কালাম মাঝির নৌকা ও ছোটো শালাকে নিয়ে যমুনায় গিয়ে তমিজের বাপ সুবিধা করতে পারলো না। যমুনার মানুষ বিলের মাঝিদের মোটে গ্রাহ্য করে না, এমন কি আকালের সময় গিরিরডাঙা থেকে উঠে-যাওয়া মাঝিরাও যমুনার মাঝিদের সঙ্গে কুটুম্বিতা করার আশায় নিজেদের পুরোনো আত্মীয়স্বজনকে একটু এড়িয়েই চলে। সাড়ে পাঁচশো ছয়শো হাত একেকটা বেড়জালে যমুনার যতোটা পারে তারা দখল করেছে। সেখানে কালাম মাঝির ফেলে-দেওয়া ও নিজের ভেঁড়াখোড়া জালের টুকরা টাকরা জোড়া দিয়ে লম্বা-করা বাহাত্তর হাত জাল খাটাবার মতো পানি না জুটলে তমিজের বাপ কী আর করে, জাল গুটিয়ে নৌকা বেয়ে চলে আসে বাঙালি নদীর বৌছোবা দয়ের বাকে। ১৫/২০ হাতি গভীর এই দয়ে নিজের চোখের জল গচ্ছিত রেখে মানাসের শুকনা খাটাল ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক পর্যন্ত গিয়ে হারিয়েই গিয়েছিলো। অনেক পরে যমুনার উপচেপড়া পানি বয়ে বাঙালি নদী পুব থেকে এসে এ খাটাল ধরে কয়েক মাইল ছুটে বেরিয়ে যায় দক্ষিণের দিকে, আর তার পথভোলা রোগ একটি স্রোত পোড়াদহের মাঠ ছুঁয়ে কাশবনের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ে কাৎলাহার বিলে।
তমিজের বাপ বাঙালির কোলে মরা মানাসের বৌডোবা দয়ের ধার ঘেঁষে জাল খাটালো। কতোকাল আগে গোরা সেপাইদের হাতে ভবানী সন্ন্যাসী মারা পড়েছিলো এ। দয়ের জায়গাতেই। সবাই জানে সন্ন্যাসীর শোকে মানাস শুকিয়ে গেলো, কিন্তু তার মড়া লুকিয়ে রাখতে ফেলে গেলো তার চোখের জল, দয়ের পানি তাই বারো মাস এমনিই থাকে। যমুনার মাছ, বাঙালির মাছ, এমন কি মানাসের সেই আমলের মাছের। বংশধর তারাও এখানে এসে ভবানীকে পাহারা দিয়ে কিংবা তার খোরাক হয়ে নিজেদের মীনজীবন সার্থক করে। তমিজের বাপের কপালের ফের, সে নৌকা ভেড়ালো ওখানটাতেই। সেই সন্ধ্যায় জাল খাটাবার পর কোমর পানিতে দাড়িয়ে তমিজের বাপ বিড়বিড় করে কী সব শোলোক বলতে লাগলো; তার স্বর ক্রমে নিচু হয়ে আসছিলো দেখে কালাম মাঝির ভাগ্নে বুধা ভয় পায়, তমিজের বাপ কি ঘুমিয়ে পড়লো নাকি? তারপর, বিশ্বাস করা মুশকিল, রাত এক পহরও যায় নি, সন্ধ্যাতারা আসমানের মাঝামাঝিও চড়ে নি, বাঘাড় মাছটা ঠিক মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়া শিশুর মতো মাথা গুঁজে দিলো তমিজের বাপের জালের মধ্যে। এক মণ সোয়া মণ ওজনের সেই বাঘাড় নৌকায় তুলতে দুইজনের জান বেরিয়ে যাবার দশা। ছোটো নৌকা; অতো বড়ো বাঘাড়ের ঝাপটায় একবার এ কাত হয়, একবার ও কাত হয়। অতো বড়ো মাছ পেয়ে বুধা হাত নাড়ে, পা নাড়ে, কোমর দোলায়, মাথা ঝাকায়, তবু তার খুশির দুই আনাও সে খালাশ করতে পারে না। ও নানা, দুই মণ আড়াই মণের কম হবি না গো। এই মাছের বয়েস মনে হয় পাঁচশো বছর? আরো বেশি? ও নানা, এই মাছের দাম হবি কতো? এই মাছ দেখ্যা মেলার ব্যামাক মানুষ টাসকা ম্যারা যাবি? হামি কলাম, দেখো, সারা মেলার মানুষ ভ্যাঙা পড়বি তোমার উপরে। বারবার কথা বলে এবং এতো বড়ো বাঘাড় ধরার খুশিতে এবং এতো বড়ো মাছ নৌকোয় তোলার খাটনিতে বুধার ঘুম পায়। শোলোক পড়তে পড়তে তমিজের বাপ মাছের সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে দিলে তার দাপাদাপি থামে, কিন্তু বড়োলোকের পা নাচাবার তালে তার লেজ নাড়ানো চলতেই থাকে, তাতে নৌকাটা দুলে দুলে ওঠে। দুলুনিতে বুধার ঘুম নামে চোখ ঝেঁপে।
সারা রাত ধরে নৌকা চলেছে, বুধা কিচ্ছু জানে না। ভোররাতে, তখনো আবছা আন্ধার, কোলাহল শুনে ঘুম ভেঙে গেলে বুধা দেখে, নাও ঠেকে রয়েছে কালাহার বিলের দক্ষিণ কোণে। তীরে কাদার ভেতর উত্তর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তমিজের বাপ। তার মাথার ওপর ঘুরে ঘুরে উড়ছে মণ্ডলবাড়ির শিমুলগাছের সাদা বকের ঝক। নৌকার দিকে তাকালে বুধার চোখে পড়ে, ভেতরটা শূন্য। বাঘাড় মাছ নাই। তমিজের বাপের ধার ঘেঁষে শুকনা ডাঙায় দাঁড়িয়ে রয়েছে শরাফত মণ্ডল। তার এক হাতে লণ্ঠন, অন্য হাতে বোলওয়ালা কাঠের খড়ম। আবদুল আজিজ টর্চ দিয়ে আলো ফেলছে তমিজের বাপের মুখের ওপর, মাঝে মাঝে সেটা চক্কর দিয়ে ঘুরছে বিলের অনেকটা জায়গা জুড়ে।
তার নিয়মের বাইরে শরাফত মণ্ডল একই কথা চোদ্দবার করে বলছে। কী?–না, পোড়াদহ মেলা দেখতে-আসা তার ঝি-জামাই, ভাস্তি-ভাস্তিজামাই, ভাগ্নী-ভাগ্নীজামাই এবং তাদের ছেলেমেয়েতে বাড়ি ভরা বলে তাকে শুতে হয়েছে খানকাঘরে। বিছানা বদল হওয়ায় রাতে সে ভালো করে ঘুমাতে পারে নি। ফজরের আজানের আগেই অজু করতে ঘরের বারান্দায় এলে তার চোখ পড়ে বিলের দিকে। দেখে, এক শালা মাছচোর জাল থেকে মস্ত একটা মাছ তুললো বিল থেকে। মণ্ডল কোন শালা রে? বলে জোরে হাঁক দিতেই অতো বড়ো মাছটা ফেলে দিলো বিলের পানিতে। মণ্ডল তখুনি বুঝেছে, এ শালা তমিজের বাপ ছাড়া আর কেউ নয়। লণ্ঠন নিয়ে কাছে এসে দেখে, ঠিক তাই। অনেক পয়সা খরচ করে, নায়েববাবুকে হাতে পায়ে ধরে এই বিল পত্তন নিয়েছে শরাফত; সে কি পাঁচ ভূতে মাছ মেরে নিয়ে যাবে বরল? সে আর কতো সহ্য করে?
শরাফত মণ্ডলের সাটাসাটিতে বুধার ঘুম কেটে যায় এবং ওই সাটাসাটির জন্যেই তার পক্ষে মাথা ঠিক রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার শুধু আবছা মনে পড়ে, দুইজনে মিলে ধরাধরি করে মাছটা নৌকায় তোলা হয়েছিলো, হাপসে গিয়ে সে শুয়ে পড়ে নৌকার পাটাতনের ওপর। বাঘাড় কি তার পাশে ছিলো, না নৌকার খোলের ভেতর। ওটাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, সেটা সে মনে করতে পারে না। এখন হঠাৎ দিশাহারা হয়ে বুধা জিগ্যেস করে, বাঘাড় কুটি?
এই শালা কুত্তার বাচ্চা, আরেক চোর। চোরের গোলাম চোর। বান্দো শালাক। বলতে বলতে বুধার মাথায় ও ঘাড়ে শরাফত তার খড়ম-ধরা হাতটা তুলতেই কাদের খোয়াবনামা বাপকে সামলায়, রাখেন। বাড়ি ভরা মানুষ। আজ মেলার দিন। কী করেন?
হাত সামলে শরাফত আগের কথারই পুনরাবৃত্তি করে, তমিজের বাপের বিলের মাছ চুরি করার কথা সে বলে আসছে অনেক দিন থেকেই। তার দুর্ভাগ্য, তার কথায় কেউ কান দেয় না। রোজ রাত করে শালা যে ঘাড়ে একটা জাল নিয়ে এখানে আসে, সে কি এমনি এমনি? পাকা চোর, এতোদিন ধরা পড়ে নি। আজ পোড়াদহের মেলা, পাকুড়গাছ থেকে মুনসি নিজের চোখজোড়া আজ মজুত রেখেছে গোটা বিলের ওপর, এই বিলের কোনো অনিষ্ট করতে গেলে সে শালা আজ ধরা না পড়ে যায় না।
একটু আলো ফুটলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির হয় বৈকুণ্ঠ। মাঝরাত থেকে মোষের দিঘির উঁচু পাড়ে তালতলায় দাঁড়িয়ে সে নজর রাখছিলো পাকুড়তলার পশ্চিমে সন্ন্যাসীর ভিটার ওপর। মঙ্গলবার দ্বিপ্রহরের পর বারবেলায় ভবানী ঠাকুর এসে আসন গ্রহণ করবে পোড়াদহ মাঠের বটতলায় তার বিগ্রহের মধ্যে। তখন থেকে সন্ন্যাসীর পূজা। রাত্রি দুই প্রহর কাল পর্যন্ত সন্ন্যাসী পূজার ভোগ নেবে, তারপর কৈলাসধামে। প্রত্যাবর্তন কালে মোষের দিঘির পাশ দিয়ে গিয়ে পাকুড়গাছের দিকে কয়েক পলক নজর দিয়ে ঠিক ব্রাহ্মমূহর্তে পৌঁছে যাবে নিজের ভিটার ওপর। সূর্যঠাকুর পুব আকাশ জুড়ে সিঁদুরের ছোপ লাগানো শুরু করবে আর সন্ন্যাসীও মিলিয়ে যাবে আলোর মধ্যে আলো হয়ে। নিজের শিষ্যসঙ্গীদের বংশধর, অন্তত দশনামীদের কাউকে না দেখলে ঠাকুর কষ্ট পাবে জেনেই তো বৈকুণ্ঠ তার ঠাকুরদার সৎ ভাইদের ছেলেদের প্রতারণা মেনে নিয়ে বিঘা বিঘা জোতজমি জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাইদের ভোগ করতে দিয়ে নিজে পড়ে রয়েছে এখানে। এই রাতে কি তার ঘুমিয়ে থাকলে চলে? তা বছরের পর বছর এই রাত চলে যায়, সন্ন্যাসীর খাড়া-ধরা ছায়া দেখতে পায় না সে। আজ তার ভাবনা হয়, এসব কিসের লক্ষণ? তার নিজের কোনো দোষ হলো না তো? নিজের কী দোষ ঘটতে পারে খুঁজতে খুঁজতে বৈকুণ্ঠ দেখে, বাঙালির পথহারা রোগা স্রোত ধরে একটা নৌকা উত্তর দিক থেকে ঢুকে পড়লো কাৎলাহার বিলের ভেতর। বৈকুণ্ঠের বুক দুরুদুরু কাঁপে : প্রভু কি তবে এবার নৌবিহারে ফিরে যাচ্ছেন? কিন্তু নৌকা তো যাচ্ছে দক্ষিণে, তবে নিজের ভিটায প্রভু উঠবেন কী করে? —বৈকুণ্ঠ ধন্দে পড়ে। তবে সে হলো গিরির সন্তান, টাসকা মেরে বসে থাকলে তার চলবে? প্রভুর প্রতি দায়িত্বপালনের তাগিদে পাকুড়তলা ঘুরে বিলের পশ্চিম তীর ধরে সে ছুটতে লাগলো দক্ষিণের দিকে। যাবার সময় হুরমতুল্লার ঘরের সামনে একটা হাঁক দিয়ে যায়।
কিন্তু মণ্ডলবাড়ির ঘাটে এসে দেখে ঘটনা তো একেবারে অন্যরকম। তমিজের। বাপের মতো মানুষ কি এটা কখনো করতে পারে? তবে জিমের বাপের আচরণের। রহস্য ভেদ করা এদের মতো যে-সে জাতের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কোন ইশারায়, কার ইঙ্গিতে তমিজের বাপ এখানে এসেছে তা বলতে পারতো এক চেরাগ আলি ফকির। তা ফকিরই নাই, এখন আর কে কী বলবে?
বৈকুণ্ঠের হাঁকে হুরমতুল্লা এসেছে বটে, কিন্তু মণ্ডলের কথা সে বিশ্বাস করে কী করে? আবার মণ্ডল কি কখনো অন্যায্য কথা বলতে পারে? তমিজের বাপটাও একবারে চুপ, সে যে কী করলো না করলো তাই বা বোঝে কীভাবে? হুরমুতল্লা উসখুস করে, মেলার দিকে তার মেলা করা দরকার এখনি। মেলায় বেচবে বলে কাল তেলিহারা হাট থেকে কেশুরের বিচি আর মুলার বিচি কিনে এনেছে। নবিতন গোটা বিশেক পাটের শিকা বুনে রেখেছে, খুব নকশা করা শিকা। দাম মনে হয় ভালোই উঠবে। অন্তত ভদ্দরলোকরা তো পছন্দ করবেই। সকাল সকাল মেলায় যেতে না পারলে জুতসই জায়গা পাওয়া মুশকিল।
নেহায়েত মেলার দিন। শরাফত মণ্ডলের বাড়িতে নাইওর ভরা। আবার মেলা দেখতে টাউন থেকে কাদেরের দলের ছেলেরা আসবে, নেতাদের কেউ কেউ থাকতে পারে। তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। এতোসব ঝামেলা না থাকলে এই শালা তমিজের বাপকে হাতপা বেঁধে গোরুর গাড়িতে চালান করে দিতো আমতলি থানায়। জেলের ঘানি টেনে শালার জীবন কাটতো।
এর মধ্যে ঝামেলায় ফেলে শরাফতের বড়ো ছেলেটা। সূর্য উঠলে টর্চের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলে তিন ব্যাটারির দামি জিনিসটা রেখে আসতে সে একবার ঘুরে আসে বাড়ির ভেতর থেকে। এবার টর্চের বদলে তার হাতে ধরা তার ছেলের হাত। আজিজ বাপকে একটু তফাতে ডেকে এনে বলে, বাপজান, ওই মানুষটাক না ঘটানোই ভালো। কী কী নাকি জানে।
তমিজের বাপকে শীতে কিংবা ভয়ে কিংবা অন্য কোনো কারণে কাঁপতে দেখে এবং শরাফতের এক পায়ের খড়ম তার হাতে ওঠায় বাবর তার বাবার কোমর জড়িয়ে ধরে। কেঁদে ফেলে। এতো বড়ো ছেলেকে কাঁদতে দেখে শরাফতের রাগ হয়। তার নিজের। ছেলে ও নাতি কি তার ইজ্জতের দিকে একটু দেখবে না? আজিজটা পুরোপুরি বৌয়ের বশ হয়ে গেছে। টর্চলাইট রাখতে বাড়ির ভেতরে গেলে বৌয়ের কাছ থেকে সে বোধহয় হুকুম নিয়ে এসেছে এখন শরাফতকে সে তমিজের বাপের হাজাধরা পা দুটো দুধ দিয়ে ধুয়ে দিতে না বলে! হুমায়ুন মরার আগে বৌটা স্বপ্নে হাবিজাবি কীসব দেখলো, তখন থেকে তমিজের বাপের ভয়ে সবসময় কাতর। দুই বেটা এবং একমাত্র নাতির আচরণে শরাফত ক্ষোভে দুঃখে অপমানে নেতিয়ে পড়ে, তমিজের বাপের ওপর রাগটাকে সে আর শানাতে পারে না।
তমিজ তার বাপের খবর পায় পোড়াদহের মেলায়। কামালপুর, আওলাকান্দি আর আমতলি থেকে ছুতাররা গোরুর গাড়ি করে কাঠের খাট, পালং, তক্তপোষ, আলনা, বেঞ্চি আর পিঁড়ি, জলচৌকি এসব আনতে শুরু করেছে মাঝরাত্রি থেকে। তমিজ তাদের। কামলা খাটবে বলে মেলায় বসে রয়েছে আরো আগে থেকে। সারাটা দিন ছুতারদের সঙ্গে থাকতে পারলে তাদের মাল নামিয়ে আর এইসব মালই খরিদ্দারদের গোরুর গাড়ি। কি নৌকায় উঠিয়ে ভালো কামাই করা যায়। দিনটা কিছুতেই নষ্ট করা যায় না। এখন মেলাতেই কার মুখে বাপের কীর্তির খবর পেয়ে সে এখানে এসেছে একরকম ছুটতে ছুটতে। শরাফত তখন মেলার দিনটা পার হোক, পরে দেখা যাবি বলতে বলতে চলে যাচ্ছে নিজের বাড়ির দিকে। পেছনে তার দুই ছেলে, নাতি, এ আত্মীয় সে আত্মীয়, কুটুম্ব, চাকরবাকর, কামলাপাট মেলা।
কাদায় পায়ের পাতা তখনো গাঁথা, তমিজের বাপ তাকিয়ে রয়েছে উত্তরের দিকে। তমিজ বাপের হাত ধরতেই তার নিজের এবড়োখেবড়া হাতের তালুতে বরফের ছোঁয়া পায়। মানুষের হাত এতো ঠাণ্ডা হয়? তমিজের শরীর কেঁপে ওঠে, বাপ তার বেঁচে আছে তো? সেই হিম হাত ধরে তমিজ বাপকে টেনে তোলে শুকনা ডাঙায়, তমিজের বাপের পা দুটো যেন কাদা থেকে উপড়ে তোলা হলো। ডাঙায় উঠে তমিজের বাপ তার দিকে একবার আর বৈকুণ্ঠের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে। তার ঢুলুঢুলু চোখে কাঁচা রক্ত ছলছল করে। তমিজের বাপ হতে থাকল তমিজ বলে, বাজান, বাড়িত চলল।
তমিজের বাপ কোনোদিকে তাকায় না, সে যে কাউকে দেখছে কি কারো কথা শুনছে তা মনে হয় না। বৈকুণ্ঠ তমিজের কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলে তমিজ, কথা কস না! যাবার দে। হামরা মেলাত যাই। বৈকুণ্ঠের পা টলছে, তার মুখে গাঁজার গন্ধ।
তমিজের একটু তাড়াতাড়ি মেলায় যাওয়া দরকার। দেরি হলেই ছুতাররা অন্য কামলা লাগিয়ে দেবে। বৈকুণ্ঠকে নিয়ে তমিজ উঠে পড়লো কালাম মাঝির নৌকায়। নৌকার ভেতরে বাঘাড় মাছ তার বিশাল শরীরের গন্ধ দাগ ও চিহ্ন রেখে গেছে। বুধা অনেকক্ষণ তো কোনো কথাই বলতে পারে না, তার মুখ ফুটলো কালাহার পার হয়ে নৌকা বাঙালির রোগা স্রোতে ওঠার পর।
দুপুর পার করে দিয়ে বাড়ি ফিরে তমিজের বাপ দরজার চৌকাঠে মাথা রেখে সটান শুয়ে পড়ে ঘরের মেঝেতে।
কুলসুম বলে, ইগলান কী শুনিচ্ছি গো? তুমি বলে বিলের মাছ চুরি করবার গেছিলা? মণ্ডল বলে তোমাক খড়মের বাড়ি মারিছে? মণ্ডল তোমাক বান্দিছিলো? কুটি মারলো গো? মাথাত মারিছে? গাওত বলে পান্টি দিয়া কোন দিছে? ক্যা গো, কথা কও না? কথা কও না কিসক? ও তমিজের বাপ!
তমিজের বাপ তবু সাড়া দেয় না। তার নাক দিয়ে শোঁ শোঁ আওয়াজ বেরোয়। কিছুক্ষণের মধ্যে ওই আওয়াজের তেজ কমে; ওই নাকডাকার মিহি ও মোটা স্বরে সারা ঘরটিকে সে টেনে তোলে নিজের ঘুমের মধ্যে। হেঁটে হেঁটে। ঘুমের মধ্যে তো সে হাঁটেই। কিন্তু এখন এমন হি হি করে কাঁপে কেন? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তমিজের বাপ হাঁটে, কথা কয়, বিড়িবিড় করে হয়তো শোলোকও বলে। কুলসুমকে জড়িয়ে ধরে সে ঘুমের মধ্যে, আবার তাকে ঠেলে দেয় ঘুমের মধ্যেই। কিন্তু কৈ ঘুমিয়ে পড়লে তমিজের বাপ তো কখনো এমন করে কাঁপে না। সে তো এখন শুধু কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে তার সারা শরীর একেকবার কুঁকড়ে আসে, একেকবার ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তার মাথা গড়িয়ে পড়ে চৌকাঠ থেকে মাটিতে, আবার নিজে নিজেই মাথা উঠে যায় চৌকাঠের ওপর।