সময়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নেতৃত্বাধীনে এটাই সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান। এটা তৃতীয় হিজরীর মুহরম মাসে সংঘটিত হয়।

এ অভিযানের কারণ : মদীনার গোয়েন্দা বাহিনী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে খবর দেন যে, বনু সা‘লাবাহ ও মুহারিব গোত্রের এক বিরাট বাহিনী মদীনার উপর আক্রমণ করার জন্য একত্রিত হচ্ছে। এ খবর শোনা মাত্রই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিমগণকে প্রস্তুতির নির্দেশ দেন এবং আরোহী ও পদাতিক মিলে মোট চারশ জন সৈন্যের বাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। উসমান ইবনু আফফান (রাঃ)-কে মদীনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করেন।

পথে সাহাবীগণ বনু সা‘লাবাহ গোত্রের জাববার নামক এক ব্যক্তিকে পাকড়াও করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে হাযির করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং সে ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর তিনি তাকে বিলাল (রাঃ)-এর বন্ধুত্বে দিয়ে দেন এবং সে পথ প্রদর্শক রূপে মুসলিমগণকে শত্রুদের অবস্থানস্থল পর্যন্ত রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যায়।

এদিকে শত্রুরা মদীনার সৈন্য বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং আশে পাশের পাহাড় গুলোতে লুকিয়ে যায়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন এবং সেনাবাহিনী সহ ঐ জায়গা পর্যন্ত গমন করেন যেটাকে শত্রুরা নিজেদের দলের একত্রিত হওয়ার স্থান নির্বাচিত করেছিল। এটা ছিল আসলে একটি প্রস্রবণ যা যূ ‘আমর নামে পরিচিত ছিল। বেদুইনদের উপর প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত এবং মুসলিমদের শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে তাদের ওয়াকিবহাল করানোর জন্য তৃতীয় হিজরীর পূর্ণ সফর মাসটি তিনি সেখানে অতিবাহিত করেন। তারপর মদীনায় ফিরে আসেন।[1]

[1] ইবুন হিশাম ২য় খন্ড ৪৬ পৃঃ, যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯১ পৃঃ, কথিত আছে যে, দুা’সুর অথবা গাওরসি মুহারিবী এ যুদ্ধেই নাবী (সাঃ)-কে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে এটা অন্য এক যুদ্ধের ঘটনা। সহীহুল বুখারীর ২য় খন্ডের ৫৯৩ পৃঃ।

 ৬. কা‘ব ইবনু আশরাফের হত্যা (قَتْلُ كَعْبِ بْنِ الْأَشْرَفِ):

এ ছিল ইহুদীদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি, যে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি অত্যন্ত শত্রুতা ও হিংসা পোষণ করত। সে নাবী (ﷺ)-কে কষ্ট দিত এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যভাবে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে বেড়াত। ‘তাই’ গোত্রের শাখা বনু নাবাহানের সাথে তার সম্পর্ক ছিল। আর তার মাতা বনু নাযীর গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে ছিল বড় ধনী ও পুঁজিপতি। আরবে তার সৌন্দর্য্যের খ্যাতি ছিল। সে একজন খ্যাতনামা কবিও ছিল। তার দূর্গটি মদীনার দক্ষিণে বনু নাযীর গোত্রের আবাদী ভূমির পিছনে অবস্থিত ছিল।

বদর যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় লাভ এবং নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের নিহত হওয়ার প্রথম খবর শুনে সে অকস্মাৎ বলে ওঠে ‘সত্যিই কি ঘটনা এটাই? এরা ছিল আরবের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এবং জনগণের বাদশাহ। যদি মুহাম্মাদ (ﷺ) তাদেরকে হত্যা করে থাকে তবে পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ ওর উপরিভাগ হতে উত্তম হবে অর্থাৎ আমাদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই উত্তম হবে।

তারপর যখন সে নিশ্চিতরূপে জানতে পারল যে, এটা সত্য খবর তখন আল্লাহর এ শত্রু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং মুসলিমদের নিন্দা এবং ইসলামের শত্রুদের প্রশংসা করতে শুরু করল এবং তাদেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগল। কিন্তু এতেও তার বিদ্বেষ বহ্ণি প্রশমিত না হওয়ায় সে অশ্বে আরোহণ করে কুরাইশদের নিকট গমন করল এবং মুত্তালিব ইবনু আবী অদাআ সাহমীর অতিথি হল। তারপর সে কুরাইশদের মর্যাদাবোধ উত্তেজিত করতে, তাদের প্রতিশোধাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করতে এবং তাদেরকে নাবী (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে উৎসাহিত করতে কবিতা বলে বলে ঐ কুরাইশ নেতাদের জন্য বিলাপ করতে লাগল যাদের বদর প্রান্তরে হত্যা করার পর কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। মক্কায় তার অবস্থান কালে আবূ সুফইয়ান ও মুশরিকরা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নিকট আমাদের দ্বীন বেশী পছন্দনীয়, না মুহাম্মাদ (ﷺ)- ও তাঁর সঙ্গীদের দ্বীন? আর উভয় দলের মধ্যে কোন্ দলটি বেশী হিদায়াত প্রাপ্ত?’ উত্তরে কা‘ব ইবনু আশরাফ বলল ‘তোমরাই তাদের চেয়ে বেশী হিদায়াত প্রাপ্ত এবং উত্তম। এ ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াত নাযিল করেন

‏(‏أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْنَ أُوْتُوْا نَصِيْبًا مِّنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُوْنَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوْتِ وَيَقُوْلُوْنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوْا هَؤُلاء أَهْدَى مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا سَبِيْلاً‏)‏ ‏[‏ النساء‏:‏ 51‏]‏‏.‏

‘‘যাদেরকে কিতাবের জ্ঞানের একাংশ প্রদত্ত হয়েছে, সেই লোকেদের প্রতি তুমি কি লক্ষ্য করনি, তারা অমূলক যাদু, প্রতিমা ও তাগূতের প্রতি বিশ্বাস করে এবং কাফিরদের সম্বন্ধে বলে যে, তারা মু’মিনগণের তুলনায় অধিক সঠিক পথে রয়েছে।’ (আন-নিসা ৪ : ৫১)

কা‘ব ইবনু আশরাফ এ সব কিছু করে মদীনায় ফিরে এসে সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) স্ত্রীদের ব্যাপারে বাজে কবিতা বলতে শুরু করে এবং কট্যূক্তির মাধ্যমে তাঁদেরকে ভীষণ কষ্ট দিতে থাকে।

তা এ দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘কে এমন আছে যে, কা‘ব ইবনু আশরাফকে হত্যা করতে পারে? কেননা, সে আল্লাহ এবং তার রাসূল (ﷺ)-কে কষ্ট দিয়েছে এবং দিচ্ছে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ), আব্বাদ ইবনু বিশর (রাঃ), আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তার নাম সিলকান বিন সালামাহ যিনি ছিলেন কা’বের দুধ ভাই, হারিস ইবনু আউস (রাঃ) এবং আবূ আবস ইবনু জাবর (রাঃ) এ খিদমতের জন্যে এগিয়ে আসেন। এ সংক্ষিপ্ত বাহিনীর নেতা ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ)।

কা‘ব ইবনু আশরাফের হত্যার ব্যাপারে যে সব বর্ণনা রয়েছে ওগুলোর সারমর্ম হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন বললেন, ‘কা‘ব ইবনু আশরাফকে কে হত্যা করতে পারে? সে আল্লাহ এবং তার রাসূল্লাহ (ﷺ)-কে কষ্ট দিয়েছে।’ তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) উঠে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি প্রস্তুত আছি। আমি তাকে হত্যা করব এটা কি আপনি চান?’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জবাবে বললেন, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, ‘তাহলে আপনি আমাকে অস্বাভাবিক কিছু বলার অনুমতি দিচ্ছেন কি?’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁ’ তুমি বলতে পার।’

এরপর মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) কা‘ব ইবনু আশরাফির নিকট গমন করলেন এবং তাকে বললেন, ‘এ ব্যক্তি মুহাম্মাদ (ﷺ) আমাদের কাছে সাদকাহ চাচ্ছে এবং প্রকৃত কথা হচ্ছে সে আমাদেরকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

একথা শুনে কা‘ব বলল, ‘আল্লাহর কসম! তোমাদের আরো বহু দুর্ভোগ পোহাতে হবে।’

মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, ‘আমরা যখন তার অনুসারী হয়েই গেছি তখন হঠাৎ করে এখনই তার সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত মনে করছি না। পরিণামে কী হয় দেখাই যাক। আচ্ছা, আমি আপনার কাছে এক অসাক বা দু’ অসাক (এক অসাক =১৫০ কেজি) খাদ্য শস্যের আবেদন করছি?’

কা‘ব বলল ‘আমার কাছে কিছু বন্ধক রাখো।’

মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) বললেন, ‘আপনি কী জিনিস বন্ধক রাখা পছন্দ করেন?’

কা‘ব উত্তর দিলো, ‘তোমাদের নারীদেরকে আমার নিকট বন্ধক রাখো।’

মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, ‘আপনি আরবের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুদর্শন পুরুষ, সুতরাং আমরা আমাদের নারীদেরকে কিরূপে আপনার নিকট বন্ধক রাখতে পারি?’

সে বলল, ‘তাহলে তোমাদের পুত্রদেরকে বন্ধক রাখো।’

মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, ‘আমরা আমাদের পুত্রদেরকে কী করে বন্ধক রাখতে পারি? এরূপ করলে তাদেরকে গালি দেয়া হবে যে, এক অসাক বা দু অসাক খাদ্যের বিনিময়ে তাদেরকে বন্ধক রাখা হয়েছিল। এটা আমাদের জন্যে খুবই লজ্জার কথা হবে। আমরা অবশ্য আপনার কাছে অস্ত্র বন্ধক রাখতে পারি।’

এরপর দুজনের মধ্যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) অস্ত্র নিয়ে তার কাছে আসবেন। এদিকে আবূ নায়িলাও (রাঃ) অগ্রসর হলেন অর্থাৎ কা‘ব ইবনু আশরাফের কাছে আসলেন। কিছুক্ষণ পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে বিভিন্ন দিকের কবিতা শোনা ও শোনানোর কাজ চললো। তারপর আবূ নায়িলা (রাঃ) বললেন, ‘ভাই ইবনু আশরাফ! আমি এক প্রয়োজনে এসেছি। এটা আপনাকে আমি বলতি চাচ্ছি এই শর্তে যে, আপনি কারো কাছে এটা প্রকাশ করবেন না।’ কা‘ব বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তাই করব।’

আবূ নায়িলাহ (রাঃ) বললেন, ‘এ ব্যক্তির (মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর) আগমন তো আমাদের জন্যে পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা আরব আমাদের শত্রু হয়ে গেছে। আমাদের পথ ঘাট বন্ধ হয়ে গেছে, পরিবার পরিজন ধ্বংস হতে চলেছে। সন্তান-সন্ততির কষ্টে আমরা চৌচির হচ্ছি।’ এরপর তিনি ঐ ধরণেরই কিছু আলাপ আলোচনা করলেন, যেমন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা করেছিলেন। কথোপকথনের সময় আবূ নায়িলাহ (রাঃ) এ কথাও বলেছিলেন আমার কয়েকজন বন্ধু বান্ধব রয়েছে যাদের চিন্তাধারা ঠিক আমারই মত। আমি তাদেরকেও আপনার কাছে নিয়ে আসতে চাচ্ছি। আপনি তাদের হাতেও কিছু বিক্রি করুন এবং তাদের উপর অনুগ্রহ করুন।’

মুহাম্মাদ ইবনু মাসালামা (রাঃ) এবং আবূ নায়িলাহ (রাঃ) নিজ নিজ কথোপকথনের মাধ্যমে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে সফলকাম হন। কেননা, ঐ কথোপকথনের পরে অস্ত্রশস্ত্র বন্ধু বান্ধবসহ এ দুজনের আগমনের কারণে কা‘ব ইবনু আশরাফির সতর্ক হয়ে যাওয়ার কথা নয়। তারপর হিজরী ৩য় সনের রবিউল আওয়াল মাসের ১৪ তারীখে চাঁদনী রাতে এ ক্ষুদ্র বাহিনী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট একত্রিত হন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাকীয়ে গারকাদ পর্যন্ত তাঁদের অনুসরণ করেন। তারপর বলেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে যাও। বিসমিল্লাহ। হে আল্লাহ! এদেরকে সাহায্য করুন।’ তারপর তিনি নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। তারপর বাড়িতে তিনি সালাত ও মুনাজাতে লিপ্ত হয়ে পড়েন।

এদিকে এ বাহিনী কা‘ব ইবনু আশরাফির দুর্গের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার পর আবূ নায়িলাহ (রাঃ) উচ্চৈঃস্বরে ডাক দেন। ডাক শুনে কা‘ব তাদের নিকট আসার জন্যে উঠলে তার স্ত্রী- যে ছিল নববধূ- তাকে বলল, ‘এ সময় কোথায় যাচ্ছেন? আমি এমন শব্দ শুনতে পাচ্ছি যে, যেন তা হতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে।’

স্ত্রীর এ কথা শুনে কা‘ব বলল, ‘এটা তো আমার ভাই মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা এবং দুধ ভাই আবূ নায়িলাহ। সম্ভ্রান্ত লোককে যদি তরবারী যুদ্ধের দিকে আহবান করা হয় তবে সে ডাকেও সে সাড়া দিবে।’ এরপর সে বাইরে আসল। তার দেহ থেকে সুগন্ধি ছুটছিল এবং তার মাথায় খোশবুর ঢেউ খেলছিল।

আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তাঁর সঙ্গীদেরকে বলে রেখেছিলেন। ‘যখন সে আসবে তখন আমি তার চুল ধরে শুঁকবো। যখন তোমরা দেখবে যে, আমি তার মাথা ধরে তাকে ক্ষমতার মধ্যে পেয়ে গেছি তখন ঐ সুযোগে তোমরা তাকে হত্যা করবে।’

সুতরাং যখন কা‘ব আসলো তখন দীর্ঘক্ষণ ধরে আলাপ আলোচনা ও গল্পগুজব চললো। তারপর আবূ নায়িলাহ (রাঃ) বললেন, ‘ইবনু আশরাফ! আজুয ঘাঁটি পর্যন্ত চলুন। সেখানে আজ রাতে কথাবার্তা বলাবলি হবে। সে বলল, ‘তোমাদের ইচ্ছা হলে চলো।’ তারপর তাদের সাথে সে চলল।

পথের মধ্যে আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তাকে বললেন, ‘আজকের মতো এমন উত্তম সুগন্ধির সাথে আপনার পরিচয় নেই।’ একথা শুনে কা’বের বক্ষ গর্বে ফুলে উঠল। সে বলল, ‘আমার পাশে আরবের সর্বাপেক্ষা অধিক সুগন্ধি ব্যবহারকারিণী মহিলা রয়েছে।’ আবূ নায়িলাহ (রাঃ) বললেন, ‘আপনার মাথাটি একটু শুঁকবো এ অনুমতি আছে কি?’ সে উত্তরে বলল ‘হ্যা, হ্যাঁ’। আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তখন কা‘বের মাথায় হাত রাখলেন। তারপর তিনি নিজেও তার মাথা শুঁকলেন এবং সঙ্গীদেরকেও শুঁকালেন। কিছুদূর যাওয়ার পর আবূ নায়িলাহ (রাঃ) বললেন, ‘ভাই আর একবার শুঁকতে পারি কি?’ কা‘ব উত্তর দিল ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। কোন আপত্তি নেই।’ আবূ নায়িলাহ (রাঃ) আবার শুঁকলেন। সুতরাং সে নিশ্চিত হয়ে গেল।

আরো কিছুদূর চলার পর আবূ নায়িলাহ (রাঃ) পুনরায় বললেন, ‘ভাই আর একবার শুঁকবো কি?’ এবারও কা‘ব উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, শুঁকতে পারো।

এবার আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তার মাথায় হাত রেখে ভালভাবে মাথা ধরে নিলেন এবং সঙ্গীদেরকে বললেন, ‘আললাহর এ দুশমনকে হত্যা করে ফেল।’ ইতোমধ্যেই তার উপর কয়েকটি তরবারী পতিত হলো, কিন্তু কাজ হলো না। এ দেখে মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) নিজের কোদাল ব্যবহার করে তার দুনিয়ার স্বাদ চিরতরে মিটিয়ে দিলেন। আক্রমণের সময় সে এত জোরে চিৎকার করেছিল যে, চতুর্দিকে তার চিৎকারের শব্দ পৌঁছে গিয়েছিল এবং এমন কোন দূর্গ বাকী ছিল না যেখানে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হয়নি। কিন্তু ওটা মুসলিমদের ক্ষতির কোন কারণ হয় নি।

কা‘বকে আক্রমণ করার সময় হারিস ইবনু আউস (রাঃ)-কে তাঁর কোন এক সাথীর তরবারীর কোণার আঘাত লেগেছিল। ফলে তিনি আহত হয়েছিলেন এবং তাঁর দেহ হতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। কা‘বকে হত্যা করে ফিরবার সময় যখন এ ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী হররায়ে আরীয নামক স্থানে পেঁŠছেন তখন দেখেন যে, হারিস (রাঃ) অনুপস্থিত রয়েছেন। সুতরাং তারা সেখানে থেমে যান। অল্পক্ষণ পরে হারিসও (রাঃ) সঙ্গীদের পদচিহ্ণ ধরে সেখানে পৌঁছে যান। সেখান হতে তাঁরা তাঁকে উঠিয়ে নেন এবং বাকীয়ে গারকাদে পৌঁছে এমন জোরে তাকবীর ধ্বনি দেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-ও তা শুনতে পান। তিনি বুঝে নেন যে, কা‘ব নিহত হয়েছে। সুতরাং তিনিও আল্লাহ আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করেন। তারপর যখন এ মুসলিম বাহিনী তাঁর খিদমতে উপস্থিত হন তখন তিনি বলেন, ‘আফলাহাতিল উজূহু’ অর্থাৎ এ চেহারাগুলো সফল থাকুক। তখন তারা বললেন, ‘অ অজুহুকা ইয়া রাসূলুল্লাহ’ অর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আপনার চোহরাও সফলতা লাভ করুক। আর সাথে সাথেই তাঁরা তাগূতের (কা‘বের) কর্তিত মস্তক তাঁর সামনে রেখে দেন। তিনি তখন আল্লাহ পাকের প্রশংসা করেন এবং হারিস (রাঃ)-এর ক্ষত স্থানে স্বীয় পবিত্র মুখের লালা লাগিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরোগ্য লাভ করেন এবং পরে আর কখনো তিনি কষ্ট অনুভব করেন নি।[1]

এদিকে ইহুদীরা যখন কা‘ব ইবনু আশরাফির হত্যার খবর জানতে পারল তখন তাদের শঠতাপূর্ণ অন্তরে ভীতি ও সন্ত্রাসের ঢেউ খেলে গেল। তারা তখন বুঝতে পারল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন অনুধাবন করবেন যে, শান্তি ভঙ্গকারী, গন্ডগোল ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এবং প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার ভঙ্গকারীদেরকে উপদেশ দিয়ে কোন ফল হচ্ছেনা তখন তিনি তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতেও দ্বিধাবোধ করবেন না। এ জন্যেই তারা এ তাগূতের হত্যার প্রতিবাদে কোন কিছু করার সাহস করলনা, বরং একেবারে সোজা হয়ে গেল। তারা অঙ্গীকার পূরণের স্বীকৃতি দান করল এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধাচরণের সাহস সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলল।

এভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনার বিরুদ্ধে বহিরাক্রমণের মোকাবেলা করার অপূর্ব সুযোগ লাভ করলেন এবং মুসলিমরা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে গেলেন যে গোলযোগের তাঁরা আশঙ্কা করছিলেন এবং যার গন্ধ তাঁরা মাঝে মাঝে পাচ্ছিলেন।

[1] এ ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৫১-৫৭ পৃঃ, সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩৪১-৪২৫ পৃঃ, ২য় খন্ড ৫৭৭ পৃঃ, সুনানে আবূ দাউদ আউনুল মা’বূদ সহ দ্রষ্টব্য ২য় খন্ড ৪২-৪৩ পৃঃ এবং যা’দুল মাআ’দ ২য় খন্ড ৯১ পৃঃ, এ সব হাদীস গ্রন্থ হতে গৃহীত হয়েছে।

 ৭. গাযওয়ায়ে বাহরান (غَزْوَةُ بُحْرَان):

এটা ছিল বড় সামরিক অভিযান যার সৈন্য সংখ্যা ছিল তিনশ জন। এ সেনাদল নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তৃতীয় হিজরীর রবিউল আখের মাসে বাহরান নামক একটি অঞ্চলের দিকে গমন করেছিলেন। এটা হিজাযের মধ্যে ফারা সীমান্তে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি জায়গা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেনাবাহিনীর রাবিউল আখের ও জুমাদিউল উলা এ দু’মাস সেখানে অবস্থানের পর মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ অভিযানে তাঁদেরকে কোন প্রকার যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়নি।[1]

[1] ইবুন হিশাম ২য় খন্ড ৫০-৫১ পৃঃ, যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯১ পৃঃ। এ গাযওয়ার কারণের ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। কথিত আছে, মদীনায় এ খবর পৌঁছে যে, বনু সুলায়েম গোত্র মদীনা ও ওর আশেপাশে আক্রমণ চালাবার জন্যে খুব বড় রকমের সামরিক প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছে। এটাও কথিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুরাইশদের কোন এক যাত্রীদলের সন্ধানে বের হয়েছিলেন। ইবনু হিশাম এ কারণেই বর্ণনা করেছেন। আর ইবনুল কাইয়্যেমও এটাই গ্রহণ করেছেন। তাই তিনি প্রথম কারণটি উল্লেখ করেন নি। এটাই সত্য বলেও মনে হচ্ছে। কেননা, বনু সুলায়েম গোত্র ফারা এলাকায় বসবাসই করেনি বরং তারা নাজদের বাসিন্দা ছিল, যা ফারা হতে বহু দূরে।

৮. সারিয়্যাতু যায়দ ইবনু হারিসাহ (سَرِيَّةُ زَيْدِ بْنِ حَارِثَةَ):

এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৩য় হিজরী জুমাদিউল আখের মাসে। উহুদ যুদ্ধের পূর্বে মুসলিমদের জন্যে এটা ছিল সর্বশেষ এবং সাফল্যজনক অভিযান।

ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ হল কুরাইশরা বদর যুদ্ধের পর হতে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের মধ্যে নিমজ্জিত তো ছিলই, তদুপরি যখন গ্রীষ্মকাল আসলো এবং শাম দেশে বাণিজ্যের সফরের সময় এসে পড়লো তখন তারা আর এক দুশ্চিন্তায় নিপতিত হলো। এর ব্যাখ্যা হচ্ছে সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া- যাকে ঐ বছর শামদেশে গমনকারী কাফেলার আমীর নিযুক্ত করা হয়েছিল- কুরাইশকে বলল ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং তার সঙ্গীরা আমাদের বাণিজ্য পথ কঠিন করে ফেলেছে। তার সঙ্গীদের সাথে আমরা কিভাবে মোকাবেলা করব তা আমি বুঝতে পারছি না। তারা সমুদ্র উপকূল ছাড়তেই চাচ্ছে না। আর উপকূলের বাসিন্দারা তাদের সাথে সন্ধি করে নিয়েছে। সাধারণ লোকেরাও তাদের সাথী হয়ে গেছে। তাই, তখন আমি কোন্ রাস্তা অবলম্বন করব তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আর যদি আমরা বাড়িতেই বসে থাকি তবে মূলধনও খেয়ে ফেলবো, কিছুই বাকী থাকবে না। কেননা, গ্রীষ্মকালে সিরিয়ার সাথে এবং শীতকালে আবিসিনিয়ায় ব্যবসা করার উপরে আমাদের জীবিকা নির্ভর করছে।’

সাফওয়ানের এ উক্তির পর বিষয়টির উপর চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়ে গেল। অবশেষে আসওয়াদ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব সাফওয়ানকে বলল, ‘তুমি উপকূলের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে ইরাকের রাস্তায় সফর কর।’ প্রকাশ থাকে যে, এটা খুবই দীর্ঘ রাস্তা। এটা নাজদ হয়ে সিরিয়া চলে গেছে এবং মদীনার পূর্ব দিকে কিছু দূর দিয়ে গিয়েছে। কুরাইশদের নিকট এটা ছিল সম্পূর্ণ অজানা পথ।

এ জন্য আসওয়াদ ইবনু আব্দুল মুত্তালিব সাফওয়ানকে পরামর্শ দিল যে, সে যেন বাকর ইবনু ওয়াইলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ফুরাত ইবনু হাইয়ানকে পথ প্রদর্শক হিসেবে সঙ্গে নেয়।

এ ব্যবস্থাপনার পর কুরাইশের বাণিজ্য কাফেলা সাফওয়ান ইবনু উমাইয়ার নেতৃত্বে নতুন পথ ধরে যাত্রা শুরু করল। কিন্তু এ যাত্রীদলের এ পথ যাত্রার খবর ইতোমধ্যেই মদীনায় পৌঁছে গিয়েছিল। ঘটনা হল সালীত ইবনু নুমান যিনি মুসলিম হয়েছিলেন, নাঈম ইবনু মাসউদের সাথে এক মদ্যপানের মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। নাঈম তখনো মুসলিম হয়নি। এটা মদ্যপান নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বের ঘটনা। যখন নাঈমের উপর নেশা চেপে বসল তখন সে কুরাইশ কাফেলার সফর এবং তাদের অভিপ্রায়ের কথা পূর্ণভাবে বর্ণনা করে দিল। সালীত (রাঃ) দ্রুতগতিতে নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তৎক্ষণাৎ আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন এবং একশ জন অশ্বারোহীর একটি বাহিনীকে যায়দ ইবনু হারিসার নেতৃত্বে প্রেরণ করলেন। যায়দ (রাঃ) অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পথ অতিক্রম করলেন। কুরাইশদের কাফেলা সম্পূর্ণ অসতর্ক অবস্থায় কারদাহ নামক একটি প্রস্রবণের উপর শিবির স্থাপনের নিমিত্ত অবতরণ করছিল, ইত্যবসরে মুসলিম বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পুরো কাফেলার উপর অধিকার লাভ করলেন। সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া এবং কাফেলার অন্যান্য রক্ষকদের পলায়ন ছাড়া আর কোন উপায় থাকল না।

মুসলিমরা কাফেলার পথ প্রদর্শক ফুরাত ইবনু হাইয়ানকে এবং কথিত মতে আরো দুজনকে গ্রেফতার করে নেন। কাফেলার নিকট প্রচুর পরিমাণ রৌপ্য ছিল, যার মূল্য আনুমানিক এক লক্ষ দিরহাম হবে, সবগুলোই মুসলিমরা গনীমতরূপে লাভ করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকীগুলো মুসলিমদের মধ্যে বন্টন করে দেন। ফুরাত ইবনু হাইয়ান নাবী কারীম (ﷺ) -এর পবিত্র হাতে ইসলামের দীক্ষাগ্রহণ করেন।[1]

বদর যুদ্ধের পরে এটাই ছিল কুরাইশদের জন্য সর্বাপেক্ষা বেদনাদায়ক ঘটনা, যাত্ম ফলে তাদের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বহুগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। এখন তাদের সামনে দুটি মাত্র পথ ছিল, হয় তারা গর্ব ও অহংকার ত্যাগ করে মুসলমানদের সাথে সন্ধি করবে, না হয় ভীষণ যুদ্ধ করে নিজেদের অতীত গৌরব ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনবে এবং মুসলিমদের শক্তি এমনভাবে চূর্ণ করে দিবে যাতে তারা পুনর্বার মাথা চাড়া দিতে না পারে। মক্কাবাসীগণ দ্বিতীয় পথটি বেছে নিল। সুতরাং এ ঘটনার পর কুরাইশদের প্রতিশোধ গ্রহণের উত্তেজনা আরো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল। তারা মুসলিমদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য এবং তাদের ঘরে ঢুকে তাদের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য পূর্ণ মাত্রায় প্রস্তুতি শুরু করে দিল। এভাবে পূর্ববর্তী ঘটনাবলী ছাড়া এ ঘটনাটিও উহুদ যুদ্ধের বড় একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

[1] ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৫০-৫১ পৃঃ, রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ২১৯ পৃঃ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *