২৪. গণিকাবৃত্তির অধিকারের লড়াই, নিশ্চয়তা, নিরাপত্তায় স্বেচ্ছাসেবী
বিশ্বজুড়ে যৌনকর্মীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন চলছে। গোটা ভারতে চলছে। কলকাতাও বাদ নেই। দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি পশ্চিমবঙ্গের ৬৫ হাজার যৌনকর্মীর সমষ্টিগত দল। ১৯৯২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার সবচেয়ে বড়ো নিষিদ্ধপল্লি সোনাগাছিতে প্রতিষ্ঠিত দুর্বার, ভারতের লক্ষ লক্ষ যৌনকর্মীর সঙ্গে নারী অধিকার, যৌনকর্মীদের অধিকার সমর্থন, মানব পাচার বিরোধী এবং এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করছে। ফোর্ড ফাউন্ডেশন এবং ন্যাশনাল এডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (এনএসিও), ইত্যাদি সংস্থাগুলির সাহায্যে পশ্চিমবঙ্গে যৌনকর্মীদের জন্য ৫১টি বিনামূল্যের ক্লিনিক চালানো হয়, যারা নেটওয়ার্কিং, অধিকার সুরক্ষা এবং যৌনকর্মীদের জন্য বিকল্প জীবিকা তৈরির মতো উদ্যোগেও সহায়তা করে। গণিকাবৃত্তিকে বৈধ পেশা এবং যৌনকর্মীদের কর্মী হিসাবে স্বীকৃতির লড়াইয়ের জন্য এবং যৌনকর্মীদের তথা তাঁদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ সামাজিক অস্তিত্বের জন্য দলটির লক্ষ্যমাত্রায় স্পষ্টত রাজনৈতিক। তাঁরা গণিকাবৃত্তি বৈধকরণের জন্য কাজ করে এবং আইন সংস্কারের চেষ্টা করে, যা যৌন মানবাধিকারকে সীমাবদ্ধ করে।
১৯৯২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এন্ড পাবলিক হেস্থের একজন জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ডঃ স্মরজিৎ জানা এইচআইভি সম্পর্কিত গবেষণার জন্য সোনাগাছির নিষিদ্ধপল্লি এলাকা পরিদর্শন করেন। একটি সমগোত্রীয় শিক্ষা দল যৌনকর্মীদের মধ্যে থেকে গঠিত হয় এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। অল্প কিছুদিন পরে গবেষণায় যৌনকর্মীদের মধ্যে যৌন বিষয়ক অধিকার, তাঁদের সন্তানদের শিক্ষা, আর্থিক পরিসেবাগুলির সুবিধা এবং পুলিশ এবং স্থানীয় গুণ্ডাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হওয়ার সমস্যাগুলি উঠে আসে, সঙ্গে নিরাপদ যৌনসঙ্গমের স্বার্থে কন্ডোম ব্যবহারের প্রসার ঘটানো হয়। এভাবে ১৯৯৫ সালে তিনি ১২ জন যৌনকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার মহিলা সমিতি কমিটি’ (ডিএমএসসি) গঠন করেন। ২০১২ সালের মধ্যে ডিএমএসসি পশ্চিমবঙ্গের ৪৮টি শাখার মধ্য থেকে ৬৫ হাজার সদস্যের সদস্যপদ লাভ করে এবং যেগুলি যৌনকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাঁদের সন্তান এবং সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের বোর্ড সদস্য হিসাবে থাকেন। কেবল নারীই যৌনকর্মীই নয়, বরং পুরুষ এবং ট্রান্সজেন্ডার যৌনকর্মীরাও এতে সদস্য হন। গণিকাপেশায় আসতে ইচ্ছুক এমন কোনো মেয়েই এই বোর্ডকে এড়িয়ে তাঁর পেশা শুরু করতে পারবে না। এই বোর্ডেই যাচাই করা হয় বয়স (নাবালিকা কি না। সেক্ষেত্রে ১৮ উপরে বয়স হতে হব। বয়সের প্রমাণপত্র না-থাকলে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে বয়স জেনে নেওয়া হয়), এই পেশায় আসতে কেউ বাধ্য করেছে কি না জানতে চাওয়া হয়, পাচারকৃত কি না জানা হয় ইত্যাদি।
দুর্বার এসটিডি/এইচআইভির ইন্টারভেন্সন প্রোগ্রাম (সাধারণত সোনাগাছি প্রকল্প নামে পরিচিত) ১৯৯৯ সাল থেকে চালু হয়। সোনাগাছি প্রকল্পের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা All India Institute of Hygiene and Public Health’, যেটি কলকাতার অবস্থিত একটি কেন্দ্রীয় সরকারি ‘Public Health Training and Research Institute’, যাঁরা ১৯৯২ সালে এই প্রোগ্রামটি শুরু করে তাঁদের থেকে ডিএমএসসি কর্তৃক গৃহীত হয়। ১৯৯৯ সালে এসটিডি/এইচআইভি ইন্টারভেনশন প্রোগ্রাম নিয়ন্ত্রণ লাভের পর ডিএমএসসি পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য নিষিদ্ধ এলাকায় সোনাগাছি মডেলের অনুসরণ করা শুরু করেন।
‘শ্রমিকের অধিকার চাই’—আন্তর্জাতিক শ্রমদিবসে সোনাগাছিতে এই শ্লোগান তুলে পদযাত্রা করেন কয়েক হাজার যৌনকর্মী। ওই মিছিলে তাঁদের সন্তান ও অন্যান্য সংঠনের সদস্যরাও হাজির থাকেন। প্রতি বছর ১ মে সোনাগাছিতে নিজেদের কাজও বন্ধ রাখেন যৌনকর্মীরা। এই দাবি নিয়েই গত কয়েকবছর ধরে লাগাতার আন্দোলন করে চলেছেন সোনাগাছি সহ রাজ্যের অসংখ্য যৌনপল্লির কর্মীরা। শরিতা দশ বছর ধরে থাকেন মহানগরের এই যৌনপল্লিতে। সোনাগাছির বহু ঘটনার সাক্ষী শরিতা। তিনি অভিযোগ করেন—“এখনও সমাজে নানা ধরনের অত্যাচার আমাদের সহ্য করতে হয়। কখনও চাঁদার জুলুম তো কখনও মাস্তানের চোখরাঙানি। তা ছাড়া পুলিশের বিভিন্ন ধরনের অত্যাচারও আছে। এসব জ্বালাতন সঙ্গে করেই আমাদের চলতে হয়। কিছু ঘটনা অন্তরালেই থেকে যায়। অনেকে পাশে থাকার কথা বললেও লড়াইটা অনেক ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদেরকেই করতে হয়। এত কিছু সত্ত্বেও এখনও আমরা শ্রমের স্বীকৃতি পেলাম না। আমাদের দাবি সরকারি শ্রমদপ্তরে ‘যৌনকর্মী হিসাবে আমাদের নথিভুক্ত করতে হবে। এটা আমাদের অন্যতম মূল দাবি। জানি না কবে মিলবে আমাদের অধিকার”।
আন্দোলনের কিছু ফল যে মেলেনি তা নয়। সোনাগাছি সহ রাজ্যের বিভিন্ন যৌনপল্লির যৌনকর্মীরা সরকারি নানা সুবিধা পাচ্ছেন। আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ‘স্বাস্থ্য সাথী’, ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’, ‘সমব্যথী’ ‘সবুজ সাথী’, ‘খাদ্য সাথী’, ‘শিক্ষাশ্রী” সহ অনেক প্রকল্পেরও অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু এখনও শ্রমিকের অধিকার পাননি তাঁরা। এটাই এখন কুরে কুরে খায় যৌনকর্মীদের। এটাই এখন মূল লড়াই তাবৎ যৌনকর্মীদের। তা ছাড়া ইমমরাল ট্রাফিকিং’ আইনের ফাঁদে পড়েও তাঁদের হয়রানির শিকার হতে হয়। যৌনপল্লিগুলির মহল্লায় মহল্লায় যৌনকর্মীদের এই অভিযোগ। তাঁদের বক্তব্য—“এটা আমাদের পেশা। তবু কেন পুলিশ হয়রান করবে? আর কবে এসব বন্ধ হবে?” ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উদ্যাপন হয়। যৌনকর্মীরা কিন্তু এখনও তাঁরা সরকারিভাবে কর্মী হিসাবে নথিভুক্ত নন। বছরের পর বছর শ্রমিকের মর্যাদা চাই’ বলে দাবি করে আসছেন। মর্যাদা পাননি বলে কিন্তু যৌনকর্মীরা ঘরে বসে নেই। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে শুধু দাবি বা পদযাত্রা নয়, শ্রম দিবসে তাঁরা কাজও বন্ধ রাখেন। সারা বিশ্বে অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে যখন স্বাভাবিক ছুটি যাপন করেন কর্মীরা, তখন যৌনকর্মীরা শ্রমিকের মর্যাদার দাবিতে কাজ বন্ধ রাখেন। এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে কাজল বসু বলেন, “আমরা ২৫ বছর ধরে সরকারি শ্রমদপ্তরের তালিকায় যৌনকর্মীদের কর্মী হিসাবে নথিভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছি। তা ছাড়া ইমমরাল ট্রাফিকিং অ্যাক্টের বিভিন্ন ধারা বাতিল করতে হবে।”
ভারতে আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ ঘোষিত যৌনকর্মীদের মোটামুটি এই কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—(১) লালবাতি এলাকার ভিতরে বা বাইরে যৌনপল্লিতে বসবাসকারী যৌনকর্মী, (২) পথচারী বা ভাসমান যৌনকর্মী, (৩) ছোটোবেলায় পারিবারিক দারিদ্রের জন্য দেবদাসী হিসাবে উৎসর্গীকৃত মেয়েরা, যাঁদের বেশিরভাগকেই পরে যৌনকর্মী হতে বাধ্য হয়, (৪) যাযাবর শ্রেণির মেয়েরা, যাঁদের ছোটোবেলা থেকেই যৌনকর্মী হওয়ার তালিম দেওয়া হয় এবং পরে পারিবারিক অভাব মেটানোর জন্য যৌনকর্মে নিযুক্ত করা হয়, (৫) যেসব মেয়েদের পূর্বপুরুষরা প্রথাগতভাবে পারিবারিক ভরণপোষণের জন্য মেয়েদের নাচগান পরিবেশনের উপর নির্ভর করতেন, তাঁদের অনেকে আজকাল বাইজি, নাচনি ইত্যাদি নামে যৌনকর্মে নিযুক্ত থাকেন, (৬) কলগার্ল বা শৌখিন যৌনকর্মী, যাঁদের অনেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত। যাঁরা নিজেদের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য আংশিক বা পুরোভাবে যৌনকার্যে নিযুক্ত থাকেন, (৭) পুরুষ এবং হিজড়ে যৌনকর্মী, যাঁরা টাকার বিনিময়ে প্রধানত মহিলা, সমকামী বা উভয়কামী পুরুষদের যৌনক্ষুধা মেটান এবং (৮) শিশু যৌনকর্মী, যাঁরা কলগার্ল ছাড়া উপরের সব শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত এবং যাঁদের বেশির ভাগই ট্র্যাফিকিংয়ের মর্মান্তিক শিকার। বস্তুত বেশিরভাগ যৌনকর্মীকেই ছলে-বলে-কৌশলে যৌনকার্যে নিযুক্ত করা হয়েছে। কেউ কেউ নানা দৈব-দুর্বিপাকে এমন এমন পেশায় মুখে পড়েছেন যে, নিছক বেঁচে থাকার তাগিদে যৌনপেশায় যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। যৌনকর্মীদের প্রতি সামাজিক বিরূপতা বা ঘৃণা এত গভীর ও ব্যাপক যে, যাঁর উপর একবার যৌনকর্মীর ছাপ পড়ে যায় তাঁর পক্ষে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসার কোনো উপায় থাকে না। ন্যূনতম মানবিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে চরম দারিদ্র্যে, জঘন্য পরিবেশে নানাভাবে নিপীড়িত হয়ে তাঁদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়।
উপরি প্রাপ্তি হিসাবে ভারতের বেশির ভাগ যৌনকর্মী কোনো না-কোনো যৌনরোগে প্রায়ই ভুগতেন। আজকাল তাঁদের অনেককেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু যৌন-সংসর্গের মাধ্যমে এইচআইভি নামক ভাইরাস শরীরে সংক্রামিত হলে যে মারণরাগ এইডসের উৎপত্তি হয়, তার কোনো প্রতিষেধক টিকা ওষুধ এখনও বেরোয়নি। যৌনকর্মীরাই এইডসের সবচেয়ে বড়ো শিকার। সেই অসুখ ছড়িয়ে পড়ে খদ্দেরদের মধ্যে। কারণ নিছক জীবিকার জন্য তাঁদের অনেক খদ্দেরকে যৌনতৃপ্তি দিতে হয় এবং বেশিরভাগ খদ্দের কণ্ডোম ব্যবহার করতে চান না। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন আর কেউ কন্ডোম ছাড়া যৌনকর্ম করতে পারবে না। ফলে যৌনরোগের প্রাদূর্ভাব অনেকটই কমেছে।
এইডস নিবারণ প্রকল্পের সহায়তায় যেসব যৌনকর্মীরা কন্ডোম ব্যবহারের অপরিহার্যতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন হয়েছেন। তবে দরিদ্র যৌনকর্মীদের মধ্যে দারিদ্রতার কারণে কন্ডোম ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক খদ্দেরকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। সেজন্য ভারতের কিছু শহরের লালবাতি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচ আই-ভি/এডসের প্রসার ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে এবং তার ফলে তাঁদের খদ্দেরদের মধ্যেও বাড়ছে। এইচআইভি আক্রান্ত খদ্দেরদের মাধ্যমে তাঁদের স্ত্রীদের শরীরেও এই ভাইরাস সংক্রামিত হচ্ছে। আবার স্ত্রীদের মাধ্যমে তাঁদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সন্তান এই ভাইরাসের শিকার হচ্ছে।
১৯৯০ দশকের প্রথম থেকে ভারতের কিছু শহরের লালবাতি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি/এইডস নিবারক প্রকল্প কার্যকারী হয়। কলকাতার সোনাগাছি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে শুরু হয় ১৯৯২ সাল থেকে। এই প্রকল্পের একটি অঙ্গ হিসাবে ওই এলাকার কিছু বাছাই করা যৌনকর্মীকে এইচআইভি/এইডস পরীক্ষা, কন্ডোম ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়ে পিয়ার এডুকেটর হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। রোজ কিছু সময় অন্যান্য যৌনকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের এইচআইভি/এইডস সম্বন্ধে সচেতন করা ও কন্ডোম ব্যবহারের পদ্ধতি ইত্যাদি শিখিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে একটি মাসোহারা বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পিয়ার এডুকেটররা বুঝতে পারলেন যে, যৌনকর্মীরা তাঁদের খদ্দেরদের সঙ্গে যৌন সংসর্গের সময়ে কন্ডোম ব্যবহার করতে যথেষ্ট আগ্রহী হলেও, খদ্দেররা সাধারণভাবে তা করতে একেবারেই অনিচ্ছুক। এটাও বুঝতে পারলেন যে, কোনো যৌনকর্মী তাঁর কন্ডোম ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক খদ্দেরকে প্রত্যাখ্যান করলে, সেই খদ্দেরের পক্ষে একটু বেশি টাকা খরচ করলে কন্ডোম ব্যবহার না-করেই যৌনকর্মে রাজি এরকম যৌনকর্মীকে আশেপাশেই পাওয়া শক্ত হয় না। ফলে কন্ডোমের ব্যবহারের অনুপাত প্রায় কিছুই বাড়ছিল না। যদিও এই মুহূর্তে যে-কোনো যৌনপল্লিতেই কন্ডোম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। কন্ডোম ছাড়া কোনো যৌনকর্মীই যৌনকর্ম করেন না। ফলে এইডসের প্রাদুর্ভাব এখন অনেকটাই নির্মূল হয়েছে। যৌনপল্লির মেয়েরা এটা বুঝেছে, কন্ডোম শুধু যৌনরোগ থেকেই মুক্তি দেয় না, মুক্তি দেয় অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ থেকে, মুক্তি দেয় ঘনঘন অ্যাবরশন থেকে, মুক্তি দেয় নিয়মিত গর্ভনিরোধক পিল খাওয়া থেকে। এমনকি তাঁদের যৌনাঙ্গের ভিতর-বাইরে পুরুষের বীর্যে মাখামাখি ও ধৌতকরণ থেকেও মুক্তি মিলল।
ডা. স্মরজিৎ জানা, যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটিকে। কিছু সাফল্য অবশ্যই এসেছে। যেমন সোনাগাছির যৌনকর্মীদের যে সমবায় তহবিল, সেই ‘উষা কোঅপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড’-এ নিবন্ধিকরণ করা গেছে যৌনকর্মীদের নামেই। এটা একটা বিরাট বড়ো সাফল্য, যেহেতু যৌনপেশা এখনও পূর্ণ বৈধ বৃত্তি বলে স্বীকৃত নয় ভারতের আইনে। কিন্তু ওই মূল জায়গাটায় সমস্যা থেকে গেছে। বহু উদ্যোগ সত্ত্বেও যৌনবৃত্তিকে বৈধ পেশায় স্বীকৃতি দেওয়া যায়নি। এ নিয়ে আইন সংশোধনের কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। যেমন যৌনকর্মীর সন্তানদের জন্য বারুইপুরে একটি হোস্টেল চালু হয়েছে, যেখানে থেকে সাধারণ স্কুলে, আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার সঙ্গে পড়াশোনা করতে পারবে তারা। আলাদা পরিবেশে থেকে। কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তো এখনও বদলায়নি। ফলে কোনো শিক্ষকই হয়তো ঘুরিয়ে এমন কোনো একটা খোঁচা দিয়ে দিলেন যে, বাচ্চাটির খারাপ লাগল। যে কারণে স্কুল থেকে ‘ড্রপ আউট’-এর সংখ্যাও খুব বেশি।
পিতৃপরিচয় ছাড়া শিশুদের স্কুলে নেওয়া হত না। যৌনকর্মীদের সন্তানদের কোনো পিতৃপরিচয় নেই। একমাত্র মা তাঁদের অভিভাবক। তাহলে কি যৌনকর্মীর সন্তানদের পড়াশোনার অধিকার থাকবে না? পড়াশোনা করে নিজের পছন্দের পেশায় নিযুক্ত হওয়ার অধিকার থাকবে না? সকলের জন্য শিক্ষা’—এই শ্লোগানের মাহাত্ম্য কী? যৌনকর্মীদের সন্তানদের অপরাধ কি কেবল তাঁর মা যৌনকর্মী বলে? পল্লিগুলি বাস করা একজন যৌনকর্মীর তো স্বামী থাকে না। তা ছাড়া সেই সন্তানের প্রকৃত পিতা কে তাও জানা সম্ভব নয়। আর জানা গেলেও সেই পুরুষ পিতৃত্ব স্বীকার করতে বাধ্যও নয়। অবশ্য যাঁরা নিজের বাড়ি থেকে বিশেষত বিবাহিতরা (নিজ সংসার সামলে) যৌনপল্লিতে বা অন্যত্র যৌনকর্ম করেন, তাঁদের পিতৃপরিচয়ের সমস্যা হয় না। কারণ তাঁদের কারোর স্বামী আছে, অথবা বিধবা, অথবা ডিভোের্স। সমস্যা হয় যৌনপল্লিতে স্থায়ীভাবে বাস করা যৌনকর্মীদের।
চালু এই ব্যবস্থার জন্য চড়া মাসুল মাশুল দিচ্ছেন যৌনকর্মীদের সন্তানরা। কারণ চালু এই ব্যবস্থার জেরেও সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। অথচ এখনও পর্যন্ত তাঁরা সমস্যারই সমাধান করতে পেরেছেন। সেই তুলনায় আবার অনেকে পিছিয়ে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের সন্তানরা। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের সন্তানরাও যাতে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, এ বার সেই প্রচেষ্টাই জারি রাখতে চলেছেন পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের সন্তানরা। কোন্ পথে, কীভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের সন্তানদের একজোট করা সম্ভব হতে পারে? কীভাবেই-বা সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করানোর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের সামিল করানো সম্ভব হতে পারে সেই ভাবনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের অন্যতম সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি। এই সংগঠনের অধীনেই আছে পশ্চিমবাংলা যৌনকর্মীদের সন্তানদের সংগঠন ‘আমরা পদাতিক’। তাঁরা লড়াই জারি রেখেছে। তবে এখনও অনেক পথ চলার বাকি থেকে গিয়েছে। যে কারণে একদিকে যেমন আরও পথ চলার জন্য অঙ্গীকার আছে। তেমনই অন্যদিকে আবার পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে পথ চলার স্বপ্ন এবং লড়াইও রয়েছে।
শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ নয়। সমাজের প্রান্তিক অংশের বাসিন্দা হিসাবে অন্যান্য রাজ্যের যৌনকর্মীদের সন্তানদেরও যদি সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করানোর জন্য প্রচেষ্টা জারি রাখা না-হয়, তাহলে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের প্রান্তিক অংশের বাসিন্দারাই। দেশের অন্য রাজ্যগুলির যৌনকর্মীদের সন্তানরাও যাতে পদাতিকের মতো কোনো সংগঠনের অধীনে থেকে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রয়াস জারি রাখতে পারে, সেই জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে পদাতিক। এখনও অনেক সমস্যা আছে। ওই সব সমস্যার মধ্যে অন্যতম হল সমাজের চালু ব্যবস্থা। এই সংস্কৃতির কারণে সন্তানের পরিচয় হিসাবে প্রথমেই পিতার নাম জানতে চাওয়া হয়। যৌনকর্মীদের সন্তানদের অনেকেই জানেন না তাঁদের পিতার নাম। যে কারণে সমাজের চালু এই ব্যবস্থার জন্য বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে যৌনকর্মীদের সন্তানদের। সেইজন্য স্কুল-কলেজ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কখনও অপমানিত, কখনও আবার হয়রানির শিকার হচ্ছেন যৌনকর্মীদের সন্তানরা। যে কারণে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে পিতৃপরিচয়ও সমস্যা হিসাবে দেখা দিচ্ছে। সন্তানের পরিচয় হিসাবে পিতা এবং মাতা দুজনের নামই নেওয়া যায়। কিন্তু সমাজের চালু ব্যবস্থার জন্য আগে পিতার নাম জানতে চাওয়া হয়। এই বিষয়টি মোকাবিলার জন্য আইনের বদল প্রয়োজন। আইন বদল করে প্রতিটি ক্ষেত্রে সন্তানের পরিচয় হিসাবে প্রথমে মায়ের নাম নেওয়ার বিষয়টি চালু হওয়া প্রয়োজন। অথবা পিতা বা মাতা যে-কোনো একজনের নামেই চলুক। বিশেষ করে আমাদের দেশ সহ বিশ্বের বহু দেশে সিঙ্গেল মাদার আছেন, তাঁদের সন্তানদেরও মাতার নামই সম্বল। আছে ধর্ষিতার সন্তানেরা, তাঁরা কেন পিতৃপরিচয় দিতে যাবেন? যদি পিতা বা মাতা যে কোনো একজনের নাম উল্লেখ করে সন্তানদের পরিচয় সম্পূর্ণ করতে পারে, তাহলে সার্বিকভাবে সমাজেরই মঙ্গল হবে। কলকাতার বিভিন্ন যৌনপল্লিতে যেভাবে যৌনকর্মীদের সন্তানরা আছেন, সেই তুলনায় আবার বেশি সমস্যায় আছেন কলকাতার বাইরে এ রাজ্যের বিভিন্ন যৌনপল্লির যৌনকর্মীদের সন্তানরা। কারণ ওইসব যৌনপল্লির অধিকাংশ স্থানেই সমাজবিরোধী তথা দুষ্কৃতীদের দৌরাত্মে যৌনকর্মী এবং তাঁদের সন্তানদেরও বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যে কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়িতেই সন্তানদের রেখে আসেন ওই সব স্থানের যৌনকর্মীরা।
তবে শুধুমাত্র যে আইন বদলের মাধ্যমে সন্তানের পরিচয় হিসাবে প্রথমে মায়ের নাম নেওয়ার দাবিই জানানো হচ্ছে, তা নয়। কারণ সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যৌনকর্মীদের সন্তানদের যুক্ত করানোর সঙ্গে নীতি-নির্ধারণের বিষয়টিও জড়িত আছে। ডাক্তার স্মরজিৎ জানা বলেন, “বাল্যবিবাহ রোধ এবং শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি সহ বিভিন্ন অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারি নীতি-নির্ধারক কমিটিগুলিতে যৌনকর্মীদের সন্তানদের প্রতিনিধি রাখার জন্য আমাদের দাবি আছে। কারণ নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে যদি যৌনকর্মীদের সন্তানদের তরফে প্রতিনিধি রাখা না-হয়, তাহলে যথাযথ নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সমস্যা বাড়ে বই কমে না।” একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, “আমরা পদাতিক’ শুধুমাত্র যৌনকর্মীদের সন্তানদের স্বার্থরক্ষার কথা বলে না। বরং সার্বিকভাবে শিশুদের অধিকার রক্ষার জন্যই লড়াই জারি রেখেছে এই সংগঠন। বাল্যবিবাহ রোধ সহ বিভিন্ন ধরনের মাদক দ্রব্যের ব্যবহার, শিশুদের উপর হিংসাত্মক ঘটনার বিরুদ্ধে এবং শিশুদের অধিকার রক্ষার বিশ্বজুড়ে আন্দোলনের শরিক ‘আমরা পদাতিক’।
পশ্চিমবঙ্গে যৌনকর্মীদের সন্তানদের আত্মসম্মান রক্ষার লড়াইয়ের জেরে প্রতি বছর এখন মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে ৩০ জনের বেশি সফল হচ্ছেন। যৌনকর্মীদের সন্তানরাও এখন চাকরি করছেন। তেমনই শুধুমাত্র শিক্ষা নয়, তার সঙ্গে ফুটবল সহ বিভিন্ন ধরনের খেলা এবং নাচ-গান-ছবি আঁকা সহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও পদাতিকের মাধ্যমে যুক্ত আছেন যৌনকর্মীদের সন্তানরা। ডাক্তার স্মরজিৎ জানার কথায়, “আমরা পদাতিকের মতো যৌনকর্মীদের সন্তানদের এত বড়ো মাপের সংগঠন আর কোথাও নেই। তবে সমাজের বিভিন্ন অংশে এখনও বিভিন্ন ধরনের হুঁত্সর্গ রয়েছে। যৌনকর্মীদের সন্তানরাও বিভিন্ন ধরনের হুঁৎমার্গ থেকে মুক্ত নয়। সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে যৌনকর্মীদের সন্তানদের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি সার্বিকভাবে তখনই সফল হবে, যখন বিভিন্ন ধরনের হুঁৎমার্গ থেকে তাঁরা মুক্ত থাকতে পারবেন।” সাধারণ মানুষের মানসিকতা উন্নত না-হলে, কীভাবে বিভিন্ন ধরনের ছুঁৎমার্গ থেকে মুক্ত হবে সমাজ?
তবে যৌনকর্মীদের সন্তানদের পড়াশোনা শেখানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা অন্য পেশায় যেতে পারে, স্বাবলম্বী হয়। যৌনকর্মীর সন্তানেরা যাতে কোনোভাবে সমাজে নিজেদের অচ্ছুৎ বা অপাংক্তেয় না মনে করতে পারে, সেজন্য খুব জরুরি ছিল এই উদ্যোগ। এখন যৌনকর্মীর সন্তানেরাও মূল ধারার স্কুলে ভর্তি হচ্ছে। তাদের নিজস্ব একটা ফুটবল দল হয়েছে, যে দল গত বছর তৃতীয় ডিভিশনে খেলার পর দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলার যোগ্যতামান পার করেছে।
শিশুর বড়ো হয়ে ওঠার সঙ্গে অনেকগুলো জিনিস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শিক্ষা তেমন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তেমনই দরকার সঠিক পরিবেশটাও। সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ বা সমাজের সঙ্গে যোগ না-থাকলে শিশুদের বড় হওয়ার সঙ্গে খারাপ সঙ্গ বা ভুল পথে চলে যাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকে বলে মনে করেন চাইল্ড সাইকোলজিস্টরা। যৌনকর্মীদের সন্তানদের ভুল পথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি থাকে। অনেকেই এমন আছে যারা জানেই তার বাবা কে! কিন্তু মা আছে। পেটের টানে তিনি এমন জায়গায় এসে পড়েছেন যে সেখান থেকে আর বেরোবার জায়গা নেই। দুই কুঠুরির ঘরে ভালো করে বসার জায়গাও থাকে না যৌনকর্মীদের। এর মধ্যেই অহোরাত্র কাস্টমারদের যাতায়াত লেগেই আছে। এর মধ্যে পড়াশোনা শিখে আলোর পথ দেখার সম্ভাবনা কম। এমনটাই জানাচ্ছে দুর্বার সমন্বয় সমিতির প্রধান ডঃ স্মরজিৎ জানা। তার চেষ্টাতেই দুর্বারের বারুইপুর হোমে আরও বড় ঘরে থাকার সুযোগ পাচ্ছে যৌনকর্মীর সন্তানরা। শিশু দিবসে এটাই হতে চলেছে ওদের গিফট। যেমন রফিক মণ্ডল জানাল, “আমাদের পড়াশোনার জায়গা ছিল না, এই হোম পাওয়ার পর আমাদের খুব সুবিধা হয়েছে।” আগে যে জায়গা ছিল সেখানে মাত্র ৩০ জনের থাকার। জায়গা। বারুইপুরের বাড়িতে আরও ৭০ জন যৌনকর্মী সন্তানের থাকার সুযোগ হবে। ওই সব ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের মায়েরা মীনা সর্দার, সুনীতা অধিকারী, আলোরানি বিশ্বাসরাও খুবই খুশি এই সুবিধা পেয়ে।
যৌনকর্মীদের পল্লিতেও স্কুল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হল। যৌনকর্মীদের পল্লি এলাকায় শিশু ও বয়স্কদের স্কুল খোলায় উদ্যোগী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সমাজ নগরে প্রায় ৫০ জন যৌনকর্মী রয়েছেন। পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ৩০-৩৫ জন। তাদের জনা পনেরো স্কুল যায় না। তার কারণ যৌনকর্মীর সন্তান হওয়ায় স্কুলে গেলে সহপাঠীদের কাছ থেকে নানা কটুক্তি শুনতে হয়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির তরফে ২০০৫ সালে বিদ্যাসাগর সর্ব শিক্ষা বিদ্যালয় চালু করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থের অভাবে তা এখন বন্ধ। উদ্যোক্তারা এলাকায় স্কুলের প্রয়োজন আছে। শিশু ও বয়স্করা যাতে পড়াশোনা করতে পারে, সে চেষ্টা করা হবে। সঙ্গে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা রাখা হবে। সে জন্য এলাকায় একটি ঘরের দরকার। তিনি বলেন, “আমার চেষ্টা শুরু করেছি। আশা করছি শীঘ্রই স্কুল চালু করা যাবে।” অভিভাবক মঞ্চের সম্পাদক ল্যারি বসু জানান, “২০০৫ সালে একটি স্কুল শুরু করেছিলেন তাঁরা। অর্থাভাবে তা পরে বন্ধ হয়ে যায়। পরে স্কুল চালু করার প্রতিশ্রুতি দেন।” এলাকার বাসিন্দা তথা দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সদস্য শিপ্রা সিংহ জানান, এই পল্লির অধিকাংশ বাচ্চা বাইরের স্কুলে পড়তে চায় না। তিনি বলেন, “এলাকায় স্কুল হবে শুনে ভালো লাগছে।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যৌনকর্মীরা জানান, “আমাদের সন্তানদের সমাজ ভালো ভাবে নেয় না। হাসি ঠাট্টা করে। এলাকায় স্কুল হলে তারা পড়াশোনা করতে পারবে।”
যৌনকর্মীদের উপর নির্যাতনের শেষ নেই, যা বলে শেষ করার নয়। এমনকি যৌনদস্যুদের অত্যাচারেও গণিকারা অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। বছর ঘুরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস আসে যায়। কিন্তু যৌনকর্মীদের জীবনে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কোনো প্রভাব পড়ে না। দিনদিন যৌনদস্যুদের লাগাতার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে বিভিন্ন যৌনপল্লির যৌনকর্মীরা। যৌনকর্মীদের সুত্রে জানা যায়, পেট বাঁচাতেই তাঁরা এ পেশায় এসেছে। ভ্রাম্যমান যৌনকর্ম করে কোনোমতে তাঁরা দিন যাপন করে। একদল যৌনদস্যু তাঁদেরকে বারবার ঠকিয়ে মানবেতর জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাঁরা জানান ওই সমস্ত যৌনদস্যু খদ্দের সেজে তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করে খদ্দেরদের পছন্দমতো স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পরেই ঘটে বিপত্তি। যৌনকর্মীরা জানান, চুক্তি অনুযায়ী যতজন খদ্দের সেখানে থাকার কথা থাকে তার চেয়ে অনেক বেশি। ভুয়ো খদ্দের সেজে যৌনদস্যুরা তাঁদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মনমতো ভোগ করার পর কখনো নামমাত্র কিছু টাকা দেয়, কখনো-বা খালি হাতে মারপিট করে ফিরিয়ে দিচ্ছে। যৌনকর্মীরা তাঁদের ন্যায্য মূল্য চাইলে তাঁদেরকে এলাকা থেকে উচ্ছেদসহ নানাপ্রকার হুমকি প্রদান করে থাকে। সামাজিকভাবে তাঁদের অবস্থান ক্ষীণ হওয়ায় তাঁরা কারও কাছে বিচার চাইতে গেলে উলটো তাঁদেরকে এলাকা ছাড়তে বলা হয়। এলাকায় ভুয়ো খদ্দের নামক যৌনদস্যুদের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে কে খদ্দের আর কে যৌনদস্যু তা বুঝতে পারছে না যৌনকর্মীরা। একেক বার একেক জন তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করলেও ঘটনাস্থলে পরিচিত বেশ কিছু যৌনদস্যুর কবলে তাঁরা বারবার পড়ছে বলে। দেশের বিভিন্ন শহরে যৌনকর্মীদের জীবন মানোন্নয়নে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও মফস্বল এলাকাগুলির যৌনপল্লিতে কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করে না। যৌনকর্মীদের দাবি এলাকার মানুষ যৌনবৃত্তিকে পাপ আর যৌনকর্মীদেরকে পাপী হিসাবে দেখে, ঘৃণা করে। কিন্তু যেসব যৌনদস্যু প্রতারণার মাধ্যমে বিনামুল্যে তাঁদের পাপী শরীরগুলোকে ভোগ করছে সমাজপতিরা তাঁদের দিকে একবারও নজর দিচ্ছে না, বরং এটাকে ভালো কাজ হিসাবেই দেখছে।
যৌনকর্মীদের নিয়ে বাংলাদেশেও অনেক কাজ হচ্ছে। যৌনকর্মীদের নিরাপত্তা, জীবন ও জীবিকার অধিকার বিষয়ে এক গণশুনানিতে যৌনকর্মীদের জীবন ও জীবিকার অধিকার প্রশ্নে রাষ্ট্রকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। তাঁদের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল’ না হয়ে সংবেদনশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ চারটি সংগঠন এই গণ-শুনানির আয়োজন করে। আয়োজক হিসাবে ছিল মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন সংহতি, সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক ও সোয়াসা। রাষ্ট্রকে তার সামাজিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত করে মোট ১০টি সিদ্ধান্ত ও দুটি সুপারিশ করা হয়েছে গণশুনানিতে।
মিজানুর রহমান বলেছেন–“যে-কোনো ধরনের অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কমিশনে অভিযোগ দায়ের করুন। প্রয়োজনে কমিশন আইনি লড়াইয়ে আপনাদের থাকবে।” সাতজন যৌনকর্মীর অভিজ্ঞতা শোনার পর তিনি বলেছেন–“এ ধরনের অনুষ্ঠানে বিচারকের ভূমিকায় এসে আমি মর্মাহত, লজ্জিত। এনাফ ইজ এনাফ। রাষ্ট্র তুমি সংযত হও।” সারা দেশ থেকে আসা যৌনকর্মী ও যৌনকর্মীদের নিয়ে কর্মরত সংগঠনগুলোর উপস্থিতিতে এই গণশুনানিতে পুনর্বাসন সমস্যা, পুলিশি হামলা আর পাড়া-মহল্লার সন্ত্রাসীদের নির্যাতন ও হয়রানি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন যৌনকর্মীরা। তাঁরা বলেছিলেন–“পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের যৌথ হামলার শিকার হয় তাঁরা। কোথাও বিচার চাইতেও যেতে পারে না। উলটে তাঁদেরকেই চুরি, ছিনতাই, পাচার সহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করে কারাগারে পাঠানো হয়। ভোটের অধিকার যখন আছে, তখন রাষ্ট্র আমাদের মৌলিক অধিকার পূরণে বাধ্য।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বিচারক হিসাবে যে সিদ্ধান্তগুলো পড়ে শোনান, তা হল–পুনর্বাসন না-করা পর্যন্ত পেশা হিসাবে যৌনকর্মকে স্বীকৃতি দিতে হবে, পুলিশি হয়রানি বন্ধ ও দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে, যৌনপল্লির পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, আদালত ও বিচারকদের আরও সংবেদনশীল হতে হবে। যাঁরা নির্বাচনে দাঁড়ান তাঁরা প্রতিনিধি হিসাবে যেন যৌনকর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় মনোযোগী হন। পাশাপাশি যৌনকর্মীদের আইনি সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন। করতে হবে।”
যৌনপেশায় কিছু দিককে আইনি বৈধতা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’। আর এমন প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে সরব হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। ইরান চুক্তি থেকে শুরু করে অনেক চলমান ইস্যুর ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ মূল বিষয়টি সম্পর্কে অবগত না-হয়েই অন্যের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে নিজের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ নিজস্ব টুইটার অ্যাকাউন্টে তাই এই সংক্রান্ত প্রস্তাবিত নীতির প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। অ্যামনেস্টি মনে করে–শরীর বিক্রির পেশায় যেসব মেয়েরা যুক্ত তাঁদের অধিকার রক্ষা রাষ্ট্র সব ধরনের দায়িত্ব নিক। এঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবে ‘অপরাধী’ বলে চিহ্নিত করা বন্ধ করুক।
তবে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত শোনা যাচ্ছে। কেউ অ্যামনেস্টির এই অবস্থানকে স্বাগত জানিয়ে যৌনকর্মীদের অবস্থার উন্নতির আশা করছেন। কেউ এই নীতির চরম বিরোধিতা করছেন। সেইসঙ্গে আছেন সনিয়া ডলিনসেকের মতো কিছু মানুষ, যাঁরা মনে করেন, অ্যামনেস্টি যৌনকর্মীদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট অবস্থান নিয়ে অত্যন্ত ভালো কাজ করেছে। যৌনকর্মীদের কাজ সম্পর্কে অ্যামনেস্টির নীতির পক্ষে অনেকেই সমর্থন জানিয়েছেন। কারমেন অ্যামিসিটিয়ে মনে করেন, যৌনকর্মীদের জন্য এটা ভালো দিন। কিউটক্যাট্রিয়য়ানা নামের আড়ালে এক টুইটার ব্যবহারকারী মনে করেন, বিরোধীরা এই প্রস্তাবের মর্ম বুঝতে পারছেন না। এর সাহায্যে নিপীড়ন, হিংসা, মানবপাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। এইলিন স্মার্ট অভিযোগ করেছেন, অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে অ্যামনেস্টির নীতির ভুল মূল্যায়ন ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাঁর মতে, অবিলম্বে তা বন্ধ করা উচিত। ডনিয়া ক্রিস্টিন আবেগে আপ্লুত হয়ে অ্যামনেস্টির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
বিরোধীরাও যথেষ্ট সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। রেচেল মোরান নামের এক প্রাক্তন যৌনকর্মী, লেখক ও ব্লগার নিজস্ব টুইটার অ্যাকাউন্টে এই ভয়াবহ জগত সম্পর্কে নিজের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতার কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। একটি টুইটে তিনি লিখেছেন, অ্যামনেস্টি তাঁদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতি সমর্থন জানানোর ফলে যৌন ব্যাবসা ও মানব পাচারের কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া অসংখ্য মানুষ তাঁর কাছে অশ্রুপাত করছেন। নারীবাদী সংগঠন ‘ফেমেন’-এর সুইডেন শাখা অ্যামনেস্টির প্রস্তাবের বিরোধিতা করে লিখেছেন—“যেসব মানুষদের টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে, এখন তাঁদের অধিকার যৌনপেশার দালালদের চেয়েও কমে গেল। অ্যামনেস্টি যৌন ক্রেতা ও দালালদের ‘অ্যামনেস্টি’ ক্ষমা করে দিল। প্রায় একই সুরে অভিযোগ করেছেন আন্দ্রেয়াস পেটারসন। লার্স ওলি আবেগের সঙ্গে লিখেছেন—“বিদায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল। নারী অধিকারের জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তোমাদের সংগঠনের উপর আর আস্থা রইল না।”
যৌনপেশা ও যৌনকর্মীদের বিরোধীরা মনে করে অ্যামনেস্টি যৌনকর্মী ও দালালদের বৈধ করতে চায়। বলা হচ্ছে বেশ্যালয়ের মালিকানাকে বৈধ করার সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। যৌনপেশাকে পুরোপুরি ‘ডিক্রিমিনালাইজ’ করা, অর্থাৎ অপরাধ হিসেবে গণ্য না-করার সপক্ষে অ্যামনেস্টি। ডাবলিনের ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিলের এক সভায় ৭০টি দেশ থেকে আগত ৪০০ প্রতিনিধির এক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দৃশ্যত প্রস্তাবটি সমর্থন করেন, যদিও ভোটাভুটির কোনো খুঁটিনাটি তথ্য দেওয়া হয়নি।
অ্যামনেস্টি বিভিন্ন যৌনকর্মী সংগঠন ও গোষ্ঠী, এইচআইভি/এইডস ত্রাণকর্মী এবং মানুষ পাচার বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে দু-বছর ধরে কথাবার্তা বলার পর এই সিদ্ধান্তে আসে যে, যৌনকর্মীদের মানবাধিকার রক্ষার শ্রেষ্ঠ পন্থা হল দালালি ও গণিকালয়ের মালিকানা সহ সব ধরনের যৌন-পরিসেবাকে বৈধ ঘোষণা করা। এর ফলে যৌনকর্মীদের মারধোর, যৌন নির্যাতন, অকারণে গ্রেপ্তার, ব্ল্যাকমেল, নারী পাচার ও জোর করে এইডস পরীক্ষার ঘটনা কমবে, বলে অ্যামনেস্টির ধারণা। কাজেই অ্যামনেস্টির মহাসচিব সলিল শেট্টি একটি ‘ঐতিহাসিক দিনের কথা বলেন।
তবে ডাবলিনের এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার আগে থেকেই অ্যামনেস্টির অভিপ্রায় জ্ঞাত ছিল এবং অপরাপর বহু নারী অধিকার গোষ্ঠী সমালেচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘Coalition Against Trafficking in Women’ বা নারী পাচার বিরোধী জোটের কার্যনির্বাহী পরিচালক তাইনা বিয়্যাঁ এইমের মতে, যৌনকর্ম সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যকলাপ অপরাধের তালিকা থেকে অপসারণ করার অর্থ দালালদের Business-man’-এ পরিণত করা, যাতে তাঁরা নির্বিচারে অসহায়দের ‘বেচতে পারে। ডাবলিনের ভোটের আগেই নারী পাচার বিরোধী জোট একটি খোলাচিঠিতে সাবধান করে দিয়েছিল যে, এর ফলে অ্যামনেস্টির ভাবমূর্তি ‘বিশেষভাবে মলিন’ হবে। সিএটিডাব্লিউ-এর অনলাইন পিটিশনে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার স্বাক্ষর পড়েছে। যাঁরা স্বাক্ষর করেছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন মেরিল স্ট্রিপ, কেট উইন্সলেট এবং এমা থমসনের মতো হলিউড তারকারাও আছেন।
নারী অধিকার গোষ্ঠী ‘Equality Now’-এর নারী পাচার বিরোধী কর্মসূচির পরিচালক এশোহে আঘাটিসে বলেছেন—“বাণিজ্যিক যৌনসম্ভোগের চাহিদা বাড়ার ফলেই নারী পাচার বাড়ে। তখন হঠাৎ নীতি বদলে বলতে পারে না যে, যাঁরা সেই চাহিদা বাড়াচ্ছে, চলো তাদেরই সুরক্ষা দেওয়া যাক।” তাই বিয়্যাঁ এইমও বলেছিলেন—শোষিতদের রক্ষা করার জন্য শোষণকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। অপরদিকে অ্যামনেস্টি বলছে—‘Forced Labour’ বা বেগার খাটানো কিংবা যৌন শোষণের জন্য নারী পাচার ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
বিষয়টি এমনই বিতর্কিত যে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আইনকানুন চালু আছে। আইসল্যান্ড, সুইডেন এবং নরওয়েতে যৌনকর্মীদের পরিবর্তে তাঁদের গ্রাহকদেরই অপরাধী হিসাবে দেখা হয়। সম্প্রতি ফ্রান্সও যে পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করছে। ইউরোপের বহু দেশে গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ। অপরদিকে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড এবং আরও কয়েকটি দেশে তা সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত।
কলকাতার সোনাগাছিতে ‘ঊষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। সোনাগাছির যৌনকর্মীদের জন্য এই সংস্থাটিও অভূতপূর্ব কাজ করছে। ঊষা কো-অপারেটিভ সম্পর্কে আরও একটু জেনে রাখা প্রয়োজন আমাদের। এই প্রতিষ্ঠানের একটা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস জানতে আমাদের একটু পিছন দিকে যেতে হবে। উষা কো-অপারেটিভের যাত্রা শুরু ১৯৯৫ সালের ২১ জুন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতাই নয়, সারা ভারত মায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম যৌনকর্মীদের কো অপরেটিভের বিস্তার। যৌনকর্মী সদস্যদের আর্থিক কল্যাণের উদ্দেশ্য মাথায় রেখেই এ পথ চলা। তার পরের ইতিহাস দীর্ঘ ২৩ বছরের এক উত্থানের ইতিহাস রচিত হয়ে গেল। ১৯৯৫-৯৬ সালে যে সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৯৪ জন, সেই সংখ্যা ২০১২-১৩ সালে এসে দাঁড়াল ১৯ হাজার ৭২২ জন। এই সংখ্যাটা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৯৯২ সালে ‘All India Institute of Hygiene and Public Health’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সহায়তায় সোনাগাছি অঞ্চলে যৌনস্বাস্থ্য প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। উদ্দেশ্য, যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসচেতন করে তোলা। যৌনকর্মীদের ঘরে ঘরে গিয়ে এইডস সহ বিভিন্ন যৌনরোগ এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা বোঝাতে শুরু করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে শিখল শুধু স্বাস্থ্যসচেতন হলেই চলবে না, প্রয়োজন অর্থনৈতিক সুরক্ষা।
একসময় অভাব-অনটনের সময় কিস্তিওয়ালা সুদখোরদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হত এবং সেই ঋণ শোধ করতে দম বেরিয়ে যেত। পথে বসার উপক্রম হত। এহেন এক পরিস্থিতিতে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সদস্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ‘উষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি। উষা কো-অপারেটিভ প্রথমদিকে কলকাতা সহ হাওয়ার পৌর এলাকায় কাজ করার অধিকার পেলেও পরে ২০০৯ সালে উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ এই চারটি জেলাতেও কাজ করার অধিকার পায়। অবশ্য ২০০১ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত যৌনকর্মীরাই চাইছিলেন উষার ছায়াতলে ঠাঁই পেতে। নানা আবেদন নিবেদনের পর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সমবায় মন্ত্রী রবীন্দ্র ঘোষ যৌনপল্লি এলাকায় যৌনকর্মীদের কো-অপরেটিভ গড়ে তোলার অনুমোদন দেন। উষা কো-অপারেটিভ ব্যাংক আজ যৌনকর্মীদের নিজস্ব ব্যাংক। ভুলে গেলে চলবে না, এই কো-অপারেটিভ গড়ে ওঠার আগে কোনো ব্যাংকই যৌনকর্মীদের টাকা জমা রাখত না। পেশা আর ঠিকানাই যৌনকর্মীদের কষ্টার্জিত অর্থ থেকে কিছুটা সঞ্চয় করে রাখার অধিকার দিত না। এখনও সেই অধিকার পাওয়া যায়নি। ফলে প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অর্থ নিজেদের কাছেই রাখতে হত এবং সেটা খরচও হয়ে যেত। প্রয়োজনের সময় ঋণ করা ছাড়া কোনো উপায়ই থাকত না। উষা কো-অপারেটিভ ব্যাংক যৌনকর্মীদের সেই সমস্যার সুরাহা এনে দেয়। শুধু সঞ্চয়ই নয়, প্রয়োজনের সময় সহজ শর্তে ঋণও পেতে পারে যৌনকর্মীরা। সেভিংস ডিপোজিট (বার্ষিক সুদের হার ৫ শতাংশ), খ্রিফট ফান্ড (বার্ষিক সুদের হার ৭ শতাংশ), রেকারিং ডিপোজিট (বার্ষিক সুদের হার ৯.০৬ শতাংশ), মাসিক আয় প্রকল্প (বার্ষিক সুদের হার ৮ শতাংশ), স্থায়ী জমা প্রকল্পে (৮ বছর ৫ মাসে ডাবল)। ১৯৯৫-৯৬ সালে আমানত জমা পড়েছিল মাত্র ৩ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ সালে এসে আমানত বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়াল ১৬২৫ লাখে।
উষা কো-অপারেটিভ এখানেই থেমে থাকেনি। উষা বোঝে আরও অনেক কাজ করতে হবে। যৌনরোগ এড়াতে কন্ডোমের কোনো বিকল্প নেই। বাইরে থেকে কন্ডোম কিনলে খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। তাই যাতে সুলভে ও সঠিক মানের কন্ডোম তাঁরা যাতে পেতে পারে, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে কন্ডোমের সামাজিক বিপণনের ব্যবস্থা শুরু করে। সারা পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীরা এই কন্ডোম ব্যবহার করে। যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করেন এমন। বহু সংস্থাকেও উষা কো-অপারেটিভ কন্ডোম বিক্রি করছে। এছাড়াও স্টেশনারি ব্যাবসা, ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের ব্যবসা, প্রসাধনী ব্যাবসা, কৃষি উৎপাদন ও বিপণন, পশুপালন ও মৎস্য চাষ এবং সেইসঙ্গে ন্যাপকিনের ব্যাবসাও করছে। যৌনকর্মী ও যৌনকর্মীদের সন্তানদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পথ প্রশস্ত করতেই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
চিটফান্ডের কবলে পড়ে উষা কো-অপারেটিভের আমানত লক্ষণীয়ভাবে কমতে শুরু করে দিয়েছিল। বহু যৌনকর্মী বেশি সুদের লোভে উষায় টাকা না-রেখে চিটফান্ডগুলিতে টাকা রাখতে শুরু করে দিয়েছিল। ঘটনায় দেখা গেছে লোভের বশে সোনাগাছি এলাকায় শুধু যৌনকর্মীরাই নয়–যৌনকর্মীর বাবু দালাল, বাড়ির কাজের লোক সবাই এইসব ভুয়ো সংস্থায় অর্থ লগ্নি করেছিলেন। মোট বিনিয়োগ কোটি টাকা ছাপিয়ে যাবে। উষা কো অপরেটিভ নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ক্রমশ সঞ্চয়ী হয়ে উঠছেন এই রাজ্যের যৌনপল্লিগুলির মেয়েরা। পেশায় থাকাকালীন একটি পয়সাও সঞ্চয় না করায় এই রাজ্যের যৌনকর্মীদের ভিতর অনেকেই একটা বয়সের পর ফুটপাথে বসে ভিক্ষা করেছেন অথবা শেষ বয়সে চরম দুর্গতির শিকার হয়েছেন। জীবনের নির্মমতা ক্রমাগত যন্ত্রণা দিয়েছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর অশক্ত হয়েছে, আকর্ষণ হারাচ্ছে। একে তো সারাটা জীবন সমাজে প্রান্তিক মানুষ হিসাবে জীবন কাটানো। তার ওপর এই সমাজেরও ওঁদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর মানসিকতা ছিটেফোঁটাও ছিল না। ফলে পেশা থেকে সরে যাওয়ার পরের দিনগুলিতে যৌনকর্মীদের একাংশের চরম দুর্গতি অনেক যৌনকর্মীর চোখ খুলে দিয়েছে। ফলে তাঁদের ভাবনা চিন্তায় বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে। যৌনকর্মীদের ভিতর সঞ্চয়ের প্রবণতা বেড়েছে। তাঁদের একটা বড়ো অংশ নিয়মিতভাবে সঞ্চয় করছেন। রোজগারের উত্তুঙ্গ সময়ে সঞ্চয় করার অভ্যাসটি যে-কোনো মানুষেরই সুঅভ্যাসের মতো করে অনুশীলন করা উচিত। সারা বাংলার যৌনকর্মীদের ভিতর গরিষ্ঠ সংখ্যকই এখন এমনটি মনে করেন। কিন্তু কলকাতা সহ এই রাজ্যের বিভিন্ন যৌনপল্লিগুলিতে নিয়মিত কিছু কিছু করে টাকা সঞ্চয় সম্পর্কে সচেতনতা জাগানোর কাজটি করতে সময় লেগেছে প্রায় দুটি দশক। এখন তাঁর সুফল ভোগ করছেন অধিকাংশ যৌনকর্মী। এর কৃতিত্ব প্রাপ্য ঊষা মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের। এটি যৌনকর্মীদের জন্যে তৈরি প্রথম সমবায়। জানা গিয়েছে, সমবায়ের টার্ন ওভার এখন বার্ষিক ২৯ কোটি টাকা।
কলকাতা শহরের সোনাগাছি যৌনপল্লিটি মহানগরীর সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম যৌনপল্লি। এছাড়াও, মহানগরীর পরিচিত যৌনপল্লিগুলির ভিতর রয়েছে রামবাগান, বৌবাজার, ওয়াটগঞ্জ, খিদিরপুর, কালীঘাট এলাকার যৌনপল্লিগুলি। এছাড়াও দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ জুড়ে বিভিন্ন যৌনপল্লিগুলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন যৌনপেশার সঙ্গে যুক্তরা। এঁদের ভিতর একটা বড়ো অংশই ওই যৌনপল্লিগুলিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কেবলমাত্র সোনাগাছিতেই যৌনকর্মীর সংখ্যা অন্ততপক্ষে ৯ হাজার। ১৯ থেকে ৪৫ বছর বয়স্ক মেয়েরা এখানে যৌনপেশায় যুক্ত। মাথা পিছু দৈনিক রোজগার অবশ্য একেক রকম। জানা গিয়েছে, বয়স্ক মহিলাদের চেয়ে তরুণীদের রোজগার তুলনায় অনেকটাই বেশি। সোনাগাছির বাসিন্দা একজন তরুণী যৌনকর্মী দিনে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করে থাকেন। এখানকার বাসিন্দা যৌনকর্মীদের ন্যূনতম দৈনিক আয় গড়ে ৫০০ টাকা। তবে বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়ের পরিমাণও কমতে শুরু করে।
শেষ করব এমন কয়েকটি কয়েকটি সংগঠনের কথা বলে যাঁরা বহু বছর ধরে যৌনকর্মীদের নিরাপত্তা, অধিকার ও স্বাস্থ্য নিয়ে আন্দোলন ও লড়াই করছেন। গণস্বাস্থ্য কর্মসূচি বর্তমানে বেশ কয়েকটি এনজিও এবং সরকারি সংস্থা এইডস সহ যৌনরোগ প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এনজিও প্রতিষ্ঠান ‘সংলাপ’-এর প্রতিষ্ঠাতাদের দ্বারা রচিত এই ‘গিলটি উইথআউট ট্রায়াল’ যৌনপল্লির শরীর-ব্যাবসার বহু তথ্য জ্ঞাপন করে। ২০০৫ সাল থেকে সোনাগাছি প্রকল্প যৌনকর্মীদের সমবায়। সমবায়টি এই অঞ্চলের যৌনকর্মীদের মধ্যে কাজ করে তাঁদের মধ্যে কন্ডোম ব্যবহার ও মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিষয়ে সচেতনতার কথা প্রচার করে। ১৯৯২ সালে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী স্মরজিৎ জানা এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে যৌনকর্মীরাই এই প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখেন। এই সংস্থায় কৃতিত্ব যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ কমিয়ে এনেছে, যা ভারতের অন্যান্য নিষিদ্ধপল্লির তুলনায় বেশ কম। সেইজন্য রাষ্ট্রসংঘের এইডস কর্মসূচিতে এটি ‘বেস্ট প্র্যাকটিস মডেল’ বলে বন্দিত হয়েছে। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি সোনাগাছি প্রকল্প সহ পশ্চিমবঙ্গের ৬৫,০০০ যৌনকর্মী ও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। এঁরা যৌনকর্মীদের অধিকার, স্বীকৃতি ও যৌন-ব্যাবসার বৈধকরণের দাবি জানার। এছাড়াও তাঁরা বিভিন্ন শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের কর্মসূচি পালন করে।
১৯৯৭ সালের ১৪ নভেম্বর কলকাতায় আয়োজিত এই সম্মেলনের শিরোনাম ছিল–Sex Work is Real Work : We Demand Workers Rights’। ২০০৫ সালে ‘Born into Brothels’ নামে তথ্যচিত্রটি তৈরি করে শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র বিভাগে অস্কার ছিনিয়ে আনে। এই তথ্যচিত্রে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের সন্তানদের জীবনযাত্রা চিত্রিত হয়েছে। এতদিন যৌনপেশার পরিধি সীমাবদ্ধ ছিল মূলত দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট এবং গৌরীশংকর লেনের মধ্যেই। এখন সোনাগাছির এলাকা ক্রমেই বাড়ছে, চারপাশ দিয়ে বাড়ছে। যৌনকর্মীরাও ছড়িয়ে পড়ছেন আশেপাশের অঞ্চলে।
দুর্বারের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের অন্যান্য কিছু এলাকায় যৌনকর্মীরাও তাঁদের নিজস্ব সংস্থা গড়ে তুলেছে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল–পঞ্চম (বিহার), সাভেরা (দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার), সেক্স ওয়ার্কার্স ফোরাম (কেরল), বেশ্যা এইডস মোকাবিলা পরিষদ (মহারাষ্ট্র), উইমেন্স ইনিশিয়েটিভ (তিরুপতি)। এছাড়াও সারা বিশ্বে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর। বাংলাদেশের দুর্জয় নারী সংঘ, উল্কা নারী সংঘ, অক্ষয় নারী সংঘ ইত্যাদি।
ভারতের লক্ষ লক্ষ যৌনকর্মীদের পক্ষে সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের নানাবিধ অধিকারের দাবি করা এবং ইতোমধ্যে অতি অল্প হলেও তার কিছুটা আদায় করা তাঁদের নিজেদের কাছে বা অন্যদের কাছেও ১৫ বছর আগে প্রায় স্বপ্নেরও অতীত ছিল। অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের কিছু দেশে যৌনকর্মীরা বেশ কয়েক বছর হল তাঁদের নিজেদের কিছু দাবি-দাওয়া আদায় করতে পেরেছে। কিন্তু এইসব যৌনকর্মীরা ভারতের ও অন্যান্য অনুন্নত দেশের যৌনকর্মীদের মতো এত দরিদ্র, এত নির্যাতিত ও এত অসহায় কখনোই ছিল না। ভারতের যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়নের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে তা আরও জোরালো হবে এবং অন্যান্য অনুন্নত দেশের যৌনকর্মীদের পক্ষে পথ-প্রদর্শক হিসাবে গণ্য হবে।
বস্তুত মানুষ হিসাবে আমরা সবাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পুঁজিবাদের বদ্ধভূমিতে বন্দি হয়ে পড়ছি ক্রমশ। ক্ষমতার লড়াই চলছে সর্বত্র। নারীও পিছিয়ে নেই, সেই লড়াইয়ে নারীও সামগ্ৰীক অংশীদার। সবাই জানে ক্ষমতায়নের প্রধান রসদ অর্থ। সেই অর্থ নিজের ঘরে মজুত করার জন্য ‘ভালো’ বা ‘মন্দ’ কোনোকিছুতেই দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। তাঁরা সেই সারসত্য মেনে নিয়েছে–লজ্জা ঘৃণা ভয়, তিন থাকতে নয়। তাই এ কাজে পাপবোধ হয় না?” এমন প্রশ্নে জনৈক যৌনকর্মী সপ্রতিভ উত্তর দিলেন–“আরে ধুস। শরীরে যৌনাঙ্গ আছেই তো যৌনকর্ম করার জন্যে। শরীরটাও আমার। যৌনাঙ্গটাও আমার। সেই যৌনাঙ্গ দিয়ে কার সঙ্গে কতজনের সঙ্গে কীভাবে যৌনকর্ম করব, সবটাই আমি ঠিক করি। পাপবোধ হবে কেন? পাপবোধ তাঁদেরই হয়, যেসব মেয়েরা তাঁর শরীরের উপর পুরুষের একক মালিকানায় বিশ্বাসী।”
তাই বিশ্বায়নের নিত্যনতুন কৌশল মানুষের মগজ আর মননে জমা হচ্ছে পরতে পরতে। মৌলবাদ ও পুঁজিবাদ দুটোই মানুষের অস্তিত্বের জন্য চরম সংকটের। এ সংকট রাতারাতি মুক্ত হয়ে যাবে, এ আশাও আমি করি না। পুঁজিবাদী মূল্যবোধে ঠাসা মগজের কারফিউ কোনোদিন ভাঙবে কি না তাও জানি না।