মতিন বলল, নিশু, আমি একটা কবিতার লাইন বলব, তুমি বলবে কার লেখা। নিশু বিরক্ত গলায় বলল, কবিতা কবিতা খেলা খেলব না।
না খেললে নাই। আমি কবিতার লাইনটা বলি।
প্লিজ স্টপ।
If you can dream and not make dreams your master.
নিশু বলল, রুডইয়ার্ড কিপলিং।
তুমি কি নিশ্চিত?
হুঁ।
তারা দুজন রিকশায়। সকাল আটটা। কোর্ট শুরু হবে দশটায়। তাদের মামলা আজ উঠবে কি-না নিশ্চিত না। উঠার কথা আছে। যতবার মামলা হিয়ারিং-এর জন্যে উঠছে ততবারই উকিলকে তিনহাজার করে টাকা দিতে হচ্ছে। তাঁর ফি, মুহুরির ফি। এছাড়াও খরচ আছে। সারাক্ষণ একে তাকে পান খাওয়ার খরচ দিতে হচ্ছে।
মতিন বলল, নিশু! মামলা মামলা খেলাটা কি তোমার ভালো লাগছে?
নিশু বলল, না।
মতিন বলল, একটা কাজ করলে কেমন হয়? মামলার বিষয়টা মাথা থেকে দূর করে দাও। পড়াশোনা করতে চলে যাও।
নিশু বলল, রিকশা থামাতে বলো।
মতিন দেখল, নিশু কাঁদছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তার শরীর কাঁপছে। মতিন বলল, কী হয়েছে?
নিশু বলল, রিকশা থামাতে বলো।
মতিন রিকশা থামাল। সেও কৌতূহলী হয়ে তাকাচ্ছে। নিশু শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে শান্ত গলায় বলল, তুমি নেমে যাও।
মতিন বলল, কেন?
নিশু বলল, মামলা নিয়ে তুমি বিরক্ত হয়ে পড়েছ। ক্লান্ত এবং বিরক্ত। আমি তোমাকে মুক্তি দিচ্ছি। তোমাকে মামলা বিষয়ে আর কিছু করতে হবে না।
মতিন বলল, আমি নিজের কথা ভেবে কিছু বলি নি। তোমার কথা ভেবে বলেছি।
নিশু বলল, নামো রিকশা থেকে। নামো। আমার এই মামলায় কারোর সাহায্য লাগবে না।
কোর্টের এই ঝামেলা তুমি একা কী করে সামলাবে?
দেখি পারি কি-না।
নিশু, I am sorry. I apologize. অ্যা
পলজি অ্যাকসেপটেড। এখন রিকশা থেকে নামো।
নিশুর চোখের দৃষ্টি কঠিন, গলার স্বর কঠিন। মতিন রিকশা থেকে নেমে পড়ল।
নিশুর উকিলের নাম সোবাহান খন্দকার। ভদ্রলোক কুঁজো হয়ে হাঁটেন। সারাক্ষণ পান খান। কথা বলার সময় চোখ পিটপিট করেন। একসময় ভালো ক্রিমিন্যাল লইয়ার ছিলেন, এখন বাজার পড়ে গেছে।
সোবাহান খন্দকার নিশুকে বললেন, বারোটার দিকে মামলা উঠবে। টাকা এনেছেন?
নিশু বলল, টাকা তো কাল রাতে মতিন আপনাকে দিয়ে এসেছে।
সোবাহান খন্দকার বললেন, আমার টাকার কথা বলছি না। মামলা উঠবে। তার খরচ। মতিন সাহেব কোথায়? তাঁকে দরকার ছিল।
উনি আসতে পারেন নি। কী দরকার আমাকে বলুন।
টাকা লাগবে।
টাকা লাগবে সেটা তো একবার বলেছেন। কত টাকা লাগবে?
ভালো অ্যামাউন্টই লাগবে।
কেন ভালো অ্যামাউন্ট লাগবে বলুন?
আপনি মেয়েমানুষ, সবকিছু আপনার সঙ্গে ডিসকাস করা সম্ভব না।
নিশু বলল, মামলাটা আমার। এখন থেকে কোর্টে আমিই আসব। কথাবার্তা যা বলার আমার সঙ্গেই বলতে হবে। টাকা-পয়সার লেনদেন আমিই করব। কত দিতে হবে?
পাঁচ।
পাঁচ কি শ?
আরে না, হাজার।
এত টাকা কেন?
একটা কাগজের কপি বের করতে হবে। আপনার যে মেডিক্যাল অ্যাকজামিনেশন করা হয়েছে তার কপি।
কপি তো দেয়া আছে।
যেটা দেয়া আছে সেখানে কিছু সমস্যা আছে। আমাদের আরেকটা কপি লাগবে।
কী সমস্যা আমাকে বুঝিয়ে বলেন।
সোবাহান খন্দকার বিরক্ত হয়ে বললেন, এত কিছু আপনাকে বুঝাতে গেলে আমি আমার নিজের কাজটা কখন করব? বারোটার সময় মামলা উঠবে। এখন বাজে এগারোটা। আমার নিজের তো একটা প্রিপারেশন আছে। টাকাটা দিয়ে চুপ করে থাকেন। মামলা কোর্ট থেকে নামুক, যা বুঝবার তখন বুঝবেন।
নিশু বলল, এত টাকা তো সঙ্গে আনি নি।
কত এনেছেন?
তিন হাজার।
তিন হাজারই দিন। বাকি টাকাটা আমার পকেট থেকে দিয়ে দিচ্ছি। মতিন সাহেবকে দিয়ে বাকি দুই হাজার আজ সন্ধ্যায় আমার চেম্বারে পাঠিয়ে দিবেন। মামলায় রেজাল্ট পেতে হলে পয়সা খরচ করতে হবে।
মামলা উঠেছে। মামলার একনম্বর আসামিকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। সে তার নিজের বক্তব্য পাখি পড়ার মতো বলল।
প্রফেসর সাহেবের মেয়ে নিশু তার বাবার মৃত্যুর পর উচ্ছখল জীবনযাপন শুরু করে। তার ফ্ল্যাটে সন্ধ্যার পর নানান ধরনের পুরুষ মানুষের আনাগোনা। গান-বাজনা। উনি দরজা জানালা সন্ধ্যার পর সবসময় বন্ধ করে রাখেন।
একদিন আমি উনাকে বললাম, নিশু আপা, ভদ্র অঞ্চলে আপনি বাস করেন। আপনার পিতা ছিলেন একজন সম্মানীত শিক্ষক। আপনি এইসব কী শুরু করেছেন?
উনি আমার কথায় খুবই রেগে গেলেন। আমাকে দেখে নিবেন, পুলিশে দিবেন, হেনতেন নানান কথা। তাতে আমার একটু রাগ উঠে গেল। আমি খারাপভাবেই বললাম, ভদ্র পল্লীতে আপনি কীভাবে নারী ব্যবসা করেন আমি দেখে নেব।
এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। উনার বাড়ি থেকে রাত দুইটার সময় এক স্যুট-টাই পরা ভদ্রলোক বের হয়েছে। মুখ দিয়ে মদের গন্ধ। ঠিকমতো পা ফেলতে পারে না এমন অবস্থা। আমি আমার দুই বন্ধুসহ তাকে আটকালাম। মেজাজ খুবই খারাপ ছিল। চড় থাপ্পড় দিয়ে বললাম, তোর ঘরে মা-বোন নাই?
এই ঘটনার পরে নিশু আপা আমার কাছে এসে আপোসের প্রস্তাব দিল। আমাকে দুপুরে তার বাসায় খানা খেতে বলল।
আমি একা না গিয়ে আমার দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিলাম। আমরা খাওয়া দাওয়া করলাম। উনার জোরাজুরিতে সেক্স ও করলাম। উনি যে আমাদের তিনজনকে ফাঁসাবার জন্যে এই নাটক করেছেন–এইটা জানতাম না। এর বেশি আমার কিছু বলার নাই।
কোর্ট অ্যাডজর্নড হয়ে গেল। সোবাহান খন্দকার কপালের ঘাম মুছতে মুছতে নিশুকে বললেন, জেরা শুরু হলে তার অবস্থা কী হবে সে চিন্তাও করতে পারছে না। মোরব্বা বানিয়ে ফেলব।
নিশু বলল, পারবেন?
সোবাহান খন্দকার উচ্ছাসের হাসি দিয়ে হঠাৎ গলা নামিয়ে বললেন, আসামিপক্ষ থেকে একটা আপোসের প্রস্তাব আছে। বিবেচনা করবেন কি-না দেখেন।
নিশু অবাক হয়ে বলল, কিসের আপোস?
মামলায় এ পর্যন্ত আপনার যা খরচ হয়েছে আসামিপক্ষ সব খরচ দিয়ে দিবে, আপনারা মামলা তুলে নিবেন।
আপনার কাছে প্রস্তাব দিয়েছে?
জি। সিদ্ধান্ত আপনাদের। আমার কাজ সব কিছু জানানো।
আপনার কি ধারণা আমাদের আপোসে যাওয়া উচিত? মামলার অবস্থা কী।
অবস্থা ভালো। কনভিকশন হবেই, তারপরেও…
তারপরেও কী?
আরেক দিন কথা বলি। আমি খুবই টায়ার্ড! মতিন সাহেবকে দিয়ে দুই হাজার টাকা পাঠিয়ে দেবেন।
মতিন হাঁটতে হাঁটতে কোর্টভবন পর্যন্ত চলে এলো। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করল কোর্ট এলাকায়। কোর্ট কাচারি করা লোকজন মনে হয় ডাবের ভক্ত। চারদিকে কাটা ডাবের ছড়াছড়ি। সে বিশ টাকায় একটা ডাব কিনে খেল। স্ট্যাম্পের এক ভেন্ডরের পাশের টুলে কিছুক্ষণ বসে রইল। তার কাছে কেন জানি শান্তি শান্তি লাগছে। যদিও শান্তি শান্তি লাগার কারণ স্পষ্ট না। শান্তির কারণ কি এই যে, নিশুর ঝামেলা আর তাকে নিতে হচ্ছে না? দুএকদিন পরেই নিশুর রাগ পড়ে যাবে, তখন মতিন আগের মতো মামলা মোকাদ্দমা নিয়ে ছোটাছুটি করতে পারবে–এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই। নিশু একবার যেটা বলবে। সেটাই।
স্ট্যাম্পের ভেন্ডর মতিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কী কেইস?
মতিন বলল, রেপ কেইস।
আসামি আপনের কে হয়?
অতি দূরসম্পর্কের আত্মীয়। যখন আমরা মানুষ ছিলাম না, বাঁদর ছিলাম, তখন একই গাছের ডালে লাফালাফি করেছি।
আপনের কথা বুঝলাম না।
মতিন বলল, বাঁদর থেকে মানুষ হবার পর এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। বাদর হয়ে যখন আমরা কিচকিচ করতাম তখন একজন আরেকজনের কথা বুঝতাম। মানুষ হয়ে ভাষা শেখার পর কেউ কারো কথা বুঝি না।
স্ট্যাম্প ভেন্ডর বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে। মতিন উঠে পড়ল। হঠাৎ মনে হলো, তার যাবার কোনো জায়গা নেই। যাদের যাবার কোনো জায়গা নেই তারা। কোথায় যায়? নৌকায় করে বুড়িগঙ্গায় কিছুক্ষণ হাওয়া খেলে কেমন হয়? বুড়িগঙ্গা তেমন দূরেও না।
ঘণ্টায় পঞ্চাশ টাকা হিসেবে মতিন একটা ছইওয়ালা নৌকা ভাড়া করে ফেলল। নৌকার মাঝি বুড়ো। ধবধবে সাদা দাড়ি। বাবড়ি চুল। চেহারায় কোথায় যেন রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ ভাব আছে। অনায়াসে কল্পনা করা যায় বুড়ো রবীন্দ্রনাথ তার সোনার তরী নিয়ে বুড়িগঙ্গায় ভেসে বেড়াচ্ছেন।
মতিন বলল, বুড়ো মিয়া, আপনার নাম কী?
কুদ্দুস।
আপনি নৌকা নিয়ে আশেপাশেই সামান্য ঘোরাঘুরি করবেন।
আর কেউ আছে আপনের সাথে? না-কি আপনি একলা?
আমি একলা।
অনেকেই মেয়েছেলে নিয়া নৌকায় উঠে। নৌকার পর্দা ফালায়া রঙ ঢঙ করে, এইজন্যে জিগাইলাম।
আপনের নৌকায় পর্দা আছে?
জি আছে।
দুই দিকেই পর্দা আছে। নৌকা ছাড়ব?
ছাড়েন।
নৌকা বুড়িগঙ্গার মাঝামাঝি আসতেই মাঝি বলল, আর কিছু লাগব?
মতিন অবাক হয়ে বলল, আর কিছু লাগব মানে কী?
বিয়ার আছে। টাইগার বিয়ার। দুইশ টেকা কইরা কৌটা। রাখতে হয়। অনেকেই চায়।
আর কী আছে?
পুরিয়া আছে। পঞ্চাশ টেকারটাও আছে, আবার একশ টেকারও আছে। সুই নাই।
ফেনসিডিল নিশ্চয়ই আছে?
আমার কাছে নাই। চাইলে আইন্যা দিতে পারব।
আপনি কখনো খেয়েছেন?
তওবা! আমি কেন খাব?
নিজে খাবেন না, অন্যকে খাওয়াবেন।
বুড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কেউ কাউরে কিছু খাওয়ায় না। প্রত্যেকে তার খানা নিজে খায়।
মতিন বলল, বালিশ আছে আপনের কাছে?
বালিশ দিয়া কী করবেন?
শুয়ে ঘুমাব। অনেক দিন পানির উপর ঘুমানো হয় না।
বুড়ো পাটাতনের নিচ থেকে বালিশ চাদর বের করে দিল। বালিশ চাদর দুটোই পরিষ্কার।
বুড়ো বলল, আপনের কিছুই লাগব না?
মতিন বলল, না।
একটা বিয়ার খাইয়া শুইতেন, আরামের ঘুম হইত। বিয়ার হইল ঘুমের ওষুধ। ঠাণ্ডা ছিল। বরফের বালতিতে রাখা।
মতিন বলল, এমনিতেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ঘুমের ওষুধ লাগবে। কুদ্স ভাই শুনেন, ঘুমিয়ে পড়লে জাগাবেন না। আমার পরিকল্পনা একটা লম্বা ঘুম দেয়।
মতিনের ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। নৌকা প্রবল দুলছে। শোঁ শোঁ বাতাস, মুষলধারে বৃষ্টি। নৌকা বুড়িগঙ্গার অন্যপাশে থেমে আছে। মাঝি কুদ্দুস ছইয়ের ভেতর বসা। সে কাঁপছে। মতিনকে উঠে বসতে দেখে সে বলল, এমন এক ঘুম আপনে দিছেন যার হিসাব নাই। একবার ভাবলাম লোকটার কি মৃত্যু হয়ে গেছে? দিনের অবস্থা দেখছেন? তুফান ছাড়ছে।
মতিন বলল, চা খেতে পারলে হতো।
কুদ্দুস বলল, চা নাই। বিয়ার আছে। বিয়ার দেই?
মতিন বলল, বিয়ার আরেক দিন এসে খাব। নৌকায় কতক্ষণ আছি বলেন তো?
সাড়ে চাইর ঘণ্টা। হেই পারে যাইতে লাগবে এক ঘণ্টা। পাঁচ ঘণ্টায় আপনে আমারে দিবেন আড়াই শ। দিনের যে অবস্থা পঞ্চাশ টেকা বখশিস ধইরা তিনশ টাকা মিল কইরা দিয়েন।
আচ্ছা। চলেন রওনা দেই।
কী পাগলের কথা কন! বাতাস কেমন ছাড়ছে দেখেন না! বাতাস কমুক। ভাইজান করেন কী?
আমি একজন কবি।
আপনের দেশের বাড়ি কোনখানে?
উজবেকিস্তান। পাহাড়ি অঞ্চল।
আপনেরে দেইখা মনে হয় বাঙালি।
মানুষ দেখে কি কিছু বুঝা যায় বুড়ো মিয়া? মানুষ দেখে কিছু বুঝা যায় না।
এইটা সত্য কথাই বলছেন, মানুষ দেইখা কিছু বুঝার উপায় নাই।
বাতাসের জোর আরো বেড়েছে। নৌকা টালমাটাল করছে। মতিন বলল, বুড়ো মিয়া, নৌকা ডুবে যাবে না তো?
কুদ্দুস চিন্তিত গলায় বলল, গতিক তো সুবিধার দেখি না।
নৌকার দুলুনির সঙ্গে মিলিয়ে কবিতা তৈরি করা যায় না?
নদ্দিউ নতিম সাহেব এই অবস্থায় কী করতেন? কবিতা তৈরির চেষ্টা নিশ্চয়ই করতেন।
দুলছে হাওয়া
দুলছে নদী
এখন যদি
তলিয়ে যায় জলে
অপূর্ব কৌশলে…
নৌকা এখন খাবি খাওয়ার মতো করছে। ছইয়ের এক অংশ খুলে গেছে। কুদ্দুস বলল, ভাইজান, শক্ত কইরা ধরেন, ছই উইড়া গেলে নৌকা ডুবব।
ছই উড়ে গেল না, কিন্তু নৌকা পানিতে কাত হয়ে ডুবে গেল। কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে মতিন ডাঙ্গায় উঠল। কুদ্দুস বলল, দুই হাত দিয়া মাথা চাইপা ধরেন। শিলাবৃষ্টি হইতেছে।
অনেকক্ষণ ধরেই কলিংবেল বাজছে। বৃষ্টি এবং বাতাসের শব্দে কলিংবেলের রিনঝিন ঢাকা পড়ে গেছে। কলিংবেলের শব্দটাকে বৃষ্টির শব্দের অংশ বলে মনে হচ্ছে। তারপরেও কী মনে করে মৃন্ময়ী দরজা খুলল।
মতিন বলল, আপনি কি আমাকে চিনেছেন? আমার নাম মতিন।
মৃন্ময়ী বলল, আপনার এই অবস্থা কেন?
মতিন বলল, বুড়িগঙ্গায় নৌকাডুবি। সাঁতরে উঠেছি। সাঁতারটা শেখা না থাকলে আজ আমার খবর ছিল।
হাত মনে হয় কেটেছে। রক্ত পড়ছে। আসুন ভেতরে আসুন।
মতিন ভেতরে ঢুকল। মৃন্ময়ী বলল, বাবার একসেট কাপড় যদি দেই, আপনি পরবেন?
পরব।
সরাসরি বাথরুমে চলে যান। আমাদের গিজার ফিজার নেই। পানি গরম করে দিচ্ছি। সাবান ডলে ভালোমতো গোসল করুন! বাথরুমে নতুন সাবান আছে।
আমার গরম পানি লাগবে না।
লাগবে। আপনি শীতে থরথর করে কাঁপছেন। বাথরুমে ঢোকার আগে কি এককাপ গরম চা খাবেন? চায়ের পানি গরম আছে। আমি এক্ষুনি দিতে পারব।
দিন।
বড় একটা কাপ ভর্তি চা এনে মতিনের হাতে দিতে দিতে মৃন্ময়ী বলল, রাত কটা বাজে জানেন?
না।
এগারোটা দশ। রাতের খাবার নিশ্চয়ই খান নি?
না।
আমি খেয়ে নিয়েছি, আপনাকে একা খেতে হবে। আমার ধারণা একা ভাত খেয়ে আপনার অভ্যাস আছে।
জি অভ্যাস আছে। বাড়িতে লোকজন নেই?
আছে। আমার ছোটখালা আছেন। আমার এক মামাতো ভাই আছে। তারা শুয়ে পড়েছে। আপনার অস্বস্তি বোধ করার কোনো কারণ নেই। আপনি যে কোনো একদিন যে আসবেন তা আমি যেমন জানি অন্যরাও জানে।
তাহলে তো ভালোই।
আপনি বাবার অফিসে গিয়ে যেসব কাণ্ডকারখানা করেছেন, বাবা সব গল্পই আমার সঙ্গে করেছেন।
আমি তেমন কোনো কাণ্ডকারখানা করি নি।
করেছেন। বাবাকে বই উৎসর্গ করে এমন সব কথা লিখেছেন যে, তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন।
উনি কাঁদেন নি।
বাবা কাঁদলে তার চোখে পানি আসে না। তাঁর গলা খসখসে হয়ে যায়। আপনি এত বড় লেখক, কিন্তু আপনার Observation দুর্বল।
আমি বড় লেখক?
না, আপনি না। নদ্দিউ নতিম।
মতিন খেতে বসেছে। মৃন্ময়ী হাসিমুখে তার সামনে বসে আছে। মতিন বলল, আমি মনে হয় বিরাট এক ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি।
কিছুটা তো ফেলেছেনই। হঠাৎ যদি ছোটখালার ঘুম ভাঙে, তিনি এই দৃশ্য দেখলে খাবি খাবেন।
মতিন বলল, হঠাৎ গভীর রাতে এই বাড়িতে উপস্থিত হলাম কেন জিজ্ঞেস করলেন না?
আপনি মানুষকে চমকে দিতে পছন্দ করেন এইজন্যেই কাজটা করেছেন।
মতিন বলল, ভুল বলেছেন। অনেকদিন আগে আপনার বাবা আমাকে তার মেয়ের জন্মদিনে আসার জন্যে দাওয়াত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, একসঙ্গে রাতে খাওয়া-দাওয়া করবেন। সিমের বিচি দিয়ে গরুর মাংস রান্না হবে। আজ সেই দিন। আজ আপনার জন্মদিন না?
মৃন্ময়ী হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
মতিন তাকিয়ে আছে। নিজেকে সামলে নিতে মৃন্ময়ীর কতক্ষণ লাগে তা তার দেখার ইচ্ছা। কেউ কেউ মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলায়। যেমন–নিশু। আবার কেউ কেউ আছে একবার কাঁদতে শুরু করলে কাঁদতেই থাকে। যেমন–তৌহিদা। এই বিষয়ে কি গিনিজ বুকে রেকর্ডের ব্যবস্থা আছে? থাকলে তৌহিদা নিজের জায়গা করে নিতে পারত।
মৃন্ময়ী নিশুর মতোই দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, সরি। আপনার কথা চট করে মনের ভেতরে গিয়ে লাগল। আপনাকে যে বাবা নিমন্ত্রণ করেছিলেন সেটা আমাকে বলেছিলেন। সিমের বিচি দিয়ে গরুর মাংস রাঁধতেও বলেছিলেন।
কই আজ তো সিমের বিচি দিয়ে মাংস রান্না হয় নি!
মৃন্ময়ী চোখ মুছতে মুছতে বলল, এই রান্নাটা বাবার খুব পছন্দের। আমি ঠিক করেছি যতদিন বেঁচে থাকব এই জিনিস খাব না।
আমি হলে উল্টোটা করতাম, উনাকে মনে করার জন্যেই বেশি বেশি খেতাম।
একেক মানুষ একেক রকম। কেউ মতিন উদ্দিন আবার কেউ নদ্দিউ নতিম। ভালো কথা, বাবা আপনার বই পড়েছেন। অল্প কয়েক পৃষ্ঠাই বাকি ছিল।
কিছু কি বলেছেন?
বলেছেন, তাঁর হয়ে আমি যেন আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেই। আপনি খাওয়া শেষ করুন, আমি ঠিক বাবার মতো আপনার মাথায় হাত রাখব।
মতিনের মাথায় হাত রেখে মৃন্ময়ী আবারো ফুঁপিয়ে উঠল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমার মনটা স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। একটু পর পর কাঁদি। আপনি কি আমার মনটা ঠিক করে দিতে পারবেন?
মতিন বলল, আমি পারব না। আমার এক বন্ধু আছে। জঙ্গলে থাকে, সে পারবে। যাবেন তার কাছে?
আপনি বললে যাব। আপনি কি যেতে বলছেন?
হ্যাঁ।