ভালবাসাকে নিয়ে মা চলে এলেন ঢাকায়। ইয়াসমিন যেহেতু নটা পাঁচটা চাকরি করে, ভালবাসাকে মারই দেখাশোনা করতে হয়। ভালবাসার পুরো নাম স্রোতস্বিনী ভালবাসা। নামটি আমিই দিয়েছি। এই নাম নিয়ে প্রথম আপত্তি করেছিল মিলন।
এ কোনও নাম হল!
কখনও শুনিনি কারও নাম ভালবাসা।
তাতে কি!
লোকে হাসবে শুনে।
তাতে কি!
বড় হলে ছেলেরা টিটকিরি দেবে।
তাতে কি!
মিলনের মা মোসাম্মৎ আফিফা খাতুন নামটি ঠিক করেছিলেন। ওই নামটিই মেয়ের জন্য রাখা প্রায় হচ্ছিল হচ্ছিল, কিন্তু ইয়াসমিনের জোর আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে না। ইয়াসমিন আমার দেওয়া নামটির পক্ষে রীতিমত আন্দোলন করে এটিকেই বহাল রাখে। এখন গাল ভরে সবাই ফোলা ফোলা গালের মেয়েটিকে ভালবাসা বলে ডাকে। ভালবাসা গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বেড়ায় সারা বাড়িতে। দেখে আমার খুব ভাল লাগে। আমার কোলে বসে মাঝে মাঝে কমপিউটারের কীবোর্ড টিপে আমার লেখা নষ্ট করে দেয়, এতেও আমার রাগ হয় না। ভালবাসার জন্য ভালবাসা জাগে।
মার যাযাবর জীবন যে শান্তিনগরের বাড়িটিতে স্থিরতা পাবে, তা পায় না। মা স্থিরতা চান, কিন্তু তাঁকে দেবে কে? অবকাশে বাবার অধীনতা মানতে হয়। আর শান্তিনগরে মানতে হয় আমার অধীনতা। মার পরাধীন জীবন পরাধীনই থেকে যায়। নাহিদকে মার পছন্দ নয়। নাহিদ নিজে সিগারেট খায়, আমাকেও সিগারেট খাওয়া শেখাচ্ছে, এটি তো আছেই, তার ওপর মার ধারনা নাহিদ খুব বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু নয় আমার। মাকে আমি ধমকে চুপ করতে বলি, বলে দিই আর যেন একটি কথা না উচ্চারণ হয় নাহিদের বিরুদ্ধে। মা আড়ালে গিয়ে চোখের জল ফেলেন। নাহিদ আমার বাড়িতে যখন খুশি আসবে, তাকে যেন সম্মান করা হয়, এটি জানিয়ে দিই। সম্মান নাহিদকে ঠিকই করা হচ্ছিল, কিন্তু নাহিদ অবশ্য আমাকে ফাঁক পেলেই বলে আমার বাড়ির কোন মানুষটি তার সঙ্গে কোন সৌজন্যটি দেখায়নি, দরজা খুলতে দেরি করেছে, সময়মত খাবার দেয়নি, তার দিকে অবজ্ঞা চোখে চেয়েছে। নাহিদের এসব শুনে সব রাগ আমার গিয়ে পড়ত মার ওপর। কিন্তু একদিন নাহিদের ওপর আমার নিজেরই রাগ হয়। নিপার মা নিপাকে নিয়ে আমার বাড়িতে নাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে এসেছিলেন এক রাতে। আমার বাড়িতে নাহিদের সঙ্গে নিপার দেখা হতে হতে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। মাঝে মাঝে নাহিদ রাত কাটায় নিপাদের বাড়িতে। শেষ রাতটিতেই ঘটনাটি ঘটেছে, নিপার সঙ্গে রাতে এক বিছানায় শুয়েছিল নাহিদ, কিন্তু নাহিদের হাত অন্ধকারে বারবারই নিপার শরীরে আনাচে কানাচে গিয়েছে,একসময় সে জোরও করেছে নিপার কাপড় জামা খুলে নিতে। নিপা তার মাকে এই ঘটনা জানিয়ে দিলে নিপার মা নিজে আসেন আমাকে বলতে যে আমি যেন নাহিদকে বলে দিই আর কোনওদিন যেন সে নিপাদের বাড়িতে না ঢোকে। এটি কোনও কারণ নয় নাহিদকে সন্দেহ করার বা তার ওপর রাগ করার। নাহিদ সম্ভবত সমকামী, যা আমার আগে জানা ছিল না। নাহিদ জানায়নি, সেটি সে লুকিয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত ব্যপার সে লুকোতেই পারে, এ তার দোষ নয়। সন্দেহটি জাগে যখন একটি পত্রিকায় কায়সারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে লেখা হয়। লেখা হতেই পারে, কায়সারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক মোটেও লুকোনো কোনও ব্যপার নয়। কিন্তু কায়সার আমার হাতে একদিন মার খেয়েছিল, মার খেয়ে ছেঁড়া শার্ট পরেই তাকে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল এ কথাটি লেখা হয়েছে। ঠিক এরকম না হলেও কাছাকাছি একটি ঘটনা ঘটেছিল এবং নাহিদ সেটি দেখেছে। বাড়িতে তখন আর কেউ ছিল না যে কি না পত্রিকার কাউকে এ খবরটি দিতে পারে। সেই থেকে নাহিদের ওপর যে আমার আস্থা ছিল, সেটি কমে যায়। আমি আর দরজা খুলি না নাহিদ এলে। সে খুব চেষ্টা করে আমার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করার,অনুরোধ আবদার, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা, চিঠি লেখা, ফোন, সবই সে করে। কিন্তু আমাকে সে কিছুতেই নরম করতে পারে না। আমার ব্যক্তিগত ব্যপার নিয়ে পত্রিকায় লেখা ছাপা হতেই পারে। প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে। এসব আমি এখন আর গ্রাহ্য করি না। কারণ একটি সত্য ঘটনার সঙ্গে সাতটি বানানো ঘটনা মিশিয়েই সাধারণত আমার ব্যক্তিগত জীবন রচনা করে হলুদ সাংবাদিকরা। প্রথম প্রথম আমার দুঃখ হত, রাগ হত। কিছু না হলেও ভাবনা হত। এখন ওসব গল্পে একবার চোখ বুলিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিই। নাহিদকে আমি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম, কিন্তু গুপ্তচর হিসেবে আমার কাছে সে আসুক, তা আমি চাই না। নাহিদ নিজে আমার সম্পর্কে লিখতে পারে বা আমার সম্পর্কে বলতে পারে অন্য কোনও সাংবাদিককে, এতে আমার আপত্তি নেই। সমালোচনা থাকতেই পারে। কিন্তু লুকিয়ে কেন! যা সে আমার কাছে বলছে, আমার আড়ালে গিয়েই সে সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলছে, তা যখন জানা হয়ে যায়, তখন সে আমার আর যা কিছুই হোক, বন্ধু নয়, এ ব্যপারে আমি নিশ্চিত। সামনে এক কথা, আড়ালে আরেক কথা বলার চরিত্র অনেক লোকের। এমন চরিত্র আমার মোটেও পছন্দ নয়, এমন চরিত্রের মানুষকে আমার বাড়িতে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ আমি দিতে চাই না।
গৌরী রাণী দাসকে যখন আমার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলাম, মা বলেছিলেন, ‘অজানা অচেনা কাউরে বাড়িতে জায়গা দিবি! এইটা কি ঠিক হবে!’ মাকে আমি এক ধমক দিয়ে থামিয়েছিলাম, বলে, যে, ‘আমার বাড়িতে আমি কারে জাগা দিব না দিব সেইটা তোমার ভাবতে হবে না। এইটা আমার বাড়ি।’ আমার কণ্ঠস্বর আমার কাছেই খুব বাবার কণ্ঠস্বরের মত ঠেকেছিল। বাবার এরকম দিনে দুবার করে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতেন যে অবকাশ নামের বাড়িটি তাঁর বাড়ি।
গৌরী রাণী দাস গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল, তার পক্ষে এবং দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির দাবি করে আমি একটি কলাম লিখেছিলাম পত্রিকায়। আমার কথা কোনও না কোনও ভাবে কানে যায় গৌরী রাণীর। কানে যাওয়ার পরই গৌরী আমার বাড়িতে এসে আশ্রয় চায়। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সে মামলা করেছে, মামলার কারণে তাকে থাকতেই হবে ঢাকায়, কিন্তু এ শহরে কোনও থাকার জায়গা নেই তার। আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি একটি অসহায় মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়া। গৌরী রাণীকে বলেছি, যতদিন তার দরকার, সে নিশ্চিন্তে আমার বাড়িতে থাকবে, খাবে। মামলায় টাকা পয়সা দরকার হলেও আমার কাছ থেকেই নেবে। গৌরী রাণীকে বাড়িতে রীতিমত রানীর আসনে বসিয়ে দিলাম। সপ্তাহ দুই পার হলে মা বললেন, গন্ধে বাড়িটায় টিকা যায় না। মার ধারনা গন্ধটি গৌরীর গায়ের। মাকে তখনও হিংসুটে সংকীর্ণ মনা বলে থামিয়েছিলাম। পরে একদিন নিজেই আমি বোটকা গন্ধ পাই গৌরীর গা থেকে বেরোচ্ছে। গৌরী গোসল করে এলেও ওর গা থেকে যায় না। গৌরী এ বাড়িতে আসার পর থেকেই গন্ধটি আমি পাচ্ছিলাম, কিন্তু কখনও মনে হয়নি এ গৌরীর গন্ধ। গন্ধ দিন দিন তীব্র হয়ে উঠল। আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না গৌরীকে এ বাড়িতে চলে যেতে বলার। আমি বরং ওর কাপড় চোপড় ধোবার ব্যবস্থা করি। নাক ঢেকে মিনু গৌরীর কাপড়জামা ধুয়ে দেয়। তার পরও গন্ধ যায় না। গন্ধটি গেল, গৌরী যেদিন গেল।
মহাভোজের আয়োজন কর, আমার লেখক বন্ধুরা খাবেন।
রাঁধাবাড়া শেষ। কিন্তু এক্ষুনি আবার সাতজনের জন্য রাঁধো। সাতজন গার্মেণ্টেসএর মেয়ে আসছে খেতে।
ঘর ছেড়ে দাও, কলকাতা থেকে দাদা বা দিদি আসছেন। পাঁচদিন থাকবেন।
মদ আনাতে হবে, কবি বন্ধুরা পান করবেন।
জোরে গান বাজবে, যত জোরে ইচ্ছে করে, আমার পরান যেমন জোরে চায়।
কেউ শব্দ কোরো না, আমার লেখার অসুবিধে হয়।
রাত দুটো পর্যন্ত আড্ডা চলছে, তাতে কার কি! এটা আমার বাড়ি, সারারাত আড্ডা দেব। ড্রাইভারকে খাবার দাও, রান্নাঘরে না, ডাইনিং টেবিলে।
এসব কোনও কিছুতে মার আপত্তি নেই। দিন দুপুরে কায়সারকে নিয়ে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করছি, ঘন্টা পার করে দুজনই এলো চুলে বেরোচ্ছি ঘর থেকে, এতেও মার আপত্তি নেই। কিন্তু তারপরও দেখি মা হঠাৎ হঠাৎ আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যান। মা বাড়িতে থাকলে বাড়িটিকে বাড়ি মনে হয়। কোথাও কোনও ধুলো নেই। স্নানঘরের মেঝেয় জল পড়ে নেই। বিছানার চাদর কুঁচকে নেই। কাপড় চোপড় আধোয়া নেই। ক্ষিধে পাওয়ার আগেই খাবার দেওয়া হয় টেবিলে। যা যা ভালবাসি খেতে তাই দেখি রান্না হচ্ছে। লেখার টেবিলে ঘন ঘন চা দিতে কাউকে বলতে হয় না। বলার আগেই চা এসে যায়। বাড়ির সব কিছু আশ্চর্য সুন্দর হয়ে ওঠে। মা থাকলে বুঝি না যে মা আছেন। মা না থাকলেই টের পাই যে মা নেই। ইয়াসমিনকে একদিন মার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, মা রাগ কইরা চইলা গেছে।
‘কেন রাগ করছে?’
‘তুমি নাকি বলছিলা, টাকা পয়সা বেশি খরচ হইতাছে বাজারে।’
‘হ তা কইছিলাম। কিন্তু মারে উদ্দেশ্য কইরা তো কই নাই।’
‘মা ভাবছে মারে কইছ।’
মা আমার স্বাধীনতায় কোনও বাধ সাধেন না। কেবল তাঁর প্রতি আমার দুর্ব্যবহার তাঁকে কাঁদায়। তাঁকে যাযাবর করে। মা এখানে আমার কাছে ধমক খেয়ে অভিমান করে অবকাশে আশ্রয় নেন। অবকাশে বাবার ধমক খেয়ে আবার আমার কাছে ফিরে আসেন। মার স্থায়ী কোনও জায়গা নেই বসবাসের। মার নিজস্ব কোনও ঘর নেই। সংসার নেই। আমি লক্ষ করি না, মার প্রতি ব্যবহারের বেলায় আমি আমার অজান্তেই বাবা হয়ে উঠি। বাবার প্রতি আমার সমীহ বরাবরই ছিল, আছে, যতই তিনি নিষ্ঠুর হন না কেন। তাঁকে নিষ্ঠুর বলে গাল দিয়েছি, কিন্তু তাঁর প্রতাপের প্রতি গোপনে গোপনে শ্রদ্ধা ছিল বোধহয়, যা কখনও বুঝিনি যে ছিল। তাই যখনই আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি, যখনই স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে জীবনে, তখনই আমার অজান্তেই আমি ছোটখাটো বাবা হয়ে উঠি। প্রতাপশালী। ক্ষমতাবান। মার দারিদ্র, মার হত ভাগ্য, মার রূপ হীনতা, মার হীনমন্যতা, মার নুয়ে থাকা, মার কষ্ট, মার নির্বুদ্ধিতা, মার বোকামো, মার ধর্মপরায়ণতা, মার কুসংস্কার কোনওদিন আমাকে আকর্ষণ করেনি। এসব আমাকে মা থেকে কেবল দূরেই সরিয়েছে। মা আমার সংসারে নিজেকে প্রয়োজনীয় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যান। আমার তবুও মাকে বাড়তি মানুষ বলে হয়। বাবার যেমন মাকে মনে হয়, অবকাশে। ঈদ পরব এলে আমি বাবার জন্য নানারকম উপহার নিয়ে ময়মনসিংহে যাই। মার কথা আমার মনে থাকে না। যদি কখনও দিতে হয় কিছু মাকে, আলমারি খুলে আমার পুরোনো কোনও শাড়ি, যা অনেকদিন পরেছি, এখন আর ভাল লাগে না পরতে, তাই দিই। তা পেয়েই মার খুশির অন্ত নেই। প্রথম নিতে চান না। বলেন, ‘তুমি পছন্দ কইরা কিনছ শাড়ি, তুমি পড়। আমার যা আছে, তা দিয়া ত চলতাছেই।’
‘না এই শাড়ি আমি ত আর পরি না।’
‘তারপরও কখনও যদি ইচ্ছা হয়, পরতে পারবা।’
‘না। না। এই শাড়ি এখন আমার আর পছন্দ না।’
মা অগত্যা নেন। সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলেন, ‘নাসরিনের পছন্দের একটা শাড়ি নাসরিন দিয়া দিল আমারে। শাড়িটা একদিনও ও পরে নাই।’
খরচ বাঁচানোর জন্য মাকে যদিও কোনওদিন আমি বলিনি, মা তবু আমার সংসারের খরচ বাঁচাতে চেষ্টা করেন। এক মুরগি একদিনের জন্য কেনা হল, তা দিয়ে দুদিন চালাতে চান। ভাগে কম পড়লে রাগ করি। তিনি নিজের ভাগেরটুকুও আমার পাতে তুলে দিয়ে কাজের মেয়েদের সঙ্গে বসে ডাল ভাত খেয়ে ওঠেন। আমার আর্থিক অবস্থা নিয়ে আমার চেয়ে মার দুর্ভাবনা বেশি। ভালবাসা হাঁটতে গেলে মার ভয়, পড়ে যাবে বুঝি। আমি বারান্দায় দাঁড়ালে মার ভয় কোনও ঘাতক বুঝি আমাকে দেখছে রাস্তা থেকে অথবা আশে পাশের কোনও বাড়ি থেকে। মার ভয় দেখতে বড় বিচ্ছিরি লাগে আমার। আগের মত এখন আর পুলিশ পাহারা নেই। দরজার পুলিশ হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেছে। মিছিল যখন শান্তিনগরের দিকে আসে, তখনই কেবল আমার বাড়ির সামনের রাস্তায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আমি সময় অসময়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ি, মা পেছন থেকে বলেন, ‘বাইরে যাইস না। কখন কি হয়, কে জানে।’
আমি পেছন ফিরি না। মা বলতে থাকেন, ‘যাইতে হইলে কাউরে নিয়া যা। একলা যাইস না।’
আমি তবুও পেছন ফিরি না।
বুকের মধ্যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ভয় পুষে রাখতে রাখতে আমার এখন অসহ্য লাগে। কিন্তু এই যে বেরিয়ে যাই, যাই কোথায়? যাই শহর ছাড়িয়ে কোথাও। অতি বিনয়ী, অতি স্বল্পভাষী, অতি সৎ সাহাবুদ্দিন জিজ্ঞেস করেন, ‘আপা কোনদিকে যাবো?’ ‘যান, যেইদিকে খুশি যান।’
আমার কোনও ঠিকানা নেই যাওয়ার। সাহাবুদ্দিন যেতে থাকেন দক্ষিণের দিকে। দক্ষিণের দিকে কোনও গন্তব্য নেই। শহর ছাড়িয়ে নির্জনতার দিকে, গ্রামের দিকে, বনের দিকে, নদীর দিকে। আমার ভাল লাগে এই গতি, এই ছুটে যাওয়া। জানালায় হাওয়া এসে চুল এলো করে দেয়, ভাল লাগে। ইচ্ছে করে বনের পথে একা একা হেঁটে যাই, কোনও কলাপাতার বেড়ার আড়ালে গ্রামের কোনও মাটির ঘরে যাই, পুকুরে স্নান করি, নদীতে সাঁতার কাটি, বিলে নেমে মাছ ধরি, গ্রামের ফ্রক পরা মেয়েদের সঙ্গে গোল্লাছুট খেলি। ইচ্ছেগুলোকে আমি দমন করি, আমি জানি আমার শহুরে ঢংএ শাড়ি পরা, আমার গাড়ি, আমার জুতো-পা, আমার ছোট চুল সবই উদ্ভট দেখাবে এ অঞ্চলে, সকলে সার্কাসের ক্লাউন দেখছে এমন চোখে আমাকে দেখবে। গাড়ি থামিয়ে সেদিন গাড়িতেই বসে থাকি। সাহাবুদ্দিনের ঘর বাড়ি বউ বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করি। সাহাবুদ্দিন সংকোচে সলাজে উত্তর দেন। যে টাকা তিনি মাইনে পান, তা দিয়ে সংসার চলে কি না জিজ্ঞেস করলে বলেন, চলে। কোনও অভাব নেই? না। অন্য ড্রাইভার দেড় দুহাজার মত পায়, সাহাবুদ্দিনকে আমি দিই মাসে আড়াই হাজার। ইচ্ছে করেই দিই, এই টাকা সাহাবুদ্দিন দাবি করেননি। দুপুরে আমার বাড়িতেই খান। যদিও দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত তাঁর চাকরির সময়, কিন্তু মাসে বেশির ভাগ দিনই তাঁকে আটটা নটা পর্যন্ত থাকতে হয়। কখনও কখনও রাত দুটো। কোনওদিন আপত্তি করেননি, যে, এত রাত পর্যন্ত থাকা সম্ভব নয়। বাড়তি সময়ের জন্য তাকে কিছু বাড়তি টাকা দিতে যাই, সে টাকা হাতে নিতে সাহাবুদ্দিন লজ্জায় মরে যান। জোর করে দিতে হয়। সব মিলিয়ে মাসে তাঁর তিন হাজার টাকার মত সম্ভবত হয়। সাহাবুদ্দিনের আগে একটি ড্রাইভার ছিল, অল্প বয়স ছিল সেই ড্রাইভারের, ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাত, আর কোথাও কাউকে তুলে আনতে পাঠালে পথে নেমে তেল বিক্রি করত গাড়ির। ওই ছোকরা ড্রাইভারকে বাদ দিয়ে সাহাবুদ্দিনকে চাকরি দেওয়ার পর আমার কখনও ভাবতে হয় না গাড়ির ব্যপারে। গাড়ি মুছে পরিস্কার করে ঝকঝকে করে রাখেন সাহাবুদ্দিন। ইস্টার্ন হাউজিংএর গ্যারেজএ গাড়ি রেখে ড্রাইভাররা আড্ডা পেটায়, তাস খেলে। সাহাবুদ্দিনকে ওই আড্ডায় কখনও দেখিনি। তিনি গাড়ির ভেতর বসে বসে নামাজ শিক্ষা জাতীয় পকেট বই পড়েন। একবার তিনি সভয়ে জানিয়েছিলেন, কিছু অচেনা লোক তাঁকে প্রতিদিন খুঁজতে আসে গ্যারেজে। সাহাবুদ্দিনের ভয় ওই অচেনা লোকগুলো আমার কোনও ক্ষতি করার উদ্দেশে আসে তাঁর কাছে। সাহাবুদ্দিনকে শাসিয়ে যেতে আসে, যেন আমার গাড়ি আর না চালায় বা গাড়ির ভেতর গোপনে বোমা রাখতে আসে। সাহাবুদ্দিন তাই নিজেই গাড়ি থেকে বের হন না, প্রহরীদের বলে দিয়েছেন যেহেতু ওই লোকগুলো তাঁর চেনা কেউ নয়, যেন ওদের গ্যারেজের দিকে যাওয়ার সুযোগ না দেওয়া হয়। সাহাবুদ্দিন, পাজামা পাঞ্জাবি পরা লিকলিকে ক্লিন সেভড পঁয়ষট্টি বছর, আমাকে রক্ষা করেন আমাকে না জানিয়ে। তাঁকে কোনওদিন বলিনি কি হচ্ছে দেশে আমাকে নিয়ে। তিনি খবর পান কি হচ্ছে। তিনি যে জানেন তা আমাকে জানতে দেন না। শহরের রাস্তায় আমার গাড়ির দিকে কোনও লোক বা কোনও দল এগোতে থাকলে তিনি দ্রুত গাড়ি চালান, আমাকে বলতে হয় না দ্রুত পার হয়ে যেতে। আমাকে বলতে হয় না যে রাস্তায় মিছিল বা সভা হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে সেদিকে না যেতে। তিনি নিজেই অন্য রাস্তা ধরেন। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ঘুরে যাচ্ছেন কেন?
বললেন, ‘ওদিকে আজকে মিছিল আছে।’
‘কিসের মিছিল?’
সাহাবুদ্দিন চুপ। তিনি জানেন না যে আমি জানি কিসের মিছিল হচ্ছে।
‘কারা মিছিল করছে?’
‘ওরা ভাল লোক না।’
সাহাবুদ্দিনের সংক্ষিপ্ত উত্তর। ওদিকে ভাল লোকের মিছিল হচ্ছে না, ওদিকে আমার যাবার দরকার নেই।
‘গাড়িতে তেল লাগবে?’
‘না।’
গাড়ির তেল ধীরে খরচ হয়। যেটুকু চলে গাড়ি, সেটুকুই খরচ।
‘সাহাবুদ্দিন, আপনার টাকার দরকার আছে? টাকা লাগবে কিছু?’
‘না।’
‘আপনার ছেলে বলেছিলেন মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে। যদি কখনও দরকার হয় কিছু বলবেন।’
‘আমার লাগবে না।’
সাহাবুদ্দিন বড় অপ্রতিভ বোধ করেন টাকা পয়সার প্রসঙ্গ উঠলে। নম্রতা আর নির্লোভতার একটা সীমা আছে, সাহাবুদ্দিন সীমা ছাড়িয়ে যান। মাঝে মাঝে মনে হয় সাহাবুদ্দিন এই গ্রহের কেউ নয়, অন্য গ্রহ থেকে অন্যরকম একজন মানুষ এই নোংরা পৃথিবীতে এসে পড়েছেন। ভাবি, আজ যদি দেশের মানুষগুলো সাহাবুদ্দিনের মত সৎ হত, তাহলে হয়ত দেশটির চেহারা বদলে যেতে পারত। হাতে গোনা কিছু ধনী লোক কোটি কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বসে আছে, কোনওদিনই তা আর ফেরত দিচ্ছে না। সরকারের সঙ্গে বেশ খাতির তাদের, সরকার ঋণখেলাপিদের গোপনে ক্ষমা করে দেয়। যে সরকারই আসে, সে সরকারের সঙ্গেই এদের খাতিরের ব্যবস্থা আছে। সততা কোথায় আছে আর? শিক্ষকদের সৎ বলে জানতাম। শিক্ষকদের মধ্যেও অসততার বীজ রোপন করা হয়ে গেছে। তাঁরাও আজকাল মোটা টিউশন ফি নিয়ে ছাত্র পড়িয়ে পরীক্ষা পাশের নিশ্চয়তা দেন। পুলিশ ঘুষ খাচ্ছে। কৌশলী খাচ্ছে, প্রকৌশলী খাচ্ছে। রাস্তাঘাট আজ নির্মাণ হল, তো কাল ভেঙে যাচ্ছে। ভেজাল সবখানে। ডাক্তাররা হাসপাতালের রোগীকে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে টাকা আদায় করে অপারেশন করছে, অপারেশনের প্রয়োজন না থাকলেও পেট কাটছে টাকার জন্য। মন্ত্রী ঘুষ খাচ্ছে, আমলারা খাচ্ছে। যাদের খাবার আছে, তারাই আরও বেশি করে খেতে চাইছে। আর যাদের নেই, যারা খেতে পাচ্ছে না, তারা মুখ বুজে অন্যের খাওয়া দেখছে। সততা যদি টিকে থাকে কোথাও, দরিদ্রদের মধ্যেই আছে। কিন্তু মুখ বুজে আছে কেন সবাই! কেন নিজের অধিকারটুকুর দাবি তারা করে না। রিক্সাঅলারা রোদে জলে ভিজে অমানুষিক পরিশ্রম করে সামান্য কটি টাকা রোজগার করে, আরোহীদের মার খায় ধমক খায় কিন্তু প্রতিবাদ করে না। পাঁচতারা হোটেলের কিনারে, বারিধারার বড় বড় প্রাসাদের পাশে নোংরা বস্তিতে জীবন যাপন করছে মানুষ অথচ প্রতিবাদ করছে না। ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকেরা দেখছে বড় বড় রেস্তোরাঁয় লোকেরা পেট পুরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে, দেখেও কেড়ে খেতে চাইছে না কোনও খাবার। একবার কাউরান বাজারে গিয়েছিলাম রাতে, ওখানে অনেক রাতে ট্রাক ভরে শাক সবজি আসে, ট্রাক থেকে শ্রমিকেরা নামায় সেসব, কিছু সবজি কিনে ফিরে আসার সময় দেখেছিলাম, শহরের শ্রমিকেরা ফুটপাতে ঘুমোচ্ছে, কারও কোনও ঘর নেই, ঘুমোবার জায়গা নেই, গরমে কোনও হাওয়া নেই, মশা কামড়াচ্ছে, কোনও মশারি নেই, সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত, রাস্তার কিনারে কোথাও একটু ঘুমোবার জায়গা পেলেই খুশি ওরা, ওরাও প্রতিবাদ করতে জানে না। ধনী আর দরিদ্রের প্রকট বৈষম্য দেখে আমার বড় রাগ হয়। নিজের কথা ভাবি, রাগ করার কী অধিকার আছে আমার! আমিই বা ধনীদের চেয়ে আলাদা কোথায়, আমাকে ধনী বলেই বিচার করবে যে কোনও উদ্বাস্তু উন্মুল মানুষ। আমি একটি দামি আ্যপার্টমেন্ট কিনেছি, আমার একটি গাড়ি আছে। আমি ধনীই বটে। নিজেকে আমি সান্ত্বনা নিই এই বলে যে আমি কোনও অসততা করে টাকা উপার্জন করিনি, আমি কোনও অবৈধ ব্যবসা করি না, লোক ঠকাই না, একটিও কালো টাকা আমার নেই। তারপরও একটি গ্লানি আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। আমি কি এখন সব ছেড়ে ছুড়ে ফুটপাতে রাত কাটাবো, বস্তিতে ঘর তুলব? আমি কি সব টাকা পয়সা বিলিয়ে দিয়ে না খেয়ে বা আধ পেট দিন কাটবো? এতে কি ধনী দরিদ্রের বৈষম্য শেষ হবে? হবে না। আমি কি লিখে এই বৈষম্য দূর করতে পারব? আমি জানি, পারব না। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে দূর্নীতি। কোনও রাজনৈতিক নেতাই দরিদ্র মানুষের অবস্থা পরিবর্তনের কথা ভাবে না। চেষ্টা করে না। গণতন্ত্র ব্যবহার করে যে দলই ক্ষমতায় আসে, ক্ষমতায় এসে ক্ষমতা অপব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়াই আসল উদ্দেশ্য। দেশ এবং দেশের মানুষের মঙ্গল, ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করার নীতি কারওরই নেই। একবার বারিধারার বস্তির এক হতদরিদ্র লোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, চোখের সামনে এত যে ধনী দেখছেন, এত যে ওদের ধন দেখছেন, কি রকম লাগে আপনাদের? আপনারাও মানুষ, ওরাও মানুষ, কিন্তু ওরা সুখে থাকবে, আপনারা কষ্টে থাকবেন, এই নিয়মটি কেন মেনে নিচ্ছেন? কেন ধনীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন না? লোকটি বলেছিল, ‘আল্লায় তাদেরে দিছেন, আমাদেরে দেয় নাই। ইহলোকে যদি কষ্ট করি, পরলোকে আল্লাহ অনেক দিবেন। এই সময় ঈমান মজবুত রাখা জরুরি। আল্লাহ তো আমাদেরে দুর্দশা দিয়া আমাদের ঈমান পরীক্ষা করতেছেন। ঈমান যদি ঠিক রাখতে পারি, তাইলে আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন।’ আমি নিশ্চিত, লোকটি নিজের বুদ্ধি থেকে এই কথা বলেনি। বলেছে সেই কথা যা তাকে শিখিয়েছে আমাদের নেতারা। আমাদের রাজনীতিকরা ধর্মকে ব্যবহার করেন গরিবদের দাবিয়ে রাখার জন্য। তা না হলে আজ বারো কোটি লোকের মধ্যে মানবেতর জীবন যাপন করা আশি ভাগ লোক যদি প্রতিবাদ করত, যদি পথে নামত, তবে ধনীর সাধ্য ছিল না আরাম আয়েশে জীবন যাপন করা। ধর্ম তাই ধনীদের আরামে রাখার একটি অস্ত্র। ধর্ম রাজনীতিকদেরও অস্ত্র। ধর্মের কথা বলে গরিবকে নিশ্চুপ রাখা যায়, ধর্মের কথা বলে ভোটে জেতা যায়। ধর্মের কথা বলে ধর্মীয় অনুভূতি উসকে দেওয়া যায়। ধর্মের কথা বলে উড়ির চড়ের ঘুর্ণিঝড়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুকে আড়াল করা যায়, হাজার হাজার ঘরহীন মানুষকে আকাশের তলে বাস করানো যায়। প্রতিবছর বন্যায় ঘরবাড়ি ভাঙা, জলে তলিয়ে যাওয়া সহায় সম্বলহীন মানুষকে বলা যায় আল্লাহ ঈমান পরীক্ষা করছেন। ঈমানের পরীক্ষা কেবল গরিবদেরই ওপরই কেবল? এই প্রশ্নটি করারও কারও সাহস নেই। এতে লাভ সকল বিত্তবান এবং মধ্যবিত্তর। মধ্যবিত্তের স্বপ্ন বিত্তবান হওয়া। বিত্তবানদের সব পন্থাই তারা অবলম্বন করে। অথচ কোনও সামাজিক দুরবস্থার বিরুদ্ধে যে আন্দোলনই গড়ে ওঠে, কিছু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সচেতন মানুষ দ্বারাই তা গড়ে ওঠে। তাই আন্দোলন কখনও খুব শক্ত হয়ে দানা বাঁধে না। থেমে থেমে যায়। এর পেছনে যে কারণটি আছে, তা নিশ্চয়ই, যেহেতু মধ্যবিত্তদের দলটি, সমাজ সচেতন হলেও, সমাজের মঙ্গলের জন্য আন্দোলন করলেও, সত্যিকার ভুক্তভোগী নয়।
ভুক্তভোগীরা যখন আন্দোলনে নামে, জীবন দিয়ে নামে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের আন্দোলন মাটি করে দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। দেশের কোনও কারখানায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইন মেনে চলা হয় না। শ্রমিকদের খাটানো হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশি, মাইনে দেওয়া হচ্ছে কম, তার ওপর সুযোগ সুবিধে যা তাদের প্রাপ্য তার কিছুই দেওয়া হচ্ছে না। এসবের বিরুদ্ধে কোনও কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করতে চাইছে, সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক নেতাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে মালিকের পক্ষ থেকে দিয়ে দেওয়া হল মোটা অংকের টাকা। ব্যস, নেতা থামিয়ে দিল আন্দোলন। এভাবেই চলছে দেশ। সেই কত কাল আগে লাঙল ব্যবহার শুরু। কৃষি ব্যবস্থার কত উন্নতি হয়ে গেল কত দেশে, আর কৃষি-প্রধান দেশটিতে এখনও লাঙলই সম্বল জমি চাষ করার জন্য। যে কৃষকরা ফসল ফলাচ্ছে, সেই কৃষকদের হাতে ফসলের সঠিক মূল্য পৌঁছোচ্ছে না। কৃষক এবং ক্রেতার মাঝখানের ব্যবসায়ীরাই মূল্যের অধিকটা পকেটে পুরছে। এমন একটি ব্যবস্থা কি কখনও করা সম্ভব নয় যে ব্যবস্থায় ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে এই বিশাল পার্থক্যটি ঘুচবে! যখন ধনী অত বেশি ধন তৈরি করার সুযোগ পাবে না, আর দরিদ্রকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হবে না! কজন মানুষ সৎ পথে ধনী হতে পারে এ দেশে! খুব কম। যারা খুব ধনী, বেশির ভাগই অসৎ পথে ধনী হয়েছে, অন্যকে ঠকিয়ে ধন বানিয়েছে নিজের জন্য। উপার্জনের কর ফাঁকি দিয়ে চলছে অধিকাংশ ধনী। ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে পার্থক্য ঘোচানোর ব্যবস্থাটি তৈরি করে মানুষের মধ্যে সমতা আনতে যে সততা আর নিষ্ঠা প্রয়োজন তা কজন মানুষের মধ্যে আছে! মানুষ নিজের কথাই ভাববে নাকি অন্যের! মানুষ যদিও সৎও হয়, সরকারের অসততার কারণে মানুষ অসৎ হতে বাধ্য হয়। ওপরতলায় দূর্নীতি বাড়লে নিচ তলাতেও দূর্নীতি বাড়ে। দেশটি দরিদ্র দেশ। দেশটির মাটির তলে এমন কিছু সম্পদ নেই যা দিয়ে রাতারাতি ধনী হয়ে যেতে পারে। জনসংখ্যা উন্মাদের মত বাড়ছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বছর বছর মানুষ মরছে, বাস ট্রাক গাড়ি রেলগাড়ি যখন তখন উল্টো হয়ে পড়ছে, জাহাজ ডুবছে, লঞ্চ ডুবছে —একসঙ্গে তিনশ চারশ মানুষ এক মিনিটেই মরে যাচ্ছে। এত মরেও জনসংখ্যা রোধ হচ্ছে না। বাড়ছেই। অসুখে অপুষ্টিতে শিশু মরছে, শিশুর মৃত্যু হার বাড়লে শিশুর জন্মের হারও বাড়ে। অনিশ্চয়তা থেকে বাড়ে। চারদিকে অশিক্ষা বাড়ছে। কুশিক্ষা বাড়ছে। অভাব বাড়ছে। অন্ধত্ব বাড়ছে। সংশয় বাড়ছে, হতাশা বাড়ছে। হতাশা বাড়লে ধর্ম বাড়ে। দিনে কয়েকটি করে খোদ ঢাকা শহরেই ইসলামি জলসার আসর বসে। ধর্ম এখন বেশ বড় একটি ব্যবসা। ধর্মের ব্যবসা যাদের আছে, তারা ভাল কামাচ্ছে। লোক ঠকানোর ব্যবসা যারাই করে, ভাল কামায়। যত বেশি লোক ঠকাতে পারবে, তত বেশি কামাই। দেশে একজনও সৎ নেতা বা নেত্রী নেই, যার ওপর ভরসা করা যায়। কোনও নেতাই দেশ এবং দেশের মানুষের মঙ্গলের কথা ভাবে না। সবাই আছে নিজের স্বার্থ নিয়ে। ডঃ কামাল হোসেন গণফোরাম নামে একটি রাজনৈতিক দল শুরু করেছেন। তিনি একসময় শেখ মুজিবর রহমানের খুব প্রিয় লোক ছিলেন। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানটি তাঁরই লেখা। মুজিব আমলে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর মতের মিল না হওয়ায় তিনি আওয়ামি লীগ থেকে বেরিয়ে আসেন। গণফোরামের সদস্য সংখ্যা খুবই কম, বেশির ভাগ সদস্যই উচ্চজ্ঞশক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, আইনজ্ঞ। এই দলে বেশ কজন অভিজ্ঞ বাম রাজনীতির নেতা আছেন। কোনওদিন যদি ক্ষমতায় যেতে পারে গণফোরাম, তবে আমার বিশ্বাস দেশটির চেহারা পাল্টাবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ডঃ কামাল হোসেন এই গণফোরামকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করতে পারছেন না। সম্ভবও নয়। জনপ্রিয় রাজনীতি করতে হলে কর্মী পুষতে হয়, সন্ত্রাসী পুষতে হয়, জনগনকে ধোঁকা দিতে হয়। সেটা আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে যারা যুক্ত, তাঁরা পারেন না।গত নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে হেরে গেছেন অশিক্ষিত ট্রাক ব্যবসায়ী হারুন মোল্লার কাছে। কামাল হোসেন একজন বিখ্যাত আইনজ্ঞ, জাতিসংঘের উপদেষ্টা, শিক্ষিত, সৎ, সেকুলার, অথচ তাঁকে হেরে যেতে হয় রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ একটি লোকের কাছে। কি নাম এই দেশের গণতন্ত্রের যে গণতন্ত্রের ভোট টাকা দিয়ে কেনা হয়? এ আর যাই হোক সত্যিকার গণতন্ত্র নয়। দেশের আশিভাগ দরিদ্রর কাছ থেকে ভোট পাওয়ার জন্য তাকে মিথ্যে আশ্বাস দাও, কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দাও, ভোট পাবে, যত বদমাশই তুমি হও না কেন। যার যত টাকা বেশি, তার তত ভোট বেশি। যে যত বেশি মিথ্যে বলতে পারে, তত ভোট পাবে বেশি। আমি উদাস বসেছিলাম জানালায় মাথা রেখে। এলোমেলো ভাবনার মধ্যে ডুবে। সাহাবুদ্দিনের ডাকে আমি চমকে উঠি। বাড়ি এসে গেছে। সাহাবুদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন দরজা খুলে।
বেরিয়ে আসতে আসতে বলি, ‘আপনাকে না কতদিন বলেছি দরজা খুলে দেবেন না গাড়িতে ওঠার সময়, বেরোবার সময়!’
সাহাবুদ্দিন মাথা নত করেন।
ঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবি, সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে এই যে আমি এই ভদ্রতা করছি, তা কেন করছি, আমার নিজের জন্য নাকি সাহাবুদ্দিনের জন্য! নিজের জন্য নিশ্চয়ই, নিজে আমি খানিকটা উদার হয়েছি ভেবে আমার ভাল লাগে, সেই ভাল লাগাটি আমি আমাকে দিতে চাই।
সাহাবুদ্দিনের জন্য দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও পরিশ্রমের কাজ নয়। এটি করে তিনি আমাকে সন্তুষ্ট রাখতে চান, আমি যেন তাঁকে খুব সহজে বলে না দিতে পারি, আপনার চাকরি আজকের মত এখানেই শেষ। চাকরিটি সাহাবুদ্দিনের দরকার। সাহাবুদ্দিন গাড়ির তেল চুরি করছে না, আমাকে ঠকিয়ে পয়সা কামাতে চাইছে না, কারণ তাঁর মধ্যে কোথাও কোনও সৎ একটি মানুষ লুকিয়ে আছে, ছোটবেলায় কখনও হয়ত শিখেছিলেন, অন্যায় করিও না, মানুষের মনে কষ্ট দিও না, অসৎ পথে চলিও না এসব নীতিবাক্য। বুড়ো হয়ে গেছেন, আজও শৈশবের উপদেশবাণী মেনে জীবন কাটাচ্ছেন যখন বেশির ভাগ মানুষই ওসব হয় ভুলে গেছে, অথবা ভুলে না গেলেও মেনে চলা জরুরি মনে করে না, অথবা মেনে চলতে চাইলেও নিজের চাহিদা আর চারপাশের দূর্নীতি তাদের ওসব মেনে চলতে দেয় না। ওসব এখন পুরোনো কথা, বাজে কথা।
লেখার ঘরে ঢুকে ফ্যান চালিয়ে দিয়ে আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি। মাথার ভেতর পোকার মত নানান ভাবনা কিলবিল করছে। কত লেখা অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে, শেষ করতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয় কী হবে লিখে! কী দরকার লিখে! একটি বিচ্ছিরি হতাশা আমাকে গ্রাস করে রাখে। আমার এসব লেখায় সমাজের কোনও পরিবর্তন হবে না, তবে আর লেখা কেন! দেশের আশি ভাগ মানুষ লিখতে পড়তে জানে না। আমার লেখা শিক্ষিতরাই কেবল পড়ার সুযোগ পায়। শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের সমস্যা নিয়েই লিখি বেশি। কারণ আমি এদেরই দলের লোক। আমি খুব দরিদ্রের ঘরে পৌঁছতে পারি না, শারীরিক ভাবে না, মানসিক ভাবেও না। আমি কেবল কল্পনা করতে পারি তাদের জীবন, আমি তাদের সত্যিকার একজন হতে পারি না। আমি নূরজাহানের কথা লিখি, লিখি কারণ খবরের কাগজে নূরজাহানের যন্ত্রণা পড়ে সেই যন্ত্রণা আমি অনুভব করেছি। আমি কিন্তু নূরজাহানের জীবন যাপন করে সেই যন্ত্রণা অনুভব করিনি। দুই অনুভবের মধ্যে একটি বড় ফারাক আছে। আমি কি আসলে আমার নিজের জন্য নূরজাাহানকে ব্যবহার করছি! নাকি আমি সত্যি সত্যিই নূরজাহানের কষ্ট বুঝতে চাইছি। নূরজাহানের কথা আমি লিখি কেন! কজন নূরজাহান আমার লেখা পড়তে পারে,পড়ে মনে শক্তি পেতে পারে! একজনও না। আমি কি তবে আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের জন্য লিখি, যেন পড়ে আমাকে বাহবা দেয়, নাকি আমি তাদের ভেতরে আমার যে অনুভব সেই অনুভবটিকে ছড়িয়ে দিতে চাই, যেন তারা শোয়া থেকে বসে থাকা থেকে উঠে দাঁড়ায়, যেন কিছু ভাল কিছু একটা করার জন্য উদ্যোগী হয়! আমি ঠিক বুঝে পাই না, কী প্রয়োজন এই দেশটির জন্য। অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হলেই সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে, ধর্মের রাজত্ব যাবে, শিক্ষা চিকিৎসা সব ব্যবস্থার উন্নতি হবে! নাকি একটি সুস্থ রাজনৈতিক অবস্থা এলেই সমাজ সুস্থ হবে! নাকি ধর্মীয় আইনের অবসান হলেই সব সমস্যা দূর হবে! কোনটি? এর কোনটি নারী পুরুষের বৈষম্য, সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর বৈষম্য, ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে পারে! কেবল একটি পরিবর্তনই কি যথেষ্ট, যেহেতু একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক ওতপ্রোত! নাকি আলাদা আলাদা করে একই সঙ্গে সব কিছুর জন্য লড়াই করতে হবে! ধুত্তুরি বলে আমি উঠে পড়ি চেয়ার থেকে। চা খাওয়া দরকার। চায়ের জন্য মিনুকে ডাকি। মিনু দৌড়ে রান্নাঘরে চলে যায় আমার জন্য চা বানাতে। আজকে মিনু তো গার্মেন্টসএ কাজ করতে পারত। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত। কিন্তু মিনুকে কেন দিচ্ছিন! গার্মেণ্টেসএ কাজ করতে! আমার আরামে আয়েসে অসুবিধে হবে বলে! নাকি মিনুর মঙ্গলের কথা ভাবছি আমি! গার্মেন্টসএর মেয়েরা যে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, সেই নিরাপত্তাহীনতা এখানে মিনুর নেই, সেটি ভাবছি।
নাহ, চা না খেলে আমার মাথা থেকে এসব যাবে না, এই প্রশ্নগুলি।
আমি যখন চা খাচ্ছি, তখন আসে সেই পাঁচজন মেয়ে। আগেও একদিন এসেছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে। সাদাসিধে শাড়ি পরা, সাদাসিধে চুলের বিনুনি, কিন্তু কথাগুলো এদের সাদাসিধে নয়। এদের কথা আগেরবারের মতই। আমি এই যে মেয়েদের স্বাধীনতার বিষয়ে লিখছি, এভাবে লিখে কোনও লাভই হবে না, যদি পুঁজিবাদী সমাজ টিকে থাকে। সুতরাং আমাকে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে হবে, আমাকে পার্টিতে সক্রিয় হতে হবে, এই পার্টি যদি ক্ষমতায় আসে, তবেই আমার স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
নাহ, আমি কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে চাচ্ছি না।
কেন?
যেহেতু রাজনীতি আমি বুঝি কম।
মেয়েরা আমার সঙ্গে অনেকটা একমত হয় যে আমি রাজনীতি বুঝি কম।
চা আসে। পাঁচজনের সামনে চা ঠাণ্ডা হতে থাকে। পাঁচজনই চা পানের চেয়ে বেশি আগ্রহী কথা বলতে।
আমি কেন আলাদা করে ধর্মহীনতার কথা বা নারী স্বাধীনতার কথা লিখছি! আমি কেন কেবলই কমিউনিজমের কথা লিখছি না, কারণ কমিউনিজম এলেই আপনা আপনি নারী স্বাধীনতা আসবে, ধর্ম দূর হবে। আমি যে সমস্যাগুলো তুলে ধরছি, সেগুলো সুপারফিসিয়াল সমস্যা। আমি লিখছি ঠিকই সমস্যা নিয়ে, কিন্তু কোনও সমস্যারই গোড়া পর্যন্ত যাচ্ছি না, সমস্যার মূলটিকে চিহ্নিত করছি না। মেয়েরা আরও আরও সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমস্যার কথা উল্লেখ করে বলে, সব কিছুর কারণই হল পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা।
খুক খুক করে হঠাৎ কেশে উঠি। কাশি পায় বলেই কাশি। কাশির সঙ্গে হঠাৎ হাসিও পায় কারণ পাঁচজনের একজন যখন জিজ্ঞেস করে, কাশি হয়েছে কেন?, আমি প্রায় বলতে নিচ্ছিল!ম, পুঁিজবাদী সমাজ ব্যবস্থাটিই আমার এই কাশির কারণ।
পাঁচজনের কথা শুনতে শুনতে আমি লক্ষ করি, বাক্যগুলো চমৎকার তাদের। কিন্তু এও লক্ষ্য করি, বাক্যগুলো তাদের মন থেকে বেরোচ্ছে না, বেরোচ্ছে মাথা থেকে। চমৎকার চমৎকার বাক্যগুলো সবে যেন ওরা মুখস্ত করে এল। পাঁচজনের কেউ কারও সঙ্গে কোনও কিছুতে দ্বিমত পোষণ করছে না। একজন কথা বললে চারজন মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে। পাঁচজনকেই আমার সাদাসিধে রোবটের মত মনে হয়।
ওরা আমাকে দীর্ঘ সময় নিয়ে টন টন উপদেশ দান করে বিদেয় হয়।
আমি বসে থাকি সোফায়, বসেই থাকি। টেলিভিশন ছেড়ে ইয়াসমিন জিটিভির হিন্দি গান শুনছে। টেলিভিশনের দিকে আমার চোখ। কিন্তু আমার মন অন্য কোথাও। যখন সাজু , লাভলি আর জাহেদা এসে আমাকে ডাকে, জিজ্ঞেস করে কেমন আছি, তখনও মন সেই অন্য কোথাও থেকে ফেরেনি। তবে ফেরে যখন জাহেদা আর সাজুর চাকরি গেছে, শুনি। চাকরি যাওয়ার কারণ গার্মেণ্টেসএর মালিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন। দীর্ঘদিন থেকে ওরা এই আন্দোলন করার কথা ভাবছিল। ওরা শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কী তাদের পাওনা, কী তারা পাচ্ছে না, কী করে মালিক তাদের ঠকাচ্ছে, এসব বলে বলে বুঝিয়ে বুঝিয়ে কয়েক হাজার শ্রমিককে সচেতন তরে প্রতিবাদী করে রাস্তায় নামিয়েছিল। কিন্তু মালিকের ভাড়াটে গুণ্ডারা মিছিলের শ্রমিকদের পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দিয়েছে, পুলিশ কোনও গুণ্ডার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করেনি। পনেরো ঘন্টা কাজ করা, সপ্তাহের ছুটি, পরবের উৎসবের ছুটি,ঐচ্ছিক ছুটি কিছুই না পাওয়া, তিন হাজার শ্রমিকের জন্য দুটো মাত্র টয়লেট থাকা, তার ওপর দুবারের বেশি টয়লেট ব্যবহার করার নিয়ম না থাকা, কারও বাচ্চা পেটে এল তো চাকরি যাওয়া, কেউ একদিন অসুখে পড়ে কারখানায় আসতে না পারলে একদিনের মাইনে কাটা, অতিরিক্ত কাজের জন্য কোনও বাড়তি টাকা না দেওয়া — এসব আগেই আমাকে জানিয়েছিল ওরা। আমি লিখেওছি কারখানার শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে। কিন্তু লিখলেই কি সমস্যা যায়! ওরা যে আন্দোলনটি করছিল কারখানা বন্ধ করে দিয়ে, সেটিরই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শ্রমিকদের মেরে মাথা ফাটিয়ে, পা ভেঙে, হাত ভেঙে দিয়ে নেতাদের চাকরি খেয়ে মালিক বেশ আছে। মালিকের এই অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। আদালত কোনও মামলা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। আমি বলি, ‘একটা জিনিস ভাল যে কারখানা বন্ধ থাকবে।’
জাহেদা বলে, ‘কালই কারখানা খুলবে আপা।’
জ্ঞকোনও শ্রমিক যদি কাজ না করে তবে কি করে খুলবে?’
‘অনেক শ্রমিকই মালিকের সঙ্গে আপোস করবে। মালিকের অধীনতা মেনে নেবে।’ জ্ঞকিন্তু সবাই তো মানবে না!’
জ্ঞযারা মানবে না, তাদের তো ছাটাই করেই দিয়েছে। কিন্তু মালিকের অসুবিধে হবে না। দেশে গরিবের সংখ্যা প্রচুর। চাইলেই শ্রমিক পাবে। যে কোনও কনডিশনে কাজ করার জন্য অনেকেই প্রস্তুত।’
জাহেদাকে আমি আমার চোখের সামনে দেখেছি ধীরে ধীরে সচেতন হতে, হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করতে, দাঁতে দাঁত পিষতে। রাতে রাতে শ্রমিকদের সঙ্গে গোপন বৈঠক সেরে জাহেদার দলটি আমার বাড়িতে চলে আসত, ক্ষিধে পেট, তাড়াতাড়ি খাবার আয়োজন করতাম ওদের জন্য। খেতে খেতে বলত কতদূর এগোচ্ছে কাজ, আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে দল ভারী হতে। আজ অনেকদিন হল চাকরি নেই জাহেদা আর সাজুর। লাভলীর চাকরিটি এখনও আছে, তবে এটিও যাবে যে কোনও একদিন। সাজু আর জাহেদা অন্য কারখানায় চাকরির জন্য গিয়েও পায়নি চাকরি। অভিজ্ঞতা আছে গার্মেন্টসএর কাজে, জানার পরও কোনও চাকরি জোটে না। অনেকক্ষণ শুনি তাদের কথা। অনেকক্ষণ বসে থাকি। একসময় উঠে গিয়ে আমি ব্যাংকের চেকবইএর শেষ পাতাটি ছিঁড়ে আনি। সাড়ে চার হাজার টাকা আছে ব্যাংকে, পুরোটাই লিখে দিই জাহেদার নামে।
জাহেদা অবাক, ‘টাকা কেন?’
‘সেলাই মেশিন কেনো। ঘরে বসে সেলাই করে আপাতত কিছু রোজগার কর।’
আমি গিয়েছি পল্লবির বস্তিতে জাহেদার ছোট্ট বেড়ার ঘরটিতে। ঘরটিতে কেবল একটি চৌকি আর একটি ছোট্ট টেবিলের জায়গা হয়। চৌকিতে পা তুলে আসন করে বসে গল্প শুনেছি জাহেদার সাজুর আর লাভলির জীবন সংগ্রামের। জাহেদা কি করে গ্রাম থেকে শহরে এসে বেঁচে থাকার লড়াই করেছে। মাত্র অষ্টম শ্রেণীর বিদ্যে নিয়ে গার্মেন্টসএর শ্রমিক হওয়া ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না তার। সাজু লেখাপড়া করতে পছন্দ করত, মেট্রিক পাশ করেছে, কিন্তু কলেজে পড়া সম্ভব হয়নি অভাবের কারণে, তাই চাকরি করা শুরু করেছে। লাভলিরও প্রায় একই অবস্থা। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারে সাহায্য করার জন্য তাকে চাকরি করতেই হচ্ছে। সাজু আর জাহেদা একসঙ্গে থাকে কয়েক বছর থেকে, দুজনের একটি বাচ্চাও আছে। বাচ্চাটিকে তারা গ্রামে জাহেদার মার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখানে তাদের দুজনই সারাদিন বাইরে, বাচ্চা রাখার কেউ নেই। সাজু খুব গর্ব করে বলে জ্ঞআমরা লিভ টুগেদার করি। বিয়ে জিনিসটা যুক্তিহীন।’
জ্ঞএখানে কোনও অসুবিধে হয় না বিয়ে ছাড়া একসঙ্গে থাকতে?’ আমি জিজ্ঞেস করি। সাজু বলে, ‘না। গরিব আর ধনীদের লিভ টুগেদারে কোনও অসুবিধা নাই। অসুবিধা হয় মধ্যবিত্তদের।’
তা ঠিক, ভাবি, সমস্ত অসুবিধে মধ্যবিত্তের। মধ্যবিত্তের লজ্জা বেশি, ভয় বেশি, যত সংস্কার আছে, সব মানার এবং মানার ভানও বেশি।
সাজুর লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ থাকার কারণে পত্রপত্রিকা যেখানেই যা পায়, পড়ে। পড়তে পড়তেই আমার লেখা ওর নজরে আসে। প্রতি সপ্তাহে তার পড়া চাইই আমি যা লিখি। লাভলী আর জাহেদাসহ অনেককে সে আমার লেখা পড়িয়েছে। এরপর সাজুই প্রথম জাহেদাকে নিয়ে আমার সঙ্গে একদিন দেখা করতে আসে, এরপর লাভলীকে নিয়ে জাহেদা আসে, এরপর ওদের সূত্র ধরে আরও গার্মেন্টসএ শ্রমিক আসে। ওদের সঙ্গে কথা বলে আমার ভেতরে সাহসের জন্ম হয়। ওদের সঙ্গ আমাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সঙ্গের চেয়ে বেশি আনন্দ দেয়। ওদের সাহস এবং মনোবল আমাকে চমকিত করে। বাসের দরজায় ঝুলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে, বাসে চড়ার পয়সা না থাকলে মাইল মাইল পথ পায়ে হাঁটছে, দুপুরের কড়া রোদ মানছে না, রাতের অনিশ্চয়তা মানছে না, হেঁটে যাচ্ছে। ওরা পুঁজিবাদের সংজ্ঞা পড়েনি, সমাজতন্ত্রের কোনও তত্ত্ব কথা জানে না। কিন্তু নিজেদের অধিকার সম্পর্কে ওরা জানে, কঠোর পরিশ্রম করতে জানে, এবং তার মূল্য কড়ায় গণ্ডায় আদায় করার জন্য যা কিছু করতে হয় তা করতে জানে। অভাব ওদের মাথাকে নত করেনি। কোনও ষড়যন্ত্র ওদের পিছপা করে না। কোনও আঘাত ওদের থামায় না। ওরা অনেক কিছুতে অজ্ঞ, কিন্তু কোনও কিছুতেই মূর্খ নয়। প্রচণ্ড উদ্যম ওদের। ভয় পেলে ওদের চলে না, কাতর হলে চলে না। ধর্মের ভেদ, নারী পুরুষের ভেদ মানা ওদের চলে না। কারও দেওয়া পথ বা মত মেনে চলে না, নিজেদের পথ ওরা তৈরি করে নেয়। প্রতি মুহূর্তে সংগ্রাম করছে, অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের জন্য সংগ্রাম। সংগ্রামী হিসেবে আমার নাম হয়েছে, কিন্তু আমি নিজে বুঝি, আমার মত দশটি তসলিমা যোগ করলেও এক জাহেদার মত সংগ্রামী হতে পারবে না। আমার সাহসকে দশ দিয়ে গুণ করলেও এক জাহেদার সাহসের সমান হবে না। নিজেকে নিয়ে যত গর্ব করি আমি, তার চেয়ে বেশি করি জাহেদাদের নিয়ে।
চেকটি নিয়ে যখন ওরা চলে যায়, হঠাৎ একটি জিনিস আমার মনে উঁকি দেয়, আমি কি ওদের আগুনে কিছুটা জল ঢেলে দিলাম। যে ক্রোধটি ওদের ছিল, তা কি খানিকটা নষ্ট করে দিলাম! এই সুবিধেটুকু দিয়ে ওদের কি আমি শান্ত করে দিলাম। ওরা কি গার্মেণ্টেসএর মালিকদের শোষণের কথা আর কোনও শ্রমিকদের বলবে না, ওদের একত্রিত করবে না! শ্রমিকের অধিকার আদায় করার জন্য ওরা কি আর আন্দোলন করবে না! ওরা কি এখন কেবল সেলাই মেশিন নিয়ে বসে বসে সেলাই করবে আর একটু একটু করে দুজনের, কেবল দুজনের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনার কথাই ভাববে! সম্মিলিত মানুষের সংগ্রাম থেকে আমি কি জাহেদা আর সাজুকে সরিয়ে দিলাম! একটি শীত শীত ভয় আমাকে কাঁপাতে থাকে।
বছর চলে যাচ্ছে। এ সময় ব্যস্ততার শেষ নেই। দিন রাত আমি লেখায় ব্যস্ত। প্রুফ দেখায় ব্যস্ত। সামনে ফেব্রুয়ারি। ফেব্রুয়ারি মানেই হচ্ছে বইমেলা। মেলায় বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকেরা উন্মাদ হয়ে ওঠেন। পত্রিকার কলামগুলো নিয়ে কাকলি প্রকাশনী থেকে বের হচ্ছে ছোট ছোট দুঃখ কথা। কাকলির সেলিম আহমদ আমার অনুরোধ রেখেছিলেন ফ্যান দাও বইটি বের করে। ফ্যান দাও পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় লেখা কবিতার সংকলন। সেই সময়ের পত্র পত্রিকা ঘেঁটে যে সব কবিতা পেয়েছি, সেই ভুলে যাওয়া কবিতা গুলো নিয়ে বই সম্পাদনা করেছি। এটি করার জন্য আমাকে প্রেরণা দিয়েছিলেন নিখিল সরকার। তিনজনের ওপর তিনটি বইয়ের কাজটি ভাগ করে দিয়েছেন তিনি। সে সময় গল্পলেখকরা মন্বন্তরের ওপর যেসব গল্প লিখেছিলেন, সেগুলো সংকলিত করার দায়িত্ব বেলাল চৌধুরীর ওপর, আমার ওপর কবিতার, আর নিখিল সরকার নিজে নিয়েছেন মন্বন্তরের ছবি নিয়ে বই করার দায়িত্ব। মন্বন্তরের সময় শিল্পীদের আঁকা আঁকা ছবিগুলো যোগাড় করেছেন, ছবি নিয়ে লেখা তাঁর বড় একটি প্রবন্ধ যাচ্ছে বইটিতে। বইটির নাম দায়। বইগুলো পুনশ্চ নামের ছোট একটি প্রকাশনী থেকে বেরোয়। ফ্যান দাও বইটি খুব একটা চলবে না জেনেও সেলিম আহমদ বইটি প্রকাশ করেন আমার অনুরোধে, অনুরোধে ঢেঁকি গিললে পরে আনুকূল্য লাভের সম্ভাবনা আছে বলে। কাকলি প্রকাশনী তাই নতুন একটি নতুন বই পেয়েছে আমার। পার্ল পাবলিকেশনের ভাগ্যে শিকে তেমন ছেড়েনি, তাঁকে দিয়েছি লজ্জা এবং অন্যান্য নামের একটি বই, এটি আমার লেখা বই নয়, তবে লজ্জা নিয়ে অন্য লেখকরা যা লিখেছেন, সেসবের সংকলন। পার্ল পাবলিকেশনের মিনু খুব মন খারাপ করেছেন, বলেছেন, ‘অরিজিনাল কিছু দেন।’
‘অরিজিনাল কোত্থেকে দিই এখন!’
ব্যস্ত ছিলাম কোরানের নারী লিখতে, বেদ বাইবেল কোরান ঘাঁটায়। আমার মেয়েবেলা নামে একটি উপন্যাস এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। অসম্পূর্ণ জিনিস তো কাউকে দেওয়া যায় না। মিনুকে শেষ পর্যন্ত পুরোনো চারটে উপন্যাস জড়ো করে ছাপতে বলি, চারকন্যা নাম বইয়ের। মিনুর মুখে একটু হাসি ফোটে, কিন্তু তারপরও আমাকে মনে করিয়ে দেন, নতুন বই কিন্তু আমি পাই নাই। খোকা যেসব বই ছেপেছিলেন, সেগুলো প্রকাশ করার দায়িত্ব এক এক করে বিভিন্ন প্রকাশককে দিয়ে দিই। দুঃখবতী মেয়ে নামে ছোট গল্পের একটি বই মাওলা ব্রাদার্সকে দিই। বহুদিন থেকে ঘুরছেন মাওলার প্রকাশক। কাউকে মন খারাপ করে দিতে ইচ্ছে হয় না। সবাইকে মনে হয় কিছু না কিছু দিই। কিন্তু সাধ্য কোথায়! জ্ঞানকোষ প্রকাশনীর প্রকাশক লোকটি অত্যন্ত অমায়িক, তাঁকে আমার নির্বাচিত কলামটি প্রকাশ করার অনুমতি দিয়েছি। এটি পেয়ে তিনি মহাখুশি, যদিও বইটি পুরোনো। সবাইকে আমার কথা দিতে হয় নতুন বই লেখা হলেই তাদের দেব। অংকুর প্রকাশনীর মেজবাহউদ্দিন আহমেদের করুণ মুখটি দেখে মায়া হয়। তিনি বলেন, আজ থেকে পাঁচ বছর আগে মিলনকে উপন্যাস লেখার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েছেন, আজও মিলন কোনও বই দেয়নি। তিনি সমীক্ষণ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছাপতেন, সমীক্ষণে আমি নিয়মিত লিখতাম। সে কারণে মেজবাহউদ্দিনের সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি প্রকাশনা ব্যবসায় নামার পর থেকে বই চাইছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে পরামর্শ দিই পত্রিকায় পক্ষে বিপক্ষে যেসব লেখা বেরিয়েছে, ওগুলো প্রকাশ করে যেন তিনি আপাতত সন্তুষ্ট থাকেন। কোনও নতুন বই নেই? আছে একটি বই। কোরানের নারী। সব প্রকাশকই নাম শুনে আঁতকে উঠেছেন। কেউ এই বইটি প্রকাশ করার সাহস পাননি।
প্রকাশকদের এমন ভিড়ে আমার বারবারই পুরোনো সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। যখন কেবল একজন লেখক এবং একজন প্রকাশকের মধ্যে কথা হত। পরিকল্পনা হত। দুজনের শ্রম এবং স্বপ্ন থেকে একটি বইয়ের জন্ম হত। খোকার সঙ্গে সেই আমার দিনগুলো। কী ভীষণ আবেগ ছিল তখন, কী প্রচণ্ড উত্তেজনা ছিল! সেই দিনগুলো এখনকার এই ভিড়ভাট্টার দিনের চেয়ে অনেক সুন্দর ছিল। খোকার কথা আমার খুব মনে পড়ে। আমার দুঃসময়ের সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। সুসময় এল, সব আছে, তিনিই কেবল নেই। খোকার সঙ্গে কোনওদিন আমার সম্পর্ক নষ্ট হবে আগে ভাবিনি। কিন্তু হয়েছে। এর পেছনে কারণটি খোকাই। একদিন তিনি হঠাৎ আমার হাত ধরে জ্ঞআপনি কি কিছুই বোঝেন না, আমার ভালবাসা আপনি কেন বোঝেন নাঞ্চ বলে কেঁদে উঠেছিলেন, আমি হতচকিত বিস্ময়ে বোবা হয়ে ছিলাম, এও আমাকে দেখতে হল! জীবনে অনেক অপমানকর, অনেক লজ্জাকর, অনেক ঘৃণ্য দৃশ্য আমি কল্পনা করেছি, কিন্তু এই দৃশ্যটি আমার চরম দুঃস্বপ্নের মধ্যেও আসেনি কোনওদিন! আর সইছিল না আমার। মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে এক্ষুনি বুঝি আমি পড়ে যাবো, মুচ্ছগ! যাবো। দ্রুত নিজের হাত টেনে নিয়ে খোকার সামনে থেকে সরে গিয়ে তাঁকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছি। খোকা যে কখনও আমার প্রেমে পড়ে আমাদের চমৎকার বন্ধুত্বটির এমন সর্বনাশ করে দেবেন কোনওদিন, কে জানতো! খোকাকে বের করে দিয়ে আকুল হয়ে কেঁদেছি। স্বপ্ন ভেঙে গেলে মানুষ যেমন শূন্য বোধ করে, কাঁদে, আর্তনাদ করে, তেমন করে। এরপর থেকে খোকা আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেননি। এই ঘটনার বেশ কয়েকমাস আগে খোকার বউ আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন যে খোকার সঙ্গে বোধহয় আমার গভীর প্রেম চলছে, তখন খোকা নিজেই আমাকে বলেছিলেন তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁর বউকে যেন আমি আমাদের সম্পর্কের ব্যপারে জানিয়ে আসি, যেন তাঁর ভুল ভাঙে। তাই করেছিলাম। করার পর খোকার বউ আমার বাড়িতে খোকার সঙ্গে অথবা একাই মাঝে মাঝে চলে আসতেন। গল্প হত। খাওয়া দাওয়া হত। পত্রিকায় সাংবাদিকরা আমার সঙ্গে খোকার বিয়ে দিয়েছে কতবার, বাংলাবাজারের প্রকাশকরা কত অপদস্থ করেছে খোকাকে। কিন্তু কিছুই আমাদের সম্পর্ককে এতটুকু ম্লান করেনি। কিন্তু খোকা নিজেই কী না শেষ পর্যন্ত সব তছনছ করে দিলেন!
আগের জীবন আর নেই। সেই উত্তেজনার জীবন। পঈচ্ছদজ্ঞশল্পী হিসেবে তখন সমর মজুমদার আর ধ্রুব এষ খুব ভাল করছে। খুব কাছ থেকে ওঁদের কাজ দেখেছি। এলিফেন্ট রোডে সমরের বাড়িতে গিয়ে সমরের পঈচ্ছদ আঁকা দেখতাম, আর্ট কলেজের হোস্টেলে থাকতেন ধ্রুব এষ। ধ্রুব আমার কবিতার বইয়ের প্রতি পাতার জন্য স্কেচ করতেন রাত জেগে। সমরের পঈচ্ছদ ভাবনার মধ্যে আমার ভাবনাগুলো মিলিয়ে দেখতাম কেমন দেখায়। একটি ভাল না লাগলে আরেকটি, আরেকটি না লাগলে আরেকটি। এরকম যোগ বিয়োগ চলত। ক্লন্তি ছিল না কিছুতে। ধ্রুব হল কি কাজ? না, আজ হয়নি, কাল হবে। কাল আবার ধ্রুবকে শহর খুঁজে ধরা। ধ্রুব এটা খুব সুন্দর হয়েছে, ওটায় আরেকটু রং হলে ভাল হয়। এখন কে পঈচ্ছদ করছে, কেমন হচ্ছে পঈচ্ছদ তার খোঁজ রাখি না। পরিধি যত বাড়ছে, আমার চলাচল তত সংক্ষিপ্ত হচ্ছে। আগের সেই আবেগ, সেই উত্তেজনা চাইলেও ফিরে পেতে পারি না এখন।
ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে উৎসব শুরু হয়ে গেছে। পুরো মাস জুড়ে চলবে উৎসব। বইমেলা, জাতীয় কবিতা উৎসব, কবিতা পাঠ, কবিতা আবৃত্তি, গানের মেলা, নাট্যোৎসব। সারা বছর লেখকেরা এই একটি মাসের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। শিল্পী সাহিত্যিক পাঠক দর্শক শ্রোতা সব এসে জড়ো হন একটি জায়গায়। এই মাসটির জন্য আমিও অপেক্ষা করে থাকি। কিন্তু ঘরে বসে আছি আমি। কোথাও আমি আমন্ত্রিত নই। কেবল আমারই কোথাও যাবার অনুমতি নেই। কেউ আমাকে কোথাও অংশগ্রহণ করার জন্য ডাকে নি। সাধারণ দর্শক হিশেবেও আমি সকল জায়গায় অনাকাঙ্খিত। কবিরা এক অনুষ্ঠান শেষ করে আরেক অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। আনন্দের জোয়ার তাঁদের ভাসিয়ে নিচ্ছে আরও অধিক আনন্দের দিকে। আমিই কেবল একা একটি অন্ধকার ঘরে বসে আছি। সকলে বাইরে, প্রতিদিন বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত উৎসবে। আমি জানি আমি যদি মেলার দিকে যাই, আমার চারপাশে ভিড় জমে যাবে। ভিড়ের একটি দল আমাকে মেরে ফেলতে চাইবে, আরেকটি দল আমার পায়ের ধুলো নিতে চাইবে। একদল আসবে ছুরি হাতে, আরেকদল বই হাতে, অটোগ্রাফ নিতে। আমার তবু ইচ্ছে করে ছুটে যাই, সেই আনন্দের দিকে সব মুত্যুভয় তুচ্ছ করে ছুটে যাই। মরলে মরব। তবু যাই। কিন্তু পারি না। অদৃশ্য একটি শেকল আমার পায়ে।
কবিবন্ধুরা ব্যস্ত। কারও সময় নেই আমার খবর নেবার, কেমন আছি আমি, উৎসবে যেতে না পারার কষ্টে কেমন ভুগছি। জাতীয় কবিতা উৎসব হচ্ছে, পুরো ফেব্রুয়ারি জুড়ে বইমেলা হচ্ছে, কবিতাপাঠ হচ্ছে। আমিই খবর নিই, জিজ্ঞেস করি, কেমন হচ্ছে মেলা? চমৎকার হচ্ছে, দারুন হচ্ছে, আজ এই হল, কাল এই হল এসবের দীর্ঘ বর্ণনা শুনি। আবৃত্তির নতুন ছেলে মেয়েরা আমার কবিতা আবৃত্তি করে, বইয়ের অংশ থেকে পাঠ করে, কলাম পাঠ করে ক্যাসেট বের করেছে। ক্যাসেটগুলো হাতে আসে। প্রকাশকরা খবর দেন, আমার বইয়ের প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় মুদ্রণ হয়ে গেছে এর মধ্যেই। ছেপে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না, এত বিক্রি হচ্ছে। জানান যে অনেকে আসে লেখকের খোঁজে, অটোগ্রাফ চায়।
‘আমার যে যেতে ইচ্ছে করছে।’ ব্যকুলতা আমার কণ্ঠে।
শুনে প্রকাশকরা জিভে কামড় দেন, ‘এ কথাটি মুখেও নেবেন না। বিপদ তো আছেই। তাছাড়া মেলা কমিটির লোকেরা আপনাকে মেলায় ঢুকতে দেবে না, সে তো জানেনই।’
একুশে ফেব্রুয়ারির দিন ভোরবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি খালি পায়ে ছেলেরা মেয়েরা শাদা পোশাক পরা, হাতে ফুল আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গাইতে গাইতে যাচ্ছে শহীদ মিনারের দিকে। এরকম আমিও যেতাম। আমিও প্রতি একুশেতে ফুল দিতাম শহীদ মিনারে। আজ শহরের সব লেখক কবি, সব শিল্পী সাহিত্যিক উৎসবে ব্যস্ত, অটোগ্রাফ দিচ্ছেন, কবিতা পাঠ করছেন, চা খেতে খেতে অনুরাগী পাঠক বা লেখক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। অনেকদিন দেখা না হওয়া কত শত বন্ধুর সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কত সাহিত্যিক আলোচনা হচ্ছে বিশ্ব সাহিত্য পরিষদের মাঠে, বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে। আমিই কেবল একা। আমিই কেবল বঞ্চিত সবকিছু থেকে। আমারই কেবল অধিকার নেই কোনও আনন্দ পাওয়ার। জানালার গ্রিলে মাথা রেখে দেখতে থাকি গান গাইতে গাইতে হেঁটে যাওয়া মানুষ। যত দূর চোখ যায়, কেবল মানুষ। কী আশ্চর্য সুন্দর যে হয়ে ওঠে ফাল্গুনের এই দিনটি! চারদিকে কৃষ্ণচূড়ার লাল, আর কণ্ঠে কণ্ঠে করুণ এই সুর। সুরটি আমাকে কাঁদাতে থাকে। আমি বিছানায় উপুড় হয়ে গুলিবিদ্ধ মানুষের মত পড়ে থাকি। নিজেকে সত্যিই মৃত মনে হয়। মৃতই মনে হতে থাকে। তখন একটি হাত আলতো করে আমার পিঠ স্পর্শ করে। বুঝি, এটি মার হাত। মা কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘আজকে আমি তোমার হইয়া শহীদ মিনারে একটা লাল গোলাপ দিয়া আসব।’
ফেব্রুয়ারি শেষ হলে আবার আমার বন্ধুদের আনাগোনা শুরু হয় আমার বাড়িতে। শামসুর রাহমান কিছুদিন খুব ঘন ঘন আসেন। আড্ডা আলোচনা নেমন্তন্ন এসব কারণ তো আছেই, আরেকটি নতুন কারণ যোগ হয়েছে। সেটি প্রেম। শামসুর রাহমান প্রেমে পড়েছেন নিজের গোড়ালির বয়সী এক মেয়ের। কয়েকটি পাগল করা প্রেমের কবিতাও লিখে ফেলেছেন এর মধ্যে। কে এই মেয়ে যাকে নিয়ে এত কাব্য! মেয়ে রাজশাহীর, নাম ঐশ্বর্যশীলা। ঐশ্বর্যশীলাকে নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজিম মাহমুদ একদিন ঢাকায় আসেন। সুন্দরী মেয়ে, বিয়ে হয়েছে, চার বছর বয়সী একটি পুত্রসন্তানও আছে। ঐশ্বর্যশীলা আমার বাড়িতে থাকবে কদিন। নাজিম মাহমুদ থাকবেন তাঁর কন্যার বাড়িতে। কন্যা অধ্যাপক স্বামী নিয়ে ঢাকা শহরে থাকে। ঐশ্বর্যশীলা এসেছে এ খবরটি পেয়ে শামসুর রাহমান চলে আসেন আমার বাড়িতে। দুজনে যখন নিভৃতে কথা বলছেন, আমি বারান্দার অন্ধকারে বসে প্রেম নিয়ে ভাবি। প্রেমে পড়ার কোনও বয়স নেই, আসলেই নেই। একুশ বছরে বয়সী মৃগাংক সিংহ আর আটান্ন বছর বয়সী শরিফা খাতুন মিনা প্রেম করে বিয়ে করেছে। মৃগাংক আর মিনার সঙ্গে আমার পরিচয় নির্মলেন্দু গুণের মাধ্যমে। মিনা তাঁর বনানীর বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন করেছে কয়েকদিন। আমার বাড়িতেও নতুন দম্পতি বেড়াতে আসে। খুব বেশি কোথাও মিনা আর মৃগাঙ্ক যেতে পারে না। স্বামী স্ত্রীর বয়সের এই পার্থক্য দেখে লোকেরা হাসে বলে। আমি যদিও সাদরে বরণ করেছি ওঁদের, কিন্তু আমার সংশয় হয়, মৃগাঙ্ক এই বিয়েটি মিনার দৌলতের কারণেই করেছে। মৃগাঙ্ক অজপাড়াগাঁর এক দরিদ্র কৃষকের ছেলে। সুদর্শন। সবল সুঠাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে, সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে উপন্যাস লিখছে। মিনা একটি প্রকাশনী শুরু করেছে মৃগাঙ্কর বই প্রকাশ করার জন্য। মিনা ধনী। তাঁর ছেলে মেয়ে আমেরিকায় থাকে, নিজেও তিনি আমেরিকা যান মাঝে মাঝে, হাতে গ্রীন কার্ড। মিনাকে নিজের আত্মীয় স্বজন সব বিসর্জন দিয়ে এই বিয়েটি করতে হয়েছে। বিয়ের পর মাথায় ঘোমটা পরে তিনি স্বামী সহ শ্বশুর বাড়িও ঘুরে এসেছেন। আমার সংশয় হয়, মৃগাঙ্ক একদিন মিনার টাকা পয়সা সব ভোগ করে, পারলে আমেরিকা পাড়ি দেবার সুযোগ করে নিয়ে মিনাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমার আশঙ্কার কথা গুণকে জানিয়েছি, গুণেরও অনেকটা এরকম সংশয়। শামসুর রাহমান আর ঐশ্বর্যশীলার প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে না, এ আমি নিশ্চিত। শামসুর রাহমান জীবনে আরও মেয়ের প্রেমে পড়েছেন। প্রেমে পড়ে আশ্চর্য সুন্দর সব কবিতা লিখেছেন। ঐশ্বর্যশীলার কথা ভেবেও তিনি কবিতা লিখবেন। সাহিত্যের ভাণ্ডার আরও ঐশ্বর্যমণ্ডিত করবেন। ঐশ্বর্যশীলা রাজশাহীতে স্বামীর সঙ্গে বাস করবে, স্বামীটি, ঐশ্বর্য নিজেই বলেছে, অসম্ভব ভাল। আমার মনে একটি প্রশ্ন জেগেছে, ঐশ্বর্য কি আসলেই শামসুর রাহমানের প্রেমে পড়েছে? নাকি দেশের প্রধান কবির খ্যাতির প্রেমে পড়েছে সে! তাকে নিয়ে শামসুর রাহমানের লেখা কবিতাগুলো পড়ে অভিভূত সে, ওটিই তার সবচেয়ে বড় পাওয়া। একজন কবিকে আবেগস্পন্দিত করে, আলোড়িত করে, কবির হৃদয়োচ্ছঅ!স জাগিয়ে সে নিজের জীবনকে সার্থক করছে।
প্রেম করা কোনও দোষের ব্যপার নয়, প্রেমে মানুষ যে কোনও বয়সেই পড়তে পারে। আমারও মাঝে মাঝে খুব প্রেম করতে ইচ্ছে করে। কোনও উতল প্রেমে যদি একবার ভাসতে পারতাম! ইচ্ছেটি আমার বুকের ভেতর কোথাও গোপনে লুকিয়ে থাকে, বুঝি না যে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ মন যখন খুব উদাস হয়ে আসে, একা বসে থেকে থেকে ইচ্ছেটিকে টের পাই, ইচ্ছেটিকে আলতো করে তুলে নিয়ে ইচ্ছেটির গায়ে আমি নরম আঙুল রাখি। জীবনের রূঢ়তা, ক্রূরতা থেকে ইচ্ছেটির পেলব শরীর আমি আড়াল করে রাখি। রূপবান রুচিবান রসজ্ঞ আলমগীরকে দেখে কদিন রঙিন হয়েছিলাম। আলমগীরের বিয়ে ভেঙে গেছে, এখন নতুন করে সে একটি প্রেম এবং একটি বিয়ের কথা ভাবছে। তার হৃদয়ের দরজা হাট করে খোলা। দরজা খোলা থাকলে যাতায়াত করা যায়, কিন্তু দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে গেলেই অস্থির লাগে। আলমগীরের প্রেমে আমি পড়তে পড়তেও পড়িনি। ভাল লাগে তার সঙ্গ, এটুকুই। কায়সারের সঙ্গে সম্পর্কটি এখন সাদামাটা শারীরিক সম্পর্ক। কায়সারকে আমার পেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তার জন্য আমার মন কেমন করে না। প্রেমের ইচ্ছেটি গুনগুন করে আমাকে গান শোনাচ্ছে যখন, মনে পড়ে সেই কলেজ জীবনের হাবিবুল্লাহকে। আমাকে কী উন্মাদের মতই না ভালবাসত হাবিবুল্লাহ ! যখন সে জানল যে আমি তাকে ভালবাসি না, ভালবাসি রুদ্রকে, সে নাওয়া খাওয়া লেখাপড়া সব ছেড়ে দিয়ে লাইলির জন্য যেমন হয়েছিল মজনু, তেমন হয়ে উঠেছিল। দাড়ি কাটে না, চুল কাটে না, ক্লাস করে না, পরীক্ষা দেয় না, দিলেও একের পর এক ফেল করতে থাকে। আমার নাম জপতে তার দিন যায়, রাত যায়। একদিন রুদ্রকে হাতের কাছে পেয়ে মাথায় রক্ত চেপেছিল ছেলের, রুদ্রকে সে মেরেছিল, সত্যিকার মেরেছিল, বলেছিল, আর যদি কোনওদিন তাকে সে দেখে কলেজ এলাকায়, তবে খুন করবে। সেই হাবিবুল্লাহ। এ জীবনে একজনই আমাকে সত্যিকার ভালবেসেছিল। এতটা জীবন পেরিয়ে, এতটা বয়স পেরিয়ে সেই ভালবাসা আমার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। হাবিবুল্লাহ যদি আমাকে আগের মত ভালবাসতে পারে, তবে আমি এবার আর তাকে ফিরিয়ে দেব না। আমিও বাসব ভাল। আসলে ভালবাসলে ওরকম ভাবেই বাসতে হয়। ওরকম তীব্র করে, ওরকম জগত সংসার তুচ্ছ করে। বাধভাঙা প্রেমের জোয়ারে ভাসতে আমার সাধ জাগে। হাবিবুল্লাহ কেমন আছে, কোথায় আছে কিছুই জানি না। আমার গোপন ইচ্ছেটি তার খোঁজ করে, করে করে একদিন মেলে খোঁজ। হাবিবুল্লাহ নামের একজন ডাক্তার ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চাকরি করে। ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে পাশ করেছে। এ নিশ্চয়ই সেই হাবিবুল্লাহ। পঙ্গু হাসপাতাল ফোন করে করে আমি তাকে পাই। ফোনেই কথা হয় হাবিবুল্লাহর সঙ্গে। এই হাবিবুল্লাহ সেই হাবিবুল্লাহই। আমার ফোন তার কাছে অপ্রত্যাশিত। বাড়িতে আসতে বলি তাকে। এক সন্ধেয় সুদর্শন যুবকটি আমার বাড়িতে এসে হাজির হয়। আগের মতই আছে। এতটুকু পরিবর্তন নেই। প্রথমেই সম্বোধন নিয়ে আড়ষ্টতা। আমরা তুই বলতাম পরষ্পরকে। কিন্তু হাবিবুল্লাহ তুমি বলে সম্বোধন করার পর আমার জিভে তুই তুমি আপনি কিছুই আর আসে না। অতপর ভাববাচ্যের আশ্রয় নিই। ভাববাচ্যে খুব বেশিদূর কথা এগোতে চায় না। থেমে থেমে যায়। দুচারটে কথা হওয়ার পর হাবিবুল্লাহ তার জীবনের দুটো সুখবর দেয়, সে বিয়ে করেছে, তার দুটো বাচ্চা আছে। যে তুফান বইছিল, সেটি হঠাৎ থেমে শান্ত হয়ে যায়। স্তব্ধ চরাচর জুড়ে কেবল জল পড়ার টুপটুপ শব্দ, কোথাও কেউ নেই, অসহ্য নির্জন চারদিক। কেন অবাক হই! আমি কি মনে মনে ভেবেছিলাম যে হাবিবুল্লাহ আমার বিরহে চিরকুমার থেকে গেছে। হ্যাঁ ভেবেছিলাম বৈ কি। দূরাশাকে আশার মত দেখতে লেগেছে।
‘তোমার ভাবীকে বললাম, পুরোনো এক কলেজ-ফ্রেণ্ডএর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি..’
‘আমার ভাবী?’ বিস্ময়ে তাকাই, হাবিবুল্লাহর সঙ্গে কখন হাসিনা বা গীতার দেখা হল! হাবিবুল্লাহ লাজুক হেসে বলল, ‘আমার ওয়াইফ।’
ও। মুখে আমার মলিন হাসি সামাজিক কথাবার্তার নিয়মের সঙ্গে বহুদিন আমার সম্পর্ক নেই। কী জানি, কখনও কি ছিল!
হাবিবুল্লাহ নিজের চাকরি, নিজের সংসার ইত্যাদির গল্প বলে। আর ক্ষণে ক্ষণেই আমার প্রসঙ্গে বলে, ‘তুমি তো খুব বড় হয়ে গেছ। অনেক টাকা পয়সা করেছো। আমাদের এই ডাক্তারি চাকরি করে আর কত পয়সা পাওয়া যায়! জীবন চলে না।’
বাড়িটি গোল গোল চোখ করে দেখতে দেখতে বলে, বাড়িটা কিনেছো বুঝি?’
‘হ্যাঁ।’
‘অনেক দাম তো নিশ্চয়ই। আমার কি আর বাড়ি কেনার সামর্থ হবে?’
‘কেন হবে না, নিশ্চয়ই হবে।’
‘আরে নাহ! যে টাকা পাই, সে টাকা তো খাবার খরচেই চলে যায়। বাপের বাড়িতে থাকি.। তাই চলতে পারছি।’
‘বাপের বাড়িতে থাকলে অসুবিধে কি? নিজের বাড়ি হতেই হবে, এমন কি কোনও কথা আছে!’
‘তোমার তো গাড়িও আছে নিশ্চয়ই।’
‘হ্যাঁ আছে।’
‘বেশ টাকা করেছো।’
‘নাহ। খুব বেশি না। আর.. টাকা পয়সা কি সুখ দেয় নাকি? সুখটাই জীবনে বড়। সুখের সঙ্গে টাকা পয়সার সম্পর্ক নেই।’
‘তোমার ভাবী খুব ভাল মেয়ে। তাকে নিয়ে আমি সুখে আছি। তা বলতে পারো।’
‘এ কি প্রেমের বিয়ে?’
‘নাহ। অ্যরেঞ্জড ম্যারেজ।’
‘বউ কি ডাক্তার?’
‘না, ডাক্তার না। বি এ পাশ করেছে।’
‘চাকরি বাকরি করছে নিশ্চয়ই।’
‘না। তোমার ভাবী হাউজওয়াইফ।’
হাবিবুল্লাহ তার পকেটের মানিব্যাগ থেকে বউ বাচ্চার ছবি বের করে। দেখায়।
‘বউ তো বেশ সুন্দর!’
হাবিবুল্লাহ হেসে বলে, ‘আগে আরও সুন্দর ছিল। এখন তো বাচ্চা টাচ্চা হওয়ার পর ..’
আমার লেখার ঘরে, এমন কী শোবার ঘরেও দুজনে নিরালায় বসে থেকে দেখেছি হাবিবুল্লাহ আমার দিকে কখনও প্রেম চোখে তাকায়নি। কখনও সে পুরোনো সেই দিনের কথা তোলেনি। যত আমি অতীতে ফিরি, সে তত বর্তমানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে, একদিকে ব্উ আরেকদিকে দুই বাচ্চা। এই হাবিবুল্লাহ সেই হাবিবুল্লাহই, কিন্তু এই হাবিবুল্লাহ সেই হাবিবুল্লাহ নয়। তার প্রেম আমার জন্য আর একফোঁটা অবশিষ্ট নেই। আমার ইচ্ছে গুলোকে আমি নিঃশব্দে সরিয়ে রাখি।
হাবিবুল্লাহ আমাকে সেই আগের মত লাজুক হেসে বলে, ‘তোমাকে একটা কথা বলব, রাখবে?’
‘কি কথা?’ সোৎসাহে জানতে চাই। তার বুকের ভেতর আমার জন্য আগের সেই ধুকপুকুনি এখন যে আছে সে কথাই বলবে বোধ হয়।
‘জানি, তুমি পারবে, যদি চাও।’ বলে হাবিবুল্লাহ আবার সেই মিষ্টি লাজুক হাসিটি হাসে।
‘কি কথা, আগে তো শুনি।’ হৃদয় আমার চঞ্চল হয়ে ওঠে। শান্ত প্রকৃতিতে দোল লেগেছে। জলে ঢেউএর কাঁপন উঠেছে।
হাবিবুল্লাহর ঠোঁটে অপ্রস্তত হাসি। কথাটি সে শেষ পর্যন্ত বলে, যে কথাটি বলতে চায়। ‘আমাকে তুমি আমেরিকা পাঠানোর ব্যবস্থা কর।’
মুহূর্তে কাঁপন থেমে যায়। থেমে যায় সব আলোড়ন। আমার জন্য এটি এক অপার বিস্ময়। যে বিস্ময় মনকে বড় তিক্ত করে।
নিস্পৃহ কণ্ঠে প্রশ্ন বলি, ‘আমি? আমেরিকা পাঠাবো? কি করে পাঠাবো?’
‘তুমি পারবে। তোমার তো অনেক বিদেশে যোগাযোগ আছে। তুমি চাইলেই পারবে। এই দেশে ডাক্তারি করে কোনও টাকা পয়সা বানানো যায় না। এখন যদি আমেরিকায় যেতে পারি, তবেই ভাগ্যের পরিবর্তন হবে।’
আমি কাউকে আমেরিকা পাঠানোর ক্ষমতা রাখি না, এ কথাটি হাবিবুল্লাহকে বললেও সে মানে না। তার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার দ্বারা এখন সবকিছুই সম্ভব। আমি অসম্ভব ক্ষমতাধারী একজন কেউ।
মা হাবিবুল্লাহকে সেই আগের মত পাতে বেড়ে বেড়ে খাওয়ান। এই মার চোখে হাবিবুল্লাহ আর আমাকে নিয়ে একসময় কত স্বপ্ন ছিল। খেতে খেতে হাবিবুল্লাহ বলে, জ্ঞআমার ওয়াইফও খুব ভাল রাঁধে খালাম্মা।’
এত ওয়াইফের গল্প শুনতে মারও বোধহয় ভাল লাগে না। মা সম্ভবত জানেন, হাবিবুল্লাহর সঙ্গে আমি দেখা করতে চেয়েছি তার ওয়াইফের গল্প শোনার জন্য নয়। আমার ইচ্ছেগুলো কাউকে আমি বলিনি। কিন্তু মার নিরুত্তাপ চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়, মা আমার ইচ্ছেগুলো কখনও গোপনে পড়ে নিয়েছেন।
চলে যাওয়ার আগে হাবিবুল্লাহ বলে, ‘দেখ, তোমার এই ভাইটার জন্য কিছু করতে পারো কি না।’
প্রেমিক কি না শেষ পর্যন্ত ভাই এ নেমেছে। হা কপাল!
হাবিবুল্লাহ চলে যাওয়ার পর আমি অন্ধকার বারান্দায় একা বসে থাকি তারা ফোটা আকাশের দিকে তাকিয়ে। বড় নিঃসঙ্গ লাগে। বাড়িভর্তি মানুষ, সকলে আমার আপন, আত্মীয়, তার পরও যেন আমার মত এত একা কেউ নেই। হাবিবুল্লাহকে আমি মনে মনে ক্ষমা করে দিই। তার এই জীবনটি সেই জীবন নয়। যে জীবন যায়, সে জীবন যায়ই। বারোটি বছর চলে গেছে। অবুঝ কিশোরীর মত আমি বারো বছর আগের পুরোনো প্রেম ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। দীর্ঘ বারো বছর। কম সময় নয়। সময় অনেকটা খুনীর মত। প্রেমকে খুন করে নিঃশব্দে চলে যায় সময়, আমাদের কারও বোঝার আগেই।
ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত। যে প্রেম সত্যিকার প্রেম ছিল, তাকে অবহেলায় ছুঁড়ে দিয়েছিলাম, বুঝিনি কি হারাচ্ছি আমি। আজ বুঝি কি হারিয়েছি। আজ নিঃসঙ্গতা আমার কানে কানে বলে যায়, ‘তুমি খুব বোকা মেয়ে। তুমি আসল সোনা ছেড়ে নকল সোনা নিয়ে পড়ে ছিলে পুরো যৌবন।’ আজ আর সেই প্রেম আমি ফিরে পেতে পারি না। দেরি হয়ে গেছে। খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে। কখন যে যেতে যেতে তিরিশ বছর চলে গেছে, খেয়াল করিনি। হাবিবুল্লাহ সুখে থাক বউ বাচ্চা নিয়ে। বিবাহিত পুরুষরো স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত হলে আমার ভাল লাগে। কায়সারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটি মাঝে মাঝে আমাকে দেয়। কায়সারকে বলেওছি কদিন, ‘তুই আর আসিস না আমার কাছে, হেনুকে নিয়ে সুখে থাক। অন্য কোনও মেয়ের কাছে যাওয়ার তো দরকার নেই।’ কায়সার তবুও আসে। সপ্তাহে একদিন হলেও আসে, একঘন্টার জন্য হলেও আসে। অবশ্য মাঝে মাঝে সপ্তাহ দুসপ্তাহ পার হয়ে যায়, এমনকী মাসও পার হয়, মনে হয় কায়সার বুঝি আর আসবে না, কিন্তু ঠিকই উদয় হয়। একদিন কায়সারের বউ হেনু আমাকে ফোন করে বলেছে, ‘কি করে আমার স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক করেন? আপনার লজ্জা হয় না? আপনি না মেয়েদের কথা লেখেন! তবে আরেক মেয়ের সর্বনাশ করেন কেন?’ আমি ক্ষণকাল বাক্যহারা বসে ছিলাম। হেনুকে কোনও উত্তর দিতে পারিনি। এরপর শুকনো গলায় বলেছি, ‘আপনার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন, তাকে ফেরান। তাকে বলেন যেন আমার কাছে আর না আসে।’ বড় অপরাধী লাগে নিজেকে। কিন্তু কি করে ফেরাবো আমাকে। এই সঙ্গীহীন প্রেমহীন জীবনে কায়সার যদি কোনও কোনওদিন আমাকে সামান্য সঙ্গ দেয়, আমি কী করে বাধা দেব নিজেকে সেটি গ্রহণ না করার জন্য! আমাকে সন্যাসী হতে হবে যে! এত পিপাসা রেখে কী করেই বা জল ছোঁবো না! আমি তো মানুষ, দেবী নই। অবিবাহিত কোনও পুরুষ প্রেমিক যদি পেতাম অপরাধ বোধটি যেত। কিন্তু যেতে যেতে আমার যে তিরিশ বছর চলে গেছে। সমবয়সীরা সকলেই বিবাহিত। আমার জন্য কেউ বসে নেই এই দুনিয়ায়। হাবিবুল্লাহর মত উন্মাদ প্রেমিকও বসে নেই।
আমার এখনকার বন্ধু বা শুভাকাঙ্খীর সকলে আমার চেয়ে বয়সে হয় অনেক বড়, নয় অনেক ছোট। সমবয়সী কোনও বন্ধু নেই আমার। আমার বাড়িতে যেমন অখ্যাত মানুষের আনাগোনা, তেমন বিখ্যাত মানুষের। সকলেরই সমান আদর এ বাড়িতে। মনে যদি মেলে, তবে বয়স কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বন্ধু হতে গেলে কবি বা লেখক হতে হবে, এমন কোনও নিয়ম আমার নেই। গার্মেণ্টেসএর কাঠখোট্টা ব্যবসায়ী ইয়াহিয়া খান যেমন বন্ধু, আপাদমস্তক কবি নির্মলেন্দু গুণও তেমন বন্ধু। ইয়াহিয়া খানের তবু সাহিত্যজ্ঞান কিছু আছে, মাঝে মাঝে কবিতাও লেখেন। কিন্তু খসরু সাহিত্যের ধারে কাছে নেই। শুরু থেকে শেষ অবদি তিনি ব্যবসায়ী, তিনি আমার ভাল বন্ধু। মিলনের বড় বোন মিনা স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে, রুমি নামের এক ছেলের সঙ্গে দীর্ঘদিন তার প্রেম, রুমিকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করেছে, এ সময় তার একটি চাকরি দরকার। জীবনে কখনও চাকরি করেনি, সেই কতকাল আগে বিএ পাশ করেছে। এখন কে দেবে তাকে চাকরি। খসরুকে বললে তিনি মিনাকে তাঁর আপিসেই সেক্রেটারির একটি চাকরি দেন। স্বামীর অত্যাচারের প্রতিবাদ করে বেরিয়ে এসে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, এরকম মেয়ের সংখ্যা অনেক। অনেক মেয়ের কেবল সুযোগ নেই বলে মুখ বুজে পড়ে থাকে ভালবাসাহীন সংসারে। আমার ইচ্ছে করে একটি কর্মজীবী হোস্টেল তৈরি করতে মেয়েদের জন্য। কিন্তু অত টাকা কোথায় পাবো। খসরু সাহিত্যিক নন, ডাক্তার রশীদও সাহিত্যিক নন, কিন্তু রশীদের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা যে কোনও বিষয়ে আমি কথা বলতে পারি। কেবল খুব বিখ্যাত মানুষই যে জ্ঞানী হন বা উদার হন, তা নয়। এই জীবনে অনেক অখ্যাত মানুষের মহানুভবতা আর প্রশস্তচিত্ততা আমাকে অভিভূত করেছে। এত ছোট লেখক হয়েও এত তুচ্ছ প্রাণী হয়েও আমার সৌভাগ্য যে অনেক বড় বড় লেখকের সান্নিধ্য আমি পেয়েছি। এ বাড়িতে শিব নারায়ণ রায়ের মত পণ্ডিত লোকও এসে থেকেছেন। শিব নারায়ণ রায় আর অম্লান দত্তকে বক্তৃতা করার জন্য এক অনুষ্ঠানে ডেকেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি আমার বাড়িতে এসেছিলেন অম্লান দত্তকে নিয়ে। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর জন্য আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা। কিছু কিছু মানুষ আছেন দেশে, যাঁদের আলোয় আমরা আলোকিত। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার দেশটিতে নক্ষত্রের মত জ্বলছেন তাঁরা। অম্লান দত্ত ছোটখাটো মানুষ, অতি সস্তা অতি মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি পরেন, অতি সাধারণ জীবন যাপন তাঁর, হেঁটে গেলে যে কেউ ভাববে কোনও সদাগরি আপিসের ছাপোষা কেরানি বুঝি। কথা কম বলেন, কিন্তু যখন বলেন, এত সুন্দর বলেন, যে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ব ভারতীর উপাচার্য ছিলেন অম্লান দত্ত অথচ অহংকারের একটি কণাও তাঁর মধ্যে নেই। অম্লান দত্ত ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীর আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। দুজনের অনেক আগে থেকেই বন্ধুত্ব। ফেরদৌসী জাত শিল্পী। গাছের মরা ডাল শেকড় তিনি কুড়িয়ে আনেন, সেগুলোর দিকে তন্ময় তাকিয়ে থেকে থেকে আবিস্কার করেন সৌন্দর্য, শিল্প। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার চোখ সবার নেই। ফেরদৌসীর এই অসাধারণ গুণের কথা তখনও খুব বেশি কেউ জানে না। আমার বিশ্বাস, এই শিল্পটি একদিন আদর পাবে, এ দেশের একজন বড় শিল্পী হিসেবে তিনি সম্মান অর্জন করবেন। ফেরদৌসির যে গুণটি আমার সবচেয়ে ভাল লাগে, তা তাঁর সারল্য, তাঁর মুক্ত হৃদয়। তিনি কিছু লুকোতে, কিছু আড়াল করতে পছন্দ করেন না। অবলীলায় বলে যাচ্ছেন নিজের দোষের কথা, নিজের অক্ষমতার কথা, নিজের অপারগতার কথা। কজন সাধ্য রাখেন তা বলতে! ফেরদৌসীর তিন মেয়ে, রাজেশ্বরী প্রিয়রঞ্জিনী, চন্দ্রেশ্বরী প্রিয়দর্শিনী, ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী। ফেরদৌসীও নিজের নামের সঙ্গে প্রিয়ভাষিনী যোগ করে নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়ে, তাঁর স্নেহ পেয়ে আমি ধন্য হই। শিবনারায়ণ রায়ের জন্য হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, হোটেল ছেড়ে দিয়ে তিনি আমার অতিথি হয়েছেন। নির্মলেন্দু গুণ আর মহাদেব সাহা এসেছিলেন শিবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে। ‘এই যে ফতোয়া দেওয়া হল তসলিমাকে, এই যে মাথার মূল্য ঘোষণা করা হল, এর প্রতিবাদ কি কিছু করছেন আপনারা?’ শিবনারায়ণ রায় জিজ্ঞেস করলেন। নির্মলেন্দু গুণ বললেন, ‘প্রতিবাদ তো অনেক হয়েছে।’ ধমক দিয়ে উঠলেন শিবনারায়ণ, ‘অনেক হয়েছে মানে? কী হয়েছে? কতটুকু আন্দোলন হয়েছে এসবের বিরুদ্ধে? কিছুই করছেন না আপনারা। কিছুই না।’ শিবনারায়ণের সঙ্গে নির্মলেন্দু গুণের আলাপ বহু বছরের। তাঁর মেয়ে মৈত্রেয়ী রায়ের প্রেমে একসময় খুব উতলা হয়েছিলেন গুণ, মৈত্রেয়ী গুণের প্রেমে পড়েনি, গুণ শেষ পর্যন্ত নীরা লাহিড়ীর কাছেই নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। ধমক খাবার পর বেশিক্ষণ বসেননি গুণ আর মহাদেব। আমি খুব অপ্রতিভ বোধ করছিলাম। ফতোয়া ঠেকানোর সাধ্য কি ওঁদের আছে! আমার দুঃসময়ে কাছে আছেন ওঁরা, এই তো আমার জন্য অনেক বেশি। ওঁরা মানুষ হিসেবে বড় বলেই সকল ঈর্ষার উর্ধে। মাঝারি কবি বা লেখকরা ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যান। সৈয়দ শামসুল হক আর হুমায়ুন আজাদের মত বড় লেখক যদি ঈর্ষা করেন, তবে মাঝারিরা করবেন না কেন! ঈর্ষা শুরু হয়েছে আমার বই যখন বেশি বিক্রি হতে শুরু হল তখন থেকে, আর আনন্দ পুরষ্কার তো ঈর্ষার আগুনকে আরও দপদপ করে জ্বালিয়ে দিল। আমার জন্মের আগে থেকে ওঁরা লিখছেন, আর কি না পুরষ্কার দেওয়া হয় আমাকে! এ কারও কারও সয়, সবার সয় না। কেবল হাতে গোনা কজন লেখক কবিই আমার সত্যিকারের বন্ধু। বন্ধু তো যে কেউ হতে পারে, কিন্তু সত্যিকারের আর কজন হতে পারে! কবি রফিক আজাদকেই দেখেছি, সামনে প্রশংসা করেন, আড়ালে গাল দেন। সাহিত্য জগতে এধরনের লোকের সংখ্যাই বেশি। রফিক আজাদকে কবি হিসেবে আমি শ্রদ্ধা করি, প্রচণ্ড আমুদে লোক, আড্ডা জমিয়ে রাখেন চমৎকার চমৎকার সব কথা বলে। আমি কারও থেকে দূরে সরতে চাইনি, ধীরে ধীরে বুঝেছি আমি সব কবি বা লেখকের কাছে কাঙ্খিত নই। জনপ্রিয়তা আর পুরষ্কার আমাকে অনেকটাই নিঃসঙ্গ করেছে। ফতোয়ার কারণে আমার নামটি বিদেশে জেনেছে বলে দেশের ভেতর আমি আরও বেশি নিঃসঙ্গ হয়েছি। মাঝারিরা বলছেন, ফতোয়াটির ব্যবস্থা নাকি আমি নিজেই করেছি, যেন নাম হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, আসলে কি ওঁরা আমাকে ঈর্ষা করেন! নাকি এ নিতান্তই আমার আত্মাভিমান! নিজেকে আমি এত বড় ভাবছি যে মনে হচ্ছে আমি যেন ঈর্ষার বস্তু হয়ে গেছি। অন্য কিছুও তো হতে পারে, সম্ভবত আমি ভাল লেখক নই, ভাল কবি নই, সে কারণেই আমার নামটি কালো কালিতে ঢেকে দিয়েছেন ওঁরা। ছোট লেখক যদি বড় পুরস্কার হাতিয়ে নিতে পারে, সন্দেহ হবে না কেন ওঁদের! ওঁদের চোখ দিয়েও নিজেকে দেখি আমি, যদি বাজারে গুঞ্জন শোনা যায় যে আমি পঁয়তাল্লিশ লক্ষ টাকা ঘুস নিয়েছি একটি বই লিখে, আর সেই টাকায় নিজের সুখের জন্য বাড়ি গাড়ি কিনেছি, তবে কেন ওঁরা কুঞ্চিত চোখে কুপিত দৃষ্টি ছুঁড়বেন না! আমাকে কুটিল, কূলটা, কুচরিত্র বলেই তো মনে হবে। আমাকে ঘৃণা না করার, ভাবি, কোনও কারণ নেই।
আমার ইশকুল বা কলেজ জীবনের কোনও বন্ধু বা বান্ধবীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। ঝুনু খালার মুখে শুনেছি, আমার ইশকুলের বান্ধবী সারা এখন ভিখারুন্নেসা ইশকুলের বাংলার শিক্ষিকা। শুনে আমি উত্তেজিত সারার সঙ্গে দেখা করার জন্য। সারা একদিন আসে আমার বাড়িতে। আমরা দুজন মুখোমুখি বসি। কথা হয়। কিন্তু সে কথায় প্রাণ নেই। এই সারার সঙ্গে ছোটবেলার কত মধুর দিন কেটেছে আমার, আজ সারার সঙ্গে কথা বলার মত কথা খুঁজে পাওয়া যায় না। আর বন্ধুরা কে কোথায় আছে জানতে চাওয়া, স্বামী কি করে, বাচ্চাদের বয়স কত এসবের পর আমরা দুজন চুপচাপ বসে থাকি। বিদ্যাময়ী ইশকুলের বান্ধবী পাপড়ি আমার শান্তিবাগের বাড়িতে একদিন এসেছিল, ওর সঙ্গেও কথা খুঁজে পাইনি বেশি। জীবন যাপনের পার্থক্য বড় বেশি দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। আমার কোনও স্বামী সন্তান নেই। সবাই এখন ঘর সংসার করছে। সবারই চাকরি বাকরি আছে। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত। এখন পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ওঠা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না, বিশেষ করে সে বান্ধবী যদি একা হয়। ভয় তো খানিকটা কাজ করেই, স্বামী যদি আবার প্রেমে পড়ে যায় বান্ধবীটির। তার চেয়ে বিবাহিতাদের বিবাহিতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা স্বস্তিকর। আমার ডাক্তার বন্ধু বা বান্ধবীরা এখন কে কোথায় আছে, জানি না। ঢাকা শহরে নিশ্চয়ই অনেকে আছে, কিন্তু কারও সঙ্গেই আর দেখা হয় না। নাসিমুল যখন মিটফোর্ডে কাজ করত, দেখা হয়েছে কদিন। ও জাপানে যাবার চেষ্টা করছিল তখন। সবাই কেমন দূরে চলে গেছে। অথচ সেই দিনগুলি মনে হয় এত কাছে, যেন হাত বাড়ালেই নাগাল পাওয়া যাবে। যেন বন্ধুরা আবার সব একসঙ্গে হব। কোথায়! দিন তো কেবল চলেই যাচ্ছে। আমরা তো পরস্পরকে কেবল হারিয়েই ফেলছি। তিন বছর আগে হঠাৎ একদিন বইমেলায় শাফিনাজ এসেছিল হন্তদন্ত হয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে, চেম্বার থেকে খানিকক্ষণের জন্য ছুটি নিয়ে ছুটে এসেছিল। বিদ্যাপ্রকাশের দোকানে ঢুকেই আমাকে বলল, কেমন আছ, তোমার জন্য চিন্তা হয়, সাবধানে থেকো কেবল এটুকুই বলার সময় ছিল ওর। রোগী বসে আছে, ফিরে যেতে হবে। শাফিনাজ, কী ঘনিষ্ঠই না ছিল আমার। ঢাকা শহরেই দুজন বাস করি, অথচ বছর চলে যায়, বয়স চলে যায়, দেখা হয় না। পিজি হাসপাতালে একবার শিপ্রার সঙ্গে গিয়েছিলাম, হালিদার সঙ্গে দেখা হয়েছে। খুব অল্প সময় কথা হয়েছে। হালিদা তখনও বিয়ে করেনি, বলেছে বিয়ে টিয়ে ও আর করছে না। এই একজনই বিয়ে না করা বান্ধবী আছে। শিপ্রা, খসরু একদিন জানালেন, রাজশাহী চলে গেছে। ডাক্তার বন্ধুদের সঙ্গে যদি কোনও বড় হাসপাতালে চাকরি করা যায়, কোনও না কোনও সূত্রে যোগাযোগ হয়ত হত। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বিচ্ছিত হয়ে গেলে সেই যোগাযোগটিও আর থাকে না। একদিন আমার এক ইশকুলের বান্ধবী এসেছিল শান্তিবাগের বাড়িতে, সে মিটফোর্ড হাসপাতালে নার্সের চাকরি করে। আমাকে হাসপাতালে প্রতিদিনই দেখেছে, কিন্তু লজ্জায় পরিচয় দিতে পারেনি। আমি ডাক্তার, সে নার্স, তাই নাকি তার লজ্জা হয়েছে পরিচয় দিতে। এত অন্যরকম হয়ে গেছে লাকি, সেই আগের গাল ফোলা মুখটি আর নেই, চোখ বসা, গাল বসা মেয়েটি যে সেই লাকি, পরিচয়ের পরও আমার চিনতে কষ্ট হয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি দূরে চলে গেছি, নাকি ওরা দূরে চলে গেছে! নাকি সময় আমাদের দূরে সরিয়েছে! নাকি জীবনই এমন, পুরোনো ফেলে নতুনের দিকে যেতে চায় কেবল! পুরোনো দিনের কথা জানালায় বসে ভাবতে ভাল লাগে, দিনগুলো আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। যখন কল্পনা করি সেই জীবনে ফেরার, তখন এই বয়সে সেই জীবনে যাওয়ার কল্পনা করি না, মনে মনে আসলে সেই বয়সী, সেই পুরোনো পরিবেশের মানুষটি আমি যাই সেই জীবনে, সেই পুরোনো মানুষটিকে পুরোনো জীবনে ফেরানো আর এখন পুরোনোকে নতুন জীবনের মধ্যিখানে সত্যিকার দাঁড় করানো দুটো দু জিনিস। মেলে না। অবকাশ আমার কত আপন, অথচ এখন অবকাশে গেলে বেশিক্ষণ কাটাতে ইচ্ছে করে না, কী যেন বড় বড় নেই নেই লাগে। কী নেই! আমার শৈশব কৈশোরটি আমার ভেতরে আর নেই! নাকি আগের মানুষগুলো আর আগের মত নেই! বদলে গেছে। সবকিছুই বদলে যাচ্ছে। স্বীকার করতেই হয় যে আজ যে দিন চলে যাচ্ছে, সে দিন চলে যাচ্ছেই। আগামীকালের দিনটি নতুন একটি দিন। আজ যা হারাচ্ছি, কাল তা ফিরে পাবো না। আমরা খুব দ্রুত ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছি, এত দ্রুত, যেন দৌড়োচ্ছি। আমরা বড় হয়ে যাচ্ছি, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, আমাদের সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, ভাবলে বুকের মধ্যে চিনচিন একটি ব্যথা হয়, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, জীবন এত ছোট কেন! কাকে বলব, সকলেই তো জানে জীবন খুব ছোট। সম্ভবত মিনু জানে না, মিনুর কাছে জীবন খুব দীর্ঘ বড় দীর্ঘ বলে মনে হয়, যেন ফুরোচ্ছে না। একটিই জীবন আমাদের, কেউ এটিকে হেলায় ফেলায় নষ্ট করে, কেউ এটিকে দুর্বিসহ বলে মনে করে, কারও কাছে জীবন বড় অমূল্য সম্পদ। এক আমার কাছেই জীবনকে মনে হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন, কখনও এটি সুন্দর, কখনও কুৎসিত, কখনও সয়, কখনও নয়, কখনও আবার এর রূপ রস গন্ধে এত বিভোর হই যে আঁকড়ে ধরি যেন কোনওদিন পালিয়ে না যায়।
ঢোলের বাজনা শুনছি। রাস্তায় জমজমাট পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রা। ছেলেরা ধুতি পরে ঢোল বাজাচ্ছে, মেয়েরা আটপৌরে শাড়ি পরে কলসি কাখে নাচছে। রঙিন কাগজে বানানো বিশাল বিশাল হাতি ঘোড়া বাঘ ভালুক নিয়ে হাঁটছে মানুষ। রূপকথার চরিত্রদের মুখোশ পরেছে অনেকে। ছায়ানট সকাল থেকে বসে গেছে রমনার বটমূলে। চারদিকে গানের উৎসব হচ্ছে। সমবেত কণ্ঠে বাঁধ ভেঙে দাও এর সুর, জীর্ণ পুরাতন ছূঁড়ে ফেলে নতুনকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। পুরো ঢাকার মানুষ জড়ো হয়েছে রমনায়, রমনার আশে পাশে। নকশি কাঁথা পেতে বসেছে ঘাসে, তালপাখায় বাতাস করছে। মুড়িমুড়কি খাচ্ছে। সোহরওয়ার্দি উদ্যানে ফকির আলমগীর গাইছেন মানুষের মুক্তির গান। আগে অর্ধেক রাত পর্যন্ত ফকির আলমগীরের মঞ্চ বানানোর কাজ দেখতাম, গানের আড্ডায় কেটে যেত পয়লা বৈশাখের আগের রাতটি। প্রতি পয়লা বৈশাখে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে আমিও ছিলাম। ভোর বেলা থেকে শুরু করে মধ্য রাত পর্যন্ত উৎসবে, আনন্দে। আমার তো বছরে দুটো দিনই আছে উৎসবে মাতার। একুশে ফেব্রুয়ারি আর পয়লা বৈশাখ। আমার ঈদ নেই, শবে বরাত নেই, শবে কদর নেই, ফাতেহা এ দোয়াজদহম, ফাতেহা এ ইয়াজদহম, মিলাদুন্নবি নেই। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে কোনও ধর্মীয় উৎসবে আমি জড়িত হই না। আমার কেবল ছিল বাংলা আর বাঙালির উৎসব। আজ সবারই অধিকার আছে, কেবল আমারই নেই উৎসবের একজন হওয়ার, মাঠে ময়দানে কোথাও গিয়ে গান শোনার অধিকার আমার নেই। রমনায় আজ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে সানজিদা খাতুনের ছায়ানট। মাঠে মাঠে আজ মেলা বসেছে। চারদিকে কুটিরশিল্পের মেলা, বাংলা বইয়ের মেলা, গানের মেলা, নৃত্যমেলা, উৎসব উৎসব গন্ধ ভেসে আসছে চারদিক থেকে। কেবল আমিই, আমিই একা ঘরে, জীর্ণ পুরাতন আমি, বসে আছি একা একা, নতুনকে বরণ করার অধিকার আমার নেই। বিষণ্নতা আমাকে বিবশ করে রাখে।
বিকেলে মা আমার ঘরে উঁকি দিয়ে ঠোঁট উল্টো বললেন, ‘এইবারের পয়লা বৈশাখের মেলা নাকি জমে নাই।’
‘কে কইল তোমারে?’
‘পাশের বাসার চুমকির মা কইল। গেছিল মেলায়। লোকই নাকি নাই।’
খানিক বাদেই মা প্রসন্ন মুখে আমার জন্য ভাজা-মুড়ি আর আদা-চা নিয়ে ঘরে ঢোকেন।
‘ছায়ানটের গান ত হইতাছে, কিছু কইছে?’ আমি মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, উৎসুক জানার জন্য।
মা আমার চোখের দিকে না তাকিয়ে ‘এই বিশ্রী গরমের মধ্যে গান শুনতে বাইরে কে যায়? ঘরে বইসা গান শুনাই ভাল’ বলে দ্রুত বেরিয়ে যান। মাকে কেমন অস্থির দেখায়। মনে হয় লুকোচ্ছেন কিছু। মা কি আমার মেলায় যেতে না পারার কষ্ট কমাতে মিথ্যে বলছেন! পাশের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে চুমকির মাকে ডেকে একবার আমার জানতে ইচ্ছে হয় মেলা সত্যিই জমেনি কি না। মার রেখে যাওয়া ভাজা মুড়ি চিবোতে চিবোতে চায়ে চুমুক দিয়ে মার চালিয়ে দেওয়া গান জ্ঞচারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারি, ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি….’ শুনতে শুনতে মনে মনে বলি, না থাক, মেলা হয়ত সত্যিই জমেনি।