আজ একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছে।
হোসেন সাহেবের কাছে এক রোগী এসে উপস্থিত। সাফারি গায়ে লম্বা-চওড়া এক জন মানুষ। দরজা খুলতেই জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তার সাহেব কি আছেন? হোসেন সাহেব নিজেই দরজা খুলেছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, কোন ডাক্তার?
ডঃ হোসেন, হোমিওপ্যাথ। হোসেন সাহেবের বিস্ময়ের সীমা রইল না। কয়েক মিনিট বুঝতেই পারলেন না, কী করবেন কী বলবেন। শেষ পর্যন্ত রোগী এসে পড়েছে! রোগীদের সঙ্গে ডাক্তাররা কীভাবে কথা বলে, কে জানে? খুব বেশি খাতির করতে নেই বোধহয়। তাতে রোগী মনে করতে পারে ডাক্তারটা কিছু জানে না। আবার খুব গম্ভীর হয়ে থাকলে পরের বার আসবে না।
জ্বি ভাই, জ্বি। আমিই ডঃ হোসেন। বসুন, আরাম করে বসুন। চায়ের কথা বলে আসি।
না না, চা লাগবে না।
লাগবে। অবশ্যই লাগবে।
অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে তিনি চায়ের কথা বলতে গেলেন। ফিরে এলেন হোমিওপ্যাথির বাক্স নিয়ে। স্টেথিসকোপ একটা কেনা দরকার। থাৰ্মেমিটারটা নষ্ট। টুনি ভেঙেছে। এইসব যন্ত্রপাতি এখন দরকার। প্রেসার মাপুর ঐ জিনিসও কিনতে হবে।
অসুখটা কী, ভাই বলুন।
আমার কিছু না। আমার স্ত্রীর গলায় মাছের কাঁটা বিধেছে। সে বলল, হোমিওপ্যাথিতে নাকি এর ওষুধ আছে। আপনার সাইনবোর্ড দেখলাম। ভাবলাম
ভালো করেছেন, খুব ভালো করেছেন। এক্ষুণি, ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। কোনো অসুবিধা নেই। মাছের কাঁটা পালাবার পথ পাবে না। কী মাছ?
কৈ মাছ।
ও আচ্ছা, কৈ মাছ। ছোট কৈ না বড়ো কৈ?
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, এসবও কি ওষুধ দিতে লাগে!
হ্যাঁ, লাগে। হোমিওপ্যাথি খুবই জটিল চিকিৎসা। মনে হয় সোজা। সোজা মোটেই না।
ভদ্রলোক ওষুধ নিয়ে যাবার সময় ওষুধের দাম এবং ভিজিট বাবদ দুটি চকচকে পাঁচ টাকার নোট দিয়ে গেলেন। বিস্ময়ের উপর বিস্ময়। হোসেন সাহেব হড়বড় করে বললেন, গলার কাঁটাটা গেল। কিনা একটু খবর দিয়ে যাবেন। না গেলে কড়া ডোজের আরেকটা ওষুধ দেব।
হোসেন সাহেব লক্ষ করলেন, জীবনের প্রথম বেতন পেয়ে যেমন আনন্দ হয়েছিল, আজ তার চেয়েও অনেক বেশি আনন্দ হচ্ছে। চেঁচিয়ে সবাইকে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হল, বাসায় কেউ নেই। বড়ো বৌমা অফিসে, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। শাহানা গেছে তার কোনো বান্ধবীর বাড়ি। ছোট বৌমা এবং রফিকও নেই। হোসেন সাহেব নোট দুটি হাতে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন।
মনোয়ারার মেজাজ। আজ অন্য দিনের চেয়েও খারাপ। দাঁতের ব্যথা শুরু হয়েছে। রান্না করতে গিয়ে জেনেছেন, ঘরে লবণ নেই। রহিমার মাকে লবণ আনতে পাঠিয়ে তিনি রানাঘরে বসে আছেন। হোসেন সাহেবকে ঢুকতে দেখে চট করে জ্বলে উঠলেন।
এখানে কী চাও?
না, কিছু চাই না।
যাও, রান্নাঘর থেকে যাও। পুরুষমানুষকে রান্নাঘরে দেখলেই আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়।
হোসেন সাহেব ক্ষীণস্বরে বললেন, মাথায় রক্ত তো তোমার উঠেই আছে, নতুন করে আর কী উঠবে। বলেই তিনি অপেক্ষা করলেন না, অত্যন্ত দ্রুত বসার ঘরে চলে এলেন। এ-রকম একটা সুসংবাদ কাউকে দিতে না-পারার কস্টে তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। অবশ্য বাড়িওয়ালার বাসা থেকে বৌমার অফিসে টেলিফোন করা যায়। সেটাই বোধহয় সবচে নিরাপদ।
বীণা মেয়েটি বড়ো ভালো। দেখতে পেয়েই বলল, টেলিফোন করতে এসেছেন, তাই না চাচা?
হ্যাঁ, কী করে বুঝলে?
আপনি যখন লজ্জা—লজ্জা মুখে আসেন, তখনই বুঝতে পারি।
বীণা হাসতে লাগল। হোসেন সাহেব গলা নিচু করে বললেন, আমার এখন একটা টেলিফোন নিতে হবে। রোগী-টোগী আসছে। ওরা খোঁজখবর করে।
কিসের রোগী?
হোসেন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, হোমিওপ্যাথি করছি তো! জোন না তুমি? সাইন বোর্ড দেখ নি–এম. হোসেন! গলিটায় ঢুকতেই সাইনবোর্ড। নারকেল গাছে লাগানো।
টেলিফোনে নীলুকে পাওয়া গেল। নীলু উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, কোনো খারাপ খবর নাকি বাবা?
না, না, খবর সব ভালো। এমনি টেলিফোন করলাম। তুমি ভালো তে মা?
জ্বি, ভালো।
কাজের চাপ খুব বেশি নাকি?
না, খুব বেশি না।
আসার পথে একটা থামোমিটার নিয়ে এসে তো। থামোমিটার ছাড়া বড্ড অসুবিধা হচ্ছে। রোগীপত্র আসতে শুরু করেছে। আজ এক জন এসে কুড়ি টাকা ভিজিট দিল।
কুড়ি টাকা ভিজিট, বলেন কি বাবা!
না, মানে, কুড়ি টাকা দিতে চেয়েছিল, আমি দশ টাকা রাখলাম। এরচে বেশি রাখলে জুলুম হয়ে যায়, কী বল মা?
হ্যাঁ, তা তো হয়ই।
ডাক্তার হয়েছি বলে তো রোগীর চামড়া খুলে নিতে পারি না। কী বল মা?
জ্বি, তা তো ঠিকই।
আর শোন মা, ঐ সাইনবোর্ডটা বদলে একটা বড়ো সাইনবোর্ড করাতে হবে। এত ছোট অনেকের চোখে পড়ে না। বীণা তো দেখেই নি।
হ্যাঁ, তা তো করাতেই হবে।
হোসেন সাহেব প্ৰায় পনের মিনিট কথা বললেন। বীণা এর মধ্যে চা এবং জেলি-মাখানো টেস্ট বিসকিট নিয়ে এসেছে। চা খেতে-খেতে বীণার সঙ্গেও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কথা বললেন। হোমিওপ্যাথি জিনিসটা যে অসম্ভব জটিল, সেটা জলের মতো বুঝিয়ে দিলেন। পাওয়ার ২০ এবং পাওয়ার ২০০-এর পার্থক্যটা কী, তাও বললেন। তাঁর আজ বড়ো আনন্দ হচ্ছে। এই আনন্দ পৃথিবীর সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারলে ভালো হত। তাৰ্থকরা যাচ্ছে না। হাতের কাছে যে কজনকে পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরকেই আপাতত বলা যাক।
তিনি সারা দুপুর ভাবলেন, প্রথম রোজগারের টাকাটা দিয়ে কী করবেন। সবাইকেই একটা কিছু কিনে দিতে পারলে ভালো হত। সেটা বোধহয় সম্ভব নয়, তবু বিকেলে একবার নিউ মার্কেটে গিয়ে দেখা যেতে পারে। তিনি সাধারণত দুপুরে খানিকটা ঘুমান। আজমানসিক উত্তেজনায় ঘুমুতেও পারলেন না। শুয়ে—শুয়ে বিকাল পর্যন্ত হোমিওপ্যাথির বইয়ে লক্ষণ-বিচার চ্যাপ্টারটা দু বার পড়লেন। সন্ধ্যাবেলা নিউ মার্কেট থেকে সবার জন্য একটা করে কাঠ পেনসিল কিনে আনলেন।
মনোয়ারা তিক্ত গলায় বললেন, পেনসিল দিয়ে আমি কী করব?
লিখবো। আর কি করবে?
লেখালেখির কোন কাজটা আমি করি?
বেশ তো, লিখতে না চাও কান চুলকাবে।
মনোয়ারা রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন ঠিক তাঁর মতো একটি পেনসিল রহিমার মা ও পেয়েছে। সে বটিতে তার পেনসিলটি চাঁচতে চেষ্টা করছে।
হোসেন সাহেব অনেক রাত পর্যন্ত বসার ঘরে বসে রইলেন। ঐ ভদ্রলোক যদি খবর দিতে আসেন–সেটা শোনা দরকার। ওষুধ দিয়েই কর্তব্য শেষ এ-রকম ডাক্তার তিনি হতে চান না।
শাহানা একমনে কী-একটা বই পড়ছে। এত মনোযোগ দিয়ে যখন পড়ছে নিশ্চয়ই গল্পের বই। মাঝে মাঝে আবার চোখ মুছছে। চোখ মোছার দৃশ্যগুলি দেখতে হোসেন সাহেবের বড়ো ভালো লাগছে। এত সুন্দর হয়েছে মেয়েটা। মনেই হয় না। তাঁর মেয়ে, যেন অচিন দেশের কোনো এক রাজকন্যা পথ ভুলে এ বাড়িতে এসে পড়েছে। টাঙ্গাইলের সাধারণ একটি সূতি শাড়ি পরে বসে আছে তাঁর সামনে। আবার যেন কিছুক্ষণ পরই চলে যাবে।
ও শাহানা!
কি বাবা?
এত মন দিয়ে কী পড়ছিস? গল্পের বই?
হুঁ।
বই পড়তে পড়তে কেউ এত কাঁদে? গল্পটা কী রে?
শাহানা বই থেকে মুখ না তুলেই বলল, একটা মেয়ে একই সঙ্গে দুটি ছেলেকে পছন্দ করে। যখন যার কাছে যায়, তাকেই ভালো লাগে। এই নিয়ে গল্প।
হোসেন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ঐ কী অসম্ভব কথা! একই সঙ্গে দুটি ছেলেকে পছন্দ করবে। কীভাবে? আজেবাজে একটা কিছু লিখলেই হল?
শাহানা কপাল কুঁচকে বলল, বিরক্ত করো না তো বাবা, পড়ছি দেখছি କn1।।
হোসেন সাহেব চুপ করে গেলেন।
দেয়াল-ঘড়িতে বারটার ঘণ্টা পড়ল, তার মানে এখন বাজছে এগারটা। ঘড়িতে একটা ঘণ্টা কম পড়ে। রাত যখন ১টা হয় তখন আবার ঘণ্টা পড়ে বারটা।
খামোকা বসে আছ কেন বাবা, শুয়ে পড় না।
বসি খানিকক্ষণ। তোকে তো বিরক্ত করছি না।
কতক্ষণ বসে থাকবে?
তোর পড়া শেষ হোক, তারপর যাব।
আমি তো বাবা বই শেষ না করে উঠব না।
না উঠলে না। উঠবি, আমি কি উঠতে বলছি?
বাইরে ঝিঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। এবার বর্ষা অনেক দেরিতে শুরু হল। আজ আষাঢ়ের মাঝামাঝি, বর্ষণ হচ্ছে এই প্রথম।
শাহানা।
কি?
তোর বিয়ে যেন কবে, বিশে আষাঢ় না একুশে?
জানি না বাবা।
সে কি! নিজের বিয়ের তারিখ নিজে জনিস না?
তুমিও তো নিজের মেয়ের বিয়ের তারিখ জান না। আর একটি কথাও বলবে না। বাবা, প্লিজ!
আচ্ছা, বলব না। কত পাতা বাকি?
এই তো আবার কথা বলছি।
আর বলব না। জানালাটা বন্ধ করে দে, বৃষ্টির ছাঁট আসছে।
তুমি বন্ধ করে দাও না কেন? তুমি তো আর কিছু করছ না, বসেই আছ।
হোসেন সাহেব উঠে জানালা বন্ধ করলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, সোফায় পিঠ বাঁকা করে বসে থাকা এই অসম্ভব রূপবতী মেয়েটি এক দিন বুড়ি হয়ে যাবে। চুলে পাক ধরবে। চোখের কালো রঙ হবে ঘোলাটে। কী প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতা! তাঁর মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল। তিনি দেখলেন, শাহানা আবার চোখ মুছছে।
ও শাহানা!
কি।
শব্দ করে পড় না। আমিও শুনি কী লিখেছে।
তোমার ভালো লাগবে না। বাবা। এটা আমাদের গল্প। তোমাদের না। ঠিক ঠিক, খুব ঠিক। সময় আলাদা করে রেখেছে তাদের দু জনকে। চেষ্টা করেও হয়তো একে অন্যকে ছুঁতে পারবে না। ঢালা বর্ষণ হচ্ছে বাইরে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বড়ো সৌমার ঘরে টুনি জেগে উঠেছে। বাথরুম করবে। হয়তো। শোবার আগে ভালোমতো বাথরুম করিয়ে নিল রাত—দুপুরে ঝামেলা করতে হয় না।
নীলু টুনিকে কোলে করে বের হল। অবাক হয়ে বলল, রাতি-দুপুরে কী করছেন। বাবা?
কিছু না, এই বসে আছি। বৃষ্টির নমুনোটা দেখেছি মা? ভাসিয়ে দেবে। তুমি কি মা একটু কষ্ট করে–
হোসেন সাহেব কথা শেষ করলেন না। নীলু, শান্ত স্বরে বলল, দিচ্ছি। চায়ের সঙ্গে আর কিছু দেব?
এক স্লাইস রুটি দিতে পার যদি থাকে; মাখন দিও না। এই বয়সে মাখনটা সহ্য হয় না।
নীলু মুহূর্তের মধ্যেই চা-রুটি নিয়ে এল। মুখে একটি বিরক্তির রেখাও পড়ল না। ঠোঁট বাকল না। পরের ঘরের একটি মেয়ে কত যত্বই না করল! এই ঋণ তো কখনো শোধ হবে না। পবের বাড়ির একটি মেয়ের কাছে আকাশপ্রমাণ ঋণ রেখে তাঁকে মরতে হবে।
বৌমা, একটু বস না। এই দু মিনিট।
নীলু বসল। হোসেন সাহেব হাসিমুখে বলতে লাগলেন, গ্রামের বাড়িতে প্রথম বর্ষণে কত মাছ মেরেছি। প্রথম বর্ষণে কী হয় জান? মাছগুলি সব মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়। পানি ছেড়ে শুকনোয় উঠে আসে, স্রোতের উল্টো দিকে সাঁতরায়। কত কী যে করে!
শাহানা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আবার বকবক শুরু করলে বাবা!
হোসেন সাহেব চুপ করে গেলেন। বৃষ্টিতে ঢাকা শহর আজ হয়তো ড়ুবে যাবে; এখন আবার বাতাস দিচ্ছে।
এক রাতের বৃষ্টিতে বাড়ির সামনে হাঁটুপানি জমে গেছে। আরেকটু হলে ঘরে পানি ঢুকত। শাহানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পানি দেখছে। নীলু অফিসে যাবার জন্য তৈরি হয়ে বাইরে এসে আঁৎকে উঠল। ভীত গলায় বলল, বন্যার পানি নাকি শাহানা? সমুদ্রের মতো লাগছে।
শাহানা হাসিমুখে বলল, আজ আর অফিসে যেতে পারছি না। শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত যদি তুলতে পার, তাহলে অবশ্যি ভিন্ন কথা। কিংবা একটা রিকশা যদি বারান্দা পর্যন্ত আনা যায়।
কে আনবে রিকশা?
সেটা একটা সমস্যা। রফিককে বলা যাবে না। সে এখনো ঘুমুচ্ছে না। ঘুমুলেও পানি ভেঙে রিকশা আনার পাত্র সে নয়।
শাহানা বলল, তোমার কি যাওয়াটা খুবই দরকার ভাবী?
হুঁ।
আনিস ভাইকে বলি, একটা রিকশা এনে দিক।
যাও প্লিজ। দেখি সে আছে কিনা।
সে নেই। বাজার করতে গিয়েছে। এক ঘণ্টার উপর হয়েছে, এসে পড়বে। এলেই রিকশা আনতে পাঠাব।
থ্যাংকস। শাহানা।
নীলু ভেতরে ঢুকে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভারি একটা বাজারের ব্যাগ হাতে আনিসকে আসতে দেখা গেল। লাউয়ের মাথা, পুই শাক বের হয়ে আছে। অন্য হাতে একটা হাঁস। এত বাজার-টাজার আনিসের নিশ্চয়ই নয়। বীণাদের বাজার। আনিসের প্যান্ট ভাঁজ করে হাঁটু পর্যন্ত তোলা। কী কুৎসিতই না দেখাচ্ছে!
আনিস হাসিমুখে বলল, কি ব্যাপার শাহানা, তুমি এখনো বারান্দায়?
তাতে আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে?
আরে না, আমার অসুবিধা কি? আমার বরং সুবিধাই হল। তোমার মুখ দেখে যাত্রা করেছি বলে কুড়ি টাকায় হাঁস পেয়ে গেলাম। এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে এই হাঁসের দাম হত। কমসে কম চল্লিশ।
কেন। শুধু শুধু কথা বলেন? কে আপনার এইসব কথা শুনতে চায়? আপনি চট করে একটা রিকশা ডেকে দিন তো আনিস ভাই। ভাবী অফিসে যাবে। আর প্যান্টটা নামান, কি যে বিশ্ৰী দেখাচ্ছে!
আনিস অপ্রস্তুত হয়ে হাসল। শাহানা বলল, খামোেকা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাজার দিয়ে রিকশা নিয়ে আসুন?
আনিস বাজারের থলি নামিয়ে রেখে প্যান্টের ভাঁজ খুলতে—খুলতে বলল, দুদিন পর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এখনো তুমি এত রেগে রেগে কথা বল! পরে অসুবিধা হবে।
কী অসুবিধা হবে?
তোমার নিজেরই খারাপ লাগবে। মনে হবে, লোকটা তো ভালোই ছিল, কেন যে এত খারাপ ব্যবহার করেছি!
শাহানা একটা বিরক্তির ভঙ্গি করে ঘরে ঢুকে গেল। আবার যদি বের হয় এই আশায় আনিস বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। শাহানা এল না। আনিসকে আবার প্যান্ট ওঠাতে হল। রিকশা আনতে যেতে হবে। তারপর যাবে পুরানো ঢাকায়-আজ শরাফ আলি ভাইকে বাড়িতে পাওয়ার সম্ভাবনা। গতরাতের ঝুম বৃষ্টিতে নিশ্চয়ই প্রাণভরে বোতল টেনেছে। এবং যদি টেনে থাকে, তাহলে এখনো ঘুমে। দড়ির একটা কৌশল যদি আদায় করা যায়।
গলির সামনে এসে আনিসকে থমকে দাঁড়াতে হল! নর্দমা উপছে উঠেছে। পূতিগন্ধময় পানি ঢুকছে গলিতে। নাড়ি উল্টে আসার মতো দুৰ্গন্ধ। সুস্থ মাথায় কেউ এই পানিতে পা ড়ুবিয়ে গলিতে ঢুকবে না। আনিসের অবশ্যি ফিরে যেতে ইচ্ছু করছে না। আজ গেলেই শরাফ আলিকে পাওয়া যাবে। বড়ো কিছু পেতে হলে কষ্ট করতেই হয়। সে প্রায় চোখ বন্ধ করে গলিতে ঢুকে পড়ল।
পানবিড়ির দোকানের ঝাঁপ খোলা। বুড়ো লোকটি কৌতূহলী হয়ে আনিসকে দেখছে। চোখে চোখ পড়তেই বলল, শরাফ আলির খোঁজে যান?
জ্বি।
আইজ পাইবেন। বাড়িত আছে। এটু আগে পাঁচটা স্টার সিগ্রেট কিনল।
আনিস বলল, আমাকে এক প্যাকেট ভালো সিগারেট দিন! সিগারেট দেখলে খুশি হবে।
বুড়ো বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল। যার অর্থ, খুশি হবার লোক শরাফ আলি নয়।
দরজা খুলল রেশমা। ঝলমলে একটা শাড়ি গাফে পেঁচানে। মুখটি করুণ ও বিষন্ন। ভারি চোখ-মনে হচ্ছে এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে। অনিস ভয়ে-ভয়ে বলল, শরাফ ভাই আছেন?
হুঁ, আছেন।
মেয়েটি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরে ঢুকতে দেবার ইচ্ছা নেই হয়তো। আনিস বলল, ভেতরে এসে বসব? রেশমা দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল।
পা ধোওয়া দরকার, একটু পানি দেবেন?
পা ধোওয়ার দরকার নাই, এইটা মসজিদ না।
আনিস ঘরে ঢুকল। মেয়েটি কটু গলায় বলল, দুই দিন পরে পরে ফ্যান আসেন? কি চান আপনে?
আনিসের মন খারাপ হয়ে গেল। এত স্নিগ্ধ মুখ মেয়েটির, অথচ কী কঠিন গলায় কথা বলছে।
কী, কথা কন না কেন? ভদ্রলোকের ছেইলা।
ম্যাজিক শিখতে আসি। পামিং শিখি।
আসল ম্যাজিক আমার কাছে আছে, শিখবেন?
মেয়েটির চোখে-মুখে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা হাত দরজার কপাটে। অন্য হাত কোমরে। যেন প্রচণ্ড একটা ঝগড়ার প্রস্তুতি। অথচ মুখ এখন হাসি-হাসি।
কি, দেখবেন ম্যাজিক?
বলতে-বলতে মেয়েটি এক হাতে শাড়ি ঘোমটার মতো মাথায় দিয়ে নরম গলায় বলল, এই দেখেন, এখন আমি ভদ্রলোকের মাইয়া। দেখলেন?
আনিস কিছু বোঝবার আগেই রেশমা বুক থেকে শাড়ি সরিয়ে ফেলল। ব্লাউজ বা ব্রা কিছুই নেই। সাদা শঙ্খের মতো মেয়েটির সুগঠিত বুক ঝলমল করছে। আনিসের গা ঝিমঝিম করতে লাগল। রেশমা শান্ত গলায় বলল, একটু আগে ছিলাম ভাল মাইনসের ঝি, এখন হইলাম, নটি বেটি। এরে কয় ম্যাজিক। আপনেরে একটা কথা কই–আপনে ভালো মাইনষের পুলা, খারাপ জায়গায় ঘুরাঘুরি করেন ক্যান? এইখানের বাতাসে দোষ আছে। খারাপ বাতাস শইলে লাগবে। যান, বাড়িত যান!
আনিস নিঃশব্দে বের হয়ে এল। আকাশে আবার ঘন হয়ে মেঘ করেছে। পথে নামতেই বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়তে লাগল। পানওয়ালা হাসিমুখে বলল, দেখা হইছে। শরাফ ভাইয়ের সাথে?
আনিসা জবাব দিল না।